রবিন হুড – ১০

দশ

এই ঘটনার পর কয়েক সপ্তাহ ধরে শেরিফ মহাশয় রবিন হুডের দলকে ধরবার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারলেন না। রবিন হুডের কথা ক্রমে রাজার কানে গিয়ে পৌঁছল। রাজার কাছ থেকে শেরিফের ওপর কড়া হুকুম এল, ‘যে ভাবেই হোক রবিন হুডের দলকে ধরতেই হবে। তা না হলে, তোমাকে বরখাস্ত করব।’ শেরিফ তো মহা মুশকিলে পড়লেন। কতরকমের ফন্দি আঁটলেন, কিন্তু ফল কিছুই হল না। শেষে দ্বিগুণ পুরস্কার ঘোষণা করে দিলেন, যদি কেউ লোভে পড়ে কোনওভাবে সফল হয়।

গাই-অব-জিসবোর্ন নামে রাজার সৈন্য-দলে একজন নাইট এই পুরস্কারের কথা শুনতে পেলেন। এই স্যার গাই খুব প্রসিদ্ধ তিরন্দাজ ও অসি-যোদ্ধা কিন্তু তাঁর মনটা খুব নীচ ছিল। তিনি রাজার অনুমতি নিলেন এবং একটুকরো কাগজে হুকুম লিখিয়ে নিয়ে নটিংহাম শহরের শেরিফের কাছে এসে বললেন,–’শেরিফ মশাই! আমি সেই প্ৰসিদ্ধ রবিন হুডকে ধরতে এসেছি—আপনাকে আমায় একটু সাহায্য করতে হবে।

শেরিফ বললেন,–’নিশ্চয়ই করব, স্যার গাই! রাজার হুকুম না নিয়ে এলেও আমি খুব খুশি হয়ে সাহায্য করতাম। এখন বলুন দেখি আপনার ক’জন লোকের দরকার।

স্যার গাই বললেন,—’ ‘আজ্ঞে! লোকজনের আমার কিছু দরকার নেই। রবিন হুডকে ধরা অনেক লোকের কাজ নয়। আমি একাই চেষ্টা করব। আপনি এক কাজ করবেন, কতকগুলো লোককে বার্নস ডেলে প্রস্তুত রাখবেন, আমার এই রূপোর শিঙাটির আওয়াজ শুনলেই যেন তারা গিয়ে হাজির হয়।’

শেরিফ বললেন, ‘বেশ, তাই হবে।’

তারপর স্যার গাই ছদ্মবেশ ধরে তাঁর কাজে বের হয়ে গেলেন।

এদিকে উইল স্কারলেট আর লিটল জন ঠিক সেই দিনই দলের লোকদের পোশাক কিনতে বার্নস ডেলে এসেছিল। শহরের কাছে এসে তারা ভাবল—দুজন যদি একসঙ্গে ধরা পড়ি? তার চেয়ে বরং একজন বাইরে থাকি, একজন শহরে ঢুকি।’ এরকম পরামর্শ করে উইল শহরে প্রবেশ করল, জন বাইরে পাহাড়ের ওপর অপেক্ষা করতে লাগল।

খানিকক্ষণ অপেক্ষা করবার পরই জন দেখল, উইল স্কারলেট ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে শহরের বাইরে এসেছে, আর পঞ্চাশ-ষাট জন লোক নিয়ে শেরিফ তার পিছন-পিছন তাড়া করেছেন। খানা, গর্ত, ঝোপ, সব ডিঙিয়ে উইল ছুটছে। শেরিফের লোকেরা হোঁচট খেয়ে গর্তে পড়ল, কারও-বা পা ভেঙে গেল, কারও বা ঘাড় মটকে গেল, আবার কেউ-কেউ ক্লান্ত হয়ে রাস্তার ধারে বসে হাঁপাতে লাগল।

পাহাড়ের ওপর থেকে এই ব্যাপার দেখে প্রথমে তো লিটল জন হেসেই খুন। তারপর তার মনে ভয় হল—’আচ্ছা, উইল যদি হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।’ ঠিক এই সময় জন দেখল, শেরিফের একজন লোক উইলের খুব কাছে এসে পড়েছে। লোকটিকে দেখে লিটল জন চিনতে পারল। শেরিফের দলে তার মতো কেউ-ই ছুটতে পারত না। স্কারলেটের বিপদ দেখে, জন লোকটিকে লক্ষ করে একটি তির ছুড়ল। কী কুক্ষণেই বেচারি উইলকে তাড়া করেছিল। বুকে তির লেগে সে যে উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ল, আর উঠল না।

হঠাৎ এই ব্যাপার দেখে শেরিফের লোকেরা ভয়ে খানিকক্ষণ আর এগোল না। কিন্তু ওপরের দিকে চেয়ে যখন দেখল, শত্রুপক্ষ মোটে একজন এবং সে লিটল জন, তখন তারা উৎসাহে চিৎকার করে লিটল জনকেই তাড়া করল। এদিকে উইল স্কারলেট পাহাড় পার হয়ে অদৃশ্য হয়ে পড়েছে। লিটল জনও যদি তখন চলে যায়, তা হলে কোনও গোলই হয় না। কিন্তু তার দুর্বুদ্ধি, সে মনে করল, দাঁড়াও, আর এক বেটাকে শেষ না করে যাচ্ছি না’–এই বলে যেই তির ছুড়তে যাবে অমনি মটাৎ করে তার ধনুকটি দুই ভাগ হয়ে ভেঙে গেল। এদিকে শেরিফের কতকগুলো লোক একেবারে তার সমনে এসে হাজির হলে, লিটল জনের বজ্রমুষ্টি খেয়ে দেখতে-দেখতে জনা দশেক লোক মাটিতে পড়ে গেল।

তখন শেরিফের কয়েকজন তিরন্দাজ একসঙ্গে লিটল জনকে লক্ষ করেছে দেখে, শেরিফ বললেন, ‘আর কেন বাপু! লিটল জনই হও আর গ্রিনলিফই হও, এবার ধরা পড়েছ।’

জন বলল,–’বাঃ, শেরিফ মহাশয়! আপনার কথাগুলো বড় মিষ্টি লাগছে। তা কী আর করব, আমার বরাত নেহাত মন্দ দেখছি। তবে আর দেরি কেন, ধরুন আমাকে।’

তখন শেরিফের লোকেরা লিটল জনকে ধরে দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে বাঁধল! শেরিফ মহা আহ্লাদে বললেন,—’ ‘ব্যাটা! তুমি রূপোর প্লেটগুলো চুরি করেছিলে, এবারে তার শোধটা পাবে এখন। আজ‍ই তোমাকে বার্নস ডেলের পাহাড়ের ওপর ফাঁসি দেব।’

জন বলল,–’ফাঁসি দাও আর যাই করো, বেশি বড়াই কোরো না। ভগবানের ইচ্ছা হলে এখনও তোমাকে ফাঁকি দিতে পারি।’

সে কথা আর কে গ্রাহ্য করে? লিটল জনকে নিয়ে সকলে তাড়াতাড়ি বার্নস ডেলে চলল। মনে ভয়ও আছে, পাছে দস্যু দল হঠাৎ এসে জনকে উদ্ধার করে নেয়।

বার্নস ডেলে পৌঁছেই ফাঁসিকাঠ খাড়া করে তাতে নতুন দড়ি লাগানো হল। শেরিফ লিটল জনকে বললেন,–’আর দ্যাখো কী বাছাধন? যাও, এখন ফাঁসিকাঠে চড়ো।’

লিটল জনের উদ্ধারের আর কোনও আশাই নেই। রবিন হুডের শিঙাটা তার কাছে থাকলে, তবু না হয় একবার ফুঁকে দেখত। দড়ির ফাঁস গলায় পরিয়ে লোকজন তৈরি। শেরিফ হুকুম করলেই দড়ি টানবে।

তখন শেরিফ জিজ্ঞাসা করলেন,–’সব ঠিক? তবে তৈরি হও এক–দুই,’–তিন বলবার আগেই দূর থেকে শিঙার অস্পষ্ট আওয়াজ তাঁর কানে এসে পৌঁছল। আর অমনই তিনি বলে উঠলেন, ‘এ কী! শিঙার আওয়াজ যে শুনলাম! এ স্যার গাই-এর শিঙার আওয়াজ! তিনি যে বলে গিয়েছিলেন, শিঙার ফুঁ শুনলে তখনই লোকজন নিয়ে যেতে! নিশ্চয়ই তিনি রবিন হুডকে পাকড়াও করেছেন।’

একজন লোক বলল,—’হুজুর! বেয়াদপি মাপ করবেন। স্যার গাই যদি রবিন হুডকে ধরে থাকেন, তাহলে তো মজাই হয়েছে। এ লোকটার ফাঁসি এখন রেখে দিন, সে সর্দার বেটাকেও এনে দুজনকে এক সঙ্গেই ঝোলানো যাবে।’

শেরিফ বললেন,–’বেশ কথা বলেছ! তাহলে এক কাজ করো—বেটাকে ফাঁসিকাঠের সঙ্গে বেঁধে রেখে, চলো আমরা সে বেটাকেও গিয়ে নিয়ে আসি।’

পাঠক পাঠিকা! চলো এখন আমরা লিটল জন ও শেরিফের কথা রেখে, একবার রবিন হুডের কী হল দেখে আসি।

লিটল জন যে দিন ধরা পড়ে, ঠিক সেই দিন সকাল বেলা রবিন হুড জনের সঙ্গে বনের পথে চলতে চলতে দেখতে পেলেন, কিম্ভূতকিমাকার চেহারার একটা তিরন্দাজ আসছে। তখন একই সময়ে দুজনেরই ইচ্ছা, লোকটার তিরের হাত কেমন একবার পরীক্ষা করে দেখেন। রবিন হুড কিন্তু কিছুতেই লিটল জনকে সেটা করতে দেবেন না! তিনি নিজেই পরীক্ষা করবেন। কাজেই লিটল জন একটু বিরক্ত হল, এবং সেই রাগেই সে উইল স্কারলেটের সঙ্গে বার্নস ডেলে গিয়েছিল।

লিটল জন বিরক্ত হয়ে চলে গেলে পর, রবিন হুড সেই লোকটির দিকে এগোলেন। লোকটিকে দেখে হঠাৎ রবিনের মনে হল যেন তার তিনটি পা। কিন্তু আরও কাছে গিয়ে দেখলেন, যে, তা নয়—মাথা, চুল এবং লেজ সমেতে একটা আস্ত ঘোড়ার চামড়া দিয়ে লোকটি তার সমস্ত গা ঢেকেছে—ঘোড়ার মাথাটায় বেশ হেলমেট হয়েছে এবং লেজটি পিছনের দিকে ঝুলে থাকায় হঠাৎ তিন পা বলেই মনে হয়।

লোকটির কাছে এসে রবিন হুড বললেন,–’নমস্কার দাদা! তোমার ধনুকটি দেখলে মনে হয়, তুমি একজন পাকা তিরন্দাজ।’

লোকটি বলল,—’হ্যাঁ ভাই! তির ছোঁড়ার অভ্যাসটা আমার আছে বটে, কিন্তু আমি সে কথা ভাবছি না। পথটা হারিয়ে ফেলেছি, আবার কী করে খুঁজে বার করি তাই ভাবছি।’

লোকটির কথা শুনে রবিনের হাসি পেল। তিনি মনে মনে ভাবলেন,—’রাস্তা তো নয়, বুদ্ধিটাই বোধ করি হারিয়ে ফেলেছে।’ প্রকাশ্যে বললেন,–’আচ্ছা ভাই! আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছি। এখন বলো দেখি, এখানে কেন এসেছ?’

লোকটি বলল,—’তুমি কে হে বাপু, যে তোমাকে কাজের হিসাব দেব?’

রবিন বললেন,–’আরে চটে যাও কেন দাদা? বুঝতে পারছ না, আমি হচ্ছি রাজার বনের পাহারাওয়ালা, বিদঘুটে চেহরার কোনও লোক এসে রাজার হরিণ না মারে, সেটা দেখাই হচ্ছে আমার কাজ।’

লোকটি বলল,–’তা ভাই, আমার চেহারাটা খারাপ হতে পারে কিন্তু তা বলে মনে কোরো না যে, আমি খামোখা এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি! আচ্ছা, তুমি বলছ তুমি রাজার লোক, আমিও রাজার কাছেই এসেছি। রবিন হুড বলে একজন ডাকাত আছে, তাকেই আমি খুঁজছি, তুমি কি তার দলের লোক?’

রবিন বললেন,–’না দাদা! ডাকাত টাকাতের আমি ধার ধারি না। রবিন হুডকে দিয়ে তোমার কী দরকার?’

লোকটি বলল,—’তা যাই হোক না কেন, তবে কিনা সেই দস্যুটার সঙ্গে আমাকে দেখা করতেই হবে।

রবিন হুড বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা কী। তখন তিনি বললেন,–’এসো ভাই তিরন্দাজ। আমার সঙ্গে এসো, আর একটু বেলা হলে তোমাকে আমি রবিন হুডের আড্ডা দেখিয়ে দিতে পারব। ততক্ষণ চলো, কে বেশি ভালো তির চালাতে পারে তারই একবার পরীক্ষা হোক।’ এই বলে রবিন উইলো গাছের একটা সরু ডাল প্রায় ষাট গজ দূরে মাটিতে পুঁতে বললেন, ‘আচ্ছা ওই ডালটাতে তির লাগাও দেখি! তুমিই আগে মারো।’

লোকটি বলল, ‘না ভাই, আমি আগে নয়। তুমিই আগে মারো।’

তখন রবিন হুড ধনুকে গুণ পরিয়ে তির ছুড়লেন—প্রায় এক ইঞ্চির জন্য তাঁর তির ডালে লাগল না। তারপর অপরিচিত লোকটি খুব হুঁশিয়ার হয়েই তির চালাল, কিন্তু ডাল থেকে প্রায় তিন আঙুল দূর দিয়ে চলে গেল।

দ্বিতীয় বার অপরিচিত লোকটিরই আগে পালা। এবারে তার তির, ডালের ডগায় ছোট একটি মালা ছিল, তার মধ্য দিয়ে চলে গেল। তারপর রবিন মারলেন। তাঁর তির সেই ডালটিকে ঠিক মাঝখানে কেটে দু-ভাগ করে ফেলল।

এই দেখে লোকটি বলল, —শাব্বাশ ভাই! তোমার খাসা হাত এমন ওস্তাদি আমি কখনও দেখিনি, তোমার হাত বোধ করি রবিন হুডের চেয়েও পরিষ্কার। আচ্ছা, তোমার নামটি কী ভাই?’

রবিন বললেন,–’তোমার নামটি কী আগে বলো, তারপর আমার নাম বলব।’

লোকটি বলল,—’আমার নাম গাই-অব-জিসবোর্ন। রবিন হুডকে ধরব বলে প্রতিজ্ঞা করে বেরিয়েছি।’

রবিন হুড বললেন,–’কী! তোমার নাম গাই-অব-জিসবোর্ন? তাই তো, তোমার কথা যেন শুনেছি বলে মনে হয়। আচ্ছা, তুমিই না লোকদের ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে পয়সা রোজগার করো?’

স্যার গাই বললেন,–’হাঁ তা করি বটে, তবে কি না সকলের বেলা নয়। শুধু রবিন হুডের মতো ডাকাতের বেলা।

রবিন বললেন,—’বাবা! তুমি দেখছি রবিন হুডের ওপর বড় চটা। কেন বাপু, সে তোমার কী করেছে?’

স্যার গাই বললেন,–’কিছু করবার কথা হচ্ছে না, সে ব্যাটা যে ভীষণ ডাকাত!

রবিন বললেন,–’হলই বা ডাকাত! সে তো আর যার তার ওপর জুলুম করে না! বড় লোকের টাকাকড়ি নিয়ে, যারা গরিব দুঃখী, খেতে পায় না, তাদের দেয়। তার অপরাধের মধ্যে দেখছি, সে যখন খেতে পায় না, তখন মাঝে-মাঝে রাজার এক আধটা হরিণ মারে

স্যার গাই বললেন,–’আরে থামো বাপু! তুমি দেখছি রবিন হুডের বড় ভক্ত। এক একবার মনে হয় তুমি রবিন হুডেরই লোক।’ রবিন বললেন,–’আগেই তো বলেছি আমি তা নই। যাক বাজে কথা, এখন বলো দেখি, রবিন হুডকে ধরবার মতলবটা কী ঠাওরেছ?’ স্যার গাই বললেন,—’মতলবটা ঠাওরেছি এই, আমার হাতে এই যে রূপোর শিঙাটি রয়েছে, যদি রবিনকে ধরতে পারি, তবে এটি ফুঁকব আর তখনই দলবল নিয়ে শেরিফ এসে হাজির হবেন। এখন তুমি যদি রবিন হুডকে দেখিয়ে দিতে পারো, তাহলে আমার বকশিশের অর্ধেকটা তোমাকে দেব।’

রবিন বললেন,–’বটে! তুমি মনে করছ টাকার লোভে আমি একটা লোককে ফাঁসির জন্য ধরিয়ে দেব? অবশ্য রবিন হুডকে দেখিয়ে দেব তা ঠিক, কিন্তু আমার এই তলোয়ারের গুঁতোয় যা বকশিশ আদায় করতে পারি, শুধু তারই জন্য তাকে দেখাব। এই আমিই হচ্ছি সারউড বনের সেই দস্যু রবিন হুড।’

‘তবে রে ব্যাটা, এই নাও বকশিশ!’ হঠাৎ এই বলে বিদ্যুদ্বেগে স্যার গাই রবিন হুডকে আক্রমণ করল।

রবিন মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না, হঠাৎ অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হয়ে একটু মুশকিলে পড়লেন। গাইয়ের আঘাতগুলো নানারকমে বিফল করে দিয়ে বললেন,–’তুমি তো ভারী ছোট লোক হে! সামান্য ভদ্রতাটুকুও জানো না? না বলে কয়ে হঠাৎ তলোয়ার চালাতে আরম্ভ করলে?’

কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি! স্যার গাই ক্ষান্ত হল না। কাজেই দুজনে ভীষণ তলোয়ারযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। দুর্ভাগ্যবশত হঠাৎ হোঁচট খেয়ে রবিন হুড পড়ে গেলেন। ভালো যোদ্ধা মাত্রেই এমন সময়ে তলোয়ার নামিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। কিন্তু স্যার গাই পতিত রবিন হুডকে তাঁর বাঁ-পায়ে আঘাত করল। ক্ষণকালের জন্য রবিন হুড মনে-মনে ঈশ্বর স্মরণ করলেন। আবার তখনই চট করে লাফিয়ে উঠে, তরবারি দিয়ে স্যার গাইকে এমন আঘাত করলেন, যে গোঁ-গোঁ শব্দ করে সে মাটিতে পড়ে গেল—আর উঠল না!

স্যার গাইকে বধ করে রবিন হুড়ের মনে বড়ই দুঃখ হল। একেবারে মেরে ফেলার ইচ্ছা তাঁর মোটেই ছিল না—কিন্তু কী আর করবেন, স্যার গাই-এর নিজের দোষেই তার এই শাস্তি!

তখন তাঁর নিজের আঘাতের দিকে রবিন হুডের নজর পড়ল; দেখলেন, আঘাত তেমন গুরুতর নয়। সামান্য চেষ্টাতেই রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল—ক্ষতস্থানটি রুমাল দিয়ে বেঁধে ফেললেন। তারপর স্যার গাইয়ের মৃতদেহ টেনে একটা ঝোপের ভিতর নিয়ে গিয়ে, তার সেই ঘোড়ার চামড়া নিজের গায়ে পরলেন এবং নিজের জামা স্যার গাইকে পরিয়ে, তলোয়ার দিয়ে তার মুখটাকে এমনভাবে বিকৃত করে দিলেন যেন দেখলে ভুল হয় যে, সে–রবিন হুড। স্যার গাইয়ের মুখের আকৃতি অনেকটা রবিন হুডের মতোই ছিল।

তারপর ঘোড়ার চামড়াটা টেনে নিজের মুখটাকে কতকটা ঢেকে, সেই রূপোর শিঙাটি বাজালেন। এই শিঙার আওয়াজই বার্নস ডেলে লিটল জনের প্রাণ বাঁচাল। সে কথা আমরা এর আগেই জানতে পেরেছি। শেরিফ মহাশয় এই শব্দ শুনেই, ফাঁসি থামিয়ে দিয়ে লোকজন নিয়ে বার হয়েছিলেন।

রবিন হুড শিঙা বাজাবার মিনিট কুড়ি পরেই শেরিফ বাছা বাছা জনা কুড়ি তিরন্দাজ নিয়ে এসে হাজির। রবিন হুডকে স্যার গাই মনে করে তিনি জিগ্যেস করলেন,–স্যার গাই! আপনি কি শিঙা বাজিয়ে আমাদের সংকেত করেছেন? ‘

রবিন বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই শিঙা বাজিয়েছি।’

তখন শেরিফ ব্যস্ত হয়ে জিগ্যেস করলেন,—’ ‘স্যার গাই! খবর কী শিগগির বলুন?’

রবিন বললেন,–’খবর আর কী! রবিন হুডের সঙ্গে আমার লড়াই হয়—আর ওই দেখুন ঝোপের ভেতর রবিন হুড পড়ে আছে। শেরিফ উৎসাহে বলে উঠলেন—’বাহবা, ক্যা বাৎ ক্যা বাৎ! এমন চমৎকার খবর এ জন্মেও শুনিনি। ব্যাটাকে যদি জীবন্ত ধরতে পারতেন, তাহলে দুটো ফাঁসি একসঙ্গেই দিতাম।’

রবিন বললেন,—’দুটো ফাঁসি! আর একটা কার ফাঁসি, শেরিফ মশাই?’

শেরিফ বললেন,–’আ রে স্যার গাই! বলব কী, আজ আমাদের বরাত খুলে গিয়েছে। আপনি চলে এলে পর, আর একটু হলেই একটা ব্যাটা দস্যুকে ধরেছিলাম, তার নাম বোধ করি উইল স্কারলেট। সে ব্যাটা তো পালিয়ে গেল। কিন্তু তার সঙ্গে যে ছিল, তাকে ধরে আমরা ফাঁসি দিচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময়ে আপনার শিঙার আওয়াজ শোনা গেল।’

রবিন বললেন,–’লোকটা কে? কাকে ধরে ফাঁসি দিচ্ছিলেন?’

শেরিফ বললেন,–’লোকটা আর কেউ নয়, সারউড বনের সব চেয়ে ওস্তাদ দস্যু, রবিন হুড়ের পরেই সে! তার নাম লিটল জন।’

‘লিটল জন’ নাম শুনেই রবিন হুড চমকে উঠলেন। মনে-মনে ভাবতে লাগলেন, তাহলে তো দেখছি ঠিক সময়েই শিঙা বাজিয়েছিলাম!

সকলে মিলে তখন লিটল জনকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য বার্নস ডেলে চলল। রবিন হুডের মন চিন্তায় পূর্ণ, কী করে লিটল জনকে উদ্ধার করবেন। কিন্তু বাইরে চিন্তার ভাব যাতে প্রকাশ না পায়, তাই শেরিফের সঙ্গে খুব গল্প জুড়ে দিলেন। ক্রমে তাঁর শহরের দরজার কাছে হাজির হলেন। রবিন হুড, শেরিফকে বললেন,–শেরিফ মশাই! আমার একটা কথা রাখবেন কি?

শেরিফ বললেন,—’কী কথা স্যার গাই? আপনার কথা রাখব না তো কার কথা রাখব —বলুন।’

রবিন বললেন,–’কথাটা হচ্ছে কী জানেন, আমি বকশিশ কিছু চাই না। তবে কি না, সর্দারকে যখন বধ করেছি, তখন তার চেলাটাকেও আমার হাতে দিন, আমি তাকে বধ করি। লোকে বলবে, —স্যার গাই খুব বাহাদুর বটে! দস্যুর সর্দার দুটোকে এক দিনেই শেষ করেছেন।’ শেরিফ বললেন,–’তা বেশ তো। আপনি যা চাইবেন, তাই হবে। তবে কিনা পুরস্কারটাও আপনার পাওয়া উচিত—রবিন হুডকে মারা তো আর সহজ কাজ নয়!’

এরকম কথা বলতে-বলতে শহরে এসে ছদ্মবেশী রবিন লিটল জনের কাছে গেলেন। লিটল জন তখন ফাঁসিকাঠেই বাঁধা ছিল। স্যার গাই-এর বেশধারী রবিন হুড শেরিফের লোকদেরকে বললেন, ‘তোমরা একটু সরে দাঁড়াও দেখি! আমি এই ডাকাতটাকে একটু ভগবানের নাম শুনিয়ে দিই।’

এই কথা বলে তিনি নীচু হয়ে লিটল জনের বাঁধন দড়ি কেটে দিলেন। স্যার গাই-এর তিরধনুক বুদ্ধি করে সঙ্গেই এনেছিলেন, সেই তিরধনুক লিটল জনের হাতে দিয়ে, তার কানে ফিসফিস করে বলে দিলেন——জন! আমি রবিন হুড।’ লিটল জন কিন্তু এর আগেই তাঁকে চিনতে পেরেছিল, এবং এটাও বুঝেছিল যে, আজ আর তার ফাঁসিটা হল না।

রবিন হুড তখন শিঙাটা বাজিয়ে, দুজনে মিলে শেরিফের লোকদের ওপর তির চালাতে আরম্ভ করে দিলেন। শেরিফের লোকেরা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, অস্ত্র চালাবারও খেয়াল হল না। এর ওপর আবার নতুন বিপদ! হঠাৎ অন্য এক দিক থেকে শেরিফের লোকেদের ওপর ঝাঁকে-ঝাঁকে তির এসে পড়তে লাগল! শেরিফ যখন ছদ্মবেশধারী রবিনকে নিয়ে শহরে ঢুকেছিলেন, তখন থেকে উইল স্টাটলি এবং উইল স্কারলেট, লিটল জনকে উদ্ধার করবার জন্য উপায় বার করছিল, এ তাদের দলের তির। শেরিফের লোকজন তখন ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলাল। রবিন হুড ও লিটল জন দলের সঙ্গে মিলে সারউড বনে চলে এলেন।


© 2024 পুরনো বই