রবিন হুড – ১

এক

দ্বিতীয় হেনরি যখন ইংল্যান্ডের রাজা, তখন ইংল্যান্ডের উত্তরে শুধু রাজাদের শিকারের জন্যে কতগুলি বন ছিল। অন্য কেউ বিনা হুকুমে এই বনে শিকার করলে তার প্রাণদণ্ড হত। বনে রক্ষকদের যিনি সর্দার থাকতেন, তাঁর ক্ষমতা কম ছিল না। তিনি জেলার প্রধান রাজকর্মচারী শেরিফ এবং প্রধান পাদরি বিশপের সঙ্গে ক্ষমতায় সমান ছিলেন।

নটিংহাম শহরের কাছে সারউড বন এবং বার্নসডেল শহরের কাছে বার্নসডেল বন, এই দুটি বনই সকলের চেয়ে বড়। হিউ ফিটজুথ নামক এক ব্যক্তি স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র রবার্টকে নিয়ে সেখানে বাস করতেন। তখন তিনিই এই বনের কর্তা ছিলেন।

১১৬০ খ্রিস্টাব্দে লকলি শহরে রবার্ট জন্মগ্রহণ করে। লকলি শহরে জন্ম হওয়ায়, অনেক সময় লোকে তাকে লকলি বলে ডাকত। রবের শরীরে যথেষ্ট শক্তি ছিল। সে দেখতেও বেশ সুশ্রী ছিল। রব ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে বনে-বনে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসত। ক্রমে একটু বড় হলে, সে তিরধনুক তৈরি করে, বনের রক্ষকদের মতো তির চালাতে আরম্ভ করল, এবং অতি অল্প দিনের মধ্যে বেশ নিপুণ তিরন্দাজ হয়ে উঠল।

রব্ শীতকালে বাবার কাছে বসে কুখ্যাত দস্যুদলের গল্প শুনতে বড় ভালোবাসত। আবার বর্ষাকালে সে ঘরে বসে তার ধনুকের জন্য সুন্দর তির প্রস্তুত করে তাতে পালক বাঁধত।

রবের মায়ের স্বভাব বড়ই কোমল ছিল। তিনি ভাবতেন রব বড় হয়ে রাজার দরবারে চাকরি করবে কিংবা পাদরি হবে। তাই ছেলেবেলা থেকে তার তিরধনুকের প্রতি এত আকর্ষণ দেখে তাঁর মনে কষ্ট হত। তিনি রবকে ভদ্রঘরের ছেলের উপযুক্ত সমস্ত শিক্ষাই দিয়েছিলেন, কিন্তু রবের কাছ তিরধনুকেরই বেশি আদর ছিল।

নটিংহাম শহরের খুব কাছে গ্যামওয়েল লজে রবের কাকা থাকতেন। গ্যামওয়েল লজের কাছেই আরল অব হান্টিংডনের প্রাসাদ। রবের খুড়তুতো ভাই উইল এবং আরল অব হান্টিংডনের একমাত্র কন্যা ম্যারিয়ান, এই দুইজন রবের খেলার সাথী ছিল। কিন্তু এই আরলের সঙ্গে রবের বাবার বনিবনা ছিল না। শুনতে পাওয়া যায়, ম্যারিয়ানের বাবা নাকি রাজার সাহায্যে রবের বাবাকে তাড়িয়ে, আরল অব হান্টিংডন হয়েছিলেন। ম্যারিয়ান কিংবা রব এই শত্রুতা গ্রাহ্য করত না সবসময় এক সঙ্গে খেলা না করলে তাদের চলত না।

নটিংহামের শেরিফ এবং হারফোর্ডের বিশপ এই দুইজন রবের বাবার শত্রু ছিলেন। আরল শেরিফ ও বিশপ তিন জনে পরামর্শ করে

রবের বাবার নামে রাজার কানে অনেক কথা লাগালেন, এবং তার ফলে রবের বাবার কাজটি গেল।

তখন শীতকাল। রবের বয়স সবেমাত্র উনিশ বছর। হঠাৎ একদিন সন্ধের পর, একজন নতুন লোক সর্দার হয়ে এসে তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে শেরিফ মহাশয়ও রবের বাবাকে মিছিমিছি গ্রেপ্তার করে নটিংহামের জেলখানায় বন্দি করলেন। রব ও তার মা সে রাত্রে জেলখানাতেই থাকবার হুকুম পেলেন বটে, কিন্তু পরদিন সকালে খুব অভদ্রভাবে তাকে ও তার মাকে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিল। তখন তাঁরা রবের কাকা স্কোয়ার জর্জের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলেন।

রবের মা’র শরীর আগে থেকে অসুস্থ থাকায় এই শীতের কষ্ট তাঁর সহ্য হল না। দু-মাস যেতে না যেতেই তার মৃত্যু হল। রবের দুঃখের সীমা থাকল না। শীতের পর বসন্ত আসতে না আসতেই তার বাবাও নটিংহামের জেলখানায় মারা গেলেন।

এই দুর্ঘটনার পর দু-বছর কেটে গেল। রবের খুড়তুতো ভাই উইলকে তার বাবা স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে রবের সঙ্গে ম্যারিয়ানের বন্ধুতার কথা জানতে পেরে, আরল অব হান্টিংডন ম্যারিয়ানকে রানি ইলিনরের সখীর কাজে নিযুক্ত করে দিলেন। ম্যারিয়ানও লন্ডন চলে গেলেন। রব বড়ই নিঃসহায় অবস্থায় পড়ল।

স্কোয়ার জর্জ অবশ্য রবকে খুবই ভালোবাসতেন। কিন্তু সে মনের দুঃখে সর্বদা বনে-বনে ঘুরে বেড়াত। একদিন রব কাকা জর্জের সঙ্গে খেতে বসেছে, আহারাদির পর স্কোয়ার জর্জ বললেন, ‘বাবা রব! একটা খবর শুনেছ কি?’

রব বলল,–’কী খবর কাকা?’

স্কোয়ার জর্জ বললেন,—’ ‘নটিংহাম শহরে মেলা বসেছে। শেরিফ বলছেন যে, মেলায় তিরন্দাজদের একটা টুর্নামেন্টে খেলা হবে। সে টুর্নামেন্টে যারা ভালো তিরের খেলা দেখাতে পারবে রাজার বনে তাদের পাহারা দেওয়ার কাজ দেওয়া হবে। আর যে সবচেয়ে ভালো তির চালাবে, তাকে একটা সোনার তির পুরস্কার দেবেন। তুমি কেন যাও না বাবা? আর যদি পুরস্কারটা পাও, তবে না হয় তুমি যে মেয়েটিকে ভালোবাসো, তাকে সেটা দিও, কেমন?’ রব যে ম্যারিয়ানকে ভালোবাসে, সেটা স্কোয়ার জর্জ জানতেন।

কাকার কথা শুনে রব একটু লজ্জিত হয়ে বলল, ‘কাকা! এ দারণ খবর, নিশ্চয়ই আমি যাব। রাজার বন পাহারা দেওয়ার কাজ যদি পাই তাহলে তো ভালোই, আমি তাই চাই। আমাকে যেতে দেবেন তো কাকা?’

স্কোয়ার জর্জ বললেন,–’নিশ্চয়ই দেব বাবা! অবশ্য তোমার মা থাকলে কী বলতেন জানি না। কিন্তু আমি দেখছি, রাজার বন পাহারা দিতে পারলে তুমি বড় খুশি হবে। যাও বাবা! ভগবান তোমার ভালো করুন।’

যুবক রব তার কাকাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে, যাত্রার আয়োজন করতে গেল। ধনুকে নতুন গুণ পরিয়ে, বেছে, বেছে সোজা ডাল দিয়ে তিরগুলো বানিয়ে নিল।

তারপর একদিন সকালে রব্ নটিংহাম যাত্রা করল। বনের মধ্য দিয়ে পথ, রবের মনে বড়ই ফূর্তি। শিষ দিয়ে গান করতে-করতে চলেছে। খানিক দূরে গিয়ে দেখতে পেল, একদল বনের পাহারাওয়ালা একটা ওক গাছের তলায় বসে মাংসের পিঠে খাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজনকে দেখে রব চিনতে পারল। এই ব্যক্তিই বনের নতুন কর্তা হয়ে এসে তার বাবাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।

রব ভালোমন্দ কিছুই বলল না। সে আপন মনে চলে যেতে চাইল। কিন্তু দলপতি হঠাৎ রবকে দেখতে পেয়ে বলে উঠল,–’বাঃ, কী বাহাদুর বাচ্চা তিরন্দাজ রে! তোমার এই দু-আনা দামের ধনুক আর খেলনার মতো তির নিয়ে তুমি কোথায় যাচ্ছ হে ছোকরা? নটিংহামের মেলায় তির ছুড়তে যাচ্ছ বুঝি? হো হো হো হো।’

সর্দারের ঠাট্টা শুনে রব রেগে গেল। বলল,–’কেন বাপু, এত ঠাট্টা কেন? তোমার ধনুকের চেয়ে কি আমার ধনুক খারাপ? আর তুমি কি মনে করো আমার চেয়ে ভালো তির চালাতে পারবে?’

দলপতি ব্যাঙের সুরে বলল,–’তাই? আচ্ছা বাপু! তোমার বিদ্যেটা একটু দেখাও দেখি? আমি যেখানে বলব, ঠিক সেখানে যদি তোমার তির লাগাতে পারো, তাহলে তোমাকে কুড়িটা পেনি বকশিশ দেব! আর যদি না পারো, তাহলে তোমায় শাস্তি না দিয়ে ছাড়ব না।’ রব বলল, ‘আচ্ছা বেশ! বলো কোথায় তির লাগাব, যদি না পারি তাহলে আমার মাথা বাজি রইল।’

ঠিক এই সময়ে প্রায় একশো গজ দূরে কতকগুলো হরিণ চরে বেড়াচ্ছিল। দলপতি মনে করল, এতদূরে রাজার হরিণগুলোর কোনও অনিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সে বলল,–’আচ্ছা! ওই দূরে যেখানে হরিণগুলো দেখছ যদি তার অর্ধেক পর্যন্তও তোমার তির চলে, তবে জানব তুমি বাহাদুর।’

রব আর কথা বাড়াল না। ধনুকের গুণটি পরীক্ষা করে কান পর্যন্ত টেনে একটি তির ছেড়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে সর্বপ্রথম হরিণটি হঠাৎ শূন্যে লাফিয়ে উঠে, একেবারে সটান মাটিতে পড়ে ধড়ফড় করতে লাগল!

এই অসম্ভব কাণ্ড দেখে সকলে একেবারে স্তম্ভিত। তখন দলপতি চেঁচিয়ে উঠল,–’জানো ছোকরা! তুমি কতদূর অন্যায় কাজ করেছ? রাজার হরিণ মারলে? এখন তোমার মাথা কাটা যাবে। যাও-যাও! শিগগির এখান থেকে সরে পড়ো, তোমার মুখ যেন আর দেখতে না পাই।’

রবের রক্ত গরম হয়ে উঠল। ‘বটে, তোমার এমন নীচ স্বভাব? তা হবে না কেন, তোমাকে এখন আমি চিনতে পেরেছি। তুমিই তো আমার বাবার কাজটি কেড়ে নিয়ে, আমাদেরকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলে।’ এই কথা বলে সে তাড়াতাড়ি এগোল।

দলপতি রেগে আগুন। সে তখনি ধনুক নিয়ে রবকে লক্ষ করে এক তির ছাড়ল। সৌভাগ্যবশত তির ছাড়বার সময় দলপতি হোঁচট খেয়েছিল বলেই রবের রক্ষা! তির তার কান ঘেঁষে এক গোছা চুল কেটে নিয়ে শনশন শব্দে চলে গেল।

রব তক্ষুনি আক্রমণকারীর দিকে ফিরে বলল,—’আরে মশাই! মুখে শুধু বড়াই করলে কী হবে, আমার মতো তির চালাতে পারো না দেখছি। আচ্ছা দ্যাখো দেখি, আমার এ দু-আনার ধনুকের তির কেমন চলে?’

বলতে না বলতে শনশন শব্দে রবের তির ছুটল এবং তক্ষুনি দলপতি বিকট চিৎকার করে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আর নড়ল না!

এতদিনে রব তার বাবার প্রতি অত্যাচারের প্রতিশোধ নিল বটে, কিন্তু সে এখন খুনের দায়ে পড়ল। বিশেষত রাজার কর্মচারীকে সে খুন করেছে! ধরা পড়লেই তার প্রাণদণ্ড নিশ্চিত।

দলপতির অবস্থা দেখে অপর পাহারাওয়ালারা বিমূঢ়। তারা কর্তব্য স্থির করবার আগেই রব প্রাণপণে ছুটে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে পড়ল।

বনের একপাশে এক গরিব বিধবা স্ত্রীলোক থাকত। ছুটতে-ছুটতে ক্লান্ত হয়ে প্রায় সন্ধের সময় রব এই বৃদ্ধার কুটিরে এসে হাজির হল। বৃদ্ধার সঙ্গে রবের আগে থেকে পরিচয় ছিল কতবার সে রবকে আদর যত্ন করে খেতে দিয়েছে! তাকে এমন অবস্থায় ছুটে আসতে দেখে বৃদ্ধা বুঝতে পারল যে, সে বিপদগ্রস্ত। যা হোক যত্ন করে তাকে আহারাদি করালেন। রব একটু সুস্থির হয়ে বৃদ্ধাকে সব কথা বলল।

রবের কথা শুনে বৃদ্ধা বলল,—’তাই তো বাবা! তোমার দেখছি ভারী বিপদ। আজকাল বড়লোকেরা গরিবের ওপর বড় অত্যাচার করে। এই দ্যাখো না, আমার ছেলে তিনটি এখন ডাকাত হয়ে পড়েছে। তাদের অপরাধ এই যে, খেতে পাই না দেখে, তারা একটা হরিণ মেরেছিল। কাজেই এখন তারা ডাকাত, বাড়ি-ঘর ছেড়ে বনে লুকিয়ে থাকে। তাদের কাছে শুনেছি, আরও নাকি চল্লিশজন লোক ডাকাত হয়ে এই বনে দলবেঁধে লুকিয়ে আছে।’

রব বলল,—’বুড়ি মা, তারা কোথায় থাকে? আমি তাদের দলে মিশব।’

বৃদ্ধা কিছুতেই রবকে সে কথা বলবে না, রবও ছাড়বে না। শেষে বৃদ্ধা বলল,—’—তুমি যদি আজ রাত্রে আমার বাড়িতে থাকো, তবে আমার ছেলেদের সঙ্গে তোমার দেখা হতে পারে। তারা আজ রাত্রে আমার কাছে আসবে।

রব থেকে গেল। রাতে বৃদ্ধার তিনটি ছেলে এসে হাজির। তাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করে রব বড়ই সন্তুষ্ট হল। রবের কাছ থেকে সব কথা শুনে, বিধবার ছেলে তিনটি যখন দেখল যে, রবের মনের ভাব তাদেরই মতো, তখন তাকে নিজেদের আড্ডার সন্ধান বলল, এবং প্রতিজ্ঞা করে নিল, সে কথা রব কাউকে বলবে না। আরও বলল,–’দ্যাখো রব! আমাদের দলের এখন একজন সর্দার চাই। তার বুদ্ধি-চোখ এবং হাত বেশ পাকা হবে। তাই আমরা মনে করেছি ডাকাত হয়েও শেরিফের টুর্নামেন্টে সকলকে হারিয়ে যে সেই সোনার তির পুরস্কার পাবে এবং ধরা পড়বে না, তাকেই আমরা সর্দার করব।’

রব বলল,–’আচ্ছা! আমিও নটিংহামেই যাচ্ছিলাম, দেখি শেরিফ মহাশয়ের পুরস্কারটা পাই কি না।’

রবের বয়স কম হলেও, তার তেজ ও উৎসাহ দেখে বৃদ্ধার ছেলেরা বলল,–’তুমি যদি শেরিফের সোনার তির জিতে আনতে পারো, তাহলে তোমাকেই আমাদের দলের সর্দার করব।’

তখন সকলে মিলে পরামর্শ করল যে, রব ছদ্মবেশে নটিংহামে যাবে। রাজার লোককে খুন করেছে, এখন পোশাক পরিবর্তন না করে নটিংহামে গেলেই, শেরিফের লোক তাকে ধরে ফেলতে পারে।

এদিকে নটিংহাম শহরে মেলা বসেছে। শেরিফ ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে ঘোষণা করে দিয়েছেন, যে রবার্ট ফিটজুথ (রবের পুরো নাম) নামক ডাকাতকে ধরে দিতে পারবে, সে তিন হাজার টাকা পুরস্কার পাবে। মেলা লোকে পরিপূর্ণ। নানারূপ আমোদপ্রমোদেই সকলে ব্যস্ত, শেরিফের ঘোষণাপত্রের দিকে কারও মন নেই।

শহরের চারদিকে প্রাচীর। শেরিফের লোক এবং বনের প্রহরীরা সতর্ক হয়ে দরজায় পাহারা দিচ্ছে। মাঝে-মাঝে শেরিফ নিজে এসে পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে, অপরাধীকে গ্রেপ্তার করবার জন্য উৎসাহ দিচ্ছেন। রবের বাবার প্রতি তার যে রাগ ছিল, তা এখন ছেলের ওপর পড়েছে।

নটিংহামের মেলায় এই তির-খেলাটাই সকলের চাইতে জমকালো। বিকালবেলায় সোনার তির লাভ করবার জন্য কুড়িজন তিরন্দাজ এসে হাজির। তাদের মধ্যে একজন ভিখারিও ছিল। তার মুখখানি বড়ই বিমর্ষ, গায়ে নানা রং-এর কাপড় জড়ানো, হাতে ও মুখে ব্রাউন রং-এর ছাপ এবং মাথায় একটি হলদে রং-এর কপাল–ঢাকা টুপি (হুড)। তার অদ্ভুত চেহারা দেখে আর সে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে আসছে দেখে সকলেই তাকে ঠাট্টা করতে লাগল।

এই ভিখারিই আমাদের রব। সে খোঁড়া ভিখারি সেজে কখন যে শহরে ঢুকেছে, কেউ তা বুঝতে পারেনি। ভিখারির পাশেই একজন বলিষ্ঠ লোক দাঁড়িয়েছিল, তার একটি চোখে সবুজ কাপড় বাঁধা। তাকেও সকলে ঠাট্টা বিদ্রুপ করতে লাগল।

টুর্নামেন্টের মাঠের চারধারে মাচা, তার ওপরে হাজার-হাজার লোক। সেই মাচার মাঝখানে শেরিফ মহাশয় তার মেয়েকে নিয়ে বসেছেন। শেরিফের আসনের একদিকে হারফোর্ডের বিশপ মহাশয় এবং অপর দিকে একটি সুন্দরী মহিলা। এই মহিলা রবের বাল্যকালের সাথী কুমারী ম্যারিয়ান। তিনি তার বাবা আর্ল অব হান্টিংডনের সঙ্গে টুর্নামেন্ট দেখতে এসে তারই পাশে চুপ করে বসে আছেন। ম্যারিয়ানকে দেখে রবের মন উৎসাহে নেচে উঠল।

তারপর বিউগল বাজিয়ে সংকেত করামাত্র খেলা আরম্ভ হল। প্রথম টার্গেট ৪৫ গজ দূরে। টার্গেটের ঠিক মাঝখানে একটি কালো রঙের গোল দাগ, তার চারদিকে আর একটি গোল দাগ, আবার সেটাকেও ঘিরে আর একটি গোল দাগ। কুড়িজন তিরন্দাজের মধ্যে বারোজনের তির ভেতরকার দাগে বিঁধল। তার মধ্যে ভিখারির এবং সবুজ কাপড়ে এক চোখবাঁধা লোকটির তির অন্যদের চেয়ে ভেতরে পড়ল। দর্শকেরা সকলেই তাদের দুইজনকে খুব বাহবা দিল। তারপর টার্গেটটিকে ৬০ গজ দূরে রাখা হল। এবারে পাঁচজন তিরন্দাজের তির ভেতরের দাগে বিঁধল। ভিখারি ও চোখ-বাঁধা লোকটির তির, এবারেও অন্য তিনজনের চেয়ে ভেতরে পড়ল। ভিখারিকে দেখে আগের যারা ঠাট্টা করছিল, এখন তারাই আহ্লাদে চিৎকার করে উঠল। এইরকম অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে অন্য তিরন্দাজদের মন দমে গেল এবং তারা আস্তে-আস্তে সরে পড়ল।

চোখবাঁধা লোকটি যুবক রবের বাহাদুরি দেখে বলল,–’দ্যাখো ভাই! তোমার খাসা তিরের হাত, আমি হেরে গেলেও দুঃখ নেই। আমার নিশ্চয়ই বিশ্বাস, তুমি ওই দেমাকি লোক তিনটেকে হারিয়ে সোনার তির নিতে পারবে।’ এই সময় রবের চোখ হঠাৎ ম্যারিয়ানের ওপর পড়ল। ম্যারিয়ান অবশ্য তখনই মুখ ফিরিয়ে নিলেন, কিন্তু রবের মনে হল, যেন ম্যারিয়ান তাকে চিনেছে।

এবারে টার্গেট অনেক দূরে। প্রথমবারে ভেতরের কালো দাগটি যত বড় দেখেছিল, এবারে সমস্ত টার্গেটই যেন ততটুকু। শেরিফ, আল এবং বিশপের তিরন্দাজ তিনজন খুব মনোযোগের সঙ্গেই তির ছুড়ল বটে, কিন্তু কারও তির ভেতরের দাগে লাগল না।

তারপর রবের পালা। রব ভয়ে ভয়ে এসে দাঁড়াল। আকাশে মেঘ, তার ওপর আবার বাতাস, রবের ভাবনা হল, ‘না জানি কী হয়!’ এমন সময় ম্যারিয়ানের ওপর আবার তার দৃষ্টি পড়ল, ম্যারিয়ান একটু হাসলেন। রবের মনে হল, যেন ম্যারিয়ান তাকে সাহস দিচ্ছেন। তার মনে আবার উৎসাহ ফিরে আসল।

ঠিক এই সময়ে বাতাসের জোর একটু কম হওয়ায় রব উৎসাহের সঙ্গে তির ছেড়ে দিল। তির শনশন শব্দে গিয়ে একেবারে লক্ষ্যের ঠিক মাঝখানে পড়ল। তখন সকলের কী আনন্দ! ‘ভিখারির জয়! ভিখারির জয়!’ চারদিকেই আনন্দধ্বনি!

তারপর চোখ-বাঁধা লোকটির পালা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে বাতাসের গতিটার বড় খেয়াল করল না—তার তির ভেতরের দাগের বাইরে পড়ল। কিন্তু রব সোনার তির পাবে ভেবেই তার আনন্দ। রবকে বলল,—’দ্যাখো ভাই! আমি হেরেছি বলে কিছুই দুঃখ নেই।’ এই বলে সে হঠাৎ জনতার মধ্যে কোথায় যে মিশে গেল, তার কোনও দেখা পাওয়া গেল না।

এরপর একজন লোক এসে পুরস্কার নেওয়ার জন্য রবকে শেরিফের কাছ নিয়ে গেল। শেরিফ রবকে লক্ষ করে বললেন,–’তোমার তো খুব ভালো তিরের হাত! তোমার নাম কী হে? রব বলল,—’আজ্ঞে হুজুর! লোকে আমাকে ‘ভ্রমণকারী রব’ বলে।’

টুর্নামেন্টে যেসব মহিলা কৌতুক দেখতে আসেন, তাদের মধ্যে থেকে সে দিনের জন্য একজনকে রানি ঠিক করা হয়। শেরিফ প্রথম থেকে ভেবেছিলেন,—’তিরের খেলায় যে জিতবে সে তার মেয়েকেই রানি করবে। রবের হাতে সোনার তিরটি দিয়ে বললেন,–’এই তিরটি তোমাকে পুরস্কার দেওয়া হল, এখন এই মেয়েদের মধ্যে একজনকে রানি করো।’

পাছে রব আর কারুকে রানি করে ফেলে, তাই পেছন দিক থেকে একজন এসে তার মুখ শেরিফের মেয়ের দিকে ফিরিয়ে দিল। কিন্তু রব তার সংকেত গ্রাহ্য করল না, সটান ম্যারিয়ানের সামনে গিয়ে সোনার তিরখানা তাকে দিয়ে তাকেই রানি করল।

ম্যারিয়ান তার হাত থেকে তিরটি নিয়ে বললেন,–’হুড় পরা, রব। (Rob in the Hood) তোমাকে বহু ধন্যবাদ।’ এই বলে তিনি সোনার তিরটি মাথায় গুঁজে রাখলেন। চারদিক থেকে ‘ওই রানি! ওই রানি!’ বলে সবাই চিৎকার করে উঠল।

শেরিফ আর সহ্য করতে না পেরে, ভিখারির ওপর নজর রাখবার জন্য প্রহরীদের বলে দিলেন। কিন্তু নজর রাখবে কী করে? ততক্ষণে সে জনতার মধ্যে কোথায় অদৃশ্য হয়ে পড়েছে।

সেদিন সন্ধ্যার পর সারউড বনে একটি খোলা জায়গায়, চল্লিশজন দস্যু আগুনের চারদিকে বসে আহারান্তে গান করছিল, এমন সময় হঠাৎ রব সেখানে গিয়ে হাজির, তাকে শত্রু মনে করে সকলে লাফিয়ে উঠল। তখন রব বলল,–’ভাই, তোমরা ব্যস্ত হোয়ো না, আমি শত্রু নই। গরিব বিধবার ছেলে তিনটি এখানে থাকে, তাদের আমি খুঁজতে এসেছি।’

বিধবার ছেলেরা রবকে চিনতে পেরে বলল,–আরে এ যে রব!’ এসো ভাই এসো, তুমি টুর্নামেন্টে জিতেছ আমরা সে খবর পেয়েছি। এখন বলো দেখি ভাই, মেলার খবর তোমার মুখে শুনি!’

রব তখন হেসে বলল,—’সোনার তির তো পেয়েছি, শেরিফকেও নাকাল করতে কসুর করিনি। কিন্তু ভাই তির তো আমার কাছে নেই। বকশিশ পাওয়ার পর যাকে রানি করলাম তাকেই তিরটা দিয়ে দিয়েছি। রব দেখল, তার কথা যেন সকলে বিশ্বাস করল না। তখন আবার বলল, ‘আচ্ছা ভাই! তোমাদের দলেই তো থাকব বলে এসেছি, না হয় আমি একজন সামান্য তিরন্দাজ হয়েই থাকব।’

রবের কথা শুনে দলের একজন লোক এগিয়ে এল। তাকে চিনতে রবের দেরি হল না, এ ব্যক্তি মেলার সেই এক চোখ বাঁধা তিরন্দাজ। সে রবকে বলল, ‘ভাই! তোমার বাহাদুরি আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি। সোনার তির না-ই বা রইল তোমার কাছে, সেটা তো ভালো হাতেই পড়েছে। যাকে রানি করেছিলে, তিনি তোমাকে ‘রব ইন দি হুড’ নাম দিয়েছেন। তাই আমিও বলছি, ভাই রব ইন দি হুড়, আমার নাম উইল স্টাটলি, আমি তোমাকে ছাড়া আর কাকেও সর্দার বলে মানব না।’

উইল স্টাটলিই দস্যুদলের মধ্যে সকলের শ্রেষ্ঠ তিরন্দাজ ছিল। তাকে রবের অধীন হতে দেখেই সকলের আহ্লাদের সীমা রইল না। তখন রবকে তারা ‘রবিন হুড’ নাম দিয়ে দলের সর্দার করে নিল। রবিন হুড প্রতিজ্ঞা করলেন যে, তিনি সবসময় তাদের নিয়মগুলি মেনে চলবেন। রবিন হুডকে একটি শিঙা দেওয়া হল; এই শিঙা তিনবার বাজালে, দস্যুদল যেখানেই থাকুক না কেন, তখনি এসে তার কাছে হাজির হবে।

এইভাবে ‘রবিন হুড’ নাম ধরে রব দস্যুদলের দলপতি হয়ে রইলেন।


© 2024 পুরনো বই