চমৎকার নির্জন বাংলো। পাশেই একটি ছোট্ট ঝরনা খানিক রোদের সোনা ও খানিক আমলকী বনের ছায়া মেখে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে পাথরে পাথরে সকৌতুকে লাফাতে লাফাতে নীচের দিকে কোথায় নেমে গিয়েছে চোখের আড়ালে। দূরে নীচে শ্বেত বালুতটের ফ্রেমেআঁটা গঙ্গাকে দেখাচ্ছে আঁকা ছবির মতো। বহুদূর থেকে মাঝে মাঝে জনতার ক্ষীণ। একতান শোনা যায় কিন্তু সে যেন অন্য জগতের কলগুঞ্জন! কাছে খালি নিৰ্বরের সংগীত, তরুকুঞ্জের মর্মর-ছন্দ, প্রভাতি পাখির কাকলি, দুপুরের ঘুঘুদের ঘুমপাড়ানি সুর!
বাবা জানতেন, আমি জনতার অর্থহীন মুখরতাকে ভয় করি, তাই আমার দেহ ও মনের বিশ্রামের জন্যে যোগ্যস্থানই নির্বাচন করেছেন।
যাঁর রক্তমাংসে আমার দেহের প্রত্যেক অণু-পরমাণু গড়া, শিশুবয়স থেকে যিনি আমার সমস্ত সবলতা-দুর্বলতা, স্বাভাবিক ঝোক, হাবভাব, শিক্ষা-দীক্ষা লক্ষ করে আসছেন, পুত্রের চরিত্র তার কাছে যে বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগেরই মতন সহজ হবে, এজন্যে বিস্মিত হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু সন্তানরা—বিশেষ করে পুত্ররা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন স্বাভাবিক সত্যটা বুঝতে পারে না। যৌবনের উদ্দামতায় আত্মহারা হয়ে তারা ভাবে, বাবা তো মিউজিয়ম-এর সেকেলে বিশেষত্ব, অতি-অগ্রসর একালের ধর্ম তিনি ধারণায় আনবেন কেমন করে? ছেলেরা যখন ঠাওরায় বাপকে ঠকালুম হারালুম, তখন আসলে ঠকে ও হারে যে তারা নিজেরাই, যুগে যুগে এ সত্যের পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে যে কতবার, সে হিসাব কেউ রাখেনি। আদিমকাল থেকে আজ পর্যন্ত যুগে যুগে এ সত্য পিতাদের পক্ষেই রায় দিয়েছে,
তবু এখনও পুত্রদের বিশ্বাস-জন্মদাতাদের চেয়ে তারাই হচ্ছে বেশি বুদ্ধিমান।…
সেদিন অজানা পাখি আমার বাংলোর একটি জানলায় বসে নিজের ভাষায় প্রথম প্রভাতকে দিচ্ছিল সুন্দর অভিনন্দন।
তার কণ্ঠস্বরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু আমি বিছানার ওপরে উঠে বসতেই পাখি গেল পালিয়ে। মানুষকে কোনও জীবই বিশ্বাস করে না—সিংহ-ব্যাঘ্র পর্যন্ত তাকে ভয় বা শত্রু বলে সন্দেহ করে।
কিন্তু পাখি যে-গান গেয়ে গিয়েছিল, তার সুরের রেশ তখনও ঘুরছিল আমার ঘরের ভেতরে। বনের পাখির বনের গান ডাক দিয়ে গেল আমাকে ঘরছাড়া বনের পথে।
উঠে দেখলুম, গরম চা, এগ পোচ ও টোস্ট প্রস্তুত। তাড়াতাড়ি প্রাতঃক্রিয়া সেরে, জামাকাপড় পরে, চা প্রভৃতির সদ্ব্যবহার করে বেরিয়ে পড়লুম বাংলো থেকে।
মন যে কেন সেদিন অকারণে প্রফুল্ল হয়ে উঠল জানি না—বোধ করি নিয়তির ছলনা!
প্রতিদিনের মতো সেদিনও যদি-না বাংলোর বাইরে পা বাড়াতুম, তাহলে আজ হয়তো দেখা। হত না আপনার সঙ্গে এবং আমাকেও বলতে হত না এই অভিশপ্ত জীবনের অবাস্তব কাহিনি।
আগেই বলেছি, এখানে বসে দূর থেকে গঙ্গাকে দেখাচ্ছিল আঁকা ছবির মতো—অচপল, জীবনহীন। তবু তার মধ্যে ছিল কবির সংগীত, চিত্রকরের মৌন স্বপ্ন। …সেই দিকে চেয়ে নিজের অজ্ঞাতসারে কখনও চড়াই, কখনও উত্রাই পেরিয়ে চলে গেলুম অনেক দূর, অনেক দূর। মনকে সেদিন ছেড়ে দিয়েছিলুম আকাশে-বাতাসে, পাহাড়ের শিখরে শিখরে, নিরুদ্দেশের যাত্রীর মতো। আমি যেন পৃথিবীর মাটি-ভোলা স্বপ্নলোকের পথিক!
কিন্তু হায়, আচম্বিতে হল স্বপ্নভঙ্গ। ছিড়ে গেল আমার প্রাণের বীণার তার।
দূর থেকে একটা মূর্তি হনহন করে এগিয়ে আসছে আমার দিকেই। মাঝে মাঝে সে পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আবার দেখা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে সে এক-একটা দশবারো ফুট উঁচু পাথরের ঢিপি এক এক লাফে অত্যন্ত অনায়াসে পার হচ্ছে! মূর্তিটা মানুষের চেয়ে দ্বিগুণ বড়! চিনতে দেরি লাগল না। বুকটা ধড়াস করে উঠল! সেই শয়তান!
রাগে সারা শরীর জ্বলতে লাগল। ও কেন এদিকে আসছে? আমার কাছে কী চায় ও? স্থির করলুম, নিজের হাতে যে মূর্তি গড়েছি, আজ নিজের হাতেই তাকে ধ্বংস করব ওকে আক্রমণ করবার জন্যে প্রস্তুত হলুম।
সে কাছে এল। তার অপার্থিব কুৎসিত মুখে মাখানো অবজ্ঞা ও বিদ্বেষের এবং সেইসঙ্গেই তিক্ত যন্ত্রণার ভাব। কিন্তু রাগের মাথায় ওসব আমি ভালো করে লক্ষ করলুম
চিৎকার করে বললুম, পিশাচ! কোন সাহসে তুই আমার সামনে এসেছিস? আমার প্রতিহিংসার ভয়ে তোর বুক কাঁপছে না?
মৌনমুখে সে আমার আরও কাছে এল।
দূর হ নরকের কীট! না, না, দাঁড়া! আমার পায়ের তলায় তোকে গুড়িয়ে ধুলো করে দি!
দৈত্যটা বললে, আমি এইরকম অভ্যর্থনারই আশা করছিলুম। হতভাগ্যকে সবাই ঘৃণা। করে—আর আমার মতন হতভাগ্য পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কিন্তু ওগো আমার স্রষ্টা, আমি যে তোমারই হাতে গড়া জিনিস, তোমার সঙ্গে আমার বন্ধন যে অচ্ছেদ্য, তুমিও কি আমাকে ঘৃণা করবে? তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও—এ কথা বলতে তোমার মুখে বাধল না? আমার প্রতি তুমি তোমার কর্তব্য পালন করো, তাহলে আমিও তোমার আর মনুষ্যজাতির প্রতি আমার কর্তব্য পালন করব। যদি শান্তি চাও, আমার কথা শোনো। নইলে যতক্ষণ তোমার আত্মীয়-বন্ধুদের দেহে রক্ত থাকবে, ততক্ষণ আমি পূর্ণ করব মৃত্যুর উদর!
ক্রোধে অধীর কণ্ঠে বললুম, ঘৃণ্য রাক্ষস! শয়তান! তোর পক্ষে নরক-যন্ত্রণাও তুচ্ছ শাস্তি। তোকে সৃষ্টি করেছি বলে তুই আমাকে দোষ দিচ্ছিস? আয় তবে, যে দীপ জ্বেলেছি, নিবিয়ে দি এখুনি!—বলেই আমি তার ঘাড়ের ওপরে লাফিয়ে পড়লুম।
সে খুব সহজেই আমাকে এড়িয়ে বলল, শান্ত হও। মিনতি করি আমার কথা শোনো। আমি যথেষ্ট দুঃখ ভোগ করেছি, আমার দুঃখ আরও বাড়িয়ো না। হ্যা, দুঃখময় আমার জীবন, কিন্তু সে-জীবনও আমার কাছে প্রিয়। তুমি আমাকে আক্রমণ করলে আমিও বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষা করব। মনে রেখো, তুমি আমাকে গড়েছ তোমার চেয়ে বলবান করে— আকারেও আমার কাছে তুমি বামনের মতো। কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে লড়াই করতে চাই না। আমি হচ্ছি তোমারই দাস—তোমারই সৃষ্টি। তুমি আমার রাজা, আমি তোমার প্রজা। আমাকে তুমি পদদলিত কোরো না। আমি তোমার কাছে সুবিচার চাই। এই দুনিয়ার চারদিকেই আনন্দের হাসি, নিরানন্দের কান্না খালি আমার বুকে। প্রথমে আমার স্বভাব ছিল মিষ্টি, শান্ত, সদয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাকে আজ করে তুলেছে দানব। আমাকে সুখী করো আমিও হব সুচরিত্র।
আমি মাথা নেড়ে বললুম, না, না, না! দূর হ! তোর কোনও কথাই আমি শুনব না। তোর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কই থাকতে পারে না। আমরা শত্রু। হয় দূর হ, নয় লড়াই। কর—বেঁচে থাকুক খালি আমাদের একজন।
দৈত্য কাতর কণ্ঠে বললে, কেমন করে আমি তোমার মন ফেরাব? প্রভু, আমার কথা বিশ্বাস করো। আমার মনে ছিল প্রেম, উদারতা, মনুষ্যত্ব। কেবল মানুষের অবহেলাই আমার প্রকৃতিকে জঘন্য করে তুলেছে। ভেবে দ্যাখো। আমার স্রষ্টাই যখন আমার প্রতি বিরূপ, তখন অন্য মানুষদের কাছ থেকে কী আশা করতে পারি! এই বিপুল জগতে আমি একাকী—আমি একাকী। সংসারে-সমাজে-গ্রামে-নগরে আমার ঠাঁই নেই—আমি হচ্ছি বনজঙ্গল-পাহাড়ের জীব! আমার বন্ধু আকাশ-বাতাস, মানুষের চেয়ে তারা দয়ালু। মানুষরা যদি আমার সন্ধান পায় তাহলে দল বেঁধে আমাকে হত্যা করতে ছুটে আসে। মানুষ আমার শত্রু, আমিই-বা মানুষের বন্ধু হই কেমন করে? প্রভু, আগে আমার কাহিনি শোনো, তারপর বিচার করো।
আমি বললুম, যেদিন তুই জন্মেছিলি, সে দিনকে অভিশাপ দি। আমার যে হাত তোকে গড়েছে, তাকেও আমি অভিশাপ দি।
দানব বলল, তবু আমার কাহিনি শোনো।
অগত্যা আমাকে রাজি হতে হল।