এই অদ্ভুত আবিষ্কার করে আনন্দে আমি যেন উন্মত্ত হয়ে উঠলুম। এবং এই উন্মাদনার মধ্যে তলিয়ে গেল আমার সমস্ত পরিশ্রম ও দুঃখ-কষ্টের কথা। প্রকৃতির যে রহস্য ভাণ্ডারের দ্বার আজ পর্যন্ত কেউ খুলতে পারেনি, তারই চাবি আমার হস্তগত।
বন্ধু, আপনার মুখের ভাব দেখে বুঝতে পারছি, আমার গুপ্তকথা জানবার জন্যে আপনি অত্যন্ত আগ্রহান্বিত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু অসম্ভব, সেকথা আপনাকে জানানো অসম্ভব! আগে আপনি আমার কাহিনির সবটা শুনুন। তা হলেই বুঝতে পারবেন, আমার এই গুপ্তকথা জানার অর্থই হচ্ছে, স্বখাতসলিলে ড়ুবে মরা। যে দুর্ভাগ্যের তাড়নায় আমি নিজেই আজ ধ্বংসের মুখে এগিয়ে চলেছি, তার কবলে আপনাকেও নিক্ষেপ করে লাভ নেই। বলেছি, এক্ষেত্রে জ্ঞানের পাত্র হয়েছে বিষের পাত্র—এ বিষ সহ্য করবার শক্তি থেকে আমরা বঞ্চিত।
আবিষ্কারের পর চিন্তা করতে লাগলুম, আমি সৃষ্টি-ক্ষমতার অধিকারী হয়েছি বটে, কিন্তু অতঃপর কী সৃষ্টি করা উচিত? মানুষ, না মানুষের চেয়ে নিচু কোনও জীব?
যে-কোনও জীবের কাঠামোর মধ্যে শত-শত জটিল খুটিনাটি আছে। তন্তু, মাংসপেশি ও শিরা-উপশিরা তৈরি করে যথাস্থানে বসিয়ে কাজে লাগানো বড়ো যে-সে ব্যাপার নয়। আপাতত আমার হাতে যে মালমশলা আছে, তার সাহায্যে শেষ পর্যন্ত হয়তো আমি সফল হতে পারব; হয়তো বারংবারই আমাকে বিফল হতে হবে; হয়তো আমার গঠনকার্য হবে অসম্পূর্ণ!
কিন্তু তবু আমি দমলুম না, কারণ, প্রথমবারে বিফল হলেও দ্বিতীয়বার চেষ্টা করতে পারব। এবং দ্বিতীয়বারেরও পরে আছে তৃতীয়বার!
স্থির করলুম, সর্বপ্রথমে মানুষই গড়ব। …কাজ আরম্ভ করতে দেরি হল না। কিন্তু সাধারণ মানবদেহের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশগুলি ঠিকমতো গড়ে তোলা বড়োই কষ্টসাধ্য দেখে ভিন্নভাবে কাজ শুরু করলুম।
এবারেও মানুষের কাঠামো গড়ব বলে স্থির করলুম বটে, কিন্তু খুদে পাঁচ-ছফুট লম্বা মানুয নয়। এ হবে দানবের মতন বৃহৎ মানব—যেমন দৈর্ঘ্যে, তেমনি প্রস্থে! বিরাট দেহ, বিপুল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ! ..কয়েক মাস ধরে দরকারি মালমশলা সংগ্রহ করে দেহ গড়তে বসে গেলুম।
গড়তে গড়তে মনের ভেতর দিয়ে যেসব বিভিন্ন ভাবের ঝড় বয়ে যেতে লাগল, তা আর বলবার নয়। জীবন ও মৃত্যুর সীমাবন্ধন ছিন্ন করব আমি! অন্ধ বিশ্বের ওপরে করব আলোকবর্ষণ! নতুন এক জাতের মানুষ আবির্ভূত হবে এই পৃথিবীতে, তারা শ্রদ্ধা করবে আমাকে সৃষ্টিকর্তা বলে! আমার মানসপুত্ররা হবে কত সুখী, কত সুন্দর! এমন কথাও ভাবলুম, আমি যদি জড়কেও জ্যান্ত করে তুলতে পারি, তাহলে মড়াকেও আবার বাঁচিয়ে তুলতে পারব না কেন?
এইসব ভাবি, মাঝে মাঝে মূর্তি গড়ি এবং মাঝে মাঝে কেতাবের পর কেতাব পড়ি। দিনের পর দিন যায়, আমি থাকি ঘরের ভেতরে বন্দি। আমার চোখ গেল বসে, গাল গেল চুপসে, শরীর গেল শীর্ণ হয়ে। জানলার ফাক দিয়ে সূর্য-চাদ উঁকি মেরে যায়, কিন্তু সেদিকে তাকাবার সময় আমার নেই।
এক-একবার বেরিয়ে যাই, কবর খুঁড়ে অস্থি নিয়ে আসবার জন্যে। সময়ে সময়ে জ্যান্ত জীবজন্তু এনে তাদের দেহে অস্ত্রাঘাত করে যন্ত্রণা দিয়ে পরীক্ষা করি, একটা জীবনহীন জড়পিণ্ডকে জীবন্ত করবার জন্যে। আমার গুপ্ত সাধনার বীভৎসতা কে কল্পনা করতে পারবে? মাঝে মাঝে আমারও মনুষ্যত্ব বিদ্রোহী হয়ে উঠত, কিন্তু বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে আবার তাকে শান্ত করতুম। শরীর যখন আর বয় না, তখনও ছুটি নেই—এই একমাত্র কর্তব্য পালনের জন্যে আমি হয়ে উঠলুম যেন আত্মহারা, উন্মাদগ্রস্ত!
শীত গেল, বসন্ত গেল, গ্রীষ্ম গেল আমার ঘরের বাইরে দিয়ে হেসে-গেয়ে-নেচে-ফুল ছড়িয়ে।
তারপর সে এক ঘনঘোর বর্ষার রাত্রি। জানলার শার্সির ওপরে শুনছি বাতাসের ধাক্কা এবং বৃষ্টির পটাপট শব্দ। বাইরের দিকে জেগে জেগে উঠছে বিদ্যুতের অগ্নিপ্রভা!
ঘড়িতে টং করে বাজল একটা। আমি উঠে দাঁড়িয়ে প্রকাণ্ড টেবিলের ওপরে শোয়ানো, আমারই হাতে-গড়া বিরাট মূর্তিটার মুখের দিকে তাকালাম। কী দৃশ্য!
মূর্তিটা ধীরে ধীরে তার বিবর্ণ হলদে চোখদুটো খুলে ফেললে—সঙ্গে সঙ্গে প্রবল শ্বাসপ্রশ্বাসে তার বক্ষস্থল সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠল।
আমার প্রাণ কেঁপে উঠল যেন দারুণ এক দুর্ঘটনায়! এতকাল ধরে এত চিন্তা, যত্ন ও পরিশ্রমের পরে এ আমি কী গড়েছি? জীবনলাভের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মূর্তিটার রূপ যে গেল বদলে! হলদে চামড়ার তলা থেকে ওর সমস্ত মাংসপেশি ও শিরা-উপশিরা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, জীবন্তের মুখে মড়ার দাঁত্রে মতন তার দাঁতগুলো ঝকঝক করছে, তার ধূসর শ্বেত অক্ষিকোটরে জ্বলজ্বল করছে দুটো ভয়ানক জলীয় চক্ষু! এ তো মানুষ নয়, এ যে রাক্ষস!
এক মুহূর্তে আমার সমস্ত স্বপ্ন ছুটে গেল—মনের ভেতরে জেগে উঠল বিষম আতঙ্ক ও বিজাতীয় ঘৃণা! এই অপসৃষ্টির জন্যেই কি আমি জীবনের এতগুলো দিন ব্যয় করলুম?
আর সে দৃশ্য সহ্য করতে পারলুম না, দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসে নিজের ঘরে ঢুকে একেবারে বিছানার ওপরে গিয়ে আশ্রয় নিলুম। চেষ্টা করলুম ঘুমোবার জন্যে—কিন্তু মনের সে অবস্থায় কি ঘুম সহজে আসতে চায়? অনেকক্ষণ ছটফট করবার পর তন্দ্রা এল—কিন্তু তার সঙ্গে এল ভয়াবহ সব দুঃস্বপ্ন। আবার ধড়মড় করে উঠে বসলুম।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে—জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের ভেতরে এবং সেই আলোতে দেখলুম, বিছানার মশারিটা দুই হাতে ফাঁক করে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। আমার স্বহস্তে সৃষ্ট সেই ভীষণ দানবটা! এবং তার দুটো জলীয় চোখ—যদি তাদের চোখই বলা চলে-ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে আমারই পানে!
তার চোয়াল দুটো খুলে গেল, তার মুখ দিয়ে বেরুল বোবাদের মতন কী একরকম অব্যক্ত শব্দ, তারপর সে যেন বিদ্রুপের হাসি হাসলে।
তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে পড়লুম। সে হাত বাড়িয়ে আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে, কিন্তু কোনও গতিকে তাকে ফাঁকি দিয়ে আমি সরে পড়লুম। একেবারে নেমে এলুম বাড়ির উঠোনে। তারপর উত্তেজিতভাবে ক্রমাগত পায়চারি করি আর প্রত্যেক শব্দে চমকে উঠে ভাবি-ওই বুঝি এই দানোয় পাওয়া মৃতদেহটা আবার আমাকে আক্রমণ করতে আসছে! …উঃ, অসম্ভব সেই মূর্তি! কোনও মানুষ তার দিকে তাকাতে পারে না! মিশরের হাজার হাজার বছর ধরে রক্ষিত মড়া বা মমি যদি জীবনলাভ করে, তবে তার বীভৎসতাও হার মানবে এর কাছে!
চাঁদ ড়ুবল, আলো ফুটল, সূর্য উঠল। বিনিদ্র চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে সেই অভিশপ্ত বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম। চলতে চলতে বারংবার পিছন ফিরে দেখতে লাগলুম— মনে তখনও ভয় ছিল যে, হয়তো সেই রাক্ষসটাও আমাকে খোঁজবার জন্যে পথে বেরিয়ে আসবে! সঙ্গে সঙ্গে এ কথাটাও ভাবতে লাগলুম যে, প্রকাশ্যে সেই কল্পনাতীত অমানুষিক মূর্তির আবির্ভাব দেখলে রাজপথের ওপরে কীরকম চাঞ্চল্য ও গোলমালের সৃষ্টি হবে। এবং আমার সঙ্গে তার সম্পর্ক আবিষ্কার করলে দেশের লোকের কাছে আমি লাভ করব কীরকম অভ্যর্থনা।
মানুষ হয়ে আমি ভগবানের অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে গিয়েছিলুম ভেবেছিলুম ঈশ্বরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বুঝি জড়বিজ্ঞান! তারই ফল এই। চেয়েছিলুম স্বর্গে উঠতে, নেমে এলুম পাতালের অন্ধকারে। দেবতা গড়তে গিয়ে দানব গড়ে বসেছি!