দিনকয় আর তাঁবু তুলতে পারলুম না।
সেবা-শুশ্রুষা ও ঔষধ-পথ্যের গুণে তিন দিনের মধ্যেই অজয়বাবু আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। ভদ্রলোকের জীবনী শক্তি অদ্ভুত!
চতুর্থ দিনের সন্ধ্যার সময়ে তাবুর ভেতরে আমরা দুইজনে বসে আগুন পোয়াচ্ছিলুম।
জিজ্ঞাসা করলুম, অজয়বাবু, একাকী পথিকের পক্ষে এ হচ্ছে মহাপ্রস্থানের পথ। এখানে কেন আপনি এসেছেন?
তার মুখের ওপরে ঘনিয়ে উঠল বিষাদের কালিমা। তিনি ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন, একজন পলাতকের সন্ধানে।
কে সে?
তার পরিচয় দেওয়া অসম্ভব।
দেখলুম, অজয়বাবু সহজে কোনও কথা ভাঙতে রাজি নন। কথাটা ঘুরিয়ে জানবার জন্যে বললুম, যার খোঁজে এতদূর এসেছেন সে-ও কি আপনারই মতো একলা?
হ্যাঁ। তার সঙ্গী হতে পারে, দুনিয়ার এমন দুঃসাহসী মানুষ কেউ নেই।
সে কি এমন ভয়াবহ?
ভয়াবহ বললেও তার সঠিক বর্ণনা করা হয় না। সে ভয়ানকেরও চেয়ে ভয়ানক!
আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগের দিনে এখানে আমি দুঃস্বপ্নের এক মূর্তি দেখেছি।
সচমকে সোজা হয়ে বসে আমার মুখের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অজয়বাবু বললেন, দুঃস্বপ্নের মূর্তি?
বীভৎস দুঃস্বপ্নের মূর্তি। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে হচ্ছে চোখের ভ্ৰম, অপচ্ছায়া।
না, না, চোখের ভ্রম নয়, আপনি দেখেছেন এক দানবকে! সত্যি করে বলুন, সেই দৈত্যটা কোনদিকে গিয়ে..
দানব? দৈত্য? চোখের ভ্রম নয়? বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে আরব্য উপন্যাসের দৈত্য? অজয়বাবু, আপনি কী বলছেন?
অজয়বাবু উঠে দাঁড়ালেন। চারদিকে একবার পায়চারি করে এসে উত্তেজনায় কম্পিত স্বরে বললেন, বলুন—দয়া করে বলুন, সে কোনদিকে গিয়েছে? জানেন, তারই খোঁজে আজ আমি মৃত্যুকে তুচ্ছ করে এখানে এসেছি?
অজয়বাবু, শান্ত হোন, উত্তেজিত হবেন নাএখনও আপনার শরীর সুস্থ হয়নি।
অজয়বাবু আগুনের দিকে মুখ ফিরিয়ে আবার বসে পড়লেন, আর কোনও কথা বললেন না।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে বসে শুনতে লাগলুম, তাবুর বাইরে ধু ধু তুষারপ্রান্তরের ওপর দিয়ে হা-হা রবে কাঁদতে কাঁদতে বয়ে যাচ্ছে শীতার্ত বাতাস। তাঁবুর কোন ফাক দিয়ে সেই অশান্ত বাতাসের দুই-একটা তুষার-শীতল দীর্ঘশ্বাস ভেতরে ঢুকে আমাদের বুকেও শিহরণ জাগিয়ে আগুনের শিখাদের করে তুলছিল অস্থির।
ধীরে ধীরে বললুম, অজয়বাবু, আপনি আমার মনে কৌতূহলকে জাগিয়েছেন। চিরদিনই আমি হচ্ছি রহস্যের সন্ধানী। আমি জানতে চাই প্রকৃতির বিচিত্র সত্যকে। আমি করতে চাই অজানা-জ্ঞানের উপাসনা। আমি চাই গোপনীয়তাকে প্রকাশ করতে। এই সাধনায় জীবন দিতেও আমার আপত্তি নেই।
বেদনাবিকৃত কণ্ঠে অজয়বাবু বললেন, আপনিও কি আমার মতন উন্মাদগ্রস্ত হয়েছেন? তাহলে দেখছি, আপনিও আমার মতন হতভাগ্য।
হতভাগ্য! আপনি নিজেকে হতভাগ্য বলে মনে করছেন কেন?
সত্যই আমি হতভাগ্য! প্রকৃতির রহস্য হচ্ছে বিষের পাত্রের মতোই মারাত্মক! আমার কাহিনি যদি শোনেন, তাহলে এ বিষের পাত্ৰ এখনি ছুড়ে ফেলে দেবেন!
তার কাহিনি! …শোনবার জন্যে আমার কৌতূহল আরও বেশি জাগ্রত হয়ে উঠল, বললুম, প্রকৃতির রহস্যের সঙ্গে আপনার কাহিনির কী সম্পর্ক, বুঝতে পারছি না। কারণ, আপনার কাহিনি এখনও আমি শুনিনি।
অজয়বাবু বললেন, আপনার সম্বন্ধেও আমি কিছু জানি না। আগে আপনার কথাই বলুন।
আমার জীবন দীর্ঘ নয়; অভিজ্ঞতাও অল্প। তাই বলবার কথাও বেশি নেই। তবু আমার বাল্য ও প্রথম যৌবনের কথা, আমার আদর্শ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা এবং আমার শিক্ষাদীক্ষা ও ভ্রমণের কথা খুব সংক্ষেপে বর্ণনা করলুম।
সমস্ত শুনে অজয়বাবু বললেন, যার জীবনের আদর্শ আর উদ্দেশ্য নেই, সে মানুষই নয়। আপনি সে শ্রেণির অন্তর্গত নন জেনে সুখী হলুম। কিন্তু মানুষ হচ্ছে তুচ্ছ অসম্পূর্ণ জীব, আদর্শের কাছে কোনওদিন সে পৌঁছতে পারে না।
আমি বললুম, তবু আদর্শের কাছে পৌঁছবার চেষ্টা আর আগ্রহের মধ্যেই থাকে মনুষ্যত্বের সবচেয়ে বড়ো পরীক্ষা।
অজয়বাবু দুঃখিত স্বরে বললেন, সে পরীক্ষায় আমি বিফল হয়েছি। আমার চেষ্টা আর আগ্রহের অভাব ছিল না। কিন্তু তবু আমি আদর্শের কাছে গিয়ে পৌঁছতে পারিনি। আমার কাহিনি শুনুন, তাহলেই সব বুঝতে পারবেন।
খানিকক্ষণ স্তব্ধ থেকে অজয়বাবু তার কথা বলতে আরম্ভ করলেন।
অদ্ভুত, বিচিত্র ও আশ্চর্য সেই কাহিনি। আরব্য উপন্যাসের মতন অবাস্তব ও ছেলেভোলানো নয়, অথচ অবাস্তবও তার মধ্যে হয়েছে সম্ভবপর! সে কাহিনি যেমন করুণ, তেমনি ভয়ানক!
হিমালয়ের অন্তঃপুরে বসে নিঃশব্দ অন্ধ রাত্রির বুকে তুষারার্ত ঝোড়ো হাওয়ার কান্নার সঙ্গে সেই কল্পনাতীত কাহিনি শুনতে শুনতে আতঙ্কে ও বিস্ময়ে মাঝে মাঝে আমার হৃদয়। স্তম্ভিত ও নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে যেতে লাগল