[অনেককাল আগে একটি বিলাতি গল্প পড়েছিলুম। লেখকের নাম মনে নেই। কিন্তু গল্পটি ভালো লেগেছিল বলে তার প্লট এখনও বেশ মনে আছে। তোমাদেরও ভালো লাগতে পারে এই বিশ্বাসে সেই গল্পটির ছায়া অবলম্বন করে এই কাহিনিটি আরম্ভ করা হল।]
অন্নচিন্তা চমৎকারা কি না জানি না, কারণ বাবা পরলোকে গিয়েছেন ব্যাংকের টাকা ইহলোকে রেখেই। কাজেই কাজের মধ্যে দুই, খাই আর শুই। ওরই মধ্যে একটুখানি ফাঁক পেলেই তাস-দাবা খেলি আর পরচর্চা করি।
উঃ, জীবনটা কী একঘেয়েই না লাগছে! তিতিবিরক্ত হয়ে স্থির করলুম, এইবারে দুএকটা অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ব।
কিন্তু আমার উপযোগী অ্যাডভেঞ্চার কই? গায়ে জোর নেই, পথে-ঘাটে কাবলিওয়ালার সঙ্গে হাতাহাতি বা ফুটবলের মাঠে গোরার সঙ্গে গুঁতোগুতি করা আমার পক্ষে অসম্ভব। এমন সাহস নেই যে, উড়োজাহাজে চড়ে অন্য কারুর রেকর্ড ভাঙব। এমনকি আমি ব্যাডমিন্টন বা টেবিলটেনিস পর্যন্ত খেলতে পারি না।
ছেলেবেলায় মার্বেল, গুলি-ডান্ডা আর হা-ড়ু-ড়ু-ড়ু খেলেছিলুম বটে, কিন্তু সে সবকে তোমরা তো কেউ অ্যাডভেঞ্চার বলে মানতে রাজি হবে না?
কিন্তু আমার বুদ্ধি আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। কেবল সুবুদ্ধি নয়, দুষ্টুবুদ্ধিও। অতএব নিজের বুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে আমি একটা নতুন অ্যাডভেঞ্চারের পথ আবিষ্কার করে ফেললুম।
অর্থবলের সঙ্গে বুদ্ধিবল থাকলে অ্যাডভেঞ্চারের ভাবনা কী?
সেদিন রাঁচি ফাস্ট প্যাসেঞ্জার হাওড়া থেকে খড়গপুরে যেতে পুরো আধ ঘণ্টা লেট হয়ে গিয়েছিল কেন, তোমরা কি কেউ সে গুপ্ত খবর রাখো?
হাওড়া থেকে ট্রেনের একখানা ফাস্ট ক্লাস কামরায় ঢুকে দেখি, গাড়ির ভেতরে যাত্রী আছেন খালি আর-একটি ভদ্রলোক। চেহারা দেখলেই মনে হয়, যেন একটি পেট-মোটা গ্লাডস্টোন ব্যাগ।
নিজের আসনে বসে খানিকক্ষণ স্টেশনের ভিড় দেখলুম। তারপর ফিরে কামরার ভদ্রলোকটিকে ডেকে শুধালুম, মশাইয়ের কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
ভদ্রলোক তার শিকারি বিড়ালের মতো গোঁফে তা দিতে দিতে বললেন, রাঁচি।
হাওয়া খেতে?
না, সেখানে আমার জমিদারি আছে।
মশাই তাহলে জমিদার?
ভদ্রলোক আমার দিকে মস্তবড়া গোলগাল মুখখানা ফিরিয়ে গোঁফের আড়ালে হাসলেন কি দাঁত খিচোলেন, স্পষ্ট বোঝা গেল না।
আমি মুখ তুলে কমিউনিকেশন কর্ডের দিকে তাকালুম। ওখানে লেখা রয়েছে, অকারণে, ওই কর্ড বা শিকল ধরে টানলে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা হবে। এ নোটিশ তোমরাও নিশ্চয় ট্রেনে চড়ে লক্ষ করেছ? পথে হঠাৎ কোনও বিপদ হলে ওই কর্ড বা শিকল ধরে টানলেই চলন্ত ট্রেন তখনই থেমে যায়।
ট্রেন তখন হাওড়া ছেড়ে মাঠের ভেতর দিয়ে, গ্রামের পর গ্রামের পাশ দিয়ে দৌড়তে শুরু করেছে উর্ধ্বশ্বাসে। খানিকক্ষণ চুপচাপ বাইরের দৃশ্য দেখলুম। কিন্তু সেখানে অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ না পেয়ে বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালুম এবং কমিউনিকেশন কর্ড ধরে মারলুম এক জোর-টান!
গোঁফে তা দেওয়া শেষ করে জমিদার তখন ঘুমোবার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু পার। দেখে তিনি চমকে, আশ্চর্য স্বরে বলে উঠলেন, আঁ-আঁ করেন কী?
আর করেন কী, দেখতে দেখতে মাঠের মধ্যিখানে ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়ল।
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলুম, গার্ড সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে।
আমি একগাল হেসে বললুম, Good evening guard!
কর্ড ধরে কে টেনেছে?
আমি।
কেন? কামরায় কেউ খুন হয়েছে?
নাঃ!
কামরায় হঠাৎ কারুর অসুখ করেছে?
উহুঁ। আচ্ছা, গার্ড! আজ কেমন সুন্দর চাঁদ উঠেছে বলো দেখি?
গার্ড প্রথমটা হতভম্ব হয়ে গেল। তারপর একবার তীক্ষ দৃষ্টিতে আমার মুখের পানে তাকিয়ে বলল, ও, তাই নাকি? কতটা মদ খাওয়া হয়েছে?
মদ! চাঁদ দেখা আর মদ খাওয়া এক কথা নাকি?
বাজে কথা রাখো! কর্ড ধরে টেনেছ কেন বলো।
শখ হয়েছে তাই টেনেছি। এই শখের দাম পঞ্চাশ টাকা তো? আমি দাম দিতে রাজি আছি। দামটা কি এখনই নেবে?
আচ্ছা, খাপুরে পৌছে সেটা দেখা যাবে। আপাতত তোমার নাম আর ঠিকানা দাও।
নাম-ঠিকানা নিয়ে গার্ড গজগজ করতে করতে চলে গেল। ট্রেন আবার ছুটল।
আড়-চোখে চেয়ে দেখলুম, জমিদারের শিকারি গোঁফজোড়া কী এক ভয়ে কাবু হয়ে ঝুলে পড়েছে। আমি আবার কমিউনিকেশন কর্ডের দিকে স্থির-চোখে তাকিয়ে রইলুম।
জমিদার এস্ত স্বরে বললেন, ওকী মশাই, আপনি ওদিকে তাকিয়ে আছেন কেন? শিকল ধরে ফের টান মারবেন নাকি?
আমি হাসিমুখে বললুম, বোধহয় আর-একবার টান মারব।
জমিদার তাড়াতাড়ি উঠে অনেক দূরে গিয়ে আড়ষ্টভাবে বসে পড়লেন। তারপরে যেই আন্দুল স্টেশনে গাড়ি থামল, তিনি শশব্যস্ত হয়ে নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে কামরা ছেড়ে নেমে গেলেন।
আমি বললুম, কী মশাই, এই না বললেন, আপনি রাঁচি যাচ্ছেন?
জমিদার আমার দিকে একটা ভীত দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই দৌড় মারলেন। বোধহয় তিনি অন্য কামরায় গিয়ে উঠলেন। বোধহয় তিনি আমাকে বদ্ধ পাগল ভাবলেন।
গাড়ি ছাড়ল। অনেকক্ষণ ধরে কবিত্বের চর্চা করলুম—অর্থাৎ দেখতে লাগলুম, ধু ধু মাঠ, ঝোপঝাপ, গাছপালা আর ঘুমন্ত গ্রামের ওপরে চাঁদের আলোর কল্পনা। চাঁদের বাহার দেখে শিয়ালরা হুক্কা-হুয়া গান গেয়ে উঠল।
কিন্তু বেশি কবিত্ব আমার ধাতে সয় না। আমি চাই অ্যাডভেঞ্চার। অতএব গাত্রোত্থান। করে আবার কর্ড ধরে দিলুম জোরে এক টান!
আবার গাড়ি থামল। অবিলম্বেই গার্ডের পুনরাবির্ভাব। এবারে তার অগ্নিমূর্তি। হুমকি দিয়ে বললে, মাতলামি করবার জায়গা পাওনি? জানো, তোমাকে আমি গাড়ি থেকে নামিয়ে দেব?
আমি পরম শান্ত ভাবেই বললুম, জাননা, আমি জীবনে কখনও মদ খাইনি? জানো, আমি ফার্স্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জার? জানো, আমাকে অপমান করেছ বলে আমি তোমার নামে রিপোর্ট করব?
তোমার যা-খুশি কোরো বাবু! কিন্তু কেন তুমি আবার কর্ড ধরে টেনেছ? এবারেও কি শখ হয়েছে?
না, এবারে শখ নয়। এবারে আমার ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। তোমার ঘড়ির সঙ্গে সেটাকে মিলিয়ে নিতে চাই।
কী আশ্চর্য, এই জন্যে তুমি ট্রেন থামিয়েছ? দু-বারে তোমাকে একশো টাকা জরিমানা দিতে হবে। এরপরে আবার কর্ড ধরে টানলে ট্রেন আর থামবে না।
রাত্রে যদি আমি ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখি, তাহলেও ট্রেন থামবে না? তাও কি হয় বন্ধু? আমি আরও জরিমানা দেব, আবার কর্ড ধরে টানব। গাড়ি না থামলে আমি তোমার নামে নালিশ করব। আইন না মানলে তোমার শাস্তি হবে। বুঝেছ?…যাও, আর আমায় বাজে বকিয়ো না!
গার্ড ফিরে যেতে যেতে হঠাৎ কী ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর বললে, তোমার টিকিট দেখি!
আমি অনেকক্ষণ ধরে পকেট হাতড়ে হাতড়ে হাওড়া থেকে খাপুরের একখানা থার্ড ক্লাস টিকিট বার করলুম।
গার্ড মহা উৎসাহে এক লাফ মেরে বলে উঠল, যা ভেবেছি তাই!
আমি গম্ভীর স্বরে বললুম, তুমি কী ভেবেছ, আমি জানতে চাই না। তবে এই টিকিটের ওপরে বাড়তি যা দাম হবে আমি তা দিতে রাজি আছি।
গার্ড কড়াস্বরে বললে, রেখে দাও তোমার ওসব চালাকি! নামো ফার্স্ট ক্লাস থেকে! যাও থার্ড ক্লাসে।
গদির ওপরে জাঁকিয়ে, সম্পূর্ণ বিদেশি কায়দায় আসনসিঁড়ি হয়ে বসে পড়ে বললুম, আমি এখান থেকে নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু, বাবা! আমি আইন জানি। তুমি এখান থেকে আমাকে তাড়াতে পারবে না।
গার্ড ক্রুদ্ধ স্বরে বললে, আচ্ছা, পরের স্টেশনেই, তোমার কী অবস্থা হয়, দেখো। ট্রেন লেট হয়ে গেছে, এখানে আমি আর গোলমাল করতে চাই না।
আমি দুই হস্তের দুই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বললুম, তুমি আমার কলা করবে। আমি পাঁচশো টাকা বাজি হারব—পরের স্টেশনে কেউ যদি এই কামরা থেকে আমাকে এক-পা নড়াতে পারে।
কামরার সামনে, লাইনের ওপরে তখন অন্যান্য আরোহীরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে সাগ্রহে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল। সেই জনতার শেষপ্রান্তে আমি জমিদারমশাইয়ের শিকারি গোঁফজোড়াও আবিষ্কার করলুম।
গার্ডও তাঁকে দেখে বললে, বাবু, আপনিও এই কামরায় ছিলেন না?
জমিদার বললেন, ছিলুম। কিন্তু পাগলের কাছ থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি।
গার্ড বললে, আপনাকে আমি সাক্ষী মানব।
আমি বললুম, জমিদারমশাই, আমরা দুজনেই সহযাত্রী ছিলুম, আপনি আমার সাক্ষী।
শিকারি গোঁফ-জোড়া আবার ঝুলে পড়ল, নিজের মোটা দেহ নিয়ে হাঁসফাস করতে করতে জমিদার অদৃশ্য হয়ে গেলেন তৎক্ষণাৎ।
গার্ড বললে, তুমি আমার সাক্ষী ভাঙাবার চেষ্টা করছ? বহুত আচ্ছা, পরের স্টেশনেই তোমার সঙ্গে আবার আমার দেখা হবে।
আমি হো হো করে হেসে বললুম, আমি প্রস্তুত হয়েই রইলুম। তোমার মতন দশ-বিশটা গার্ডকে আমি ট্যাকে পুরতে পারি। বাছাধন, পরের স্টেশনে খালি তুমি কেন, সমস্ত রেল কোম্পানিকে আমি অভ্যর্থনা করতে রাজি আছি।
রাগে ফুলতে ফুলতে জনতা সরিয়ে, গার্ড নিশান নেড়ে সিগন্যাল দিলে। গাড়ি আবার চলল।
আবার খানিকক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে বসে দেখতে লাগলুম, গাছের ওপরে চাঁদের রুপোলি আলো আর গাছের নীচে কালো অন্ধকার। মাঠে মাঝে মাঝে পুকুরের জল চকচক করছে।
একবার কমিউনিকেশন কর্ডের দিকেও দৃষ্টিপাত করলুম। কিন্তু তাকে নিয়ে তৃতীয়বার টানাটানি করতে ভরসা হল না।
পরের স্টেশন হচ্ছে উলুবেড়িয়া। ট্রেন স্টেশনের ভেতরে ঢুকল। খানিক পরেই গার্ড এল স্টেশনমাস্টার এবং আরও জনকয়েক লোককে সঙ্গে নিয়ে। স্টেশনমাস্টার আমাকে। ডেকে হুকুম দিলে, গাড়ি থেকে তুমি নেমে এসো। তোমার টিকিট দেখাও।
বললুম, গাড়ি থেকে না নেমেই আমি টিকিট দেখাতে পারি। এই দ্যাখো বসেই ফস করে একখানা ফার্স্ট ক্লাস টিকিট বার করে ফেললুম।
দুই চক্ষু ছানাবড়ার মতো বিস্ফারিত করে গার্ড খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইল। তারপর বিস্মিত স্বরে বললে, একটু আগেই ওই বাবু আমাকে থার্ড ক্লাস টিকিট দেখিয়েছে।
বললুম, হতে পারে। আমি দু-রকম টিকিট কিনেছি। খুশি হলে আমি চার রকম টিকিটও কিনতে পারি। কিন্তু সেটা বেআইনিও নয়, আর সেজন্যে তোমাদের মুখমাড়াও সইতে রাজি নই। যাও, এখান থেকে সরে পড়ো!
স্টেশনমাস্টার গলাটা যথাসম্ভব ভারিকে করে তুলে বললে, কর্ড ধরে টেনে তুমি দুবার ট্রেন থামিয়েছ।
হ্যাঁ, এই নাও দাম বলেই একখানা একশো টাকার নোট বার করে ফেলে দিলুম।
স্টেশনমাস্টার বললে, এ যাত্রা তোমাকে ছেড়ে দিলুম, কিন্তু ভবিষ্যতে এমন কাজ আর কোরো না।
অদুরে আবার দেখা দিয়েছে সেই শিকারি গোঁফজোড়া। গোঁফের মালিককে সম্বোধন করে বললুম, আসুন জমিদারবাবু, আবার এই কামরায় এসে উঠুন। আপনার আর কোনও ভয় নেই।
কিন্তু আমার পাগলামি সম্বন্ধে তার সন্দেহ এখন বোধহয় দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। গোঁফের সঙ্গে তাঁর মুখখানা আবার সাঁৎ করে কোথায় মিলিয়ে গেল।
আমার কিছু টাকা খরচ হল বটে, কিন্তু এই অ্যাডভেঞ্চারটা তোমাদের কেমন লাগল?