জয়ন্তের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে মানিক বললে, ‘জয়, তুমি কি মনে কর ও গাড়ি দু-খানার মধ্যে আমাদের শত্রু আছে?’
জয়ন্ত বললে, ‘শত্রু-মিত্র জানি না, আমি কেবল সতর্ক হয়ে থাকতে চাই৷’
জয়ন্তের মুখের কথা শেষ হবার আগেই ভোঁ ভোঁ ভোঁ ভোঁ করে ক্রমাগত হর্ন বাজাতে বাজাতে প্রথম মোটরখানা তীব্রগতিতে সাঁৎ করে তাদের চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল এবং পরমুহূর্তেই দ্বিতীয় গাড়িখানা! গাড়ি তো নয়, যেন দু-দুটো অগ্নিহীন উল্কা, সে প্রচণ্ড গতির ঝড়ের ভিতর থেকে চেনা বা অচেনা কোনো মানুষের মুখই আবিষ্কার করা গেল না!
সুন্দরবাবু বললেন, ‘মেল ট্রেনের স্পিডও এদের কাছে বোধ হয় হার মানে! কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এরা কেন যাচ্ছে আর কোথায়ই বা যাচ্ছে?’
পথের ধুলোর দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘যেখানেই যাক, ওরা আমাদের ফাঁকি দিতে পারবে না৷ আমরা ওদের নাগাল ধরবই৷’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘নাগাল ধরবে মানে? ওদের নাগাল ধরতে গেলে আমাদেরও তো ওদের চেয়ে বেশি জোরে গাড়ি ছোটাতে হয়! হুম, আমি তাতে মোটেই রাজি নই! গাড়ি যদি একবার হোঁচট খায়, তাহলে ওঙ্কারধাম দেখবার আগেই গোলোকধামে গিয়ে হাজির হতে হবে!’
জয়ন্ত রুপোর নস্যদানি থেকে একটিপ নস্য নিয়ে বললে, ‘সুন্দরবাবু, ছেলেবেলায় কচ্ছপ আর খরগোশের গল্প পড়েননি? কচ্ছপ দৌড়ে খরগোশকে শেষে হারিয়ে দিয়েছিল৷ আমরা গাড়ির স্পিড না বাড়িয়েও ওদের নাগাল ধরব৷ পথের দিকে তাকিয়ে দেখুন৷ ধুলোর ওপরে গাড়ির চাকার দাগ দেখতে পাচ্ছেন না?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘ও হো হো হো বুঝেছি! ওই দাগ ধরে আমরা ওদের পিছু নিতে পারব, তুমি এই বলতে চাও তো?’
অমলবাবু বললেন, ‘কিন্তু ওদের পিছু নেবার দরকারই বা কী?’
জয়ন্ত বললে, ‘দরকার একটু আছে বই কী! এমন মারাত্মক স্পিড নিয়ে যারা আমাদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চায়, তাদের নিয়ে মাথা না ঘামালে চলবে কেন!’
অমলবাবু ভীত কন্ঠে বললেন, ‘আপনি কি বলতে চান, ওই গাড়ি দু-খানার মধ্যে চ্যান আর ইন আছে?’
-‘চ্যানকেও চিনি না, ইনকেও চিনি না, এখন উঠুন গাড়িতে!’ – এই বলে জয়ন্ত নিজের গাড়ির ভিতরে গিয়ে বসে পড়ল৷ আর সকলেও তখন তার অনুসরণ করলে, গাড়ি তিনখানা আবার অগ্রসর হতে লাগল৷
জয়ন্ত প্রথম গাড়ির ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসল, পূর্ববর্তী গাড়িগুলোর চক্রে চিহ্নিত পথের উপরে দৃষ্টি রাখবার জন্যে৷
মানিক সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললে, ‘আচ্ছা জয়, যারা গেল তারা যদি চ্যানের দল হয় তবে তারা আমাদের আক্রমণ না করে এগিয়ে গেল কেন? আর শত্রুরা আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষ ছেড়ে এখানে এলই বা কী করে? আমাদের জাহাজে তারা তো ছিল না!’
জয়ন্ত বললে, চ্যান আর ইন হয়তো এখনও এখানে এসে পৌঁছোতে পারেনি, কিন্তু মানিক, তুমি ভুলে যেয়ো না যে এটা হচ্ছে বিংশ শতাব্দী! চ্যানের টেলিগ্রাম হয়তো আমাদের আগেই কালাপানি পার হয়েছে!’
-‘জয়, তুমি কি বলতে চাও, চ্যানের কোনো টেলিগ্রাম পেয়ে তার দলের লোকেরা আমাদের পিছু নিয়েছে?’
-‘হতেও পারে, না হতেও পারে! হয়তো ওরা হুকুম পেয়েছে আমাদের উপরে পাহারা দেবার জন্যে! ওঙ্কারধামে যাবার প্রধান রাস্তা হচ্ছে এইটাই৷ হয়তো ওরা এগিয়ে গেল আমাদের পথ আগলে থাকবার জন্যে৷’
গাড়ি ছুটছে! দু-ধারে সেই সবুজ খেত, আর মাঝখানে সেই সোজা রাঙা রাস্তা৷
মানিক বললে, ‘দূরে একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে৷’
ড্রাইভার বললে, ‘হ্যাঁ, ওর নাম সিয়েম রিপ৷ আর মাইল খানেক পরেই আমরা ডাকবাংলোয় গিয়ে পৌঁছোব৷’
সিয়েম রিপ গ্রাম থেকে উত্তর দিকে মোড় ফিরতেই চোখের সামনে জেগে উঠল, বিরাট ওঙ্কারধামের বিপুল দেবালয়! চারিধারের নিবিড় জঙ্গল ও সুদীর্ঘ বনস্পতিরা ওঙ্কারধামের পঞ্চচূড়ার অনেক নীচে পড়ে রয়েছে৷ দূর থেকে ওঙ্কারধামকে দেখে মনে হল, বিরাটতায় সে মিশরের পিরামিডের চেয়ে এবং সূক্ষ্ম শিল্পের নিদর্শনরূপে শাজাহান বাদশার তাজমহলের চেয়ে খাটো নয়! এই অরণ্যের মধ্যে হঠাৎ তাকে দেখলে তার বাস্তবতা সম্বন্ধে সন্দেহ হয়৷ এ যেন আলাদিনের প্রদীপবাহী দৈত্যের হাতে গড়া কোনো অসম্ভব মায়ামন্দির, যেকোনো মুহূর্তে দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে!
ওঙ্কারধামের ছায়ায় এসে দেখা গেল, তাদের অগ্রবর্তী সেই গাড়ি দু-খানার চাকার দাগ বাংলো ছাড়িয়েও এগিয়ে গিয়েছে৷
সুন্দরবাবু সর্বপ্রথমেই ডাকবাংলোয় ঢুকে একটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘হুম, এইবারে আহার আর বিশ্রাম!’
জয়ন্ত বললে, ‘আপাতত আমাকে ও দু-টি সুখ থেকেই বঞ্চিত হয়ে থাকতে হবে৷ আগে বাংলোর চারিদিকটা তদারক না করে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছি না!’
মানিক বললে, ‘কিন্তু এখানে তদারক করবার কিছু আছে বলেই মনে হচ্ছে না৷ চারিদিক শান্তিময়, শত্রুদের কোনো চিহ্নই নেই৷’
‘হ্যাঁ, ঝড়ের আগে প্রকৃতি খুব শান্ত থাকে বটে-‘ মৃদুস্বরে এই কথা বলেই জয়ন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷
অমলবাবু বললেন, ‘এই ওঙ্কারধাম আমার পুরোনো বন্ধুর মতো৷ মানিক, আগে আমি মন্দিরের সঙ্গে আলাপ করে আসতে চাই৷’
মানিক বললে, ‘এই অদ্ভুত মন্দির আমারও কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছে! চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে যাই৷’
অগ্রসর হতে হতে অমলবাবু অর্ধনিমীলিত নেত্রে যেন সুদূর অতীতের দিকে তাকিয়েই যে কাহিনি বর্ণনা করলেন তা হচ্ছে এই-অস্তলোক থেকে পূর্ব আকাশের গায়ে ছবির মতন আঁকা নীল পাহাড়ের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে যাত্রীর পর যাত্রী-যেন তাদের আর শেষ নেই!
চলেছেন রাজা আর রাজপুত্ররা সাজানো হস্তীদলের পৃষ্ঠে! চলেছেন রাজপুরোহিতগণ সোনার রথে চড়ে! চলেছেন বীরবৃন্দ ও সৈনিকগণ তেজীয়ান অশ্বদের উপরে বসে! চলেছে সভাসদ, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, কর্মচারী, সওদাগর ও ধনী-দীন প্রজার দল যথাযোগ্য যানবাহনে বা পদব্রজে! চলেছে রুগ্ন ও ভিখারির দল অরণ্যের ভিতর দিয়ে, অনুর্বর ক্ষেত্রের উপর দিয়ে বা সন্ন্যাসীর গায়ে-মাখানো শুকনো ভস্মের মতো সাদা ধুলোয় ভরা উঁচু-নীচু পথ মাড়িয়ে,-তাদের কোনো সম্পদ নেই, তবু তারাও পিছনে পড়ে থাকতে রাজি নয়, কারণ তাদের মনে মনে জ্বলছে উজ্জ্বল আশার অম্লান বাতি! হাজারের পর হাজার, লক্ষের পর লক্ষ লক্ষ লোক চলেছে, এগিয়ে চলেছে! কত লোকের দেহ পড়েছে এলিয়ে, পায়ে পড়েছে ফোসকা, তবু তারা এগিয়ে চলেছে৷ পথের মাঝে জাগছে পাগলি নদীর ক্রুদ্ধ ঢেউ, দুরারোহ শৈলের দর্পিত শিখর, দুর্গম বনের জ্বালাময় কণ্টক-প্রাচীর, তবু তারা সব পেরিয়ে চলেছে এগিয়ে-মুখে মুখে জাগিয়ে তুলে কবি-ঋষিদের রচিত পবিত্র মন্ত্রসংগীত! কত শত শত মানুষের অক্ষম ভগ্ন দেহ জনহীন অনভ্যস্ত পথের উপর লুটিয়ে পড়ল, তবু তাদের আত্মা এগিয়ে চলল সেই বিপুল বাহিনীর পিছনে পিছনে! . . . কিছুদিন পরে দিনের রোদে আর রাতের জোছনায় দেখা গেল, সেই নির্জন নিস্তব্ধ নির্দয় পথ জুড়ে পড়ে রয়েছে মাংসহীন নরকঙ্কালের পর নরকঙ্কাল,- জীবনের যাত্রাপথে যেসব অভাগা এগিয়ে যেতে পারলে না তাদেরই শেষ-চিহ্ন!
যারা এগিয়ে গেল আর যারা এগিয়ে যেতে পারলে না, তারা প্রত্যেকেই হচ্ছে ভারতসন্তান! হিমালয়ের আশ্রয় ছেড়ে, গঙ্গার স্নিগ্ধ স্পর্শ ভুলে, সাগর পার হয়ে ব্রহ্মদেশের নিবিড় অরণ্য ভেদ করে রাজা-প্রজা, পুরুষ-নারী, মা-ছেলে, বর-বউ, কুমার-কুমারী এইখানে এসে অবশেষে কাম্যলোকের সন্ধান পেলে-আজ আমরা যে পবিত্র ভূমির উপর দিয়ে পদচারণ করছি! সে হচ্ছে শত শত যুগ আগেকার কথা, স্বাধীন ভারতবর্ষে তখনও কোনো বিধর্মী প্রবেশ করতে সাহসী হয়নি৷ খুব সম্ভব তারা যে দেশ থেকে এসেছিল আজ আমরা তাকে মাদ্রাজ বলে জানি৷ ওঙ্কারধামের পাথরে পাথরে তারা যে সংস্কৃত ভাষার লিপি খুদে গেছে, তাই দেখেই এই সত্য জানা যায়৷ ওঙ্কারধামের অসংখ্য মূর্তিও তাদের মৌন ভাষায় আর এক নিশ্চিত সত্য প্রকাশ করবে : যাদের শিল্পনিপুণ হাত তাদের গড়েছে তারা প্রথমে ছিল হিন্দু, তারপর বৌদ্ধ৷
এইখানে গহন বন কেটে তারা বিপুল সভ্যতা ও বিরাট নগর আর দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল৷ তাদের হাতের অমর চিহ্ন আজও প্রায় অটুট হয়েই আছে! ভারতের গান্ধার, সারনাথ বা কোনারকের মতো এখানে আমরা কোনো প্রাচীন শিল্পকীর্তির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাব না, ওঙ্কারধামের শত শত শিলাচিত্র, হাজার হাজার দেবতা-দানব মানব ও পশুর মূর্তি আজও সম্পূর্ণ গৌরবে বিরাজ করছে৷ এখানকার প্রাচীর ও দেওয়ালগুলি দেখলে সন্দেহ হবে, বয়সে তারা মোটেই পুরাতন নয়, সেকালে তারা যেমন শক্ত আর নিরেট ছিল আজও সেই রকমই আছে! বৃষ্টির জল আজও ছাদ ফুটো করতে পারেনি!
. . . মনে হয়, এই ঘণ্টা কয়েক আগেই যেন জীবন্তদের কলকোলাহলে ছিল চারিদিক পরিপূর্ণ হয়ে-দেবদাসীরা পায়ের নূপুর খুলে যেন এই সবে প্রণাম করে বিদায় নিয়ে গেছে, পুরোহিত মন্ত্র পড়ে পুজো সেরে এই সবে যেন চোখের অন্তরালবর্তী হয়েছেন, ধূপধুনো অগুরুর গন্ধ যেন আর একটু আগে এখানে এলেই পাওয়া যেত!
ঐতিহাসিকরা বলেন, একসময়ে ওঙ্কারধামের মতন বড়ো শহর সারা পৃথিবী খুঁজলেও পাওয়া যেত না৷ নবম শতাব্দীর প্রথমে ভারতশিল্পী যখন এই শহরকে সম্পূর্ণ করে তুলেছিলেন, তখন ইউরোপের যেকোনো নগর এর কাছে মাথা হেঁট করতে বাধ্য হত! এথেন্স, রোম, কার্থেজ ও বাবিলন প্রভৃতি বিখ্যাত ও অমর নগর তাদের উন্নতির দিনেও যে ওঙ্কারধামের চেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল, এমন মনে করবার মতো প্রমাণ নেই!
কিন্তু গভীর জঙ্গল আর হিংস্র পশুদের কবলে এত যত্নে গড়া মন্দির আর রাজধানীকে নিক্ষেপ করে কোথায় গেল সেই ভারতীয় রাজা, যোদ্ধা, সওদাগর আর শিল্পীর দল? কোথায় গেল এই সাগরপারে প্রবাসী ভারতীয় সভ্যতা? আজকের বোবা ওঙ্কারধাম সে প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না৷ কেবল মনে হয়, এই ঘণ্টা কয়েক আগে যারা এখান থেকে চলে গিয়েছে যেকোনো মুহূর্তেই তারা আবার ফিরে এসে মন্দির আর নগর পুনরাধিকার করতে পারে!
অবাক হয়ে অতীত ভারতের এই ইতিহাস শুনতে শুনতে মানিক পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে৷ সূর্য তখন সুদূর অরণ্যের মধ্যে অদৃশ্য হয়েছে-পশ্চিম আকাশের মায়াপুরীর রঙিন কিরণমালা তখনও দুলছে হালকা মেঘে মেঘে৷ ওঙ্কারধামের পদ্মফোটা খালের ঝিলমিলে জলে, বট আর নারিকেলকুঞ্জের ভিড়ে ক্রমেই বেশি করে জমে উঠছে আসন্ন সন্ধ্যার ঘনচ্ছায়া! বিভিন্ন দল বেঁধে ছোটো ছোটো মেঘের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বাসার দিকে এবং তাদের কলধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে কানে আসছে দূরের মন্দিরগর্ভ ভেদ করে বৌদ্ধ পুরোহিতদের গম্ভীর মন্ত্র-ছন্দ! শুনলে আত্মা শিউরে উঠে,-এ কি বিংশ শতাব্দীর কন্ঠস্বর না বহুযুগের ওপারে বসে ওঙ্কারধামের গৌরবের দিনে একদিন যারা এখানে উদাত্ত স্বরে স্তবপাঠ করত, তারই সুদীর্ঘ প্রতিধ্বনি আজও বেজে বেজে উঠছে মন্দিরের শিলায় শিলায়, অন্ধকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে!
মানিক হঠাৎ মুখ তুলে সবিস্ময়ে দেখলে, তার সুমুখেই জেগে উঠেছে আশ্চর্য ও বিচিত্র এক নগর-তোরণ! দেখেই সে চিনতে পারলে, কারণ এই বিখ্যাত তোরণের বহু চিত্র ইংরেজি কেতাবে এর আগেই দেখেছে! কিন্তু এর আসল ভাবের কোনো আভাস ছবিতে কেউ ফোটাতে পারেনি৷
খুব উঁচু সেই নগর-তোরণ, তার দ্বারপথ দিয়ে অনায়াসে বড়ো বড়ো হাতি আনাগোনা করতে পারে এবং তার উপরে জেগে রয়েছে চারিদিকে চারিটি বিরাট শিবের মুখ! এমন বৃহৎ শিবের মুখ মানিক জীবনে কোনোদিন দেখেনি!
ওঙ্কারধামের একজন হিন্দু রাজা একখানি শিলালিপিতে এই নগরকে প্রবলপরাক্রান্ত ও ভয়াবহ বলে বর্ণনা করে গেছেন৷ এখানকার হিন্দুরা জীবনধারণ করত তরবারির সাহায্যেই৷ তাদের স্থাপত্যেও প্রকাশ পেয়েছে সেই প্রচণ্ড ভাবই! কারণ বাহির থেকে ভিতরে ঢুকতে গেলেই শিবের যে প্রকাণ্ড মুখখানি দেখা যায়, তা ভয়ানক বটে,-সে যেন আগন্তুককে বলতে চায়, সাবধান! পূর্ব ও পশ্চিম দিকের মুখ দু-খানি যেন অনন্তের ধ্যানে আত্মহারা৷ এবং তোরণের ভিতরদিক থেকে যে মুখখানি নগরের দিকে তাকিয়ে আছে, তার ভিতর থেকে যেন আশীর্বাদ ও বরাভয়ের ভাব আবিষ্কার করা যায়!
প্রলয়কর্তা শিবকে নগররক্ষীরূপে নির্বাচন করে ওঙ্কারধামবাসী ভারতীয়রা উচিত কার্যই করেছে৷ কারণ, বারে বারে তারা যখন দিগবিজয়ে যাত্রা করত পৃথিবীর বুক ভেসে যেত তখন শোণিত প্রবাহে! প্রলয় দেবতার প্রীতির জন্যে লক্ষ লক্ষ শত্রুর প্রাণবলি দিয়ে অবশেষে তারা নিজেরাও পাষাণ দেবতার পায়ে আত্মদান করে চির বিদায় নিয়ে গিয়েছে৷ তাদের স্মৃতির শ্মশানে শেষ পর্যন্ত আজ জেগে আছেন কালজয়ী এবং চির একাকী প্রলয় দেবতাই!
অমলবাবু তোরণের উপরদিকে শিবের ভয়াল মুখের পানে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে নমস্কার করে বললেন, ‘হে মহাদেব, তুমি কেবল লয়কর্তা নও, সৃষ্টি করাও তোমার কাজ! অবোধ প্রাণী আমরা, লোভে অন্ধ হয়ে তোমার আশ্রয়ে ছুটে এসেছি বলে আমাদের অপরাধ নিয়ো না প্রভু, আমাদের তুমি রক্ষা কোরো!’
মানিক হেসে বললে, ‘এই পাথরে গড়া জড় দেবতার যদি রক্ষা করবার শক্তি থাকত, তাহলে ওঙ্কারধাম আজ শ্মশান হয়ে যেত না!’
অমলবাবু ক্রুদ্ধকন্ঠে বললেন, ‘মানিকবাবু, তীর্থক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অমন কথা বলবেন না, এখনি সর্বনাশ হবে৷’
মানিক বললে, ‘সর্বনাশ যদি হয়, তাহলে ওই পাথরের দেবতার জন্যে নিশ্চয়ই হবে না, আমাদের নিজেদের বুদ্ধির ভুলেই হবে!’
মানিকের মুখের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে আসন্ন সন্ধ্যার কালিমাখা স্তব্ধতাকে বিদীর্ণ করে আচম্বিতে জেগে উঠল একটা বন্দুকের শব্দ ও তীব্র আর্তনাদ! তারপরেই আবার বন্দুকের শব্দ!
অমলবাবু ও মানিকের সচকিত দৃষ্টি পরস্পরের মুখের দিকে ফিরল!
মানিক ত্রস্ত স্বরে বললে, ‘শব্দগুলো এল বাংলোর দিক থেকে!’ বলেই সে বেগে ডাকবাংলোর দিকে ছুটে চলল-তার পিছনে অমলবাবু!
বাংলোর হাতার মধ্যে ঢুকেই দেখা গেল, সুন্দরবাবু খুব ব্যস্তভাবে একটা বন্দুক নিয়ে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছেন!
মানিক তাড়াতাড়ি শুধোলে, ‘এখানে বন্দুক ছুড়লে কে? আর্তনাদ করলে কে?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘আমিও তোমাদের ঠিক ওই কথাই জিজ্ঞাসা করতে চাই?’
-‘জয়ন্ত কোথায়?’
-‘সে তো এইখানেই ঘোরাঘুরি করছিল!’
মানিক চিৎকার করে ডাকলে, ‘জয়ন্ত! জয়ন্ত!’
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না৷
মানিক বললে, ‘সুন্দরবাবু আপনি ওইদিকে গিয়ে খুঁজুন! অমলবাবু আপনি ওইদিকে যান! আমি এইদিকটা খুঁজে দেখি!’
তিন জনে তিন দিকে ছুটল৷ সন্ধ্যা তখনও মানুষের চোখ অন্ধ করবার মতো অন্ধকার সৃষ্টি করেনি-শেষ পাখির দল তখনও বাসায় ফিরছে! কিন্তু মন্দিরের বৌদ্ধ পুরোহিতের কন্ঠ আর শোনা যাচ্ছে না, নীরবতার মাঝখানে ছন্দ সৃষ্টি করছে কেবল তরুপল্লবের দীর্ঘশ্বাস!
হঠাৎ সুন্দরবাবুর ভীত কন্ঠস্বর শোনা গেল-‘মানিক! অমলবাবু! এইদিকে এইদিকে!’
মানিক সেইদিকে ঝড়ের মতন ছুটে গিয়ে দেখলে, একটা গাছের তলায় সুন্দরবাবু হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর হাতে রয়েছে একটা সোলার টুপি!
‘কী সুন্দরবাবু, ডাকলেন কেন?’
‘হুম, এ কী কাণ্ড! জয়ন্তের টুপি এখানে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছিল, কিন্তু জয়ন্ত কোথায়?’
ততক্ষণে অমলবাবুও আর একদিক দিয়ে ছুটে আসতে আসতে হঠাৎ একজায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এখানে এত রক্ত কেন?’
মানিক উদভ্রান্তের মতো আবার সেইদিকে দৌড়ে গেল৷ আড়ষ্ট চোখে চেয়ে দেখলে, সেখানকার মাটি রক্তে যেন ভেসে যাচ্ছে!
সে প্রায় অবরুদ্ধ স্বরে বললে, ‘এ কার রক্ত?’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘কিন্তু জয়ন্ত কোথায়?’
অমলবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বললেন, ‘মহাকালের অভিশাপ! মানিক, তোমার নাস্তিকতার ফল দেখো!’