কলিকাতায় ভেনিসের একরাত্রি

জয়ন্ত ও মানিক সেদিন ডিনার খেতে গিয়েছিল,-পার্ক স্ট্রিটে এক হালফ্যাশানি বন্ধুর বাড়িতে৷

জয়ন্ত ও মানিক থাকে বাগবাজারে, কিন্তু তাদের পার্ক স্ট্রিটবাসী এই বন্ধুটি ছিলেন সেই জাতীয় মনুষ্য, যাঁরা বিশ্বাস করেন যে, হগসাহেবের বাজারের উত্তরে আর আধুনিক ভদ্রলোকের বাস নেই৷ অতএব হগসাহেবের বাজারের দক্ষিণ দিকে আস্তানা গেড়ে এঁরা কোঁচানো কাপড় পরেন না, শিঙাড়া কচুরি খেতে ভালোবাসেন না, অ-আ ক-খ ব্যবহার করেন না, ঘড়ি ধরে দাড়ি কামান, হাঁচেন-কাশেন, স্বপ্ন দেখেন৷

জয়ন্ত ও মানিক যে এই শ্রেণির বন্ধুর খুব অনুরাগী ছিল, তা নয়৷ কলেজ ছাড়বার পর এঁর সঙ্গে পথে-ঘাটে তাদের দেখা হয়েছে কালেভদ্রে কদাচ৷ শখের গোয়েন্দাগিরিতে বারংবার আশ্চর্যরূপে সফল হয়ে জয়ন্ত আজকাল কলকাতার একজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তি বলে গণ্য হয়েছে এবং সেই খ্যাতির কিছু কিছু অংশ মানিকও পেয়েছে৷ তাদের মতন লোককে নিমন্ত্রণ করে এখন বাড়িতে আনতে পারলেও অনেকে সৌভাগ্য বলে মনে করে৷ হয়তো সেইজন্যেই পার্ক স্ট্রিট আজ বাগবাজারকে করেছে ডিনার খাবার নিমন্ত্রণ! বাগবাজারকে চমকে দেবার জন্যে পার্ক স্ট্রিট কোনো আয়োজনেই ত্রুটি করেনি৷ সে-সব দেখে জয়ন্ত ও মানিক কোনোরকম বিস্ময় প্রকাশ করলে না বলে গৃহকর্তা বোধ হয় মনে মনে কিঞ্চিৎ হতাশ হলেন৷

কিন্তু খানা খাবার টেবিলের উপরে মেনুতে খাদ্যের ফরাসি নামগুলি তাদের কাছে বড়ো বাড়াবাড়ি বলে মনে হল৷

জয়ন্ত বললে, ‘ওহে, এই ফরাসি নামগুলোর ভেতরে গোরু আর শুয়োরের মাংস লুকিয়ে নেই তো?’

গৃহকর্তা এতক্ষণে তো পেয়ে অট্টহাস্য করে বললেন, ‘কেন হে, গোরু আর শুয়োর সম্বন্ধে এখনও তোমাদের প্রাচীন কুসংস্কার আছে নাকি?’

জয়ন্ত গম্ভীর হয়ে বললে, ‘তোমার কথার উত্তর দিতে গেলে তর্ক করতে হয়৷ খানার টেবিলের সামনে সে তর্ক করার অভ্যাস আমার নেই৷ আসল কথা, ও দু-টি খাবার আমরা পছন্দ করি না৷’

খানা শেষ হলে পর সকলে পাশের একটি ঘরে গিয়ে বসলেন৷ সে ঘরটি একেবারে একেলে কায়দায় সাজানো৷ দেওয়ালে কিউবিস্ট চিত্রকরদের আঁকা ছবি, টেবিল-চেয়ার প্রভৃতি আসবাবও কিউবিস্ট কারিগরদের দ্বারা গড়া, এমনকী ঘরের মেঝের মোজেকের উপরেও কিউবিজমের প্রভাব৷

গৃহকর্তা বললেন, ‘জয়ন্ত, এ ঘরটির ডেকোরেশান তোমার কেমন লাগছে?’

-‘বেশ৷ কিন্তু ভারতবাসী যখন ঘরবাড়ি সাজায় তখন সে যদি ভারতের প্রাচীন শিল্পের আদর্শের দিকে লক্ষ রাখে, তাহলে আমি বেশি খুশি হই৷’

-‘কিন্তু আমি চাই আপ-টু-ডেট হতে৷ কিউবিজম হচ্ছে হাল-ফ্যাশানের ঢেউ৷’

-‘না, কিউবিজমের বয়েস হল ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বৎসর৷ এখনকার আর্টে হালফ্যাশান এনেছেন হাইপার রিয়ালিস্ট শিল্পীরা৷ তাদের নাম তুমি শুনেছ?’

-‘না৷’

-‘তাহলে পার্ক স্ট্রিটে বাস করেও তুমি আপ-টু-ডেট হতে পারনি৷ তুমি জানো, যিনি কিউবিজম আবিষ্কার করেছেন, তিনি এখন কিউবিজম ছেড়ে অন্য পদ্ধতিতে ছবি আঁকছেন?’

-‘না৷’

-‘তাহলে হে বন্ধু, তুমি পার্ক স্ট্রিটের কালো কলঙ্ক!’

বন্ধু মনে মনে রেগে ঠোঁট কামড়ালেন৷ অধিকাংশ আধুনিক বাঙালি-সাহেবের মতন তিনিও লোক-দেখানো আধুনিক হয়েছেন, আর্টের অত খুঁটিনাটির খবর রাখবার উৎসাহ তাঁর নেই৷

ডিনারের পর কফির পালা৷ কিন্তু কফির পেয়ালায় চুমুক দেওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই নামল যেন আকাশ ভেঙে বৃষ্টির ধারা৷ হু-হু করে ঝোড়ো-হাওয়া ঘরের ভিতরে ঢুকে প্রথমেই কিউবিস্টদের আঁকা ছবিগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে৷ তখনি তাড়াতাড়ি দরজা-জানলা বন্ধ করে দেওয়া হল৷

এক, দুই, তিন ঘণ্টা গেল, তখনও ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে৷

জয়ন্তের চোর-ডাকাত ধরার কাহিনি শুনে গৃহকর্তার সময় কিন্তু বেশ কেটে যাচ্ছে৷ তাঁর গল্প শোনার উৎসাহ যেন ফুরোতেই চায় না৷ কিন্তু শেষ-গল্প শেষ করবার আগেই ঘড়িতে বাজল সাড়ে-বারোটা৷ জয়ন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘আর অপেক্ষা করা চলে না৷ পার্ক স্ট্রিট থেকে বাগবাজার-মস্ত লম্বা দৌড়! ওঠো মানিক!’

গৃহকর্তা বললেন, ‘কিন্তু এখনও বৃষ্টি পড়ছে যে!’

-‘পড়ুক৷ চলো মানিক!’

গাড়ি বারান্দার তলাতেই তাদের মোটর দাঁড়িয়েছিল, তারা মোটরে গিয়ে উঠল৷

চৌরঙ্গি তখন একটা প্রকাণ্ড হ্রদে পরিণত হয়েছে৷ সেই জলরাজ্যে জনপ্রাণীর সাড়া নেই, কেবল সরকারি আলোক-স্তম্ভগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে দীপ্তনেত্রে যেন সেই নির্জন রাজ্য শাসন করছে, নীরবে৷

চৌরঙ্গি ছাড়িয়ে মোটর যখন সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে প্রবেশ করল পথের জলও তখন বেড়ে উঠল৷ যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখলে মনে হয়, শহরের বুকের ভিতরে সুদীর্ঘ এক নদীর আবির্ভাব হয়েছে!

মানিক বললে, ‘বর্ষায় কলকাতায় বাস করলে ভেনিসে বাস করা হয়, কারণ তখন কলকাতার রাজপথের সঙ্গে ভেনিসের জলপথের কোনো তফাতই থাকে না৷’

জয়ন্ত বললে, ‘কেবল দীর্ঘশ্বাসের সেতু আর গন্ডোলা নৌকার অভাব৷’

-‘গন্ডোলার অভাব কর্পোরেশনের দূর করা উচিত৷ বর্ষাকালের জন্যে কলকাতার মাঝে মাঝে খেয়াঘাট বসিয়ে নৌকো রাখার ব্যবস্থা করা দরকার৷ আর দীর্ঘশ্বাসের সেতুর কথা বলছ? বর্ষার সময়ে সারা কলকাতা যত দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তা দিয়ে কি শত শত সেতু তৈরি করা যায় না?’

কিন্তু জয়ন্ত কোনো জবাব দেবার আগেই তাদের মোটর হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে পড়ল৷

ড্রাইভার বললে, ‘হুজুর, গাড়ি আর চলবে না!’

জয়ন্ত বললে, ‘গাড়ি তো আর নৌকো নয়, এতক্ষণ সে যে নৌকোর কর্তব্যপালন করতে নারাজ হয়নি, এইটুকুই আশ্চর্য! এসো মানিক, এখন জলে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া কোনো উপায়ই নেই!’

সেখানটা হ্যারিসন রোডের মোড়৷ বাগবাজার তখন অনেক দূরে৷ দু-জনে জল ভাঙতে ভাঙতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হল,-পথের জল প্রবাহ ঠিক নদীর মতোই কোলাহল করতে করতে ছুটে চলেছে এবং জলের মাঝে মাঝে ভাসছে মরা ও পচা ইঁদুর, কুকুর ও বিড়ালের দেহ!

মানিক ঘৃণায় নাক টিপে ধরে বললে ‘বাড়িতে গিয়ে জলে পার্মাঙ্গেনেট অফ পটাস গুলে গা না ধুলে আর রক্ষা নেই! জয়, পার্ক স্ট্রিটের ডিনার বুঝি আর বাগবাজারি পেটে থাকে না! থুঃ থুঃ!’

জয়ন্ত বললে, ‘আমি বলি, জয় কর্পোরেশনের! আধুনিক কলকাতার টেক্সো যত বাড়ছে, তার রাস্তার জলের পরিমাণও সেই অনুপাতে দিব্যি বেড়ে উঠছে! অথচ আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপায়ে জল নিকাশের ব্যবস্থা করবার অজুহাতে কত লক্ষ টাকা খরচ করা হচ্ছে!’

দু-জনে বিরক্ত মনে হোঁচট খেতে খেতে এগিয়ে চলল, তখন তাদের দুর্দশা দেখবার জন্য পথে একটা জ্যান্ত কুকুর পর্যন্ত হাজির ছিল না৷ লাল পাগড়ি পর্যন্ত অদৃশ্য! বৃষ্টি তখনও থামেনি এবং ঝোড়ো বাতাস তখনও বন্ধ জানলায় মাথা খুঁড়ে ভিতরে ঢুকতে না পেরে কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছে!

হঠাৎ জয়ন্ত বলে উঠল, ‘হুঁ, এই তো চোরের শুভমুহূর্ত! মানিক, তুমি কি একটা মানুষ-টিকটিকি দেখতে চাও?’

মানিক বিস্মিত নেত্রে জয়ন্তের মুখের পানে তাকালে৷

জয়ন্ত আঙুল তুলে বললে, ‘আমার মুখের পানে তাকিয়ে তুমি আমার মুখ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না,-ওই বাড়িখানার তিনতলার দিকে তাকাও!’

পাশেই একখানা ত্রিতল বাড়ি! একটা মনুষ্য-মূর্তি দেয়াল বেয়ে উপরে উঠছে!

মানিক বললে, ‘চোর! কিন্তু কেমন করে লোকটা উপরে উঠছে?’

‘ট্যাঙ্কের জলের পাইপ ধরে৷’

লোকটা হাত বাড়িয়ে বারান্দার রেলিং ধরলে, তারপর ভিতরে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল৷

জয়ন্ত বললে, ‘এসো, দেখা যাক চোরটাকে ধরতে পারা যায় কি না?’

জয়ন্ত বাড়ির সদর দরজায় গিয়ে খুব জোরে কড়া নাড়তে লাগল৷ খানিকক্ষণ পরে ভিতর থেকে হিন্দুস্থানি গলায় কে শুধোলে, ‘কোন হায় রে?’

-‘বাইরে এসে দেখো না বাবা, চ্যাঁচাও কেন? বাড়িতে চোর ঢুকেছে!’

হঠাৎ রাস্তার দিক থেকে কোথায় কে তীক্ষ্ণ শিস দিলে!

জয়ন্ত চারিদিকে চেয়ে কারুকেই দেখতে পেলে না৷ বললে, ‘মানিক, এ চোর একলা আসেনি৷ তার দলের লোক নীচে কোথাও লুকিয়ে পাহারা দিচ্ছে৷ শিস দিয়ে উপরের চোরকে সে সাবধান করে দিলে৷’

দরজা খুলে বেরুল গালপাট্টাওয়ালা মস্ত একখানা মুখ৷

জয়ন্ত বললে, ‘দারোয়ানজি, রাস্তা থেকে দেখলুম একটা চোর পাইপ ধরে তিনতলার বারান্দার গিয়ে উঠল! তাকে ধরতে চাও তো শিগগির আমাদের নিয়ে ওপরে চলো!’

দারোয়ান তখনি কোণ থেকে নিজের লাঠিটা তুলে তিন বার মাটিতে ঠুকে যা বললে তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে, এই লাঠি দিয়ে সে যদি আজ চোরের মাথাটা কাঁধের উপর থেকে উড়িয়ে দিতে না পারে, তাহলে মিথ্যাই তার নাম হাতি সিং!

তার সঙ্গে জয়ন্ত ও মানিক সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতপদে উপরে উঠতে লাগল৷

একেবারে তিনতলার বারান্দায়! তিনতলার দুটো দরজা রয়েছে, দুটোই বন্ধ৷

একটা দরজার সামনে গিয়ে দারোয়ান ডাকলে, ‘হুজুর, হুজুর!’

কেউ সাড়া দিলে না৷

কিন্তু জয়ন্তের তীক্ষ্ণ কাণ শুনতে পেলে, ঘরের ভিতরে ঝটাপটির শব্দ হচ্ছে!

সে দরজায় পিঠের বামদিক রেখে দাঁড়াল৷ তার সেই ছয় ফুট চার ইঞ্চি উচুঁ দেহ আসুরিক শক্তির জন্যে বিখ্যাত, আর এ তো তুচ্ছ একটা কাঠের কবাট! তার দেহের এক ধাক্কায় ভিতরের খিল ভেঙে গেল-দরজার কবাট সশব্দে খুলে গেল!

ঘরে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার! প্রথমেই দেখা গেল রাস্তার বারান্দার দিকের খোলা দরজা দিয়ে একটা মূর্তি বেরিয়ে যাচ্ছে!

হাতি সিং ছুটে গিয়ে বাঘের মতো তার উপরে লাফিয়ে পড়ল৷

প্রথমেই একটা শব্দ হল,-কার হাত থেকে কী একটা জিনিস যেন মাটির উপরে পড়ে ভেঙে গেল! তারপরেই চোখের পলক না পড়তেই বিপুলবপু হাতি সিং কুপোকাত!

জয়ন্তও একলাফে বারান্দায় গিয়ে পড়ল, কিন্তু চোর তখন সেখানে নেই! বারান্দার রেলিংয়ে ঝুঁকে পড়ে জয়ন্ত দেখলে, জলের পাইপ ধরে আশ্চর্য বেগে সে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে! তাকে আর ধরবার চেষ্টা করা বৃথা৷

অন্ধকার ঘরে ঢুকে সে বললে, ‘হাতি সিং, তুমি উঠেছ?’

হিন্দি ভাষায় সাড়া এল, ‘উঠেছি বাবুজি! বড়োই জোয়ান চোর, ধরে রাখতে পারলুম না!’

-‘সে তোমার দোষ নয়৷ আলোর সুইচ কোথায়?’

হাতি সিং আলো জ্বালল৷

ঘরের একদিকে একখানা খাট৷ ঠিক তলাতেই মেঝের উপরে পড়ে একটি প্রৌঢ় বাঙালি ভদ্রলোক অত্যন্ত হাঁপাচ্ছেন৷

জয়ন্ত ও মানিক তাঁর পাশে গিয়ে বসল৷ প্রথমেই জয়ন্তের চোখ পড়ল ভদ্রলোকের গলার উপরে-সেখানে মানুষের আঙুলের রাঙা ছাপ! চোর তাঁর গলা টিপে ধরেছিল৷

ভদ্রলোকের বয়স হবে চল্লিশ৷ মাথায় কাঁচা-পাকা চুল৷ গৌরবর্ণ৷ দোহারা দেহ৷

হাতি সিং জল এনে তাঁর গলায় ও মুখে ঝাপটা দিতে লাগল৷ খানিকক্ষণ পরে ভদ্রলোক কতকটা সামলে নিয়ে উঠে বসলেন৷ ধীরে ধীরে বললেন, ‘আপনারা কে তা জানি না৷ কিন্তু আপনারা না এসে পড়লে আমি বাঁচতুম না৷ গেল হপ্তায় আমার সহকারী বন্ধু সুরেন বাবুকে কে খুন করেছে, আর আজ আমিও পরলোকে চলে যাচ্ছিলুম!’

মানিক বললে, ‘আমি খবরের কাগজে পড়েছি, গেল হপ্তায় বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক অমল চন্দ্র সেনের সহকারী সুরেন্দ্র নাথ বসুকে কে হত্যা করে পালিয়েছে৷ আপনি কি সেই সুরেনবাবুর কথা বলছেন?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

-‘তাহলে আপনিই হচ্ছেন প্রত্নতাত্ত্বিক-‘

-‘অমল চন্দ্র সেন৷’

জয়ন্ত অবাক হয়ে অমলবাবুর মুখের দিকে তাকালে৷ অমলবাবুর বিখ্যাত নাম সেও শুনেছে বটে, কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিকের নিরীহ দেহের উপরে এমন মারাত্মক আক্রমণ কেন? পুরানো পোকায়-কাটা পুঁথিপত্র, অচল সেকেলে মুদ্রা আর ভাঙা ইট-কাঠ-পাথর নাড়াচাড়া করা যাঁদের একমাত্র পেশা, তাঁদেরই একজনকে পাঠানো হয়েছে পরলোকে এবং আর একজনকেও-

তার চিন্তায় বাধা পড়ল৷ অমলবাবু হঠাৎ সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘ওকী, ওই বুদ্ধমূর্তিটা ওখানে পড়ে কেন? ওটা ভাঙলই বা কী করে?’

জয়ন্ত চেয়ে দেখলে, বারান্দার দিকে দরজার সামনে মাটির উপরে একটি বুদ্ধমূর্তি পড়ে রয়েছে, তার মুণ্ড ভেঙে আরেকদিকে গড়িয়ে গিয়েছে৷

সে বললে, ‘এখন বোঝা যাচ্ছে, হাতি সিং যখন চোরকে আক্রমণ করে, তখন ওই মূর্তিটাই চোরের হাত থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল! শব্দটা আমি তখনি শুনেছিলুম, কিন্তু কারণ বুঝতে পারিনি৷’

অমলবাবু উত্তেজিত কন্ঠে বললেন, ‘এত জিনিস থাকতে চোর ওই বুদ্ধমূর্তি নিয়ে পালাচ্ছিল? চোর ওই-বুদ্ধমূর্তি-নিয়ে’ বলতে বলতে তিনি হঠাৎ আবার থেমে গেলেন!

জয়ন্ত নীরবে তাঁর ভাবভঙ্গি লক্ষ করতে লাগল৷ সে বেশ বুঝলে, অমলবাবু আজকের এই বিপদের একটা হদিস খুঁজে পেয়েছেন৷

খানিকক্ষণ পরে অমলবাবু বললেন, ‘আপনারা আমার প্রাণরক্ষা করলেন, কিন্তু আপনাদের পরিচয় জানা হল না তো?’

জয়ন্ত বললে, ‘জানাবার মতো পরিচয় আমাদের কিছুই নেই৷ আমার নাম জয়ন্ত আর আমার বন্ধুর নাম মানিকলাল৷ আমাদের শখ হচ্ছে গোয়েন্দাগিরি৷’

-‘আপনাদের কথা আমিও বোধ হয় শুনেছি৷ বৈজ্ঞানিক অপরাধী ভবতোষ মজুমদারকে আপনারাই কি ধরিয়ে দিয়েছিলেন?’

-‘অনেকটা তাই বটে৷ কিন্তু পুলিশ বলবে ভবতোষকে ধরেছিলেন ইনস্পেক্টার সুন্দরবাবু৷’

-‘পুলিশ যা বলে বলুক, কিন্তু আসল বাহাদুরি কার লোকে তা জানে৷ আপনারা এখানে এলেন কেমন করে?’

জয়ন্ত সব খুলে বললে৷ অমলবাবু বললেন, ‘জয়ন্তবাবু, ভগবান আপনাদের এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন৷’

জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘অনেকটা সেইরকমই মনে হয় বটে! নইলে হঠাৎ এই দুর্যোগ, জলমগ্ন রাস্তা, মোটরের বিদ্রোহ, যথাসময়ে আপনার বাড়ির সামনে আমাদের আবির্ভাব-এ-সমস্তই অর্থহীন হয়ে পড়ে!’

অমলবাবু বললেন, ‘দেখুন, ওই বুদ্ধমূর্তিটি এতদিন আমার সহকারী সুরেনবাবুর বাড়িতে ছিল৷ ওই মূর্তিটি আমরা চার মাস আগে কাম্বোডিয়ায় গিয়ে পেয়েছিলুম৷’

-‘কাম্বোডিয়ায়? যেখানে জঙ্গলের ভিতরে প্রসিদ্ধ প্রাচীন হিন্দু মন্দির ওঙ্কারধাম আছে?’

-‘হ্যাঁ৷ সেই পিরামিডের চেয়েও আশ্চর্য মন্দির থেকে আরও তফাতে, জঙ্গলের ভিতরে প্রাচীন হিন্দুদের আরও অনেক কীর্তি লুকানো আছে৷ খোঁজে গিয়েই আমরা এই বুদ্ধমূর্তিটি পাই৷ এই মূর্তি পাওয়ারও একটা বিচিত্র ইতিহাস আছে, সে কথা পরে বলব৷’

জয়ন্ত বললে, ‘মূর্তিটি এতদিন সুরেনবাবুর কাছে ছিল,-তারপর?’

অমলবাবু বললেন, ‘গেল হপ্তায় একদিন ওই মূর্তিটি আমার পরীক্ষা করবার দরকার হয়৷ আমি মূর্তিটি সুরেনবাবুর কাছ থেকে আনিয়ে নিই৷ ঠিক সেই রাত্রেই কে সুরেনবাবুকে গলা টিপে হত্যা করে৷ কেবল তাই নয়৷ সুরেনবাবুর ঘরে আরও অনেক মূর্তি ছিল, হত্যাকারী যে সেগুলো নিয়েও নাড়াচাড়া করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ কিন্তু হত্যাকারী কোনো জিনিস বা মূর্তি নিয়ে যায়নি৷ পুলিশ এই হত্যার কোনো যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে পায়নি৷ জয়ন্তবাবু, হত্যাকারী কীসের খোঁজে সুরেনবাবুর ওখানে গিয়েছিল, বলতে পারেন?’

-‘আপনার আর কিছু বলবার আছে?’

-‘আছে, আমার কোনো শত্রু নেই৷ আজ রাত্রে আপনাদের কড়ানাড়ার শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল৷ খাট থেকে যেই নেমেছি, অমনি কে আমার গলা টিপে ধরলে-আমি অজ্ঞানের মতো হয়ে গেলুম৷ এখন দেখছি, আমার ঘরেও এক হত্যাকারী এসে আর কিছু না নিয়ে ওই বুদ্ধমূর্তি নিয়েই পালাচ্ছিল, যে-মূর্তি এতদিন সুরেনবাবুর ঘরে ছিল!’

মানিক বললে, ‘আমার তো মনে হয়, সুরেনবাবুকে খুন করে সেখানে ওই বুদ্ধমূর্তি না পেয়ে হত্যাকারী আজ আপনার এখানে খুঁজতে এসেছিল৷’

জয়ন্ত কিছু বললে না৷ দরজার কাছে গিয়ে বুদ্ধমূর্তির দেহ ও মাথা মাটির উপর থেকে কুড়িয়ে নিলে৷

মূর্তিটি চুনাপাথরে গড়া ধ্যানী বুদ্ধের, উচ্চতায় এক হাতের বেশি হবে না৷


© 2024 পুরনো বই