আমার বন্ধু জয়ন্ত গোয়েন্দাগিরি করে এখন যথেষ্ট যশস্বী হয়েছে। সে যে কত মামলার কিনারা করেছে, তার আর সংখ্যা হয় না। কিন্তু তার প্রথম মামলার কথা আজ। পর্যন্ত লিপিবদ্ধ হয়নি। মামলাটি যদিও বিশেষ অসাধারণ নয়, তবু তরুণ বয়স থেকেই সে যে কীরকম আশ্চর্য পর্যবেক্ষণ শক্তির অধিকারী ছিল, আমার এই কাহিনির ভিতরে তার উজ্জ্বল পরিচয় পাওয়া যাবে।
আমি আর জয়ন্ত তখন থার্ড-ইয়ার-এর ছাত্র। সে যে ভবিষ্যতে একজন বিখ্যাত গোয়েন্দা হবে, জয়ন্ত তখনও একথা জানত না বটে, কিন্তু সেই সময় থেকেই দেশ-বিদেশের অপরাধী-বিজ্ঞান, নামজাদা গোয়েন্দা ও অপরাধীদের কার্যকলাপ নিয়ে দস্তুরমতো মস্তিষ্ক চালনা শুরু করে দিয়েছিল। সময়ে সময়ে অতি তুচ্ছ সূত্র ধরে সে এমন সব বৃহৎ বৃহৎ তথ্য আবিষ্কার করত যে, আমরা তার সহপাঠীরা বিস্ময়ে অবাক না হয়ে পারতুম না।
একটি বৈকাল। জয়ন্ত ও আমি গোলদিঘিতে পায়চারি করছি। এমন সময় তপনের সঙ্গে দেখা। সেও আমাদের কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্র। বনিয়াদি বংশের ছেলে। তার পূর্বপুরুষেরা আগে বিপুল সম্পত্তির মালিক ছিলেন। তাদের আধুনিক অবস্থা ততটা উন্নত না হলেও, এখনও তারা ধনবান বলে পরিচিত হতে পারে। আজও তাদের বাড়িতে দোল-দুর্গোৎসবে সমারোহের অভাব হয় না।
জয়ন্তকে দেখেই তপন বলে উঠল, আরে, তোমাকেই খুঁজছি যে।
জয়ন্ত শুধালে, আমাকে খুঁজছ কেন?
–একটা হেঁয়ালির অর্থ জানতে চাই।
কীরকম হেঁয়ালি?
আমাদের বাড়িতে একটা ঘটনা ঘটেছে। গুরুতর কিছু নয় বটে, কিন্তু যথেষ্ট কৌতূহলদ্দীপক। এ ব্যাপারে তোমার মাথা খুব খেলে কিনা, তাই তোমার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই।
–ঘটনাটা বলো।
–এই ভিড়ে নয়, আমার বাড়িতে চল। মনে কোরো না কেবল ঘটনাটা বলবার জন্যেই তোমাদের বাড়িতে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। যৎসামান্য ঘটনা, তুচ্ছ চুরি–কোনও ছিঁচকে চোরের কীর্তি। কিন্তু তোমাদের সঙ্গ আমার ভালো লাগে, তাই একসঙ্গে বসে চা-টা খেতে-খেতে কিছুক্ষণ গল্পসল্প করতে চাই।
আমার দিকে ফিরে জয়ন্ত বললে, কি হে মানিক, রাজি আছ?
আমি বললুম, মন্দ কি! অন্তত খানিকটা সময় কাটানো যাবে তো।
.
দুই
তপনদের সাজানো-গুছানো বৃহৎ বৈঠকখানা। চা এল, খাবার এল।
তপন বললে, আগে ঘটনাটা শোনো, তোমার মত বলো, তারপর অন্য গল্পসল্প। দেখ, আমার প্রপিতামহ স্বর্গীয় তারাশঙ্কর চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত খেয়ালি মানুষ। কোন খেয়ালে জানি না, তিনি গুটিকয় দেব-দেবীর মূর্তি গড়িয়েছিলেন। বিষ্ণু, মহাদেব, কৃষ্ণ, রাধা, কালী, লক্ষ্মী আর সরস্বতী–এই সাতটি মূর্তি। ওর মধ্যে লক্ষ্মীর মূর্তিটিই সবচেয়ে বড় লম্বায় এক ফুট। অন্য অন্য মূর্তির কোনওটি আট ইঞ্চি লম্বা, কোনওটি ছয় ইঞ্চি। মূর্তিগুলি বেশ ভারী। কি দিয়ে গড়া জানি না, বাবা বলতেন পিতলের মূর্তি। কিন্তু বাহির থেকে বোঝবার উপায় ছিল না, কারণ প্রত্যেক মূর্তির আপাদমস্তক ছিল রঙিন এনামেল দিয়ে ঢাকা। ঠাকুরঘরের মধ্যে একটি গ্লাস-কেসের ভিতরে মূর্তিগুলি সাজানো ছিল আমার প্রপিতামহের আমল থেকেই। আমার ঠাকুরদা কি বাবা, ও মূর্তিগুলো নিয়ে কিছুমাত্র মাথা ঘামাননি, আমিও মাথা ঘামানো দরকার মনে করিনি। কিন্তু সম্প্রতি এক ব্যক্তি তাদের নিয়ে রীতিমতো মাথা না ঘামিয়ে পারেনি।
–কে সে?
–কোনও অজ্ঞাত চোর।
–তাহলে মূর্তিগুলি চুরি গিয়াছে?
হ্যাঁ।
কবে?
–তিন দিন আগে।
–মূর্তিগুলি কি মূল্যবান?
–মূল্যবান হলে সেগুলিকে কাচের আধারে ওভাবে ঠাকুরঘরে ফেলে রাখা হত না। শিল্পের দিক দিয়েও তাদের কোনও মূল্য থাকতে পারে তো?
–মোটেই নয়, মোটেই নয়। অতি সাধারণ মূর্তি, শিল্পীরা তাদের দিকে ফিরেও তাকাবে । কেবল এনামেল করা মূর্তি এইটুকুই যা, বিশেষত্ব। তবে সেজন্য কেউ-ই তাদের খুব বেশি দাম দিয়ে কিনতে রাজি হবে না। কিন্তু মজার কথা কি জানো। আমার অতি খেয়ালি প্রপিতামহ তার উইলেও মূর্তিগুলির উল্লেখ করতে ভোলেননি।
কীরকম?
উইলে তিনি বলেছেন, তার কোনও বুদ্ধিমান বংশধরের জন্য ওই মূর্তিগুলি আর সত্যনারায়ণের পুঁথিখানি রেখে গেলেন, যে ওগুলির সদ্ব্যবহার করতে পারবে। মূর্তি আর পুঁথি যেন সযত্নে রক্ষা করা হয়।
বটে, বটে! এতক্ষণ পরে একটা চিত্তাকর্ষক কথা শুনলুম। সত্যনারায়ণের পুঁথি কি তপন?
–সেকালে হাতে লেখা একখানা পুরাতন পুঁথি। সত্যনারায়ণের পুজার সময়ে পুঁথিখানি পাঠ করা হয়।
–আচ্ছা, পুঁথির কথা পরে হবে, আগে চুরির কথা বলো।
পরশু দিন মামাতো-বোনের বিয়ে ছিল। বাড়ির সবাইকে নিয়ে মামার বাড়িতে রাত কাটাতেই হয়েছিল। কাল সকালে ফিরে এসে দেখি গ্লাস-কেসের ভিতর থেকে মূর্তিগুলি অদৃশ্য হয়েছে।
ঠাকুরঘরের দরজা কি তালাবন্ধ থাকত না?
–থাকত বইকী! চোর অন্য কোনও চাবি দিয়ে তালাটা খুলে ফেলেছিল।
–মূর্তি ছাড়া আর কিছু চুরি যায়নি?
–না। এও এক আশ্চর্য কথা। ঠাকুরঘরের লক্ষ্মীর হাঁড়ির ভিতর ছিল আকবরী মোহর, কিছু কিছু রূপোর বাসনকোশন, গৃহদেবতা রঘুনাথের রূপোর সিংহাসন, সোনার ছাতা, চুড়া, পৈতা আর খড়ম। চোর কিন্তু সেসব স্পর্শ করেনি। সে যেন খালি মূর্তিগুলো চুরি করবার জন্যেই এখানে এসেছিল।
–পুলিশে খবর দিয়েছ?
–এই সামান্য চুরির মামলা নিয়ে পুলিশ হাঙ্গামা করতে ইচ্ছেই হচ্ছে না।
কারুর ওপরে তোমার সন্দেহ হয়?
কাকে সন্দেহ করব? দাস-দাসী, পাঁচক, দ্বারবান সকলেই বাবার আমলের পরীক্ষিত লোক, এতদিন পরে তাদের কারুর ওই তুচ্ছ মূর্তিগুলোর ওপরে দৃষ্টি পড়বে কেন? তারা ছাড়া বাড়িতে থাকেন শীতলবাবু। তার কর্তব্য দুরকম। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ানো। আর এটা ওটা সেটার তত্ত্বাবধান করা। তিন বছর কাজ করছেন, প্রায় আমাদের সংসারেরই একজন হয়ে উঠেছেন। গরিব হলেও লেখাপড়া জানা নিরীহ সচ্চরিত্র ব্যক্তি সকল রকম সন্দেহের অতীত।
জয়ন্ত বললে, তোমাদের ওই সত্যনারায়ণের পুঁথির কথা এইবার বলো। তোমার প্রপিতামহ ওই পুঁথিখানাতেও যখন সযত্নে রক্ষা করতে বলেছেন, তখন ওর মধ্যেও নিশ্চয়। কোনও বিশেষত্ব আছে।
তপন বললে, বিশেষত্ব? পুঁথির ভিতরে আবার কি বিশেষত্ব থাকবে? বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে একটু ভেবে সে আবার বললে, না-না, একটা বিশেষত্ব আছে বটে, কিন্তু তার সঙ্গে মূর্তি চুরির কোনও সম্পর্কই থাকতে পারে না।
জয়ন্ত বললে, হয়তো, কোনওই সম্পর্ক নেই। তবু বিশেষত্বের কথাটা শুনে রাখা উচিত।
তপন উঠে দাঁড়িয়ে বললে, পুঁথিখানা আমি এখনি নিয়ে আসছি, তুমি স্বচক্ষে দেখতে পারো।
.
তিন
তপন নিয়ে এল পুঁথিখানা।
জয়ন্ত তার পাতা ওলটাতে-ওলটাতে বললে, খুব প্রাচীন পুঁথি বটে। কিন্তু তপন, আর কোনও বিশেষত্বই তো দেখতে পাচ্ছি না।
–পুঁথি যেখানে শেষে হয়েছে, বিশেষত্বটা খুঁজে পাবে সেইখানে।
যথাস্থানে দৃষ্টিপাত করে কিছুক্ষণ মৌন মুখে বসে রইল জয়ন্ত। আরও লক্ষ করলুম, তার দুই চক্ষে ফুটে উঠেছে জ্বলন্ত কৌতূহল।
পুঁথি থেকে মুখ তুলে অবশেষে সে বললে, এখানে ভিন্ন হাতের একটু লেখা রয়েছে।
তপন বললে, হা, হিজিবিজি হেঁয়ালি। কোন ভাষা, কিছু বোঝবার যো নেই। কৌতূহল জাগায়, কিন্তু কৌতূহল মেটায় না। বহু চেষ্টা করে শেষটা হার মেনেছি।
–তোমার বাবা, তোমার ঠাকুরদাদাও নিশ্চয় পুঁথির এই লেখা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, তারাও কিছুই বুঝতে পারেননি।
–তপন, বড়ই দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, তোমার প্রপিতামহ যে বুদ্ধিমান বংশধরের জন্যে এই পুঁথিখানি সযত্নে রক্ষা করার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন, তিনি এখনও তোমাদের পরিবারের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেননি!
কিঞ্চিৎ বিরক্ত স্বরে তপন বললে, তোমার কথার অর্থ বুঝলুম না।
–বেশ, বুঝিয়ে দিচ্ছি। জয়ন্ত উঠে পড়ে দেয়ালে ঝুলানো প্রকাণ্ড একখানা দর্পণের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর পুঁথিখানা তুলে ধরে আয়নার ভিতরে তার প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে একখণ্ড কাগজের ওপরে কি সব লিখে যেতে লাগল। তারপর ফিরে এসে কাগজখানা আমাদের সামনে টেবিলের ওপরে ফেলে দিয়ে বলল, এইবারে পড়ে দ্যাখো।
সাগ্রহে ঝুঁকে পড়ে আমরা দুজনে এই কথাগুলি পাঠ করলুম
অভাবে স্বভাব নষ্ট করিবে না। সর্বদা দেবদেবীর মূর্তি স্মরণ করিবে। নিশ্চিত জানিও, তোমার অভাব লইয়া মাথা ঘামাইতে হইবে না। চিন্তা দূর করিবে। লক্ষ্মীছাড়া হইলে জীবনে লক্ষ্মীর ঝাপি বিশেষ কাজে লাগে না। জগদীশ্বর কত রূপে দ্রষ্টব্য।
তপন চমৎকৃত কণ্ঠে বললে, ওই হেঁয়ালির ভিতরে এই কথা ছিল?
জয়ন্ত বললে, হ্যাঁ। কিন্তু যা তুমি হেঁয়ালি বলে ভ্রম করছ, তা হচ্ছে আমাদের সরল মাতৃভাষাই। কেবল উলটোভাবে সাজানো।
–উলটোভাবে সাজানো মানে?
–এ হচ্ছে এক রকম সাদাসিদে গুপ্তলিপি। ইংরেজিতে একে বলে Looking Glass clipper (দর্পণ-গুপ্তলিপি)। পঞ্চদশ শতাব্দীতেও ইতালির চিন্তাশীল চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য। ভিঞ্চি এই উপায়েই গুপ্তলিপি রচনা করে গিয়াছেন। আয়নার সামনে ধরলেই এরকম গুপ্তলিপি খুব সহজেই পাঠ করা যায়।
তপন বললে, এত সহজে গুপ্তলিপির পাঠোদ্ধার করে তুমি যথেষ্ট বাহাদুরির পরিচয় দিলে বটে, কিন্তু এটা আমাদের কোন কাজে লাগবে? এত কতকগুলি মামুলি উপদেশ মাত্র। সকলেই যা জানে, তার আবার গুপ্তলিপির কি প্রয়োজন?
–ঠিক বলছ তপন। এরকম মামুলি উপদেশের জন্যে গুপ্তলিপির প্রয়োজন হয় না। তার ওপরে উপদেশগুলো কেমন যেন খাপছাড়া! আমার কি সন্দেহ হচ্ছে জানো? তোমার প্রপিতামহ এই গুপ্তলিপি রচনার সময়ে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন। যেমন বেনারসের একরকম কৌটোর ভিতরেও আবার কৌটো থাকে, তেমনি এই গুপ্তলিপির প্রথম রহস্যের ভিতরেও অন্য কোনও রহস্য আছে। তোমরা এখন দয়া করে বাইরে যাও, আমাকে কিছুক্ষণ একলা থাকতে দাও, একবার চেষ্টা করে দেখি, গুপ্তলিপির আসল অর্থ আবিষ্কার করতে পারি কিনা।
.
চার
বৈঠকখানার পাশেই ছিল তপনদের লাইব্রেরি। তপন আমাকে সেই ঘরেই নিয়ে গেল।
সাধারণত বাঙালিদের বাড়িতে এত বড় লাইব্রেরি চোখে পড়ে না। মস্ত ঘরের চারিদিকের দেওয়ালের আধখানা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে আলমারির পর আলমারি। ভিতরকার বইগুলোর নাম পড়তে-পড়তে কেটে গেল খানিকক্ষণ।
ফিরে বললুম, তপন, এখানে যতগুলো বই-এর নাম পড়লুম, সবই দেখছি পুরানো যুগের।
–তা তো হবেই। এ ঘরের চার ভাগের তিন ভাগ কেতাব সংগ্রহ করে গিয়েছেন আমার প্রপিতামহ। বই কেনা আর বই পড়া ছিল তাঁর আর-এক অদ্ভুত খেয়াল।
বই কেনা আর পড়াকে তুমি অদ্ভুত খেয়াল বলে মনে করো। জানো, আমরা পশুত্বের ধাপ থেকে মানুষের ধাপে উঠতে পেরেছি কেবলমাত্র জ্ঞানার্জনের দ্বারা?
জানি। যে-কোনও বিষয়েই বাড়াবাড়িটাকে আমি ফ্যাড বলেই মনে করি।
–না। যা আমাদের মনকে উন্নত করে, প্রশস্ত করে, তার বাড়াবাড়িও নিন্দনীয় নয়। দেখছি তোমার প্রপিতামহ একজন অত্যন্ত সুধী ব্যক্তি ছিলেন।
হঠাৎ পাশের ঘর থেকে জয়ন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে ডাক দিলে–তপন, মানিক! শিগগির এ-ঘরে এসো।
আমরা বৈঠকখানায় ঢুকে দেখলুম, জয়ন্ত একখণ্ড কাগজের দিকে তাকিয়ে স্থিরভাবে বসে আছে।
তপন শুধাল, ব্যাপার কি ভায়া? গুপ্তলিপির ভিতর থেকে কোনও নতুন অর্থ আবিষ্কার করতে পেরেছ নাকি?
–পেরেছি। তোমাদের বাড়ির যত অনর্থের মূলেই আছে এই অর্থ।
–অর্থটা শুনি।
–এখন নয়। অর্থটা ইঙ্গিতম, শুনলেও ভাল করে বুঝতে পারবে না। অর্থটা প্রকাশ করবার আগে আমি একটা কথা জানতে চাই।
কি কথা?
সত্যনারায়ণের পুঁথির এই বিশেষত্ব নিয়ে তুমি আর কারুর সঙ্গে আলোচনা করেছ?
–আগে-আগে করতুম বইকী! কিন্তু কেউই ওই হেঁয়ালি বুঝতে পারেনি। শেষে হতাশ হয়ে হাল ছেড়েদি। কেবল গত মাসে শীতলবাবুর কৌতূহল দেখে, পুঁথিখানা তার হাতে দিয়েছিলুম বটে!
তারপর?
–শীতলবাবু পরদিন পুঁথিখানা ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, তিনিও কিছুই বুঝতে পারেননি।
শীতলবাবুকে একবার এখানে ডাকবে?
–তিনি বৈকালেই দেশের জন্যে বাজারহাট করতে বেরিয়ে গিয়েছেন, সন্ধ্যার আগে ফিরতে পারবেন না।
–দেশের জন্যে বাজারহাট?
–হ্যাঁ। তার কোনও আত্মীয়ের বিয়ে, তাই এক হপ্তার ছুটি নিয়ে কাল তিনি দেশে যাচ্ছেন।
কাল, কখন?
–খুব ভোরের গাড়িতে। সূর্যোদয়ের আগেই তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।
শীতলবাবু কি তোমার বাড়ির দোতলায় থাকেন?
না, বাড়ির একতলায় খিড়কির বাগানের সামনেই।
জয়ন্ত প্রায় পাঁচ মিনিটকাল স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তারপর বললে, তপন আজ তোমার বাড়িতে আমাদের জন্য একটুখানি জায়গা হবে?
তপন বিস্মিত কণ্ঠে বললে, তার মানে।
–আমি আর আমার বন্ধু মানিক আজ তোমাদের বাড়িতে রাত্রি বাস করতে চাই।
যদিও তোমার এই প্রস্তাবের কারণ বুঝতে পারছি না, তবু সানন্দে স্বাগত সম্ভাষণ করছি। কেবল রাত্রিবাস কেন, ডানহাতের ব্যাপারটাও আমার এখানে সেরে নিও।
–আপত্তি নেই! আর একটা কথা; আমি আবার দক্ষিণ খোলা না হলে ঘুমুতে পারি না।
–নির্ভয় হও। আমার বাড়ির দক্ষিণ দিকে আছে বাগান আর পুকুর–এখানা সেকেলে বাড়ি কিনা! আমার শয়ন-গৃহও সেইদিকে। তোমরাও আমার সঙ্গে সেই ঘরেই শয়ন করবে।
.
পাঁচ
তপন যে গুরুতর আহার্যের ব্যবস্থা করেছিল, একটিমাত্র ডান হাতের সাহায্যে কোনও মানুষই তার সদ্ব্যবহার করতে পারে না। খানিক পেটে পাঠিয়ে খানিক পাতে ফেলে আমরা উঠে পড়তে বাধ্য হলুম–তপনের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও।
বাগানের দিকে দোতলার বারান্দায় খানিকক্ষণ পায়চারি করলুম তিনজনে। জ্যোত্সামালা রাত, বাগানের তাল-নারিকেল পাতায় পাতায় আলোর ফুলঝুরি, সরোবরের নৃত্যশীল জলে চন্দ্রকরের চকমকি। মৃদু পত্র-মর্মর, বাতাসের ঠান্ডা দীর্ঘশ্বাস, ঝিল্লিদের ঘুমপাড়ানো ঝঙ্কার।
খানিকক্ষণ চলল গল্প। তারপরে ঘুমে আমার চোখ ভরে এল। জয়ন্ত ঘন ঘন হাই তুলতে শুরু করেছে দেখে তপন বললে, চলো, এইবার শয্যায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়া যাক।
শুয়ে-শুয়ে খানিকক্ষণ ভাবলুম, জয়ন্ত গুপ্তলিপির এমনকী গূঢ় অর্থ আবিষ্কার করেছে, যে জন্য আজ এখানে তার রাত কাটাবার দরকার হল? জিজ্ঞাসা করলেও এখন সে জবাব দেবে না জানি, তাই তাকে কিছু জিজ্ঞাসাও করিনি। সময়ে নিরতিশয় রহস্যময় হয়ে ওঠে জয়ন্ত! এই সব ভাবতে-ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়লুম নিজের অজ্ঞাতসারে।
আচম্বিতে আমার ঘুম গেল ভেঙেকে আমাকে ধাক্কার পর ধাক্কা মারছে।
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে দেখি, জয়ন্ত। তারপর সে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিল তপনকেও।
ঘড়িতে ঢং ঢং করে বাজল রাত দুটো।
তপন সবিস্ময়ে বললে, এত রাত্রে এ কী ব্যাপার জয়ন্ত?
–কোনও কথা নয়। একেবারে একতলায় নেমে চলো। সিধে শীতলবাবুর ঘরে।
–সে কী, কেন?
কথা নয়, কথা নয়! যা বলি শোনো!
ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে পড়লুম। সিঁড়ি বেয়ে একতলায় নামলুম। খানিক এগিয়ে একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে তপন বললে, এই শীতলবাবুর ঘর।
দরজার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছিল আলোর রেখা।
জয়ন্ত বললে, তপন, শীতলবাবুকে ডাকো।
তপন ডাকলে, শীতলবাবু, শীতলবাবু!
ঘরের আলো গেল নিভে।
কোনও সাড়া নেই।
তপন আবার ডাকলে, শীতলবাবু! ঘরের আলো নেবালেন কেন? আমার ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না কেন?
এবার ঘরের ভিতর থেকে সাড়া এল, কে?
–আমি তপন, দরজা খুলুন।
দরজা খুলে একটি লোক বাইরে বেরিয়ে এসে বললে, এত রাতে। ব্যাপার কী? কোনও বিপদ-আপদ হয়েছে নাকি!
ইতিমধ্যে জয়ন্ত হাতের টর্চ জ্বেলে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিয়েছে।
শীতলবাবুও ঘরে ঢুকে ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল, কে আপনি? আমার ঘরে আপনার কি দরকার?
তপন বললে, চুপ করুন শীতলবাবু। উনি আমার বন্ধু।
শীতলবাবু বললে, কিন্তু আপনার বন্ধু এত রাতে আমার ঘরে ঢুকে কি করতে চান?
জয়ন্ত বললে, আমি দেখতে চাই, একটা ভিজে পোঁটলা আপনি ঘরের ভিতরে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন?
–পোঁটলা? কীসের পোঁটলা?
কিন্তু জয়ন্ত আর তার কথার জবাব না দিয়ে নিজের মনেই বললে, হুঁ। এই তো ঘরের মেঝেয় রয়েছে জলের দাগ। এই তো একটা জলে ভেজা জিনিস টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হা, টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে একেবারে চৌকির তলায়–বলতে-বলতে সে মেঝের ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে বুকে হেঁটে প্রবেশ করল চৌকির তলদেশে এবং সেইভাবেই আবার যখন বাইরে বেরিয়ে এল, তখন দেখা গেল, সে টানতে টানতে নিয়ে আসছে একটা চটের থলি।
তারপর সে থলির ভিতর হাত চালিয়ে একে-একে বার করলে রাধা কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, কালী, মহাদেব ও সরস্বতী–এই সাতটি দেবদেবীর এনামেল করা মূর্তি।
তপন নির্বাক, বিষম বিস্ময়ে। শীতলবাবুরও নির্বাক, দারুণ আতঙ্কে।
হঠাৎ বিষ্ণু মূর্তিটি তুলে ধরে জয়ন্ত বললে, আরে এ কী! বিষ্ণুঠাকুরের ডান পায়ের ওপর থেকে খানিকটা এনামেলের আবরণ তুলে ফেললে কে? বুঝেছি, এ হচ্ছে সুচতুর শীতলবাবুর কাজ! উনি সন্দেহ করেছিলেন, এনামেলের পাতলা আবরণ কেবল বোকাদের চোখ ঠকাবার জন্যে, কিন্তু তলায় আছে কোনও মহার্ঘ ধাতু। তপন দেখতে পাচ্ছ কি, বিষ্ণু মূর্তিটির পা কি দিয়ে গড়া?–সোনা। খালি পা কেন, সমস্ত মূর্তিটাই সোনা দিয়ে গড়া।
বলো কি জয়ন্ত!
–হ্যাঁ। কেবল বিষ্ণুমূর্তি নয়, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রত্যেক দেবদেবীর মূর্তিই নিরেট সোনা দিয়ে তৈরি। আন্দাজে মনে হচ্ছে এ মূর্তিগুলির মোট ওজন এক মণের কম নয়।
আমি তো স্তম্ভিত!
জয়ন্ত লক্ষ্মীদেবীর সবচেয়ে বড় মূর্তিটি তুলে নিয়ে বলল, তপন এইবার আমি তোমাকে অধিকতর অভিভূত করতে চাই। দেখছি লক্ষ্মীদেবীর দেহের তুলনায় আঁপিটি অতিরিক্ত বড়। ঝাপির ভিতরটা ফাঁপা। কিন্তু ঝাপির ঢাকনিটা ভেঙে খুলে ফেললে কে? নিশ্চয়ই শীতলবাবুর কীর্তি। শীতলবাবু, ঝাপির ভিতরে কি ছিল?
শীতলবাবু শুষ্কস্বরে বললেন, আমি জানি না।
–আহা, জানেন বইকী! ঝাঁপির ভিতরে যা ছিল এখনি আমাকে ফিরিয়ে দিন।
ঝাঁপির ভিতর কিছুই ছিল না।
–এখনও মিথ্যা কথা! তপন তাহলে আর দয়া নয়, তুমি এখনি থানায় ফোন করে দাও, পুলিশ এসে শেষ ব্যবস্থা করুক।
পুলিশের নামেই শীতলবাবু ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বললে, আমাকে ধরিয়ে দেবেন না, আমাকে ধরিয়ে দেবেন না।
তাহলে ঝাঁপির ভিতরে কি ছিল দিন।
শীতলবাবু বিনা বাক্যব্যয়ে জামার পকেটের ভিতর থেকে একটি ছোট কাগজের মোড়ক বার করে জয়ন্তের হাতে সমর্পণ করলে।
জয়ন্ত আগে মোড়কটা খুলে তার ভিতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুখ টিপে একটুখানি হাসলে। তারপর বললে, তপন, শীতলবাবুর মস্তিষ্ক যে তোমার চেয়ে শক্তিশালী সেটা তিনি প্রমাণিত করেছেন। কিন্তু অপরাধী হিসাবে তিনি একেবারে শিশুর মতো কচি আর কাঁচা।
তিনি যদি এত তাড়াতাড়ি বামাল নিয়ে এখান থেকে সরে পড়বার চেষ্টা না করতেন, তাহলে আমরা কিছুতেই ওঁর নাগাল পেতুম না। যাক ওকথা। এটা হচ্ছে শীলতবাবুর প্রথম অপরাধ। আর উনি এই অপরাধটা করেছেন বলেই তুমি হলে সব দিক দিয়েই আশাতীত রূপে লাভবান, কারণ উনি অপরাধটা না করলে তুমিও আমাকে ডাকতে না, আর তাহলে। তোমাদের এই দেবদেবীর মূর্তিগুলিও এনামেলের চাদরে গা ঢাকা দিয়ে ওই কাচের আধারেরই শোভাবর্ধন করতেন, এ জীবনেও তুমি তাদের আসল চেহারা দেখতে পেতে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তুমি ওকে ক্ষমা করবে, না পুলিশের হাতে সমর্পণ করবে?
তপন বললে, আমি ওঁকে ক্ষমাও করব না, পুলিশেও দেব না। শীতলবাবু বিশ্বাসহন্তা। উনি যেন এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে বিদায় হয়ে যান।
শীতলবাবুর অধিকাংশ মোটঘাট বাঁধাই ছিল। সে আর দ্বিরুক্তি না করে বাকি জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিয়ে ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, জয়ন্ত ওই মোড়কটার ভিতরে কি আছে?
জয়ন্ত হাসিমুখে মোড়কটা আমার সামনে খুলে ধরে বললে, সাত রাজার ধন এক মানিক।
প্রকাণ্ড এক হীরক খণ্ড। অতবড় হীরা আমি কখনও চক্ষেও দেখিনি।
তপনের বোধহয় মাথা ঘুরে গেল। সে একটা অস্ফুট শব্দ উচ্চারণ করে ধপাস করে চৌকির ওপরে বসে গড়ল।
.
ছয়
জয়ন্ত বললে, আমি কেন শীতলবাবুর ওপরে সন্দেহ করেছিলুম, এখন সেই কথাই শোনো।
এনামেল করা মূর্তিগুলি যে অত্যন্ত মূল্যবান, আর সত্যনারায়ণের পুঁথিখানি যে অতিশয় দরকারি, এতদিন কেন যে তোমাদের এমন সন্দেহ হয়নি, সেটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। গুপ্তলিপির রহস্য তোমরা জানতে না বটে কিন্তু এটা তো সকলেই জানতে যে, তোমার প্রপিতামহ উইলে স্পষ্ট ভাষায় বলে গেছেন, যে ওই মূর্তিগুলির আর পুঁথির সদ্ব্যবহার করতে পারবে, সে তার নাম কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। হয়তো অভাবে পড়নি বলেই তোমরা ও কথাগুলির ওপরে বিশেষ ঝোঁক দাওনি। হয়তো অভাবে পড়লেই তোমাদেরও মাথা খুলে যেত।
আমি গুপ্তলিপির পাঠোদ্ধার করবার আগেই ওই কথাগুলি শুনেই নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিলুম দেবদেবীর মূর্তিগুলি মহামূল্যবান। অবশ্য গুপ্তলিপি পড়বার পর ও সম্বন্ধে আমার আর কোনও সন্দেহই থাকেনি।
বাড়ির লোকই যে চুরি করেছে, এটা বুঝতেও আমার বিলম্ব হয়নি। ঠাকুরঘরে তালার নতুন একটা চাবি গড়াবার সুযোগ হয় বাড়ির লোকেরই। বাইরের চোর মূর্তি রহস্য জানত না, অতএব কেবল মূর্তিগুলিই চুরি করে সে সরে পড়ত না। ঘটনার দিন রাত্রে বাড়িতে ছিল দাসদাসী, পাঁচক আর দ্বারবানরা। নিশ্চয় তাদেরও কেউ চুরি করেনি, কারণ তাহলে সে ঠাকুর ঘরের সোনা-রূপোর জিনিসগুলোও ফেলে যেত না। বাড়ির ভিতরে তাদের কথা বাদ দিলে বাকি থাকে কেবল শীতলবাবু। আমার যুক্তি বললে, সেই-ই চোর।
কিন্তু কেন সে বেছে বেছে মূর্তিগুলোই চুরি করলে? আমার মতো সেও কি ভিতরের রহস্য আবিষ্কার করবার কোনও সুযোগ পেয়েছিল? তপনকে জিজ্ঞাসা করে জানলুম, পেয়েছিল। মাসখানেক আগে সে হস্তগত করেছিল পুথিখানা। খুব সম্ভব আমার মতো তাড়াতাড়ি সে গুপ্তলিপির পাঠোদ্ধার করতে পারিনি। সেই চেষ্টাতেই তার কিছুদিন কেটে যায়। তারপর নতুন চাবি গড়িয়ে চুরি করে সে প্রথম সুযোগেই।
কিন্তু চোরাই মাল রাখলে কোথায়? অতরাত্রে মূর্তিগুলো নিয়ে নিশ্চয়ই সে বাড়ির বাইরে যেতে সাহস করেনি, কেউ না কেউ তাকে দেখে ফেলতে পারে। আর বাইরেই বা সে যাবে কোথায়, তার বাসা যখন এই বাড়িতেই? কিন্তু চোরাই মাল সে নিজের ঘরে রাখতেও ভরসা করবে না। পুলিশে খবর দিলে পুলিশ এসে তার ঘরখানা তল্লাশ করতে পারে। অতএব চোরাই মাল সে এমন কোনও জায়গায় লুকিয়ে রেখেছে, যা তার ঘরের বাইরে কিন্তু বাড়ির বাইরে নয়। কিন্তু সে জায়গাটা কোথায়? তার ঘরের পাশেই আছে বাগান আর পুকুর। বাগানের মাটি খুঁড়ে বা পুকুরের জলে ডুবিয়ে মূর্তিগুলো লুকিয়ে রাখা যেতে পারে।
শীতলবাবু বুদ্ধিমান, কিন্তু কাঁচা অপরাধী। ধরা পড়বার ভয়ে দুদিন যেতে না যেতেই স্থির করলে, কোন ওজরে ছুটি নিয়ে দেশে চলে যাবে। আমি তৎক্ষণাৎ আমার পথ দেখতে পেলুম। সে দেশে যাবে কাল সকালে। আর যাবার সময়ে বহুমূল্য মূর্তিগুলো নিশ্চয়ই এখানে। ফেলে রেখে যাবে না, আজ রাত্রে এখানে রাত্রিবাস করবার জন্যে আমি তপনের কাছ থেকে চাইলুম একখানা দক্ষিণ খোলা ঘর, কারণ এ বাড়ির দক্ষিণে যে বাগান আছে, সেটা আমার অজানা ছিল না।
আমি ঘুমোবার ভান করে তোমাদের সঙ্গেই শুয়েছিলুম। তারপর তোমাদের নাসাগর্জন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে পড়ে দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালুম। যা দেখবার আশা করেছিলুম, রাত পৌনে দুটোর সময়ে দেখতে পেলুম ঠিক সেই দৃশ্যই। সন্তর্পণে বাগানে এসে দাঁড়াল শীতলবাবু। তারপর পুকুর পাড়ে গেল। জলের ভিতর থেকে দড়ি ধরে টেনে তুললে পোঁটলার মতো কি একটা জিনিস।
তার পরের কথা আর বলবার দরকার নেই।
.
সাত
আমি বললুম, কিন্তু এখনও আমরা আসল কথা শুনতে পেলুম না।
জয়ন্ত বললে, কি কথা শুনতে চাও?
–গুপ্তলিপির ভিতর থেকে তুমি দ্বিতীয় কি অর্থ আবিষ্কার করেছে?
–কেবল আমি নই, শীতলবাবুও আবিষ্কার করেছে।
–অর্থটা কি?
জয়ন্ত আমাদের সামনে একখণ্ড কাগজ খুলে ধরলে–তার ওপরে লেখা ছিল গুপ্তলিপির সেই উপদেশগুলি : অভাবে স্বভাব নষ্ট করিবে না–প্রভৃতি।
তারপর সে বললে, তপনের প্রপিতামহ সাবধানতার ওপরে সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন। যদি কেহ Looking glass cripper-এর গুপ্তকথা ধরতেও পারে, তা হলেও সে আসল গুঢ় অর্থ বুঝতে পারবে না, কথাগুলোকে উপদেশ বলেই গ্রহণ করবে। কিন্তু ভালো করে উপদেশের শব্দগুলোকে লক্ষ করো। মোট লাইন আছে ছয়টি। এখন প্রত্যেক লাইন থেকে যদি কোনও প্রথম আর শেষ শব্দ নিয়ে পরে পরে সাজিয়ে যাও, তাহলে পাওয়া যাবে এই কথাগুলি : অভাবে দেব-দেবীর মূর্তি তোমার অভাব দূর করিবে, লক্ষ্মীর ঝাপি বিশেষরূপে দ্রষ্টব্য। দেখছ, এখানেও সাবধানতা! স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি, কেবল ইঙ্গিত। কিন্তু বুদ্ধিমানের পক্ষে ওই ইঙ্গিতই যথেষ্ট।
আমি বললুম, তাহলে উপন্যাসের মর্যালটা দাঁড়াল কি?
জয়ন্ত হেসে বললে, মনীষা থাকলেও বুদ্ধিমান ব্যক্তি যদি অসৎ পথে যায়, তবে শেষ পর্যন্ত তাকে ঠকতে হয়, যেমন শীতলবাবু।
–আর মনীষা না থাকলে?
–সৎপথে নির্বোধকেও লাভবান করে। যেমন তপন। তপন সহাস্য বদনে বললে, যতই আজ বাক্য-বাগুরা বিস্তার করো, কিছুই আমি গ্রাহ্য করব না। আমার সোনার দেব-দেবীদের শত শত প্রণাম করে, এখনি দুর্ভেদ্য লোহার সিন্দুকে তুলে রাখব।