ফরাসি বিপ্লবে বাঙালির ছেলে

কিছু কম দুশো বছর আগেকার কথা।

পৃথিবীর স্থলপথে তখন ডাকাতদের ভিড়, আর জলপথে বোম্বেটেদের জয়যাত্রা। পৃথিবীর দেশে-দেশে তখন দাস-ব্যবসা চলছে পুরোদমে। বোম্বেটেরা জলে করত যাত্রীদের জীবন ও সর্বস্ব হরণ এবং আফ্রিকায় ডাঙায় নেমে করত কালো মানুষ চুরি। লাল মানুষদের দেশ আমেরিকার উড়ে গিয়ে জুড়ে বসে সাদা-মানুষরা গোলাম আর কুলির কাজে খাটাবে। বলে এইসব কালো মানুষকে দাম দিয়ে কিনে নিত।

কালো মানুষ বলতে সাধারণত বোঝায়, কাফ্রিদের। হতভাগ্য কাফ্রি জাতি! ইতিহাসের প্রথম যুগ থেকেই দেখি, পৃথিবীর অধিকাংশ সভ্য দেশেই কাফ্রিরা বন্দি হয়ে গোলাম রূপে হাড়ভাঙা খাটনি খাটছে! রোমে, আরবে–এমনকী, ভারতেও রাজাবাদশা ও বড়লোকদের ঘরে ঘরে কাফ্রি গোলাম রাখার প্রথা ছিল।

আঠারো শতাব্দীতে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে সন্ত্রান্ত সমাজের সুন্দরী বিলাসিনীরাও শখ করে কাফ্রি গোলাম পুষতেন। গোলামদের গায়ের রং সাদা নয় বলে তাদের মানুষ বলেই মনে করা হত না। আমরা যেমন কুকুর, বিড়াল ও পাখিদের আদর করে পুষি, অথচ তাদের উচ্চতর জীব বলে মনে করি না, ইউরোপীয় শৌখিন মেয়েরাও ওই কাফ্রি গোলামদের সেইভাবেই দেখতেন। দিগ্বিজয়ী সম্রাট নেপোলিয়নের ছোট বোন পলিন স্পষ্টই বলেছিলেন, কাফ্রিদের সামনে। আবার লজ্জা করব কেন? কাফ্রিরা মানুষ নাকি?

আর-একটা কথা জানিয়ে রাখি। ইউরোপীয় সুন্দরীদের কাছে তখন সবচেয়ে বেশি আদর ছিল, কাফ্রি জাতের ছোকরা গোলামদের।

.

বাঙালিদের রং কাফ্রিদের মতন কালো নয় বটে, কিন্তু তামাটে। সাহেবদের চোখে তামাটে ও কালো রঙের মধ্যে কোনও তফাত ধরা পড়ে না। তারা দুই রংকেই এক বলে ধরে নিয়ে গালাগালি দেয়। অথচ পর্তুগাল ও স্পেনের অনেক ইউরোপীয়েরও গায়ের রং অনেক ভারতবাসীর চেয়ে কালো। কিন্তু ইউরোপে জন্মেছে বলে তারা কালো হলেও কালো নয়!

প্রায় দুশো বছর আগে বাংলায় ছিল ফিরিঙ্গি-বোম্বেটেদের বিষম দৌরাত্ম।

পূর্ব-বাংলা নদনদী প্রধান বলে ফিরিঙ্গি-বোম্বেটে সেইখানেই অত্যাচার করবার সুবিধা পেত বেশি। তারা নৌকোয় ও ছোট ছোট জাহাজে চড়ে নদী বেয়ে দেশের ভিতরে ঢুকত। মাঝে-মাঝে ডাঙায় নেমে গ্রাম বা শহর লুট করে আবার পালিয়ে যেত। বোম্বেটেদের জ্বালায় পূর্ব-বাংলা তখন অস্থির হয়ে উঠেছিল।

একদিন শ্যামল বাংলার এক কালো শিশু হয়তো গ্রামের পথে বা নদীর ধারে আপন মনে নেচে-খেলে বেড়াচ্ছিল; কিংবা হয়তো সে স্নেহময়ী মায়ের কোলে নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমিয়ে খেলার স্বপন দেখছিল। হয়তো তার নাম ছিল কালু বা ভুলু, কানাই বা বলাই। হয়তো সে ছিল বাঙালি মুসলমানের ছেলে–তার নাম ছিল করিম বা অন্য কিছু। এসব বিষয়ে ঠিক করে আমি কিছু বলতে পারি না। কারণ ইতিহাস এ-সম্বন্ধে নীরব। ইতিহাস কেবল বলে, ওই অনামা খোকাটি, বাংলারই ছেলে।

গ্রামে হানা দিতে এসে ফিরিঙ্গি-বোম্বেটের শনির দৃষ্টি পড়ল হঠাৎ সেই খোকাটির ওপরে। তাদের মনে পড়ে গেল ইউরোপের সুন্দরীমহলে কৃষ্ণবর্ণ শিশু-গোলামের ভারি আদর! এ কাফ্রি শিশু নয় বটে, কিন্তু রং যার সাদা নয়, তাকে কাফ্রি ছাড়া আর কিছু বলা চলে না।

বোম্বোটেরা বাংলার সেই দুলালকে চুরি করে পালিয়ে গেল।

সেদিন সেই শিশু মাকে হারিয়ে এবং তার মা কোলের ছেলেকে হারিয়ে কত কেঁদেছিল, ইতিহাস তার বর্ণনা করেনি, কিন্তু আমরা অনুমান করতে পারি। আরও কল্পনা করতে পারি, সেখানকার সেই কান্না সারাজীবনই জেগে ছিল তার বুকের ভিতরে। এবং যারা তার এই কান্নাকে স্থায়ী করেছিল, সে যে তাদের ক্ষমা করতে পারেনি, এটাও আমরা জানতে পারব যথাসময়ে।

.

চলো, তোমাদের কত সাগর কত নদীর ওপারে, কত যুগ আগেকার নতুন দেশে নিয়ে যাই।

দেশের নাম হচ্ছে, ফ্রান্স। দুশো বছর আগে ইউরোপে ফ্রান্সের তুলনা ছিল না। ফরাসিরা যে খাবার খায়, সারা ইউরোপ তাই খেতে ভালোবাসে; ফরাসিরা যে পোশাক পরে, সারা ইউরোপ তারই নকলে সাজগোজ করে।

এই বিখ্যাত দেশের মস্ত রাজা তখন পঞ্চদশ লুই। একদিকে লুই যে নির্দয় রাজা ছিলেন, তা নয়; কিন্তু রাজা হতে গেলে যে-যে গুণের দরকার, পঞ্চদশ লুইয়ের মধ্যে তা ছিল না। তিনি রাজকার্য দেখতেন না, সর্বদাই তুচ্ছ আমোদ-প্রমোদ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকতেন। ফলে ফ্রান্স হয়ে পড়ে অরাজক দেশের মতো এবং প্রজাদের হয় অত্যন্ত দুরবস্থা। এইজন্যেই পঞ্চদশ লুইয়ের মৃত্যুর পর ষোড়শ লুইয়ের রাজত্বকালে প্রজারা খেপে উঠে বিদ্রোহী হয়ে রাজা-রানি ও আমির-ওমরাহদের হত্যা করে। ইতিমধ্যে ওইসব ঘটনা ফরাসি বিপ্লব নামে বিখ্যাত।

কাউন্ট দ্যু’ব্যারির বউয়ের সঙ্গে পঞ্চদশ লুইয়ের অত্যন্ত বন্ধুত্ব হয়–সে মাদাম দ্যু’ব্যারি নামে সুপরিচিত।

দ্যু’ব্যারি ছিল খুব সুন্দরী ও বুদ্ধিমতী। রাজা তার গল্প শুনতে ভালোবাসেন, তার পরামর্শে ওঠেন বসেন। দ্যু’ব্যারির মুখের কথায় বড়-বড় ওমরাকে রাজপদ থেকে বঞ্চিত করা হয়, আবার তার একটি ইঙ্গিতে পথের ভিখারিও আমির হয়ে দাঁড়ায়! সকলেই তার অনুগ্রহ লাভের জন্যে ব্যস্ত। কারণ, আগে সে খুশি না হলে, রাজা খুশি হন না!

দ্যু’ব্যারি রাজবাড়িরই এক মহলে থাকে। রাজা নিত্য তাকে দামি-দামি ভেট পাঠান। নয় মণ ওজনের সোনার তাল এনে রাজা তার ড্রেসিং টেবিলের আসবাব গড়িয়ে দিলেন! তার এক-একটি পোর্সিলেনের কফির পিয়ালার দাম হাজার-হাজার টাকা। তার জামাকাপড়ের দাম যে কত লক্ষ টাকা, সে হিসাব রাখা অসম্ভব। তার জড়োয়া গহনার বিনিময়ে একটি রাজ্য বিকিয়ে যায়! এইভাবে দ্যু’ব্যারির মন রাখবার জন্যে রাজা দু-হাতে প্ৰজার টাকা খরচ করেন। রাজ্যময় অভাবের হাহাকার, কিন্তু প্রজাদের কাছ থেকে কেড়ে আনা অর্থে দ্যু’ব্যারির প্রমোদ কক্ষ আলোকোজ্জ্বল! দ্যু’ব্যারির নাম শুনলে প্রজারা জ্বলে ওঠে!

একটা তুচ্ছ নারীর শক্তি রাজার চেয়েও বেশি দেখে দেশের আমির-ওমরারাও দ্যু’ব্যারির উপরে খঙ্গহস্ত হয়ে উঠল।

দ্যু’ব্যারির একটি কাফ্রি খোকা-গোলাম পোশবার শখ হল। বাজার থেকে তখনি একটি গোলাম কিনে আনা হল–যেমন করে কিনে আনা হয় বানর বা কুকুর।

সে হচ্ছে ফিরিঙ্গীদের চুরি করে আনা আমাদের সেই বাংলার অনামা ছেলে।

.

সোনার খাঁচায় বন্দি করলে বনের পাখি কি খুশি হয়? দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে বাপ-মায়ের আদরের কোল হারিয়ে বাংলার ছেলে ফিরিঙ্গি রাজবাড়ির গোলামি পেয়ে কি খুশি হয়েছিল? একটু পরেই আমরা জানতে পারব।

গোলামকে দ্যুব্যারির ভারি পছন্দ হল! পোশা কুকুরকে নাম দিতে হয়, নতুন গোলামকে কি-নামে ডাকা যায়?

সবাই শুধোয়, ওরে, তোর নাম কী?

বাঙালির ছেলে, ফরাসি ভাষা জানে না, কাজেই চুপ করে থাকে।

তখন একজন প্রিন্স তার নাম দিলেন, জামোর! ইতিহাসে বাংলার ছেলে এই নামেই বিখ্যাত হয়ে আছে।

দ্যু’ব্যারির কৃপায় জামোর খাঁটি সোনার কাজ-করা বহুমূল্য পোশাক পেলে। তার জন্যে ব্যবস্থা হল ভালো-ভালো খাবারের। রাজবাড়ির ঘরে-ঘরে দ্যু’ব্যারির আদরের দুলাল হেসে-নেচে খেলে বেড়ায়। যেখানে আমির-ওমরাহর প্রবেশ নিষেধ, সেখানেও জামোরের অবাধ গতি! আমির ওমরাহরা জামোরকে প্রসন্ন রাখতে ব্যস্ত, কারণ সে দ্যু’ব্যারির প্রিয়পাত্র! দ্যু’ব্যারি এক মিনিটও তাকে চোখের আড়ালে রাখতে পারেন না–এত তাকে ভালোবাসেন!

কিন্তু বাংলার ছেলে জামোর কি বুঝতে পারেনি, দ্যু’ব্যারি নিজের পোশা কুকুরকেও তার চেয়ে কম ভালোবাসেন না?

সাধারণ লোকেরা জামোরকে কাফ্রি বলেই জানত। কিন্তু ঐতিহাসিকরা স্পষ্ট ভাষায় তাকে native of Bengal বলে বর্ণনা করেছেন। বিখ্যাত ফরাসি চিত্রকর Decrenze দ্যু’ব্যারির সঙ্গে জামোরের একখানি তৈলচিত্র এঁকেছিলেন। দ্যু’ব্যারি কফির পেয়ালা নিয়ে পান করছেন, আর বালক জামোর ঠিক প্রিয় কুকুরের মতো কীর মুখের পানে চেয়ে ট্রে হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। তার রং কালো বটে, কিন্তু তার নাক-মুখ-চোখে কাফ্রিত্ব নেই। রাজচিত্রকর স্বচক্ষে জামোরকে দেখেই তার মূর্তি এঁকেছিলেন।

প্রসিদ্ধ ফরাসি লেখক গনকোর্ট এই বলে জামোরের বর্ণনা করেছেন; তাকে বিকটাকার মনুষ্যত্বের নমুনারূপে দেখা হত। সে সকলকে জলখাবারের থালা জোগাত, মেয়েদের ছাতা বহন করত, খুশি হলে ডিগবাজি খেত। আঠারো শতাব্দীর বিজাতীয় রুচি এই শ্রেণির ছোট্ট বিকৃতাকার জীবকে অত্যন্ত পছন্দ করত এবং নিগ্রোদের ভাবত ক্ষুদ্র দু-পেয়ে জন্তুর মতো!

বাংলার ছেলে জামোর ফ্রান্সে থেকে নিশ্চয়ই ফরাসি ভাষা শিখেছিল। এবং সে যখন শুনত, তাকে বিকটাকার কাফ্রি ও দুপেয়ে জন্তুর মতন দেখা হয়, তখন তার মন কি কত্রী ঠাকুরানির প্রতি কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠত? এত সানুগ্রহ সৌভাগ্য ও ঐশ্বর্য কি তখন তার সর্বাঙ্গে বিষাক্ত কাঁটার মতো বিঁধত না? শীঘ্রই এর উত্তর পাওয়া যাবে!

বাঙালি হচ্ছে কাফ্রি! বাঙালি হচ্ছে–দু-পেয়ে জন্তু! কেন না তার চামড়া কটা নয়!

.

ফ্রান্সের রাজার ছিল অনেক প্রাসাদ এবং প্রত্যেক প্রাসাদেই সর্বময় কর্তারূপে থাকতেন একজন করে গভর্নর। গভর্নরের পদে তখন পদবিওয়ালা সম্ভ্রান্ত লোক ছাড়া আর কারুকে বসানো হত না। একদিন রাজার কাছে দ্যু’ব্যারি আবেদন জানালে, মহারাজ আপনার লুসিয়েনেস প্রাসাদে গভর্নরের আসন খালি হয়েছে। আমার জামোরকে ওই আসনে বসাতে চাই!

পঞ্চদশ লুই চমকে উঠে বললেন, বলো কী! সম্ভ্রান্ত লোক ছাড়া আর কেউ যে গভর্নরের পদ পায় না। জামোর গভর্নর হলে অন্য-অন্য গভর্নরদের মান কোথায় থাকবে? রাজ্যের লোক কি মনে করবে?

দ্যু’ব্যারি বললে, রাজ্যের লোকের কথা আমি গ্রাহ্য করি না! এখানকার আমির-ওমরাহরা আমার শত্রু! আমি তাদের বুঝিয়ে দিতে চাই, আমার চোখে তারা জামোরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়!

রাজা হেসে বললেন, বেশ, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক! এসো জামোর, আজ থেকে তুমি গভর্নর! তোমার মাহিনা হল চারশো টাকা!

সে-যুগে চারশো টাকার দাম এখনকার চেয়ে ঢের বেশি ছিল!

যে-দেশে জামোরের জন্ম, সেখানে পশু-বানরের বিবাহে কোনও-কোনও মানুষ-বানর লাখ টাকা খরচ করেছে! সে-ও পোষা কুকুর-বিড়ালের মতন জীবন্ত খেলনা তাকে গভর্নরের পদে বসিয়ে তার মনুষ্যত্বের প্রতি সম্মান দেখানো হল না, বরং তার নীচতাকে যে উঁচু করে তুলে ধরা হল দেশের উচ্চপদস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের মাথা নীচু করবার জন্যেই, এটুকু বোঝবার মতো বুদ্ধি যে বাঙালির ছেলে জামোরের ছিল না, একথা মনে করা চলে না।

গনকোর্ট হয়তো সেইজন্যেই বলেছেন, প্রাসাদ হল গভর্নর জামোরের বনের পাখির সোনার খাঁচার মতো!

বিকটাকার মানুষ, দু-পেয়ে জন্তু জামোর মহামান্য গভর্নর হয়ে মুখে নিশ্চয় একগাল হেসেছিল, কিন্তু তার অপমানিত মনের মধ্যে কী প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠেছিল, পরের দৃশ্যেই আমরা তা দেখতে পাব।

.

পরের দৃশ্যের যবনিকা তুললুম প্রায় বিশ বৎসর পরে।

ইতিমধ্যে পঞ্চদশ লুই মারা পড়েছেন, ষোড়শ লুই কয়েক বৎসর রাজ্য করে, পূর্বপুরুষদের পাপে নির্দোষ হয়েও বিদ্রোহী প্রজাদের হাতে রানির সঙ্গে প্রাণ দিয়েছেন।

সমস্ত ফরাসি জাতি রক্ত-পিপাসায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, সকলেরই মুখে এক কথা– এতদিন ধরে যারা প্রজাদের রক্ত শোষণ করেছে, আমাদের অনাহারে রেখে আমাদেরই কষ্টার্জিত অর্থে বিলাসের খেলনা কিনেছে, আজ তাদের রক্ত চাই!

জামোর সেদিন রাজবাড়িতে ছিল না, ছিল সশস্ত্র বিদ্রোহী প্রজাদের সঙ্গে! সে আর বালক নয়, পূর্ণবয়স্ক যুবক। সেদিন সে আর কারুর গোলাম নয়, বাংলার সুনীল আকাশেরই মতন স্বাধীন! সেদিন সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে, তাকে দু-পেয়ে জন্তু ভেবে এতদিন কারা তার মনুষ্যত্বকে ব্যঙ্গ করেছে!

বিচারালয়ের কাঠগড়ায় উঠে বন্দিনী দ্যু’ব্যারি সভয়ে স্তম্ভিতনেত্রে দেখলে, তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল, রাজবাড়ির পোষা জ্যান্তো খেলনা, বিকটাকার মনুষ্যত্বের নমুনা, জামোর! আজ জানমারের মুখে কৃপাপ্রার্থী আবদারের হাসি নেই, তার দুই চক্ষে জ্বলজ্বল করছে বাংলাদেশের মুক্ত জাগ্রত মনুষ্যত্বের প্রতিহিংসা-বহ্নি!

জামোর একে-একে দ্যু’ব্যারির সমস্ত কথা প্রকাশ করে দিলে।

.

শেষ দৃশ্য।

চারিদিকে বিপুল জনতা। সকলেই চিৎকার করছে–মার, মার। যারা মনুষ্যত্বকে মর্যাদা দেয়নি, গরিবকে মানুষ ভাবেনি, তাদের সকলকে হত্যা কর।

গিলোটিনের তলায় হাড়িকাঠে গলা দিয়ে অভাগিনী দ্যু’ব্যারি সকাতরে চেঁচিয়ে উঠল, বাঁচাও, বাঁচাও। দয়া করো। আমার যথাসর্বস্ব দান করব।

ভিড়ের ভিতর থেকে নিষ্ঠুর ভাষায় কে বললে, তোমার যথাসর্বস্ব তো প্রজাদেরই নিজস্ব সম্পত্তি।

গিলোটিনের খাঁড়া নেমে এল। দ্যু’ব্যারির ছিন্নমুণ্ড আর কোনও কথা কইলে না।

এ-দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। জনতার ভিতরে কি জামোরও ছিল?

জানি না।

ইতিহাস আর তাকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি।

শিকল-পরা বাঙালি গোলাম জামোর, ফরাসিদের সাহিত্যে ও চিত্রকলায় অমর হয়ে আছে। কিন্তু গোলামির শিকল খুলে স্বাধীন জামোর কোথায় গেল, সেকথা কেউ বলতে পারে না।

বনের পাখিকে সোনার খাঁচায় বন্দি করে কেউ ভেব না, তার প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করছ। তোমরা যাকে মনে করো পাখির আনন্দের গান, সে হচ্ছে পাখির দারুণ অভিশাপ।


© 2024 পুরনো বই