অলৌকিক

ইনস্পেকটর সুন্দরবাবু৷ নতুন নতুন খাবারের দিকে বরাবরই তাঁর প্রচণ্ড লোভ৷ আজ বৈকালী চায়ের আসরে পদার্পণ করেই বলে উঠলেন, ‘জয়ন্ত ওবেলা কী বলেছিলে, মনে আছে তো?’

জয়ন্ত হেসে বললে, ‘মনে না থাকে, মনে করিয়ে দিন৷’

-‘নতুন খাবার খাওয়াবে বলেছিলে৷’

-‘ও, এই কথা? খাবার তো প্রস্তুত৷’

-‘খাবারের নাম শুনতে পাই না?’

-‘মাছের প্যাটি আর অ্যাসপ্যার্যাগাস ওমলেট৷’

-‘রেঁধেছে কে?’

-‘আমাদের মধু৷’

-‘মধু একটি জিনিয়াস৷ আনতে বলো, আনতে বলো৷’

চা পর্ব শেষ হল যথা সময়ে৷ অনেকগুলো প্যাটি আর ওমলেট উড়িয়ে সুন্দরবাবুর আনন্দ আর ধরে না৷

পরিতৃপ্ত ভুঁড়ির উপরে সস্নেহে হাত বুলোতে বুলোতে তিনি বললেন, ‘মনের মতো পানাহারের মতো সুখ দুনিয়ায় আর কিছু নেই, কী বল মানিক?’

মানিক বললে, ‘কিন্তু অত সুখের ভিতরেও কি একটি ট্র্যাজেডি নেই?’

-‘কীরকম?’

-‘খেলেই খাবার ফুরিয়ে যায়৷’

-‘তা যা বলেছ৷’

-‘আবার অনেক সময় খাবার ফুরোবার আগে পেটই ভরে যায়৷’

-‘হ্যাঁ ভায়া, ওটা আবার খাবার ফুরোনোর চেয়েও দুঃখজনক ব্যাপার৷ খাবার আছে, পেট কিন্তু গ্রহণ করতে নারাজ৷ অসহনীয় দুঃখ!’

ঠিক এমন সময়ে একটি লোক ঘরের ভিতর প্রবেশ করল৷

তাকে দেখেই জয়ন্ত বলে উঠল, ‘আরে হরেন যে! বোসো ভাই, বোসো৷ সুন্দরবাবু, হরেন হচ্ছে আমার আর মানিকের বাল্যবন্ধু৷’

মানিক বললে, ‘হরেন, ইনি হচ্ছেন সুন্দরবাবু, বিখ্যাত পুলিশ ইন্সপেকটর আর প্রখ্যাত ঔদারিক৷’

-‘হুম, ঔদারিক মানে কী মানিক?’ শুধোলেন সুন্দরবাবু৷

-‘ঔদরিক, অর্থাৎ উদরপরায়ণ৷’

-‘অর্থাৎ পেটুক৷ বেশ ভাই বেশ, যা খুশি বল, তোমার কথায় রাগ করে আজকের এমন খাওয়ার আনন্দটা মাটি করব না৷’

জয়ন্ত বললে, ‘তারপর হরেন, তুমি কি এখন কলকাতাতেই আছ?’

-‘না, কাল এসেছি৷ আজই দেশে ফিরব৷ কিন্তু যাবার আগে তোমাদের একটা খবর দিয়ে যেতে চাই৷’

-‘কীরকম খবর?’

-‘যেরকম খবর তোমরা ভালোবাসো৷’

-‘কোনো অসাধারণ ঘটনা?’

-‘তাই৷’

-‘তাহলে আমরা শুনতে প্রস্তুত৷ সম্প্রতি অসাধারণ ঘটনার অভাবে আমরা কিঞ্চিৎ ম্রিয়মান হয়ে আছি৷ ঝাড়ো তোমার খবরের ঝুলি৷’

দুই

হরেন বললে, ‘সুন্দরবাবু, জয়ন্ত আর মানিক আমাদের দেশে গিয়েছে কিন্তু আপনার কাছে আগে তার কিছু পরিচয় দেওয়া দরকার৷ আমাদের দেশ হচ্ছে একটি ছোটো শহর, কলকাতা থেকে মাইল ত্রিশ দূরে৷ সেখানে পনেরো-ষোলো হাজার লোকের বাস৷ অনেক ডেলিপ্যাসেঞ্জার কলকাতায় চাকরি করতে আসেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বড়ো অফিসার আছেন৷ স্টেশন থেকে শহরের দূরত্ব প্রায় দেড় মাইল৷ এই পথটা বেশির ভাগ লোকেই পায়ে হেঁটে পার হয়, যাদের সংগতি আছে তারা ছ্যাকড়া গাড়ি কি সাইকেল-রিকশার সাহায্য নেয়৷

‘মাস খানেক আগে-অর্থাৎ গেল মাসের প্রথম দিনে সুরথবাবু আর অবিনাশবাবু সাইকেল-রিকশায় চড়ে স্টেশন থেকে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন৷ তাঁরা দু-জনেই বড়ো অফিসার, একজন মাহিনা পান হাজার টাকা, আর একজন আটশত টাকা৷ সেই দিনই তাঁরা মাহিনা পেয়েছেন৷ স্টেশন থেকে মাইল খানেক পথ এগিয়ে এসে একটা জঙ্গলের কাছে তাঁরা দেখতে পেলেন আজব এক মূর্তি৷ তখন রাত হয়েছে, আকাশে ছিল সামান্য একটু চাঁদের আলো, স্পষ্ট করে কিছুই চোখে পড়ে না৷ তবু বোঝা গেল, মূর্তিটা অসম্ভব ঢ্যাঙা, মাথায় অন্তত নয় ফুটের কম উঁচু হবে না! প্রথমে তাদের মনে হয়েছিল সেটা কোনো নারীর মূর্তি, কারণ তার দেহের নীচের দিকে ছিল ঘাঘরার মতো কাপড়৷ কিন্তু তার কাছে গিয়েই বোঝা গেল সে নারী নয় পুরুষ; ভীষণ কালো মুখখানা সম্পূর্ণ অমানুষিক৷ তার হাতে ছিল লাঠির বদলে লম্বা একগাছা বাঁশ৷ পথের ঠিক মাঝখানে একেবারে নিশ্চল হয়ে সে দাঁড়িয়েছিল৷

‘রিকশাখানা কাছে গিয়ে, তাকে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই সে বিষম চিৎকার করে ধমকে বলে উঠল, এই উল্লুক, গাড়ি থামা! তরপরেই সে রিভলবার বার করে ঘোড়া টিপে দিলে৷ দ্রুম করে শব্দ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই রিকশার চালক গাড়ি ফেলে পলায়ন করলে৷ সুরথবাবু আর অবিনাশবাবুও গাড়ি থেকে নেমে পড়বার উপক্রম করতেই মূর্তিটা তাঁদের দিকে রিভলবার তুলে কর্কশ স্বরে বললে, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, সঙ্গে যা আছে সব রিকশার উপরে রেখে এখান থেকে সরে পড়ো৷

‘তাঁরা প্রাণে বাঁচতেই চাইলেন৷ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সঙ্গের সমস্ত টাকা, হাতঘড়ি, আংটি এমনকী ফাউনন্টেন পেনটি পর্যন্ত সেইখানে ফেলে রেখে তাঁরা তাড়াতাড়ি চম্পট দিলেন৷ পরে পুলিশ এসে ঘটনাস্থলে রিকশার পাশে কুড়িয়ে পায় কেবল সেই লম্বা বাঁশটাকে৷

‘প্রথম ঘটনার সাত দিন পরে ঘটে দ্বিতীয় ঘটনা৷ মৃণালবাবু আমাদের দেশের লোক৷ মেয়ের বিয়ের জন্যে তিনি কলকাতায় গহনা গড়াতে দিয়েছিলেন৷ ঘটনার দিন সন্ধ্যার সময়ে ট্রেন থেকে নেমে পাঁচ হাজার টাকার গহনা নিয়ে পদব্রজেই আসছিলেন৷ তিনিও একটা জঙ্গলের পাশে সেই সুদীর্ঘ ভয়াবহ মূর্তিটিকে অস্পষ্টভাবে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন৷ সেদিন কতকটা স্পষ্ট চাঁদের আলো ছিল বটে কিন্তু জঙ্গলের ছায়া ঘেঁষে মূর্তিটা এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল যে, ভালো করে কিছুই দেখবার জো ছিল না৷ সেদিনও মূর্তিটা রিভলবার ছুড়ে ভয় দেখিয়ে মৃণালবাবুর গহনাগুলো কেড়ে নিয়ে তাঁকে তাড়িয়ে দেয়৷ সেবারেও পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে পাওয়া যায় কেবল একগাছা লম্বা বাঁশ৷

‘এইবারে তৃতীয় ঘটনা৷ শশীপদ আমার প্রতিবেশী৷ কলকাতার বড়োবাজারে তার কাপড়ের দোকান৷ ফি শনিবারে সে দেশে আসে-গেল শনিবারেও আসছিল৷ তখন সন্ধ্যা উতরে গিয়েছিল, কিন্তু চাঁদ ওঠেনি৷ স্টেশন থেকে শহরে আসতে আসতে পথের একটা মোড় ফিরেই শশীপদ সভয়ে দেখতে পায় সেই অসম্ভব ঢ্যাঙা বীভৎস মূর্তিটাকে৷ অবশ্য ভালো করে সে কিছুই দেখতে পায়নি, কেবল এইটুকুই বুঝে ছিল যে, মূর্তিটা মানুষের চেয়ে প্রায় দুই গুণ উঁচু৷ সেদিনও সে রিভলবার ছুড়ে শশীপদর কাছ থেকে সাত হাজার টাকা হস্তগত করে৷ শশীপদ দৌড়ে একটা জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়ে৷ তারপর সেইখানে বসেই শুনতে পায় খটাখট খটাখট করে কীসের শব্দ! ক্রমেই দূরে গিয়ে সে শব্দ মিলিয়ে যায়৷ শশীপদ ভয়ে সারা রাত বসেছিল জঙ্গলের ভিতরেই৷ সকালে বাইরে এসে পথের উপরে দেখতে পায় একগাছা বাঁশ৷

‘জয়ন্ত, এই তো ব্যাপার৷ পরপর তিন-তিনটে অদ্ভুত ঘটনা ঘটায় আমাদের শহর রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছে৷ সন্ধ্যার পর দলে খুব ভারী না হলে পথিকরা স্টেশন থেকে ওপথ দিয়ে শহরে আসতে চায় না৷ অনেকেই মূর্তিটাকে অলৌকিক বলেই ধরে নিয়েছে৷ এখন তোমার মত কী?’

জয়ন্ত স্তব্ধ হয়ে বসে রইল কয়েক মিনিট৷ তারপর ধীরে ধীরে বললে, ‘ঘটনাগুলোর মধ্যে কী কী লক্ষ করবার আছে, তা দেখো৷ বাংলাদেশে নয় ফুট উঁচু মানুষ থাকলে এতদিনে সে সুবিখ্যাত হয়ে পড়ত৷ সুতরাং অনুমান করা যেতে পারে অপরাধী নয় ফুট উঁচু নয়৷ সে দেহের নীচের দিকটা ঘাঘরায় বা ঘেরাটোপে ঢেকে রাখে কেন? তার মুখ অমানুষিক বলে মনে হয় কেন? সে একটা লম্বা বাঁশ হাতে করে দাঁড়িয়ে থাকে, আবার বাঁশটাকে ঘটনাস্থলে ফেলে রেখে যায় কেন? সে প্রত্যেকবারেই চেষ্টা করে, তার চেহারা কেউ যেন স্পষ্ট করে দেখতে না পায়৷-কেন? শশীপদ শুনেছে, খটাখট খটাখট করে একটা শব্দ ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছে৷-কীসের শব্দ?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘তুমি কিছু অনুমান করতে পারছ?’

-‘কিছু কিছু পারছি বই কী! হরেন, ওই তিনটে ঘটনায় যাঁদের টাকা খোয়া গিয়েছে, তাঁরা কি শহরের বিভিন্ন পল্লির লোক?’

-‘না, তাঁরা সকলেই প্রায় এক পাড়াতেই বাস করেন৷’

-‘তবে তোমাদের পাড়ার বা পাড়ার কাছাকাছি কোথাও বাস করে এই অপরাধী৷’

-‘কেমন করে জানলে?’

-‘নইলে ঠিক কোন দিনে কোন সময়ে কোন ব্যক্তি প্রচুর টাকা নিয়ে দেশে ফিরে আসবে, অপরাধী নিশ্চয়ই সে খবর রাখতে পারত না৷’

-‘না জয়ন্ত, আমাদের পাড়ায় কেন, আমাদের শহরেও নয় ফুট উঁচু লোক নেই৷’

-‘আমিও ওকথা জানি৷’

-‘তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না৷’

-‘আপাতত বেশি কিছু কাজ নেই৷ আমাকে কিঞ্চিত চিন্তা করবার সময় দাও৷ তুমি আজই দেশে ফিরে যাচ্ছ তো?’

-‘হ্যাঁ৷’

-‘পরশুদিন আমার কাছ থেকে একখানা জরুরি চিঠি পাবে৷ আমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে৷ তার ঠিক এক সপ্তাহ পরে তুমি কলকাতায় এসে আমাদের নিয়ে যাবে৷’

হরেন চলে গেল৷ জয়ন্ত যেন নিজের মনেই গুনগুন করে বললে ‘খটাখট খটাখট খটাখট! মূল্যবান সূত্র৷’

তিন

নির্দিষ্ট দিনে দুপুর বেলায় হরেন এসে হাজির৷

জয়ন্ত শুধাল, ‘চিঠিতে যা যা বলেছি ঠিক সেইমতো কাজ করেছ তো?’

-‘অবিকল৷’

-‘মানিক, সুন্দরবাবুকে ফোন করে জানাও, আজ সাড়ে পাঁচটার ট্রেনে যাত্রা করব৷’

প্রায় সাড়ে সাতটার সময় তারা হরেনদের দেশে এসে নামল৷

আকাশ সেদিন নিশ্চন্দ্র৷ স্টেশন থেকে শহরে যাবার রাস্তায় সরকারি তেলের আলোগুলো অনেক তফাত থেকে মিটমিট করে জ্বলে যেন অন্ধকারের নিবিড়তাকে আরও ভালো করে দেখবার চেষ্টা করছিল৷ নির্জন পথ, আশেপাশের ঝোপঝাপের বাসিন্দা কেবল মুখর ঝিল্লির দল৷ দুইখানা সাইকেল-রিকশায় চড়ে তারা যাচ্ছিল৷ প্রথম গাড়িতে বসেছিল হরেন ও মানিক৷ দ্বিতীয় গাড়িতে জয়ন্ত ও সুন্দরবাবু৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘তুমি কী যে বুঝেছ তা তুমিই জানো, আমি ছাই এ ব্যাপারটার ল্যাজামুড়ো কিছুতেই ধরতে পারিনি!’

জয়ন্ত বললে, ‘ঘটনাগুলো আমিও শুনেছি, আপনিও শুনেছেন৷ তারপর প্রধান প্রধান সূত্রের দিকে আপনার দৃষ্টিও আকর্ষণ করতে ছাড়িনি৷ মাথা খাটালে আপনি অনেকখানিই আন্দাজ করতে পারতেন৷’

-‘মস্তক যথেষ্ট ঘর্মাক্ত করবার চেষ্টা করেছি ভায়া কিন্তু খানিকটা ধোঁয়া (তাও গাঁজার ধোঁয়া) ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি৷’

-‘মুটেরাও মস্তককে যথেষ্ট ঘর্মাক্ত করে, কিন্তু তারা উপলব্ধি করে কতটুকু৷ সুন্দরবাবু, আমি আপনাকে মস্তক ঘর্মাক্ত করতে বলছি না, মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে বলছি৷’

-‘একটা শক্তরকম গালাগালি দিলে বটে, কিন্তু তোমার কি বিশ্বাস, আজকেই তুমি এই মামলাটার কিনারা করতে পারবে?’

-‘হয়তো পারব, কারণ অপরাধীরা প্রায়ই নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কাজ করে বিপদে পড়ে৷ হয়তো পারব না, কারণ কোনো কোনো অপরাধী নিজের নির্দিষ্ট পদ্ধতি ত্যাগ করতেও পারে৷ কিন্তু হুঁশিয়ার! পথের মাঝখানে আবছায়া গোছের কী একটা দেখা যাচ্ছে না?’

হ্যাঁ দেখা যাচ্ছে বটে! মুক্ত আকাশের স্বাভাবিক আলো দেখিয়ে দিলে, অন্ধকারের মধ্যে একটা অচঞ্চল, নিশ্চল ও সুদীর্ঘ ছায়ামূর্তি৷ বাতাসে নড়েচড়ে উঠছে কেবল তার পরনের জামা-কাপড়গুলো৷

আচম্বিতে একটা অত্যন্ত কর্কশ ও হিংস্র চিৎকার চারদিকের নিস্তব্ধতাকে চমকে দিয়ে জেগে উঠল-‘এই! থামাও গাড়ি, থামাও গাড়ি৷’ সঙ্গেসঙ্গে রিভলবারের শব্দ!

কিন্তু তার আগেই অতি সতর্ক জয়ন্ত ছুটন্ত গাড়ি থেকে বাঘের মতো লাফিয়ে পড়েছে এবং গর্জন করে উঠেছে তারও হাতের রিভলবার৷

গুলি গিয়ে বিদ্ধ করল মূর্তির ডান হাতখানা, তার রিভলবারটা খসে পড়ল মাটির উপরে সশব্দে৷ কেবল রিভলবার নয়, আর একটাও কী মাটিতে পড়ার শব্দ হল-বোধ হয় বংশদণ্ড! অস্ফুট আর্তনাদ করে মূর্তিটা ফিরে দাঁড়িয়ে পালাবার উপক্রম করলে, কিন্তু পারলে না; এক সেকেন্ড টলটলায়মান হয়েই হুড়মুড় করে লম্বমান হল একেবারে পথের উপর৷

দপদপিয়ে জ্বলে উঠল চার-চারটে টর্চের বিদ্যুৎ-বহ্নি!

জয়ন্ত ক্ষিপ্ত হস্তে ভূপতিত মূর্তিটার গা থেকে কাপড়-চোপড়গুলো টান মেরে খুলে দিলে৷ দেখা গেল, তার দুই পদের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে আছে দুইখানা সুদীর্ঘ যষ্টি-ইংরেজিতে যাকে বলে স্টিল্ট এবং বাংলায় যাকে বলে রণ-পা৷

জয়ন্ত বললে, ‘দেখছি এর মুখে রয়েছে একটা প্রকাণ্ড মুখোশ-কাফ্রির মুখোশ৷ এখন মুখোশের তলায় আছে কার শ্রীমুখ, সেটাও দেখা যেতে পারে৷ আর একটানে খসে পড়ল মুখোশও৷

হরেন সবিস্ময়ে বলে উঠল, ‘আরে, এ যে দেখছি আমাদের পাড়ার বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো রামধন মুখুজ্যে৷ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ও কুপথে যায়, কুসঙ্গীদের দলে মেশে, নেশাখোর হয়, জুয়া খেলে, পাড়ার লোকদের উপরে অত্যাচার করে; এর জন্যে সবাই ত্রস্ত ব্যতিব্যস্ত! কিন্তু এর পেটে পেটে যে এমন শয়তানি এতটা তো আমাদের স্বপ্নেরও অগোচর ছিল৷’

চার

জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবু, প্রধান প্রধান সূত্রের কথা আগেই বলেছি, এখন সব কথা আবার নতুন করে বলবার দরকার নেই৷ কেবল দু-তিনটে ইঙ্গিত দিলেই যথেষ্ট হবে৷ গোড়া থেকেই আমার দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, অপরাধী হরেনেরই পাড়ার লোক৷ সে পাড়ায়-এমনকী সে শহরেও নয় ফুট উঁচু কোনো লোকই নেই৷ সুতরাং ধরে নিলুম সে উঁচু হয়েছিল কোনো কৃত্রিম উপায় অবলম্বন করে৷ অপরাধের সময়ে সে আবছায়ায় অবস্থান করে-পাছে কেউ তার কৃত্রিম উপায়টা আবিষ্কার করে ফেলে; তাতেই আমার ধারণা হল দৃঢ়মূল৷ এখন সেই কৃত্রিম উপায়টা কী হতে পারে? শশীপদ শুনেছিল, খটাখট খটাখট করে কী একটা শব্দ ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে! এই নিয়ে ভাবতে ভাবতে ধাঁ করে আমার মাথায় আসে রণ-পার কথা৷ রণ-পার উপরে আরোহণ করলে মানুষ কেবল উঁচু হয়ে ওঠে না, খুব দ্রুত বেগে চলাচলও করতে পারে৷ সেকালে বাংলাদেশের ডাকাতরা এই রণ-পায় চড়ে এক-এক রাতেই পঞ্চাশ-ষাট মাইল পার হয়ে যেতে পারত৷ পদক্ষেপের সময়ে রণ-পা যখন মাটির উপরে পড়ে, তখন খটাখট শব্দ হয়৷ কিন্তু রণ-পায় উঠে কেউ স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, টাল সামলাবার জন্যে চলাফেরা করতে হয়৷ অপরাধী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার জন্যে একগাছা বাঁশের সাহায্য গ্রহণ করত৷ কার্য সিদ্ধির পর বাঁশটাকে সে ঘটনাস্থলেই পরিত্যাগ করে যেত, কারণ রণ-পায় চড়ে ছোটবার সময় এতবড়ো একটা বাঁশ হয়ে ওঠে উপসর্গ মতো৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, এসব তো বুঝলুম, কিন্তু আসামি এমন বোকার মতো আমাদের হাতে ধরা দিলে কেন, সেটা তো বোঝা যাচ্ছে না৷’

জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘ওটা আমার কল্পনাশক্তির মহিমা৷ আগেই বলেছি তো, অপরাধীরা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কাজ করতে গিয়েই বিপদে পড়ে৷ অপরাধী সর্বদাই খবর রাখত, পাড়ার কোন ব্যক্তি কবে কী করবে বা কী করবে না৷ আমার নির্দেশ অনুসারে হরেন রটিয়ে দিয়েছিল, কলকাতায় ব্যাঙ্কের পর ব্যাঙ্ক ফেল হচ্ছে, সে ব্যাঙ্কে আর নিজের টাকা রাখবে না৷ অমুক তারিখে কলকাতায় গিয়ে সব টাকা তুলে নিয়ে আসবে৷ অপরাধী এ টোপ না গিলে পারেনি৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘একেই বলে, ফাঁকতালে কিস্তিমাত৷’


© 2024 পুরনো বই