নেতাজির ছয় মূর্তি

অসাধারণ পাগলামি

চায়ের পালা শেষ৷

জয়ন্ত বললে, ‘মানিক, অঃতপর কিংকর্তব্য? এক চাল দাবা-বোড়ে খেলবে নাকি?’

-‘রাজি৷’ মানিক উঠে দাবা-বোড়ের ছক আনতে গেল৷

-‘সুন্দরবাবু কী করবেন? খেলা দেখবেন, না থানায় ফিরবেন?’

-‘ওই ইজিচেয়ারে আরাম করে পা ছড়িয়ে শুয়ে আমি একটা গোটা চুরুটকে ভস্মে পরিণত করব৷’

-‘হাতে বুঝি নতুন মামলা নেই?’

-‘বিশেষ কিছু নয়৷’

-‘তবু শুনি না৷’ ঘুঁটি সাজাতে সাজাতে বললে জয়ন্ত৷

-‘এ একটা নিতান্ত বাজে মামলা ভাই, ল্যাজা কি মুড়ো কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না৷ এ মামলায় গোয়েন্দা না ডেকে ডাক্তার ডাকা উচিত৷’

-‘অর্থাৎ?’

-‘পাগলামি আর কি! কিন্তু অদ্ভুতরকম পাগলামি! সুভাষচন্দ্র বসুকে সারা দেশ ভক্তি করে তো? কিন্তু দেশে এমন লোকও আছে, যে নেতাজির প্রতিমূর্তি দেখলেই খেপে গিয়ে আছড়ে চুরমার করে দেয়!’

-‘ধ্যেত, ও আমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই৷’ জয়ন্ত একটা বোড়ের চাল দিলে৷

-‘হ্যাঁ, পাগলামি সারাবার জন্যে ডাক্তার ডাকা উচিত৷ কিন্তু কেউ যদি নেতাজির উপরে নিজের আক্রোশ মেটাবার জন্যে পরের বাড়িতে ঢুকে নেতাজির প্রতিমূর্তি চুরি করে, তাহলে পুলিশ না ডেকে উপায় থাকে না৷’

জয়ন্ত খেলা ভুলে সিধে হয়ে বসে বললে, ‘মূর্তি ভাঙার জন্যে মূর্তি চুরি? ব্যাপারটা চিত্তাকর্ষক বলে মনে হচ্ছে! বলুন তো খুলে৷’

-‘চিৎপুর রোডে শিল্পকলা বলে এক দোকান আছে, তার মালিক হচ্ছেন অনিল বসু৷ ওখানে বিক্রি হয় নানারকম ছবি আর মূর্তি৷ দোকানের এক কর্মচারী সামনের দিক ছেড়ে পিছন দিকে গিয়ে কোনো কাজে ব্যস্ত ছিল, হঠাৎ একটা লোক দোকানে ঢুকে কাউন্টারের উপর থেকে নেতাজির প্রতিমূর্তি তুলে নিয়ে মাটির উপর আছড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলে৷ তারপর এত তাড়াতাড়ি সে পালিয়ে যায় যে কেউ তাকে ধরতে পারেনি৷ এ হচ্ছে চার দিন আগেকার কথা৷ দোকানের মালিক বিটের পাহারাওয়ালার কাছে অভিযোগ করেছিলেন বটে, কিন্তু ওই পর্যন্ত! প্লাস্টারে গড়া মূর্তি, দাম দশ টাকা মাত্র৷ তুচ্ছ ব্যাপার!

‘তারপর দ্বিতীর ঘটনা৷ এটা কিঞ্চিৎ গুরুতর, আর অদ্ভুতও বটে৷ ঘটেছে কাল রাত্রে৷

‘ডাক্তার চারু চক্রবর্তীর নাম শুনেছ তো? তাঁর বাসভবন হচ্ছে সিমলায়, আর ডাক্তারখানা কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে৷ তিনি নেতাজির গোঁড়া ভক্ত৷ ওই শিল্পকলা থেকেই তিনি নেতাজির দু-টি প্রতিমূর্তি কিনেছিলেন৷ তার একটিকে রেখেছিলেন বসতবাড়িতে, আর একটিকে ডাক্তারখানায়৷ কাল রাত্রে বাড়িতে চোর ঢুকেছিল, কিন্তু আশ্চর্য এই যে, সে নেতাজির মূর্তি ছাড়া আর কিছুই চুরি করেনি! বাড়ির বাইরেকার বাগানে গিয়ে মূর্তিটা দেওয়ালে আছড়ে ভেঙে সে লম্বা দিয়েছে৷’

জয়ন্ত চমৎকৃত হয়ে বললে, ‘আজব কাণ্ড! তিনটে মূর্তিই কি এক ছাঁচ থেকে গড়া?’

-‘হ্যাঁ৷ তারপর শোনো৷ আজ সকালে চারুবাবু ডাক্তারখানায় ঢুকে দেখেন, সেখানেও কাল রাত্রে কে এসে নেতাজির মূর্তি নিয়ে ভেঙেছে আর মেঝের উপরে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে তার ভাঙা টুকরোগুলো! এই তো ব্যাপার জয়ন্ত৷ এ কীরকম মামলা ভায়া?’

-‘কেবল অদ্ভুত নয়, সৃষ্টিছাড়া বলাও চলে৷ কিন্তু লোকটা যদি পাগল হয়, তাহলে তার পাগলামির ভিতর বেশ একটি পদ্ধতি আছে দেখছি৷’

-‘পদ্ধতি?’

-‘হ্যাঁ৷ চারুবাবুর বাড়ি থেকে মূর্তিটা সে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল, পাছে মূর্তি-ভাঙার শব্দে বাড়ির লোকের ঘুম ভেঙে যায় এই ভয়ে৷ কিন্তু ডাক্তারখানায় অন্য লোকের ভয় নেই, তাই মূর্তিটা ভাঙা হয়েছে ঘরের ভিতরেই৷ ঘটনাগুলো আপাতত অকিঞ্চিতকর বলেই মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু জানেন তো সুন্দরবাবু, গোয়েন্দার কাছে অকিঞ্চিতকর নয় কিছুই৷ আমি একবার ঘটনাস্থলে একগাছা ভাঙা লাঠি পেয়ে হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করেছিলুম৷ যাক সেকথা৷ এই পাগল আবার যদি কোনো কাণ্ড করে, আমাকে জানাবেন৷ এখন আপনি খান চুরুট, আমরা খেলি দাবা-বোড়ে৷’

দুই

হারাধনবাবুর দগ্ধাদৃষ্ট

নতুন ঘটনা ঘটতে দেরি লাগল না৷

পরদিন প্রভাত৷ টেলিফোনের টুংটাং শুনে রিসিভারটা তুলে নিয়ে জয়ন্ত শুনলে সুন্দরবাবু বলছেন: ‘শিগগির এসো৷ পনেরো নম্বর পঞ্চানন পাল স্ট্রিটে৷’

রিসিভারটা যথাস্থানে স্থাপন করে মানিকের দিকে ফিরে জয়ন্ত বললে, ‘চটপট চুমুক দিয়ে চা শেষ করো৷ সুন্দরবাবুর আমন্ত্রণ এসেছে৷’

-‘ব্যাপারটা কী?’

-‘ঠিক বোঝা গেল না৷ খুব সম্ভব সেই মূর্তিধ্বংসকারী উন্মাদের নতুন কীর্তি৷’

পঞ্চানন পাল স্ট্রিটে পনেরো নম্বর হচ্ছে একখানা সাধারণ বাড়ি৷  দরজার সামনে রাস্তার উপরে কৌতূহলী জনতা৷

জয়ন্ত বললে, ‘এত ভিড় কেন? নিশ্চয়ই যা-তা ব্যাপার নয়! ওই যে, বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন সুন্দরবাবু৷ কী মশাই, খবর কী?’

সুন্দরবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, ‘বাড়ির ভিতর এসো৷’

বৈঠকখানায় বসে আছেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক, তাঁর ভাবভঙ্গি অত্যন্ত উত্তেজিত৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘ইনি হচ্ছেন বিখ্যাত রিপোর্টার হারাধনবাবু৷ তোমাদের পরিচয় আর দিতে হবে না, ইনি তোমাদের চেনেন৷’

-‘জরুরি তলব করেছেন কেন?’

-‘হুম, আবার সেই নেতাজি মূর্তির মামলা৷’

-‘আবার নতুন কোনো মূর্তিভঙ্গ হয়েছে?’

-‘আবার মূর্তিভঙ্গের উপর হত্যাকাণ্ডও! হারাধনবাবু, ব্যাপারটা খুলে বলুন তো!’

বিরসবদনে হারাধনবাবু বললেন, ‘এ যেন প্রকৃতির নির্দয় পরিহাস! পরের খবর সংগ্রহ করতে করতে সারা জীবন কাটিয়ে দিলুম, আর আমার নিজের বাড়ির এত বড়ো খবরটা নিয়ে  কাগজে পাঠাতে পারছি না, আমার মাথা এমন ভয়ানক গুলিয়ে গিয়েছে! বাইরের রিপোর্টারের মতন আমি যদি এখানে আসতুম, প্রত্যেক কাগজের জন্য অন্তত দু-কলম করে খবর পাঠাতে পারতুম৷ তা তো হলই না, উলটে এর-ওর-তার কাছে বারবার বলে বলে খবর ক্রমেই বাসি করে ফেলছি৷ তবে আপনার কথা আলাদা জয়ন্তবাবু! আপনি যদি সব শুনে এই অদ্ভুত রহস্যের কোনো হদিস দিতে পারেন তবে আমার মস্ত লাভ হতে পারে৷’

জয়ন্ত চুপ করে শুনলে, কিছু বললে না৷

হারাধনবাবু বললেন, ‘মাস-চারেক আগে শ্যামবাজারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে আমি নেতাজির একটি প্রতিমূর্তি কিনেছিলুম৷ মনে হচ্ছে সেই মূর্তির জন্যেই এই অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা! বাড়ির সব উপরকার ঘরে বসে অনেক রাত পর্যন্ত আমাকে কাজ করতে হয়, কালও করছিলুম৷

‘গভীর রাতে বাড়ির একতলায় একটা যেন শব্দ হল! খানিকক্ষণ কান পেতে রইলুম, কিন্তু আর কিছু শুনতে না পেয়ে ভাবলুম, শব্দটা এসেছে বাড়ির বাহির থেকেই৷ মিনিট পাঁচেক কাটল৷ তারপরই বিষম এক আর্তনাদ! জয়ন্তবাবু অমন ভয়াবহ আর্তনাদ আমি জীবনে আর কখনো শুনিনি৷ তার স্মৃতি জীবনে আর কোনোদিন ভুলতে পারব না৷ ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে দু-এক মিনিট চুপ করে বসে রইলুম৷ তারপর একগাছা লাঠি নিয়ে নীচে নেমে এলুম৷ বৈঠকখানায় অর্থাৎ এই ঘরে ঢুকে দেখি, টেবিলের উপর থেকে অদৃশ্য হয়েছে নেতাজির প্রতিমূর্তিটা৷ সব ফেলে এই কমদামি জিনিসটা নিয়ে গিয়ে চোরের কী লাভ হবে, কিছুই বুঝতে পারলুম না৷

‘এমন সময়ে নজর পড়ল, বৈঠকখানা থেকে রাস্তার দিকে যাবার দরজাটা রয়েছে খোলা৷ এই পথ দিয়েই চোর পালিয়েছে বুঝে আমিও অগ্রসর হলুম৷ বাইরে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার, হঠাৎ একটা দেহের উপরে ঠোক্কর খেয়ে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলুম কোনো গতিকে৷ দেহটার অস্বাভাবিক স্পর্শ পেয়েই বুঝলুম, সেটা হচ্ছে মৃতদেহ৷

‘দৌড়ে বাড়িতে এসে একটা লন্ঠন নিয়ে ফিরে গিয়ে দেখি যেন রক্তনদীর ভিতরে ভাসছে একটা মানুষের মৃতদেহ, গলার উপরে তার প্রচণ্ড অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন! চিত হয়ে সে পড়ে আছে, হাঁটু দুটো গুটানো, মুখটা বিশ্রী ভাবে হাঁ করা! মশাই, এবার থেকে রোজ সে বোধ হয় স্বপ্নে আমাকে দেখা দেবে৷ পুলিশ, পুলিশ! করে বারকয়েক চিৎকার করে আমি তখনই অজ্ঞান হয়ে গেলুম৷ তারপর কী হয়েছিল জানি না৷ কতক্ষণ পরে জ্ঞান হলে দেখলুম, আমার শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক পাহারাওয়ালা৷

সব শুনে জয়ন্ত বললে, ‘কিন্তু মৃতদেহটা কার?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, সেইটেই হচ্ছে প্রশ্ন৷ লাশটা শবাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে গেলেই দেখতে পাবে৷ এখন পর্যন্ত আমরা কিছুই ঠিক করতে পারিনি৷ লোকটা বেশ ঢ্যাঙা-ঢোঙা, গায়ের রং রোদে-পোড়া, দেখতে রীতিমতো জোয়ান, বয়স ত্রিশের বেশি নয়৷ পরণে তার গরিবের কাপড়, কিন্তু তাকে শ্রমিক বলে মনে হয় না৷ তার পাশে রক্তের ভিতরে পড়েছিল একখানা চাকু-ছুরি-সেখানা তার নিজের না হত্যাকারীর জানবার উপায় নেই৷ তার জামার পকেটের ভিতরে পাওয়া গিয়েছে সস্তায় তোলা একখানা ফটোগ্রাফ৷ এই দেখো৷

‘মর্কটের মতন একটা মূর্তির ছবি চেহারা দেখলে কার্তিক বলে ভ্রম হয় না-মুখ যেন বেবুনের মতো৷ পুরু পুরু ভুরু৷’

ফোটোখানা ভালো করে পরীক্ষা করে জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করলে, ‘নেতাজির মূর্তির খবর কী?’

-‘তোমাদের আসবার একটু আগে সে খবরও পেয়েছি৷ এখান থেকে খানিক তফাতে মনোমোহন মল্লিক রোডে একখানা খালি বাড়ির সামনেকার বাগানে খণ্ড-বিখণ্ড অবস্থায় ভগ্নাবশেষ পাওয়া গিয়েছে৷ আমি সেখানে যাচ্ছি, তুমিও আসবে না কি?’

-‘নিশ্চয়! হারাধনবাবু কি তাঁর সম্পত্তির ভগ্নাবশেষ দেখতে চান?’

হারাধনবাবু ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘সময় নেই মশাই, সময় নেই! এই হত্যাকাণ্ডের খবর এতক্ষণে নিশ্চয় অন্য অন্য রিপোর্টারদের হাতে গিয়ে পড়েছে, অথচ আমার বাড়িতে খুন, আর আমি কিছু লিখতে পারলুম না৷ হায়রে, এমনি আমার দগ্ধাদৃষ্ট! আরে মশাই, সেদিন ফুটবল খেলার মাঠে গ্যালারি ভেঙে পড়ে কী বিষম কাণ্ড হয়, শুনেছেন তো? সেই সর্বনেশে গ্যালারিতে ছিলুম আমি স্বয়ং! সব কাগজেই রিপোর্টাররা সেই খবর নিয়ে দস্তুরমতো হুলুস্থুল বাধিয়ে দিলে, কেবল আমার কাগজই চুপচাপ! কারণ আমি তখন চোট খেয়ে কাত! বরাত আর কাকে বলে! যাই, আজকের কাণ্ড নিয়ে কতটা লিখতে পারি চেষ্টা করে দেখি৷ যেমন করে হোক মুখ বাঁচাতে হবে তো?’

তিন

হিরালাল

যে মহামানুষকে নিয়ে ভারতে এবং ভারতের বাইরে বিস্ময়কর আন্দোলনের সাড়া পড়ে গিয়েছিল, যাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দু ও মুসলমান পরস্পরকে সত্যিকার ভাই বলে মেনে নিয়েছিল এবং যাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবকে বাধা দিতে গিয়ে মহাত্মা গান্ধীকে পর্যন্ত প্রকাশ্যে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছিল, তাঁরই খণ্ডবিখণ্ড প্রতিমূর্তির অভাবিত পরিণাম দেখে জয়ন্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ৷

তারপর সে ভগ্ন মূর্তির এক-একটা টুকরো একে একে কুড়িয়ে নিয়ে অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করতে লাগল৷

তার মুখ দেখেই মানিক বুঝতে পারলে যে, এতক্ষণ পরে জয়ন্ত একটা-না-একটা সূত্র খুঁজে পেয়েছে৷

জয়ন্ত বললে, ‘স্পষ্ট গন্ধ পেতে এখনও দেরি আছে৷ কিন্তু তবু-তবু-তবু-হ্যাঁ, একটু-আধটু আলোর আভাস পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে যেন! যে অদ্ভুত অপরাধীটি এই মামলার সঙ্গে জড়িত, তার কাছে এই যৎসামান্য পুতুলের মূল্য যেকোনো মানুষের প্রাণের চেয়েও বেশি! অথচ পুতুলটা হস্তগত করেই সে ভেঙে ফেলে!’

-‘পাগলের পাগলামি আর কাকে বলে?’

-‘না, তা নয় সুন্দরবাবু৷ একটা মস্ত কথা ভেবে দেখুন৷ মূর্তিটা সে হারাধনবাবুর বাড়ির ভিতরেও ভাঙেনি, বাইরেও ভাঙেনি, ভেঙেছে এত দূরে এসে-অথচ তার উদ্দেশ্য ছিল, মূর্তিটা হাতে পেলেই ভেঙে ফেলা৷’

-‘যে লোকটা খুন হয়েছে, সে হঠাৎ এসে পড়াতেই হয়তো মূর্তিটাকে ঘটনাস্থলে ভেঙে ফেলা সম্ভবপর হয়নি৷’

-‘হতে পারে৷ কিন্তু বাগানের ভিতর এই বাড়ির অবস্থানের দিকে আপনি ভালো করে লক্ষ করেছেন কি?’

সুন্দরবাবু চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আরে লক্ষ আবার করব কী? এটা হচ্ছে খালি বাড়ি, আসামি তাই বুঝেছিল যে, কেউ তার কার্যকলাপের দিকে দৃষ্টি রাখতে পারবে না!’

-‘আপনি হয়তো দেখেননি, কিন্তু আমি দেখেছি যে, হারাধনবাবুর বাড়ি থেকে এখানে আসবার আগেই পাওয়া যায় আর একখানা খালি বাড়ি৷ আসামি সেখানেই মূর্তিটা ভাঙেনি কেন? সে কেবল মূর্তি চুরি করেনি, একটা নরহত্যাও করেছে৷ যত দূরে মূর্তিটা বহন করে নিয়ে আসবে তার পক্ষে ততই বেশি বিপদের সম্ভাবনা৷ তবু কেন সে গ্রহণ করেনি মূর্তি ভাঙবার প্রথম সুযোগ?’

সুন্দরবাবু হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই৷’

মাথার উপরকার গ্যাসপোস্টের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে জয়ন্ত বললে, ‘আগেকার খালি বাড়িতে আলো ছিল না, কিন্তু এখানে আলো আছে৷ আসামি অন্ধের মতো মূর্তি ভাঙতে রাজি নয়, মূর্তির ভাঙা টুকরোগুলো ভালো করে স্বচক্ষে দেখতে চায়৷’

-‘এ থেকে কী বুঝব?’

-‘আপাতত কিছুই বোঝবার দরকার নেই৷ পরে হয়তো এটা একটা বড়ো সূত্র বলে গণ্য হবে৷ যাক৷ এখন আপনি কী করতে চান সুন্দরবাবু?’

-‘আমি? আমি আগে দেখব, মৃতদেহটা কেউ শনাক্ত করতে পারে কি না৷ সে কে, আর তার বন্ধুবান্ধবই বা কারা, এটা জানতে পারলে মামলাটার কিনারা করা কিছুই কঠিন হবে না৷ তাই নয় কি?’

-‘খুব সম্ভব তাই৷ আমি কিন্তু অন্যভাবে মামলাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চাই৷’

-‘কীরকম?’

-‘আপাতত আমার মত আপনার ঘাড়ে চাপাতে আমি রাজি নই৷ আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করি আসুন৷ খানিকটা অগ্রসর হবার পর আবার দু-জনে মিলে পরামর্শ করা যাবে, কী বলেন?’

-‘বহুত আচ্ছা৷’

-‘মৃতের পকেট থেকে যে ফটোখানা পাওয়া গেছে সেখানা আমায় দিতে পারেন৷’

-‘এই নাও, কিন্তু ছবিখানা কালকেই ফিরিয়ে দিয়ো৷’

-‘উত্তম৷ এখন বিদায় নিলুম৷’

খানিক দূর এসে জয়ন্ত ডাকলে, ‘মানিক৷’

-‘উঃ৷’

-‘হারাধনবাবু নেতাজির মূর্তিটা কিনেছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে৷ চলো, সেখানে যাই৷’

শ্যামবাজারের লক্ষ্মী ভাণ্ডারে গিয়ে শোনা গেল দোকানের মালিক অনুপস্থিত৷ বৈকালের আগে ফিরবেন না৷

জয়ন্ত বললে, ‘আপাতত লক্ষ্মী ভাণ্ডারে আমাদের ঠাঁই হল না৷ অঃতপর হাঁড়ির অন্য ভাত টিপে দেখতে হবে৷ চলো মানিক, চিৎপুর রোড়ের শিল্পশালায়৷’

শিল্পশালার মালিক অনিলবাবু জয়ন্তের প্রশ্ন শুনে বললেন, ‘হাঁ মশাই! ওই কাউন্টারের উপরই ছিল নেতাজির মূর্তিটা৷ যদি যে-কোনো বদমাইস যখন খুশি যেখানে-সেখানে ঢুকে যা ইচ্ছা তাই করে লম্বা দিতে পারে, তাহলে মিথ্যে আমরা টেক্সো দিয়ে মরি কেন?’

-‘ডাক্তার চারু চক্রবর্তীও তো আপনার কাছ থেকে নেতাজির আর দুটো মূর্তি কিনেছিলেন?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ কিন্তু সেখানেও তো শুনেছি এই কাণ্ড হয়েছে! এসব আর কিছু নয়, কমিউনিস্টদের কীর্তি!’

-‘আপনার এখানে নেতাজির আর কোনো মূর্তি আছে?’

-‘না মশাই, আর নাই৷’

-‘ওই মূর্তি তিনটি আপনি কোথা থেকে কিনেছিলেন?’

-‘বড়োবাজারের আগরওয়ালা এন্ড সন্স থেকে৷ ওঁদের অনেক দিনের মস্ত বড়ো কারবার৷’

-‘এই ফটোখানা কার বলতে পারেন?’

-‘উঁহু৷ না, না চিনেছি! হিরালাল৷’

-‘হিরালাল কে?’

-‘পাথরের কারিগর৷ অল্পস্বল্প মূর্তি গড়তে আর ছবির ফ্রেম গিলটি করতে পারে৷ গেল হপ্তাতেও সে এখানে কাজ করে গেছে৷ তার ঠিকানা আমি জানি না৷ সে চলে যাবার ঠিক দু-দিন পরেই আমার দোকানের মূর্তিটা কে ভেঙে দিয়ে পালিয়ে যায়৷’

শিল্পশালার বাইরে এসে মানিক বললে, ‘তুমি কোন তালে আছ কিছুই বুঝছি না জয়ন্ত! এইবারে কোন দিকে যাত্রা?’

-‘বড়োবাজারে৷ আগরওয়ালা এন্ড সন্সের কারখানায়৷’

বড়োবাজার-অন্ধকার ও দুর্গন্ধের মুল্লুক৷ সংকীর্ণ অলি-গলির অশান্ত জনস্রোত ভেদ করে জয়ন্ত ও মানিক যথাস্থানে এসে হাজির হল৷ ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে একটা দ্বারপথ দিয়ে তারা দেখতে পেলে, উঠানে বসে কারিগরদের কেউ পাথর কাটছে, কেউ ছাঁচ থেকে মূর্তি গড়ছে৷

ম্যানেজার মাড়োয়ারি৷ জয়ন্তের জিজ্ঞাসার জবাবে পুরাতন খাতা খুলে দেখে বললেন, ‘আমরা নেতাজির অনেক মূর্তি গড়েছি৷ বছর খানেক আগে একই ছাঁচ থেকে নেতাজির যে মূর্তি গড়া হয় তার মধ্যে তিনটি গিয়েছে শিল্পশালায় আর বাকি তিনটি পাঠানো হয়েছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে৷ পরে ওই ছাঁচ থেকে আরও অনেক মূর্তি গড়া হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলি পাঠানো হয়েছে  কলকাতার বাইরে৷’

-‘মূর্তিগুলি কেমন করে তৈরি করা হয়?’

-‘মুখের দুই ধার থেকে নেওয়া দুটো ছাঁচ৷ তারপর ছাঁচ দুটো একসঙ্গে যুক্ত করে মূর্তি গড়া হয়৷ ভিতরটা থাকে ফাঁপা৷ ভিজে প্লাস্টার, শুকিয়ে গেলে গুদামজাত করা হয় মূর্তিগুলো৷’

জয়ন্ত ফটোখানা বার করে বললে, ‘একে চেনেন কি?’

ম্যানেজারের মুখে-চোখে ফুটে উঠল ক্রোধের চিহ্ন৷ উত্তপ্ত ভাবে তিনি বললেন, ‘সেই বদমাইস হিরালাল৷ ওকে আবার চিনি না, খুব চিনি! ওরই জন্যে আমাদের কারখানায় হাঙ্গামা হয়৷’

-‘তাই নাকি?’

-‘হ্যাঁ মশাই, হ্যাঁ৷ হিরালাল জয়পুরের লোক৷ সে আর এক জয়পুরিয়াকে ছোরা মেরে এসে ভালোমানুষের মতো কারখানায় বসে কাজ করছিল, তারপর পুলিশ আমাদের কারখানায় ঢুকে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, আর আমাদেরও ছুটোছুটি করে মরতে হয় থানায় আর আদালতে৷ ওরকম বাঁদরমুখো মানুষকে কাজ দিয়ে আমরাই অন্যায় করেছিলুম৷ কিন্তু মশাই, সে খুব পাকা কারিগর৷’

-‘বিচারে তার শাস্তি হয়?’

‘হ্যাঁ৷ যাকে ছোরা মেরেছিল সে মরেনি বলে হিরালাল সে যাত্রা বেঁচে যায়৷ মাত্র এক বছর জেল খেটে এখন সে বোধ হয় মুক্তি পেয়েছে৷ কিন্তু সে আর এমুখো হবার ভরসা করবে না৷ তার এক সম্পর্কীয় ভাই এখানে করে, তারও সঙ্গে কথা কইবেন নাকি?’

জয়ন্ত ব্যস্ত ভাবে বলে উঠল ‘না, না, তাকে ডাকবার দরকার নেই৷ অনুগ্রহ করে তাকে আমাদের কোনো কথাই জানাবেন না৷’

-‘ব্যাপারটা কি গোপনীয়?’

-‘হ্যাঁ, অত্যন্ত৷ তারপর আর একটি জিজ্ঞাস্য আছে৷ পাকা খাতা দেখে আপনি তো বললেন যে, নেতাজির ওই ছয়টি মূর্তি গেল বছরের ৩-রা জুন তারিখে এখান থেকে বাইরে গিয়েছে৷ আচ্ছা, হিরালাল গ্রেপ্তার হয় কোন তারিখ বলতে পারেন?’

-‘ঠিক তারিখ মনে নেই৷ তবে সে কোন তারিখে শেষ মাইনে নিয়েছে খাতা দেখে তা বলতে পারি৷’

-‘বেশ, তাহলেই আমার চলবে৷’

খাতার পাতা উলটে ম্যানেজার বললেন, ‘হিরালাল শেষ মাইনে নিয়েছে গেল বছরের ২০শে মে তারিখে৷ সে প্রায় ওই সময়েই গ্রেপ্তার হয়৷’

-‘ধন্যবাদ৷ আর আপনাকে জ্বালাতন করব না৷ এসো মানিক!’

বৈকাল বেলায় জয়ন্ত ও মানিকের আবির্ভাব হল শ্যামবাজারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে৷ মস্ত বড়ো দোকান-অনেকগুলো বিভাগ৷ তারা একেবারে ম্যানেজারের সঙ্গে গিয়ে দেখা করলে৷

তাদের পরিচয় পেয়ে ম্যানেজার বললেন, ‘হ্যাঁ মশাই, হারাধনবাবুর বাড়ির খবর আমরা পেয়েছি৷ তিনি আমাদের পুরোনো খরিদ্দার৷ নেতাজির মূর্তিটি তিনি আমাদের এখান থেকেই কিনেছিলেন বটে৷’

জয়ন্ত শুধোলে, ‘আপনাদের এখানে আরও দু-টি নেতাজির মূর্তি আছে?

-‘না মশাই নেই৷ বিক্রি হয়ে গিয়েছে৷ যাঁরা কিনেছেন তাঁরাও আমাদের চেনা খরিদ্দার৷ খাতায় তাঁদের নাম আর ঠিকানা আছে৷’

-‘তাই আমি চাই৷’

খাতা দেখে ম্যানেজার বললেন, ‘একজনের নাম প্রফেসর সুরেশচন্দ্র বসু৷ ঠিকানা-চার নম্বর রাজেন রক্ষিত লেন, কলকাতা৷ আর একজন হচ্ছেন শ্যামাপ্রসাদ সেন৷ ঠিকানা-সাত নম্বর চন্দ্রকান্ত রোড, শ্রীরামপুর৷’

-‘আপনাদের কর্মচারীরা ইচ্ছা করলেই ওই খাতার উপরে চোখ বুলোতে পারে তো?’

-‘তা পারবে না কেন? এ খাতা তো গোপনীয় নয়৷’

-‘ফটোর এই লোকটাকে কখনো দেখেছেন?’

-‘জীবনে নয়৷ অমন বাঁদুরে চেহারা একবার দেখলে ভোলা অসম্ভব!’

-‘হ্যাঁ, আর একটা প্রশ্ন৷ আপনার এখানে জয়পুরের কোনো লোক কাজ করে?’

-‘করে বই কী! এক জন নয়, তিন জন৷’

-‘আচ্ছা মশাই, নমস্কার৷’

চার

খুশি মুখ আরও খুশি

সান্ধ্য চায়ের বৈঠক৷

মানিক বললে, ‘তোমার মুখ যে আজ ভারি খুশি খুশি দেখাচ্ছে জয়ন্ত৷’

-‘বুঝতে পেরেছ?’

-‘তোমাকে দেখে আমি বুঝতে পারব না? তোমার মুখ যে আমার কাছে দশ বার পড়া কেতাবের মতো পুরোনো৷’

-‘উপমায় তুমি দেখছি কালিদাস!’

-‘খুশি হবার কারণটা কী বলো দেখি?’

-‘সবুর করো, সবুরে মেওয়া ফলে৷ আমি এখন সুন্দরবাবুর জন্য অপেক্ষা করছি৷ . . . না, না, আর অপেক্ষা করতে হবে না-সিঁড়ির উপরে ওই যে তাঁর পায়ের শব্দ৷’

মানিক চেঁচিয়ে বললে, ‘ইংরেজিতে প্রবাদ আছে যে, স্মরণ করলেই শয়তান দেখা দেয়৷ তুমি সুন্দরবাবুকে স্মরণ করেছ, সুতরাং-‘

ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে সুন্দরবাবু বললেন, ‘তোমার কথা আমি শুনতে পেয়েছি মানিক৷ আমাকে কার সঙ্গে তুলনা করছ?’

-‘তুলনা নয়, আমি একটা প্রবাদের কথা বলছিলুম৷’

-‘চুলোয় যাক তোমার প্রবাদ৷ ওসব ছেঁড়া কথায় কান দেবার সময় আমার নেই৷ হ্যাঁ হে জয়ন্ত, তোমার খবর কী?’

-‘ভালো৷ নেতাজির মূর্তি নিয়ে আজ যথেষ্ট গবেষণা করা গিয়েছে৷’

-‘নেতাজির মূর্তির পিছনে এখনও তুমি লেগে আছ? বেশ, বেশ যার যা পদ্ধতি, আমি আপত্তি করব না৷ আমি কিন্তু এবারে তোমাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছি৷’

-‘অ্যাঁ:, তাই নাকি?’

-‘যে লোকটা খুন হয়েছে তাকে শনাক্ত করতে পেরেছি৷’

-‘বলেন কী!’

-‘খুনের কারণও আবিষ্কার করে ফেলেছি৷’

-‘সাধু, সাধু!’

-‘অবনীবাবুকে জানো তো?-ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের৷ যত মেড়ুয়াবাসীর নাম-ধাম-চেহারা তাঁর নখদর্পনে৷ লাশটা দেখেই তিনি চিনে ফেলেছেন৷ যার লাশ তার নাম হচ্ছে রাধাকিষণ, দেশ জয়পুরে৷ লোকটা নাকি পয়লা নম্বরের গুন্ডা, একটা মস্ত দলের সর্দার৷ অথচ সে হচ্ছে ভদ্রবংশের ছেলে৷ দেশে সুমিত্রা নামে তার এক ভগ্নী আছে, সেও একবার একটা চুরির মামলায় জড়িত হয়ে পড়ে, কিন্তু প্রমাণ অভাবে খালাস পায়৷ তাহলেই ব্যাপারখানা কতটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে বুঝেই দেখ৷ আমার কী আন্দাজ জানো? যে তাকে খুন করেছে সেও দলের লোক৷ যেকোনো কারণে রাধাকিষণ তাকে পথ থেকে সরাতে চেয়েছিল৷ ঘটনার রাত্রে হঠাৎ তাকে হারাধনবাবুর বাড়ির ঢুকতে দেখে সে তার অপেক্ষায় পথের উপরে দাঁড়িয়ে ছিল৷ তারপর সে বেরিয়ে এলে তাকে আক্রমণ করতে গিয়ে রাধাকিষণ নিজেই পটল তুলতে বাধ্য হয়৷ কী বল জয়ন্ত, আমার আন্দাজ কি ভুল?’

জয়ন্ত হাততালি দিয়ে বলে উঠল, ‘খাসা সুন্দরবাবু খাসা! কিন্তু এক ফোঁটা চোনা রয়ে গেল নাকি?’

-‘কেন?’

-‘খুনি নেতাজির মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলে কেন?’

-‘আরে, রেখে দাও নেতাজির মূর্তি! ওকথা কি তুমি কিছুতেই ভুলতে পারবে না? তুচ্ছ পুতুলচুরি, বড়োজোর ছয় মাস জেল৷ কিন্তু আসলে এটা খুনের মামলা, আর সেইটেই হচ্ছে ধর্তব্য৷’

-‘এর পর আপনার কী কর্তব্য হবে?’

-‘খুব সোজা৷ অবনীবাবুকে নিয়ে যাব বড়োবাজারের বস্তিতে৷ খুব সম্ভব ফোটোর লোকটাকে তাহলে আজকেই গ্রেপ্তার করতে পারব৷ তুমি কি আমাদের সঙ্গে আসবে?’

-‘উঁহু৷ আমার বিশ্বাস আরও সহজে আসামির দেখা পেতে পারি৷ অবশ্য আমি জোর করে কিছুই বলতে চাই না৷ আপনি যদি আজ রাত্রে আমাদের সঙ্গে আসেন, আর দৈব সহায় হয়, তাহলে হত্যাকারী নিজেই আপনার হাতের মুঠোর ভেতরে এসে পড়বে৷’

-‘কোথায় যেতে হবে শুনি৷ বড়োবাজারে?’

-‘না, চার নম্বর রাজেন রক্ষিত লেনে৷ আমি অঙ্গীকার করছি সুন্দরবাবু, আমার আন্দাজ ভুল হলে কাল আমি আপনাদের সঙ্গে বড়োবাজারের বস্তিতে ভ্রমণ করতে যাব৷ কী বলেন, রাজি তো৷’

-‘হুম!’

মানিক সকৌতুকে বললে, ‘হুম? এখান হুম মানে কী দাদা? হুঁ?’

-‘তাই ধরে নাও৷’

জয়ন্ত টেবিলের সামনে গিয়ে একখানা  কাগজে তাড়াতাড়ি কী লিখে সেখানা খামের ভিতরে পুরলে৷ তারপর খামের উপরে ঠিকানা লিখতে লিখতে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘মধু! ওরে অ মধু! শ্রীমধুসূদন!’

পুরাতন ভৃত্য মধু এসে হাজির৷ -‘আজ্ঞে বাবু৷’

-‘যাও তো বাপু এই চিঠিখানা নিয়ে৷ তুমি তো পড়তে জানো, খামের উপরে ঠিকানা লেখা আছে৷ পারো তো দৌড়ে যাও-বড্ড জরুরি চিঠি!’

মধুর প্রস্থান৷ জয়ন্তের গাত্রোত্থান৷ সে বললে, ‘সুন্দরবাবু, তাড়াতাড়ি বাড়িতে গিয়ে খেয়ে-দেয়ে খানিকটা গড়িয়ে নিন৷ রাত সাড়ে দশটার সময়ে আবার এখানে পদার্পণ করলেই চলবে৷ আমরা সাড়ে এগারোটার ভিতর যাত্রা করব৷’

সুন্দরবাবুর প্রস্থান৷ জয়ন্ত বললে, ‘মানিক, আমাকে এখন পাশের ঘরে গিয়ে পুরানো খবরের  কাগজের ফাইল ঘাঁটতে হবে৷ আজ রাত্রে বোধ হয় অনিদ্রাই ব্যবস্থা৷ তুমিও ইচ্ছা করলে অল্পবিস্তর বিশ্রাম করতে পারো৷’

রাত্রি প্রায় দশটার সময়ে পাশের ঘর থেকে জয়ন্ত বেরিয়ে এল ধূলিধূসরিত হস্তে৷

সোফার উপরে লম্বা হয়ে শুয়েছিল মানিক৷ বললে, ‘কী বন্ধু, তোমার খুশি মুখ যে আরও খুশি হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে!’

দুই ভুরু নাচিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘আমি যা খুঁজছিলুম তা পেয়েছি৷’

পাঁচ

হিরালাল কুপোকাত

রাত সাড়ে এগারোটা৷ সদর দরজায় অপেক্ষা করছিল জয়ন্তের মোটর৷ সুন্দরবাবুও মানিকের সঙ্গে সে মোটরে গিয়ে উঠল৷

সুন্দরবাবু যে সশস্ত্র সে বিষয়ে সন্দেহ নাস্তি৷ ‘মানিক, তুমিও রিভলবার এনেছ তো?’-জয়ন্ত বললে৷

-‘সেকথা আবার বলতে!’-মানিকের উত্তর৷

গাড়ি ছুটল৷ এ-রাস্তা ও-রাস্তা মাড়িয়ে গাড়ি যখন একটা চৌ মাথায় গিয়ে হাজির হল, কলকাতা শহর তখন যেন ঘুমিয়ে পড়বার চেষ্টা করছে!

জয়ন্ত চালককে ডেকে বললে, ‘গুট্টা সিং, গাড়ি থামাও৷ এইখানেই তুমি আমাদের জন্য অপেক্ষা করো৷ আমাদের এখন শ্রীচরণই ভরসা! নামো মানিক, নামুন সুন্দরবাবু! . . . আরে মশাই, আপনার নাসাযন্ত্র যে সংগীত সৃষ্টি করবার চেষ্টা করছে৷ বলি, ঘুমোলেন নাকি?’

সুন্দরবাবু ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসে প্রকাণ্ড একটি হাই তুলে বললেন, ‘ঘুমোইনি হে, ঘুমোইনি৷ এই বিষম গরমে শীতল সমীরণ সেবন করে কিঞ্চিত তন্দ্রাতুর হয়েছিলুম আর কি! আমি এখন সম্পূর্ণরূপে জাগ্রত৷ কী বলবে বলো-হুম!’

-‘এইবারে গাড়ি থেকে অবতরণ করবার সময় এসেছে৷’

-‘এসেছে নাকি? এই আমি নেমে পড়লুম৷’

-‘গাড়ি নিয়ে বেশি দূর যাওয়া সংগত নয়৷ এইবার পদব্রজে মিনিট পাঁচেক অগ্রসর হতে হবে৷’

-‘হুম-জো হুকুম৷ আমি প্রাচীন সৈনিক, যা বল তাইতেই রাজি৷ এই আমি সবেগে পদচালনা করলুম৷’

পথে আর লোক চলাচল নেই বললেই চলে৷ গোটা কয়েক কুকুর শহরের মৌনব্রত ভাঙাবার চেষ্টা করছে এবং রাস্তার এখানে-ওখানে দুই-তিনটি বা ততোধিক ষাঁড় গা এলিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে নির্বিকার ভাবে করছে রোমন্থন৷

চার নম্বর রাজেন রক্ষিত লেন৷ রেলিং-ঘেরা জমির ভিতর একখানা মাঝারি আকারের বাড়ি৷ তার গায়ে কোথাও নেই আলোর রেখা৷ বাড়ির লোকেরা নিশ্চয়ই শয্যায় আশ্রয় গ্রহণ করেছে৷ রাস্তার গ্যাস-পোস্টের আলোয় সুন্দরবাবু নামটা পাঠ করলেন-প্রফেসর সুরেশচন্দ্র বসু৷

জয়ন্ত বললে, ‘রাত্রেও এ বাড়ির ফটক বন্ধ হয় না দেখছি৷ চলুন সুন্দরবাবু বাগানে ওই হাস্নুহানার ঝোপের আড়ালে গিয়ে আমরা লুকিয়ে থাকি৷ হয়তো অনেক রাত পর্যন্ত আমাদের মশক-দংশন সহ্য করতে হবে৷ হয়তো সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেও আমাদের ভাগ্যে লাভ হবে প্রকাণ্ড একটি অশ্বডিম্ব৷ উপায় কী, যে পূজার যে মন্ত্র!’

কিন্তু জয়ন্তের আশঙ্কা সফল হল না৷ আধ ঘণ্টা কাটতে-না-কাটতেই কোথা থেকে আচমকা দেখা দিল একটা ছোট্ট কালো মূর্তি৷ তিরের মতন বাগানের ভিতর ছুটে এসেই সে বাড়ির ছায়ার ভিতরে কোথায় হারিয়ে গেল! ঠিক যেন একটা বানর! কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল নীরবে৷ তারপর একটা শব্দ-কে যেন একটা জানালা খুলছে ধীরে ধীরে৷ তারপর সব আবার চুপচাপ৷

জয়ন্ত বললে, ‘এসো মানিক, আমরা জানালার নীচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি৷ চোর বাইরে বেরুলেই গ্রেপ্তার করব৷’

কিন্তু তারা দুই-এক পা এগুবার আগেই, বাড়ির ভিতর থেকে আবার আবির্ভাব হল সেই মূর্তিটার৷ তার হাতের তলায় রয়েছে সাদা মতন কী একটা জিনিস! সে চারিদিকটা একবার চটপট দেখে নিলে, এখানকার নীরবতায় ও নির্জনতায় বোধ হয় আশ্বস্ত হল৷ হাতের জিনিসটা মাটির উপরে নামিয়ে রাখলে৷ তারপরই জেগে উঠল ফটাফট শব্দ!

জয়ন্ত সঙ্গীদের নিয়ে বেগে ছুটে এল তার কাছে৷ লোকটা তখন হেঁট হয়ে এমন একাগ্র মনে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে যে কিছু বুঝতে পারলে না৷ তার পিঠের উপর বাঘের মতো লাফিয়ে পড়ল জয়ন্ত৷ এবং সে কোনো বাধা দেবার আগেই মানিকের সাহায্যে সুন্দরবাবু হাতকড়া দিয়ে তার দুই হাত করলেন বন্দি৷ তাকে চিত করে ফেলতেই দেখা গেল তার হাড়-কুৎসিত বেবুনের মতো মুখখানা-অবিকল সেই ফটোগ্রাফের প্রতিচ্ছবি৷

জয়ন্ত মাটির উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল-সেখানে ইতস্তত বিকীর্ণ হয়ে আছে নেতাজির আর একটি মূর্তির ভাঙা টুকরো৷ সে একে একে টুকরোগুলো তুলে নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরীক্ষা করতে লাগল৷

এমন সময় বাড়ির ভিতরে জ্বলে উঠল আলো এবং  দরজা খুলে বেরিয়ে বাগানের উপর এসে দাঁড়াল আর এক মূর্তি৷

জয়ন্ত মুখ তুলে শুধোল, ‘আপনিই বোধ হয় প্রফেসর সুরেশচন্দ্র বসু?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ আর আপনি নিশ্চয়ই জয়ন্তবাবু? আপনার পত্র আমি যথাসময়েই পেয়েছি আর কাজ করেছি আপনার উপদেশ মতোই৷ যাক, বদমাইশটা ধরা পড়েছে দেখে খুশি হলুম৷ আসুন, একটু চা-টা খেয়ে যান৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘এই কি চা খাবার সময় মশাই? এই পরমসুন্দর মানুষটিকে লক-আপে পুরতে না পারলে আমি ঘুমোবারও সময় পাব না৷ দেখি সোনারচাঁদ, তোমার পকেটে কী সম্পত্তি আছে!’

বন্দি কোনো কথা কইল না৷ কিন্তু সুন্দরবাবু তার দিকে হাত বাড়াতেই সে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে খ্যাঁক করে তার হাত কামড়ে দিতে এল৷

সুন্দরবাবু চট করে নিজের হাতখানা সরিয়ে নিয়ে বলে উঠলেন, ‘ওরে বাবা হয়েছিল আর কি? তুই বেটা মানুষের ছদ্মবেশে বুনো জন্তু নাকি? হুম, এর মুণ্ডুটা দুই হাতে আচ্ছা করে চেপে ধরো তো মানিক৷ সাবধান, যেন কামড়ে না দেয়! এর পকেটগুলো হাতড়ে না দেখলে চলবে না৷’

আসামির পকেট হাতড়ে পাওয়া গেল কেবল তিন টাকা দশ পয়সা আর একখানা ছোরা৷

জয়ন্ত ছোরাখানা আলোতে পরীক্ষা করে বললে, হুঁ, এর হাতলে এখনও রক্তের দাগ লেগে রয়েছে দেখছি! নিশ্চয়ই গুন্ডা রাধাকিষণের রক্ত!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘ওহে রূপবান পুরুষ, কোন নাম ধরে তোমাকে সম্বোধন করব বাপু?’

বন্দি নিরুত্তর৷

-‘নাম বলবে না? জিতা রহো বেটা! কিন্তু তুমি তো জানো না, ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের অবনীবাবুর কাছে গেলে তোমার নামধাম আর যাবতীয় গুণাবলি কিছুই আর ধামাচাপা থাকবে না৷’

জয়ন্ত বললে, ‘রাত বাড়ছে সুন্দরবাবু৷’

-‘হ্যাঁ, আমরাও এইবার গা তুলব৷ কিন্তু ভাই জয়ন্ত, তুমি যে কেমন করে জানতে পারলে এই খুনেটা আজ আসবে, কিছু আমি বুঝতে পারছি না৷’

-‘আপাতত বুঝে কাজ নেই, কারণ আমার কাছেও এখনও সব রহস্য পরিষ্কার হয়নি৷ এ লোকটা নেতাজির মূর্তি ভাঙে কেন?’

-‘আরে থো করো ওকথা! এটা হচ্ছে খুনের মামলা, খুনি গ্রেপ্তার হয়েছে, এখনও তুমি নেতাজির মূর্তি নিয়ে মস্তক ঘর্মাক্ত করছ কেন?’

-‘না সুন্দরবাবু, এটা খুনের মামলা নয়, এটা হচ্ছে নেতাজির মূর্তির মামলা৷ আমার ধারণা খুনোখুনির কারণই হচ্ছে নেতাজির মূর্তি৷ সে কারণটা আবিষ্কার করতে না পারলে আদালতে আপনার খুনের মামলা ফেঁসে যাবে৷’

-‘অত বাক্যব্যয় কেন, কারণটা ব্যক্তই করো না বাপু৷’

-‘কারণটা অনুমান করেছি বটে, কিন্তু সে অনুমান সত্য বলে প্রমাণ করবার উপায় আমার হাতে নেই৷ তবে আসছে পরশু দিন বৈকালে আপনি যদি আমার বাড়িতে শুভাগমন করেন, তাহলে মেঘ সরিয়ে আপনাকে সূর্যালোক দেখাবার আশা করলেও করতে পারি৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘তুমি কবিতা লেখো না কেন জয়ন্ত?’

-‘হঠাৎ এ কী প্রশ্ন?’

-‘কবিদের মতো তোমার সব কথাই হেঁয়ালি! শুনি বটে, কিন্তু ধরা-ছোঁয়া বোঝা যায় না৷’

মানিক বললে, ‘জয়ন্ত কোন দুঃখে যে কবিতা লেখে না, আমি তা জানি৷ সে প্রতিজ্ঞা করেছে, সুন্দরবাবুর চেয়ে বুদ্ধিমান পাঠক না পেলে কোনোদিনই কবিতা রচনার জন্যে লেখনী ধারণ করবে না৷’

সুন্দরবাবু চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘থামো তুমি ঢাকের পিঠে ট্যামটেমি! তোমার ঘ্যানঘ্যানানি অসহনীয়৷’

ছয়

মমতাজ বেগমের কালো মুক্তা

নির্দিষ্ট দিনে যথাসময়ে সুন্দরবাবু দেখা দিলেন জয়ন্তের বৈঠকখানায়৷

জয়ন্ত বললে, ‘খবর শুভ তো?’

সুন্দরবাবু গর্বিতভাবে বললেন, ‘তোমার আগেই আমি সূর্যালোক দেখতে পেয়েছি জয়ন্ত৷’

-‘আপনি ভাগ্যবান৷’

-‘না, ঠাট্টা নয়, অবনীবাবু খোঁজখবর নিয়ে এর মধ্যেই আসামির সব গুপ্ত কথা জানতে পেরেছেন৷ তার নাম হিরালাল৷ বাড়ি জয়পুরে৷ আগে তার স্বভাব ভালোই ছিল, সৎপথে থেকে মূর্তি গড়ে বেশ দু-পয়সা রোজগার করত৷ তারপর কুসংসর্গে মিশে সে গোল্লায় যায়৷ দু-বার জেল খাটে-একবার চুরি করে, আর একবার ছোরা মেরে৷ নেতাজির মূর্তিগুলো কেন যে ভাঙত, এখনও তা জানা যায়নি, কারণ হিরালাল ও-সম্বন্ধে কোনো কথাই বলতে নারাজ৷ কিন্তু আমরা সন্ধান নিয়ে এইটুকু জানতে পেরেছি যে, সে মূর্তিগুলো তার নিজের হাতেই গড়া৷’ সুন্দরবাবু নিজের মনেই গড়গড় করে বলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু জয়ন্ত বোধ হয় মন দিয়ে তাঁর কথা শুনছিল না৷ থেকে থেকে সে যেন কান পেতে কী শোনে, মাঝে মাঝে উঠে জানালার ধারে যায়, তারপর আবার আসনে এসে বসে পড়ে৷

সুন্দরবাবু শুধোলেন, ‘তোমার আজ কী হয়েছে জয়ন্ত? তুমি এমন অন্যমনস্ক কেন?’

-‘বোধ হয় আমার হিসাবে ভুল হয়েছে৷ এখন আপনার কাছে কেমন করে মুখ রক্ষা করব জানি না৷’

-‘এ আবার কী কথা?’

-‘আজ এখানে আসবার জন্যে গেল কাল একজনকে টেলিগ্রাম করেছিলুম৷ কিন্তু নির্দিষ্ট সময় উতরে গেল, তিনি এলেন না৷’

-‘কে তিনি?’

-‘শ্যামাপ্রসাদ সেন, থাকেন শ্রীরামপুর৷’

-‘তাঁকে কী দরকার?’

-‘খুনি কেন যে নেতাজির মূর্তিগুলো ভাঙত, হয়তো এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে তাঁর কাছেই!’

-‘প্রশ্নের উৎপত্তি  কলকাতায়, আর উত্তর আসবে শ্রীরামপুর থেকে?’

জয়ন্ত সচমকে বললে, ‘মানিক, দরজায় একখানা গাড়ি এসে থামল না? একবার দেখে এসো তো!’

মানিক ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল একটি প্রাচীন ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে৷ তাঁর ডান হাতে খবরের  কাগজ দিয়ে মোড়া একটা জিনিস৷

জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করলে, ‘আপনিই কি শ্রীরামপুরের শ্যামাপ্রসাদবাবু?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ কিন্তু ঠিক সময়ে আসতে পারিনি বলে মাফ করবেন৷ আজকাল ট্রেনের ধরন-ধারণ জানেন তো?’

-‘বসুন! নেতাজির মূর্তিটি এনেছেন তো?’

-‘হ্যাঁ, এই যে আমার হাতে৷’

-‘উত্তম৷ তাহলে কাজের কথা হোক৷’

-‘জয়ন্তবাবু, আপনি কি সত্য সত্যই মূর্তিটি তিন-শো টাকা দিয়ে কিনতে চান?’

-‘নিশ্চয়ই৷’

-‘কেমন করে জানলেন ওই মূর্তিটি আমার কাছে আছে?’

-‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের ম্যানেজার আমাকে বলেছেন৷’

-‘তাহলে একথাও শুনেছেন তো মূর্তিটি আমি কিনেছি কত টাকা দিয়ে?’

-‘না৷’

-‘মশাই, আমি মস্ত ধনী নই বটে, কিন্তু ঠক-জুয়াচোরও নই৷ আগে থাকতেই আপনাকে জানিয়ে রাখতে চাই, মূর্তিটির দাম দশ টাকা মাত্র৷’

-‘শ্যামাপ্রসাদবাবু, আপনার সততা দেখে খুশিও হচ্ছি, বিস্মিতও হচ্ছি৷ মূর্তিটির আসল দাম যাই হোক, আমি তিন-শো টাকা দিয়েই ওটি আপনার কাছ থেকে কিনতে চাই৷’

শ্যামাপ্রসাদ কাগজের মোড়ক খুলে মূর্তিটি টেবিলের উপরে রাখলেন৷

পকেট থেকে তিনখানা এক-শো টাকার নোট বার করে জয়ন্ত বললে, ‘শ্যামাপ্রসাদবাবু, টেবিলের উপরে কাগজ-কলম আছে৷ এই দুই জন সাক্ষীর সামনে আপনি অনুগ্রহ করে লিখে দিন যে, তিন-শো টাকার বিনিময়ে মূর্তিটি আমার কাছে বিক্রয় করলেন, ওর উপরে ভবিষ্যতে আপনার কোনো দাবি-দাওয়া রইল না৷’

জয়ন্তর কথামতো কাজ করে তিনশত টাকা নিয়ে প্রস্থান করলেন শ্যামাপ্রসাদবাবু৷

সুন্দরবাবু সবিস্ময়ে বললেন, ‘হুম, জয়ন্তের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, জেনেশুনেও ঠকলে-আরে ছ্যাঃ!’

জয়ন্ত মুখ টিপে একটু হেসে উঠে দাঁড়াল৷ একখানা নুতন টেবিল-ক্লথ বিছিয়ে নেতাজির মূর্তি তার মাঝখানে স্থাপন করে বললে, ‘সুন্দরবাবু, এইবারে আমি একটি অপকর্ম করব-মহা অপকর্ম!’

-‘দশ টাকার মাল তিন-শো টাকায় কিনেই তো অপকর্ম করেছ তারও উপরে আবার কী অপকর্ম আছে?’

একটা হাতুড়ি নিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘আজ আমিও বরেণ্য নেতাজির ওই প্রতিমূর্তিটিকে চূর্ণবিচুর্ণ করব৷’

-‘তুমি যে হঠাৎ পাগল হয়ে গিয়েছ, সে বিষয়ে আর কোনোই সন্দেহ নেই৷ মানিক তোমার বন্ধুটিকে সামলাও, সে যেন আমার মাথায় হাতুড়ির এক ঘা না দেয়!’

জয়ন্ত মূর্তির উপরে হাতুড়ির দ্বারা আঘাত করলে এবং মূর্তিটি সশব্দে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল৷

জয়ন্ত সাগ্রহে টেবিলের উপরে হেঁট হয়ে পড়ল এবং একটা ভাঙা টুকরো তুলে সানন্দে বলে উঠল, ‘দেখুন সুন্দরবাবু! দেখো মানিক! আমার হাতে রয়েছে মমতাজ বেগমের বিখ্যাত কালো মুক্তা!’

সাত

এক ঢিলে দুই পাখি

জয়ন্ত বলতে লাগল: ‘মমতাজ বেগমকে সম্রাট সাজাহান যে মহামূল্যবান কালো মুক্তা উপহার দিয়েছিলেন, তার খ্যাতি পৃথিবীর দেশে দেশে৷

‘নাদির শাহের ভারত আক্রমণের সময় এই মুক্তাটি কোথায় হারিয়ে যায় কেউ তা জানে না৷ অনেক কাল পরে মুক্তাটি কেমন করে মধ্য ভারতের প্রতাপপুরের মহারাজার হস্তগত হয়৷ তারপর সেদিন পর্যন্ত বংশানুক্রমে মুক্তার মালিক হতেন প্রতাপপুরের মহারাজারাই৷

‘তারপর বর্তমান মহারানির শয়নগৃহ থেকে আবার মুক্তাটি হয় অদৃশ্য৷ তাই চারিদিকে খুব উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, সুন্দরবাবুর সেকথা নিশ্চয়ই মনে আছে, পুলিশ সে মামলার কিনারা করতে পারেনি৷ মহারানির এক পরিচারিকা ছিল, সে জয়পুরের মেয়ে, নাম সুমিত্রা৷ তারই উপরে সন্দেহ হয় বটে, কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ সুন্দরবাবু, চমকে উঠলেন যে বড়ো? আপনার মুখেই তো শুনেছি, হারাধনবাবুর বাড়ির সামনে নিহত রাধাকিষণের এক ভগ্নী আছে, তার নাম সুমিত্রা, আর সে জয়পুরের মেয়ে৷’

-‘হ্যাঁ মশাই, হ্যাঁ৷ এই দুই সুমিত্রা যে একই ব্যক্তি, তাতে আর কোনোই সন্দেহ নেই!’

-‘পুরাতন খবরের কাগজের ফাইল ঘেঁটে আমি আর একটি তথ্য আবিষ্কার করেছি৷ কাকে ছোরা মেরে হিরালাল যেদিন ধরা পড়ে, প্রতাপপুরের মহারানির শয়নগৃহ থেকে কালো মুক্তাটি অদৃশ্য হয় ঠিক তারই চার দিন আগে৷ কল্পনায় ঘটনাগুলো পর পর এই ভাবে সাজানো যেতে পারে?

‘সুমিত্রা মুক্তা চুরি করে ভাই রাধাকিষণের কাছে গোপনে পাঠিয়ে দিলে৷ হিরালাল হচ্ছে রাধাকিষণের দুষ্কর্মের সহকারী৷ সে হয় মুক্তাটি তার বন্ধুর কাছ থেকে চুরি করলে, কিংবা নিজে পুলিশের দৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষা করবার জন্যে রাধাকিষণই তার কাছে মুক্তাটি জিম্মা রাখলে৷ তারপর হঠাৎ একজন লোককে ছোরা মেরে হিরালাল আগরওয়ালের কারখানায় পালিয়ে এল৷ তারপর সে যখন বসে বসে প্লাস্টারের মূর্তি গড়ছে, সেই সময়ে সেখানে পুলিশের আবির্ভাব৷ সে বুঝলে পুলিশ তার কাপড়-জামা তল্লাস করবে৷ তার সামনে ছিল সবে-গড়া ভিজে প্লাস্টারের মূর্তি৷ সে তাড়াতাড়ি একটা মূর্তির মাথায় ছ্যাঁদা করে মুক্তাটি ভিতরে নিক্ষেপ করে ছিদ্রটি আবার বন্ধ করে দিলে-দক্ষ কারিগরের পক্ষে এটা খুবই সহজ কাজ৷ তারপর সে এক বৎসর জেল খাটতে গেল৷ ইতিমধ্যে নেতাজির ছয়টি মূর্তি কারখানার বাইরে এখানে-ওখানে চলে গেল৷ তাদের কোনটির মধ্যে যে মুক্তা আছে বাহির থেকে দেখে কেউ তা বলতে পারে না৷ মূর্তি নাড়লেও মুক্তার অস্বিত্ব জানা যাবে না, কারণ কাঁচা প্লাস্টার শুকিয়ে গিয়ে মুক্তাটিকে কামড়ে ধরেছে৷ মূর্তি ভাঙা ছাড়া মুক্তা আবিষ্কারের আর কোনো উপায় রইল না৷

‘তারপর হিরালালের মেয়াদ ফুরোল৷ কিছুমাত্র হতাশ না হয়ে দস্তুরমতো মাথা খাটিয়ে ভিতর ভিতর খোঁজ নিয়ে সে জানতে পারলে, কোন কোন মূর্তি কোন কোন ঠিকানায় গিয়েছে, তারপর আরম্ভ হল নেতাজির মূর্তির উপরে আক্রমণ৷ চতুর্থ মূর্তি চুরি করতে গিয়ে হারাধনবাবুর বাড়ির সামনে হিরালালের সঙ্গে দেখা হয় রাধাকিষণের৷ হিরালাল জেল থেকে বেরিয়েছে শুনে রাধাকিষণ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল৷ কিন্তু এই সাক্ষাৎকারের ফল হল রাধাকিষণের পক্ষে মারাত্মক৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হিরালাল যদি তার দুষ্কর্মের সহকারীই হয়, তবে রাধাকিষণ তার ফটো নিয়ে বেড়াত কেন?’

-‘খুব সম্ভব তৃতীয় ব্যক্তির কাছে হিরালালের খোঁজ নেবার সময়ে এই ফটো তার কাজে লাগত৷ থাক সেকথা৷ আমি বেশ আন্দাজ করলুম খুনের পরে হিরালাল আরও তাড়াতাড়ি কাজ হাসিল করবার চেষ্টা করবে, কারণ পুলিশ তাকে খুঁজছে, এখন যথাসম্ভব শীঘ্র  কলকাতা থেকে অদৃশ্য হওয়া উচিত৷

‘হিরালাল যে মূর্তির ভিতরে কালো মুক্তা লুকিয়ে রেখেছিল, তখনও পর্যন্ত এ সন্দেহ আমার হয়নি৷ কিন্তু খালি বাড়ির সামনে ঠিক আলোর নীচে হিরালাল মূর্তিটা ভেঙেছিল বলে এ সন্দেহ আমার হয়েছিল যে, ফাঁপা মূর্তিগুলোর মধ্যে এমন কোনো মূল্যবান জিনিস আছে, যার লোভে চোর এই সব কাণ্ড করে৷

‘সন্ধান নিয়ে জানলুম, ছয়টার মধ্যে দুটো মূর্তি আছে যথাক্রমে প্রফেসর সুরেশচন্দ্র বসু আর শ্যামাপ্রসাদ সেনের কাছে৷ একজন থাকেন এই শহরেই, আর একজন শ্রীরামপুরে৷ আন্দাজ করলুম, শহরের মূর্তিটাকে চুরি না করে  কলকাতার বাইরে যাওয়া হিরালালের পক্ষে স্বাভাবিক নয়৷ আমার আন্দাজ ভুল হয়নি৷ তারপর সুরেশবাবুর বাড়িতে স্বচক্ষে দেখলুম, হিরালাল কী যেন খুঁজছে মূর্তির ভাঙা টুকরোগুলোর মধ্যে৷ কিন্তু তখন পুরোনো খবরের কাগজের ফাইল থেকে বিখ্যাত কালো মুক্তার ইতিহাস আমি উদ্ধার করেছি আর রাধাকিষণের সঙ্গে এই মুক্তা চুরির যে একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকতে পারে, এমন সন্দেহও আমার মনে ঠাঁই পেয়েছে৷ এও জেনেছি যে রাধাকিষণ আর হিরালাল পরস্পরের পরিচিত আর একই দেশের লোক৷ মনে খটকা লাগল, হিরালাল কি ফাঁপা মূর্তির ভিতরে খুঁজছে কালো মুক্তাকেই?

‘কিন্তু তখনও পর্যন্ত হিরালালের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়নি৷ আমার মন বললে, তাহলে মুক্তা আছে ওই শেষ-বা ষষ্ঠ মূর্তির মধ্যেই৷ সুন্দরবাবু, কপাল ঠুকে আপনার সামনেই তিন-শো টাকা দিয়ে আমি ওই ষষ্ঠ মূর্তিটাকে কিনে ফেললুম, দেখলেন তো৷’

সুন্দরবাবু তারিফ করে বললেন, ‘ধন্যি ভায়া, ধন্যি! একটি মাত্র ইষ্টখণ্ড দিয়ে আজ তুমি একজোড়া পক্ষী বধ করেছ৷ একসঙ্গে দু-দুটো মামলার কিনারা করে ফেললে হে-ওদিকে মুক্তা চুরির আর এদিকে মূর্তি চুরির মামলা! হুম হুম!’

মানিক বললে, ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জীবন হচ্ছে বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ৷ তাঁর প্রতিমূর্তিও বড়ো কম অ্যাডভেঞ্চার সৃষ্টি করলে না-নেতাজির সবকিছুর সঙ্গেই আছে অসাধারণতার সম্পর্ক!’

‘জয় হিন্দ!’ *

* একটি বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে ৷


© 2024 পুরনো বই