যক্ষপতির রত্নপুরী – ১৫

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ । গুপ্তধন

সিঁড়ির পরেই মাটির তলায় মস্ত একটি ঘর—তার চারিদিকে পাথরের দেওয়াল। সে ঘরে অন্তত দুশো লোকের স্থান সংকুলান হতে পারে।

আমাদের সমস্ত মোটঘাট চুলের দোরে পাঠিয়েছে ধসে যাওয়া পাহাড় এবং আমাদের সঙ্গে যা—কিছু ছিল সমস্ত কেড়েকুড়ে নিয়েছে ছুন—ছিউর দলবল। কেবল কমলের কাছে ছিল ছোট্ট একটি পকেট—টর্চ, নদীর জলও তার শক্তি ক্ষয় করতে পারেনি।

সেইটেই চারদিকে ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে নিরেট অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে দেখলুম, সেই প্রশস্ত গুহা—গৃহের একদিকে রয়েছে তিনটে বড়—বড় পাথরের সিন্দুক—পুরাকালের এইরকম সিন্দুক আমি কোনও—কোনও জাদুঘরে দেখেছি। প্রত্যেক সিন্দুক প্রায় দুহাত করে উঁচু ও চওড়া এবং পাঁচহাত করে লম্বা। তার এক—একটার মধ্যে অনায়াসেই একজন লম্বা—চওড়া মানুষ শুয়ে থাকতে পারে।

রামহরি প্রথমটা ভূতের ভয়ে জড়োসড়ো হয়েছিল। এখন সিন্দুক দেখে সমস্ত ভয় ভুলে তাড়াতাড়ি একটার ডালা তুলে ফেললে! অন্য দুটোর ডালা তুললে কুমার ও কমল।

তিনটে সিন্দুকের ভেতরেই পাওয়া গেল কেবল ছোট—বড়—মাঝারি থালা ও অন্যান্য পাত্র।

বিনয়বাবু দু—চারখানা থালা পরীক্ষা করে বললেন, ‘অনেক কালের জিনিস, বিবর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে এগুলো সোনার বাসন। নইলে এত সাবধানে গুপ্ত—গুহায় লুকিয়ে রাখা হত না।’

কমল চমৎকৃত স্বরে বললে, ‘এত সোনার বাসনকোসন! না জানি এর দাম কত হবে?’

বিনয়বাবু বললেন, ‘অনেক। কেবল এইগুলো বেচলেই আমরা লক্ষপতি হতে পারি। কিন্তু কেবল সোনার বাসন কেন কমল, পরিব্রাজক হুয়েন সাংয়ের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে এখানে আরও অনেক ধনরত্ন আছে!’

বিনয়বাবুর কথা শুনতে—শুনতে আমি ‘টর্চে’র আলোটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফেলতেই দেখি, ঘরের আর—এক কোণে সাজানো রয়েছে সারে—সারে বড়—বড় ঘড়া!

সবাই ছুটে সেইদিকে গেলুম। গুনে দেখলুম, প্রত্যেক সারে রয়েছে চারটে করে ঘড়া—এমনি পাঁচ সারে মোট কুড়িটা ঘড়া!

ব্যগ্র হস্তে সবাই ঘড়াগুলো তুলে পরীক্ষা করতে লাগলুম। প্রথম তিনসারে প্রত্যেক ঘড়াই খালি। চতুর্থ সারের দুটো ঘড়া খালি ও দুটো ঘড়া তুলেই বোঝা গেল, তাদের মধ্যে কিছু আছে—সে দুটো রীতিমতো ভারী!

আমি ও কুমার দুটো ঘড়াই তুলে মেঝের ওপরে উপুড় করে দিলুম—ঝনঝন—ঝনঝন রবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল রাশি—রাশি গোল—গোল চাকতি!

একটা চাকতি তুলে নিয়েই দেখি, মোহর। অনেক কালের পুরোনো মোহর—

খুব সম্ভব দু—হাজার বছর আগেকার।

পঞ্চম সারের প্রথম ও দ্বিতীয় ঘড়াও মোহরে মোহরে পরিপূর্ণ। মুক্তোর স্রোত! কোনও মুক্তোই ছোট নয়, অনেক মুক্তোই পায়রার ডিমের মতন বড়! মেঝের ওপরে মুক্তোর স্তূপ। এত মুক্তো জীবনে এক জায়গায় দেখিনি!

চতুর্থ বা শেষ কলস মেঝের ওপরে সৃষ্টি করলে রত্নের স্তূপ! তার মধ্যে না আছে কি—হিরে, চুনি, পোখরাজ, পদ্মরাগ মণি—কত আর নাম করব? ‘টর্চে’র আলোতে সেইসব অপূর্ব রত্ন জ্বলজ্বল করে জ্বলতে লাগল!

বিস্ময়—বিস্ফারিত নেত্রে আত্মহারার মতন দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ বাঘা চাপা গলায় গর্জন করে উঠল!

পরমুহূর্তে শুনলুম কাদের কণ্ঠস্বর ও পদশব্দ! কারা যেন খটখট করে সিঁড়ি দিয়ে নামছে!

কে ওরা? আবার ছুন—ছিউর দল নাকি?

কিন্তু ভাববারও সময় নেই—আমরা নিরস্ত্র!

বললুম, ‘শিগগির ঘরের ওদিকে চল! ওই বড়—বড় সিন্দুকের পিছনে!’

সিন্দুকের আড়ালে হুমড়ি খেয়ে আমরা মাটির সঙ্গে প্রায় মিশিয়ে রইলুম। সমস্ত ঘর আলোয় আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল! তা মশাল কিংবা লণ্ঠনের আলো, উঁকি মেরে দেখবার ভরসা হল না।

পায়ের শব্দ শুনে বুঝলুম, ঘরের ভেতরে ঢুকল সাত—আটজন লোক!

একজন ভাঙা—ভাঙা হিন্দি ভাষায় বললে, ‘বার্মুক, তুমি ঠিক বলেছ! গুহার দরজা যখন খোলা, তখন সেই হতভাগা বাঙালিরা বেঁচে আছে—হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বেঁচে আছে! আশ্চর্য!’

‘ছুন—ছিউ সাহেব, আমার চোখ ভুল দেখে না! আমি দূর থেকে চকিতের মতন দেখেছি, একটা পাহাড়ের আড়ালে তারা মিলিয়ে গেল!’

‘কিন্তু বদমাইশগুলো গেল কোথায়? আমাদের সাড়া পেয়ে কোথায় তারা গা—ঢাকা দিলে? গুহার ভেতরটা ভালো করে খুঁজে দ্যাখো!’

দুই—তিনজনের পায়ের শব্দ আমাদের দিকেই এগিয়ে আসতে লাগল! বুঝলুম, আর রক্ষে নেই! স্থির করলুম শুধু হাতেই লড়তে—লড়তে মরব—আত্মসমর্পণ করব না কিছুতেই!

হঠাৎ বার্মুকই বোধহয় বললে, ‘ছুন—ছিউ সাহেব! দ্যাখো, দ্যাখো, ওদিকে জ্বলে—জ্বলে উঠছে কী ওগুলো?’

যেদিকে কলসগুলো ছিল সকলে সেই দিকেই দ্রুতপদে ছুটে গেল—তারপরই বিস্ময়পূর্ণ চিৎকার!

বার্মুক চেঁচিয়ে উঠল, ‘আল্লা, আল্লা! এ যে হিরে, মুক্তো, পান্না!’

তারপরেই গুহায় নামবার সিঁড়ির ওপরে শোনা গেল আবার অনেক লোকের পায়ের শব্দ! নিশ্চয় গুহার ভেতরে আনন্দ—কলরব শুনে শত্রুদের দলের আরও অনেক লোক নীচে নেমে আসছে! আমাদের বাঁচবার আর কোনও উপায়ই নেই!

নতুন পায়ের শব্দগুলো এল ঘরের ভেতরে! পরমুহূর্তে ছুন—ছিউয়ের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে জাগল ভীষণ গর্জন এবং তারপরেই বন্দুকের—পর—বন্দুকের কানফাটা আওয়াজে সেই বদ্ধ গুহাগৃহের ভেতরটা হয়ে উঠল ভয়াবহ! সঙ্গে—সঙ্গে নানা কণ্ঠের অভিশাপ ও আর্তনাদ, ধুপ—ধাপ করে দেহপতনের শব্দ! মনে হল কারা যেন কাদের সঙ্গে হাতাহাতি যুদ্ধও করছে!

এ আবার কী কাণ্ড? কারা লড়ছে কাদের সঙ্গে? গুপ্তধনের লোভে শত্রুরা কি নিজেদের মধ্যেই মারামারি হানাহানি লাগিয়ে দিয়েছে? দেখবার জন্যে মনের ভেতরে জাগল বিষম কৌতূহল, কিন্তু মুখ বাড়াতে গিয়ে যদি শেষটা ধরা পড়ে যাই, সেই ভয়ে দমন করলুম সমস্ত কৌতূহল!

মিনিট পাঁচেক ধরে চলল এমনি হুলুস্থুলু কাণ্ড! তারপর বন্দুকের চিৎকার থামল—কেবল একাধিক কণ্ঠের আর্তনাদে সারা ঘরটা ধ্বনিত—প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

কাফ্রি ভাষায় কে একজন বললে, ‘কই, বাবুরা তো এখানে নেই! মাল্কানও নেই!’

সিন্দুকের পিছন থেকে একলাফে দাঁড়িয়ে উঠে মাল্কান আনন্দ—বিহ্বল স্বরে বললে, ‘বাচিক! কারুক! গরক! তোমরা?’

‘আরে, আরে, এই যে মাল্কান! বাবুরা কোথায়?’

মাল্কান আমাদের ডেকে বললে, ‘বাবুসাহেব, বাবুসাহেব! আর ভয় নেই! আমাদের বন্ধুরা এসেছে!’

সবিস্ময়ে উঠে দাঁড়িয়ে বাচিকদের মশালের আলোকে এমন এক বিষম রক্তরাঙা দৃশ্য দেখলুম যে, আমাদের কারুর মুখ দিয়ে কোনও কথাই বেরুল না!

সিঁড়ির দিকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাচিক, কারুক ও গরক এবং তাদের আরও বিশ—বাইশজন সঙ্গী—অনেকেরই হাতে রয়েছে বন্দুক। ঘরের মেঝের ওপরে এখানে—ওখানে পড়ে রয়েছে অনেকগুলো মানুষের দেহ—তাদের কেউ একেবারে নিস্পন্দ এবং কেউ বা করছে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট! ভূপতিত দেহের সংখ্যা এগারো—তার মধ্যে ছুন—ছিউর দলের লোক ছিল সাতজন! সমস্ত দেহের চারিপাশ দিয়ে বইছে যেন রক্তের নদী—সে রক্ত—বিভীষিকা দেখে শিউরে উঠে কমল দুই হাতে চোখ ঢেকে অবশ হয়ে আবার বসে পড়ল।

আমি জিজ্ঞাসা করল, ‘বাচিক, তোমরা কী করে এখানে এলে?’

বাচিক সেলাম করে বললে, ‘গুমলি—বিবির হুকুমে বাবুসাহেব।’

‘তার মানে?’

‘গুমলি—বিবি হুকুম দিয়েছে, যেমন করে হোক শয়তানদের হাত থেকে বাবুসাহেবদের উদ্ধার করবার জন্যে। আপনারা কোন পথে কোথায় আসবেন জানতুম, তাই প্রস্তুত হয়েই দলবল নিয়ে এইদিকে ছুটে এসেছি!’

তখন আমার মনে পড়ল, আমরা যখন বিদায় নিই, গুমলি বলেছিল : ‘আপনারা আমার অতিথি, কিন্তু আপনাদের শত্রুকে আমন্ত্রণ করে আনলুম আমিই। কিন্তু সর্বদাই মনে রাখবেন বাবুজি, গুমলির দৃষ্টি রইল আপনাদেরই ওপরে!’

গুমলি নিজের কথা রেখেছে। নইলে আমাদের মৃতদেহগুলো সকলের অজান্তে এই অন্ধকার গুপ্তগুহার মধ্যেই মাংসহীন কঙ্কালে পরিণত হত। গুমলির উদ্দেশে করলুম মনে—মনে নমস্কার। মহীয়সী নারী!

পায়ে—পায়ে এগিয়ে দেখি, রত্নস্তূপের ওপরে এলিয়ে পড়ে রয়েছে দুরাত্মা ছুন—ছিউর রক্তাক্ত মৃতদেহ! তার দু—দিকে ছড়িয়ে পড়া দুই হাতের এক মুঠোর ভেতরে মুক্তোরাশি এবং আর—এক মুঠোর মধ্যে হিরে—চুনি—পান্না! তার দুই চক্ষু ও মুখবিবর খোলা—স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে মৌন ভাষায় সে যেন বলতে চায়—’বাঙালিবাবু, আমারই জয়—জয়কার, গুপ্তধন লুণ্ঠন করব বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম—গুপ্তধন নিয়েই চললুম আমি পৃথিবী ছেড়ে!’

প্রকাশকাল—১৯৪১

 


© 2024 পুরনো বই