দশম পরিচ্ছেদ । বেড়াজালে
গুমলির মুখের ভাব দেখে আমাদের সকলেরই মনে খটকা লাগল। কিন্তু এই অজানা গাঁয়ের অচেনা সর্দার যদি সুবিধার লোকও না হয়, তাতে আমাদের কী ক্ষতি হবে?
বিনয়বাবু জিগ্যেস করলেন, ‘লোকটা সুবিধের নয় বলছ কেন?’
‘আজ দুপুরবেলায় আমি ভিন গাঁয়ে গিয়েছিলুম। ফেরবার পথে দেখলুম, পাহাড়ের একটা ঝোপের ছায়ায় বসে আছে বার্মুক আর দুটো চিনেম্যান।’
বিনয়বাবু সচকিত কণ্ঠে বললেন, ‘চিনেম্যান?’
‘হ্যাঁ বাবুজি। তারা চুপিচুপি কী বলাবলি করছিল, আমাকে দেখেই একেবারে চুপ মেরে গেল। আমি কোনও কথা না বলে এগিয়ে এলুম। খানিক দূর এসেই ফিরে দেখলুম, বার্মুক আমাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে চিনেম্যান দুটোকে কী যেন বলছে।’
‘তারপর?’
‘তারপর তখন আর কিছু হল না। কিন্তু এইমাত্র বার্মুক এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে।’
‘কেন?’
‘হতভাগা আমাকে কী বলে জানেন বাবুজি? আজ রাত্রে আমি যদি আপনাদের খাবারের সঙ্গে বিষ মাখিয়ে আর সদর দরজা খুলে রাখতে পারি, তাহলে সে আমাকে পাঁচশো টাকা বকশিশ দেবে। অর্ধেক টাকা সে এখনি দিতে চায়।’
‘বকশিশের লোভ তোমার আছে নাকি?’
‘আছে বাবুজি, আছে!’
‘মানে?’
‘মুখপোড়া বার্মুকের কাছ থেকে বকশিশের আগাম আড়াইশো টাকা আমি আদায় করে নিয়েছি।’
‘গুমলি!’
‘ঘাবড়াবেন না বাবুজি, ঘাবড়াবেন না। বার্মুক হচ্ছে পাজির পা—ঝাড়া, মানুষ মারতে তার হাত এতটুকুও কাঁপে না। সে কাফির হলেও আমাদের ধর্ম ছেড়েছে, তাই তাকে আমরা পরম শত্রু বলেই মনে করি। তাকে ঠকিয়ে যদি আড়াইশো টাকা লাভ করতে পারি, তাহলে আমার কোনও পাপ হবে না।’
‘গুমলি, আমরা এখনি তোমার বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাই।’
‘ভয় নেই বাবুজি। যখন সব কথা প্রকাশ করলুম, তখন আপনাদের খাবারের সঙ্গে নিশ্চয়ই আমি বিষ মাখিয়ে দেব না। বার্মুকের মতলবটা ঠিক বুঝতে পারছি না বটে, তবে তার অর্ধেক টাকা যখন নিয়েছি, অর্ধেক কাজও আমি করব।’
‘অর্থাৎ?’
‘আজ রাত্রে সদর দরজাটা খুলে রাখব।’
‘তারপর?’
‘তারপর রাত্রে কেউ আমার বাড়িতে ঢুকলে ভালো করেই তাকে আদর—যত্ন করব। গরক, বাচিক, কারুক আর মাল্কানকে খবর দিয়েছি, তারা এল বলে।’
‘তারা আবার কে?’
‘আমার বিশ্বাসী লোক—আমার কথায় তারা ওঠে বসে। আজ রাত্রে তারা আমার বাড়িতে পাহারা দেবে।’
বিনয়বাবু যখন সব কথা আমাদের বুঝিয়ে দিলেন, তখন আমিও বললুম, ‘আমিও গুমলির মতে সায় দি। শঠের সঙ্গে শঠতা করতে কোনও দোষ নেই। আসুক ছুন—ছিউ, আসুক বার্মুক! এখানে এলেই তারা দেখতে পাবে, মড়ারা জ্যান্ত হয়ে বন্দুক ধরে বসে আছে!’
কুমার কৃতজ্ঞ স্বরে বললে, ‘গুমলি ঠাকরুণ! তোমার বাকি আড়াইশো টাকাও মারা যাবে না। ও টাকাটাও আমরা নিজেদের পকেট থেকে তোমায় দেব!’
গুমলি একগাল হেসে সেলাম করে বললে, ‘বাবুজি মেহেরবান!’
পাহাড়ের টঙে কাফ্রিদের ছোট্ট গাঁ, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল প্রথম রাত্রেই। রাত যত গভীর হয় স্তব্ধতা ততই থমথমে হয়ে ওঠে। মনে হয় যেন বোবা দুনিয়ায় জেগে আছে কেবল গোটাকয়েক বদরাগি কুকুর।
সদর দরজার পাশেই একটা ঘর তার মধ্যে আলো নিবিয়ে অপেক্ষা করছি আমি, কুমার, বিনয়বাবু, কমল ও রামহরি। বলা বাহুল্য, আমাদের প্রত্যেকেরই হাতে আছে একটা করে রিভলভার। এই সংকীর্ণ স্থানে বন্দুকের সাহায্য দরকার হবে না।
গরক, বাচিক, কারুক আর মাল্কানও এসেছে। তারা সবাই হচ্ছে কাফ্রিদের পুরাতন ধর্মের লোক। প্রত্যেকেরই দেহ প্রায় ছয় ফুট করে লম্বা, সারা গায়ে কঠিন মাংসপেশির খেলা। তারা কথা কয় কম, কিন্তু তাদের ভাবভঙ্গি দেখলেই বেশ বোঝা যায়, আমাদের সাহায্য করবার জন্যে তারা সকলেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
গরক ও বাচিক বাড়ির ছাদের ওপরে বসে আছে, পাহারা দেওয়ার জন্যে। কারুক আর মাল্কান অপেক্ষা করছে গাঁয়ের পথে, শত্রুরা দেখা দিলেই তারা আমাদের সাবধান করে দেবে। প্রথমে তারা আমাদের সঙ্গে বাড়ির ভেতরেই থাকতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি রাজি হইনি। আমি তাদের বুঝিয়ে দিয়েছি বাড়ির ভেতরে পাঁচটা রিভলভারই যথেষ্ট, তারা যদি যথাসময়ে শত্রুদের আগমন সংবাদ দিতে পারে, তাহলেই আমাদের যথার্থ উপকার করা হবে।
রাতের অসাধারণ নীরবতার মাঝে আমাদের হাতঘড়িগুলোর টিকটিক শব্দ যেন রীতিমতো কোলাহল বলে মনে হচ্ছে!
বাঘা পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে, আমরা কোনও অযাচিত ও অনাহূত অতিথিকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে অপেক্ষা করছি। সে আমার কোল ঘেঁষে কান খাড়া করে বসে আছে।
আচম্বিতে দূর পথ থেকে ভেসে এল একটা বিড়ালের ম্যাও—ম্যাও চিৎকার। তারপরই ছাদের ওপর থেকে সাড়া দিলে আর একটা বিড়াল!
এই হল আমাদের সঙ্কেতধ্বনি! এর মানে, এখনি হবে শত্রুদের আবির্ভাব।
আমি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালুম।
বিনয়বাবু চুপিচুপি বললেন, ‘আমরা কী করব?’
‘বিশেষ কিছু না। এখানে সবাই মিলে রিভলভার ছুড়ে হুলুস্থুল বাধিয়ে দিলে পুলিশ হাঙ্গামে জড়িয়ে পড়তে হবে। বদমাইশগুলোকে কিছু ভয় দেখাতে বা সামান্য জখম করতে পারলেই আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। রামহরি, বাঘাকে সামলে রাখো। কুমার, শত্রুরা যখন পালাবে তখন তোমরা সবাই মিলে রিভলভার ছুড়ে তাদের পেটের পিলে চমকে দিতে পারো।’
এক, দুই করে প্রায় পাঁচ—ছয় মিনিট কাটল। তারপরেই একটু একটু করে সদর দরজাটা ফাঁক করে ভেতরে ক্রমেই বেশি চাঁদের আলো এসে পড়তে লাগল। সদর দরজা একেবারে খুলে গেল। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কালো কালো পোশাক পরা তিন—তিনটে মূর্তি।
প্রথম মূর্তিটার পা লক্ষ্য করে আমি রিভলভার ছুড়লুম। লোকটা বিকট আর্তনাদ করে মাটির ওপরে বসে পড়ল।
আমার রিভলভার আরও দুইবার গর্জন করলে—কিন্তু এবারে আমি আর কারুকে লক্ষ্য করিনি।
যে পায়ে চোট খেয়ে বসে পড়েছিল, সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে প্রাণের ভয়ে ছুটতে শুরু করলে! অন্য দুজনও দাঁড়াল না।
ছাদের ওপর থেকে বড়—বড় পাথর বৃষ্টি হতে লাগল—নিশ্চয় গরক ও বাচিকের কীর্তি। কুমার প্রভৃতিও ঘর থেকে বেরিয়ে ঘন—ঘন রিভলভার ছুড়তে লাগল—আর বাঘার চ্যাঁচামেচির তো কথাই নেই। শান্তিপূর্ণ মৌন রাত্রি যেন কর্কশ শব্দের চোটে হঠাৎ বিষাক্ত হয়ে উঠল।
তারপরেই চাঁদের আলোয় দেখা গেল, দুজন লোক ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে—ছুটতে আমাদের দিকেই আসছে। প্রথমটা তাদের শত্রু ভেবে আমি আবার রিভলভার তুললুম, কিন্তু তারপরেই দেখি তারা হচ্ছে আমাদের লোক—কারুক আর মাল্কান।
মাল্কান কাছে এসেই হাঁপাতে—হাঁপাতে বললে, ‘পশ্চিম দিক থেকে অনেক লোক এই দিকেই আসছে!’
‘অনেক লোক! কত?’
‘তা বিশ—বাইশজনের কম হবে না!’
‘তারাও কি আমাদের শত্রু?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে বাবুজি! এত রাতে ভালো লোকেরা দল বেঁধে কখনও পাহাড়—পথে চলে না!’
এমন সময়ে ছাদের ওপর থেকে গরক চিৎকার করে বললে, ‘হুঁশিয়ার বাবুজি, হুঁশিয়ার! পুব দিক থেকে অনেক আদমি আসছে!’
কারুক সভয়ে বললে, ‘কী মুশকিল! দুশমনরা কি বাড়িখানা ঘিরে ফেলতে চায়?’
কারুক বোধহয় ঠিক আন্দাজই করেছে! হয়তো আমাদের বেড়াজালেই ধরা পড়তে হবে।
একাদশ পরিচ্ছেদ । মৃত্যুর হুঙ্কার
দু—দিক থেকে শত্রুরা আসছে দলে—দলে, হয়তো পালাবার সব পথই বন্ধ করে—আমাদের টিপে মেরে ফেলবার জন্যে।
জানি, আমাদের পাঁচজনের কাছে আছে পাঁচটা স্বয়ংবহ বন্দুক বা ‘অটোমেটিক রাইফেল’—তাদের প্রত্যেকটা মিনিটে গুলিবৃষ্টি করতে পারে পঁয়ত্রিশবার! সুতরাং শত্রুরা যে সহজে আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা এসে পড়েছি অপরিচিত শত্রুদের স্বদেশে; গুমলির বাড়িখানা এখানে আমাদের পক্ষে মরুভূমিতে ওয়েসিসের মতন বটে, কিন্তু সমস্ত গ্রামের বিরুদ্ধে আমরা পাঁজনে কতক্ষণ দাঁড়াতে পারব? আর আমাদের আশ্রয় দিয়ে গুমলিই বা বিপদে পড়বে কেন? শত্রুরা নিশ্চয় নিরস্ত্র নয় এবং ওদের দলে যদি শয়তান ছুন—ছিউ থাকে তাহলে ওদের সঙ্গেও যে আগ্নেয়াস্ত্র আছে, এটাও অনুমান করতে পারি। অতএব আমাদের আশ্রয়দাত্রী এই বিদেশিনি নারীর বাড়ির অঙ্গনকে যুদ্ধক্ষেত্ররূপে ব্যবহার করা বোধহয় সঙ্গত নয়।
বেশিক্ষণ ভাববার সময় নেই—প্রতি মুহূর্তেই শত্রুরা আরও কাছে এসে পড়ছে।
তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘মাল্কান, আমাদের পালাবার কোনও পথই কি খোলা নেই?’
মাল্কান যা বললে বিনয়বাবু তার অর্থ বুঝিয়ে দিলেন—’একটা পথ আছে বাবুসাহেব!’
‘কোথায়?’
‘বাড়ির খিড়কি দিয়ে বেরুলে উত্তরদিকে একটা সরু পাহাড়ে—পথ পাওয়া যাবে।’
‘উত্তরদিকে? মাল্কান, আমরা কী দেখবার জন্যে এদেশে এসেছি সেকথা তুমি বোধহয় জানো না?’
‘জানি বাবুসাহেব! গুমলি বিবির মুখে আমি সব শুনেছি—কারণ আপনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভার পড়েছে আমারই ওপরে। আপনারা তো সেকালের সেই ভাঙা মঠ দেখতে যেতে চান?’
‘হ্যাঁ। সে মঠও তো উত্তরদিকে?’
‘হ্যাঁ বাবুসাহেব।’
‘এখান থেকে সে মঠ কত দূরে?’
‘তা প্রায় বিশ—পঁচিশ মাইল হবে।’
‘তুমি এখনি আমাদের সঙ্গে যেতে পারবে?’
‘এখনি?’
‘হ্যাঁ মাল্কান। যদি রাজি হও, একশো টাকা বকশিশ পাবে।’
মাল্কান ইতস্তত করছিল, কিন্তু এই দরিদ্র কাফ্রিস্থানে একশো টাকা হচ্ছে কল্পনাতীত সৌভাগ্য! সে মহা উৎসাহে বলে উঠল, ‘বাবুসাহেব, আমি যেতে রাজি!’
আসছে কাল সকালেই আমাদের এখান থেকে বেরুবার কথা বলে আমরা আগে থাকতেই মোটঘাট বেঁধে রেখেছিলুম।
হুট বলতে ছুট দেওয়ার অভ্যাস আমাদের বরাবরই। এ হপ্তায় আমরা কলকাতার শৌখিন নাগরিক, আসছে হপ্তায় আফ্রিকার বিপুল অরণ্যে বনবাসী। এমনি ভবঘুরের জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে একটা ভালো শিক্ষা আমরা পেয়েছি। প্রবাসে যেতে হলে বাঙালিরা মস্ত বড় গৃহস্থালি ঘাড়ে করে বেরোয়—বড়—বড় ট্রাঙ্ক, সুটকেস, বিছানা, পোঁটলা—পুঁটলি! কিন্তু কত কত জিনিস সঙ্গে নিয়ে পথে—বিপথে অনায়াসেই দৈনিক জীবনযাপন করা যায়, সে সমস্যা আমরা সমাধান করতে পেরেছি! যা দরকার সে সমস্তই আমাদের সঙ্গে আছে, অথচ আমাদের মালের সংখ্যা এত কম যে, কুলি ডাকবার দরকার হয় না—নিজেদের মাল নিজেরাই বয়ে নিয়ে যেতে পারি।
তিন মিনিটের মধ্যেই আমরা মোটঘাট গুছিয়ে নিয়ে অজানার অন্ধকারে যাত্রা করবার জন্যে প্রস্তুত হলুম!
গুমলি এসে ম্লান মুখে বললে, ‘বাবুজি, আমি এখন বুঝতে পারছি, বার্মুকের কাছ থেকে টাকা দিয়ে ভালো কাজ করিনি। আপনারা আমার অতিথি, কিন্তু আপনাদের শত্রুকে আমন্ত্রণ করে আনলুম আমিই! এ দুঃখ আমার কখনই যাবে না!’
কুমার বললে, ‘না গুমলি বিবি, মিথ্যে অনুতাপ কোরো না। শত্রুরা নিশ্চয়ই আজ আমাদের আক্রমণ করত। তবে ওরা কেবল একবার চেষ্টা করে দেখেছিল যে, তোমার সাহায্যে চুপিচুপি নিরাপদে কাজ সারা যায় কি না! আর সময় নেই—সেলাম!’
‘সেলাম বাবুজি, সেলাম! একটা সেকেলে ভাঙা মঠে বেড়াতে যাওয়ার জন্যে এত বিপদ মাথায় নিয়েছেন কেন, সে কথা আমি জানি না বটে, কিন্তু সর্বদাই মনে রাখবেন বাবুজি, গুমলির দৃষ্টি রইল আপনাদেরই ওপরে!’
বাড়ির খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে এই ভাবতে—ভাবতে অগ্রসর হলুম, গুমলির শেষ কথাগুলোর অর্থ কী?
চাঁদ তখনও অস্ত যায়নি বটে, কিন্তু একটা উঁচু পাহাড়ের পিছনে নেমে গিয়েছে—চারিদিকে রাত্রির বুকের ওপরে দুলছে ঘন ছায়ার রহস্যময় যবনিকা।
শত্রুরা এখন আর চোরের মতন আসছিল না, পাহাড়ে—পথের ওপরে বহু পাদুকার কঠিন ধ্বনি শুনে নিশীথিনী তার মৌনব্রত ভঙ্গ করে যেন সচমকে জেগে উঠল। বুঝলুম কৌশলে কার্যোদ্ধার হল না দেখে শত্রুরা এমন মরিয়া হয়ে ছুটে আসছে দস্যুর মতো।
ছুন—ছিউর বাহাদুরি দেখে মনে—মনে তারিফ না করে পারলুম না। যে লোক এরই মধ্যে অপরিচিত দূরবিদেশে এসে এমন বৃহৎ এক দল গড়তে পারে, নিশ্চয়ই সে অসাধারণ ব্যক্তি।
কিন্তু বিনয়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘না বিমল, আমি ছুন—ছিউর অসাধারণতা স্বীকার করি না। পৃথিবীতে সঙ্গীর অভাব হয় ভালো কাজেই, কারণ জগতে সাধুর সংখ্যা বেশি নয়। কিন্তু কুকার্যে নিযুক্ত হয়ে তুমি যদি একবার ডাক দাও, চারিদিক থেকে সঙ্গী এসে জুটবে পঙ্গপালের মতো। পৃথিবীর হিতসাধন করবার জন্যে বুদ্ধদেবকে পথে বেরুতে হয়েছিল একাকীই, কিন্তু চেঙ্গিস খাঁ, তৈমুর লং আর নাদির শা যখন পৃথিবীর ওপরে অমঙ্গলের অভিশাপ বর্ষণ করতে বেরিয়েছিলেন, তখন তাঁদের লক্ষ লক্ষ পাপ—সঙ্গীর অভাব হয়নি।’
আলোর ছায়া পড়ে না জানি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল চারিদিককে মায়াময় করে তুলেছে যেন অচঞ্চল জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ ছায়া! কিছুই স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না, অথচ সামনে—পিছনে এপাশে—ওপাশে যেদিকেই তাকাই সেইদিকেই পাহাড় বা জঙ্গল বা ঝোপঝাপের আবছা অস্তিত্ব জাগে চোখে।
সব আগে চলেছে মাল্কান, তারপর আমরা। এমন এক সংকীর্ণ পথ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি যে, দুজনের পাশাপাশি চলবার উপায় নেই।
কুমার বাঘার গলা জড়িয়ে ধরে বললে, ‘বাঘা, তুমি এখন কারুকে ধমকধামক দেওয়ার চেষ্টা কোরো না। একেবারে চুপ করে থাকো—বুঝেছ?’
বাঘা নিশ্চয়ই বুঝলে। আমরা নিজেদের মনুষ্যত্বের গর্বে কুকুর প্রভৃতি গৃহপালিত জীবকে পশু বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি। কিন্তু পরীক্ষা করলেই দেখা যায়, মানুষের সংসারে যেসব জীব বা পশু পালিত হয়, তাদের অনেকেই আমাদের মুখের ভাষা বা মনের ভাব বুঝতে পারে। বাঘাও কুমারের বক্তব্য বুঝে একটিমাত্র শব্দও উচ্চারণ করলে না।
মিনিট পাঁচ—সাত পরে শত্রুদের পায়ের শব্দ আর শোনা গেল না। কিন্তু আরও মিনিট কয়েক পরে বহু কণ্ঠের একটা উচ্চ কোলাহল জেগে উঠে রাতের নীরবতা ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে।
মাল্কান বললে, ‘বাবুসাহেব, ওরা এতক্ষণে বুঝতে পরেছে যে শিকার হাতছাড়া হয়েছে। যদিও ওরা জানে না আমরা কোনদিকে গিয়েছি, তবু সাবধানের মার নেই—তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলুন।’
আমরা দৌড়তে আরম্ভ করলুম। সেই পাহাড়ে—পথ কোথাও বনের অন্ধকার, কোথাও চাঁদের আলো মেখে এবং কোথাও উঁচু দিকে উঠে ও কোথাও নীচু দিকে নেমে এঁকেবেঁকে সামনে চলে গিয়েছে। মাঝে—মাঝে দেখি দু—পাশেই গভীর খাদ, সেখানে এবড়োখেবড়ো পথে ছুটতে গিয়ে একবার যদি হোঁচট খাই তাহলে এ জীবনে আর শা—লো—কা মঠ, কুবের মূর্তি ও গুপ্ত গুহার গুপ্তধন নিয়ে মাথা ঘামাবার কোনও দরকার হবে না।
এতক্ষণে পথটা চওড়া হয়ে এল। এখন চার—পাঁচজন লোক অনায়াসেই পাশাপাশি চলতে পারে। চাঁদের আলোও আর পাহাড়ের আড়ালে নেই। সুতরাং পথ চলবার কষ্ট আর হঠাৎ বিপদে পড়বার ভয় থেকে অব্যাহতি পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম।
মাল্কান একবার পিছনদিকে মুখ ফিরিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর অভিভূত স্বরে বললে, ‘দেখুন বাবুসাহেব, দেখুন!’
পিছন ফিরে দেখলুম, অনেক দূরে—প্রায় হাজার ফুট নীচে এক জায়গায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে এবং আরক্ত অগ্নির ক্রুদ্ধ শিখায় শূন্যের অনেকখানি লাল হয়ে উঠেছে।
কুমার বললে, ‘ওখানে অমন আগুন জ্বলবার কারণ কী?’
মাল্কান বললে, ‘আমি বেশ বুঝতে পারছি, আগুনে পুড়ছে গুমলি—বিবির বাড়ি। শয়তানরা আমাদের ধরতে না পেরে রেগে পাগল হয়ে গুমলি—বিবির বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে।’
রামহরি দরদ ভরা গলায় বললে, ‘আহা, আমাদের আশ্রয় দিয়েই গুমলি আজ পথে বসল!’
মাল্কান মাথা নেড়ে বললে, ‘একখানা বাড়ি পুড়ে গেলেই গুমলি—বিবি পথে বসবে না। তার কেবল টাকাই নেই, যেসব কাফির এখনও বাপ—পিতামহের ধর্ম ছাড়েনি, তাদের কাছে গুমলি—বিবির মানমর্যাদাও যথেষ্ট, তার জন্যে তারা প্রাণ দিতেও নারাজ নয়। তারা যখন খবর পাবে তখন বিধর্মী বার্মুককে প্রাণ নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হবে। কিন্তু বাবুসাহেব আমার কী ভাবনা হচ্ছে জানেন? আজ গুমলি—বিবিকে হাতে পেয়ে দুশমনরা যদি তার ওপর অত্যাচার করে, তাহলে কে তাদের বাধা দেবে?’
মাল্কানের কথা শুনতে—শুনতে নীচে আর—এক দিকে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। সেখানটায় চাঁদের আলো নেই, অন্ধকারের মধ্যে নাচছে কতকগুলো ছোট ছোট চলন্ত আলোক শিখা।
মাল্কানও দেখতে পেল। ত্রস্তস্বরে বললে, ‘বাবুসাহেব, বাবুসাহেব! শত্রুরা আবার আমাদের ধরতে আসছে!’
বাঘা পর্যন্ত বুঝতে পারলে। চাপা গলায় গরর গরর করে গজরাতে লাগল।
আমি বললুম, ‘এগিয়ে চলো—এগিয়ে চলো! যতক্ষণ পারি এগিয়ে তো চলি, তারপর দরকার হলে যুদ্ধ করতেও আপত্তি নেই!’
কুমার বললে, ‘হুঁ, ছুন—ছিউ এখনও আমাদের ভালো করে চিনতে পারেনি! ভেবেছে দলে ভারী হয়ে আমাদের ওপরে সে টেক্কা মারবে!’
কমল বললে, ‘দেখা যাক ছুন—ছিউ কত বড় গুলিখোর—আমাদের অটোমেটিক রাইফেলের ক’টা গুলি সে হজম করতে পারে!’
বিনয়বাবু রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, ‘থামো ছোকরা, থামো—অত আর বাক্য—বন্দুক ছুড়তে হবে না! কথায়—কথায় যুদ্ধ অমনি করলেই হল না? বিনা যুদ্ধে যাতে কার্যসিদ্ধি হয়, আগে সেই চেষ্টাই দ্যাখো!’
রামহরিও বিনয়বাবুর কথায় সায় দিয়ে কমলের দিকে বিরক্ত চোখে চেয়ে বললে, ‘যা বলেছেন বাবু! বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়!’
আমি হাসছি দেখে বিনয়বাবু বললেন, ‘না বিমল, এসব হাসির কথা নয়! আমার বিশ্বাস, শত্রুদের দলে চল্লিশ—পঞ্চাশজনের কম লোক নেই, আর ওরাও হয়তো বন্দুক নিয়ে তৈরি হয়েই এসেছে। যুদ্ধে ওদের দশ—পনেরোজন মারা পড়লেও দলে ওরা ভারী থাকবে। কিন্তু গুনতিতে আমরা তো মোটে ছয়জন লোক, এর মধ্যে তিন—চারজন যদি মারা পড়ে বা জখম হয় তখন কী উপায় হবে?’
আমি বললুম, ‘ঠিক কথা বিনয়বাবু! নিতান্ত নিরুপায় না হলে আমরা নিশ্চয়ই যুদ্ধ করব না। চলো, চলো, তাড়াতাড়ি পা চালাও!’
আরও মিনিট পনেরো ধরে নীরবে দ্রুতবেগে আমরা অগ্রসর হতে লাগলুম। কিন্তু শত্রুরা এগিয়ে আসছিল আমাদেরও চেয়ে বেশি বেগে। কারণ খানিকক্ষণ পরেই তাদের চিৎকার শুনতে পেলুম।
চলতে—চলতে কেটে গেল আরও মিনিট দশ—বারো! পথ সেখানে সিধে নেমে গিয়েছে। মুখ ফিরিয়ে দেখলুম, মশালের আলোগুলো আমাদের কাছ থেকে বড়জোর সিকি মাইল তফাতে আছে।
আমি দাঁড়িয়ে পড়ে বললুম, ‘বিনয়বাবু, আর এগুবার চেষ্টা করা নিরাপদ নয়। তাহলে প্রস্তুত হওয়ার সময় পাব না।’
বিনয়বাবু হতাশভাবে বললেন, ‘বোঝা যাচ্ছে যুদ্ধ আমাদের করতেই হবে।’
‘হ্যাঁ, করতেই হবে। কুমার, তোমরা প্রত্যেকেই ব্যাগগুলো সামনের দিকে রেখে মাটির ওপরে শুয়ে পড়। ওরা যদি বন্দুক ছোড়ে, তাহলে ব্যাগগুলো সামনে থাকলে আত্মরক্ষার খানিকটা সুবিধে হবে।’
মাল্কান বললে, ‘বাবুসাহেব, আমাদের বাঁ—পাশেই পাহাড়ের গায়ে একটা বড় গুহা রয়েছে। আমরা এর মধ্যে আশ্রয় নিলে কি ভালো হয় না?’
‘এ গুহার ভেতর দিয়ে কি অন্যদিকে বেরুবার পথ আছে?’
‘না বাবুসাহেব।’
‘তাহলে ও গুহা হবে আমাদের পক্ষে ইঁদুর কলের মতন। ওর মধ্যে বন্দি হতে চাই না।’
ঠিক সেই সময়ে নীচের দিকে চার—পাঁচটা বন্দুকের আওয়াজ হল—সঙ্গে—সঙ্গে আমরাও মাটির ওপরে সটান শুয়ে পড়ে নিজের—নিজের বন্দুক বাগিয়ে ধরলুম।
আচম্বিতে আর একটা ভয়াবহ গম্ভীর ধ্বনি জেগে উঠে সেই পর্বতরাজ্যকে শব্দময় করে তুললে। সে ধ্বনি অপূর্ব, বিস্ময়কর, বজ্রাধিক ভীষণ—শুনলে হৃদয় স্তম্ভিত হয়ে যায়।
এদেশে এসে এরকম ধ্বনি আগেও শনেছি—এ হচ্ছে পাহাড় ধসে পড়ার শব্দ—কাফ্রিস্থানের এক সাধারণ বিশেষত্ব!
কিন্তু আমাদের এত কাছে এমন শব্দ—বিভীষিকা আর কোনওদিন জাগ্রত হয়নি। দলবদ্ধ বজ্র যেন গড়গড় করে ভৈরব নাদে ধেয়ে আসছে আমাদের মাথার ওপর দিক থেকেই।
মাল্কান এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে উদভ্রান্তের মতন চিৎকার করে বললে, ‘বাবুসাহেব, পাহাড় ধসে পড়ে নেমে আসছে এই পথ দিয়েই।’
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ । সলিল—সমাধি
সেই কল্পনাতীত, গতিশীল শব্দ—বিভীষিকার তলায় থেকে মনে হল, সৃষ্টির শেষ মুহূর্ত উপস্থিত এবং দুর্দান্ত প্রলয় উৎকট আনন্দে নেমে আসছে আমাদের মাথার ওপরে!
প্রাণের আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছি—হঠাৎ মাল্কান প্রাণপণে চিৎকার করে প্রচণ্ড এক লাফ মেরে আমাদের বাঁ—পাশের গুহাটার ভেতরে গিয়ে পড়ল।
চোখের পলক পড়তে—না—পড়তেই আমরাও প্রায় একসঙ্গেই সেই গুহার ভেতরে গিয়ে উপস্থিত হলুম—এমন কি বাঘা পর্যন্ত! আত্মরক্ষার চেষ্টা এমনি স্বাভাবিক যে, মানুষ আর পশু চরম বিপদের সময়ে ব্যবহার করে ঠিক একই রকম!
ভেতর গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই গুহার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল এবং পথের ওপর দিয়ে চলে যেতে লাগল যেন কান—ফাটানো, প্রাণ—দমানো মহাশব্দের অদ্ভুত এক ঝটিকা ও প্রকাণ্ড—প্রকাণ্ড পাথরের স্তূপ—চারিদিকে নুড়ির—পর—নুড়ি ছড়াতে—ছড়াতে! একটি নুড়ি এসে লাগল কমলের কাঁধের ওপরে, সে আর্তনাদ করে বসে পড়ল!
মিনিট দুই ধরে গুরুভার পাথরের স্তূপগুলো ঠিক জীবন্ত ও হিংস্র প্রাণীর মতন গড়াতে—গড়াতে ও লাফাতে—লাফাতে নীচের দিকে নামতে লাগল—সেই দুই মিনিট যেন দুই ঘণ্টারও চেয়ে বেশি! গুহার ভেতরটা কেঁপে—কেঁপে উঠছে যেন ভূমিকম্পে! গুহার ছাদটাও যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে চায়!
ভয়ানক মৃত্যুর বন্যা যখন গুহামুখ ছেড়ে নীচের দিকে নেমে গেল তখনও আমরা স্তম্ভিতের মতন নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম!
সর্বপ্রথমে কথা কইলেন বিনয়বাবু। হাঁপাতে—হাঁপাতে বললেন, ‘বিমল, নীচের দিক থেকে বিষম এক হাহাকার শুনতে পেয়েছ?’
আমি বললুম, ‘পেয়েছি। যে মৃত্যুকে আমরা ফাঁকি দিলুম, শত্রুরা বোধহয় তাকে এড়াতে পারেনি! অনেক লোকের কান্না শুনেছি, বোধহয় তারা সদলবলে মারা পড়েছে!’
কমল আর্তস্বরে বললে, ‘বিমলদা, নুড়ি লেগে বোধহয় আমার কাঁধের হাড় ভেঙে বা সরে গেছে। আমি ডানহাত নাড়তে পারছি না।’
বিনয়বাবু তাড়াতাড়ি কমলের কাছে গিয়ে তার সেবা—শ্রুশ্রূষায় নিযুক্ত হলেন।
কুমার ব্যাকুলস্বরে বলে উঠল, ‘সর্বনাশ! আমার বন্দুকটা যে বাইরে ফেলে এসেছি!’
আমারও বন্দুক বাইরে পড়ে আছে—প্রাণরক্ষার জন্যে ব্যস্ত হয়ে বন্দুকের কথা ভাববার সময় পাইনি।
বিনয়বাবু আর কমল বন্দুকহীন—বন্দুক নিয়ে ভেতরে ঢুকতে পেরেছে কেবল রামহরি।
ছুটে গুহার বাইরে গেলুম। সেখানেও বন্দুকগুলোর কোনও চিহ্ন নেই—ছুটন্ত পাথরের বিষম ধাক্কায় ঝাঁটার মুখে তুচ্ছ ধুলোর মতো বন্দুকগুলো যে কোথায় গিয়ে পড়েছে তা কে জানে! পাথরের চাপে হয়তো সেগুলো ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে!
কুমার বললে, ‘শত্রুদের অবস্থাও যদি বন্দুকগুলোর মতন হয়ে থাকে তাহলে আমাদের ভাবনার কারণ নেই। রামহরির একটা বন্দুক আর আমাদের চারটে রিভলভারই যথেষ্ট।’
পাহাড়ের গা দিয়ে যে ঢালু পথ বেয়ে আমরা ওপরে উঠেছি তার দিকে তাকিয়ে দেখলুম। যতদূর নজর চলে কেবল দেখা যায়, পথের ওপরে ছড়ানো রয়েছে নুড়ি আর নুড়ির রাশি,—বড়—বড় পাথরগুলো গড়াতে—গড়াতে নীচের দিকে নেমে হারিয়ে গিয়েছে দৃষ্টির অন্তরালে। শত্রুরাও অদৃশ্য। হয়তো তাদের দেহগুলো এখন পাহাড়ের পদতলে পড়ে আছে নির্জীব ও রক্তাক্ত মাংসপিণ্ডের মতো।
আশ্বস্ত হলাম বটে, কিন্তু দুঃখিতও হলুম যথেষ্ট। এতগুলো মানুষের এমন শোচনীয় পরিণাম!
তখন রঙিন ঊষার রহস্যময় আলো সেই শৈলরাজ্যকে করে তুলেছে নতুন এক স্বপ্নলোকের মতো। ভোরের পাখিদের সভায় জাগল ঘুমভাঙানি গান এবং পলাতক অন্ধকারের পরিত্যক্ত আসর জুড়ে বিরাজ করছে স্নিগ্ধসবুজ লতাপাতা—বনস্পতি।
রামহরি বললে, ‘খোকাবাবু, আমাদের মোটঘাটগুলোও রসাতলে গিয়েছে!’
আমি বললুম, ‘তাহলে উপায়? শত্রু নিপাতের পর বন্দুকের দরকার নেই বটে, কিন্তু রসদ না থাকলে পেট চলবে কেমন করে?’
মাল্কান বললে, ‘ভয় নেই বাবুসাহেব, আমাদের আর বেশিদূর যেতে হবে না। এই পাহাড়ের নীচেই আছে একটা নদী। তারপর নদী পার হয়ে ঘণ্টাখানেক পথ চললেই আমরা সেই মঠে গিয়ে হাজির হব।’
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ‘নদীটা কত বড়?’
‘চওড়া খুব বেশি নয় বটে, কিন্তু জল খুব গভীর। তবে আপনাদের ভাবনা নেই, নদীর ওপরে একটা কাঠের সাঁকো আছে।’
‘বেশ, তাহলে আবার যাত্রা করা যাক’ এই বলে আমি অগ্রসর হলুম। সঙ্গীরাও আমার পিছনে—পিছনে চলল। পিছন থেকে মাঝে—মাঝে কমলের ‘আঃ! উঃ!’ বলে আর্তনাদ কানে আসতে লাগল—বোধহয় তার আঘাতটা হয়েছে গুরুতর।
মিনিট পঁচিশ পরেই আমরা পাহাড়ের তলায় গিয়ে দাঁড়ালুম। সামনেই প্রভাত সূর্যকরে জ্বলন্ত সুদীর্ঘ এক বাঁকা তরোয়ালের মতন একটি বেগবতী নদী বয়ে যাচ্ছে কলনাদে উচ্ছ্বসিত হয়ে। চওড়ায় সে ষাট—সত্তর ফুটের বেশি হবে না, কিন্তু তার স্রোতের টান এমন বিষম যে দেখলেই মনে হয়, জল যেন টগবগ করে ফুটছে!
কুমার শুধোলে, ‘মাল্কান, তুমি যে সাঁকোর কথা বললে সেটা কোথায়?’
মাল্কান মাথা চুলকোতে—চুলকোতে বললে, ‘সাঁকোটা তো এইখানেই ছিল।’
‘এইখানেই ছিল তো গেল কোথায়? সাঁকোর তো আর পা নেই যে মর্নিংওয়াক করতে বেরুবে?’
মাল্কান বললে, ‘আমি আজ একবছর এদিকে আসিনি। গেল বর্ষায় জলের তোড়ে সাঁকোটা নিশ্চয় ভেসে গিয়েছে। এদেশে এমন ব্যাপার হামেশাই হয়।’
আমি হতাশভাবে বললুম, ‘তাহলে আমরা কী করব? এ নদীটা তো দেখছি দুই পাহাড়ের মাঝখানকার ঢালু জমি দিয়ে নীচের দিকে নেমে গিয়েছে, সাঁতার কেটে এর প্রখর স্রোত এড়িয়ে ওপারে যাওয়া সোজা নয়।’
কমল বললে, ‘সোজাই হোক আর কঠিনই হোক, আমার পক্ষে সাঁতার কাটা অসম্ভব। আমি ডানহাত নাড়তেই পারব না।’
কুমার কী বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ পিছন থেকে ইংরেজি ভাষায় কর্কশস্বরে কে বললে, ‘এখনি সবাই মাথার ওপরে হাত তোলো!’
চমকে ফিরে দেখি ঠিক আমাদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ছুন—ছিউ, আরও দুজন চিনেম্যান এবং চারজন কাফ্রি! ছুন—ছিউ ও তার চিনে সঙ্গীদের হাতে বন্দুক!
ছুন—ছিউ আবার শাসিয়ে বললে, ‘এখনও হাত তুললে না?’
বাধ্য হয়ে আমাদের সকলকেই হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে হল, কাঠের মূর্তির মতো।
ছুন—ছিউ ইঙ্গিত করতেই কাফ্রিরা ছুটে এসে ধাক্কা মেরে আমাদের মাটির ওপরে শুইয়ে দিয়ে হাত—পা বেঁধে ফেললে।
আমার সামনে এগিয়ে এসে ছুন—ছিউ প্রথম করলে বিকট অট্টহাস্য! তারপর বললে, ‘বাবু, এইবারে তোমাদের আমি হাতের মুঠোয় পেয়েছি! কিন্তু আমি বেশি কথা বলতে চাই না। প্রাণ বাঁচাতে চাও তো লকেটখানা ফিরিয়ে দাও।’
আমি বললুম, ‘তুমি যা চাইছ আমার কাছে তা নেই।’
আবার হা—হা করে হেসে উঠে ছুন—ছিউ বললে, ‘নেই? তাহলে কি তোমরা এতদূরে এসেছ ছেলেখেলা করতে? ওহে, দ্যাখো তো এদের জামাকাপড়গুলো খুঁজে!’
তারা আমাদের প্রত্যেকের জামাকাপড় তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলে—এমনি কী আমাদের মুখবিবর পর্যন্ত দেখতে ছাড়লে না।
লকেট আছে কলকাতায়, কিন্তু তার লিখন আছে আমার স্মৃতির ভাণ্ডারে। ছুন—ছিউকে সে কথা বলা উচিত মনে করলুম না।
ছুন—ছিউ রাগে যেন পাগলের মতন হয়ে উঠল। চিৎকার করে বললে, ‘ওরে বাঙালি কুত্তার দল! তোদের জন্যে আমার দুর্গতির সীমা নেই। চিন থেকে এলুম বাংলাদেশ, সেখানে বিপদের পর বিপদ এড়িয়ে এসেছি এই কাফ্রিস্থানে। এখানে এসে আমাদের দলের আটাশজন লোকের প্রাণ গিয়েছে, তবু আমি তোদের সঙ্গ ছাড়িনি। এত করেও শেষটা কি আমাকে ফাঁকে পড়তে হবে?’
আমি বললুম, ‘হ্যাঁ বন্ধু, ঠিক আন্দাজ করেছ। এখন দেশের ছেলে দেশে ফিরে যাও।’
ছুন—ছিউ চোখ পাকিয়ে বললে, ‘তাই নাকি? আমাকে যদি ফিরে যেতে হয়, তাহলে তোদেরও এই পৃথিবীতে রেখে যাব না!’
‘বেশ, তাহলে আমাদের খুন করো। মরতে হবে সকলকেই—মরতে আমরা ভয় পাই না।’
‘আচ্ছা, দেখা যাক। ওরে, তোরা এই লোকগুলোকে একসঙ্গে বেঁধে ফ্যাল। তারপর ওদের ওই নদীতে ভাসিয়ে দে!’
প্রতিবাদ করলুম না—কারণ এই উন্মত্ত শয়তানদের কাছে প্রতিবাদ বা দয়া প্রার্থনা করে কোনওই লাভ নেই।
তারা আমার ও কুমারের ওপরে রাখল বিনয়বাবু ও কমলের দেহ এবং তার ওপরে শোয়ালে মাল্কান ও রামহরিকে। তারপর লোকে যেমন করে চ্যালাকাঠের বোঝা বাঁধে, সেইভাবে দড়ি দিয়ে আমাদের সকলকে একসঙ্গে বেঁধে ফেললে। আমাদের হাত—পা আগেই বাঁধা ছিল—এটা হল বাঁধনের ওপর বাঁধন!
ভেবেছিলুম মাল্কান তো আমাদের মতন বিপদের পাঠশালায় শিক্ষাগ্রহণ করেনি, প্রাণের ভয়ে কাবু হয়ে সে হয়তো কান্নাকাটি জুড়ে দেবে। কিন্তু এখন দেখছি তার সাড়ে ছয়ফুট উঁচু দেহটির সবটাই হচ্ছে দুর্জয় সাহসে পরিপূর্ণ। তার মুখ ভাবহীন, কণ্ঠে টুঁ শব্দ নেই।
ওরা সকলে মিলে ধরাধরি করে আমাদের নদীর ধারে নিয়ে গেল।
ছুন—ছিউ বললে, ‘এই শেষবার জিজ্ঞাসা করছি—বলো, লকেট কোথায় রেখেছ?’
আমি বিরক্তস্বরে বললুম, ‘আমাকে বারবার জ্বালাতন কোরো না ছুন—ছিউ। লকেট আমার কাছে নেই।’
ছুন—ছিউ বিস্ময়মাখা ক্রুদ্ধস্বরে বললে, ‘এই বাঙালিটা আমাকে আশ্চর্য করলে যে! এ মরবে, তবু মিছে কথা বলতে ছাড়বে না!’
আমি বললুম, ‘আমি সত্য কথাই বলছি।’
‘সত্যকথা? তুমি কি বলতে চাও, লকেট তোমার কাছে ছিল না?’
‘নিশ্চয়ই ছিল!’
‘তবে?’
‘লকেট এখন আমার কাছে নেই।’
‘মানে?’
‘মানে আমি জানি না।’
‘এই তোমার শেষ কথা?’
‘হুঁ।’
‘বেশ। তাহলে আমরাও আমাদের শেষ কাজ করি। ওদের জলে ফেলে দাও।’
তারা সকলে মিলে আমাদের শূন্যে তুলে ধরলে।
রামহরি চেঁচিয়ে বললে, ‘হে বাবা বিশ্বনাথ, চরণে ঠাঁই দিও!’
পরমুহূর্তে আমরা ঝপাং করে পড়লুম নদীর গর্ভে এবং সঙ্গে—সঙ্গে তলিয়ে গেলুম পাতালের শীতল অন্ধকারে।
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ । আমাদের বাঘা
পাতালের দিকে তলিয়ে গেলুম, এবং তারপর আবার ভেসে উঠলুম।—কেবল আমি নই, আমার সঙ্গে যারা বাঁধা ছিল তারাও ভেসে উঠল আমার সঙ্গেই। আমাদের এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়ার উপায় নেই।
আচ্ছন্নের মতো শুনতে পেলুম—কল—কল—কল—কল করে গভীর জলগর্জন! কী তীব্র স্রোত—গতি তার প্রায় বন্যার মতো! জল টলমল করে হেলছে দুলছে, পুঞ্জ পুঞ্জ ফেনার ফুল ফুটিয়ে ওপরে উঠছে, নীচে নামছে, ঘূর্ণিপাকে ঘুরছে ফিরছে এবং শত সহস্র বল্লমের ফলকের মতন চকচকিয়ে ছুটে যাচ্ছে হু—হু করে! সেই নিম্নমুখী গিরিনদীর গতি অত্যন্ত দ্রুত বলে আমরা তৎক্ষণাৎ আবার ডুবে গেলুম না—টানের মুখে ভেসে চললুম খানিক দূর। এজন্যে বিস্মিত হলাম না। অত বেগবতী নদী যে পাথরকে খানিক দূর ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এ কথা সকলেই জানে।
তারপর আবার আমরা ডুবে গেলুম এবং জলের তলায় নিশ্বাস যখন বন্ধ হয়ে এসেছে, নদী আবার আমাদের ওপরে ভাসিয়ে তুলল।
এবার ভেসে উঠেই দেখি, ঠিক আমাদের পাশেই সাঁতার কাটছে বাঘা! এতক্ষণ ঘটনার ঘাত—প্রতিঘাতে তার কথা ভুলে গিয়েছিলুম। তুচ্ছ কুকুর ভেবে শত্রুরা হয় তাকে কিছু বলেনি, নয় সে নিরাপদ ব্যবধানে সরে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষা করেছে। এখন প্রভুভক্ত বাঘা এসেছে আমাদের মৃত্যুযাত্রার সাক্ষী হতে এবং আমাদের সঙ্গেই মরতে।
যে—কয় মুহূর্ত ভেসে থাকি, এর মধ্যেই সুন্দরী পৃথিবীকে ভালো করে শেষবার দেখে নিই! সূর্যের ওপরে ওই সেই নীলাকাশের চন্দ্রাতপ, তীরে—তীরে ওই সেই পাখি—ডাকা সবুজ বনভূমি, দূরে—কাছে ওই সেই গিরিরাজ হিমালয়ের স্তম্ভিত শৈল—তরঙ্গ! ভালো করে আরও কিছু দেখতে না দেখতেই আবার ডুবে গেলুম—কিন্তু আবার ভেসে উঠলুম পরমুহূর্তেই। এবার মনে হল, কে যেন আমাদের টেনে তুললে।
সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখি, বাঘা প্রাণপণে আমাদের বাঁধন—দড়ি কামড়ে ধরেছে!
বাঘা আর দড়ি ছাড়লে না—আমরাও আর ডুবলুম না।
আমাদের পাঁচজনকে টেনে তোলবার শক্তি নিশ্চয়ই বাঘার নেই। কিন্তু প্রথমত জলে গুরুভারও হয় লঘুভার এবং দ্বিতীয়ত, এই খরস্রোতা নদীর তীব্র টান আমাদের ভাসিয়ে রাখবার পক্ষে সাহায্য করলে যথেষ্টই।
বাঁধান—দড়ি কামড়ে ধরে বাঘা নদীর তীরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে। কিন্তু স্রোতের টানে তার চেষ্টা সফল হল না। তবে সে কোনওক্রমে জলের ওপরে আমাদের ভাসিয়ে রাখলে। ধন্যবাদ, বাঘাকে ধন্যবাদ!
এতক্ষণ পরে কুমার কথা কইলে। বললে, ‘বিমল, বাঘা আজ যা করলে, অন্য কোনও কুকুর তা করতে পারত না। কিন্তু এভাবে বাঘা আর কতক্ষণ আমাদের ভাসিয়ে রাখবে? বাঘা জলচর জীব নয়, আর একটু পরেই সে দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন যে মরণ ছাড়া আমাদের আর কোনও গতি নেই?’
‘আমিও সেই কথাই ভাবছি কুমার!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘শত্রুরা কি এখন আমাদের দেখতে পাচ্ছে না?’
আমি বললুম, ‘তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক দূরে এসে পড়েছি।’
কমল উৎসাহিত কণ্ঠে বললে, ‘দ্যাখো বিমলদা! বাঘার চেষ্টা একেবারে ব্যর্থ হয়নি। সে একটু—একটু করে আমাদের তীরের খানিকটা কাছে এনে ফেলেছে!’
কমলের উৎসাহ দেখে এত দুঃখেও আমার হাসি এল। আমাদের এই অবস্থায় তীরের খানিকটা কাছে আসা আর তীরে গিয়ে ওঠার মধ্যে আকাশপাতাল তফাত!
এমন সময়ে এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটল। নদীর গতি হঠাৎ অত্যন্ত বেড়ে উঠল—বোধহয় এখন আমরা যেখান দিয়ে যাচ্ছি, নদীর তলাকার জমি সেখানে খুব বেশি ঢালু। যেদিকে চলেছি সেই দিকেই ছিল আমার মাথা, তাই ওদিককার কিছুই এতক্ষণ দেখতে পাচ্ছিলুম না। আচম্বিতে ঘূর্ণায়মান স্রোতের টানে আমাদের একসঙ্গে বাঁধা দেহগুলো উলটে ঘুরে গেল—প্রচণ্ড বেগে খানিকদূর ভেসে গিয়েই দেখি, তীর একেবারে আমাদের খুব কাছে সরে এসেছে!
বিনয়বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আমরা নদীর বাঁকে এসে পড়েছি—আমরা নদীর বাঁকে এসে পড়েছি!’
সঙ্গে—সঙ্গে আমরা পেলুম এক বিষম আঘাত! অন্য সময় হলে সে আঘাতে রীতিমতো অভিভূত হয়ে পড়তুম, কিন্তু এখন আমরা অভিভূত হওয়ারও অবকাশ পেলুম না—কারণ আমাদের দেহের ওপরে লাগল কঠিন পাথুরে মাটির স্পর্শ! এ স্পর্শ যত কঠিনই হোক—এটা যে স্নেহময়ী পৃথিবীর মাটির ছোঁয়া, এই আশ্চর্য অনুভূতিই আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করে দিলে উন্মত্ত আনন্দে!
আমরা ঠেকে গিয়েছি নদীর বাঁকে! কেবল তাই নয়, বাঁকের মুখে ছিল কী একটা জলজ লতাপাতার ঘন জাল, দেহগুলোকে সে যেন জীবন্তেরই মতন ছড়িয়ে ধরলে! স্রোত আর আমাদের টেনে নিয়ে যেতে পারবে না।
রামহরি বলে উঠল, ‘জয় বাবা বিশ্বনাথ! একেই বলে, রাখে কৃষ্ণ মারে কে?’
কমল বললে, ‘হায় রামহরি, তোমার কৃষ্ণ আমাদের রাখলেন বটে, কিন্তু বাঁধনগুলো খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন না কেন?’
বাঘা তখন গলা পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে গরর—গরর রবে গর্জন শুরু করলে!
আমাদের দিকে তাকিয়ে বাঘা এতটা চটে উঠল কেন?
পরমুহূর্তেই এ—প্রশ্নের উত্তর পেলুম!
হঠাৎ বাঘা আক্রণ করলে আমাদের বাঁধন—দাড়িকে! এই দড়ির ওপরেই তার রাগ হয়েছে, সে বুঝতে পেরেছে এই দড়ির বাঁধনই হচ্ছে যত অনিষ্টের মূল!
কুমার তাকে উৎসাহ দিয়ে বারংবার বলতে লাগল, ‘আমার সোনার বাঘা! আমার বন্ধু বাঘা! বাহাদুর বাঘা! কেটে দাও তো দড়িগুলো—চটপট কেটে দাও তো ভাই!’
উৎসাহ পেয়ে বাঘার আনন্দ আর ধরে না, জয়পতাকার মতন তার লাঙ্গুল জলের ওপর তুলে সে নাড়তে লাগল ঘনঘন।
স্বাধীন, আমরা স্বাধীন! বাঘার দৌলতে আমরা জলে ডুবে মরিনি, বাঘার অনুগ্রহে ঘুচল আমাদের বন্ধন দশা!
এতক্ষণ মাল্কান একটিমাত্র কথা কয়নি, সে হঠাৎ এখন উচ্ছ্বসিত হয়ে দুই হাত বাড়িয়ে বাঘাকে বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে অশ্রুরুদ্ধ স্বরে বললে, ‘বন্ধু, আমার জীবনরক্ষক বন্ধু!’
রামহরি আহ্লাদে নাচতে—নাচতে বললে, ‘দেখছ কমলবাবু, কৃষ্ণ বাঁধন খুলে দিলেন কি না? বাঘা সেই কৃষ্ণেরই জীব!’
কুমার বললে, ‘ভগবান যা করেন ভালোর জন্যে! দ্যাখো বিমল, ছুন—ছিউ চেয়েছিল আমাদের পাতালে পাঠাতে, কিন্তু আমরা এসে উঠেছি নদীর এপারে! আর সাঁকোর দরকার হল না!’
আমি বললুম, ‘মাল্কান, আমরা ‘শা—লো—কা’ মঠের কাছে এসে পড়েছি নয়?’
‘হ্যাঁ বাবুসাহেব, খুব কাছে।’
‘তাহলে আর দেরি নয়! ছুন—ছিউ নদীর ওপারে সদলবলে সদর্পে বিচরণ করুক, ইতিমধ্যে আমরা করব কার্যোদ্ধার!’
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ । গুপ্তগুহা
ইতিহাস—বিখ্যাত কপিশ পাহাড়ের উপত্যকা! এসে দাঁড়িয়েছি আমাদের পথের শেষে।
ধ্বংসস্তূপের পর ধ্বংসস্তূপ! প্রাচীন মঠের অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়েছে—এমন একখানা ভাঙাচোরা ঘরও নেই, যার ভেতরে মাথা গোঁজা যায়। সম্রাট কণিষ্ক এখানে যেসব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য—কীর্তি স্থাপন করে গিয়েছিলেন, আজ তার কোনও সৌন্দর্যই উপভোগ করবার উপায় নেই। অতীতের ঐশ্বর্য অতীতের আড়ালেই গা—ঢাকা দিয়েছে।
মঠের ধ্বংসাবশেষের ভেতরে অনেক খোঁজাখুঁজি করলুম, কিন্তু অষ্টদন্ত তিনপদ কুবের মূর্তির কোনও সন্ধানই পাওয়া গেল না।
বিনয়বাবু মাথা নাড়তে—নাড়তে বললেন, ‘আমি তো আগেই একথা বলেছিলুম! দ্বিতীয় শতাব্দীর কণিষ্ক আর বিংশ শতাব্দীর আমরা! এর মধ্যে কত যুগ—যুগান্তর চলে গিয়েছে—কত দস্যু, কত লোভী এখানে এসেছে, গুপ্তধনের এক কণাও আর পাওয়া যাবে না!’
আমার মন মুষড়ে পড়ল। তাহলে এতদিন ধরে আমরা দেখছিলুম আলেয়ার স্বপ্ন? আমাদের এত আগ্রহ, এত চেষ্টাশ্রম, এত বিপদভোগ, সবই হল ব্যর্থ?
মাল্কান বললে, ‘বাবুসাহেব, এখান থেকে প্রায় এক মাইল দূরে আর একটা ছোট ধ্বংসস্তূপ আছে। তার ভেতরে একটা ভাঙা মূর্তিও দেখেছিলুম বলে মনে হচ্ছে।’
কিছুমাত্র উৎসাহিত না হয়েই বললুম, ‘যখন এতদূর এসেছি তখন সেখানেও না হয় যাচ্ছি, কিন্তু আর কোনও আশা আছে বলে মনে হয় না।’
কুমার ও কমল প্রভৃতি একেবারে গুম মেরে গেল। মাল্কানের পিছনে—পিছনে আবার আমরা এগিয়ে চললুম বটে, কিন্তু সে যেন নিতান্ত জীবন্মৃতের মতোই।…
মিনিট পনেরো পরে আমরা উপত্যকার শেষ প্রান্তে একটা জঙ্গলভরা জায়গায় এসে দাঁড়ালুম। সেখানেও প্রায় আশি ফুট জায়গা জুড়ে একটা ধ্বংসস্তূপ পাওয়া গেল।
পরীক্ষা করে বুঝলুম, একসময়ে সেখানে একটা মাঝারি আকারের মন্দির ছিল—এখন কোথাও পড়ে আছে রাশিকৃত পাথর, কোথাও বা খোদাই করা থামের টুকরো এবং কোথাও বা ভাঙাচোরা মূর্তির অঙ্গপ্রতঙ্গ।
চারিদিক তন্নতন্ন করে খুঁজলুম। ধুকধুকির ওপরকার লেখাটা বারবার স্মরণ করতে লাগলুম :—’শা—লো—কা : পশ্চিম দিক : ভাঙা মঠ : কুবের মূর্তি : গুপ্তগুহা।’
আমরা আগে যে ধ্বংসস্তূপে গিয়েছিলুম হয়তো সেইখানেই ছিল প্রাচীন শা—লো—কা মঠ। তারপর আমরা পশ্চিম দিকেই এসেছি বটে এবং এখানেও পেয়েছি একটা মঠ বা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু কোথায় কুবের—মূর্তি?
কুমার বললে, ‘হয়তো আগে এখানে কুবের—মূর্তি ছিল। এখন সেটা ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু গুপ্তগুহাটাই বা কোথায়?’
এমন সময় বিনয়বাবু সাগ্রহে আমাদের নাম ধরে ডাক দিলেন—তিনি তখন এক জায়গায় হাঁটু গেড়ে বসে কি পরীক্ষা করছিলেন।
বিনয়বাবুর কাছে গিয়ে দেখলুম, সেখানে কোমর পর্যন্ত ভাঙা একটা মূর্তি রয়েছে, দেখলেই বোঝা যায় অটুট অবস্থায় তার উচ্চতা ছিল অন্তত বারো ফুট। মূর্তির একখানা পা—ভাঙা, তার তলায় রয়েছে একটা হাতখানেক উঁচু লম্বাটে বেদি।
বিনয়বাবু বেদির ওপরে অঙ্গুলিনির্দেশ করে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন।
প্রথমটা কিছুই বুঝতে পারলুম না। তারপরই লক্ষ করলুম, বেদির ওপরে মূর্তির অটুট পায়ের পাশেই রয়েছে পরে পরে আরও দু—খানা পায়ের চিহ্ন। পা দু—খানা অদৃশ্য হয়েছে বটে কিন্তু পায়ের ছাপ এখনও বর্তমান।
বিনয়বাবু বললেন, ‘বিমল, এই তোমাদের কুবের মূর্তি। কুশ্রী কুবেরের অষ্টদন্ত মুখ আর প্রকাণ্ড ভুঁড়ি মহাকালের প্রহারে নষ্ট হয়ে গেছে, প্রথম দৃষ্টিতে একখানার বেশি পদও নজরে পড়ে না বটে, কিন্তু পাথরের ওপরে অন্য দুখানা পদের কিছু কিছু চিহ্ন আজও লুপ্ত হয়ে যায়নি। হ্যাঁ, এই তোমাদের কুবের মূর্তি। বোঝা যাচ্ছে, ধুকধুকিতে মিছে কথা লেখা নেই। কিন্তু গুপ্তগুহা কোথায়?’
কমল বললে, ‘সেটা যদি সহজে আবিষ্কার করা যেত, তাহলে তার নাম গুপ্তগুহা হত না।’
কমল ঠিক বলেছে কিন্তু কুবের মূর্তি যখন পেয়েছি, তখন ধুকধুকির লিখনকে আর অবিশ্বাস করা চলে না। নবজাগ্রত উৎসাহে আমরা সকলে দিকে—দিকে ছড়িয়ে পড়ে গুহার সন্ধান করতে লাগলুম। জঙ্গল ভেঙে আনাচেকানাচে অনেক খোঁজাখুঁজি করলুম, কিন্তু গুহার কোনও অস্তিত্বই আবিষ্কার করতে পারলুম না।
সকলে আবার নিরাশ মনে ভাঙা কুবের—মূর্তির পাশে এসে দাঁড়ালুম। ঘাটে এসে নৌকা ডুবল বোধহয়।
কুমার বললে, ‘উপত্যকার শেষে ওই যে পাহাড় রয়েছে, ওখানে গিয়ে একবার গুহার খোঁজ করে দেখব নাকি?’
বিনয়বাবু বললেন, ‘আমার বিশ্বাস, গুহা যদি থাকে, এই কুবের—মূর্তির কাছেই আছে। মন্দিরের সম্পত্তি মন্দিরের বাইরে থাকবে কেন?’
যুক্তিসঙ্গত কথা। কিন্তু বেদির ওপরে এই তো রয়েছে কুবের—মূর্তি, তার আশপাশের অনেকখানি পর্যন্ত সমস্তটাই পাথর দিয়ে বাঁধানো—কারণ এটা হচ্ছে বিলুপ্ত মন্দিরের মেঝে। এখানে গুহা থাকবে কোথায়? খানিকক্ষণ ভেবেও কোনও হদিশ পাওয়া গেল না।
কুমার হঠাৎ কৌতুকচ্ছলে কুবেরের পা টেনে ধরে বললে, ‘হে কুবের, হে দেবতা! আমরা হচ্ছি টাকার—অর্থাৎ তোমার পরম ভক্ত! কোথায় তোমার ঐশ্বর্য লুকিয়ে রেখেছ প্রভু, দেখিয়ে দাও—দেখিয়ে দাও!’
হঠাৎ আমার মনে হল, কুবের—মূর্তি যেন নড়ে উঠে ডানদিকে একটু সরে গেল!
তাড়াতাড়ি মূর্তির পায়ের তলায় হেঁট হয়ে পড়ে দেখি, ধূলি—ধূসরিত বেদির ওপরে আধ ইঞ্চি চওড়া একটা পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন রেখা! মূর্তিটা যে একটু সরে গেছে, আর তার নীচেকার পরিষ্কার অংশটুকু বেরিয়ে পড়েছে, সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই।
আমি বললুম, ‘কুমার, কমল, রামহরি! এসো, আমরা সবাই মিলে মূর্তিটাকে বাঁ—দিক থেকে ঠেলা দি! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই মূর্তির ভেতরে কোনও রহস্য আছে।’
সকলে মিলে যেমন ঠেলা দেওয়া, ভাঙা মূর্তিটা হড়হড় করে প্রায় হাত—দুয়েক সরে গিয়ে আবার অটল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
অবাক বিস্ময়ে দেখলুম, মূর্তির তলদেশেই আত্মপ্রকাশ করেছে একটি চতুষ্কোণ গর্ত এবং তার ভেতরে নীচের দিকে নেমে গিয়েছে একসার সংকীর্ণ সিঁড়ি! এই তাহলে গুপ্তগুহা?
কুমার আনন্দে মেতে বলে উঠল, ‘আজ দেখছি আমাদের ওপরে সব দেবতারই অসীম দয়া! রামহরির কৃষ্ণ আমাদের প্রাণ বাঁচালেন, আর পাথরের কুবের আমাদের সামনে খুলে দিলেন তাঁর রত্নভাণ্ডারের গুপ্তদ্বার! এখন দেখা যাক, ভাণ্ডার পূর্ণ কি না!’—বলেই সে গর্তের ভেতরে পা বাড়িয়ে দিলে।
রামহরি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললে, ‘ওগো কুমারবাবু, কোথা যাও? এখানে যকের ভয় আছে, সে—কথা কি ভুলে গেছ?’
আমি বললুম, ‘থামো রামহরি, বাজে বোকো না! প্রায় দু—হাজার বছর ধরে বেঁচে আছে, এমন ভূতের গল্প কোনওদিন শুনিনি। বেঁচে থাকলেও সে এত বুড়ো হয়ে গেছে যে, আমাদের দুটো ঘুসিও সইতে পারবে না! চলো সবাই গুহার মধ্যে!’