গুহাবাসী বিভীষণ
এক
বিমল ও কুমার আমেরিকান ও ইংরেজি পদ্ধতিতে ‘বক্সিং’ অভ্যাস করছিল।
আজ সকালেই ওই দুই দেশের বিশেষ পদ্ধতি নিয়ে তাদের মধ্যে তর্ক হয়ে গেছে। এখন খুব—খানিকটা ঘুসোঘুসি করেও তর্কের কোনও শেষ—মীমাংসা হল না।
বিমল মুষ্টিযুদ্ধের দস্তানা খুলে ফেলতে—ফেলতে বললে, ‘ঘুসির জোরেও যে তর্কের মীমাংসা হয় না, আপাতত সে তর্ককে বাতিল করে দেওয়া যাক।’
কুমার বললে, ‘তোমার ”সোলার প্লেক্সাসে” একটি মাত্র ঘুসি মারবার ফাঁক পেলেই এখনি একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যেত।’
বিমল বললে, ‘কিন্তু আমেরিকান কায়দা সে ফাঁক দেয় না! মনে রেখো, ”সোলার প্লেক্সাসে” ঘুসি মেরে যোদ্ধাকে অজ্ঞান করবার কৌশল প্রথমে আমেরিকাতেই আবিষ্কৃত হয়েছিল।’
বাইরে থেকে ডাকপিয়ন হাঁকলে—’চিঠি আছে!’
বিমল বললে, ‘দ্যাখো গে বিনয়বাবুর চিঠি এল কিনা! বাহাদুরগঞ্জে গিয়ে পর্যন্ত তিনি কোনও চিঠি লেখেননি!’
কুমার বেরিয়ে গেল। তারপর একখানা খাম হাতে করে ফিরে এসে বললে, ‘হ্যাঁ, বিনয়বাবুর চিঠিই বটে!’
‘কি লিখেছেন পড়ে শোনাও।’
কুমার খাম ছিঁড়ে চিঠি বার করে চেঁচিয়ে পড়তে লাগল,
প্রিয় বিমল ও কুমার,
বায়ু—পরিবর্তনের জন্যে এখানে এসে পর্যন্ত তোমাদের যে কোনও পত্র লিখিনি তার কারণ হচ্ছে, এতদিন দেবার মতো কোনও খবর ছিল না। এখানকার প্রধান ঐশ্বর্য ব্রহ্মপুত্র নদ। সে আগেও যেমন বইত, এখনও তেমনি বইছে। সকালে সন্ধ্যায় তার তীরে বসে সূর্যকিরণের জন্ম ও মৃত্যু দেখতে আমার খুব ভালো লাগে বটে, কিন্তু পত্রে সে—খবরের মধ্যে তোমরা কোনওই নতুনত্ব আবিষ্কার করতে পারতে না। কবির কলম পেলে এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের উজ্জ্বল বর্ণনা করতে পারতুম। কিন্তু তোমরা জানো, আমি কবি নই,—শুষ্কপ্রাণ বৈজ্ঞানিক মাত্র।
কিন্তু সম্প্রতি এখানে একটি দেবার মতো খবর পাওয়া গেছে।
তোমরা ভূত মানো না, আমিও মানি না। ভূতের গল্প শুনে ও পড়ে আমি কেবল শখ করে ভয় পেতে ভালোবাসি। হয়তো তোমাদেরও সেই অভ্যাস আছে, তাই আমি আজ তোমাদের একটি নতুন ভূতের গল্প শোনাব।
এখানকার বাসিন্দাদের মতে, একটি অজানা ভূত নাকি আমারই মতো বায়ু পরিবর্তনের জন্যে এ অঞ্চলে এসে উপস্থিত হয়েছে।
কিন্তু সে ভূতটি আমার মতো শান্তিপ্রিয় নয়। সে রীতিমতো উপদ্রব শুরু করেছে।
রোজ রাত্রে সে ব্রহ্মপুত্রের জলে নেমে সাঁতার কাটে। তাকে চোখে কেউ দেখেনি বটে, কিন্তু সে নাকি রোজ রাত্রেই ভয়ানক হেঁড়ে গলায় কান্নাকাটি করে আর একটা গুহার কাছে জলের ভিতর থেকে তার বিষম ঝাঁপাই—ঝোড়ার শব্দও শোনা যায়।
সে অনায়াসেই খুব চেঁচিয়ে হাসতে পারত। কিন্তু সে হাসে না, কাঁদে—খালি কাঁদে!
লোকের কথায় প্রথমটায় বিশ্বাস করিনি। কিন্তু দিন পাঁচ আগে আমিও স্বকর্ণে তার কান্না শুনেছি!
ব্রহ্মপুত্রের তীরেই একখানা বাংলোয় আমি আছি। সেদিন রাত্রে হঠাৎ বৃষ্টি আসায় আমার ঘুম গেল ভেঙে। তাড়াতাড়ি উঠে মাথার দিককার জানলাটা বন্ধ করে দিতে গেলুম।
হু—হু ঝোড়ো—হাওয়ার সঙ্গে এক আশ্চর্য ও অমানুষিক কণ্ঠের উচ্চ ও তীব্র চিৎকার ঘরের ভিতরে ভেসে এল!
তেমন কান্নাভরা বিকট চিৎকার আমি আর কখনও শুনিনি। সে চিৎকার মানুষেরও বটে, মানুষের নয়ও বটে! অর্থাৎ মানুষ ইচ্ছা করলেও তেমন ভাবে চিৎকার করে কাঁদতে পারে না।
তিনবার সেই চিৎকার শুনলুম। তারপর ঝড় ও বৃষ্টির রোখ এমন বেড়ে উঠল যে, জানলা বন্ধ করে দিতে হল।
নদীর জলের ভিতরেই ডাঙা থেকে প্রায় দুশো গজ তফাতে আছে এক শিশু পাহাড়। লক্ষ লক্ষ বৎসর পরে তার চূড়া হয়তো একদিন মেঘ রাজ্যে গিয়ে পৌঁছবে, কিন্তু এখন তার মাথা জল ছাড়িয়ে ত্রিশ ফুটের বেশি ওপরে উঠতে পারেনি। এই ছোট্ট পাহাড়ের নীচের দিকে একটা গুহা আছে। জোয়ারের সময়ে সেই গুহাটা জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে যায় এবং ভাটার সময়েও তার আধাআধি জলে ভরতি হয়ে থাকে।
আমার মনে হল, সেই ভয়াবহ আর্তনাদ আসছে ওই পাহাড়ের কাছ থেকেই।
পরশুদিন রাত্রে আবার এক কাণ্ড হয়ে গেছে।
একটা কুলি সন্ধ্যার পর জল আনতে গিয়েছিল নদীর ঘাটে।
কিন্তু হঠাৎ সে মহা ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। তার দুজন সঙ্গী ব্যাপার কি দেখবার জন্যে ঘাটের দিকে ছুটে গেল। অন্ধকারে তারা কিছুই দেখতে পেলে না বটে, কিন্তু সভয়ে শুনলে যে ঘাটের খুব কাছ থেকেই অমানুষিক কণ্ঠে কে ঘন ঘন গর্জন করছে। তারা আর না এগিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এল!
কাল সকালে গোলমাল শুনে আমি নদীর ঘাটে গিয়ে দেখি, সেই হতভাগ্য কুলির মৃতদেহ জলের ভিতরে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
ভালো করে লক্ষ করে বুঝলুম, কেউ তাকে গলা টিপে হত্যা করেছে। গলার ওপরে তখনও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মোটা মোটা আঙুলের দাগ! সেগুলো যে মানুষের আঙুলের দাগ, তাতে আর কোনওই সন্দেহ নেই!
কে তাকে হত্যা করলে? কেন হত্যা করলে? রাত্রে নদীর জলে কে কাঁদে বা গর্জন করে? পুলিশের পাহারা বসেছে, কিন্তু এসব প্রশ্নের কোনওই জবাব নেই।
এখানকার লোকেরা ভয়ে, বিস্ময়ে ও দুর্ভাবনায় কাতর হয়ে পড়েছে। সূর্য অস্ত গেলে পর কেউ আর নদীর ধার মাড়ায় না। সত্যি কথা বলতে কি, আমিও হতভম্ব হয়ে গেছি।
এরকম অসাধারণ ঘটনা নিয়ে তোমরা মাথা ঘামাতে খুব ভালোবাসো, তাই তোমাদের খবরটা জানিয়ে দিলুম। যদি নতুন উত্তেজনার প্রতি তোমাদের লোভ থাকে, তাহলে আমার বাংলোয় তোমাদের স্থানাভাব হবে না।
অতএব আশা করছি, অবিলম্বেই তোমরা সশরীরে এসেই আমার পত্রের উত্তর দেবে। ইতি—
তোমাদের
‘বিনয়বাবু’
কুমার বললে, ‘বিমল, তোমার মত কী?’
বিমল সহাস্যে বললে, ‘তাও আবার জিজ্ঞাসা করছ? এক্ষেত্রে তোমাতে আমাতে মতের অমিল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
কুমার বললে, ‘তাহলে তল্পিতল্পা বাঁধবার চেষ্টা করি?’
‘নিশ্চয়ই।’
দুই
জায়গাটি চমৎকার। যেখানে পাহাড়, নদী আর অরণ্যের মিলন হয় সেখানে প্রকৃতির রূপে কেউ খুঁত ধরতে পারে না।
আকাশের নীলিমা আছে পৃথিবীর সর্বত্রই, কিন্তু আসলে তার সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়, নদী আর অরণ্যের ওপরে চাঁদোয়া হবার জন্যেই।
বিনয়বাবু বললেন, ‘দ্যাখো বিমল ওই সেই শিশু পাহাড়!’
বিমল ও কুমার দেখলে, ব্রহ্মপুত্রের স্বচ্ছ জলে ছায়া ফেলে ছোট্ট একটি পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে।
বিমল বললে, ‘ওরই তলায় গুহা আছে?’
‘হ্যাঁ। এখন ভাটা পড়েছে, তাই গুহার উপরদিকটা দেখা যাচ্ছে।’
কুমার বললে, ‘বিনয়বাবু, আপনি কোনওদিন ওই গুহার কাছে যাননি?’
‘না। এতদিন যাবার দরকার হয়নি। আমার বিশ্বাস ওই গুহার ভিতরটা একবার পরীক্ষা করা উচিত।’
বিমল বললে, ‘বেশ তো, এখনি সে চেষ্টা করা যাক না! ঘাটে অনেকগুলো নৌকো বাঁধা রয়েছে, একখানা ভাড়া করে গুহার কাছে গেলেই চলবে।’
সকলে ঘাটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কোনও মাঝিই তাদের গুহার কাছে নিয়ে যেতে রাজি হল না।
বিমল বললে, ‘আচ্ছা, তোমরা নৌকো ছেড়ে নেমে দাঁড়াও, আমরাই দাঁড় বেয়ে গুহার কাছে যাব। তোমরা পুরো ভাড়াই পাবে।’
এ বন্দোবস্তে তাদের আপত্তি হল না। বিনয়বাবু ধরলেন হাল এবং দাঁড় নিয়ে বসল বিমল ও কুমার।
নৌকো ভেসে চলল ছোট পাহাড়ের দিকে।
প্রথমে তারা পাহাড়টাকে একবার প্রদক্ষিণ করলে, তার চারিদিকেই রোদে উজ্জ্বল নদীর জল নেচে নেচে খেলা করছে। পাহাড়টা একেবারে ন্যাড়া, তার রুক্ষ কালো গায়ে সবুজের আঁচটুকু পর্যন্ত নেই। তারি টঙের ওপর স্থির হয়ে বসে আছে একটা শকুন।
একদিকে রয়েছে সেই গুহাটা। এখন জোয়ার নয় বলে গুহার ওপর দিকটা খিলানের মতো জলের ওপরে জেগে রয়েছে। গুহার মুখ চওড়ায় দশ—বারো ফুটের বেশি নয়।
নৌকো গুহামুখে গিয়ে উপস্থিত হল। তার ভিতরটা ঘন ছায়ায় ভরা, সর্বদাই সেখানে সন্ধ্যার আলো—আঁধার বিরাজ করে। সকলে নৌকোর ওপরে হেঁট হয়ে পড়ে গুহার ভিতর দিকটা দেখবার চেষ্টা করলে, কিন্তু ভিতরে শুধু জল থইথই করছে! ভালো করে কিছু দেখাও গেল না, সন্দেহজনক কিছু আছে বলেও মনে হল না।
কুমার বললে, ‘কিন্তু বিমল, এখানে কেমন একটা আঁশটে গন্ধ পাচ্ছ না কি? কাছে কুমির থাকলে এমনি গন্ধ পাওয়া যায়।’
বিমল বললে, ‘হুঁ।’ তারপর দাঁড়টা যথাসম্ভব বাড়িয়ে দিয়ে গুহার ভিতরকার দেওয়ালে ঠুকে পরীক্ষা করতে লাগল।
আচম্বিতে তাদের নৌকোখানা তীব্রবেগে পিছু হটে গুহার মুখ থেকে খানিক তফাতে গিয়ে পড়ল! সকলে মহাবিস্ময়ে হুমড়ি খেয়ে জলের ভিতর তাকিয়ে দেখলে, কিন্তু কিছুই দেখা গেল না!
কুমার বললে, ‘জলের ভিতর থেকে বিষম ধাক্কা মেরে কে যেন নৌকোখানাকে দূরে ঠেলে দিল!’
বিমল বললে, ‘কিন্তু কে সে? কুমির যে এমন করে নৌকো ঠেলে দিতে পারে, এ—কথা তো কখনও শুনিনি!’
‘কিন্তু সে যেই—ই হোক, আমরা যে ওখানে থাকি, এটা সে চায় না!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘আমরা কি আবার নৌকো নিয়ে গুহার কাছে যাব?’
বিমল বললে, ‘না, আমরা এইবারে ওই পাহাড়ে গিয়ে উঠব।’
তিন
পাহাড়ের নীচের দিকটা নদীর জল লেগে লেগে এমন পিছল হয়ে আছে যে, তার ওপরে উঠতে তাদের বিশেষ বেগ পেতে হল।
পাহাড়ের ওপরে মানুষের আবির্ভাব দেখে শকুনটা বিরক্ত হয়ে উড়ে গেল।
বিনয়বাবু বললেন, ‘এই ন্যাড়া পাহাড়ের টুকরোর ওপরে একাট মাছিও লুকিয়ে থাকতে পারে না। এখানে এসে লাভ কি?’
বিমল বললে, ‘আমরা ওই গুহার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে ভালো করে দেখবার সুযোগ পাব।’
গুহার পাশেই রয়েছে মস্ত একখানা পাথর—জল থেকে হাত—চারেক উঁচু। কুমার তার ওপরে গিয়ে জলের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। বিমল ও বিনয়বাবুও তার পাশে গিয়ে বসলেন।
বিমল স্থির চক্ষে গুহার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘ওই গুহার ভিতরে অনায়াসেই কোনও জলচর জীব লুকিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বিনয়বাবু আপনি যে চিৎকার শুনেছিলেন, কোনও জলচর জন্তুর পক্ষে কি সেরকম চিৎকার করা সম্ভব?’
বিনয়বাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘না, না, সে হচ্ছে মানুষের কণ্ঠে অমানুষিক চিৎকার!’
‘বেশ বুঝতে পারছি, এই ভাটার সময়েও গুহার ভিতরে ডুবজল রয়েছে। কোনও মানুষ নিশ্চয়ই ওখানে বাস করতে পারে না।’
‘কোনও মানুষ ওখানে বাস করুক বা না করুক, কিন্তু চিৎকারটা এইখানেই উঠেছিল বলে আমার সন্দেহ হয়।’
‘সেদিনের সেই চিৎকার, তারপর ঘাটের ওপরে সেই নরহত্যা, তারপর আজকের এই নৌকোয় ধাক্কা মারার ব্যাপার। এই তিনটের মধ্যে কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, আমাদের এখন সেই বিচারই করতে—’
হঠাৎ কুমার চমকে পাথরের একটা কোণ দুই হাতে চেপে ধরে আর্তস্বরে বলে উঠল—’কে আমার পা ধরে টানছে—বিমল—’
বিমল জলের দিকে একবার উঁকি মেরেই চোখের পলক না ফেলতে পকেট থেকে রিভলভার বার করে উপর—উপরি দুবার গুলি ছুড়লে।
তার পরেই এক বুক—কাঁপানো গগনভেদী ভয়ঙ্কর চিৎকার!
বিনয়বাবু জলের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, কিন্তু তিনি দেখলেন কেবল মস্ত একটা ছায়া জলের ভিতরে সাঁ করে মিলিয়ে গেল এবং জলের ওপরে ভেসে উঠল খানিকটা রক্ত।
কুমার তাড়াতাড়ি পা গুটিয়ে নিয়ে হতভম্বের মতো বিমলের দিকে তাকিয়ে দেখলে, তার মুখের ভাব উদভ্রান্তের মতো!
তারপর সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললে, ‘বিমল, বিমল, জলের ভিতর থেকে কে আমার পা ধরে টানছিল?’
‘তুমি কি কিছুই দ্যাখোনি?’
‘না। দেখবার সময় পেলুম কই? খালি এইটুকু বুঝতে পেরেছি, আমার পা ধরেছিল মানুষের দুখানা হাত!’
বিমল অভিভূত কণ্ঠে বললে, ‘আমিও যা দেখেছি হয়তো সেটা মানুষেরই মুখ! কিন্তু মানুষের মুখের চেয়ে অন্তত আড়াই গুণ বড়! তার চোখ, নাক, ঠোঁট, গলা, হাত আছে, অথচ তার কিছুই সত্যিকার মানুষের মতো নয়! সে এক ভয়ানক অসম্ভব দুঃস্বপ্ন, আমার গায়ে এখনও কাঁটা দিচ্ছে।’
চার
নৌকো আবার পাহাড় ছেড়ে তীরের দিকে ফিরল।
বিনয়বাবু বললেন, ‘পৃথিবীতে চিরদিনই এক বিচিত্র জীবের কথা শোনা যায়, সাহেবরা যাকে বলে mermaid, আর আমরা বলি মৎস্যনারী। ভারতের নানা স্থানে সেকেলে মন্দিরের গায়ে এইরকম জলবাসী আর এক জীবের অর্থাৎ নাগকন্যাদের মূর্তি দেখা যায়। মৎস্যনারীদের দেহের ওপর দিকটা হয় মানুষের মতো আর নীচের দিকটা মাছের মতো। নাগকন্যাদেরও ওপর দিক মানুষের মতো দেখতে হলেও তাদের নীচের দিকটা হয় সাপের মতো।’
কুমার বললে, ‘কিন্তু তারা তো কল্পনা—জগতের জীব!’
‘আগে শোনো। অনেক নাবিক অজানা সমুদ্র থেকে ফিরে এসে অনেকবারই মৎস্যনারীর কথা বলেছে। পণ্ডিতরা সেসব কথা ঠাট্টা করেই উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সেদিন ‘স্টেটসম্যান’ কাগজে দেখলুম, এইবারে অবিশ্বাসী পণ্ডিতদের মুখ বন্ধ হয়েছে।’
‘কীরকম?’
‘সিয়েরা লিওনের ডা. গ্রাহাম মৎস্যনারীর একটি ‘মমি’ অর্থাৎ রক্ষিত দেহ নিয়ে ইংলন্ডে এসেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে এক দোকানদার ওই দেহটি কিনেছে। বড় বড় বৈজ্ঞানিক আর জীবতত্ত্ববিদ পণ্ডিত পরীক্ষা করে বলেছেন, ওটি যে একদা জীবন্ত কোনও জীবের মৃতদেহ, সে—বিষয়ে সন্দেহ করবার উপায় নেই। এটিও অর্ধ—মৎস্য আর অর্ধ—মানবীর দেহ। এর পরেও মৎস্যনারীকে আর কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে কি?’
বিমল বললে, ‘কিন্তু আমি আজ যে জীবটাকে দেখলুম, তার নীচের দিকটা জলের তলায় ঢাকা ছিল। আর তার মুখে ছিল একরাশ দাড়ি—গোঁফ। সে নারী নয়।’
কুমার বললে, ‘মৎস্যনারী যদি থাকে তবে মৎস্যনরও আছে!’
বিনয়বাবু বললেন, ‘হয়তো ও—জীবটা বানের টানে বা অন্য কোনও কারণে হঠাৎ ব্রহ্মপুত্রের জলে এসে পড়েছে। দিনের বেলায় গুহার ভিতরে লুকিয়ে থাকে, আর রাত্রে বেরিয়ে স্বদেশে ফিরতে না পেরে কেঁদে কেঁদে বেড়ায়!’
কিন্তু এর পরেও তার কান্না আর কেউ শুনতে পায়নি। তার কারণ কি বিমলের রিভলভার?