বিশ – পথের বাধা
কি দুর্গম পথ! কখনো প্রায় খাড়া উপরে উঠে গেছে, কখনো পাতালের দিকে নেমে গেছে, কখনো পাহাড়ের শিখরের চারিদিকে পাক খেয়ে, আবার কখনো বা ঘুটঘুটে অন্ধকার গুহার ভিতর দিয়ে পথটা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এ পথে নিশ্চয় লোক চলে না, কারণ পথের মাঝে মাঝে এমন সব কাঁটা—জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে যে কুড়ুল দিয়ে কেটে না পরিষ্কার করে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব। ঠাকুরদাদার পকেট—বইয়ে যদি পথের ঠিকানা ভালো করে না লেখা থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা এদিকে আসতে পারতুম না। পকেট—বইখানা এখন আমাদের কাছে নেই বটে, কিন্তু পথের বর্ণনা আমরা আলাদা কাগজে টুকে নিজেদের সঙ্গেই রেখেছিলুম।
পথটা খারাপ বলে আমরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতেও পারছিলুম না। বিশ মাইল পথ আমরা অনায়াসে একদিনেই পেরিয়ে যেতুম, কিন্তু এই পথটা পার হতে আমাদের ঠিক পাঁচ দিন লাগল।
কাল থেকে মনে হচ্চেচ, আমরা ছাড়া পৃথিবীতে যেন আর কোন মানুষ নেই। চারিদিক এত নির্জ্জন আর এত নিস্তব্ধ যে নিজেদের পায়ের শব্দে আমরা নিজেরাই থেকে থেকে চমকে উঠছি। মাঝে মাঝে বাঘা যেই ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে আর অমনি চারিধারে পাহাড়ে—পাহাড়ে এমন বিষম প্রতিধ্বনি জেগে উঠেছে যে আমার মনে হতে লাগল, পাহাড়ের শিখরগুলো যেন হঠাৎ আমাদের সাড়া পেয়ে কিচির—মিচির করে ডেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে উড়ে পালাচ্ছে—যেন এ পথে আর কখনো তারা মানুষকে হাঁটতে দেখেনি।
পাঁচ দিনের দিন, সন্ধ্যার কিছু আগে, খানিক তফাত থেকে আমাদের চোখের উপরে আচম্বিতে এক অপূর্ব্ব দৃশ্য ভেসে উঠল। সারি সারি মন্দিরের মতন কতকগুলো বাড়ি—সমস্ত যেন মিশ—কালো রঙে তুলি ডুবিয়ে, আগুনের মত রাঙা আকাশের পটে এঁকে রেখেছে। একটা উঁচু পাহাড়ের শিখরের উপরে মন্দিরগুলো গড়া হয়েছে। এই নিস্তব্ধতার রাজ্যের শিখরের উপরে মুকুটের মত সেই মন্দিরগুলোর দৃশ্য এমন আশ্চর্য্য—রকম গম্ভীর যে, বিস্ময়ে আর সম্ভ্রমে খানিকক্ষণ আমরা আর কথাই কইতে পারলুম না।
সকলের আগে কথা কইল বিমল। মহা আনন্দে সে চে�চিয়ে উঠল—”বৌদ্ধ মঠ।”
আমিও বলে উঠলুম—”যকের ধন।”
রামহরি বললে, ”আমাদের এত দিনের কষ্ট সার্থক হল।”
বাঘা আমাদের কথা বুঝতে পারলে না বটে, কিন্তু এটা সে অনায়াসে বুঝে নিলে যে, আমরা সকলেই খুব খুসি হয়েছি। সেও তখন আমাদের মুখের পানে চেয়ে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল।
আনন্দের প্রথম আবেগ কোন রকমে সামলে নিয়ে আবার তাড়াতাড়ি অগ্রসর হলুম। মঠ তখনো আমাদের কাছ থেকে প্রায় মাইলখানেক তফাতে ছিল আমরা প্রতিজ্ঞা করলুম, আজকেই ওখানে না গিয়ে কিছুতেই আর বিশ্রাম করব না।
সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমেই ঘন হয়ে উঠল। বিমল আমাদের আগে আগে যাচ্ছিল। আচমকা সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে—”সর্ব্বনাশ!”
আমি বললুম, ”কি হল বিমল?”
বিমল বললে, ”উঃ, মরতে মরতে ভয়ানক বেঁচে গেছি।”
—”কেন, কেন?”
—”খবর্দ্দার। আর এগিয়ো না, দাঁড়াও! এখানে পাহাড় ধ্বসে গেছে! আর পথ নেই!”
মাথায় যেন বজ্র ভেঙ্গে পড়ল—পথ নেই! বিমল বলে কি? সাবধানে দু—চার পা এগিয়ে যা দেখলুম, তাতে মন একেবারে দমে গেল। পথের মাঝখানকার একটা জায়গা ধ্বসে গিয়ে প্রায় পঞ্চাশ—ষাট ফুট গভীর এক ফাঁকের সৃষ্টি করেছে—ফাঁকের মুখটাও প্রায় সতেরো—আঠারো ফুট চওড়া! সেই ফাঁকের মধ্যেও নেমে যে পথের এদিক থেকে ওদিক গিয়ে উঠব, এমন কোন উপায়ও দেখলুম না। পথের দুপাশে যে খাড়া খাদ রয়েচে, তা এত গভীর যে দেখলেও মাথা ঘুরে যায়। একি বিড়ম্বনা, এতদিনের পরে, এত বিপদ এড়িয়ে যকের ধনের সামনে এসে, শেষটা কি এইখান থেকেই বিফল হয়ে ফিরে যেতে হবে?
আমার সর্ব্বাঙ্গ এলিয়ে এল, সেইখানেই আমি ধপ করে বসে পড়লুম।
খানিকক্ষণ পরে মুখ তুলে দেখলুম, ঠিক সেই ভাঙ্গা জায়গাটার ধারে একটা মস্ত উঁচু সরল গাছের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বিমল কি ভাবছে।
আমি বললুম, ”আর কি দেখচ ভাই, এখানে বসবে এস, আজ এখানেই রাতটা কোনরকমে কাটিয়ে কাল আবার বাড়ীর দিকে ফিরব।”
বিমল রাগ করে বললে, ”এত সহজেই যদি হাল ছেড়ে দেব, তবে মানুষ হয়ে জন্মেছি কেন?”
আমি বললুম, ”হাল ছাড়বো না তো কি করব বল? লাফিয়ে তো আর ফাঁকটা পার হতে পারব না, ডানাও নেই যে, উড়ে যাব।”
বিমল বললে, ”তোমাকে লাফাতেও হবে না, উড়তেও বলচি না। আমরা হেঁটেই যাব।”
আমি আশ্চর্য্য হয়ে বললুম, ”হেঁটে! শূন্য দিয়ে হেঁটে যাব কি—রকম?”
বিমল বললে, ”শোন বলচি। এই ফাঁকটার মাপ সতের—আঠারো ফুটের বেশী হবে না কেমন?”
—”হ্যাঁ।”
—”আচ্ছা, ভাঙা পথের ঠিক ধারেই যে সরল গাছটা রয়েছে, ওটা আন্দাজ কত ফুট উঁচু হবে বল দেখি?”
—”সতের—আঠারো ফুটের চেয়ে ঢের বেশী।”
—”বেশ, তাহলে আর ভাবনা কি? আমরা কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে গাছের গোড়াটা এমন ভাবে কাটব, যাতে করে পড়বার সময়ে গাছটা পথের ঐ ভাঙা অংশের ওপরেই গিয়ে পড়ে। তাহলে কি হবে বুঝতে পারছ তো?”
আমি আহ্লাদে এক লাফ মেরে বললুম, ”ওহো বুঝেচি! গাছটা ভাঙা জায়গার ওপর পড়লেই একটা পোলের মত হবে। তাহলেই আমরা তার ওপর দিয়ে ওপারে যেতে পারব। বিমল, তুমি হচ্ছ বুদ্ধির বৃহস্পতি। তোমার কাছে আমরা এক—একটি গরু বিশেষ।”
বিমল বললে, ”বুদ্ধি সকলেরই আছে, কিন্তু কাজের সময়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সকলেই সমানভাবে বুদ্ধিকে ব্যবহার করতে পারে না বলেই তো মুস্কিলে পড়তে হয়! যাক, আজ আমাদের এইখানে বিশ্রাম। কাল সকালে উঠেই আগে গাছটা কাটবার ব্যবস্থা হবে।”
একুশ – বাধার উপরে বাধা
গভীর রাত্রি। একটা ঝুঁকে—পড়া পাহাড়ের তলায় আমরা আশ্রয় নিয়েছি। আমাদের দু—দিকে পাহাড় আর দু—দিকে আগুন! বিমল আর রামহরি ঘুমোচ্ছে, আমিও কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি—কিন্তু ঘুমোই নি, কারণ এখন আমার পাহারা দেবার পালা।
চাঁদের আলোয় আজ আর তেমন জোর নেই; চারিদিকে আলো আর অন্ধকার যেন একসঙ্গে লুকোচুরি খেলছে!
হঠাৎ বৌদ্ধ মঠে যাবার পথের উপর দিয়ে শেয়ালের মত কি একটা জানোয়ার বার বার পিছনে তাকাতে তাকাতে তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল—দেখলেই মনে হয় সে যেন কোন কারণে ভয় পেয়েছে।
মনে কেমন সন্দেহ হল। পা থেকে মাথা পর্য্যন্ত কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলুম বটে, কিন্তু চোখের কাছে একটু ফাঁক রাখলুম,—আর বন্দুকটাও কাপড়ের ভিতরেই বেশ করে বাগিয়ে ধরলুম।
এক, দুই, তিন মিনিট। তার পরেই দেখলুম, পাহাড়ের আড়াল থেকে পথের উপরে একটা মানুষ বেরিয়ে এল…তারপর আর একজন…তারপর আরো একজন…তারপর একসঙ্গে দুইজন। সবশুদ্ধ পাঁচজন লোক।
আস্তে আস্তে চোরের মতন আমাদের দিকে তারা এগিয়ে আসছে! যদিও রাতের আবছায়ায় তফাত থেকে তাদের চিনতে পারলুম না—তবুও আন্দাজেই বুঝে নিলুম, তারা কারা!
সব—আগের লোকটা আমাদের অনেকটা কাছে এগিয়ে এল। আমাদের সামনেকার আগুনের আভা তার মুখের উপরে গিয়ে পড়তেই চিনলুম—সে করালী!
একটা নিষ্ঠুর আনন্দে বুকটা আমার নেচে উঠল। এই করালী! এরই জন্যে আমাদের কত বিপদে পড়তে হয়েছে, কতবার প্রাণ যেতে যেতে বেঁচে গেছে, এখনো এ আমাদের যমের বাড়ি পাঠাবার জন্যে তৈরি হয়ে আছে।
ধরি ধরি করেও কোন বারেও একে আমরা ধরতে পারিনি,—কিন্তু এবারে আর কিছুতেই এর ছাড়ান নেই।
বন্দুকটা তৈরি রেখে একেবারে মরার মত আড়ষ্ট হয়ে পড়ে রইলুম। করালী আরো কাছে এগিয়ে আসুক না,—তারপরেই তার সুখের স্বপ্ন জন্মের মত ভেঙে দেব!
পা টিপে—টিপে করালী ক্রমে আমাদের কাছ থেকে হাত—পনেরো—ষোল তফাতে এসে পড়ল—তার পিছনে পিছনে আর চারজন লোক।
আগুনের আভায় দেখলুম করালীর সেই কুৎসিত মুখখানা আজ রাক্ষসের মতই ভয়ানক হয়ে উঠেছে। তার ডান হাতে একখানা মস্ত—বড় চকচকে ছোরা, এখানা নিশ্চয়ই সে আমাদের বুকের উপরে বসাতে চায়, তার পিছনের লোকগুলোও প্রত্যেকের হাতে ছোরা, বর্শা বা তরোয়াল রয়েছে। এটা আমাদের খুব সৌভাগ্যের কথা যে, করালীরা কেউ বন্দুক যোগাড় করে আনতে পারেনি। তাদের সঙ্গে বন্দুক থাকলে এতদিন নিশ্চয় আমরা বেঁচে থাকতে পারতুম না।
করালী আমাদের আগুনের বেড়াটা পেরিয়ে আসবার উদ্যোগ করলে।
বুঝলাম, এই সময়। বিদ্যুতের মতন আমি লাফিয়ে উঠলুম—তারপর চোখের পলক ফেলবার আগেই বন্দুকটা তুলে দিলুম একেবারে ঘোড়াটি টিপে। গুড়ুম।
বিকট এক চীৎকার করে করালী মাথার উপর দু—হাত তুলে মাটির উপরে পড়ে গেল।
তার পিছনে লোকগুলো হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল—তাদের দিকেও আর একবার বন্দুক ছুঁড়তেই তারা প্রাণের ভয়ে পাগলের মত দৌড়ে পালাল!
কিন্তু বন্দুকের গুলি বোধ হয় করালীর গায়ে ঠিক জায়গায় লাগেনি, কারণ মাটির উপরে পড়েই সে চোখের নিমেষে উঠে দাঁড়াল—তারপর প্রাণপণে ছুটে অন্ধকারে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার দোনলা বন্দুকে আর টোটা ছিল না, কাজেই তাকে আর বাধা দিতেও পারলুম না।
কয়েক সেকেণ্ড পরেই ভীষণ এক আর্ত্তনাদে নিস্তব্ধ আকাশ যেন কেঁপে কেঁপে উঠল। তেমন আর্ত্তনাদ আমি জীবনে আর কখনো শুনিনি। তার পরেই আবার সব চুপচাপ।—ও আবার কি ব্যাপার?
মিনিট—খানেকের মধ্যেই এই ব্যাপারগুলো হয়ে গেল। ততক্ষণে গোলমালে বিমল, রামহরি আর বাঘাও জেগে উঠেছে।
বিমলকে তাড়াতাড়ি দু—কথায় সমস্ত বুঝিয়ে দিয়ে বললুম, ”কিন্তু ঐ আর্ত্তনাদ যে কেন হল বুঝতে পারচি না। আমার মনে হল একসঙ্গে যেন জনাতিনেক লোক চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল।”
বিমল সভয়ে বললে, ”কি ভয়ানক! নিশ্চয়ই অন্ধকারে দেখতে না পেয়ে তারা ভাঙা পথের সেই ফাঁকের মধ্যে পড়ে গেছে। তারা কেউ আর বেঁচে নেই।”
আমি বললুম, ”কিন্তু করালী ওদিকে যায় নি—সে এখনো বেঁচে আছে।”
রামহরি বললে, ”আহা, হতভাগাদের জন্যে আমার ভারি দুঃখ হচ্ছে, শেষটা অপঘাতে মরল।”
বিমল বললে, ”যেমন কর্ম্ম, তেমনি ফল—দুঃখ করে লাভ নেই! করালীর যদি শিক্ষা না হয়ে থাকে তবে তার কপালেও অপঘাতে মৃত্যু লেখা আছে।”
আমি বললুম, ”অন্ততঃ কিছুদিনের জন্যে আমরা নিশ্চয় করালীর দেখা পাব না। সে মরেনি বটে, কিন্তু রীতিমত জখম যে হয়েচে তাতে আর কোন সন্দেহ নেই।”
বিমল বললে, ”আর তিন দিন যদি বাধা না পাই, তা’হলে যকের ধন আমাদের মুঠোর ভিতরে এসে পড়বেই—এ আমি তোমাকে বলে দিলুম।”
আমি হেসে বললুম, ”তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।”
বাইশ – অলৌকিক কাণ্ড
সেই সকাল থেকে আমরা ভাঙা জায়গাটার ধারে গিয়ে, সরল গাছের গোড়ার উপর ক্রমাগত কুড়ুলের ঘা মারছি আর মারছি। এমন ভাবে আমরা গাছ কাটছি, যাতে করে পড়বার সময়ে সেটা ঠিক ভাঙা জায়গার উপরে গিয়ে পড়বে।
দুপুরের সময় গাছটা পড় পড় হল। আমরা খুব সাবধানে কাজ করতে লাগলুম কারণ আমাদের সমস্ত আশা—ভরসা এখন গাছটার উপরেই নির্ভর করচে—একটু এদিক—ওদিক হলেই সকলকে ধুলো—পায়েই বাড়ীর দিকে ফিরতে হবে।
…গাছটা পড়তে আর দেরি নেই, তার গোড়া মড় মড় করে উঠল।
বিমল বললে, ”আর গোটাকয়েক কোপ। ব্যাস, তাহলেই কেল্লা ফতে।”
টিপ করে ঠিক গোড়া ঘেঁষে মারলুম আরো বার—কয়েক কুড়ুলের ঘা।
বিমল বলে উঠল, ”হুঁসিয়ার। সরে দাঁড়াও, গাছটা পড়চে।”
আমি আর রামহরি একলাফে পাশে সরে দাঁড়ালুম।
মড় মড় মড়—মড়াৎ। গাছটা হুড়মুড় করে ভাঙা জায়গাটার দিকে ঢলে পড়ল।
বিমল বললে, ”ব্যাস। দেখ কুমার আমাদের পোল তৈরি।”
গাছটা ঠিক মাঝখানকার ফাঁকটার উপর দিয়ে পাহাড়ের ওধারে গিয়ে পড়েছে, তার গোড়া রইল এদিকে, আগা রইল ওদিকে। যা চেয়েছিলুম তাই।
আহার আর বিশ্রাম সেরে আমরা আবার বৌদ্ধ মঠের দিকে অগ্রসর হলুম। রোদ্দুরে পাহাড়ে—পথ তেতে আগুন হয়ে উঠেছিল, কিন্তু সে—সব কষ্ট আমরা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলুম না, মনে মনে দৃঢ়পণ করলুম যে আজ মঠে না গিয়ে কিছুতেই আর জিরেন নাই।
সূর্য্য অস্ত যায়—যায়। মঠও আর দূরে নেই। তার মেঘ—ছোঁয়া মন্দিরটার ভাঙা চূড়া আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে জেগে আছে। এদিকে—ওদিকে আরো কতকগুলো ছোট ছোট ভগ্নস্তূপও দূর থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
আরো খানিক এগিয়ে দেখলুম আমাদের দু—পাশে কারুকার্য্য করা অনেক গুহা রয়েছে। এই সব গুহায় আগে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বাস করতেন, এখন কিন্তু তাদের ভিতর জনপ্রাণীর সাড়া নেই।
গুহাগুলোর মাঝখান দিয়ে পথটা হঠাৎ একদিকে বেঁকে গেছে। সেই বাঁকের মুখে দাঁড়াতেই দেখলুম আমার সামনেই মঠের সিংদরজা।
আমরা সকলেই একসঙ্গে প্রচণ্ড উৎসাহে জয়ধ্বনি করে উঠলুম। বাঘা আসল কারণ না বুঝেও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে চ্যাঁচাতে লাগল, ঘেউ ঘেউ ঘেউ। অনেকদিন পর আবার পোড়ো মন্দিরটার চারিদিকে সরগরম হয়ে উঠল।
বিমল দু—হাত তুলে উচ্চৈচঃস্বরে বলে উঠল, ”যকের ধন! যকের ধন আজ আমাদের!”
আমি বললুম, ”চল, চল। আগে সেই জায়গাটা খুঁজে বার করি।”
সিংদরজার ভিতর দিয়ে আমরা মন্দিরের আঙিনায় গিয়ে পড়লুম। প্রকাণ্ড আঙিনা—চারিদিকে চকবন্দী ঘর, কিন্তু এখন আর তাদের কোন শ্রী ছাঁদ নেই। বুনো চারা গাছে আর জঙ্গলে পা ফেলে চলা দায়, এখানে—ওখানে ভাঙা পাথর ও নানারকম মূর্ত্তি পড়ে রয়েছে, স্থানে স্থানে জীবজন্তুর রাশি রাশি হাড়ও দেখলুম। বোধ হয় হিংস্র পশুরা এখন সন্ন্যাসীদের ঘরের ভিতরে আস্তানা গেড়ে বসেছে, বাইরে থেকে শিকার ধরে এখানে বসে বসে নিশ্চিন্ত ভাবে পেটের ক্ষুধা মিটিয়ে নেয়।
আমি বললুম, ”বিমল, মড়ার মাথাটা এইবার বার কর, সঙ্কেত দেখে পথ ঠিক করতে হবে।”
বিমল বললে, ”তার জন্যে ভাবনা কি, সঙ্কেতের কথাগুলো আমার মুখস্থই আছে।” এই বলে সে আউড়ে গেল : ”ভাঙ্গা দেউলের পিছনে সরল গাছ। মূলদেশ থেকে পূর্ব্বদিকে দশগজ এগিয়ে থামবে। ডাইনে আটগজ এগিয়ে বুদ্ধদেব। বামে ছয়গজ এগিয়ে তিনখানা পাথর। তার তলায় সাতহাত জমি খুঁড়লে পথ পাবে।র্”
আমি বললুম, ”তাহলে আগে আমাদের ভাঙা দেউল খুঁজে বার করতে হবে।”
বিমল বললে, ”খুঁজতে হবে কেন? দেউল বলতে এখনো নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছে ঐ প্রধান মন্দিরকে। ও মন্দিরটাও তো ভাঙা। আচ্ছা দেখাই যাক না।”
আমরা বড় মন্দিরের পিছনের দিকে গিয়ে উপস্থিত হলুম।
রামহরি বললে, ”বাহবা, ঠিক কথাই যে! মন্দিরের পিছনে ঐ যে সরল গাছ।”
তাই বটে। মন্দিরের পিছনে অনেকটা খোলা জায়গা, আর তার মধ্যে সরল গাছ আছে মাত্র একটি,—কিছু ভুল হবার সম্ভাবনা নেই।
চারিদিকে মাঝে মাঝে ছোট—বড় অনেকগুলো বুদ্ধদেবের মূর্ত্তি রয়েছে,—কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। ভাঙা, অভাঙা পাথরও পড়ে আছে অগুন্তি।
বিমল বললে, ”এরি মধ্যে কোন একটি মূর্ত্তির কাছে আমাদের যকের ধন আছে। আচ্ছা, সরল গাছ থেকে পূর্ব্বদিকে এই দশগজ এগিয়ে থামলুম। তারপর ডাইনে আটগজ,—হুঁ, এই যে বুদ্ধদেব। বাঁয়ে ছয় গজ—কুমার, দেখ দেখ, ঠিক তিনখানাই পাথর পরে পরে সাজানো রয়েচে। মড়ার মাথার সঙ্কেত তাহলে মিথ্যে নয়।”
আহ্লাদে বুক আমার দশখানা হয়ে উঠল—মনের আবেগ আর সহ্য করতে না পেরে আমি সেই পাথরগুলোর উপরে ধুপ করে বসে পড়লুম।
বিমল বললে,—”ওঠ—ওঠ। এখন দেখতে হবে, পাথরের তলায় সত্যি সত্যিই কিছু আছে কিনা।”
আমরা তিনজনে মিলে তখনি কোমর বেঁধে পাথর সরিয়ে মাটি খুঁড়তে লেগে গেলুম।
প্রায় হাত—সাতের খোঁড়ার পরেই কুড়ুলের মুখে কি—একটা শক্ত জিনিস ঠক ঠক করে লাগতে লাগল। মাটি সরিয়ে দেখা গেল, আর একখানা বড় পাথর।
অল্প চেষ্টাতেই পাথরখানা তুলে ফেলা গেল—সঙ্গে সঙ্গে দেখলুম গর্ত্তের মধ্যে সত্যসত্যই একটি বাঁধানো সুড়ঙ্গ—পথ রয়েছে।
আমাদের তখনকার মনের ভাব লেখায় খুলে বলা যাবে না। আমরা তিনজনেই আনন্দ—বিহ্বল হয়ে পরস্পরের মুখের পানে তাকিয়ে বসে রইলুম।
কিন্তু হঠাৎ একটা ব্যাপারে বুকটা আমার চমকে উঠল। গর্ত্তের ভিতর থেকে হু হু করে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে।
—”বিমল, দেখ—দেখ।”
বিমল সবিস্ময়ে গর্ত্তের দিকে তাকিয়ে থেকে বললে, ”তাই তো, একি কাণ্ড! এত দিনের বন্ধ গর্ত্তের ভেতর থেকে ধোঁয়া আসছে কেমন করে?”
তখন সন্ধ্যা হতে আর বিলম্ব নেই—পাহাড়ের অলিগলি ঝোপ—ঝাপের ধারে ধারে অন্ধকার জমতে সুরু হয়েছে, চারিদিকে এত স্তব্ধ যে পাখীদের সাড়া পর্য্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।
গর্ত্ত থেকে তখনো ধোঁয়া বেরুচ্ছে, আর কুণ্ডলী পাকিয়ে, ঘুরে ঘুরে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে!
বিমল আস্তে আস্তে বললে, ”সামনেই রাত্রি, আজ আর হাঙ্গামে কাজ নেই। কাল সকালে সব ব্যাপার বোঝা যাবে। এসো, গর্ত্তের মুখে আবার পাথর চাপিয়ে রাখা যাক।”
তেইশ – মরণের হাসি
মনটা কেমন দমে গেল। অতগুলো পাথর—চাপানো বন্ধ গর্ত্তের মধ্যে ধোঁয়া এল কেমন করে? আগুন না থাকলে ধোঁয়া হয় না, কিন্তু গর্ত্তের ভিতরে আগুনই বা কোত্থেকে আসবে? অনেক ভেবেও কিছু ঠিক করতে পারলুম না।
সে রাত্রে একটা ঘরের ভিতরে আমরা আশ্রয় নিলুম। খাওয়াদাওয়ার পর শোবার আগে বিমলকে আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ”হ্যাঁ হে, তুমি যকের কথায় বিশ্বাস কর?”
বিমল বললে, ”হ্যাঁ, শুনেছি যক একরকম প্রেতযোনি। তারা গুপ্তধন রক্ষা করে। কিন্তু যক আমি কখনো দেখিনি, কাজেই তার কথা আমি বিশ্বাসও করি না।”
আমি বললুম, ”তুমি ভগবানকে কখনও চোখে দেখনি, তবু ভগবানকে যখন বিশ্বাস কর, তখন যকের কথাতেও কর না কেন?”
বিমল বললে, ”হঠাৎ যকের কথা তোলবার কারণ কি, কুমার?”
—”কারণ আমার বিশ্বস ঐ গুপ্তধনের গর্ত্তের ভিতর ভুতুড়ে কিছু আছে নইলে—”
—”নইলে—টইলের কথা যেতে দাও। ভূত দানব যাই—ই থাক, কাল আমি গর্ত্তের মধ্যে ঢুকবই”—দৃঢ়স্বরে এই কথাগুলো বলেই বিমল শুয়ে পড়ে কম্বল মুড়ি দিলে।
আমার বুকের ছমছমানি কিন্তু গেল না! রামহরির কাছ ঘেঁষে বসে বললুম, ”আচ্ছা রামহরি, তুমি যক বিশ্বাস কর?”
—”করি ছোটবাবু।”
—”তোমার কি মনে হয় না রামহরি, যে ঐ গর্ত্তের ভেতরে যক আছে?”
—”যকই থাকুক আর রাক্ষসই থাকুক, খোকাবাবু যেখানে যাবে, আমিও সেখানে যাব।” এই বলে রামহরিও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।
যেমন মনিব, তেমনি চাকর। দুটিতে সমান গোঁয়ার। আমি নাচার হয়ে বসে বসে পাহারা দিতে লাগলুম।…
ভোরবেলায় উঠেই আমরা আবার যথাস্থানে গিয়ে হাজির। গর্ত্তের মুখ থেকে পাথরগুলো আবার সরিয়ে ফেলা হল। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করেও আজ কিন্তু ধোঁয়া দেখতে পাওয়া গেল না।
বিমল আশ্বস্ত হয়ে বললে, ”বোধ হয় অনেক কাল বন্ধ থাকার দরুন গর্ত্তের ভেতর বাষ্প—টাষ্প কিছু জমেছিল, তাকেই আমরা ধোঁয়া বলে ভ্রম করেছিলুম।”
বিমলের এই অনুমানে আমারও মন সায় দিল। নিশ্চিন্ত হয়ে বললুম, ”এখন আমাদের কি করা উচিত?”
বিমল বললে, ”সুড়ঙ্গের ভেতরে যাব, তারপর যকের ধন খুঁজে বার করব।…কুমার, রামহরি, তোমরা প্রত্যেকে এক—একটা ইলেকট্রিকের টচ্চর্চ নাও, কারণ সুড়ঙ্গের ভেতরটা নিশ্চয়ই অমাবস্যার রাতের মত অন্ধকার।” এই বলে সে প্রথমে বাঘাকে গর্ত্তের মধ্যে নামিয়ে দিলে, তারপর নিজেও নেমে পড়ল। আমরাও দুজনে তার অনুসরণ করলুম।
উঃ, সুড়ঙ্গের ভিতরে সত্যিই কি বিষম অন্ধকার। দু—চার পা এগিয়ে আমরা ভুলে গেলুম যে, বাইরে এখন সূর্য্যদেবের রাজ্য। ভাগ্যে এই ‘বিজলী—মশাল’ বা ইলেকট্রিক টচ্চর্চগুলো আমাদের সঙ্গে ছিল, নইলে এক পাও অগ্রসর হ’তে পারতুম না।
আমরা হেঁট হয়ে ক্রমেই ভিতরে প্রবেশ করছি, কারণ সুড়ঙ্গের ছাদ এত নীচু যে মাথা তোলবার কোন উপায় নেই।
আচম্বিতে পিছনে কিসের একটা শব্দ হল—সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকলেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম।
পিছনে ফিরে দেখলুম, সুড়ঙ্গের মুখের গর্ত্ত দিয়ে বাইরের যে আলোটুকু আসছিল, তা আর দেখা যাচ্ছে না।
আবার সেই রকম একটা শব্দ। তারপর আবার,—আবার—
আমি তাড়াতাড়ি ফের সুড়ঙ্গের মুখে ছুটে এলুম। যা দেখলুম, তাতে প্রাণ আমার উড়ে গেল।
সুড়ঙ্গের মুখ একেবারে বন্ধ।
বিমলও এসে ব্যাপারটা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ সবাই চুপচাপ, সকলের আগে কথা কইলে রামহরি।
সে বললে, ”কে এ কাজ করলে?”
বিমল পাগলের মতন গর্ত্তের মুখে ঠেলা মারতে লাগল; কিন্তু তার অসাধারণ শক্তিও আজ হার মানলে—গর্ত্তের মুখ একটু খুলল না।
আমি হতাশ ভাবে বললুম, ”বিমল, আর প্রাণের আশা ছেড়ে দাও, এখানেই জ্যান্তে আমাদের কবর হবে!”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই কাঁশির মত খনখনে গলায় হঠাৎ খিলখিল করে কে হেসে উঠল! সে কি ভীষণ বিশ্রী হাসি, আমার বুকের ভিতরটা যেন মড়ার মত ঠাণ্ডা হয়ে গেল!
হাসির আওয়াজ এল সুড়ঙ্গের ভিতর থেকেই! তিন জনেই বিজলী—মশাল তুলে ধরলুম, কিন্তু কারুকেই দেখতে পেলুম না।
বিমল বললে, ”কে হাসলে কুমার?”
আমি ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বললুম, ”যক, যক!”
সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই খিলখিল করে খনখনে হাসি!
মানুষে কখনও তেমন হাসতে পারে না। বাঘা পর্য্যন্ত অবাক হয়ে কান খাড়া করে সুড়ঙ্গের ভিতর দিকে চেয়ে রইল।
পাছে আবার সেই হাসি শুনতে হয়, তাই আমি দু—হাতে সজোরে দু—কান বন্ধ করে মাটির উপরে বসে পড়লুম।
চব্বিশ – ধনাগার
জীবনে এমন বুক—দমানো হাসি শুনিনি,—সে হাসি শুনলে কবরের ভেতরে মড়াও যেন চমকে জেগে শিউরে ওঠে।
সেই হাসির তরঙ্গে সমস্ত সুড়ঙ্গ যেন কাঁপতে লাগল।
আমার মনে হল বহুকাল পরে সুড়ঙ্গমধ্যে মানুষের গন্ধ পেয়ে যক আজ প্রাণের আনন্দে হাসতে সুরু করেছে; কত কাল অনাহারের পর আজ তার হাতের কাছে খোরাক গিয়ে আপনি উপস্থিত!
উপরে গর্ত্তের মুখ বন্ধ—ভিতরে এই কাণ্ড! এ জীবনে আর যে কখনো চন্দ্র—সূর্য্যের মুখ দেখতে পাব না, তাতে আর কোনও সন্দেহ নেই!
হাসির আওয়াজ ক্রমে দূরে গিয়ে ক্ষীণ হয়ে মিলিয়ে গেল—কেবল তার প্রতিধ্বনিটা সুড়ঙ্গের মধ্যে গমগম করতে লাগল!
আর কোন বাঙালীর ছেলে নিশ্চয়ই আমাদের মতন অবস্থায় কখনো পড়ে নি! আমরা যে এখনো পাগল হয়ে যাইনি এইটেই আশ্চর্য্য!
তিনজনে স্তম্ভিতের মত বসে বসে পরস্পরের মুখ চাওয়া—চাওয়ি করতে লাগলুম—কারুর মুখে আর বাক্য সরছে না।
বিমলের মুখে আজ এই প্রথম দুর্ভাবনার ছাপ দেখলুম। সে ভয় পেয়েছে কিনা বুঝতে পারলুম না, কিন্তু আমার মনে হল, আজ সে বিলক্ষণ দমে গিয়েছে! আর না দমে করে কি, এতেও যে দমবে না, নিশ্চয়ই সে মানুষ নয়!
প্রথম কথা কইলে রামহরি। আমাকে হাত ধরে টেনে তুলে বললে ”বাবু, আর এ—রকম করে বসে থাকলে কি হবে, একটা ব্যবস্থা করতে হবে তো?”
আমি বললুম, ”ব্যবস্থা আর করব ছাই! যতক্ষণ প্রাণটা আছে, নাচার হয়ে নিশ্বাস ফেলি এস!”
বিমল বললে, ”কিন্তু গর্ত্তের মুখ বন্ধ করল কে?”
আমি বললুম, ”যক!”
বিমল মুখ ভেঙিয়ে বললে, ”যকের নিকুচি করেচে! আমি ও—সব মানি না।”
—”না মেনে উপায় কি? ভেবে দেখ বিমল, যে গর্ত্তের কথা কাক—পক্ষী জানে না, সেই গর্ত্তেরই মুখ হঠাৎ এমন বন্ধ হয়ে গেল, কি করে?”
বিমল চিন্তিতের মতন বললে, ”হ্যাঁ, সেও একটা কথা বটে!”
—”মনে আছে তো, কাল এই গর্ত্তের ভিতর থেকে হু হু ক’রে ধোঁয়া বেরুচ্ছিল।”
—”মনে আছে।”
—”আর এই বিশ্রী হাসি!”
বিমল একেবারে চুপ!
হঠাৎ রামহরি চেঁচিয়ে উঠল—”খোকাবাবু, দেখ—দেখ!”
ও কী ব্যাপার! আমরা সকলেই স্পষ্ট দেখলুম, খানিক তফাতে সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে সোঁ ক’রে একটা আগুন চলে গেল।
আমি সরে এসে পাথর—চাপা গর্ত্তের মুখে পাগলের মতন ধাক্কা মারতে লাগলুম—কিন্তু গর্ত্তের মুখ একটুও খুলল না।
বিমল বললে, ”কুমার! বিজলী—মশালটা জ্বেলে আমার সঙ্গে এস। রামহরি, তুমি সকলের পিছনে থাকো! আমি দেখতে চাই, ও আগুনটা কিসের!”
আগুনটা তখন আর দেখা যাচ্ছিল না। বিমল বন্দুক বাগিয়ে ধরে এগিয়ে গেল, আমরাও তার পিছনে পিছনে চললুম। ভয়ে আমার বুকটা ঢিপঢিপ করতে লাগল।
খানিক দূরে গিয়েই সুড়ঙ্গটা আর একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে গিয়ে পড়েছে—সেইখানেই আগুনটা জ্বলে উঠেছিল!
সেইখানে দাঁড়িয়ে আমরা সতর্কভাবে চেয়ে দেখলুম।
হাত—কয়েক দূরে, মাটির উপরে কি যেন একটা পড়ে রয়েছে বলে মনে হল—বাঘা ছুটে সেইখানে চলে গেল!
বিজলী—মশালের আলোটা ভালো করে তার উপরে গিয়ে পড়তেই, বিমল বলে উঠল, ”ও যে দেখচি একটা মানুষের দেহের মত!”
রামহরি বললে, ”কিন্তু একটুও নড়চে না কেন?”
হঠাৎ আবার কে হেসে উঠল—হি—হি—হি—হি! কোথা থেকে কে যে সেই ভয়ানক হাসি হাসলে, আমরা কেউ তা দেখতে পেলুম না! সকলেই আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম—হাসির চোটে সমস্ত সুড়ঙ্গটা আবার তেমনি যেন থরথর করে কাঁপতে লাগল!
আমি আঁতকে চেঁচিয়ে বললুম, ”পালিয়ে এস বিমল, পালিয়ে এস—চল আমরা গর্ত্তের মুখে ফিরে যাই।”
কিন্তু বিমল আমার কথায় কান পাতলে না—সে সামনের দিকে ছুটে এগিয়ে গেল।
সুড়ঙ্গ আবার স্তব্ধ।
বিমল একেবারে সেই মানুষের দেহটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর হেঁট হয়ে তার গায়ে হাত দিয়েই বলে উঠল, ”কুমার, এ যে একটা মড়া!”
সুড়ঙ্গের মধ্যে মানুষের মৃতদেহ! আশ্চর্য্য!
বিমল আবার বললে, ”কুমার, এদিকে এসে এর মুখের ওপর ভালো করে আলোটা ধর তো!”
আর এগুতে আমার মন চাইছিল না, কিন্তু বাধ্য হয়ে বিমলের কাছে যেতে হল।
আলোটা ভালো করে ধরতেই বিমল উচ্চৈচঃস্বরে বলে উঠল—”কুমার, কুমার! এ যে শম্ভু!”
তাইতো, শম্ভুই তো বটে! চিত হয়ে তার দেহটা পড়ে রয়েছে, চোখদুটো ভিতর থেকে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে আর তার গলার কাছটায় প্রকাণ্ড একটা ক্ষত!
বিমল হেঁট হয়ে শম্ভুর গায়ে হাত দিয়ে বললে, ”কোন আশা নেই—অনেকক্ষণ মরে গেছে!”
আমি সেই ভয়ানক দৃশ্যের উপর থেকে আলোটা সরিয়ে নিয়ে বললুম, ”কিন্তু—কিন্তু শম্ভু এখানে এল কি করে?”
বিমল চমকে উঠে বললে, ”তাইতো, ও কথাটা তো এতক্ষণ আমার মাথায় ঢোকেনি—শম্ভু এই সুড়ঙ্গের সন্ধান পেলে কোত্থেকে?”
আমি বললুম, ”শম্ভু যখন এসেছে, তখন করালীও নিশ্চয় সুড়ঙ্গের কথা জানে।”
বিমল এক লাফ মেরে বলে উঠল—”কুমার, কুমার! আলোটা ভালো করে ধর— যকের ধন! যকের ধন কোথায় আছে, আগে তাই খুঁজে বার করতে হবে।”
চারিদিকে আলোটা বারকতক ঘোরাতে—ফেরাতেই দেখা গেল, সুড়ঙ্গের এক কোণে একটা দরজা রয়েছে!
বিমল ছুটে গিয়ে দরজাটা ঠেলে বললে, ”এই যে একটা ঘর! যকের ধন নিশ্চয়ই এর ভেতরে আছে।”