পনেরো – দুটো জ্বলন্ত চোখ
বিমলের গল্প শুনে আমার আঁতটা কেমন ছাঁৎ—ছাঁৎ করতে লাগল, গুহার বাইরে আর চাইতেই ভরসা হল না—কে জানে, সেখানে ঝোপঝাপের মধ্যে হয়তো কোন বিদকুটে চেহারা ওত পেতে বসে আছে!
আমার মুখের ভাব দেখে বিমল হেসে বলল, ”ওহে কুমার, তোমার ভয় করচে নাকি?”
—”তা একটু করচে বৈকি!”
—”এই না বললে, তুমি ভূত মান না?”
—”হুঁ, আগে মানতুম না, কিন্তু এখন আর মানি না বলে মনে হচ্ছে না!”
—”ভয় কি কুমার, আমার বিশ্বাস এ গল্পটার একবর্ণ সত্যি নয়, আগাগোড়া গাঁজাখুরি! ভূতের গল্পমাত্রই রূপকথা, পাছে লোক বিশ্বাস না করে, তাই তাকে সত্যি বলা হয়।”
কিন্তু তবু আমার মন মানল না, বিমলকে কিছুতেই আমার কাছছাড়া হতে দিলুম না। ভয়ের চোটে রামহরির রান্না রামপাখীর মিষ্টি মাংস পর্য্যন্ত তেমন তারিয়ে খেতে পারলুম না!
গুহার বাইরের দিকে বিমল অনেকগুলো সরল কাঠ ছড়িয়ে আগুন জ্বেলে বললে, ”কোন জীবজন্তু আর আগুন পেরিয়ে এদিকে আসতে পারবে না। তোমরা দুজনে এখন ঘুমোও—আমি জেগে পাহারা দি। আমার পর কুমারের পালা, তারপর রামহরির।”
ছাতকের ডাকবাংলোর সেই ব্যাপারের পর থেকে রোজ রাত্রেই আমরা এমনি করে পাহারা দি।
আমি আর রামহরি গায়ের কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লুম।
মাঝ রাত্রে বিমল আমাকে ঠেলে তুলে বললে, ”কুমার, এইবার তোমার পালা।”
শীতের রাত্রে লেপ ছাড়তে কি সাধ যায়—বিশেষ এই বনে—জঙ্গলে, পাহাড়ে—পর্ব্বতে! কিন্তু তবু উঠতে হল, কি করি, উপায় তো আর নেই!
গুহার সামনের আগুন নিবে আসছিল, আরো খানকতক কাঠ তাতে ফেলে দিয়ে, বন্দুকটা কোলের উপর রেখে দেয়াল ঘেঁষে বসলুম।
চাঁদ সেদিন মাঝ—রাত্রের আগেই অস্ত গিয়েছিল, বাইরে ঘুট—ঘুট করছে অন্ধকার! পাহাড়, বন, ঝোপঝাপ সমস্ত মুছে দিয়ে জেগে আছে খালি অন্ধকারের এক সীমাহীন দৃশ্য, আর তারই ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে ঝরনার অশান্ত ঝর্ঝর, শত শত গাছের একটানা শর—শর, লক্ষ লক্ষ ঝিঝির একঘেয়ে ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ—!
হঠাৎ আর—এক রকম শব্দ শুনলুম! ঠিক যেন অনেকগুলো আঁতুড়ের শিশু কাঁদছে, টেঁয়্যা—টেঁয়্যা—টেঁয়্যা!
আমার বুকটা ধড়ফড় করে উঠল, এতগুলো মানুষের শিশু এল কোত্থেকে? একে আজ বিশ্রী একটা ভূতের গল্প শুনেছি, তার উপরে গহন বনের এক থমথমে অন্ধকার রাত্রি, তার উপরে এই বেয়াড়া চীৎকার! মনের ভিতরে যত সব অসম্ভব কথা জেগে উঠল।
আবার সেই অদ্ভুত কাঁদুনি!
আমার মনে হল, এ অঞ্চলের যত ভূত—পেত্নী বাসা ছেড়ে চরতে বেরিয়ে গেছে, আর বাপ—মায়ের দেখা না পেয়ে ভুতুড়ে খোকারা একসঙ্গে কান্নার কনসার্ট জুড়ে দিয়েছে!
ভয়ে শিঁঠিয়ে ভাবছি—আর একটু কোণ ঘেঁষে বসা যাক, এমন সময়ে—ও কি ও!
গুহার বাইরে—অন্ধকার ভিতরে দু—দুটো জ্বলন্ত কয়লার মতন চোখ, একদৃষ্টিতে আমার পানে তাকিয়ে আছে!
বুক আমার উড়ে গেল—এ চোখদুটো যে ঠিক সেই শ্মশানের পিশাচের মত!…এখানেও পিশাচ নাকি?
ধীরে ধীরে চোখদুটো আরো কাছে এগিয়ে এসে আবার স্থির হয়ে রইল! আমার মনে হল, আঁধার—সমুদ্রে যেন আগুন—ভাঁটা ভাসছে।
আমি আর চুপ করে বসে থাকতে পারলুম না—ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বন্দুকটা কোনরকমে তুলে ধরে দিলুম তার ঘোড়া টিপে—গুড়ুম করে ভীষণ এক আওয়াজ হল,—সঙ্গে সঙ্গে জ্বলন্ত চোখদুটো গেল নিবে!
বন্দুকের শব্দে বিমল, রামহরি আর বাঘা একসঙ্গে জেগে উঠল, বিমল ব্যস্ত হয়ে বললে—”কুমার, কুমার, ব্যাপার কি?”
আমি বললুম, ”পিশাচ, পিশাচ!”
—”পিশাচ কি হে?”
—”হ্যাঁ, ভয়ানক একটা পিশাচ এসে দুটো জ্বলন্ত চোখ মেলে আমার পানে তাকিয়ে ছিল, আমি তাই বন্দুক ছুঁড়েচি!”
বিমল তখনি আমার হাত থেকে বন্দুকটা টেনে নিল। তারপর এক হাতে লণ্ঠন, আর এক হাতে বন্দুক নিয়ে আগুন টপকে গুহার বাইরে গিয়ে চারিদিকে তন্ন তন্ন করে দেখে এসে বললে, ”কোথাও কিছু নেই। ভূতের গল্প শুনে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে কুমার, তুমি ভুল দেখেচ!”
এমন সময় আবার সেই ভুতুড়ে খোকারা কোত্থেকে কেঁদে উঠল!
আমি মুখ শুকিয়ে বললুম, ”ঐ শোনো!”
—”কি?”
—”ভূতেদের খোকারা কাঁদচে; রামহরি, তুমিও শুনেচ তো?”
বিমল আর রামহরি দুজনেই একসঙ্গে হো হো করে হাসি সুরু করে দিলে! আমি রেগে বললুম, ”তোমরা হাসচ বড় যে? এ কি হাসির কথা?”
বিমল হাসতে হাসতে বললে, ”সহরের বাইরে কুমার তো কখনো পা দেও নি, সহর ছাড়া দুনিয়ার কিছুই জানো না—এখনো একটি আস্ত বুড়ো খোকা হয়ে আছো। যা শুনছ, তা ভূতদের খোকার কান্না নয়, বকের ছানার ডাক!”
—”বকের ছানার ডাক?”
—”হ্যাঁ গো হ্যাঁ! কাছেই কোন গাছে বকের বাসা আছে। বকের ছানার ডাক অনেকটা কচি ছেলের কান্নার মত।”
বেজায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলুম। কিন্তু সেই জ্বলন্ত চোখদুটো তো মিথ্যে নয়! বিমল যতই উড়িয়ে দিক, আমি স্বচক্ষে দেখেছি—আর ভুল যে দেখিনি, তা আমি দিব্যি গেলে বলতে পারি! কিন্তু আজ যে—রকম বোকা বনে গেছি, তাতে এদের কাছে সে ব্যাপার নিয়ে আপাততঃ কোন উচ্চবাচ্য না করাই ভালো!
ষোল – ‘পিশাচ’—রহস্য
পরের দিন সকালে উঠে দেখি আর এক মুস্কিল! রামহরির কম্প দিয়ে জ্বর এসেছে! কাজেই সেদিন আমাদের সেখানেই থেকে যেতে হল—জ্বর—গায়ে রামহরি তো আর পথ চলতে পারে না! ক্রমাগত পথ চলে চলে আমাদের শরীর বেশ কাহিল হয়ে পড়ছিল, কাজেই এই হঠাৎ—পাওয়া ছুটিটা নেহাত মন্দ লাগল না!
সেদিনও বিমল দুটো পাখী মেরে আনল, নিজের হাতেই আমরা রান্নার কাজটা সেরে নিলুম!
সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কালকের রাতের সেই ভূতুড়ে ব্যাপারটার কথা আবার মনে পড়ে গেল! বিমলের কাছে সে কথা তুলতে না তুলতেই সে হেসেই সব উড়িয়ে দিলে। আমি কিন্তু এত সহজেই মনটাকে হালকা করে ফেলতে পারলুম না—আমি যে স্বচক্ষে দেখেছি! ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, বাপরে!
সেদিনও সরল কাঠের আগুন জ্বেলে গুহার মুখটা আমরা বন্ধ করে দিলুম। আজ রামহরির অসুখ, কাজেই আমাদের দু’জনকেই পালা করে পাহারা দিতে হবে। আজও প্রথম রাতে পাহারার ভার নিলে বিমল নিজে!
যখন আমার পালা এল তখন গভীর রাত্রি। আজও চাঁদ ডুবে গেছে আর অন্ধকারের বুকের ভিতর থেকে নানা অস্ফুট ধ্বনির সঙ্গে সেই গাছের পাতার মর্ম্মরানি, ঝরনার ঝর্ঝরানি আর বকের ছানাদের কাতরানি শোনা যাচ্ছে।
গুহার মুখের আগুনটা কমে আসছে দেখে আমি কতকগুলো চ্যালা কাঠ তার ভিতরে ফেলে দিলুম। তারপরেই শুনলুম কেমন একটা শব্দ—গুহার বাইরে কে যেন খড়মড় করে শুকনো পাতা মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে।
কিন্তু প্রাণপণে তাকিয়েও সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে বিন্দু—বিসর্গ কিছুই দেখতে পেলুম না। শব্দটাও একটু পরে থেমে গেল।
কিন্তু আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল!
বাঘা মনের সুখে কুণ্ডলী পাকিয়ে, পেটের ভিতরে মুখ গুঁজে ঘুমোচ্ছিল, আমি তাকে জাগিয়ে দিলুম। বাঘা উঠে একটা হাই তুলে আর মাটির উপর একটা ডন দিয়ে নিয়ে, আমার পাশে এসে দুই থাবা পেতে বসল। এক হাতে তার গলাটা জড়িয়ে ধরে আমি অনেকটা আশ্বস্ত হলুম।
আবার সেই শব্দ। বাঘার দিকে চেয়ে দেখলুম, সেও দুই কান খাড়া করে ঘাড় বাঁকিয়ে শব্দটা শুনছে। তারপরেই সে এক লাফে গুহার মুখে গিয়ে পড়ল, কিন্তু আগুনের জন্য বাইরে যেতে না পেরে, সেইখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গরগর গরগর করতে লাগল।
তার গজরানিতে বিমলের ঘুম ভেঙ্গে গেল, উঠে বসে সে বললে, ”আজ আবার কি ব্যাপার! বাঘা অমন করচে কেন?”
আমি বললুম, ”বাইরে কিসের একটা শব্দ হচ্ছে, কে যেন চলে বেড়াচ্ছে।”
”সে কি কথা!”—বলেই বিমল এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে বন্দুকটা নিয়ে বাগিয়ে ধরলে।
শব্দটা তখন থেমে গেছে—কিন্তু ও কি ও! আবার যে সেই দুটো জ্বলন্ত চোখ অন্ধকারের ভিতর থেকে কটমট করে আমাদের পানে তাকিয়ে আছে!
বাঘা ঘেউ ঘেউ করে চেঁচিয়ে উঠল, আমিও বলে উঠলুম—”দেখ, বিমল দেখ!”
কিন্তু আমি বলবার আগেই বিমল দেখেছিল, সে মুখে কিছু বললে না, চোখদুটোর দিকে বন্দুকটা ফিরিয়ে একমনে টিপ করতে লাগল।
চোখদুটো আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছিল—হঠাৎ বিমল বন্দুকের ঘোড়া টিপে দিলে, সঙ্গে সঙ্গে ধুম করে শব্দ, আর একটা ভীষণ গর্জ্জন। তারপরেই সব চুপ, চোখদুটোও আর নাই।
বিমল আমার দিকে ফিরে বললে, ”ওই চোখদুটোই কাল তুমি দেখেছিলে?”
—”হ্যাঁ। এইবার তোমার বিশ্বাস হল তো?”
—”তা হয়েছে বটে, কিন্তু এ পিশাচের নয়, বাঘের চোখ!”
—”বাঘ?”
—”হ্যাঁ। বোধ হয় এতক্ষণে লীলাখেলা সাঙ্গ করেচে, তবু বলা যায় না, আজ রাত্রে আর বাইরে গিয়ে দেখে কাজ নেই—কি জানি একেবারে যদি না মরে থাকে—আহত বাঘ ভয়ানক জীব!”
পরদিন সকালে উঠে দেখলুম—বিমল যা বলেচে তাই! গুহার মুখ থেকে খানিক তফাতে, পাহাড়ের উপরে একটা মরা বাঘ পড়ে রয়েচে—আমরা মেপে দেখলুম—পাকা ছয় হাত লম্বা! বিমলের টিপ আশ্চর্য্য, বন্দুকের গুলি বাঘটার ঠিক কপালে গিয়ে লেগেছে!
সতেরো – মরণের মুখে
দিন—তিনেক পরে রামহরির অসুখ সেরে গেল, আমাদেরও যাত্রা আবার সুরু হল। আবার আমরা পাহাড়ের পথ ধরে অজানা রহস্যের দিকে এগিয়ে চললুম।
বিমল বললে, ”আমি একটু এগিয়ে যাই, আজকের খোরাক যোগাড় করতে হবে তো,—পাখী—টাকি কিছু মেলে কিনা দেখা যাক”—এই বলে সে বন্দুকটা কাঁধে নিয়ে হনহন করে এগিয়ে চলল, খানিক পরেই আঁকা—বাঁকা পথের উপরে আর তাকে দেখা গেল না—কেবল শুনতে পেলাম গলা ছেড়ে সে গান ধরেছে,—
”আগে চল, আগে চল ভাই।
পড়ে থাকা পিছে মরে থাকা মিছে
বেঁচে মরে কিবা ফল ভাই।”
ক্রমে সে গানের আওয়াজও আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।
রামহরির শরীর তখনো বেশ কাহিল হয়ে ছিল, সে তাড়াতাড়ি চলতে পারছিল না, কাজেই আমাকে বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে থাকতে হল।
সেদিন সকালের রোদটি আমার ভারি ভালো লাগছিল, মনে হচ্ছিল যেন সারা পাহাড়ের বুকের উপরে কে কাঁচা সোনার মত মিঠে হাসি ছড়িয়ে দিয়েছে। হরেক রকম পাখীর গানে চারিদিক মাত হয়ে আছে, গাছপালার উপরে সবুজের ঢেউ তুলে বাতাস বয়ে যাচ্ছে, আর এখানে—ওখানে আশেপাশে গোছা গোছা রঙিন বনফুল ফুটে, সোহাগে দুলে দুলে মাথা নেড়ে যেন বলছে—”আমাদের নিয়ে মালা গাঁথো, আমাদের আদর কর, আমাদের মনে রেখ—ভুলো না।”
কচি কচি ফুলগুলিকে দেখে মনে হল, এরা যেন বনদেবীর খোকা—খুকি। আমি বেছে বেছে অনেক ফুল তুললুম, কিন্তু কত আর তুলব—এত ফুল দুনিয়ার কোন ধনীর বাগানেও যে ধরবে না।
এমনি নানা জাতের ফুল এদেশের সব জায়গাতেই আছে। কিন্তু আমাদের স্বদেশ যে কত—বড় ফুলের দেশ, আমরা নিজেরাই সে খবর রাখি না। আমরা বোকার মত হাত গুটিয়ে বসে থাকি আর সেই সব ফুলের ভাণ্ডার দু—হাতে লুট করে নিয়ে যায় বিদেশী সাহেবরা। তারপর বড় সহরের বাজারে সেই সব ফুল চড়া দামে বিকিয়ে যায়—কেনে অবশ্য সাহেবরাই বেশী। এ থেকেই বেশ বুঝতে পারি, আমাদের ব্যবসা—বুদ্ধি তো নেই—ই—তারপরে সবচেয়ে যা লজ্জার কথা, স্বদেশের জিনিষকেও আমরা আদর করতে শিখিনি।
এই ভাবতে ভাবতে পথ চলছি, হঠাৎ রামহরি বলে উঠল, ”ছোটবাবু, দেখুন—দেখুন।”
আমি ফিরে বললুম, ”কি?”
রামহরি আঙুল দিয়ে মাটির দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে।
পথের উপরে একটা বন্দুক পড়ে রয়েছে। দেখেই চিনতে পারলুম, সে বিমলের বন্দুক।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলুম, পথের মাঝখানে বন্দুক ফেলে বিমল গেল কোথায়? সে তো বন্দুক ফেলে যাবার পাত্র নয়।
ব্যাপারটা সুবিধের নয়, একটা কিছু হয়েছেই। তারপর মুখ তুলেই দেখি, বাঘা একমনে একটা জায়গা শুঁকছে আর কেমন একটা কাতর কুঁই—কুঁই করছে।
এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখি, সেখানে খানিকটা রক্ত চাপ বেঁধে রয়েছে।
রামহরি প্রায় কেঁদে ফেলে বললে, ”খোকাবাবু নিশ্চয় কোন বিপদে পড়েচেন।”
আমি বললুম, ”হ্যাঁ, রামহরি, আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু কি বিপদ?”
রামহরি বললে, ”কি করে বলব ছোটবাবু, এখানে যে বাঘ—ভাল্লুক সবই আছে!”
আমি বললুম, ”বাঘে মানুষ খায় বটে কিন্তু ব্যাগ নিয়ে তো যায় না। বিমল বাঘের মুখে পড়েনি, তাহলে বন্দুকের সঙ্গে তার ব্যাগটাও এখানে পড়ে থাকত।”
—”তবে খোকাবাবু কোথায় গেলেন?” এই বলেই রামহরি চেঁচিয়ে বিমলকে ডাকবার উপক্রম করলে।
আমি তাড়াতাড়ি তাকে বাধা দিয়ে বললুম, ”চুপ, চুপ—চেঁচিও না, আমার বিশ্বাস বিমল শত্রুর হাতে পড়েছে, আর শত্রুরা কাছেই আছে। চ্যাঁচালে আমরাও এখনি বিপদে পড়ব।”
—”তাহলে উপায়?”
—”তুমি এইখানে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে বসে থাকো। বাঘাকেও ধ’রে রাখো, নইলে বাঘাও হয়তো চেঁচিয়ে আমাদের বিপদে ফেলবে। আমি আগে এদিক—ওদিক একবার দেখে আসি।”
বাঘার গলায় শিকলি বেঁধে রামহরি পথের পাশেই একটা ঝোপের আড়ালে গা—ঢাকা দিয়ে বসল।
প্রথমে কোন দিক দিয়ে যাব আমি তা বুঝতে পারলুম না। কিন্তু একটু পরেই দেখলুম খানিক তফাতে আরো রক্তের দাগ রয়েছে—আরো খানিক এগিয়ে দেখলুম রক্তের দাগ। তৃতীয় দাগের পরেই একটা ঝোপের পাশে খুব সরু পথ, সেই পথের উপরে একটা লম্বা দাগ—যেন কারা একটা মস্ত বড় মোট ধুলোর উপর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছে।
আমি সেই সরু পথ ধরলুম—সে পথেও মাঝে মাঝে রক্তের দাগ দেখে বুঝতে দেরি লাগল না যে, এই দিকে গেলেই বিমলের দেখা পাওয়া যাবে।
কিন্তু বিমল বেঁচে আছে কি? এ রক্ত কার? তাকে ধরে নিয়ে গেলই বা কারা? সে কি ডাকাতের হাতে পড়েচে?—কিন্তু এ সব কথার কোন উত্তর মিলল না।
আচম্বিতে আমার পা থেমে গেল—খুব কাছেই যেন কাদের গলা শোনা যাচ্ছে।
আমার হাতের বন্দুকটা একবার পরখ করে দেখলুম, তার দুটো ঘরেই টোটা ভরা আছে। তারপর ঝোপের পাশে পাশে শুঁড়ি মেরে খুব সন্তর্পণে সামনের দিকে অগ্রসর হলুম।
আর বেশী এগুতে হল না—সরু পথটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে অল্প খানিকটা খালি জমি, তার পরেই পাহাড়ে খাদ।…
যে দৃশ্য দেখলুম জীবনে তা ভুলব না। সেই খোলা জমির উপরে জনছয়েক লোক দাঁড়িয়ে আছে—তাদের একজনকে দেখেই চিনলুম, সে করালী।
আর একদিকে পাহাড়ের খাদের ধারেই একটা বড় গাছ হেলে পড়েছে এবং তারই তলায় পড়ে রয়েছে বিমলের দেহ। তার মাথা ও মুখ রক্তমাখা আর হাত ও কোমরে দড়ি বাঁধা। বিমলের উপরে হুমড়ি খেয়ে বসে আছে করালীর দলের আর একটা লোক।
শুনলুম করালী চেঁচিয়ে বলছে, ”বিমল, এখনো কথার জবাব দাও। তোমার ব্যাগের ভেতরে পকেট—বই নেই, সেখানা কোথায় আছে বল।”
কিন্তু বিমল কোন উত্তর দিল না।
বিমল চুপ।
করালী বললে, ”শম্ভু।”
যে লোকটা দড়ি ধরে ছিল, সে মুখ ফিরিয়ে বললে, ”আজ্ঞে।”
লোকটাকে চিনলুম, ছাতকের ডাক—বাংলোয় দেখেছিলুম।
করালী বললে, ”দেখ শম্ভু, আর এক মিনিটের মধ্যে বিমল যদি আমার কথার উত্তর না দেয়, তবে তুমি ওকে তুলে খাদের ভেতরে ছুঁড়ে ফেলে দিও।”
কয়েক সেকেণ্ড কেটে গেল, আমার বুকটা ধুকপুক করতে লাগল, কি যে করব কিছুই স্থির করতে পারলুম না।
করালী বললে, ”বিমল, এই শেষবার তোমাকে বলচি। যদি সাড়া না দাও, তবে তোমার কি হবে বুঝতে পারচ তো? একেবারে হাজার ফুট নীচে পড়ে তোমার দেহ গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যাবে, একটু চিহ্ন পর্য্যন্তও থাকবে না।”
বিমল তেমনি বোবার মতন রইল।
আর এ দৃশ্য সহ্য করা অসম্ভব। ঠিক করলুম করালী যা জানতে চায় আমিই তার সন্ধান দেব। কাজ নেই আর যকের ধনে, টাকার চেয়ে প্রাণ ঢের বড় জিনিষ। মন স্থির করে আমি উঠে দাঁড়ালুম।
করালী বললে, ”বিমল, এখনো তুমি চুপ করে আছ?”
এতক্ষণ পরে বিমল বললে, ”পকেট—বই পেলেই তো তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে?”
করালী বললে, ”নিশ্চয়।”
বিমল, ”ব্যাগের মধ্যে আমার একটা জামার ভেতর দিককার পকেট খুঁজলেই তুমি পকেট—বই পাবে।”
ব্যাগটা করালীর সামনেই পড়ে ছিল, সে তখনই তার ভিতরে হাত পুরে দিল। একটু চেষ্টার পরেই পকেট—বই বেরিয়ে পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে করালীর মুখে একটা পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠল।
কিন্তু এ হাসি দেখে এত বিপদেও আমার হাসি পেল। কারণ আমি জানি, পকেট—বই থেকে পথের ঠিকানার কথা বিমল আগেই মুছে দিয়েছে। এত বিপদেও বিমল ভয় পেয়ে বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেনি,—ধন্যি ছেলে যা—হোক!
বিমল বললে, ”তোমাদের মনের আশা তো পূর্ণ হল, এইবার আমাকে ছেড়ে দাও।”
করালী কর্কশ স্বরে বললে, ”হ্যাঁ, ছেড়ে দেব বৈ কি—শত্রুর শেষ রাখব না। শম্ভু, আর কেন, ছোঁড়াকে নিশ্চিন্তপুরে পাঠিয়ে দাও।”
বিমল চেঁচিয়ে বলে উঠল, ”করালী! সয়তান! তুমি—”
কিন্তু তার কথা শেষ হতে না হতেই শম্ভু বিমলকে ধরে হিড়হিড় করে টেনে খাদের ধারে নিয়ে গিয়ে একবারে ঠেলে ফেলে দিলে এবং চোখের পলক না যেতেই বিমলের দেহ ঝুপ করে নীচের দিকে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের উপরে একটা অন্ধকারের পর্দ্দা নেমে এল এবং মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যেতে যেতে আবার শুনলুম—করালীর সেই ভীষণ অট্টহাসি! তারপরেই আমি একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেলুম।
আঠারো – অবাক কাণ্ড
কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিলুম জানি না। যখন জ্ঞান হল, চোখ চেয়ে দেখলুম, রামহরি আমার মুখের উপরে হুমড়ি খেয়ে আছে। আমাকে চাইতে দেখে সে হাঁপ ছেড়ে বললে, ”কি ছোটবাবু, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে কেন?”
কেন যে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলুম, প্রথমটা আমার তা মনে পড়ল না—আমি আস্তে আস্তে উঠে বসলুম—বোকা বনে বোবার মত।
রামহরি বললে, ”তোমার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে আমার ভারী ভয় হল। বাঘাকে সেইখানেই বেঁধে রেখে তোমাকে খুঁজতে আমিই এই দিকে এলুম—”
এতক্ষণে আমার সব কথা মনে পড়ল—রামহরিকে বাধা দিয়ে পাগলের মত লাফিয়ে উঠে আমি বললুম—”রামহরি, রামহরি—আমিও ওদের খুন করব।”
রামহরি আশ্চর্য্য হয়ে বললে, ”কাদের খুন করবে ছোটবাবু, তুমি কী বলচ?”
আমার বন্দুকটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে আমি বললুম, ”যারা বিমলকে খাদে ফেলে দিয়েচে।”
—”খোকাবাবুকে খাদে ফেলে দিয়েচে! অ্যাঁ—অ্যাঁ,” রামহরি চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল!
আমি বললুম, ”এখন তোমার কান্না রাখো রামহরি! এখন আগে চাই প্রতিশোধ। নাও, ওঠ—বিমলের বন্দুকটা নিয়ে এই দিকে এস।”
আমি ঝোপ থেকে বেরিয়ে দাঁড়ালুম—ঠিক করলুম সামনে যাকে দেখব তাকেই গুলি করে মেরে ফেলব!
কিন্তু কেউ তো কোথাও নেই! খাদের পাশে খোলা জমি ধু ধু করছে—সেখানে জনপ্রাণী দেখতে পেলুম না।
রামহরি পিছন থেকে বললে, ”তুমি কাকে মারতে চাও ছোটবাবু?”
দাঁতে দাঁত ঘষে আমি বললুম, ”করালীকে! কিন্তু এর মধ্যেই দলবল নিয়ে সে কোথায় গেল?”
—”করালী”—স্তম্ভিত রামহরির মুখ দিয়ে আর কথা বেরুল না।
—”হ্যাঁ রামহরি, করালী। তারই হুকুমে বিমলকে ফেলে দিয়েচে।”
রামহরি কাঁদতে কাঁদতে বললে, ”কোনখানে খোকাবাবুকে ফেলে দিয়েচে?”
আমারও গলা কান্নায় বন্ধ হয়ে এল। কোন রকমে সামলে নিয়ে হতাশ ভাবে আমি বললুম, ”রামহরি, বিমলের খোঁজ নেওয়া আর মিছে। ঐখান থেকে হাত—পা বেঁধে তাকে খাদের ভেতরে ফেলে দিয়েচে! অত উঁচু থেকে ফেলে দিলে লোহাই গুঁড়ো হয়ে যায়, মানুষের দেহ তো সামান্য ব্যাপার। বিমলকে আর আমরা দেখতে পাব না!”
রামহরি মাথায় করাঘাত করে বললে, ”খোকাবাবু সঙ্গে না থাকলে কোন মুখে আবার মাঠাকরুণের কাছে গিয়ে দাঁড়াব? না, এ প্রাণ আমিও রাখব না। আমিও পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মরব।” এই বলে সে খাদের ধারে ছুটে গেল।
অনেক কষ্টে আমি তাকে থামিয়ে রাখলুম। তখন সে মাটির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।
যেখান থেকে বিমলকে নীচে ফেলে দিয়েচে, আমি সেখানে গিয়ে দাঁড়ালুম। তারপর ধারের দিকে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলুম, বিমলের দেহটা নজরে পড়ে কিনা!
নীচের দিকে তাকাতেই আমার মাথা ঘুরে গেল। উঃ, এমন গভীর খাদ জীবনে আমি কখনো দেখিনি—পাহাড়ের পিঠ খাড়া ভাবে নীচের দিকে কোথায় যে তলিয়ে গেছে তা নজরেই ঠেকে না। তলার দিকটা একেবারে ধোঁয়া ধোঁয়া অস্পষ্ট।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস আমার চোখে পড়ল। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে হাত পনেরো নীচেই পাহাড়ের খাড়া গায়ে একটা বুনো গাছের পুরু ঝোপ দেখা যাচ্ছে,—আর—আর সেই ঝোপের উপরে কি ও—টা?—ও যে মানুষের দেহের মত দেখতে!
প্রাণপণে চেঁচিয়ে বললুম, ”রামহরি, দেখবে এস।”
রামহরি তাড়াতাড়ি ছুটে এল, সঙ্গে সঙ্গে ঝোপের উপরে দেহটাও নড়ে উঠল।
আমি ডাকলুম, ”বিমল, বিমল!”
নীচ থেকে সাড়া এল, ”কুমার, এখনো আমি বেঁচে আছি ভাই।”
আবার আমি অজ্ঞানের মত হয়ে গেলুম—আনন্দের প্রচণ্ড আবেগে। রামহরি তো আমোদে আটখানা হয়ে নাচতে সুরু করলে।
অনেক কষ্ট আত্মসংবরণ করে আমি বললুম, ”রামহরি, অমন করে নাচলে তো চলবে না, আগে বিমলকে ওখান থেকে তুলে আনতে হবে যে!”
রামহরি তখনি নাচ বন্ধ করে, চোখ কপালে তুলে মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললে, ”তাই তো ছোটবাবু, ওখানে আমরা কি করে যাব, নামবার যে কোন উপায় নেই!”
উঁকি মেরে দেখলুম বিমলের কাছে যাওয়া অসম্ভব—পাহাড়ের গা বেয়ে মানুষ তো আর টিকটিকির মত নীচে নামতে পারে না! ওদিকে বিমল যেরকম বেকায়দায় হাজার হাজার ফুট নীচু খাদের তুচ্ছ একটা ঝোপের উপরে আটকে আছে—
এমন সময় নীচে থেকে বিমলের চীৎকার আমার ভাবনায় বাধা দিলে। শুনলুম বিমল চেঁচিয়ে বলছে, ”কুমার, শীগগির আমাকে তুলে নাও—আমি ক্রমেই নীচের দিকে সরে যাচ্ছি!”
তাড়াতাড়ি মুখ বাড়িয়ে আমি বললুম, ”কিন্তু কি করে তোমার কাছে যাব, বিমল?”
বিমল বললে, ”আমার ব্যাগের ভিতরে দড়ি আছে, সেই দড়ি আমার কাছে নামিয়ে দাও।”
—”কিন্তু তোমার হাত—পা বাঁধা, দড়ি ধরবে কেমন করে?”
—”কুমার, কেন মিছে সময় নষ্ট করচ, শীগগির দড়ি ঝুলিয়ে দাও।”
বিমলের ব্যাগটা সেইখানেই পড়েছিল—ভাগ্যে করালীরা সেটাও নিয়ে যায়নি। রামহরি তখনই তার ভিতর থেকে খানিকটা মোটা দড়ি বার করে আনলে।
জোর বাতাস বইছে, আর প্রতি দমকাতেই ঝোপটা দুলে দুলে উঠছে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিমলের দেহ নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে! কি ভয়ানক অবস্থা তার! আমার বুকটা ভয়ে ঢিপ ঢিপ করতে লাগল!
বিমল বললে, ”দড়িটা ঠিক আমার মুখের কাছে ঝুলিয়ে দাও। আমি দাঁত দিয়ে দড়িটা ভালো করে কামড়ে ধরার পর তোমরা দুজনে আমাকে ওপরে টেনে তুলো!”
আমি একবার সার্কাসে একজন সাহেবকে দাঁত দিয়ে আড়াই মণ ভারি মাল টেনে তুলতে দেখেছিলুম! জানি বিমলের গায়ে খুব জোর আছে, কিন্তু তার দাঁত কি এমন শক্ত হবে?
হঠাৎ বিষম একটা ঝোড়ো বাতাস এসে ঝোপের উপরে ধাক্কা মেরে বিমলের দেহকে আরো খানিকটা নীচের দিকে নামিয়ে দিলে—কোন রকমে দেহটাকে বাঁকিয়ে—চুরিয়ে বিমল একরকম আলগোছেই শূন্যে ঝুলতে লাগল। তার প্রাণের ভিতরটা তখন যে কি রকম করছিল, সেটা তার মড়ার মত সাদা মুখ দেখেই বেশ বুঝতে পারলুম। হাওয়ার আর একটা দমকা এলেই বিমলকে কেউ আর বাঁচাতে পারবে না।
তাড়াতাড়ি দড়ি ঝুলিয়ে দিলুম—একেবারে বিমলের মুখের উপরে। বিমল প্রাণপণে দড়িটা কামড়ে ধরলে।
আমি আর রামহরি দুজনে মিলে দড়ি ধরে টানতে লাগলুম—দেখতে দেখতে বিমলের দেহ পাহাড়ের ধারের কাছে উঠে এল; বিমলের মুখ তখন রক্তের মতন রাঙা হয়ে উঠেছে—সামান্য দাঁতের জোরের উপরেই আজ তার বাঁচন—মরণ নির্ভর করছে।
রামহরি বললে, ”ছোটবাবু, তুমি একবার একলা দড়িটা ধরে থাকতে পারবে? আমি তাহলে খোকাবাবুকে হাতে করে ওপরে তুলে নি।”
আমি বললুম, ”পারব।”
রামহরি দৌড়ে গিয়ে বিমলকে একেবারে পাহাড়ের উপরে নিরাপদ স্থানে তুলে ফেললে। তারপর তাকে নিজের বুকের ভিতর টেনে নিয়ে আনন্দের আবেগে কাঁদতে লাগল। আমি গিয়ে তার বাঁধন খুলে দিলুম।
আমি বললুম, ”বিমল, কি করে তুমি ওদের হাতে গিয়ে পড়লে।”
বিমল বললে, ”নিজের মনে গান গাইতে গাইতে আমি এগিয়ে যাচ্ছিলুম, ওরা বোধহয় পথের পাশে লুকিয়ে ছিল, হঠাৎ পিছন থেকে আমার মাথায় লাঠি মারে, আর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।”
আমি বললুম, ”তারপর যা হয়েছে, আমি সব দেখেচি। তোমাকে যে আবার ফিরে পাব, আমরা তা একবারও ভাবতে পারিনি।”
বিমল হেসে বললে, ”হ্যাঁ, এতক্ষণে নিশ্চয় আমি পরলোকে ভ্রমণ করতুম—কিন্তু ভাগ্যে ঠিক আমার পায়ের তলাতেই ঝোপটা ছিল! রাখে কৃষ্ণ মারে কে?”
আমি মিনতি স্বরে বললুম, ”বিমল, আর আমাদের যকের ধনে কাজ নেই—প্রাণ নিয়ে ভালোয় ভালোয় দেশে ফিরে যাই চল।”
বিমল বললে, ”তেমন কাপুরুষ আমি নই। তোমার ভয় হয়, তুমি যাও। আমি কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত না দেখে এখান থেকে কিছুতেই নড়ব না।”
উনিশ – গাছের ফাঁকে ফাঁড়া
আবার আমাদের চলা সুরু হয়েছে। এবারে আমরা প্রাণপণে এগিয়ে চলেছি। পিছনে যখন শত্রু লেগেছে তখন যত তাড়াতাড়ি গন্তব্য স্থানে গিয়ে পৌঁছান যায়, ততই মঙ্গল।
কত বন—জঙ্গল, কত ঝরনা, খাদ, কত পাহাড়ের চড়াই—উৎরাই পার হয়েই যে আমরা চলেছি, আর চলেছি, আর তার কোন ঠিকানা নাই। মাঝে মাঝে আমার মনে হতে লাগল, আমরা যেন চলবার জন্যেই জন্মেছি, আমরা যেন মৃত্যুর দিন পর্য্যন্ত খালি চলবই আর চলবই। দুপুর বেলায় পাহাড় যখন উনুনে পোড়ানো চাটুর মত বিষম তেতে ওঠে, কেবল সেই সময়টাতেই আমরা চলা থেকে রেহাই পেয়ে রেঁধে খেয়ে কিছুক্ষণ গড়িয়ে নি! রাত্রে জ্যোৎস্না না থাকলেও দায়ে পড়ে আমাদের বিশ্রাম করতে হয়। নইলে চলতে চলতে রোজ আমরা দেখি, আকাশে ঊষার রঙিন আভাস মস্ত এক ফাগের থালার মতন প্রথম সূর্য্যের উদয়, বনের পাখীর ডাকে সারা পৃথিবীর জাগরণ, সন্ধ্যার আভাসে মেঘে মেঘে রামধনুকের সাত—রঙা মেঘের তীরে সূর্য্যের বিদায়, তারপর পরীলোক থেকে উড়িয়ে—দেওয়া ফানুসের মত চাঁদের প্রকাশ। আবার, সেই চাঁদই কতদিন আমাদের চোখের সামনেই ক্রমে ম্লান হয়ে প্রভাতের সাড়া পেয়ে মিলিয়ে যায়,—ঠিক যেন স্বপ্নের মায়ার মতন।
কিন্তু করালীর আর দেখা নেই কেন? এতদিনে আবার তার সঙ্গে আমাদের দেখা হওয়া উচিত ছিল—কারণ এখন সে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে যে, পকেট—বইয়ে পথের কোন ঠিকানাই আর নেই! সে কি হতাশ হয়ে আমাদের পিছন ছেড়ে সরে পড়েছে, না আবার কোন দিন হঠাৎ আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে?
এমনি ভাবে দিন চলতে চলতে শেষ একদিন আমরা রূপনাথের গুহার সুমুখে এসে দাঁড়ালুম। এই রূপনাথের গুহা! শুনেছি, এই গুহার ভিতর দিয়ে অগ্রসর হলে সুদূর চীনদেশে গিয়ে হাজির হওয়া যায়। একবার এক চীন—সম্রাট নাকি এই পথ দিয়ে ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে এসেছিলেন। অবশ্য, এটা ইতিহাসের কথা নয়, প্রবাদেই এ কথা বলে। রূপনাথের গুহা বড় হোক আর ছোট হোক তাতে এসে যায় না, আর তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাবার দরকারও নেই। কিন্তু এখানে এসে আমরা আশ্বস্তির হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম—কেননা এতদিন আমরা এই গুহার উদ্দেশ্যেই আসছিলুম এবং এখানে পৌঁছে অন্ততঃ এইটুকু বুঝতে পারলুম যে, এইবারে আমরা পথের শেষ দেখতে পাব। কারণ যে জায়গায় যকের ধন আছে, এখান থেকে সে জায়গাটা খুবই কাছে—মাত্র দিন—তিনেকের পথ।
বিমল হাসিমুখে একটা গাছতলায় বসে গুনগুন করে গান গাইতে লাগল।
আমি তার পাশে গিয়ে বললুম, ”বিমল, এখনি অতটা স্ফূর্ত্তি ভালো নয়।”
বিমল ভুরু কুঁচকে বললে, ”কেন?”
—”মনে কর, বৌদ্ধ মঠে গিয়ে যদি আমরা দেখি যে, যকের ধন সেখানে নেই, —তাহলে।”
—”কেনই বা থাকবে না?”
—”যে সন্ন্যাসী আমার ঠাকুরদাদাকে মড়ার মাথা দিয়েছিল, সে যে বাজে কথা বলেনি তার প্রমাণ?”
—”না, আমার দৃঢ় বিশ্বাসি সন্ন্যাসী সত্য কথাই বলেচে। অকারণে মিছে কথা বলে তার কোন লাভ ছিল না তো!”
আমি আর কিছু বললুম না।
বিমল বললে, ”ও—সব বাজে ভাবনা ভেবে মাথা খারাপ কোরো না। আপাততঃ আজকের মত এখানে বসেই বিশ্রাম কর। তারপর কাল আবার আমরা বৌদ্ধ মঠের দিকে চলতে সুরু করব।”
সূর্য্য অস্ত গিয়েছে, তখনো সন্ধ্যা হতে দেরি আছে। পশ্চিমের আকাশে রঙের খেলা তখনো মিলিয়ে যায়নি,—দেখলে মনে হয়, কারা যেন মেঘের গায়ে নানা রঙের জলছবি মেরে দিয়ে গেছে!
সেদিন বাতাসটি আমার ভারি মিষ্টি লাগছিল! বিমল নিজের মনে গান গাইছে আর আমি চুপ করে বসে শুনছি—তার গান বাস্তবিকই শোনবার মত! এইভাবে খানিকক্ষণ কেটে গেল।
হঠাৎ সামনের জঙ্গলের দিকে আমার চোখ পড়লো! সঙ্গে সঙ্গে আমার সর্ব্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল!
আমি বেশ দেখলুম, একটা গাছের আড়াল থেকে করালীর কুৎসিত মুখখানা উঁকি মারছে। কুতকুতে চোখ দুটো তার গোখরো সাপের মত তীব্র হিংসায় ভরা। আমাদের সঙ্গে চোখাচোখি হবামাত্র মুখখানা বিদ্যুতের মত সাঁৎ করে সরে গেল।
আমি তাড়াতাড়ি বিমলের গা টিপলুম, বিমল চমকে গান থামিয়ে ফেললে!
চুপি চুপি আমি বললুম, ”করালী।”
বিমল এক লাফে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, ”কৈ?”
আমি সামনের জঙ্গলের গাছটার দিকে দেখিয়ে বললুম, ”ঐখানে।”
বিমল তখনি সেই দিকে যাবার উপক্রম করলে। কিন্তু আমি বাধা দিয়ে বললুম, ”না যেও না। হয়তো করালীর লোকেরাও ওখানে লুকিয়ে আছে। আচমকা বিপদে পড়তে পারো।”
বিমল বললে, ”ঠিক বলেচ! কিন্তু আমি যে আর থাকতে পারচি না, কুমার। আমার ইচ্ছে হচ্ছে, এখুনি ছুটে গিয়ে সয়তানের টুঁটি টিপে ধরি।”
আমি বললুম, ”না না, চল, আমরা এখান থেকে সরে পড়ি। করালী ভাবুক, আমরা ওদের দেখতে পাইনি। তারপরে ভেবে দেখা যাবে আমাদের কি করা উচিত।”
চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আমরা সেখান থেকে চলে এলুম। বেশ বুঝলুম, করালী যখন আমাদের এত কাছে কাছে, তখন কোন—না—কোন দিক দিয়ে একটা নূতন বিপদ আসতে আর বড় দেরি নেই! যকের ধনের কাছে এসেছি বলে আমাদের মনে যে আনন্দের উদয় হয়েছিল, করালীর আবির্ভাবে সেটা আবার কর্পূরের মতন উবে গেল। কী মুস্কিল, এই রাহুর গ্রাস থেকে কি কিছুতেই আমরা ছাড়ান পাব না?