পঞ্চম খণ্ড
০১. জমিদারীর কর্মভোগ
শ্রাবণের অপরাহ্ন। আজ এক সপ্তাহ ধরিয়া বৃষ্টির বিরাম নাই। দেওয়ানজি একটি ফ্ল্যানেলের কামিজ গায়ে দিয়া বসিয়া কাছারির কায করিতেছেন এবং খুক খুক করিয়া কাসিতেছেন। মাঝে মাঝে বাহিরের পানে চাহিয়া দেখিতেছেন। এখনও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতেছে। বড় জরুরী একটা সংবাদ আসিয়াছে–সেই জন্য দর্শনপ্রার্থী হইয়া অন্তঃপুরে বাবুর কাছে এত্তেলা পাঠাইয়াছিলেন। বাবু বলিয়াছেন, শীঘ্র কাছারিতে আসিতেছি। এক ঘণ্টা হইয়া গেল, কই এখনও ত বাবুর দেখা নাই।
একজন ঝি কাছারিবাড়ীর প্রাঙ্গণ দিয়া যাইতেছিল, দেওয়ানজি তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সে আসিলে জিজ্ঞাসা করিলেন–বাবু কোথায় ঝি?
অন্দরে।
কি করছেন?
বউরাণীর কাছে বসে আছেন।
কেমন আছেন বউরাণী এবেলা?
ভাল আছেন।
আচ্ছা–যা।
ঝি চলিয়া গেল।
একটু অন্ধকার হইয়া আসিয়াছিল। চশমার সাহায্যেও দেওয়ানজি কাগজে কালির রেখা আর স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছেন না। কলমটি তুলিয়া মনে মনে বাবুর বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন। অস্ফুটস্বরে বলিলেন, ক্রমে যে রকম স্ত্রৈণ হয়ে উঠছে–বিষয় সম্পত্তি রাখবে কি করে? তদারক অভাবেই যে সব নষ্ট হবে দেখছি! যে রকম শুনছি, দুটিতে জোটের পায়রার মত অষ্টপ্রহর এক সঙ্গে আছে। ব্রত করছেন না আমার মুণ্ড করছেন! স্ত্রীকে ছুতে বারণ–কিন্তু এ যে ছোঁয়ার বাবা! এর চেয়ে যে ছোঁয়া ভাল ছিল। স্ত্রী এখন জপতপ–স্ত্রীই এখন ছোকরার ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছে!
গুরু গুরু ধ্বনিতে আকাশে মেঘগর্জন হইল। অন্ধকার বাড়িয়া উঠিল। বনের মধ্যে দুই একটা ঝি ঝি পোকাও বাগিনী ভঁজিতে সুরু করিয়াছে। যুবকের এই দাম্পত্যলীলার কথা চিন্তা করিতে করিতে, দেওয়ানজির নিজ যৌবনের স্মৃতিও জাগিয়া উঠিল। বাবুর কথা ছাড়িয়া, তখন তিনি নিজ জীবনের মিষ্ট মিষ্ট পুরাতন টুকরাগুলি মনের মধ্যে উলট পালট করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ এইরূপে কাটিলে, একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ভৃত্যকে ডাকিলেন। বলিলেন–অন্দরমহলে বাবুমশায়ের কাছে খবর দে যে দেওয়ানজি আপনার অপেক্ষায় বসে আছেন।
যে আজ্ঞে। –বলিয়া ভৃত্য প্রস্থান করিল। ফিরিয়া আসিয়া সংবাদ দিল, বাবু শীঘ্ন আসিবেন।
ক্রমে সন্ধ্যা উপস্থিত হইল, তথাপি বাবুর দেখা নাই। দেওয়ানজির সম্মুখে এখন আলো জ্বলিতেছে। ঘড়ির পানে চাহিয়া দেখিলেন, প্রায় সাড়ে ছয়টা। সায়ংসন্ধ্যা করিবার সময় বহিয়া যায়–সুতরাং দেওয়ানজি উঠিলেন। একজন কর্মচারীকে বলিলেন–তুমি এইখানে বসে থাক। বাবু যদি আসেন ত বোলো আমি সন্ধ্যে–আহ্নিক সেরে রাত্রি আটটার মধ্যে ফিরে আসব।
যথাসময়ে ফিরিয়া দেওয়ানজি শুনিলেন বাবু এখনও বাহির হন নাই। একবার ভাবিলেন, তাহাকে কথাটা স্মরণ করাইবার জন্য পুনরায় তোক পাঠাইবেন। আবার ভাবিলেন, আটটা ত বাজিয়াছে, নয়টার সময় বাবু বৈঠকখানা বাড়ীতে শয়ন করিতে আসিবেন, সেই সময়ই সাক্ষাৎ হইবে। সুতরাং দেওয়ানজি সবুর করিলেন।
বাবুর আচরণে দেওয়ানজি আজ মনে মনে বিলক্ষণ বিরক্ত হইয়াছেন। ভাবিতেছেন, আমার ষাট বছর বয়স হইয়াছে–আমি আর কয়দিন? এখন হইতে সব দেখিয়া শুনিয়া না লইলে, বিষয় কেমন করিয়া রক্ষা হইবে? আমার অবর্তমানে অন্য দেওয়ান নিযুক্ত হইবে–কিন্তু সে কি আমার মত প্রাণ দিয়া মনিবের স্বার্থরক্ষা করিবে? কর্তার এরূপ অমনোযোগ পাইলে সে ত দুই হাতে লুটিবে।
বাবুর মন বিষয়কার্যের দিকে আকৃষ্ট করিবার জন্য কি উপায় অবলম্বন করা যাইতে পারে, তাহাই দেওয়ানজি এখন মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলেন। জলে না পড়িলে লোকে সাঁতার শিখে না। অতএব তিনি স্থির করিলেন, নিজে দিনকতকের জন্য কোনও অছিলায় সরিয়া যাইবেন। বিষয়ের সমস্ত বোঝাটি নিজের মাথায় পড়িলে, তখন নিশ্চয়ই বাবুর চেতনা হইবে।
রাত্রি নয়টার পর লণ্ঠনবাহী ভৃত্যের পশ্চাতে অন্তঃপুর হইতে রাখাল ছাতা মাথায় দিয়া বাহির হইল। তখন আবার বৃষ্টি পড়িতেছিল। বৈঠকখানার বারান্দায় বেঞ্চির উপর দেওয়ানজি বসিয়া ছিলেন, বাবুর আগমনে তিনি দাঁড়াইয়া উঠিলেন।
রাখাল বলিল, কাকা–এখনও বাড়ী যান নি?
ক্রোধ ও বিরক্তির ভাব যথাসাধ্য দমন করিয়া নরম সুরে দেওয়ানজি বলিলেন, না বাবা–একটু জরুরী কায় ছিল তাই।
রাখাল বলিল, ওহো–আপনি আমায় বিকেলে একবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন–নয় কাকা?
হ্যা বাবা–প্রথম একবার চারটের সময় বলে পাঠিয়েছিলাম–তুমি বলেছিলে শীগগির আসছি। সাড়ে পাঁচটা অবধি অপেক্ষা করে–তোমায় মনে করিয়ে দেবার জন্যে আবার একবার লোক পাঠিয়েছিলাম।
রাখাল বলিল, ঠিক ঠিক। ভারি অন্যায় হয়ে গেছে–ও কথাটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। আমায় মাফ করুন কাকা। আপনার ভারি কষ্ট হয়েছে।
দেওয়ানজির মন এবার যথার্থই নরম হইল। বলিলেন–না বাবা–কষ্ট আর কি?
রাখাল বলিল, এই শ্রাবণ মাসের রাত্রি–অন্ধকার ঘুট ঘুট্ করছে, বৃষ্টি পড়ছে। এত রাত্রে জলকাদায় আপনাকে বাড়ী যেতে হবে। সন্ধ্যার আগেই বাড়ী গেলেন না কেন? বড় কি জরুরী কায ছিল?
হ্যা বাবা–বিশেষ জরুরী কায।
আচ্ছা তবে উপরে আসুন। সেখানেই শুনব। –বলিয়া রাখাল সিঁড়ি দিয়া উঠিতে আরম্ভ করিল।
দেওয়ানজি পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে যাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, বউরাণী এখন কেমন আছেন?
কথাটা শুনিয়া রাখাল একটু লজ্জানুভব করিল। বুঝিল আমি যে বউরাণীকে লইয়া মত্ত হইয়া পড়িয়াছি–কর্তব্যের অবহেলার কারণ যে বউরাণীই–তাহা বুড়া ধরিয়া ফেলিয়াছে। উত্তর করিল–দিনের বেলায় ত ভাল ছিলেন। বিকেল থেকে গা–টা আবার গরম হচ্ছে। এই এখন উত্তাপ দেখে এলাম–১০১ উঠেছে।
দেওয়ানজি বলিলেন, ও আর বেশী কি? ভারি বর্ষাটা পড়েছে–জোলো হাওয়ায় এসময় একটু আধটু জ্বরজাড়ি হয়েই থাকে। তার জন্যে কিছু ভাবনা নেই।
রাখাল নীরবে উঠিয়া নিজ শয়নকক্ষে উপনীত হইল। একটা চেয়ারে বসিয়া ভৃত্যকে বলিল–শুকনো তোয়ালে দিয়ে আমার পা বেশ করে মুছে দে। –দেওয়ানজিকে বলিল–বসুন কাকা। ব্যাপার কি বলুন।
দেওয়ানজি উপবেশন করিয়া বলিলেন, আজ সদর থেকে মতিবাবু পেস্কার চিঠি লিখেছেন যে পরশু তারিখে কালেক্টরসাহেব মির্জাহাটের ডাকবাঙ্গলায় এসে পৌঁছবেন, সেখানে তিনদিন থাকবেন।
রাখাল বলিল, এই ঘোর বর্ষায় সাহেব সফরে বেরিয়েছেন?
মির্জাহাটের কাছেই একটা বড় জলা আছে, সেখানে সাহেব পাখী শিকার করবেন–পেস্কার লিখেছেন। গত বৎসরও এসেছিলেন। আমাদের এলাকায় আসছেন, ভাল রকম অভ্যর্থনা করতে হবে ত? –জেলার মালিক–যে সে হাকিম ত নয়!
রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, ডালি–টালি দিতে হবে বোধ হয়?
ডালি ত দিতে হবেই। সে বন্দোবস্ত করেছি। তোমায় জিজ্ঞাসা না করেই, হরিচরণকে বিকেলে কলকাতা রওয়ানা করে দিয়েছি। এ সকল বিষয়ে সে ভারি হুঁসিয়ার। উইলসনের হোটেল থেকে খাবার জিনিষপত্র, দুবোতল শ্যাম্পেন, আধ ডজন হুইস্কি–আরও সব কি কি–আমাদের পাকা ফর্দই তৈরি করা আছে–সেই অনুসারে সব জিনিষ কিনে, কাল সন্ধ্যের গাড়ীতে হরিচরণ কলকাতা থেকে সোজা একেবারে মির্জাহাট রওনা হবে।
রাখাল বলিল, মির্জাহাটে আমাদের কাছারি-টাছারি আছে?
দেওয়ানজি ভাবিলেন, প্রায় তিনমাস আসিয়াছেন–এখনও কোথায় আমাদের কোন কাছারি আছে অবগত নহেন। এমনি করিয়াই কি জমিদারী চলিবে? প্রকাশ্যে বলিলেন–না, মির্জাহাটে আমাদের কাছারি নেই; তবে সেখান থেকে দেড় ক্রোশ অন্তরে ভদ্রকালী বলে একটা গ্রাম আছে, সেখানে আমাদের বেশ ভাল কাছারিই আছে। ও অঞ্চলে ঐটাই আমাদের প্রধান কাছারি। বেশ দোতলা বাড়ী। ছেলেবেলায় তুমি কৰ্ত্তামশায়ের সঙ্গে দুএকবার গিয়েছিলে, বোধ হয় স্মরণ নেই।
রাখাল মনে মনে হাসিয়া বলিল, কই মনে পড়ে না।
দেওয়ানজি বলিলেন, সেখানকার নায়েবের নামেও পরোয়ানা পাঠিয়েছি। সাহেবের। জন্যে, মুর্গী, ডিম, ঘি, দুধ, মাছ, শাকসজী এই সব যোগাড় করে রাখবে।
রাখাল বলিল, তবে ত সব বন্দোবস্তই হয়ে গেছে।
দেওয়ানজি বলিলেন, হ্যাঁ। কিন্তু একটা কথা ভাবছি। নায়েবের উপর ভর দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা কি ঠিক?
রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, আপনি নিজে যাবেন? সে হলে ত ভালই হয়।
দেওয়ানজি ধীরে ধীরে বলিলেন, আমি–নিজে অবশ্য যেতে পারি। কিন্তু তুমি গেলেই ভাল হয় বাবা।
রাখাল বলিল, আমি? আমি এখন কি করে–
দেওয়ানজি বলিলেন, বউরাণী এখন ত ক্রমেই ভাল হয়ে উঠছেন। ঐ সামান্য জ্বরটুকু কবিরাজ দুদিনেই ভাল করে দেবে এখন। আমি রইলাম, সৰ্ব্বদাই খবর নেব। তোমার না যাওয়াটা ভাল দেখায় না বাবা।
রাখাল নীরব হইয়া বসিয়া রহিল। ইতিমধ্যে ভৃত্য পা মুছাইয়া তাহাকে শুষ্ক চটিজুতা পরাইয়া দিয়াছিল।
দেওয়ানজি, বাবুর মনের ভাব বুঝিয়া বলিলেন, এ সময় তোমায় যেতে বলতাম। কিন্তু একে ত এসে অবধি তুমি কালেক্টর সাহেবের সঙ্গে দেখা করনি। তার উপর তোমার এলাকায় তিনি আসছেন, তুমি স্বয়ং গিয়ে তার অভ্যর্থনা করবে না–এতে সাহেব হয়ত মনে মনে চটে যাবেন। হাকিমের মেজাজ, বলা ত যায় না।
ভাবিয়া চিন্তিয়া রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, আমায় কি করতে হবে?
দেওয়ানজি বলিলেন, বেশী কিছু নয়। তুমি কাল আহারাদির পর পাল্কীতে রওনা হয়ে ভদ্রকালী কাছারিতে যাও। সন্ধ্যে নাগাদ পৌঁছে যাবে এখন। হরিচরণও ডালি নিয়ে রাত দুপুরে সেখানে পৌঁছবে। মুর্গী–টুর্গী, ঘি–দুধ, শাক–সজীগুলো, আর ডালির জিনিষপত্র সকালবেলাই নায়েবের সঙ্গে রওনা করে দিও। তারা ডাকবাঙ্গলায় গিয়ে বসে থাকবে। বেলা ৮টা ৯টার আগে সাহেব পৌঁছবেন না। সাহেব পৌঁছলে, ঘি–দুধ, শাক–সজীগুলো নায়েব গিয়ে সাহেবের খানসামাকে দেবে এখন। কলকাতার ডালিটে রেখে দেবে। একজন ঘোড়সওয়ার সেখানে হাজির থাকবে–এদিকে কাছারিতে তোমার পাল্কী বেহারা প্রস্তুত রাখবে। সাহেব এসে ডাকবাঙ্গলায় পৌঁছলেই ঘোড়সওয়ার ছুটে এসে তোমায় খবর দেবে। তুমি পাল্কীতে বেরিয়ে পোড়। সাহেবের কাছে নিজের কার্ড পাঠিয়ে দিও। দিলেই সাহেব তোমায় ডেকে পাঠাবেন–শেহ্যাণ্ড করে চেয়ারে বসাবেন। হুজুর কেমন আছেন, মেমসাহেব কেমন আছেন, তিনি এলেন না কেন, পথে হুজুরের কোনও কষ্ট হয়নি ত–এই সব তাকে জিজ্ঞাসা করবে।
রাখাল বলিল, বাঙ্গলায়?
দেওয়ানজি বলিলেন, না–না–ইংরেজিতেই বলবে। ওটা ভুলে যাচ্ছিলাম। কৰ্ত্তামশায় বাঙ্গলাতেই ঐ রকম করে বলতেন কিনা, তাই আমার মাথায় ঘুরছিল। তুমি ইংরেজিতেই বলবে। ইংরেজিতে আর হুজুর বলতে হবে না। দুচারবার বা ইওর অনার বললে–দু একবার বা সার বললে। ইওর অনারটাই বেশী। এসব হয়ে গেলে তখন বলবে, হুজুরের সেবার জন্যে কিঞ্চিৎ মুর্গী, ডিম, শাক–সজী পূর্বেই পাঠিয়েছিলাম–আমার কর্মচারীরা সে সব খানসামার জিম্মা করে দিয়েছে। আর হুজুরের জন্যে যৎসামান্য একটি ডালি নিয়ে এসেছি, এইটি গ্রহণ করলে কৃতার্থ হই। হরিচরণকে ইসারা করবে, সে ঢুকে ডালিটি সাহেবের সম্মুখে রেখে দেবে।
রাখাল বলিল, বাবা!–এত কাণ্ড করতে হবে? কৰ্ম্মভোগও কম নয়!
ঈষৎ হাসিয়া দেওয়ানজি বলিলেন, তা কি আর আমি বুঝিনে বাবা? কিন্তু কি করবে? –হাকিমেরা হলেন কলির দেবতা তাদের পূজা স্তব না করলে কি রক্ষে আছে?
রাখাল একটু চিন্তা করিয়া বলিল, তারপর–পূজো করে আমি এখানে ফিরে আসতে পারব ত?
দেওয়ানজি বলিলেন, না–সেটা ভাল দেখায় না। তিনদিন সাহেব থাকবেন, রোজ সকালে একবার করে গিয়ে দেখাটা করা উচিত।
কি বলব রোজ রোজ?
দেখা করে বলবে, হুজুরের কোনও কষ্ট হচ্ছে না ত? কোনও বিষয়ের অসুবিধে হয় ত বলুন, আমি বন্দোবস্ত করি। এই রকম দুটো চারটে শিষ্টাচারের কথা বলে চলে আসবে। একটু খোসামোদ করা আর কি!
অগত্যা রাখাল সম্মত হইল। বলিল–আচ্ছা, আমার যাওয়াটা নিতান্তই দরকার যখন আপনি বলছেন–তখন যেতেই হবে। সব বন্দোবস্ত করে দিন।
রাত্রি হইয়াছিল, দুই চারিটা কথায় পর দেওয়ানজি বিদায় লইলেন। রাখাল শুইয়া অন্ধকারের মধ্যে ভাবিতে লাগিল, আড়াই মাস এসেছি, এখনও একদিনের জন্যেও ছাড়াছাড়ি হইনি। তাকে না দেখে, এ তিনদিন কেমন করে বাঁচব?
বউরাণীর রোগাপাণ্ডুর মুখখানি মনে করিয়া, ভাবী বিরহের যন্ত্রণা রাখালের আরও বাড়িয়া গেল। অস্ফুটস্বরে সে বলিল, যদি একখানা মোটরকার থাকত, তাহলে এ কষ্টটি পেতে হত না। রোজ ভোরে উঠে বোঁ করে বেরিয়ে যেতাম। খোসামোদ বরামদ উঞ্ছবৃত্তি যা করবার করে, বেলা দুপুর নাগাদ আবার বাড়ী ফিরে আসতাম। এখন, এ তিনদিন সে ভাল থাকলে বাঁচি।
০২. ঘাত-প্রতিঘাত
পরদিন প্রাতে উঠিয়া অন্তঃপুর হইতে সংবাদ আনাইয়া রাখাল জানিল, বউরাণী একটু ভাল আছেন।
স্নানাদি সমাপন করিয়া, বেলা আটটার সময় রাখাল অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল। বউরাণীর কক্ষের দ্বারের নিকট গিয়া দেখিল, দুইটি স্ত্রীলোক তাহার শয্যাপার্শ্বে বসিয়া আছে, রাখালকে দেখিয়া তাহারা সরিয়া গেল।
প্রবেশ করিয়া রাখাল দেখিল, তিনটি বালিস উপর্যুপরি রাখা, তাহাতে হেলান দিয়া বউরাণী বসিয়া আছে। রাখালকে দেখিয়া তিনি মাথায় কাপড় টানিয়া দিলেন।
শয্যার নিকট চেয়ারে বসিয়া রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, এখন কেমন আছ ইন্দু?
ক্ষীণস্বরে বউরাণী বলিলেন, ভাল আছি।
গা এখন গরম নেই ত?
পাণ্ডুবর্ণ ওষ্ঠাযুগল ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া বউরাণী উত্তর করিলেন, আমি কি জানি? গা জানে।
রাখাল তাহার মনোভাব বুঝিল। বউরাণীকে সে স্পর্শ করিল না, তাহার ললাটে অথবা হস্তে হস্ত রাখিয়া উত্তাপ পরীক্ষা না করিয়া মৌখিক প্রশ্ন করিল, তাই তাঁহার অভিমান। বিষাদপূর্ণ নেত্রে একবার বউরাণীর পানে চাহিয়া, পরক্ষণেই দৃষ্টি আনত করিয়া রাখাল ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিল। বলিল–তুমি ত জান ইন্দু!
আমি কি জানি?
জান ত–আমার দুর্ভাগ্য কি। রাখালের কণ্ঠস্বর অশ্রুবাষ্পে আপ্রায়।
বউরাণীও একটি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিলেন। তাহার পর চেষ্টাকৃত হাসির সহিত বলিলেন–না–না তুমি রাগ কোরো না। আমি তামাসা করে বলেছি বই ত নয়। দুর্ভাগ্য কেন? যে ব্রত ধারণ করেছ, সে ব্রত পালন করার মত শক্তি সংযম তোমার আছে, সে কি দুর্ভাগ্য–আমার গা এখন বেশ আছে। গরম নেই।
ঔষধ পথ্যাদির কথা, কবিরাজের কথা প্রভৃতির পর বউরাণী বলিলেন, তুমি এখনও মুখখানি অমন বিষণ্ণ করে রয়েছ কেন? আমি ঐ কথা বলেছি বলে?
রাখাল বলিল, না।
তবে তুমি কি ভাবছ?
রাখাল বলিল, দেখ ইন্দু, তুমি আজ ঐ কথা বলেছ বলেই যে আমার মন বিষণ্ণ হয়েছে, তা নয়। আমার ভারি অসহ্য হয়ে পড়েছে। এই ব্রতের ফেরে পড়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে। যতদিন তুমি সুস্থ ছিলে, ততদিন তোমায় ছুঁতে না পাবার জন্যে আমার কষ্ট হয়েছে বটে কিন্তু সে কষ্ট আমি সইতে পেরেছিলাম। কিন্তু যতদিন থেকে তুমি অসুখে পড়তে আরম্ভ করেছ–এইবার নিয়ে তোমার তিনবার অসুখ হল–ততদিন থেকে আমার সহ্য করবার ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। জ্বরের সময় মাথার বেদনায় তুমি ছটফট কর, তখন তোমার মাথাটিতে আমি হাত বুলিয়ে দিতে পাইনে, তোমার হাতটি ধরে আমি ওঠাতে অক্ষম, তোমার যখন শীত করে, তোমার গায়ে কাপড়খানা টেনে দেবারও অধিকার নেই–আমার মনের মধ্যে যে কি হয় তা তোমায় কি করে জানাব ইন্দু? ভাবছি, ব্রত–ট্ৰত ঢের হয়েছে, আর কায নেই–এইখানেই একে সাঙ্গ করে দিই।
বউরাণী অন্যদিকে চাহিয়া কয়েক মুহূর্ত নীরবে বসিয়া রহিলেন। তাঁহার যেন কান্না পাইতেছে। কিন্তু মনের সে ভাব তিনি প্রাণপণে দমন করিতে লাগিলেন। কৃতকাৰ্য্য হইয়া বলিলেন–তা কি হতে পারে? আমি কি তা হতে দিতে পারি? কখনই নয়। আমি তোমার ধর্মের সহায় না হয়ে কি অধৰ্ম্মের কারণ হব?
রাখাল কিছু বলিল না। তাহার হৃদয়ে বউরাণীর প্রতি একটা অবিমিশ্র শ্রদ্ধার ভাব উদিত হইল।
কয়েক মুহূর্ত পরে বউরাণী স্মিতমুখে বলিলেন, কেবল, একটি ঘটনা হলে, আমি বোধ হয় খুব স্বার্থপরের মত কায করব–তোমার ব্রত ভেঙ্গে দেব।
রাখাল বিস্মিত হইয়া বউরাণীর মুখের প্রতি চাহিল। রুদ্ধ কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করিল–কি সে ঘটনা ইন্দু?
বউরাণী ধীরে ধীরে বলিতে লাগিলেন, তোমার ব্রত উদযাপন হবার আগে, এ সাড়ে তিনমাসের ভিতর যদি আমার অন্তিমকাল উপস্থিত হয়–তা হলে–তা হলে–
রাখাল ভর্ৎসনার স্বরে বলিল, ছি ইন্দু–অমন কথা কি বলতে আছে? অমন অমঙ্গলের কথা মুখে এন না।
বউরাণী বলিলেন, অমঙ্গল? স্ত্রীলোকের পক্ষে এর চেয়ে আর কি মঙ্গল, কি সৌভাগ্য হতে পারে? সেদিন কিন্তু আমি আর শুনব না। মরবার সময় তোমার কোলে মাথা রেখে আমি মরব–তোমার ব্রত আমি মানব না।
কথা শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গে বউরাণীর নেত্রযুগল অপূর্ণ হইয়া আসিল। মুখে হাসি, চোখে জল–সেই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখিয়া রাখাল মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া রহিল। কিন্তু তাহা অল্পক্ষণের জন্য মাত্র। ধীরে ধীরে তাহার হৃদয়ে একটা বেদনার সঞ্চার হইল। সে বেদনা আত্মগ্লানিপ্রসূত–নিজের প্রতি ধিক্কারজনিত।
বউরাণী মনে করিলেন, তাঁহার মরিবার কথাতেই রাখাল বুঝি ব্যথা পাইয়াছে। মন ফিরাইবার জন্য অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন। চক্ষু মুছিয়া বলিলেন–হ্যা গা, শুনলাম নাকি কালেক্টার সাহেব আমাদের কোন গ্রামে আসছেন?
রাখাল বলিল, হ্যাঁ, মির্জাহাটে আসছেন।
সে কতদূর
ভদ্রকালীর কাছে।
তবে ত অনেক দূর! বন্দোবস্ত–টন্দোবস্ত হয়েছে?
হয়েছে। কলকাতায় তোক গেছে ডালি কিনে আনতে। অন্য জিনিষপত্র সরবরাহ করবার জন্যে দ্রকালীর নায়েবের কাছে হুকুমনামা পাঠান হয়েছে। সে সব ত হয়েছে, কিন্তু আমি বড় মুস্কিলে পড়ে গেছি।
কেন কি হয়েছে?
দেওয়ানজির সঙ্গে রাখালের গতরাত্রে যে সমস্ত কথাবার্তা হইয়াছিল তাহা বউরাণীকে শুনাইয়া বলিল, তোমার শরীরের এই অবস্থা, এখন ততদিন তোমায় ছেড়ে আমি কি করে যাই?
বউরাণী একটু ভাবিলেন। তাঁহার মুখে অভিমানের ছায়া আসিয়া জমা হইতে লাগিল। হঠাৎ বলিলেন–তিনদিন ছেড়ে থাকতে কাতর হচ্ছ, ষোল বছর আমায় ছেড়ে ছিলে কি করে? তাহার ওষ্ঠযুগল আজ অল্প স্ফীত হইয়া উঠিল।
রাখাল মনে করিল বলি, তখন যে তোমায় চিনিনি বুঝিনি। বেশ উত্তর হইত–ভালবাসাও প্রকাশ পাইত–কিন্তু এ মিথ্যা কৈফিয়ৎ তাহার কণ্ঠমূলে আসিয়া বাধিয়া গেল। সে ভাবিল, ছি ছি–আমার প্রতি এত বিশ্বাস, এত ভালবাসা যার, তাহাকে মিথ্যা কথা বলিয়া আমি প্রবঞ্চনা করিব? আমায় ধিক্। সেই ক্ষোভ সেই আত্মগ্লানি আবার তাহার বুকে তরঙ্গ তুলিল। রাখাল নীরব হইয়া রহিল।
বউরাণী ভুল বুঝিয়া মনে করিলেন তাঁহার শ্লেষে লজ্জা পাইয়াই সে অমন করিয়া রহিল। তাড়াতাড়ি বলিলেন–তোমার মনে কি আমি দুঃখ দিলাম? আমি আজ ক্রমাগত তোমায় আঘাত করছি। রোগ হয়ে কি যেন এক জন্তু হয়ে গেছি!–তুমি আমায় মাফ কর। দেখ, তোমার কাছে যদি অভিমান না করব, তবে কার কাছে করব?
বউরাণীর কণ্ঠস্বরটি এমন কোমল করুণামাখা, এমন মধুর মিনতিপূর্ণ, এমন একটা আত্মসমর্পণের সুর তাহার মধ্যে ধ্বনিত হইয়া উঠিল যে রাখালের আত্মগ্লানি বাড়িল বই কমিল না। তাহার এ ভাবও বউরাণী লক্ষ্য করিলেন, করিয়া ব্যথিত হইলেন। রাখালের মন অন্যদিকে ফিরাইবার জন্য আর একবার যত্ন করিলেন। বলিলেন–ভদ্রকালীতে বড় জাগত্র কালী আছেন শুনেছ?
না। খুব জাগ্রত নাকি?
হ্যা গো, সকলেই বলে।
রাখাল কম্পিত স্বরে বলিল, তবে আমি সেখানে মার কাছে পূজো মানত করে আসব, যাতে তুমি আমার শীগগির ভাল হয়ে উঠ।
বউরাণী বলিলেন, দেখ–এই বলে মানত কোরো যে, ভাল হয়ে, আমরা দুজনে একত্র গিয়ে মার পূজো দিয়ে আসব–কেমন?
হ্যাঁ, তাই মানত করব।
আর, মার প্রসাদী একটু সিঁদূর আমার জন্যে নিয়ে এস–কেমন?
অবশ্য নিয়ে আসব।
এই সময় পর্দার বাহিরে দাঁড়াইয়া রাণীমা বলিলেন, বাবা ভবেন।
রাখাল বলিল, কি মা?
বউমা এখন সাবু খাবেন কি? সাবু তৈরি হয়েছে। –বলিতে বলিতে পর্দা সরাইয়া তিনি প্রবেশ করিলেন।
রাখাল দাঁড়াইয়া উঠিল, বুঝিল তাহাকে বাহিরে যাইতে হইবে।
কাছে আসিয়া রাণীমা জিজ্ঞাসা করিলেন, হ্যা বাবা, কবিরাজী চিকিৎসা ত এতদিন হল, জ্বরটুকু ছেড়েও ছাড়ছে না, বার বার তিনবার ঘুরে ঘুরে পড়লেন। সদর থেকে কোনও ডাক্তারকে আনিয়ে একবার দেখালে ভাল হয় না?
রাখাল বলিল, হ্যা মা আমিও সেই কথা ভাবছিলাম। যাই দেওয়ান কাকাকে জিজ্ঞাসা করি, দেখি তিনি কি বলেন।
তাই পরামর্শ করে একটা ব্যবস্থা কর বাবা। মার আমার শরীর শুকিয়ে আধখানি হয়ে গেছে। যদি ডাক্তার হাওয়া–টাওয়া বদলাতে বলে, না হয় হাওয়া বদলাতেই নিয়ে যাও।
বউরাণীর সাক্ষাতে এ বিষয়ে অধিক চর্চা করা রাখালের ইচ্ছা নহে। দেখি ডাক্তার এসে কি বলেন। –বলিয়া তাড়াতাড়ি সে বাহির হইয়া গেল।
০৩. মুসলমান ও মেষশাবক
আহারাদির পর রাখাল রওয়ানা হইল। পাল্কীতে এত দীর্ঘপথ পূৰ্ব্বে কখনও সে অতিক্রম করে নাই। ছাড়িবার সময় পাল্কীর মাঝখানটিতে রাখাল বসিয়াছিল। ক্রোশখানেক পথ, দুই পার্শ্বে শস্যক্ষেত্র দেখিতে দেখিতে চলিল। ক্রমে দোলানিতে তাহার দ্ৰিাবেশ হইল। ধীরে ধীরে সাবধানে সে শয়ন করিল এবং শীঘ্রই ঘুমাইয়া পড়িল। ঘণ্টাখানেক পরে আবার তাহার চেতনা হইল। ঘড়ি খুলিয়া দেখিল, বেলা দুইটা বাজিয়াছে। উপাধানের নিম হইতে পাণের ডিবা বাহির করিয়া একটা পাণ মুখে দিয়া, অলসভাবে বাহিরের পানে চাহিয়া রহিল। ধীরে ধীরে বউরাণীর চিন্তা তাহার মনের মধ্যে প্রবেশ করিল। ভাবিতে লাগিল–আজ তাহাকে দেখিতে পাইব না। কল্য নয়–পরশুও নয়। তৎপরদিন সন্ধ্যা নাগাদ আবার সাক্ষাৎ হইবে। বউরাণী এখন কি করিতেছেন, কি বলিতেছেন, কে কে তাহার কাছে আছে, গা–টি এখনও শীতল আছে কি না–এই সকল কথা রাখাল চিন্তা করিতে লাগিল। বারম্বার এই কথাই তাহার মনে বেদনা দিতে লাগিল–তিনদিন তাহার সহিত দেখা হইবে না–তার পর দিন? –দেখা হইবে ত? মানুষের শরীর–পদ্মপত্রের জল–বলা ত যায় না। যদি ফিরিয়া দেখি–বউরাণী নাই!–কঠিন পীড়া, কখন কি হয় বলা ত যায় না। –যদি গিয়া দেখি, বাড়ীর লোক সকলে কাঁদিতেছে–সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে! এ কথা ভাবিতে রাখালের হৃৎকম্প উপস্থিত হইল, সৰ্ব্বশরীর শিহরিয়া উঠিল–ধীরে ধীরে সে চক্ষু মুদ্রিত করিল। তাহার সেই মুদ্রিত চক্ষু হইতে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়াইয়া পাল্কীর বিছানায় পড়িতে লাগিল।
কিয়ৎক্ষণ এইরূপে কাটিলে, রাখাল চক্ষু খুলিল। ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল। আলখাল্লার প্রান্ত দিয়া চক্ষু মুছিয়া মনে মনে বলিল–না, তাই কি হতে পারে? ভগবান কি আমার উপর এমনই নিষ্ঠুর হবেন? –কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার তাহার মনে। হইল–আমাকে ভগবান দয়া করবেন কেন? আমি যে মহাপাপী। ফুলের মত কোমল নিৰ্ম্মল যে জঙ্গাজলের মত স্নিগ্ধ পবিত্র যে–তারই আমি সৰ্ব্বনাশ করতে বসেছি–ভগবান আমায় কৃপা করবেন কি?
এইরূপ চিন্তায় একঘণ্টা কাল অতিবাহিত হইলে পাল্কী একটি ক্ষুদ্র গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করিল। পথের একপার্শ্বে বৃহৎ বটবৃক্ষ–অন্য পার্শ্বে একটি পুরষ্করিণী–কিয়দ্দূরে মুড়ি–মুড়কি পাটালিগুড় প্রভৃতির একখানি দোকান দেখা যাইতেছে। বেহারাগণ সেই বটবৃক্ষতলে পাল্কীখানি নামাইল। তাহাদের মধ্যে যে ব্যক্তি প্রবীণ সে আসিয়া যোড়হস্তে বলিল, হুজুর, যদি হুকুম হয় ত এইখানে আমরা একটু জিরিয়ে জল খেয়ে নিই।
বেশ। এই নাও। –বলিয়া রাখাল একটি টাকা বেহারার হাতে দিল। পাল্কীতে একভাবে অনেকক্ষণ থাকিয়া তাহারও দেহ আড়ষ্ট হইয়া গিয়াছিল, তাই সে নামিয়া পড়িল। জিজ্ঞাসা করিল–এটা কোন্ গ্রাম?
বেহারা বলিল, এটা চেড়াগা হুজুর। এখানে মুসলমানই বেশী–হিঁদু খুব কম।
কার জমিদারী?
মৌগঞ্জের সিঙ্গিবাবুদের।
রাখাল সিংহবাবুদের নাম শুনিয়াছিল। অত্যাচারী প্রজাপীড়ক বলিয়া তাহাদের অখ্যাতি আছে।
হাত পা ধুইবার জন্য বেহারাগণ পুষ্করিণীতে নামিল। রাখাল পদচারণা করিতে করিতে গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করিল। ছোট ছোট নীচু বাটীর ঘর–কাহারও একখানি কাহারও বা দুইখানি মাত্র–উঠানে হাঁস মুর্গী চরিতেছে, চালে লাউ কুমড়ার গাছ। কোথাও বা কোন মুসলমান রমণী কুটীরের দাওয়াতে চরকা কাটিতেছে; কোনও সম্পন্ন গৃহস্থের বিবি চোখে কাজল কাণে রূপার ঝুমকা হাতে রূপার বাজু পরিয়া উঠানে বসিয়া শিশুকে স্তন্যপান করাইতেছে। এই সকল দেখিতে দেখিতে রাখাল অগ্রসর হইল।
কিয়দ্দূর গিয়া দেখিল একটা কুটীরের অঙ্গনে কয়েকজন লোক একত্র হইয়া গোলমাল করিতেছে। দুই ব্যক্তি, একটা হৃষ্টপুষ্ট মেষশাবকের বন্ধনরঙ্কু ধরিয়া টানাটানি ও বচসা করিতেছে–বাকী লোক দাঁড়াইয়া তামাসা দেখিতেছে। একজন–সে মুসলমান–বলিতেছে–এ ভেড়া আমি কিছুতেই দিমুনা–জান্ গেলেও না। অপর ব্যক্তি হিন্দু–ইহার হস্তে একটা লাঠি এবং মাথায় পাগড়ী–বলিতেছে–দিবিনে? তোর বাপ যে সে দেবে। জমিদারের হুকুম। দিবিনে? –মুসলমান বলিতেছেজমিদারের জমি মাংনা ত রাখিনে। খাজনা নেয় না? পোষা ভেড়া আমি দিমু ক্যান? এহ–জুলুম! কুটীরের দাওয়াতে একটি দশ বারো বৎসরের ছেলে মুখখানি কাদ কাদ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে; তাহার পশ্চাতে চালের বাতা ধরিয়া একজন বয়স্কা রমণী, বোধ হয় বালকের মাতা।
ব্যাপারটা কি বুঝিতে না পারিয়া পথ হইতে রাখাল অঙ্গনে উঠিয়া বলিল, তোমরা সব এখানে কি গোলমাল লাগিয়েছ?
মুসলমানটি বলিল, ঠাউর, সেলাম। আপনি ত হেঁদুরের সাধু, আপনি কন্ ত। আমি এই ভেড়াটি আপনার পুতের মত পেলেছি পুষেছি। নিজে না খেয়ে ওকে খাওয়াইয়েছি। খাইয়ে এত বড়ষ্টা করেছি। আমার পেয়ারের জানোয়ার, আমি দিমু ক্যান হুজুর? নিয়ে গিয়ে ওকে জবা করবে!
অপর লোকটা চীকার করিয়া বলিল, বেটার সয়তানি দেখ! জমিদারের বাড়ীতে কাল খানা–কলকাতা থেকে বড় বড় বাবুরা এসছে–দিবিনে? দিবি ত দে, নৈলে জুতিয়ে খাল খিচে দেব। –বলিয়া দড়ি ধরিয়া সে একটা হেঁচকা টান দিল, ভেড়াটা মাটীতে পড়িয়া ভ্যা ভ্যা করিতে লাগিল।
রাখাল ক্রদ্ধ হইয়া বলিল, তুই কে রে?
সে মুখ বিকৃতি করিয়া উত্তর করিল, ঈস–লাট এসেছেন! ভারি ত সাধু–ওনার কাছে নিকেশ দিতে হবে আমি কে রে! আমি সিঙ্গিবাবুদের বর্কন্দাজ–কারু তোয়াক্কা রাখি? যাও যাও ঠাকুর–এগায়ে ভিখ মিলবে না–এখানে সব মুসলমান।
রাখাল ধৈৰ্য্য হারাইয়া চীৎকার করিয়া উঠিল, চোপরাও হারামজাদা! যার জিনিষ সে দেবে না, তুই জোর করে নিয়ে যাবি?
অন্যান্য মুসলমান যাহারা এতক্ষণ দর্শকভাবে উপস্থিত ছিল মাত্র, দুর্দান্ত জমিদারের ভয়ে কথাটি কহিতে সাহস করিতেছিল না–অপরিচিত সন্ন্যাসীর এই জোর দেখিয়া তাহাদেরও মুখ ফুটিল। কেহ বলিল–হবিব ভাই, দিসনে। তোর ভেড়া তুই দিবি ক্যান? কেহ বলিল, জুলুম? দেখি ত বন্দাজের ছাওয়াল ক্যামনে এ ভেড়া নিয়ে যায়!–কেহ বা আরও চড়া চড়া কথা বলিতে লাগিল।
সাধু সন্ন্যাসীর অভিশাপের ভয়েই হউক, অথবা মুসলমানেরা সমবেত হইতেছে দেখিয়াই হউক, এতক্ষণে বৰ্কন্দাজ একটু নরম হইল। সুর নামাইয়া বলিল–আমি ত আর অমনি চাচ্ছিনে। যা উচিত মূল্য হয়–নে। টাকা দিচ্ছি।
হবিবুল্লা বলিল, রাখি দে তোর ট্যাকা। যারে পেয়ার করি, তার গলায় ছুরি দিতে দিমু ক্যান্? ক খনো না। জান গেলেও না।
রাখাল বলিল, ওহে জমিদারের বর্কন্দাজ, ভাল চাও ত মানে মানে বিদায় হও। তোমার মনিবের ভেড়া খেতে সাধ হয়ে থাকে ত, যে ইচ্ছ করে বেচবে তার ভেড়া কিনে নিয়ে যাও। গরীবের উপর জুলুম কোরো না।
বর্কন্দাজ রাখালের প্রতি দৃকপাত মাত্র না করিয়া তর্জনী হেলাইয়া বলিল, আচ্ছা থাক বেটারা। জমিদারের অপমান! মজাটা দেখাচ্ছি। –বলিয়া রাগে গর গর করিতে করিতে প্রস্থান করিল।
রাখাল দেখিল, বৰ্কন্দাজের শেষের কথা শুনিয়া সকলেই একটা আতঙ্ক উপস্থিত হইয়াছে। তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল, এই দফা সারলে রে! একখানকে সাতখান করে গিয়ে নাগাবে। জমিদার হয়ত নেঠে পেঠিয়ে দেবে। –হবিবুল্লা বলিল, দেয় দেবে। মরি ত মরব–একবার বই ত নয়।
রাখাল বলিল, দেখ, তোমাদের জমিদার ভাল লোক নয়। যদি তোমাদের উপর কোনও অত্যাচার হয়–কালকে মির্জাহাটে কালেক্টার সাহেবের তাবু পড়বে, তিনদিন তিনি সেখানে থাকবেন–তোমরা তাঁকে গিয়ে সব কথা জানিও। –বলিয়া রাখাল প্রস্থান করিল; মুসলমানগণ সসম্মানে তাহাকে অভিবাদন করিতে লাগিল।
পাল্কীর নিকট পৌঁছিয়া রাখাল দেখিল, বেহারাগণ জল পান করিয়া প্রস্তুত হইয়া বসিয়া আছে। পাল্কী আবার গন্তব্যপথ ধরিল।
বসিয়া বসিয়া রাখাল এইমাত্ৰ–দৃষ্ট ব্যাপারটি মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিল। আর সকল কথার উপরে–যারে পেয়ার করি তার গলায় ছুরি দিতে দিমু ক্যান্। –এই কথাগুলিই তাহার কর্ণে যেন বারম্বার ধ্বনিত হইতে লাগিল। একজন সামান্য মুসলমান, সে যে প্রবল পরাক্রান্ত জমিদারের রোষানল উপেক্ষা করিয়া, নিজ নিশ্চিত বিপদকে তুচ্ছ জ্ঞান করিয়া, আপন স্নেহের পাত্রটিকে রক্ষা করিল–ইহাতে রাখাল লোকটার প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করিতে লাগিল। মনে মনে বলিল, এই ত চাই।
মানসিক উত্তেজনা কতকটা নিবৃত্ত হইলে, রাখাল আবার বউরাণীর চিন্তায় মগ্ন হইল। আসিবার সময় তাহাকে ভাল দেখিয়া আসিয়াছে। ভাবিল ফিরিয়া গিয়া কৃষ্ণনগর হইতে ডাক্তার সাহেবকে আনাইয়া একবার দেখাইব; তিনি যদি বায়ু পরিবর্তনের উপদেশ দেন, তবে বায়ু পরিবর্তনে লইয়া যাইব। সিমলা হউক–নৈনিতাল হউক–দার্জিলিঙ হউক, ডাক্তার সাহেব যেমন বলিবেন। তাহা হইলেই বউরাণী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করিবেন। আমার অলীক ব্রতের কাল প্রায় তিনমাস অতীত হইয়াছে। আর তিনমাস পরেই। হঠাৎ রাখালের মুখ বিমর্ষ হইয়া গেল। কে যেন তাহার বুকে সজোরে এক চাবুক মারিল। তাহার চক্ষু বিস্কুরিত হইল, নাসিকা স্ফীত হইল, নিশ্বাস ঘন ঘন বহিতে লাগিল।
অল্পে অল্পে রাখালের মস্তকটি অবনত হইয়া পড়িল। স্তব্ধ হইয়া এই ভাবে অনেকক্ষণ সে বসিয়া রহিল। বসিয়া অনেকক্ষণ ভাবিল। তাহার চোখ দিয়া ফোঁটা ফোঁটা জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। শেষে অস্ফুটস্বরে রাখাল বলিল, সেই নিরক্ষর নীচ মুসলমানের যেটুকু ধৰ্ম্মজ্ঞান আছে, আমার কি তাও নেই? যে যাকে পেয়ার করে, অন্য কেউ পাছে তার গলায় ছুরি দেয় এজন্যে সে আপনার জান কবুল করেছে। আমি যাকে ভালবাসি, আমি যে স্বহস্তেই তার গলায় ছুরি দিতে উদ্যত হয়েছি! আমায় ধিক্–আমার অদৃষ্টকে ধিক্।
০৪. ব্যাধি বড় প্রবল
কালেক্টর সাহেবকে খাতির করিয়া তিনদিন পর রাখাল বাশুলিপাড়ায় ফিরিল। তখন অপরাহ্নকাল। সকলে তাহাকে দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেল। এ তিনদিনে তাহার মুখ চক্ষু যেন কেমন হইয়া গিয়াছে। অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতেই রাণীমা শঙ্কিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, বাবা ভবেন, সেখানে গিয়ে কিছু অসুখ–বিসুখ হয়েছিল?
রাখাল বলিল, না মা!
তবে তোমার চেহারা অমন হয়ে গেল কেন বাবা?
বোধ হয় পথের কষ্টে। –বলিয়া রাখাল সেখান হইতে সরিয়া পড়িল।
বউরাণীর নিকট গিয়া দেখিল, তিনি একটু ভাল আছেন। সে অবধি আর জ্বর আসে নাই, কাসিটাও একটু কমিয়াছে। বউরাণীও তাহার ভাবান্তর লক্ষ্য করিলেন। বলিলেন–তুমি সেখানে কেমন ছিলে?
ভাল ছিলাম।
তোমার চোখ মুখ অমন বসে গেছে কেন?
রাখাল বলিল, না, ও কিছু নয়।
বউরাণীও মনে করিলেন বোধ হয় পথের কষ্টে ওরূপ হইয়াছে। দুইচারিটি অন্যান্য কথার পর জিজ্ঞাসা করিলেন–মা দ্রকালীকে দর্শন করে এসেছ?
এসেছি।
যা বলেছিলাম, সেই রকম পূজো মানৎ করেছ?
কয়েক মুহূর্তকাল নীরব থাকিয়া রাখাল বলিল, না।
এ উত্তরে বউরাণী একটু বিস্ময় অনুভব করিলেন। কি হইয়াছে কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। রাখালও অধিকক্ষণ সেখানে রহিল না। জলযোগদি সারিয়া বহিৰ্বাটিতে আসিয়া বসিল।
সন্ধ্যার পর দেওয়ানজি আসিলেন। বউরাণীর স্বাস্থ্য, কালেক্টার সাহেবের সংবাদ প্রভৃতির আলোচনা শেষ হইলে তিনি বলিলেন–বাবা, আমাকে মাসখানেক ছুটি দিতে হচ্ছে।
রাখাল বলিল, কেন কাকা?
আমার শরীরটা এদানী বড়ই খারাপ হয়েছে। তাই মনে করছি, দার্জিলিঙে গিয়া মাসখানেক থাকি। সে বছর কর্তার সঙ্গে দার্জিলিঙ গিয়েছিলাম, পনেরটি দিন মাত্র ছিলাম, তাতে যথেষ্ট উপকার হয়েছিল। খুব বেড়াতাম, খুব ক্ষিধে হত। একবার ঘুরে আসি।
রাখাল বলিল, তা আপনার স্বাস্থ্যের জন্যে যদি আবশ্যক বিবেচনা করেন, বেশ ত ঘুরে আসুন।
দেওয়ানজি বলিলেন, কিন্তু কাযকৰ্ম্ম তুমি একটু দেখো শুনো বাবা। নায়েব দেওয়ান যিনি আছেন তিনি অবশ্য পাকা লোক; কিন্তু নিজের সম্পত্তি নিজে না দেখলে সব নয়ছয় হয়ে যাবে।
অতঃপর দেওয়ানজি কাযকৰ্ম্ম সম্বন্ধে রাখালকে নানা উপদেশ দিতে লাগিলেন, কিন্তু কোন কথাই রাখালের কাণে প্রবেশ করিল না। তাহার মন জমিদারী হিসাবপত্রের শতযোজন উর্দ্ধে বিচরণ করিতেছিল। এ কয়দিন সে যে চিন্তায় ব্যাপৃত ছিল সেই চিন্তাতেই বিভোর হইয়া রহিল।
বহুক্ষণ বাক্যব্যয়ের পর দেওয়ানজি বুঝিলেন শ্রোতার মনোযোগ নাই!
তখন তিনি থামিলেন–একটি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন–আচ্ছা বাবা, আজ তা হলে উঠি, রাত হল।
রাখালও দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, আসুন কাকা।
দেওয়ানজি বিদায় লইলে রাখাল তামাক হুকুম করিল। ধূমপান করিতে করিতে সেই নির্জন কক্ষে বসিয়া কত কি আকাশ পাতাল চিন্তা করিতে লাগিল। কয়েকটান টানিবার পর, আলবোলার নল তাহার হাত হইতে খসিয়া পড়িল। লোকে বলে তাম্রকূটের ধূম চিন্তা–ব্যাধির মহৌষধি। কিন্তু ব্যাধি যখন বড় প্রবল, তখন মহৌষধিও আর ফলদায়ক হয় না। রাখালের এখন সেই অবস্থা।
কিয়ৎক্ষণ পরে ভোজন প্রস্তুত হইবার সংবাদ আসিল। রাখাল অন্তঃপুরে গিয়া ভোজনে বসিল, কিন্তু সে নাম মাত্র। আহাৰ্য্যদ্রব্য যেমন ছিল, পাতে প্রায় তেমনিই পড়িয়া রহিল। রাণীমা কাছে বসিয়া ছিলেন, উঠিতে দেখিয়া বলিলেন–ওকি ভবেন, কিছুই যে খেলিনে!
রাখাল বলিল, না মা, আজ ক্ষিধে নেই।
শরীর ভাল আছে ত?
আছে।
রাণীমা কাতরস্বরে বলিলেন, না বাবা, আমায় ভাড়াসনে। তোর কি হয়েছে বল্। তোর শরীর নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে। কবিরাজ মশাইকে ডেকে পাঠাব?
রাখাল বলিল, না, কবিরাজ ডাকতে হবে না। আপনিই সেরে যাবে। –বলিয়া সে মুখ প্রক্ষালনে ব্যাপৃত হইল।
অন্যান্য দিন-বিশেষ যখন হইতে বউরাণী পীড়িত হইয়াছেন–শয়ন করিতে যাইবার পূৰ্ব্বে রাখাল তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, দুই দণ্ড কথাবার্তা কহিয়া তবে যায়।
আজ আর তাহা করিল না। বৈঠকখানা বাড়ীতে গিয়া শয়নকক্ষের দ্বার বন্ধ করিল; ভৃত্য তামাক সাজিয়া আনিয়াছিল, দ্বার বন্ধ দেখিয়া কিয়ৎক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করিল, দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কলিকায় ফুঁ দিল, একটু আধটু গলার আওয়াজ করিল, যদি বাবু দ্বার খুলিয়া দেন–তথাপি কোনও ফল হইল না। ভৃত্য তখন অগত্যা কলিকাটি খুলিয়া লইয়া নীচে নামিয়া গেল এবং সবন্ধু সেটির সদ্ব্যবহারে প্রবৃত্ত হইল।
০৫. রাখাল মনস্থির করিল
দুই দিবস পরে বউরাণী অন্নপথ্য করিলেন। পরদিন দেওয়ানজি দার্জিলিঙ যাত্রা করিলেন।
এ উভয় ঘটনার জন্যই রাখাল অপেক্ষা করিয়াছিল, নচেৎ সে মনস্থির করিয়াছে–বুক বাঁধিয়া লইয়াছে। তাহার সকল দ্বিধাই কাটিয়া গিয়াছে। ভালবাসার বুকে সে ছুরি মারিবে না, বিশ্বাসের স্থানে সে প্রতারণা করিবে না, বউরাণীকে সকল কথাই সে খুলিয়া বলিবে। তাহার পর যাহা হয় হউক।
দ্বিপ্রহরের পর দেওয়ানজিকে পাল্কীতে তুলিয়া দিয়া, নিজ শয়নকক্ষে ফিরিয়া আসিয়া রাখাল আবার ভাবিতে বসিল। এখন তাহার মুখমণ্ডলে বিগত কয়েক দিনের সে অশান্তির ছায়াটা আর নাই। স্বীয় কর্তব্য সম্বন্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া তাহার মনে শান্তি ফিরিয়া আসিয়াছে। কিন্তু যাতনারও অন্ত নাই, চিন্তারও অবধি নাই।
এখন তাহার প্রধান চিন্তা নিজ ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে। এখান হইতে যাইতে হইবে–কালই হউক পরশুই হউক। এইখানেই প্রতিমাখানিকে বিসর্জন দিয়া যাইতে হইবে, এ জীবনে দেখা হইবে না। না দেখিয়া, জীবন কি করিয়া কাটিবে?
অন্ধকারময় নিজ ভবিষ্যৎ জীবনের মধ্যে রাখাল কোথাও যে একটু আলোকের সন্ধান না পাইতেছে এমন নহে। এখন সে ভাবিতেছে, আমার বড় সাধের প্রতিমা বিসর্জন দিয়া যাইতে আমার বুক ফাটিয়া যাইবে। তা যাউক–আমার পূজার প্রতিমাখানিকে আমি অপবিত্র করিলাম না, এই আমার সান্ত্বনা। ঐটুকুই আমার অবশিষ্ট জীবনের চির অন্ধকারের মধ্যে আলোক রেখা। যাহাকে ভালবাসিয়াছি, তাহার গলায় যে আমি ছুরি দিলাম না, যাহাকে পূজা করিবার জন্য বুকের সিংহাসন পাতিয়াছিলাম তাহাকে কলঙ্কিত করিলাম না–ইহাই আমার ভাবী জীবন আলো করিয়া রত্নদীপের মত জ্বলিবে।
রাখাল স্থির করিয়াছে, আজ বিকালে বউরাণীকে অন্তঃপুরের উদ্যানে লইয়া গিয়া, সকল কথা তাহাকে বলিবে। কৃত অপরাধের জন্য তাঁহার পায়ে শত সহস্র ক্ষমা চাহিয়া, চিরবিদায় গ্রহণ করিবে।
ঘড়িতে চারিটা বাজিলে, মনে মনে এই সঙ্কল্প লইয়া রাখাল অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল। গিয়া দেখিল বউরাণী তাঁহার কক্ষে বসিয়া একখানি পুস্তক পাঠ করিতেছেন। রাখালকে দেখিয়া তিনি লজ্জিত হইয়া পুস্তক বন্ধ করিলেন।
রাখাল নিকটস্থ একখানি চেয়ারে বসিয়া বলিল, চল, বাগানে বেড়াতে যাবে? –বলিয়া সে নিজেই বুঝিতে পারিল, তাহার কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন অদ্ভুত রকম শুনাইল।
বউরাণী তাহার মুখের পানে শঙ্কিত দৃষ্টিতে কয়েক মুহূৰ্ত্ত চাহিয়া রহিলেন। শেষে বলিলেন–কেমন আছ?
রাখাল বলিল, ভাল আছি।
তোমার গলা এমন ভারি হয়েছে, চোখ ফুলেছে কেন?
রাখাল সে কথায় উত্তর না দিয়া বলিল, বাগানে এস, সেইখানে বলব।
পূর্বপ্রথা মত প্রথমে বউরাণী উদ্যানে গেলেন। কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিয়া রাখালও সেখানে গিয়া নির্দিষ্ট স্থানে বউরাণীর সহিত মিলিত হইল।
দুইজনে তখন পাশাপাশি হইয়া বাগানে বেড়াইতে লাগিল। বউরাণী মাঝে মাঝে কাতরদৃষ্টিতে রাখালের পানে চাহিতে লাগিলেন।
নিজ বক্তব্য আরম্ভ করিবার জন্য রাখাল প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিল, কিন্তু একবারও কৃতকাৰ্য্য হইল না। কণ্ঠ অবধি আসিয়া কথা বাধিয়া যায়, কিছুতেই বাহির হইতে চায় না।
বউরাণী কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলেন, আমার একটি কথা রাখবে?
রাখাল বলিল, কি বল।
বউরাণী বলিলেন, তোমার শরীর মন দুই খারাপ হয়েছে। ষোল বচ্ছর পশ্চিমে ছিলে, হঠাৎ এ বাঙ্গলা দেশে এসে এখানকার জলহাওয়া তোমার সহ্য হচ্ছে না। আর ষোল বচ্ছরকাল সে একভাবে জীবন কাটিয়েছ, এখন সম্পূর্ণ অন্যরকম অবস্থার মধ্যে পড়েছ, মনও তোমার বিকল হয়ে গেছে। আমি বলি কিচল, কিছুদিন তোমাতে আমাতে পশ্চিমে বেড়িয়ে আসি। মাও অনেকদিন থেকে তীর্থে যাব যাব করছেন–চল, আমরা দুজনে ওঁকে তীর্থ–দর্শন করিয়ে নিয়ে আসি। মাসদেড়েক বেড়িয়ে, পূজোর আগে আবার ফিরে আসা যাবে। কি বল?
উত্তরের জন্য বউরাণী কিয়ৎক্ষণ নিষ্ফল অপেক্ষার পর আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি বল?
রাখালের যেন হঠাৎ চমক ভাঙ্গিল। জিজ্ঞাসা করিল–আঁ?
বউরাণী বলিলেন, কি বল? যাবে? তাহলে আমি মাকে বলি, সব উয্যুগ করি?
রাখাল বলিল, কোথা যাবার কথা বলছ?
বউরাণী বলিলেন, আমি এতক্ষণ যা বললাম শোননি?
রাখাল লজ্জিত হইয়া বলিল, আমি একটা অন্য বিষয় ভাবছিলাম। তেমন মনোযোগ করিনি। কি বলছিলে বল ত।
বউরাণী তাহার পূর্ব প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি করিলেন। শুনিয়া রাখাল বলিল, আচ্ছা, ভেবে দেখি।
এতক্ষণে রাখাল হৃদয়ঙ্গম করিয়াছে, যাহা বলিবার আছে তাহা বউরাণীর সাক্ষাতে বলার মত শক্তি তাহার নাই। আজ রাত্রে বসিয়া একখানি চিঠিতে তাহাকে সকল কথা। সে লিখিবে, কল্য সুযোগমত কোনও সময় সেখানি তাঁহার হস্তে দিবে।
.
রাত্রে আহারাদির পর শয়নকক্ষে আসিয়া, রাখাল বউরাণীকে পত্র লিখিতে বসিল।
এক পৃষ্ঠা, দুই পৃষ্ঠা, তিন পৃষ্ঠা লেখে, লিখিয়া ছিঁড়িয়া ফেলে, আবার আরম্ভ করে। এক একবার কলম নামাইয়া, উৰ্দ্ধমুখ হইয়া বসিয়া ভাবে–আবার লিখিতে থাকে। মাঝে মাঝে চেয়ারে হেলিয়া পড়িয়া হস্ত দ্বারায় চক্ষু আবৃত করিয়া খানিক কাদিয়া লয়। চক্ষু মুছিয়া আবার লেখে। এইরূপ করিতে করিতে রাত্রি একটা বাজিল, দুইটা বাজিল, তিনটাও বাজিয়াও গেল।
পত্র লেখা প্রায় শেষ হইয়াছে, আর পৃষ্ঠাখানেক হইলেই হয়। কিন্তু এখন রাখালের হাত কাঁপিতে লাগিল। সারারাত বাতির কাছে বসিয়া থাকিয়া মাথা কেমন ঝিম ঝিম করিয়া উঠিল। তাই সে ভাবিল, বাহিরে গিয়া ছাদের মুক্ত–বায়ুতে একটু বেড়াই, তাহার পর পত্র শেষ করিয়া শয়ন করিব।
এই ভাবিয়া টেবিল ছাড়িয়া রাখাল উঠিল। দ্বার খুলিয়া বাহিরে গিয়া ছাদে পদচারণা। করিতে লাগিল। ভাদ্রমাস, তথাপি আকাশ আজ মেঘ শূন্য। চন্দ্র অস্তগত, সেই নিৰ্ম্মেঘ আকাশে লক্ষ লক্ষ তারা জ্বলিতেছে। চারিদিক নিস্তব্ধ–বনের ঝিল্লীরাও ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। মৃদুমন্দ বাতাস বহিতেছে।
কিছুক্ষণ পদচারণা করিতে করিতে হঠাৎ কি একটা কথা রাখালের মনে হইল–ছাদের মাঝে থমকিয়া সে দাঁড়াইল। কিছুক্ষণ ভাবিল। তাহার পর কক্ষমধ্যে ফিরিয়া আসিয়া, পত্রখানির শেষ পৃষ্ঠা লিখিয়া, আলোক নিৰ্ব্বাণ করিয়া শয়ন করিল।
যতক্ষণ নিদ্রা না আসিল, ততক্ষণ রাখাল পত্রের শেষাংশের কথাটিই ভাবিতে লাগিল। মনে মনে বলিল–বৃথা আশা! বৃথা আশা! সেই যে পড়েছিলাম।
কিন্তু মজ্জমান জন শুনিয়াছি ধরে।
তৃণে, যদি আর কিছু না পায় সম্মুখে।
আমার এ আশাও তাই। যাই হোক, দুটো দিন বই ত নয়। কালই এখান থেকে চলে যাব ভেবেছিলাম, না হয় আর দুটো দিন রইলাম। গোলমাল একটা হবেই–হয়ত এরা আমাকে পুলিশেও দিতে পারে। জেল হবে? হয় হোক, জেলের বাইরে জেলের ভিতরে, আমার পক্ষে দুই সমান।
ক্রমে রাখাল নিদ্রিত হইয়া পড়িল।
০৬. বজ্রাঘাত
পরদিন বউরাণী আশা করিয়াছিলেন, আহ্নিক ও জলযোগের সময় তিনি যখন অন্তঃপুরে আসিবেন, তখন নিশ্চয়ই তাহার সহিত দেখা হইবে এবং তীর্থ পৰ্য্যটনের প্রস্তাব সম্বন্ধে তিনি কিছু না কিছু বলিবেন। তাহার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা দেখিয়া বউরাণী ব্যাকুল হইয়া পড়িয়াছেন, গত রাত্রে ভাল করিয়া নিদ্রা হয় নাই।
তাঁহার আশা কিন্তু পূর্ণ হইল না। রাখাল জলযোগাদির জন্য যথাসময়ে অন্তঃপুরে আসিল বটে, কিন্তু বউরাণীর সহিত সাক্ষাৎ না করিয়াই আবার বাহির হইয়া গেল।
তখন বউরাণী আশা করিতে লাগিলেন, মধ্যাহ্নকালে আহারের সময় নিশ্চয়ই সাক্ষাৎ হইবে। কিন্তু রাখাল আসিয়া আহার করিয়া গেল–সাক্ষাৎ হইল না
বউরাণীর মনে তখন একটু অভিমান উপস্থিত হইল। তিনি ভাবিতে। লাগিলেন–কেন? এমন করিয়া আমার নিকট হইতে পলাইয়া বেড়াইতেছেন কেন? আমি কি করিয়াছি? –জানিয়া শুনিয়া কোনও অপরাধ ত আমি করি নাই। পূৰ্ব্বে আমাকে এত ভালবাসিতেন, আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য কত ব্যাকুল হইয়া থাকিতেন, এখন এমন হইয়া গেলেন কেন? ভদ্রকালী হইতে ফিরিয়া আসা অবধি এই পরিবর্তন দেখিতেছি। কি হইল কিছুই ত আমি বুঝিতে পারিতেছি না!
ভাবিয়া চিন্তিয়া বউরাণী অবশেষে স্থির করিলেন, তাহার শরীর খারাপ হইয়াছে। বলিয়াই এমন হইয়া গিয়াছেন। যাহা হউক, আজ বিকালে দেখা হইলে তীর্থযাত্রার কথাটা পাকাঁপাকি করিয়া ফেলিতেই হইবে।
শ্বশ্রূঠাকুরাণীকে খাওয়াইয়া, আহার করিয়া বউরাণী যখন আপনার কক্ষে ফিরিয়া আসিলেন তখন বেলা প্রায় একটা। প্রভাত হইতেই আকাশে মেঘ করিতেছিল, এতক্ষণে মেঘটা বেশ ঘন হইয়া আসিয়াছে। পশ্চিম দিকের জানালায় দাঁড়াইয়া বউরাণী সেই মেঘের লীলা দেখিতে লাগিলেন। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকিতেছে–আজ জল না হইয়া আর যায় না।
দেহ দুর্বল, অধিকক্ষণ বউরাণী দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না। একটি সোফার উপর আসিয়া বসিলেন। একটু পরেই কনক সুরবালা আসিবে, তাহাদের এখনও বোধ হয় আহার শেষ হয় নাই। একখানা নূতন মাসিকপত্র আসিয়াছিল, তাহারই মোড়ক খুলিয়া বউরাণী ছবিগুলি দেখিতে লাগিলেন। ঘড়িতে ঠং করিয়া একটা বাজিল।
সঙ্গে সঙ্গে বাহিরে পদশব্দ শুনা গেল। অমনি বউরাণীর হৃদয়যন্ত্রে শোণিতপ্রবাহ খরতর বেগে বহিল–এই পদশব্দ পরিচিত ও আকাঙ্ক্ষিত। বস্ত্রাদি তিনি তাড়াতাড়ি সম্বরণ করিয়া লইলেন। মুহূর্ত পরে রাখাল আসিয়া প্রবেশ করিল।
বউরাণী উঠিয়া দাঁড়াইলেন। অনুযোগের স্বরে বলিলেন–আজ এতক্ষণে মনে পড়ল?
রাখাল মস্তক অবনত করিয়া রহিল, কোনও উত্তর করিল না।
বউরাণী বলিলেন, বস। বসবে না?
রাখাল বলিল, না। –বলিয়া আংরাখার বুকের ভিতরে হাত পুরিয়া খামে ভরা। চিঠিখানি বাহির করিয়া, কম্পিত হস্তে বউরাণীর নিকটে ধরিল।
বউরাণী জিজ্ঞাসা করিলেন, কার চিঠি?
তোমার।
হাত বাড়াইয়া বউরাণী চিঠিখানি লইয়া খামের এপিঠ ওপিঠ দেখিয়া বুঝিলেন ইহা ডাকে আসে নাই। জিজ্ঞাসা করিলেন–কে লিখেছে?
খুলে দেখ। –বলিয়া রাখাল মাতালের মত টলিতে টলিতে বাহির হইয়া গেল।
তাহার আচরণে বউরাণীর মনে একটা প্রবল শঙ্কা জাগিয়া উঠিল–যেন একটা অপরিচিত রাক্ষস মুখব্যাদান করিয়া তাহাকে গ্রাস করিতে আসিতেছে। তাহার বিবর্ণ মুখ আরও বিবর্ণ হইয়া গেল। হস্তপদ কাঁপিতে লাগিল। কোনও ক্রমে পত্রখানি খুলিলেন। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের সেই অল্পালোকে পাঠ করিলেন
আমি তোমাকে কি বলিয়া সম্বোধন করিব জানি না। তুমি আমার জীবনের একমাত্র সুখ, একমাত্র আনন্দ–কিন্তু বিধির বিড়ম্বনায় তোমা ধনে আমি বঞ্চিত হইতে বসিয়াছি। তেমন লেখাপড়া শিখি নাই, মনের সকল কথা গুছাইয়া বলিবার ক্ষমতা নাই, নহিলে এই পত্রেও আমার অকৃত্রিম ভালবাসার প্রমাণ দিতে পারিতাম। আমি আজন্ম দুঃখী, মনে করিয়াছিলাম এতদিনে বুঝি বিধাতা আমার সুখের মুখ দেখাইলেন; কিন্তু অদৃষ্ট ছাড়া পথ নাই, আমার সব ভস্ম হইয়া গেল। আমি অতি অকৃতী অধম দুরাচার। তোমার নিকট আমি যে অপরাধ করিলাম, জানি তাহার ক্ষমা নাই। সতী সাধ্বী হিন্দু স্ত্রী তাহা ক্ষমা করিতে পারে না। আমি ক্ষমার অযোগ্য ও অশিক্ষিত। আমি মূর্খ, কিন্তু তোমাকে ভালবাসিয়া এই কয়মাসে আমার যে শিক্ষালাভ হইয়াছে তাহারই ফলে আজি আমি তোমাকে এই পত্র লিখিতে বসিয়াছি। আমি তোমাকে যেরূপ ভালবাসিয়াছি, জীবনে কখনও কাহাকেও সেরূপ ভালবাসি নাই। ভালবাসা কাহাকে বলে, তোমাকে দেখিবার পূৰ্ব্বে তাহা আমার জ্ঞানের অগোচর ছিল। তোমাকে ভালবাসিয়াছি, সুতরাং তোমার সহিত প্রবঞ্চনা করিব না। তুমি আমাকে অকৃত্রিমভাবে বিশ্বাস করিয়াছ, তোমার বুকে ছুরি মারিব এমন নরাধম আমি নহি। তবে আসল কথা বলি শুন। আমার নাম ভবেন্দ্র নয়, আমি তোমার স্বামী নহি। তোমার স্বামী ভবেন্দ্র এখন পরলোকে, তাহাই জানিতে পারিয়া বিষয়ের লোভে আমি ভবেন্দ্র সাজিয়া–
এই পর্যন্ত পাঠ করিয়া, বউরাণী চক্ষে অন্ধকার দেখিলেন। সম্বিৎ হারাইয়া সোফার উপর হইতে সশব্দে নিমে পড়িয়া গেলেন।
ইহার অর্ধ মিনিট পরে, পাণ চিবাইতে চিবাইতে হেলিতে দুলিতে কনকলতা আসিয়া পৌঁছিল। দ্বারে পদার্পণ মাত্র আঁ? কি হল? –বলিয়া সে ছুটিয়া বউরাণীর নিকট গেল। চিঠিখানি মেঝের উপর পড়িয়াছিল–সেখানি কুড়াইয়া লইয়া ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে এখানে এক ছত্র, ওখানে দুই ছত্র পাঠ করিয়া, ব্যাপারটা মোটামুটি বুঝিতে পারিল। তাড়াতাড়ি চিঠি বস্ত্রমধ্যে লুকাইয়া, ওগো কি হল গো! বলিয়া চীৎকার আরম্ভ করিয়া দিল। তখন বাড়ীর মধ্যে একটা ছুটাছুটি পড়িয়া গেল। প্রথমে আসিল সুরবালা, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ হাঁফাইতে হাঁফাইতে হাবার মা এবং আরও কয়েকজন আসিল। হাবার মা হাউমাউ করিয়া বাড়ী মাথায় করিবার উপক্রম করিয়াছিল, কনক অনেক কষ্টে তাহাকে থামাইল। শেষে রাণীমা আসিয়া পৌঁছিলেন। মুখে জল ছিটাইয়া পাখার বাতাস করিয়া অনেক কষ্টে বউরাণীর চেতনা সম্পাদন করা হইল। তিনি চক্ষু খুলিলেন। ধরিয়া তাহাকে সোফায় বসান হইল।
রাণীমা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, কি হয়েছিল মা? হঠাৎ অমন মূর্ছা গেলে কেন?
বউরাণী কোনও কথা না বলিয়া, হস্তদ্বারা শুধু নিজ ললাট স্পর্শ করিলেন। কনক লক্ষ্য করিল, বউরাণী চক্ষু পত্রখানির অম্বেষণ করিতেছে না। তাঁহার দৃষ্টি ঊর্ধ্বে।
রাণীমা বলিলেন, মা, বিছানায় শোবে কি?
বউরাণী ইঙ্গিতে সম্মতি জানাইলেন।
তখন কয়েকজন ধরাধরি করিয়া তাহাকে শয্যায় লইয়া গেল। বস্ত্রাদি পরিবর্তনের পর শুশ্রূষা চলিতে লাগিল।
ব্যাপারটা কি সম্যক অবগত হইবার জন্য কনকের প্রাণ ছটফট করিতেছিল। জ্যাকেটের নিমে পত্রখানা যেন তপ্ত অঙ্গারের মত তাহাকে দগ্ধ করিতে লাগিল। ধীরে ধীরে বউরাণীর শয্যা–কক্ষ পরিত্যাগ করিয়া কনক নিজের কক্ষে গিয়া উপস্থিত হইল। সাবধানে দ্বারটি রুদ্ধ করিয়া বাহিরের দিকের খোলা জানালার নিকট গিয়া সে দাঁড়াইল, তখন বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে। জানালা দিয়া জলের ছাট আসিতে লাগিল। একটু পশ্চাতে সরিয়া বক্ষের ভিতর হইতে পত্রখানি বাহির করিয়া কনক পড়িতে আরম্ভ করিল। –এলোমেলো গোছের একটা ভূমিকার পর রাখাল তাহার নিজ জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আরম্ভ করিয়াছে। স্ত্রী লীলাবতীর সহিত প্রণয়াভাব, ছুটি লইয়া তাহাকে আনিতে গৃহে গমন, সেখানে গিয়া স্ত্রীকে না পাওয়া, নবীনের সহিত পলায়নের গুজব, খুস্রপুরে ফিরিয়া আসিয়া নিজের অবস্থাসঙ্কট, রেলগাড়ী হইতে সন্ন্যাসীর লাস নামা, রাত্রে তাহার বাক্স খুলিয়া টাকা ও কাগজের বস্তা অপহরণ, কাগজপত্র হইতে মৃত ব্যক্তি পরিচয়লাভ, ডায়ারির কথা, তাহাদের উভয়ের বয়স ও আকারগত সাদৃশ্য–অবশেষে ভবেন্দ্র সাজিয়া বাশুলিপাড়ায় আগমনের অভিসন্ধি ও তৎপক্ষে আয়োজনাদি সমস্ত বর্ণনা, করিয়া অবশেষে রাখাল লিখিয়াছে–
আমি যে দুরভিসন্ধিটি করিয়াছিলাম–তাহা সম্পূর্ণরূপেই সিদ্ধ হইয়াছিল। আমাকে কেহই তোমরা জাল বলিয়া সন্দেহ করিতে পার নাই। আমি নিৰ্বিয়ে এই বিপুল সম্পত্তি ভোগ করিতে পারিতাম। কিন্তু আমার হিসাবে একটা ভুল হইয়াছিল। তখন জানিতাম না, ভালবাসা কি পদার্থ। জানিতাম না, ভালবাসিলে মানুষের মনের গতির কিরূপ পরিবর্তন হয়। এখন তাহা জানিয়াছি; সুতরাং আমার সকল আয়োজনই ব্যর্থ হইয়া গেল তোমার পায়ে আমি যে অপরাধ করিয়াছি–তাহার জন্য শত সহস্র ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া, আমি চিরবিদায় গ্রহণ করিলাম। যতদিন বাঁচিয়া থাকিব, ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিব যেন তুমি ভাল থাক, সুখে থাক, ধৰ্ম্মপথে থাকিয়া জীবন অতিবাহিত করিতে পার। তোমার নিকট যেমন সকল কথা প্রকাশ করিয়া লিখিলাম, আমার উচিত ছিল পরম পূজনীয়া রাণীমাতার নিকটও সমস্ত বলিয়া তাঁহার পায়ে ধরিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া যাওয়া। কিন্তু আমি একটা কথা ভাবিয়া তাহা হইতে বিরত রহিলাম। কথাটা তাহা হইলে হয়ত বাটীর সকলের নিকট প্রচার হইয়া যাইবে–ক্রমে গ্রামময় দেশময় রাষ্ট্র। হইবে। তাহাতে লোকে তোমার কলঙ্ক ঘোষণা করিবে। তুমি যে কত পবিত্র তাহা লোকে বুঝিবে না। তোমার অনিষ্ট যাহা করিবার তাহা ত করিয়াছি–আর বেশী করিব না। আমার কথা তোমার মন হইতে মুছিয়া ফেলিও। আমার ন্যায় হতভাগ্য আর ধরাতলে নাই। ইতি–
শ্রীরাখালদাস ভট্টাচার্য্য
পুনশ্চ
একটা কথা মনে পড়িয়া গেল, তাই বিদায় লইয়াও আবার আসিলাম। সে কথা তোমাকে লিখিয়া আমার কৃত অপরাধ আরও গুরুতর করিতেছি কি না জানি না। আমার এখন বুদ্ধি লোপ হইয়াছে, কি লিখিতেছি তাহা জানি না। এ কয়মাসে আমার প্রতি তোমার মনের ভাব কিরূপ হইয়াছে জানি না। আমি যেমন তোমাকে জ্ঞানশূন্য হইয়া ভালবাসিয়াছি, তুমিও যদি আমাকে সেইরূপ বাসিয়া থাক, এবং যদি বিধবার পুনৰ্ব্বার বিবাহকে পাপ ও অন্যায় বলিয়া মনে না কর, তবে এস আমরা নূতন বিধান অনুসারে যথাশাস্ত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। তুমি যদি ইহাতে সম্মত হও, তবে আমি হাতে স্বর্গ পাইব তাহা বলাই বাহুল্য। আর যদি এ বিষয়ে তোমার অমত হয়, তবে তাহা জানিতে পারিবামাত্র আমি এখান হইতে চিরদিনের জন্য বিদায় গ্রহণ করিব। আমার সকল অপরাধ তুমি মার্জনা কর, ইহাই তোমার চরণে আমার শেষ ভিক্ষা। ইতি
শ্রীরাখাল
বৃষ্টিটা এতক্ষণে বেশ চাপিয়া আসিয়াছে। আকাশ মাঝে মাঝে গর্জন করিতেছে। পত্রখানি পাঠ শেষ করিয়া কনকলতা কিয়ৎক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া বাহিরের পানে চাহিয়া রহিল। তাহার পর সেখানি নিজের বাক্সের মধ্যে চাবিবন্ধ করিতে করিতে মনে মনে বলিল–ভাগ্যিস্ এখানি আমার হাতে পড়েছে, তাই রক্ষে–অন্য কারু হাতে পড়লে এতক্ষণে বাড়ীময় টী টী হয়ে যেত। রাখাল চলে যাক, লোকে মনে করুক সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে গেছে–ঘরে তার মন টিকলো না। রাখাল ঠিকই বলেছে–জানাজানিটে না হলেই মঙ্গল।
বাক্স বন্ধ করিয়া আবার কনক জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়া বৃষ্টি দেখিতে লাগিল–অস্ফুটস্বরে বলিল–আশ্চর্য্য!–আশ্চর্য্য!–লোকটা মানুষ না দেবতা? পায়ের ধুলো নিতে ইচ্ছে করছে।
এমন সময় দ্বারে ঘন ঘন করাঘাত করিয়া সুরবালা বলিল, কনকদিদি, কি করছ, শীগগির এস। বউরাণীর আবার ফিট হয়েছে।
কনক তখন দ্বার খুলিয়া বউরাণীর শয়নকক্ষের দিকে ছুটিল।
০৭. কনকলতার অভিসার
রাখাল বৈঠকখানার বাড়ীতে শয্যায় শয়ন করিয়া এপাশ ওপাশ করিতেছিল। কিয়দ্দূরে টেবিলের উপর আলো জ্বলিতেছে। বউরাণীর অবস্থা মোটেই ভাল নহে, রাত্রি দশটা অবধি সে তাহার সংবাদ পাইয়াছে। কবিরাজ ঘন ঘন অন্তঃপুরে যাতায়াত করিতেছেন।
সে মনে মনে ভাবিতেছে, এ আমি কি করিলাম? ইন্দুর শরীর যেরূপ দুৰ্বল, তাহাতে এ অবস্থায় সে এই বিষম আঘাত সহ্য করিতে পারিবে না, ইহা আমি বুঝিলাম না কেন? ইহা বুঝিবার জন্য ত বিশেস বুদ্ধিমত্তারও প্রয়োজন ছিল না–ছি ছি–আমি কি নিৰ্ব্বোধ!–কি নিৰ্ব্বোধ! ইন্দু যদি না বাঁচে, তবে আমিই ত তাহাকে হত্যা করিলাম! হত্যা বলিয়া হত্যা–একেবারেই জবাই নিষ্ঠুরতার একশেষ। স্ত্রীহত্যা করিব ইহাও কি আমার অদৃষ্টে ছিল? ছি ছি–অদৃষ্ট লইয়াই পৃথিবীতে আসিয়াছিলাম!–রাখালের চক্ষু দিয়া প্রবল অশ্রুপ্রবাহ ছুটিল–বালিসে মুখ খুঁজিয়া সে কাঁদিতে লাগিল।
কিয়ৎক্ষণ পরে কতকটা আত্মসংবরণ করিয়া ভাবিতে লাগিল–যাহা আমি আশা করিয়াছিলাম তাহা হইবার নহে। স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে। যদি ইন্দুর বিবাহকরিবার মত হইত, তবে সে আমার পত্র পড়িয়া কখনই এতদূর আঘাত পাইত না। নৈরাশ্যজনিত কতকটা দুঃখ সে পাইত বটে সন্দেহ নাই–কিন্তু আশার সূচনাও তাহার মধ্যে একটু থাকিত; কিন্তু তাহা হয় নাই। আর কেমন করিয়াই হইবে? এখানেও আমার হিসাবে ভুল। আজন্ম হিন্দু–সংস্কারের অধীন হিন্দুগৃহে প্রতিপালিতা–সে কেমন করিয়া পত্যন্তর গ্রহনের কথা মনে স্থান দিবে? কত শতাব্দী ধরিয়া যে দেশে কুলরমণীগণ, বিধবার অন্য পতিগ্রহণকে মহাপাপ বলিয়া মনে ধারণা করিয়া আসিয়াছেন, তাঁহাদের বংশে জন্মিয়া হঠাৎ কোনও রমণী কি বংশপরম্পরাগত বদ্ধমূল সে সংস্কারকে উৎপাটিত করিতে পারেন? –আমার তাহা আশা করাই বাতুলতা হইয়াছিল। আমি বাতুল নহি ত কি? –না, বাতুল হইলে ত বাঁচিয়া যাইতাম, এ দুঃসহ মৰ্ম্মযাতনার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাইতাম। –রাখাল শয্যায় উঠিয়া বসিয়া, করতলে মস্তক রাখিয়া চক্ষু মুদিত করিয়া বলিতে লাগিল, আহা যদি পাগল হইয়া যাইতাম। যদি পাগল হইতাম!
কাছারির পেটা ঘড়িতে ঢং করিয়া একটা বাজিলে রাখাল হঠাৎ চমকিয়া উঠিল। সে তখন শয্যা হইতে নামিয়া একটি জানালার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। এখান হইতে অন্তঃপুরের প্রবেশদ্বার দেখিতে পাওয়া যায়। আকাশে মেঘ আছে, তাই জ্যোৎস্না ভাল করিয়া ফুটিতে পারিতেছে না। সেই সামান্য আলোকেও রাখাল যেন অনুভব করিল, দাস–দাসীগণ মাঝে মাঝে সে দ্বারপথে যাতায়াত করিতেছে। শূন্যদৃষ্টিতে রাখাল দ্বারে পানে চাহিয়া কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল। অবশেষে শ্রান্তি অনুভব করিয়া শয্যায় ফিরিয়া আসিল। চক্ষু মুদিত করিয়া পড়িয়া রহিল, যদি নিদ্রা আসে। কিন্তু যে হতভাগ্য, নিদ্রা তাহার কাছে আসিবে কেন?
কিছুক্ষণ এইরূপে পড়িয়া থাকিবার পর রাখাল চকিত হইয়া শুনিল, তাহার বন্ধ দুয়ারে কে বাহির হইতে করাঘাত করিতেছে। বিদ্যুতের মত সহসা এই চিন্তা তাহার মনে প্রবেশ করিল–বুঝি বউরাণীর অন্তিম সময় উপস্থিত হইয়াছে, সেই সংবাদই কেহ দিতে আসিয়াছে। তৎক্ষণাৎ উঠিয়া বসিয়া জড়িত কণ্ঠে রাখাল বলিল, কে?
কোনও উত্তর নাই। দ্বারে করতাড়না পূৰ্ব্বত চলিতে লাগিল।
রাখাল তখন উঠিয়া কম্পিত করে দ্বার মোচন করিয়া সবিস্ময়ে দেখিল, এক বিধবাবেশিনী রমণীমূৰ্ত্তি। কম্পিত জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল–কে? কে তুমি?
রমণী নীরবে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া, ক্ষিপ্রহস্তে দ্বার বন্ধ করিল। পরে রাখালের দিকে ঘুরিয়া দাঁড়াইল। মাথার কাপড় পশ্চাতে একটু টানিয়া দিয়া, একগোছা চুল কাণের কাছে আসিয়া পড়িয়াছিল তাহা সরাইয়া রাখালের পানে চাহিয়া রহিল। রাখাল দেখিল রমণী যুবতী, বয়সে অনুমান বিংশতিবর্ষ, মুখখানি সৌন্দর্য্যের প্রভায় ঝলমল করিতেছে, কেবল চক্ষু দুইটি যেন একটু বিষ।
রাখাল আবার জিজ্ঞাসা করিল, তুমি–আপনি–কে?
রমণী বলিল, আমি কনকলতা।
রাখাল কনকলতার নাম জানিত, দূর হইতে একবার তাহাকে না দেখিয়াছিল এমন নয়। বলিল–ওঃ–তা কি খবর? বউরাণী কেমন আছেন?
কনক গম্ভীরভাবে বলিল, মোটেই ভাল নেই।
রাখাল রুদ্ধশ্বাসে বলিল, ভাল নেই? তবে কি– বলিয়া আর তাহার কথা বাহির হইল না; সে ফ্যাল ফ্যাল করিয়া কনকের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
কনক পূৰ্ব্ববৎ বলিল, কবরেজ জবাব দিয়েছে। রাত কাটে কিনা সন্দেহ।
এ কথা শুনিয়া রাখাল পালঙ্কের প্রান্তে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল
কনক বাতিটা উজ্জ্বল করিয়া দিল। খড়খড় করিয়া চেয়ারখানা পালঙ্কের নিকট টানিয়া, আলোকের দিকে মুখ করিয়া বসিল। প্রায় এক মিনিট কাল নীরবে থাকিয়া, অতি মিষ্ট অতি কোমল স্বরে বলিল–সে আর এখন ভাবলে কি হবে বলুন? যার অদৃষ্টে যা লেখা আছে, তাই হবে ত। সে কি কেউ খণ্ডাতে পারে? –চোখের জল ফেলবেন না, ছি আপনি ত জ্ঞানবান।
রাখাল ধীরে ধীরে মাথাটি তুলিল। জিজ্ঞাসা করিল–বউরাণী কি আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন?
না। তার কি জ্ঞান আছে?
জ্ঞান নেই? কতক্ষণ থেকে অজ্ঞান আছেন?
সেই আপনি যখন চিঠি দিয়ে বেরিয়ে এলেন–তারপর থেকে দুএকবার মাত্র খুব অল্প সময়ের জন্যে জ্ঞান হয়েছিল, নইলে বরাবরই ত অজ্ঞান রয়েছেন।
রাখাল ভাবিতে লাগিল, চিঠির কথা এ জানে দেখিতেছি। এতক্ষণ কি আর চাপা আছে, বাড়ীর সবাই জানিয়াছে সন্দেহ নাই। তা জানুক, কিন্তু কোনও গোলমাল এখনও উঠিল না কেন? বোধ হয় বউরাণীকে লইয়া সকলে ব্যস্ত–প্রাণ লইয়া টানাটানি–তাই এখনও আমার কথা কেহ ভাবে নাই; কিন্তু এ কনকলতা আসিয়াছে কি অভিপ্রায়ে?
রাখালকে চিন্তাকুল দেখিয়া কনক সান্ত্বনার স্বরে বলিল, আপনি বউরাণীকে আজ যে চিঠিখানি দিয়ে এসেছিলেন–বুঝেছেন রাখালবাবু–সে চিঠিখানি ভাগ্যিস প্রথমে আমার হাতে পড়েছিল–আমি সেখানিকে লুকিয়ে ফেলেছি।
রাখাল আশ্চর্য্য হইয়া বলিল, আপনি চিঠি লুকিয়ে ফেলেছেন কেন?
কনক চেয়ারে একটু নড়িয়া চড়িয়া একবার রাখালের পানে, একবার ভূমির দিকে চাহিয়া বিষণ্ণ স্বরে বলিল, সে চিঠি অন্য লোকের হাতে পড়লে এতক্ষণ কি রক্ষে থাকত? পুলিশে এতক্ষণ–
রাখাল বলিল, থানা পুলিশ এলে কি হত?
কি না হত? সৰ্ব্বনাশ হত। আপনাকে বেঁধে নিয়ে যেত।
যেত যেতই–তার জন্যে আপনার মাথাব্যথা কি?
কনক ঠোঁট দুখানি ফুলাইয়া অভিমানের স্বরে বলিল, মাথা থাকলেই মাথাব্যথা হয়। আপনার হাতে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যেত, তাই আমার চক্ষে দেখতে হত ত? কেন, আমার বুকটা কি পাথর দিয়ে গড়া, না লোহা দিয়ে গড়া? –শেষের দিকে কনকের কণ্ঠস্বর ভারি হইয়া আসিয়াছিল, তাহার চক্ষুযুগলও ছল ছল করিতে লাগিল।
এই সকল ভাবভঙ্গি দেখিয়া রাখালের বিস্ময় উত্তরোত্তর বর্ধিত হইয়া চলিল। জিজ্ঞাসা করিল–আপনি কি শুধু এই কথা বলতেই এখানে এসেছেন?
কনক রাখালের পানে একটি কটাক্ষবাণ হানিয়া বলিল, কেন, এসে কোনও দোষ করেছি? আপনি বিরক্ত হয়েছেন?
রাখাল এ প্রশ্ন উপেক্ষা করিয়া বলিল, এতরাত্রে কি করে এলেন?
আজ অন্দরের সব দরজাই ত খোলা রয়েছে। আমি একটা সুযোগে টুপ করে বেরিয়ে এসেছি।
রাখাল একটু বিরক্তির স্বরে বলিল, আপনার সাহস ত কম নয়!
কনক মধু ছড়াইয়া বলিল, আমাকে বারবার আপনি আপনি বলে কেন লজ্জা দিচ্ছেন? আমি ত মান্যগণ্য কেউ নই–আমি আপনার দাসী মাত্র। শেষ কথাটির সঙ্গে সঙ্গে কনক দ্বিতীয়বার রাখালের প্রতি এক বিলোল কটাক্ষ নিক্ষেপ করি না। তাহার পর মুখটি নত করিয়া বলিল–সাহস কি সাধে হয়েছে? –প্রাণের দায়ে।
রাখাল বুঝিল, ইহার মনে কোনও গুঢ় অভিসন্ধি আছে। জিজ্ঞাসা করিল–তোমার প্রাণের আবার কি দায়?
কনক কথা কহে না। তাহার মস্তক যেমন অবনত ছিল, তেমনই রহিল।
একটু অপেক্ষা করিয়া রাখাল আবার বলিল, তোমার উদ্দেশ্য কি?
আড়নয়নে রাখালের প্রতি চাহিয়া লজ্জাজড়িত স্বরে, থামিয়া থামিয়া কনক বলল, যদি–দাসীকে–চরণে স্থান দেন–এই আশায় এসেছি। আর উদ্দেশ্য কি? –বলিয়া একটি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
কথাটা শুনিয়া রাখালের পিত্তসুদ্ধ জ্বলিয়া গেল। ঘৃণায় সে মুখ অন্যদিকে ফিরাইল।
কয়েক মুহূর্ত পরে কনক কাতরকণ্ঠে বলিতে লাগিল, দেখুন, বউরাণীর কপালে যা ছিল, তা ত হল। বোধ হয় রাত পোয়াতে পোয়াতেই সব শেষ হয়ে যাবে। এত বিষয়–এ রাজার সম্পত্তি বারো ভূতে লুটে খাবে সে কি ভাল? আপনিই কেন ভোগ করুন না! আপনার ত–আপনার ত–
রাখাল মুখ ফিরাইয়া বলিল, আমার কি?
কনক মাথার কাপড় একটু সম্মুখে টানিয়া, বীণা–বিনিন্দিত কণ্ঠে বলিল, আপনার ত–বিধবা বিবাহ করতে–কোনও আপত্তি নেই।
রাখাল বিদ্রুপের স্বরে বলিল, তোমাকে নাকি?
ক্ষতিই বা কি? আমিও ব্রাহ্মণের মেয়ে–আমার বাপেরা বেশ ভাল কুলীনই ছিলেন।
রাখাল পূৰ্ব্ববৎ বলিল, সেই কুল তুমি উজ্জ্বল করতে চাও?
এই শ্লেষকে গ্রাহ্য না করিয়া কনক বলিল, আপনি যেমন ভবেন্দ্র সেজে আছেন, সেই ভবেন্দ্রই থাকবেন। কে জানবে বলুন? আমরা দুজনে রাজার হালে থাকব।
রাখাল মনে মনে বলিতে লাগিল–এ মানবী না পিশাচী? উঃ–কি অর্থলোভ! আমি যে কোনকালে ইহাকে পত্নীভাবে ভালবাসিতে পারিব, বউরাণীকে লিখিত আমার চিঠি পড়ার পর সে আশা অবশ্য ইহার নাই। কেবল মাত্র বিষয়ের লোভে ধৰ্ম্মে জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত হইয়াছে। উঃ কি শয়তানী!
রাখালকে নীরব দেখিয়া কনক কটাক্ষ হানিয়া বলিল, একটা উত্তর দিন। দাসীকে চরণে রাখবেন কি? ।
দন্তে দন্তে চাপিয়া, কঠোরস্বরে রাখাল বলিল, ইচ্ছে করছে, তোমায় চিৎ করে ফেলে তোমার গলাতেই চরণ দুখানি রাখি। একটা স্ত্রীহত্যা করেছি–লোভ হচ্ছে–আরও একটা না হয় করি–যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন।
কনক উঠিয়া দাঁড়াইল। মুহূর্ত মধ্যে অভিনেত্রীর ভাবভঙ্গি সমস্তই পরিবর্তিত হইয়া গেল। কমনীয় কণ্ঠে বলিল–রাখালবাবু–আমারও যে সে লোভ না হচ্ছে তা নয়। যদি তা করেন, ঐ পা দুখানি যদি আমার গলায় চেপে আমার এ ব্যর্থ কলঙ্কিত জীবন শেষ করে দিতে পারেন, তাহলে বোধ হয়, আমি যে আমি–আমিও উদ্ধার হয়ে যাই। কিন্তু সে সব কাব্য–সে হবার নয়। দিন–আমি আপনার পায়ের ধূলো নেব। আমার প্রগল্ভতা ক্ষমা করবেন। –বলিয়া কনক ক্ষিপ্ৰকরে রাখালের পদযুগল স্পর্শ করিল।
কনকের এই অভিনয় আচরণ দেখিয়া রাখাল অবাক হইয়া গিয়াছিল। তাহাকে বিস্ময়ের অবসর না দিয়া কনক বলিতে লাগিল–আপনার সেইচিঠি পড়ে অবধি আপনার পায়ের ধূলো নেবার জন্যে আমি ছটফট করছিলাম। মানুষ যে এমন সাচ্চা, এমন ত্যাগী হতে পারে, তা আমার ধারণাই ছিল না। আমি আপনাকে প্রেম জানাতে আসিনি রাখালবাবু, ভক্তি জানাতেই এসেছিলাম; কিন্তু অঙ্গারঃ শতধৌতেন–তার ময়লা যাবে কোথা বলুন? –ওরই মধ্যে দুষ্টামি বুদ্ধিও এল, ভাবলাম একটুখানি অভিনয় করে নিই। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, আমি নিষ্ঠাবতী হিন্দু বিধবা–টিধবা কিছুই নই–আমি একজন অভিনেত্রী। মুখে রঙ মেখে কলকাতার পেশাদারী থিয়েটারের ষ্টেজে দাঁড়িয়ে। প্রেম করে করে আর প্রেমের গান গেয়ে গেয়ে আমার মুখে রক্ত উঠে গেছে রাখালবাবু! আমার প্রকৃত পরিচয় এখানে কেউ জানে না–আজ আপনি জানলেন। আপনি যেমন সেজে এসেছেন, আমিও তাই।
রাখাল বলিল, আপনি সেজে এসেছেন? কেন?
আমার অদৃষ্টের দোষ। সে অনেক কথা রাখালবাবু–অবসর পাই ত অন্য কোন সময় বলব। আর অদৃষ্টের দোষই বা কেন বলি? বরং গুণই বলা উচিত। আপনার মত লোক যে পৃথিবীতে আছে–এখানে না এলে ত জানতে পারতাম না। আমি এখানে আর বেশীদিন থাকব না; কিন্তু যে কদিন আছি, আপনার কোনও উপকার যদি করতে পারি–আমি করব। এখন আসি তবে, প্রণাম।
রাখাল কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে কনকের পানে চাহিল। বলিল–একটু বসুন। বউরাণীর কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি।
কনকলতা আবার উপবেশন করিল।
রাখাল বলিল, চিঠিখানি আপনার হাতে কি করে পড়ল?
যে অবস্থায় চিঠি কনকের হস্তগত হইয়াছিল তাহা সে বর্ণনা করিল।
রাখাল বলিল, তারপর দুএকবার যে বউরাণীর জ্ঞান হয়েছিল, তখন আপনি কাছে ছিলেন?
ছিলাম।
তিনি কি বললেন তখন?
বিশেষ কিছুই বলেন নি।
রাখাল সঙ্কোচের সহিত জিজ্ঞাসা করিল, আমার উপর কি খুব বিরক্ত হয়েছেন বলে বোধ হল?
কনক গম্ভীরভাবে বলিল, রাখালবাবু, সে কথা জিজ্ঞাসা করা বৃথা। জ্ঞান হলে চিঠিখানার খোঁজ পৰ্য্যন্ত তিনি আর করেন নি।
রাখাল একটি দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করিল।
কনক বলিতে লাগিল, এখন সে সব আর ভেবে কি হবে বলুন? আপনি যে শেষরক্ষে করেছেন–এজন্যে বউরাণী নিশ্চয়ই আপনার উপর খুব কৃতজ্ঞ। এখন ভাগ্যে ভাগ্যে যদি তিনি বেঁচে ওঠেন তাহলেই মঙ্গল। আপনি এখন কি করবেন?
রাখাল বলিল, আমি এখান থেকে চলে যাব। বউরাণীর জীবনের আশঙ্কা নেই–এই সংবাদটুকু জানতে পারলেই আমি চলে যাই।
কোথায় যাবেন?
কিছুই স্থির করিনি। যে দিকে দুচক্ষু যাবে।
কনক বলিল, রাখালবাবু আমার একটি অনুরোধ রাখবেন?
কি বলুন।
যাবার পূর্বে আমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাবেন।
কেন?
বিশেষ কারণ আছে।
কি কারণ?
সে তখন বলব। এখন এইমাত্র বলি, যদি আমার সঙ্গে দেখা না করেই চলে যান, তবে না জেনে আপনি একটা মানুষের সর্বনাশ করে ফেলবেন। অথচ সে নির্দোষ। আমায় কথা দিন যে আমার সঙ্গে দেখা না করে যাবেন না।
রাখাল ধীরে ধীরে বলিল, এর মধ্যে কি গুঢ় রহস্য আছে, আমি ত কিছুই বুঝিতে পারছিনে। আচ্ছা, আপনি যখন অত করে বলছেন, তখন তাই হবে।
কনক উঠিল। বলিল–এখন আসি তবে, প্রণাম।
রাখালও উঠিয়া দাঁড়াইল। কনকের পশ্চাৎ পশ্চাৎ দ্বার অবধি গিয়া বলিল–এখন গিয়ে বউরাণীকে কেমন দেখেন, রামাকে দিয়ে বলে পাঠাবেন?
আচ্ছা–পাঠাচ্ছি। –বলিয়া কনক চলিয়া গেল।
কিয়ৎক্ষণ পরে রামা আসিয়া সংবাদ দিল, রাত্রি দুইটার সময় বউরাণী জাগিয়াছিলেন। কথাবার্তা কহিয়াছেন, দুগ্ধপান করিয়াছেন–এখন আবার ঘুমাইতেছেন।
এই সংবাদ শুনিয়া রাখালের মন কতকটা সুস্থির হইল। কনকের সহিত কথোপকথন, তাহার কর্তৃক সেই গূঢ় রহস্যের ইঙ্গিত প্রভৃতি ভাবিতে ভাবিতে শেষ রাত্রিতে সে ঘুমাইয়া পড়িল।
০৮. নবাবে নবাবে
প্রভাত হইলে রাখালের নিদ্রাভঙ্গ হইল। সে তখন শয্যাত্যাগ করিয়া ছাদে গিয়া বেড়াইতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে মুখাদি প্রক্ষালন করিয়া আসিয়া শুনিল বউরাণী জাগিয়াছেন, ভাল আছেন, ঔষধ পান করিয়াছেন, কবিরাজ বলিয়াছেন আর কোন আশঙ্কা নাই।
ইহার অল্পক্ষণ পরে একজন ঝি আসিয়া বলিল, রাণীমা তাহাকে স্মরণ করিয়াছেন।
রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, বউরাণী কি করছেন?
সুরোদিদি তাঁর কাছে আছেন, তারই সঙ্গে কথাবার্তা কইছেন।
সুরবালা নামী এক অনাথা ব্রাহ্মণ কন্যা অন্তঃপুরে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া আছে, ইহা রাখাল জানিত; কিন্তু তাহাকে চক্ষে কখনও দেখে নাই। সে ইহাও জানিত, সুরবালা বউরাণীর একজন প্রিয়পাত্রী।
রাখাল অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতেই রাণীমা বলিলেন, হ্যা বাবা, তোর মুখ চোখ এ কি হয়ে গেছে? রাত্রে ঘুমুসনি বুঝি?
রাখাল কোনও উত্তর করিল না। নতনেত্রে দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার চক্ষু দিয়া ফোঁটা ফোঁটা করিয়া জল পড়িতে লাগিল।
রাণীমা বলিলেন, ভবেন, কাদিসনে কাঁদিসনে। তোর চোখে জল দেখলে আমার বুক যে ফেটে যায় বাবা! রাত দুপুরের পর থেকে আর ফিট হয়নি, তখন থেকে বউমা ভালই আছেন। ভয় কি? কবরেজ বলে গেছেন আর কোনও ভয় নেই। কাল রাত্রে তুই কি খেলি না খেলি কিছুই আমি দেখতে পারিনি। যা স্নান করে আয়, আমি তোর আহ্নিকের যোগাড় করে রাখি। আহ্নিক করে একটু জল মুখে দে। যাবি, বউমাকে এখনি দেখবি?
রাখাল নীরবে মাথা নাড়িল।
স্নান আহ্নিক সারিয়া জলযোগান্তে রাখাল যখন বাহিরে আসিল, তখন নয়টা বাজিয়াছে। বৈঠকখানা বাড়ীর নিকটস্থ হইয়া দেখিল, বারান্দায় বেঞ্চিখানির উপর খগেন্দ্রনাথ বসিয়া আছে। তাহার গায়ে ইংরাজি সাইক্লিং পোষাক, মাথায় সোলা হ্যাঁট। বাইসিক্লখানি বারান্দার নিয়ে রাখা রহিয়াছে। রাখালকে দেখিবামাত্র সে উঠিয়া দাঁড়াইল, টুপী খুলিয়া বলিল–নমস্কার মশায়।
রাখাল বলিল, নমস্কার। আপনি হঠাৎ যে? কোথা থেকে?
কলকাতা থেকে আসছি। আপনার কাছে একটা বিশেষ কার্য আছে।
কায় আছে? আচ্ছা বেশ–স্নান–টান করুন, জল খান। তার পর কাযের কথা হবে এখন।
খগেন্দ্র বলিল, আজ্ঞে না। বিশেষ জরুরি কায। আমায় আবার বিকেল তিনটের গাড়িতেই ফিরতে হবে। কথাটা সেরে ফেলাই যাক না।
লোকটার ভাব দেখিয়া রাখাল মনে মনে একটু বিরক্ত হইল। ভাবিল, ভগিনী ত থিয়েটারের অভিনেত্রী–ইনি আসিয়াছেন যেন একটি নবাব। বলিল–আচ্ছা, অপেক্ষা করুন, আমার অবসর হলে আপনাকে ডেকে পাঠাব। –বলিয়া রাখাল সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া গেল।
খগেন্দ্র মনে মনে বলিল–ছিলেন ত রেলের কেরাণী–পঁচিশ মুদ্রা বেতন। এখানে আসিয়া নবাব হইয়াছেন। নবাবী শীঘ্রই ভাঙ্গিয়া দিতেছি।
খগেন্দ্র সেখানে বসিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল এবং মাঝে মাঝে পকেট হইতে ঘড়ি খুলিয়া দেখিতে লাগিল। অর্ধ ঘণ্টা হইয়া গেল, বাবু ডাকাইয়া পাঠাইলেন না। তখন খগেন্দ্ৰ আপন মনে বলিয়া উঠিল, ড্যাম্। আমি কিসের জন্যে এখানে বসে উমেদারী করি? উমেদার আমি, না ঐ রাস্কেল? নিজেই যাই–থোড়াই কেয়ার করি। –বলিয়া খটমট শব্দে বুটের আওয়াজ করিতে করিতে খগেন্দ্র সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া গেল।
রাখাল তাহার শয়নকক্ষে খোলা জানালার কাছে একখানি ঈজিচেয়ার টানিয়া বসিয়া আকাশ পাতাল চিন্তা করিতেছিল। হঠাৎ জুতার শব্দে চমকিয়া দ্বারের পানে চাহিয়া দেখিল।
খগেন্দ্র প্রবেশ করিয়া ব্যঙ্গস্বরে বলিল, ভারি ব্যস্ত আছেন নাকি? –বলিয়া একখানা চেয়ার টানিয়া উপবেশন করিল।
বিরক্তিতে ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া রাখাল বলিল, আপনি কি চান?
পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া হাতে ঘুরাইতে ঘুরাইতে খগেন্দ্র বলিল, আমার কিছু টাকার প্রয়োজন।
রাখাল বলিল, তা, আমার কাছে কেন? আপনার ভগ্নীর বেতন বাবদ যদি কিছু বাকী থাকে, আপনার ভগ্নীকে গিয়ে বলুন। দেওয়ানজি নেই, নায়েব দেওয়ান আছেন–তিনি হিসাব করে দেবেন এখন।
খগেন্দ্র মনে মনে বলিল, নবাব!–প্রকাশ্যে বলিল, আজ্ঞে না–ভগ্নীর বেতনের হিসাব নয়। আপনার কাছেই কিছু পাবার আকাঙ্ক্ষা রাখি। বেশী নয়, উপস্থিত এক লক্ষ টাকা, আর মাসে মাসে বেঙ্গল ব্যাঙ্কের উপর দুহাজার টাকার একখানি করে চেক। এই হলেই হবে।
বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে রাখাল খগেন্দ্রের মুখের পানে চাহিল। শেষে বলিল–নেশাটেশা কিছু করেন?
করতাম। এদানি টাকার অভাবে আর বড় পারিনে। একবোতল জনিওয়াকার ত আমার জলযোগ ছিল। নেশা করে আপনার কাছে আসিনি, দিব্যি শাদা চোখেই এসেছি। টাকাটা চট পট বের করুন দেখি। এক লক্ষ টাকার কোম্পানির কাগজ যদি মজুদ থাকে, তবে তাই এণ্ডোর্স করে দিন। কিম্বা ব্যাংকের উপর চেক্ হলেও চলতে পারে, কলকাতায় গিয়ে আমি ভাঙ্গিয়ে নেব এখন।
রাখাল বলিল, আপনাকে আমি টাকা দেব কেন?
খগেন্দ্ৰ হা হা করিয়া হাসিয়া বলিল, আমি যে আপনার ভাই হই। –পরে স্বর নামাইয়া বলিল, আপন ভাই নই–মাসতুতো ভাই। অর্থাৎ চোরে চোরে যা হয়। এত বড় বিষয়টা একলা একলাই খাবেন মশায়–মাসতুতো ভাইকেও কিছু বখরা দিন। সমস্ত বিষয় স্বচ্ছন্দে ভোগ করুন; আমি কেবল নগদ এক লক্ষ আর মাসে মাসে দুহাজার পেলেই সুন্তুষ্ট থাকব। এখন বাঙ্গলা কথাটা বুঝলেন?
রাখাল বলিল, বাঙ্গলা কথাটা কি?
কথাটা এই যে, আপনি মোটেই ভবেন্দ্র চাটুয্যে নন, আপনি রাখাল ভটচায্যি–খুস্রুপুরে ঘকাঘট করে টেলিগ্রাপ করতেন, ঘটাঘট করে টিকিট বেচতেন, ট্রেণ এল ছেঁড়া জুতো ফটাফট্ করে ট্রেণ পাস করতে প্ল্যাটফর্মে ছুটতেন। এখন বুঝলেন ত? না আরও টীকে আবশ্যক?
রাখাল বলিল, এসব আপনি জানলেন কি করে?
খগেন্দ্ৰ বুক চিতাইয়া বলিল, বিস্তর পরিশ্রম করে, বিস্তর অর্থব্যয় করে।
রাখাল বলিল, তবে আপনার পরিশ্রম অর্থব্যয় বৃথা হয়েছে।
কারণ?
কারণ আপনি টাকা পাবেন না। খগেন্দ্র
একটুকু না দমিয়া বলিল, টাকা পাব না?
না।
খগেন্দ্র কয়েক মুহূর্ত কি ভাবিল। শেষে বলিল–রাখালবাবু, আপনি বোধ হয় মনে করছেন সব ফাঁকা আওয়াজ? তা নয় মশায়। বোধ হয় ভাবছেন, আমি এত বড় সম্পত্তিটার মালিক, ও কোথাকার কে, ও আমার কিই বা করতে পারবে, সাক্ষী সাবুদই। বা পাবে কোথা। মশায়, আমরা কলকাতার লোক, কাঁচা কায করিনে। প্রমাণ সাক্ষী সাবুদ সমস্তই মজুত। আমি আপনার ময়নামতীতে গিয়েছিলাম, বসন্তপুরে গিয়েছিলাম, খুস্রুপুরে গিয়েছিলাম–আর আপনি যেখানে কখনও যান নি–সেই তিনতারিয়া মঠে অবধি গিয়েছিলাম। খুসুপুরের আপনার সিগন্যালম্যান, পানিপাড়ে, দুজন খালাসী–এরা ছুটী নিয়ে এসেছে। কলকাতায় আমার বাড়ীতে বসে ডালরুটির শ্রাদ্ধ করছে। তারা সনাক্ত করবে আপনি তাদের ভূতপূৰ্ব্ব ছোটবাবু রাখাল ভটচায্যি। তিনতারিয়া মঠের চারজন সন্ন্যাসীকেও এনেছি–গোঁসাই লছমন গির, ভৈরো গির, বাসদেও গির আর দামোদর গির। তাদের গাঁজার গন্ধে বাড়ীতে আমার টেকা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তারা আপনাকে দেখে বলবে, আপনি তাদের ভূতপূৰ্ব্ব মোহন্ত ভজনানন্দন গির ২০১ নন। সাক্ষীগুলিকে টাকা দিয়ে মশায় যে ভাঙ্গিয়ে নেবেন, সে পথ রাখিনি। আমার বাড়ীর দরজায় চারজন দরোয়ান অষ্টপ্রহর পাহারা দিচ্ছে। –সমস্ত এখন শুনলেন। ত? –টাকাটা চটপট বের করুন দেখি। নয় ত বলুন, কৃষ্ণনগরে গিয়ে পুলিশ সাহেবের কাছে সব ব্যাপারটা কাল বলি। এখানে পিনাল কোড আছে? না থাকে ত দেওয়ানজির সেরেস্তা থেকে আনিয়া ৪১৯ ধারাটা দেখুন দেখি!
রাখাল তাচ্ছিল্যের সহিত বলিল, দেখেছি।
দেখেছেন ত? তিনটি বচ্ছর শ্রীঘর। এখন আপনার মতটা বদলাল কি?
রাখাল হাই তুলিয়া বলিল, না। –আপনি টাকা পাবেন না। আমায় মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছেন। আমি কালই বউরাণীর কাছে সকল কথা প্রকাশ করেছি।
ইহা শুনিয়া খগেন্দ্র আকাশ হইতে পড়িল। বলিল–আঁ? প্রকাশ করেছেন?
হ্যাঁ। আপনার–ভগ্নীই হোন আর যেই হোন–সেই কনকলতাকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন। –বলিয়া ভৃত্যকে ডাকিল। ভৃত্য আসিলে বলিল–বাবুকে নীচে নিয়ে যা–স্নান–টানের বন্দোবস্ত করে দিগে। আর যদি ওঁর বোনের সঙ্গে দেখা করতে চান, অন্দরে ঝিকে ডেকে রাণীমার কাছে এত্তেলা পাঠিয়ে দিস।
০৯. খগেন্দ্র প্রতিশোধ লইল
নামিয়া বারান্দায় আসিয়া খগেন্দ্র ধপাস্ করিয়া বেঞ্চিখানার উপর বসিয়া পড়িল। ভৃত্য একবাটি তৈল আনিয়া বলিল, বাবু, কিছু কাপড়–চোপড় আছে, না আমলাদের কারু কাছ থেকে একখানা ধুতি চেয়ে আনব?
খগেন্দ্র বলিল, ধুতি চাইনে।
ভৃত্য বলিল, তবে চান করবেন কি করে?
স্নান করব না।
খগেন্দ্রের মুখভাব দেখিয়া ভৃত্য কিঞ্চিৎ বিস্মিত ও ভীত হইল। একটু চুপ থাকিয়া আবার বলিল–তবে জলখাবার আনিয়ে দিই?
খগেন্দ্র মাথা ঝাঁকিয়া বলিল, নাঃ।
ভৃত্য মনে করিল, আর কিছু নয়, বাবু ইহাকে বোধ হয় খুবই অপমান করিয়াছেন, মনের সেই খেদে স্নান অথবা জলযোগ কিছুই করিতে চাহিতেছে না। এদিক ওদিক ঘুরিয়া বলিল–আপনার ভগ্নীর সঙ্গে দেখা করবেন কি? এত্তেলা পাঠাব?
পাঠা। –বলিয়া খগেন্দ্র অন্যমনস্ক হইল। ভূত্য চলিয়া গেল।
তখন খগেন্দ্র তাহার কোটের ভিতর দিককার বুকপকেট হইতে একটি রৌপ্য নির্মিত ফ্ল্যাস্ক বাহির করিল। ইহার মধ্যে ব্র্যাণ্ডি ভরা ছিল। ভ্রু ঘুরাইয়া ফ্লাস্কের মুখটি খুলিয়া সেই নির্জলা সুরা দুই তিন ঢোক পান করিল। ফ্ল্যাস্কটি আবার পকেটে রাখিয়া, গালে হাত দিয়া চিন্তা আরম্ভ করিল।
বড় আশা করিয়াই সে আসিয়াছিল, তাহার বহুদিনের আশা আজ চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছে। একে নৈরাশ্যের বেদনা, তাহার উপরে খালি পেটে ব্র্যাণ্ডির প্রভাব–সে ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া উঠিল। রাখাল কি অভিপ্রায়ে যে বউরাণীর নিকট সকল কথা প্রকাশ করিয়াছে, তাহা খগেন্দ্র কিছুই অনুমান করিতে পারে নাই এবং সে বিষয়ে চিন্তা করিবার শক্তিও তাহার মস্তিষ্কে এখন নাই। তাহার নাক ও কাণ হইতে আগুন ছুটিতে লাগিল; কিন্তু বুকের ভিতরটা ঠাণ্ডা হিম হইয়া উঠিতেছে। সুতরাং ফ্ল্যাস্কটি বাহির করিয়া খগেন্দ্র আরও কিঞ্চিৎ পান করিল।
অল্পক্ষণ পরেই তাহার ইচ্ছা হইতে লাগিল, কাছারির প্রাঙ্গণে খানিক ছুটিয়া বেড়ায়। বুদ্ধিও যোগাইল, কিন্তু লোকে তাহা হইলে ভাবিবে তাহার নেশা হইয়াছে, অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতে দিবে না, কনকের সহিত সাক্ষাৎ হইবে না।
এইরূপ অবস্থায় প্রায় কুড়ি মিনিট কাটিলে, ভৃত্য ফিরিয়া আসিয়া বলিল, বাবু আসুন।
খগেন্দ্র উঠিয়া টলিতে টলিতে, ভূতের সঙ্গে সঙ্গে চলিল।
পূৰ্ব্বপরিচিত অন্তঃপুর কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করিয়া খগেন্দ্র দেখিল, কনকলতা তাহার জন্য অপেক্ষা করিতেছে। চেয়ারে গিয়া বসিয়া উৰ্দ্ধদৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করিল–কনক, কি খবর?
কনক শঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি অমন হয়ে গেলেন কেন? –আপনার কি হয়েছে?
খগেন্দ্র বলিল, তুমি জান না?
না।
তবে কি বিলকুল মিথ্যে কথা নাকি? আমার সঙ্গে ধাপ্পাবাজি করলে?
কে?
কে আবার। তোমাদের ঐ রাখাল।
তার সঙ্গে দেখা হয়েছে? কি বলেছেন তিনি?
আমি এসে তার কাছে টাকা চাইলাম। না দিলে সব প্রকাশ করে দেব বললাম। সে বললে, আমি কাল বউরাণীর কাছে নিজেই সব প্রকাশ করে দিয়েছি। এ কথা কি। সত্যি না মিথ্যে?
কনক বলিল, সত্যি।
খগেন ফ্লাস্ক বাহির করিয়া আর একটু পান করিয়া বলিল, বাড়ীর সকলে শুনে কি বলছে?
বাড়ীর কেউ এখনও জানে না; শুধু বউরাণী জানেন। কিন্তু আপনি এখন খালিপেটে ব্র্যাণ্ডি খাচ্চেন কেন?
রত্নদীপ খগেন্দ্র বলিল, ব্রাণ্ডি মোদের রাজাঃ। একটু খাবে?
কনক বলিল, না–না–আপনিও খাবেন না। ভদ্রলোকের বাড়ীর মধ্যে এ সব কি?
ওঃ। –বলিয়া খগেন্দ্র চক্ষু মুদ্রিত করিল। প্রায় দুই মিনিট কাল পরে নিজ মস্তকের উপরিভাগে সঘন কর–সঞ্চালন করিতে করিতে, খিল খিল করিয়া আপন মনে হাসিতে লাগিল।
তাহার ভাব দেখিয়া কনক বলিল, ওকি করেন? বাড়ীর লোকে মনে করবে কি?
খগেন্দ্র চক্ষু বুজিয়া বলিতে লাগিল, প্রথমটা–আমারই বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছিল–হা হা হা। দেখ, প্রথম যখন রাখাল আমায় ঐ কথা বললে–হা হা–তখন হা হা, ভেবে নিলাম–ও হঠাৎ সাধু হয়ে, বুঝেছ কনক, সমস্ত পরিত্যাগ করে যাবার মলব করেছে। এখন তোমার কথা শুনে তবে না স্পষ্ট বুঝতে পারছি ওর চালাকি!–হা হা–খেলাটা–খেলেছে ভাল।
কনক জিজ্ঞাসা করিল, কি খেলা?
কি খেলা তুমি জান না? বুঝতে পারছ না? স্ত্রীবুদ্ধি আর কত হবে! হা হা হা! ও ভাবলে কি বুঝেছ–ভাবলে–একদিন না একদিন আমার এ জাল ত ধরা পড়েই যাবে–তখন আমার কি হবে? দেখলে বউরাণী ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্চে। হা হা–মাছ বড়শী গিলেছে–আর যায় কোথা? এখন যদি বউরাণী শোনে ও ভবেন্দ্র নয়–তা হলেও বউরাণী ওকে আর ঠেলতে পারবে না। কি বল কনক? হা হা। তাই স্থির করলে, বউরাণীকে সকল কথা বলে, বিধবা বিবাহ হোক সিভিল ম্যারেজ হোক–একটা কিছু করে রাখি। –এসব কথা চাপা থাকে বহুৎ আচ্ছা। –প্রকাশ হয় ড্যাম্ কেয়ার। উঃ–কি বুদ্ধি–কি বুদ্ধি!–বলিয়া খগেন্দ্র ধীরে ধীরে মাথাটি নাড়িতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ এইরূপ করিয়া বলিল, আচ্ছা! আচ্ছা! যাবেন কোথা? বউরাণীকে হাত করেছেন–কথাটা প্রকাশ হলে না হয় জেলে যাবার কি অর্ধচন্দ্র খাবার ভয়ই রইল না, কিন্তু কলঙ্ক? বউরাণীর একটা কলঙ্ক কি হবে না? –কি বল কনক? আমি ফের যাচ্ছি। রাখালের কাছে। গিয়ে বলছি, তো–তোমার সব মঃ–মলবই আমি বুঝেছি। টাঃ–টাকা দেবে ত দাও–নইলে সব প্রকাশ করে দেব। সিভিল ম্যারেজই কর, আর বিধবা বিবাহই কর, গিয়ে বঃ–বঙ্গবাসীতে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ অ্যাসা ছড়া কাটতে আরম্ভ করব, যে বাপ বাপ বলে দেঃ দেশ থেকে পালাতে হবে। সহজে ছাড়ছিনে বাবা!–সহজে ছাড়ছিনে। কিন্তু কনকতুঃ –তুমি ভাই–কোনও কঃ–কর্মের নও। সেই ত বউরাণী বিঃ–বিধবা বিবাহে রাজি হল–আমার তরফ থেকে ত রার–রাজি করতে পারলে না। –বলিয়া খগেন্দ্র মাথাটি নাড়িয়া নাড়িয়া মুদিত নেত্র করিয়া গান ধরিল–ভেঁচে থাক ভিদ্যেসাগর–ছিরজীবী হয়ে থুমি।
খগেন্দ্রের অবস্থা দেখিয়া কনক ভীত হইয়া পড়িল। সে তাহার স্কন্ধে হস্তাৰ্পণ করিয়া বলিল, খগেনবাবু–ও খগেনবাবু।
খগেন্দ্র যেন সুপ্তোত্থিতের ন্যায় চক্ষু খুলিয়া বসিল, খি?
আপনি অমন করছেন কেন?
খেন–খি খরেছি?
আপনার ভয়ানক নেশা হয়েছে। আবোল তাবোল বকছেন।
খি আবোল তাবোল বকছি? হুঁ।
কনক বলিল, আপনি ও সব মৎলব পরিত্যাগ করুন। রাখালবাবুর কাছে আর যাবেন না। টাকা পাবার আপনার আর কোন আশা নেই।
খোনও–আশা হ্নেই?
না।
খেন হ্নেই?
সে অনেক কথা–এখন শুনলে আপনি বুঝতেও পারবেন না। আপনার শরীর ভাল নেই। এখন বাইরে যান, স্নান করে খেয়ে একটু ঘুমুন। ও বেলা আবার কথাবার্তা হবে।
খগেন্দ্র দাঁড়াইয়া উঠিল। তাহার চক্ষু দুইটা লাল টক্ টক্ করিতেছে–আগুনের মত জ্বলিতেছে। জিজ্ঞাসা করিল–হামার–খোন–আশা–হ্নেই?
কনক সভয়ে একটু সরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, না।
খগেন্দ্র হঠাৎ উন্মত্তের ন্যায় লম্ফ দিয়া, তাহাকে এক ধাক্কা দিল। কনক ভূতলশায়িনী হইল। অভিনেতার ভঙ্গীতেফাপীয়সী এই হোর শাস্তি। –বলিয়া খগেন্দ্র সেখান হইতে টলিতে টলিতে বাহির হইল। সিঁড়ি নামিয়া, অঙ্গনের মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া, দুই হস্তে তেঁড়রা বাজাইবার সঙ্কেত করিয়া ভাঙ্গা গলায় চীৎকার করিয়া বলিল–তেরে দুম–তেরে দু তেরে দুম–ভাই সকল, কে কোথায় আছ। ঘ্রবণ কর। ও ভবেন্দ্র নয়–ভবেন্দ্র নয়–ভবেন্দ্র নয়। ও রাখালও রাখাল; আর তোমাদের ঐ সুরবালাও রাখালের স্ত্রীরররী। –বলিয়া টলিতে টলিতে খগেন্দ্র অন্তঃপুর হইতে বাহির হইল, টলিতে টলিতে কাছারি বাড়ীর প্রাঙ্গন পার হইয়া রাস্তায় গিয়া পড়িল।
তাহার অবস্থা দেখিয়া গ্রামবাসীরা সন্ত্রস্থ হইয়া পথ ছাড়িয়া দিল। পল্লীবালকেরা নিরাপদ ব্যবধান হইতে হাততালি দিয়া বলিতে লাগিল, ওরে মাতাল সাহেব দেখবি আয়। –কিন্তু খগেন্দ্র কোনও দিকে দৃকপাত মাত্র না করিয়া, অনাবশ্যক পদঘর্ষণে ধূলা উড়াইতে উড়াইতে স্টেশন অভিমুখে চলিল।
বাইসিক্লখানি কথা তাহার মনে পড়িল না।
১০. রাণীমার হুকুম
আজ প্রাতঃকাল হইতে বউরাণী ভাল আছেন–ঔষদ পথ্যাদি সেবন করিয়াছেন। কিন্তু অন্তরের মধ্যে তিনি যে দুঃসহ যাতনা ও লজ্জা অনুভব করিতেছিলেন, ঘুণাক্ষরেও তাহা কাহারও নিকট প্রকাশ করেন নাই। রাণীমা প্রভৃতির ধারণা, শারীরিক দোৰ্ব্বল্যের জন্যই হঠাৎ তিনি ওরকম মূর্হিত হইয়াছিলেন। কনক আজ মাঝে মাঝে বউরাণীমার সহিত একা ছিল বটে, কিন্তু স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ও প্রসঙ্গ উত্থাপন করে নাই, বউরাণীও তাহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেন নাই। কনক দেখিল চিঠিখানি কি হইল, কাহার হাতে পড়িল, এ সকল সম্বন্ধে তাহার বিন্দুমাত্রও উৎকণ্ঠা বা কৌতূহল নাই।
কনক যখন কক্ষান্তরে খগেন্দ্রের সঙ্গে কথাবার্তা কহিতেছিল, বউরাণী তখন বালিসে হেলান দিয়া শয্যায় বসিয়া, করতলে কপোল রাখিয়া, আকুল নয়নে নিজ অদৃষ্ট বিড়ম্বনার কথা চিন্তা করিতেছিলেন। চিন্তার কূল কিনারা নাই। ভাবিতেছিলেন, জন্মান্তরে আমি না জানি কি মহাপাপ করিয়াছিলাম, যাহার জন্য এ শাস্তি, এ কলঙ্ক আমায় ভোগ করিতে হইল। তাহার চক্ষু এখন শুষ্ক। বুকের ভিতর খাণ্ডবদহন–চোখের জল মরিয়া গিয়াছে।
সিঁড়ি দিয়া খগেন্দ্র যখন নামিতে লাগিল তখন তাহার বুটের প্রবল শব্দ বউরাণীর কাণে গেল। এই অপরিচিত শব্দে তিনি চমকিয়া উঠিয়া সেই দিকে কাণ দিয়া রহিলেন। শব্দ ক্রমে নীচে নামিল। তাহার পর অঙ্গন হইতে সেই বীভৎস চীৎকার–প্রত্যেক কথাটি বউরাণীর কাণে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীতে একটা সোরগোল উঠিল তাহাও তিনি অনুভব করিলেন। অপমান ও ধিক্কার তাহার চারিদিকে বেড়া-আগুনের মত যেন নূতন তেজে জ্বলিয়া উঠিল। মাথা ঝিম্ ঝিম্ করিতে লাগিল–চেতনা লুপ্ত হইল–তিনি শয্যার উপর মূর্হিত হইয়া পড়িলেন। কেহ তাহা দেখিতে পাইল না–জানিল না।
ওদিকে খগেন্দ্র প্রস্থান করিবামাত্র অঙ্গনে অন্তঃপুরিকাগণ সমবেত হইয়া পরস্পর। মুখ চাওয়া–চাওয়ি করিতে লাগিল। পূজার ঘর হইতে রাণীমা আলুথালুবেশে ছুটিয়া আসিলেন। যাহাকে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন–কি বলে গেল? –কণকের ভাই ও কি বলে গেল? –রাণীমার কাণেও খগেন্দ্রের সকল কথা প্রবেশ করিয়াছিল; কিন্তু নিজের কাণকে তিনি যেন বিশ্বাস করিতে পারিতে ছিলেন না। এমন সৰ্ব্বনাশের কথা কি সহসা বিশ্বাস হয়?
কেহ রাণীমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। তখন তিনি রুদ্ধশ্বাসে বলিতে লাগিলেন, কোথায় কনক কোথায়? সুরবালা কোথায়?
একজন রমণী একটা কক্ষের দিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করিয়া বলিল, সুরবালা ঐ ঘরে আছে।
রাণীমা তখন পাগলিনীর মত সেই কক্ষে গিয়া প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন সুরবালা দেওয়াল ধরিয়া দাঁড়াইয়া আছে–কাঁদিতেছে।
রাণীমা দুই চক্ষু কপালে তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, সুরো–সুরো–ও আমার ভবেন নয়?
সুরবালা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, না।
ও তোমার স্বামী?
হ্যাঁ। –বলিয়া সুরবালা ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতে লাগিল।
রাণীমা তখন বাহিরে আসিয়া ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। হাঁফাইতে হাঁফাইতে বলিতে লাগিলেন–কনক? –কনক কই?
একজন ছুটিয়া উপরে গিয়া কনককে ডাকিয়া আনিল। তাহাকে দেখিবামাত্র রাণীমা বলিলেন, হ্যা কনক, তোমার দাদা উঠানে দাঁড়িয়ে কি বলে গেল বাছা?
কনক কোনও উত্তর না দিয়া অবনতমুখে রহিল।
রাণীমা বলিলেন, যে এসেছে ও কি আমার ভবেন নয়?
কনক স্পষ্ট বলিল, না।
ও সুরবালার স্বামী?
হ্যাঁ।
রাণীমা কপালে করাঘাত করিয়া বলিলেন, হা জগদীশ্বর!–বলিয়া ছিন্নমূল তরুর ন্যায় কাঁপিতে কাপিতে সেইখানে লুটাইয়া পড়িলেন।
ওদিকে বহিৰ্ব্বাটীতেও এ সংবাদ পৌঁছিতে বিলম্ব হয় নাই। খগেন্দ্র টলিতে টলিতে কাছারির প্রাঙ্গণ পার হইবার এক মিনিট পরেই আমলাদের নিকট সংবাদ পৌঁছিল। নায়েব–দেওয়ান কালীকান্তবাবু তখনও কাছারিতে আসেন নাই–তাঁহাকে ডাকিবার জন্য একজন আমলা ছুটিল। নায়েববাবু তখন ভোজনে বসিয়াছেন। তাড়াতাড়ি সে কাৰ্য্য সমাধা করিয়া, আচমনান্তে গোটা দুই পাণ মুখে দিয়া স্থলোদরের উপর চাপকানের বোতাম আঁটিতে আঁটিতে ছুটিয়া আসিলেন। কাছারিতে পৌঁছিয়া হাঁফাইতে হাঁফাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, পালিয়েছে?
আমলারা বলিল, না।
নায়েববাবু তখন, জমাদার হনুমান সিং–জমাদার হনুমান সিং। –বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন।
জমাদার হনুমান সিং আসিয়া দাঁড়াইল। নায়েববাবু হুকুম দিলেন–এই জমাদার। হনুমান সিং–ঐ যে বেক্তি হামলোগকো বাবু সাজকে আয়া হ্যাঁয়–উ বাবু নেই হ্যাঁয়–জোচ্চোর হ্যাঁয়। যেৎনা পাইক বরকন্দাজ সব লোক যাও, বৈঠকখানা বাড়ীমে পাহারা দেও! বাবুকে ভাগনে মৎ দেও।
যো হুকুম। –বলিয়া জমাদার পাইক বরকন্দাজ একত্র করিতে ছুটিল।
নায়েববাবু কপালের ঘৰ্ম্ম মুছিয়া দুই গ্লাস জল পান করিলেন। বলিতে লাগিলেন–আমি সেইকালেই সন্দেহ করেছিলাম, কাউকে বলিনি তাই। ষোল বচ্ছর যে মানুষ নিরুদ্দেশ, সে কি আর ফেরে? দেওয়ানজি যে কাকা কাকা শুনেই গলে গেলেন! হতাম যদি আমি দেওয়ান, দেখতাম আমার চক্ষে কেমন করে ধূলো দিত। ভাগ্যিস আমি চার্জে রয়েছি। হেঁ হেঁ, আটকালাম ত–পালাতে ত দিলাম না! দেওয়ানজি যদি থাকতেন, এতক্ষণ ও পাঁচিল পগার ডিঙিয়ে পালিয়ে যেত। ওরে আর এক গেলাস জলদে।
একজন বৃদ্ধ আমলা বলিল, তা যেন হল। এখন, কর্তব্য কি?
নায়েব দেওয়ান মহাশয় গেলাস নামাইয়া বলিলেন, থানায় খবর পাঠাই।
বৃদ্ধ বলিল, দারোগা যখন জিজ্ঞাসা করবে–উনি যে ভবেন্দ্রবাবু নন–তার প্রমাণ কি? –শুধু সেই মাতালের কথাটুকুর উপর নির্ভর বই ত নয়। বর্ধমানের জাল প্রতাপৰ্চাদের মোকদ্দমার কথা জানেন ত। জাল প্রমাণ করা সোজা কথা নয়।
কথাটা শুনিয়া নায়েববাবু দমিয়া গেলেন। তখন সহসা তাহার মনে হইল, যদি মাতালের কথা মিথ্যা হয়, এই যে আমি বাবুর চারিদিকে পাহারা বসাইলাম–বাবু কি মনে করিবেন? –কল্যই ত আমার চাকরি যাইবে। প্রকাশ্যে বলিলেন–তা সে মাতাল গেল কোথা? তাকে ডেকে ভাল করে জিজ্ঞাসাই করা যাক না। কতক্ষণ গেছে?
একজন বলিল, বড় জোর আধ ঘণ্টা।
নায়েববাবু তখন আবার পেয়াদা পাইকগণকে ডাকাডাকি আরম্ভ করিলেন। তাহারা আসিলে, মাতাল বাবুকে খুঁজিয়া ডাকিয়া আনিবার জন্য আদেশ প্রচার করিলেন।
বৃদ্ধ আমলাটি বলিল, আমার বিবেচনায়, একবার রাণীমার সঙ্গে কথা কইলে আপনি ভাল করতেন। আমরা, ধরুন সবাই চাকর। তার হুকুম নিয়ে কায করাই ভাল। তিনি কি বলেন, থানায় খবর পাঠাতে বলেন–কিম্বা দার্জিলিঙে দেওয়ানজিকে তার করতে বলেন–সেটা জানলে হত।
নায়েবাবু বলিলেন, যাবই ত। রাণীমার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করবই ত। তাকে না জিজ্ঞাসা করেই কি কোনও কায করব? –ওরে কে আছিস? যা ত–অন্দরে রাণীমার কাছে এত্তেলা পাঠা যে নায়েববাবু একবার প্রণাম করতে চান।
রাণীমার হুকুম আসিতে বিলম্ব হইতে লাগিল। নায়েববাবু চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। লোকের উপর লোক পাঠাইতে লাগিলেন। শেষে তাহার তলব হইল।
অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া কালীকান্তবাবু যথাস্থানে নীত হইলেন। পর্দার আড়ালে রাণীমা ছিলেন। কালীকান্ত উদ্দেশে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বলিলেন, মা, যা শুনছি এ সব কি সত্য?
ঝির মুখে রাণীমার উত্তর উচ্চারিত হইল, সত্য।
উনি তা হলে আমাদের বাবু নন?
না।
তবে এখন উপায়?
উপায়–ঈশ্বর যা করবেন।
থানায় একটা খবর পাঠাব? –আমি তাকে নজরবন্দীতে রেখেছি।
থানায় খবর পাঠিও না। পাইক বর্কন্দাজ সরিয়ে নাও। ওঁকে কেউ যেন অপমান বা বিরক্ত না করে। উনি যখন নিজের ইচ্ছায় চলে যাবেন, তখন যাবেন।
আর কোনও হুকুম আছে?
বউমার ব্যারাম বড্ড বেড়েছে। ষ্টেশনে ঘোড়সওয়ার ছুটিয়ে দাও। কৃষ্ণনগরের সাহেব ডাক্তারকে টেলিগ্রাফ কর যেন তিনি সন্ধ্যার গাড়ীতে নিশ্চয় এসে পৌঁছন। যত টাকা আবশ্যক টেলিগ্রাফে তাকে পাঠিয়ে দাও। সন্ধ্যার গাড়ীর সময় ষ্টেশনে পাল্কী নিয়ে। ষোলজন বেহারা যেন উপস্থিত থাকে, ডাক্তার সাহেবকে নিয়ে আসবে।
আর কোনও হুকুম আছে? দেওয়ানজিকে আসতে টেলিগ্রাফ করব কি?
না।
প্রণাম করিয়া নায়েব মহাশয় বিদায় গ্রহণ করিলেন। রাণীমার আচরণে তিনি হতভম্ব হইয়া পড়িয়াছেন। ধীরপদবিক্ষেপে কাছারিতে ফিরিয়া প্রথমে রাণীমার হুকুমগুলি তামিল করিলেন। তাহার পর, নিজ কেশহীন মস্তকাগ্রভাগে হস্ত–সঞ্চালন করিতে করিতে করিতে ক্রমাগত ভাবিতে লাগিলেন, যে ব্যক্তি এমন সৰ্ব্বনাশ করিয়াছে, যাহাকে মাটীতে কোমর অবধি পুঁতিয়া ডালকুত্তা দিয়া খাওয়াইলেও রাগ যায় না–সেই জুয়াচোরের উপর। রাণীমা এমন সদয় কেন?
সদয় হইবার কারণ আছে। কনকলতা চিঠি বাহির করিয়া তাঁহার নিকট প্রমাণ করিয়াছে, মাতাল আসিয়া একথা প্রকাশ করিবে যখন ঘুণাক্ষরেও রাখাল জানিত না, তখন সেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া বউরাণীকে সমস্ত জানাইয়াছিল। কনক তাঁহাকে বুঝাইয়াছে, রাখাল যে সময়মত সাবধানতা অবলম্বন করিয়া এই পবিত্রকুলের দীপ্তিটুকু অপরিম্লান রাখিল, এজন্য সে ইহাদের কৃতজ্ঞতারই পাত্র; এবং জন্মদরিদ্র হইয়াও এই বিপুল সম্পত্তিলাভের প্রলোভনকে জয় করিয়া ধৰ্ম্মপথে অটল রহিল, সে জন্য ভক্তির পাত্র বটে।
১১. কড়ি না মাণিক?
সেই যে খগেন্দ্রের উন্মত্ত গর্জন শুনিয়া বউরাণী সংজ্ঞা হারাইয়াছিলেন, তাহার পর সেই অবস্থাতেই তিনি পড়িয়া রহিলেন, অর্ধঘণ্টা কাল কেহ তাহার খোঁজ খবর লইল না।
অর্ধঘণ্টা পরে একজন পরিচারিকা কি করিতে সে কক্ষে আসিয়াছিল, সেই প্রথমে সকলকে সংবাদটা দিল। অনেক কষ্টে তাহার মূৰ্ছাভঙ্গ করা হইল, মূর্ছাভঙ্গের অনতিকাল পরে তিনি প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হইয়া পড়িলেন।
সন্ধ্যার গাড়ীতে কৃষ্ণনগরের সিভিল সার্জন আসিলেন। তিনদিন জ্বরভোগের পর, ডাক্তার সাহেবের অবিশ্রান্ত চিকিৎসায় রাত্রি দ্বিপ্রহর হইতে বউরাণীর জ্বরটা নরম পড়িতে লাগিল। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তাহার লুপ্তচেতনাও ফিরিয়া আসিল।
সুরবালা তখন বউরাণীর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া তাহার মাথাটির কাছে মৃদু মৃদু পাখার বাতাস করিতেছিল। সুরবালার পানে চাহিয়া অত্যন্ত ক্ষীণস্বরে বলিলেন–তুমি সারারাত বসে রয়েছ?
সুরবালা বলিল, না আমি ত বেশীক্ষণ আসিনি। রাণীমা এতক্ষণ ছিলেন, আমাকে বসিয়ে তিনি গঙ্গাস্নানে গেছেন। তিনি এ দুদিন স্নানও করেন নি, খানও নি।
বউরাণী বলিলেন, দুদিন? কদিন আমার অসুখ করেছে?
আজ তিনদিন হল না? –পরশু দুপুরবেলা তুমি হঠাৎ মূৰ্ছা গিয়েছিলে।
বউরাণী যেন ভাবিতে চেষ্টা করিয়া বলিতে লাগিলেন, পরশু–দুপুরবেলা? ওঃ–হ্যাঁ। বলিয়া তিনি চক্ষু মুদিত করিলেন। তাঁহার সেই মুদিত চক্ষুরই পল্লব ভেদ করিয়া ফোঁটা ফোঁটা জল পড়িতে লাগিল।
তাঁহাকে কাঁদিতে দেখিয়া সুরবালা কি করিবে, কি বলিবে, কিছুই ভাবিয়া পাইল না। হঠাৎ বলিয়া ফেলিল–ডাক্তারসাহেব কাল বলছিলেন। –বলিয়া চুপ করিল।
বউরাণী চক্ষু খুলিয়া, সুরবালার মুখের পানে চাহিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন–কে?
সুরবালা বলিল, ডাক্তারসাহেব।
ডাক্তারসাহেব কে?
কৃষ্ণনগর থেকে ডাক্তারসাহেব এসেছেন কিনা।
কৃষ্ণনগর থেকে ডাক্তারসাহেব এসেছেন বুঝি? কবে?
পরশু সন্ধ্যাবেলা।
বটে!–বলিয়া বউরাণী অন্যদিকে চাহিয়া কি ভাবিতে লাগিলেন।
সুরবালা বলিল, তিনি বলেছেন, তুমি একটু ভাল হলেই তোমাকে হাওয়া বদলাতে নিয়ে যেতে।
বউরাণীর চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল। বলিলেন–তার আর দরকার নেই।
সুরবালা বলিল, কেন?
সব শুনেছ ত?
শুনেছি।
তবে–আর আমার বেঁচে কি হবে?
সুরবালা বলিল, তুমি ও কথা বলছ কেন ভাই? একদিন আমি ও কথা বলেছিলাম, তাতে তুমি আমায় কি বলে তিরস্কার করেছিলে মনে করে দেখ।
বউরাণী একটি কম্পিত দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন। পরে বলিলেন–তোমার অবস্থায় আমার অবস্থায় যে অনেক প্রভেদ ভাই! আমার জীবন যে কলঙ্কিত হয়ে গেছে। এ জীবন যত শীঘ্র শেষ হয় ততই ভাল নয় কি?
সুরবালা পাখাটি নামাইয়া আকুলভাবে বউরাণীর একখানি হাত নিজ হাতের মধ্যে লইল। বলিল–ও কথা তুমি কেন বল? তোমার ত কোনও দোষ নেই।
বউরাণী মাথাটি নাড়িয়া বলিলেন, আমার পোড়া অদৃষ্টের দোষ।
সুরবালা বলিল, তুমি ত নিজের স্বামী জেনেই–
এ কথায় বউরাণী একটু উত্তেজিত হইলেন। তাঁহার চক্ষুযুগল প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। বলিলেন–সে কথা একশো বার–হাজার বার।
সুরবালা উৎসাহিত হইয়া বলিল, তা হলে তোমার দেহ মন দুই ত খাঁটি আছে। কলঙ্কিত হয়েছে কেন বলছ? পাথরের মূর্তিকে মানুষ যে ঈশ্বর মনে করে পূজো করে–সে পূজো পাথর পায়, না ঈশ্বর পান? তুমিও তেমনি তোমার স্বামীকেই পূজো করেছ।
বউরাণী চক্ষু মুদিয়া বলিলেন, আচ্ছা, ভেবে দেখি।
সুরবালা আগ্রহে তাঁহার মুখখানির পানে চাহিয়া রহিল। বউরাণীর চক্ষুর পল্লব মাঝে মাঝে কাঁপিতে লাগিল, নিশ্বাসও মাঝে মাঝে কাঁপিয়া কাপিয়া উঠিল। কিয়ৎক্ষণ এইরূপ কাটিলে তিনি চক্ষু খুলিয়া আবার সুরবালার দিকে চাহিলেন, সে দৃষ্টি কৃতজ্ঞতা মাখান। বলিলেন–হ্যা ভাই–তুমি ঠিক বলেছ। তুমি ঠিক বলেছ। একটা কায কর না ভাই।
সুরবালা জিজ্ঞাসা করিল, কি? বল।
আমার ঐ দেরাজে, মাঝের খাটালে, ডানদিকের দেরাজটি খোল। তার ডানদিকের কোণে সবার নীচে, একটি হাতীর দাঁতের বাক্স আছে–নিয়ে এস।
সুরবালা উঠিয়া গিয়া দেরাজ খুলিয়া বাক্সটি বাহির করিয়া আনিল। বউরাণী বাক্সটি লইয়া যেন স্নেহের সহিত বুকের উপর রাখিলেন।
সুরবালা বলিল, এতে কি আছে ভাই?
বউরাণী বাক্সটি আস্তে আস্তে খুলিলেন। ভিতরে একটা রেশমী রুমালে কি বাধা রহিয়াছে দেখা গেল। পুঁটুলিটি বুকের উপর রাখিয়া আস্তে আস্তে খুলিতে লাগিলেন। বাহির হইল গুটিকতক কড়ি।
সুরবালা জিজ্ঞাসা করিল, কিসের কড়ি ভাই?
বউরাণীর অধর প্রান্তে একটু হাসি খেলিয়া গেল। বলিলেন–বাসি বিয়ের পরদিন, ফুলশয্যার আগে, কড়ি খেলতে হয় না? –এগুলি আমাদের সেই খেলার কড়ি।
কথাটি শুনিয়া সুরবালার চক্ষু জলে ভরিয়া আসিল। বউরাণী সুরবালার দিকে পাশ ফিরিলেন। রুমালখানি বিছানায় মেলিয়া, হাত দিয়া সেখানিকে চোস্ত করিয়া কড়িগুলি একটি একটি করিয়া গণিয়া তাহার উপর রাখিলেন। শেষেরটি রাখিয়া ব্যস্ত হইয়া বিছানায় হাতড়াইতে লাগিলেন। বলিলেন–একটা যে কম ভাই!
রত্নদীপ সুরবালা খুঁজিতে লাগিল। একটি কড়ি কি করিয়া দলভ্রষ্ট হইয়া পাশের বালিসের নীচে আত্মগোপন করিয়াছিল। সুরবালা সেটি কুড়াইয়া বউরাণীর হাতে দিল।
বউরাণী সেটিকে হাতে লইয়া নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। যেন কড়ি নয় একটি মানিক–হারানো মাণিক পাওয়া গিয়াছে। দেখিয়া, সেটি রুমালের উপর রাখিয়া, আবার সকল কড়ি গণনা করিলেন। তাহার পর রুমালটি সযত্নে বাঁধিয়া, বাক্সে রাখিয়া বলিলেন–দেরাজে সেইখানে আবার রেখে এস ভাই।
সুরবালা দেরাজ বন্ধ করিয়া আসিয়া দেখিল, বউরাণীর চক্ষু মুদিত। সুরবালা তাঁহার কাছে বসিলে ক্ষণেকের জন্য চক্ষু খুলিয়া বলিলেন–আমার ঘুম আসছে।
ঘুমোও। –বলিয়া সুরবালা তাঁহার মাথার উপর আবার মৃদু মৃদু পাখা করিতে লাগিল। বউরাণী শীঘ্রই ঘুমাইয়া পড়িলেন। সুরবালা দেখিল তাঁহার সেই সুপ্তিমগ্ন মুখে, কয়েক দিবস পরে আজ শান্তির ছায়া, বিরাজ করিতেছে।
১২. শেষ
অন্তঃপুরমধ্যে সুরবালা পরিচয়ে যে স্ত্রীলোক বাস করিতেছে, সে রাখালের স্ত্রী, এ কথা খগেন্দ্র প্রচার করিয়া যাইবার কিছুক্ষণ পরে রাখালের কর্ণেও প্রবেশ করিল। শুনিয়া তাহার বিস্ময়ের অবধি রহিল না। পাঁচ ছয়মাস পূর্বে যে লীলাবতী বসন্তপুর হইতে নবীনচন্দ্রের সহিত নিরুদ্দেশ হইয়াছিল, সে যে কি ঘটনাচক্রে আসিয়া এই পরিবারমধ্যে আশ্রয় লাভ করিতে সমর্থ হইল, তাহা রাখাল কিছুই বুঝিতে পারিল না। স্মরণ করিয়া দেখিল সুরবালার নাম যে বারংবার শুনিয়াছে, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও সে তাহাকে চক্ষে দেখিতে পায় নাই। সুতরাং সে যে নিজেকে রাখালের চক্ষু হইতে অন্তরালে রাখিতে বিশেষ যত্নবতী ছিল, ইহাতে রাখালের অণুমাত্র সন্দেহ রহিল না। এই সকল বিষয় চিন্তা করিয়া তাহার কৌতূহল ক্রমেই বর্ধিত হইয়া উঠিল। কাহাকেই বা জিজ্ঞাসা করে? অন্তঃপুরের দ্বার তাহার জন্য চিরদিনের মত রুদ্ধ। দুই একজন ঝি এখনও মাঝে মাঝে তাহার নিকট কাৰ্য্য উপলক্ষে আসিতেছে বটে, কিন্তু তাহাদিগকে এ বিষয়ে কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিতে রাখালের প্রবৃত্তি হইল না। কনকলতার সঙ্গে তাহার শেষ কথা। হইয়াছিল, তাহারও রাখালের স্মরণ হইল। এখান হইতে বিদায় গ্রহণের পূর্বে একবার সাক্ষাতের জন্য কনকের সনির্বন্ধ অনুরোধ তখন প্রহেলিকা বলিয়াই মনে হইয়াছিল। এখন রাখাল বেশ বুঝিতে পারিল, এই ব্যাপারের সহিত সে অনুরোধের নিশ্চয়ই কোনও সম্বন্ধ আছে।
বউরাণীর অবস্থা আর নিতান্ত সঙ্কটাপন্ন নহে, এইটুকু শুনিবার জন্যই রাখাল অপেক্ষা করিয়া ছিল, এখন তাহা শুনিয়াছে অথচ যাইতে পারিতেছে না। লীলাবতীর সহিত পুনৰ্ম্মিলিত হইবার আকাঙ্ক্ষা তাহার নাই। সে যেরূপ শুনিয়াছে এবং বিশ্বাস করিয়াছে, তাহাতে সে আকাঙ্ক্ষা থাকিতেও পারে না। তবে যাহাকে মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া বিবাহ করিয়াছিল, এত বৎসর ধরিয়া যাহাকে স্বীয় অর্ধাঙ্গিনীর স্বরূপ মনে করিত, তাহার কি হইয়াছে এবং পরিণামে কি হইবে, ইহা জানিবার জন্য একটা আগ্রহ রাখালের মনকে অধিকার করিয়া রহিল। কনকলতার সহিত কেমন করিয়াই তাহার সাক্ষাৎ হয়–এবং সাক্ষাৎ না করিয়া চলিয়া যাইতেও সে পারে না, এইরূপ দ্বিধায় পড়িয়া আরও দুইদিন কাটিয়া গেল।
তৃতীয় দিন প্রাতে শুনিল, দেওয়ানজিকে দার্জিলিঙে টেলিগ্রাম করা হইয়াছে–কল্য তিনি আসিয়া পৌঁছিবেন। রাণীমা এবং বউরাণী তীর্থযাত্রার আয়োজন করিতেছেন–দিনও স্থির হইয়া গিয়াছে। শুনিয়া রাখাল ভাবিল, আমি নড়িতে চাহিতেছি না, তাই ইহারা তাড়াতাড়ি চলিয়া যাইতেছেন; দুর্জনের জন্য স্থানত্যাগে উদ্যত হইয়াছেন। সুতরাং তাহার আর বিলম্ব করা চলে না। সে বিকালের গাড়ীতে রওনা হইবে স্থির করিল। রাণীমা যে তাহার প্রতি নিতান্ত নিষ্করুণ নহেন, তাহারই আজ্ঞায় নজরবন্দীর পাহারা, অন্যান্য প্রকারের অপমান এবং পুলিশের হাতকড়ি হইতে নিষ্কৃতি পাইয়াছে, ইহা সে অবগত ছিল। তাই ভাবিল, তাহাকে একবার প্রণাম করিতে যাইবে। এবং সেই সঙ্গে কনকলতার সহিত একবার সাক্ষালাভের অনুমতি প্রার্থনা করিবে।
স্নানাদি শেষ হইলে রাখাল অন্তঃপুরে এত্তেলা পাঠাইয়া দিল, সঙ্গে সঙ্গে রাণীমা তাহাকে আহ্বান করিলেন। অন্তঃপুরে প্রবেশ করিবামাত্র যেটি সর্বপ্রথম কক্ষ, ঝি সেই কক্ষে রাখালকে বসাইল। অল্পক্ষণ পরে রাণীমা আসিয়া প্রবেশ করিলেন।
রাখাল দেখিল তাঁহার মুখ অবনত, মেঘের মত গম্ভীর। তাঁহার বসিবার আসন ছিল কিন্তু তিনি উপবেশন করিলেন না। রাখাল এক পা এক পা করিয়া তাঁহার সম্মুখে আসিল। কি বলিয়া সম্বোধন করিবে? মা বলিবার অধিকার আর তিনি তাহাকে দিবেন কি না, স্থির করিতে পারিল না। ধীরে ধীরে নতজানু হইয়া ভূমিতে মস্তকস্পর্শ করিয়া সে প্রণাম করিল। তাহার পর কষ্টে অশ্রুরোধ করিয়া নতনেত্রে বলিল–আমার সকল অপরাধ ক্ষমা করুন। –বলিয়া সে আকুলনয়নে ঊর্ধ্বমুখে রাণীমার দিকে চাহিল। দেখিল তাহার দুইচক্ষু দিয়া দরদর ধারায় অশ্রু বহিতেছে।
দেখিয়া রাখালেরও চক্ষের বাঁধ ভাঙ্গিল। কম্পিতকণ্ঠে সে বলিল, আপনাকে মা বলে সম্বোধন করার যোগ্য আমি নই, আমি মহাপাপী। যদি অনুমতি করেন, তা হলে আপনার পায়ে ধূলো নিয়ে জন্মের মত বিদায় হই।
রাণীমার ওষ্ঠযুগল কাঁপিতে লাগিল। তিনি বলিলেন, বাবা আর কিছু বলিতে পারিলেন না। প্রবল অশ্রুবন্যায় তাঁহার বক্তব্য ভাসিয়া গেল অঞ্চলটি মুখের উপর চাপিয়া তিনি ফোঁপাইতে লাগিলেন।
রাখাল বলিল, আমি নিজেকে যত দুর্ভাগ্য মনে করেছিলাম দেখছি তা নই। আপনি আমায় পুত্র সম্বোধন করে আপনাকে মা বলবার অধিকার আমায় দিলেন। মা, তবে আসি। –বলিয়া রাখাল ভূমিতে আবার প্রণত হইল।
চক্ষু হইতে অঞ্চল উন্মোচন করিয়া রাণীমা বলিলেন, বাবা এসআশীৰ্বাদ করি যেন ধৰ্ম্মে মতি অচল থাকে। যেন আবার তুমি সুখী হও। –বলিয়া ধীরে ধীরে তিনি দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলেন। দ্বারের নিকট পৌঁছিয়া হঠাৎ থামিয়া বলিলেন–একটু অপেক্ষা কর, কনক তোমার সঙ্গে দেখা করবে। –রাখাল কিন্তু কনকের সহিত সাক্ষাৎ করিবার কথা ভুলিয়া গিয়াছিল।
প্রায় পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করিবার পর, কনকলতা সেই কক্ষে প্রবেশ করিল। রাখাল তখন একটা চেয়ারে বসিয়া ছিল। কনক আসিয়া রাখালের অনতিদূরে দাঁড়াইল; এবং তাহার অনুরোধ সত্ত্বেও উপবেশন করিল না।
কনক মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি আজই চললেন?
রাখাল বলিল, বিকেলের গাড়ীতে যাব। বউরাণী এখন কেমন আছেন?
কনক বলিল, লোকের কাছে দেখাতে চাচ্ছেন যে তিনি খুব ভালই আছেন, কিন্তু আমার বিশ্বাস তা নয়।
রাখাল বলিল, শুনছি পরশু দিনই তীর্থযাত্রা করবেন। শরীরের এ অবস্থায় এত তাড়াতাড়ি যাওয়াটা ঠিক হবে?
সে কথা আমরা সকলে তাকে বলে বলে হেরে গেছি। তিনি আর কিছুতেই এখানে থাকতে চাচ্ছেন না।
কোথায় যাওয়া স্থির হয়েছে?
কাশী। আপনি এখন কোথায় যাবেন?
রাখাল বলিল, আমি কলকাতায় যাচ্ছি। তারপর সেখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাব।
কনক বলিল, লীলাবতী এখানে রয়েছে তা শুনেছেন কি?
রাখাল বলিল, শুনেছি।
তার কি ব্যবস্থা করলেন?
নিজের ব্যবস্থা সে ত নিজেই করেছে, আমি আর তার কি করব? আপনি ত সবই জানেন।
আমি জানি, কিন্তু আপনি জানেন না। লীলাবতীর সম্বন্ধে আপনি একটা মহাভ্রমে পড়েছেন।
এ কথা শুনিয়া রাখাল চমকিয়া উঠিল। বলিল–কেন? কি ভ্রমে পড়েছি?
কনক বলিল, আপনার স্ত্রী সতী সাধ্বী, তবে কিঞ্চিৎ নির্বোধ। শুধু নিজের বুদ্ধি দোষে এই ফ্যাসাদটি বাধিয়েছে।
রাখাল আগ্রহে উদ্গ্রীব হইয়া বলিল, কি রকম, কি রকম?
কনক তখন একটু একটু করিয়া লীলাবতীর ইতিহাস রাখালের নিকট ব্যক্ত করিল।
রাখাল শুনিয়া কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল। শেষে বলিল–এ কথা তুমি ত ঐ লীলারই কাছে শুনেছ? ওর কথায় বিশ্বাস কি? নিজের দোষ ঢাকবার জন্যে এই রকম একটা কিছু ও ত এখন বলবেই।
কনক বলিল, ওর কাছে প্রথম একথা শুনিনি রাখালবাবু।
প্রথমে তবে কার কাছে শুনলে?
আপনার কোনও বন্ধুর কাছে।
আমার বন্ধু? কে?
সেই যে–যিনি ব্র্যাণ্ডি খান–খগেন্দ্রবাবু। আপনার প্রতি অকৃত্রিম বন্ধুতাবশতঃ তিনি আপনার জীবনচরিতের উপকরণ সংগ্রহ করতে করতে এই সমস্ত কথা জানতে পেরেছিলেন।
রাখাল কনকের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। তাহার মনে সন্দেহ হইতে লাগিল, লীলাবতীর প্রতি স্নেহবশতঃ তাহার মঙ্গলার্থ এ হয়ত মিথ্যা করিয়া আমায় এ সমস্ত বলিতেছে।
কনক বলিল, ও কি, আমার কথায় আপনি অবিশ্বাস করছেন নাকি?
রাখাল বলিল, আপনার এ সকল কথা সত্য তার প্রমাণ কি?
কনক বলিল, প্রথম, আমি আপনাকে মিথ্যা কেন বলব? আমার তাতে লাভ?
লীলাবতী আপনার সখী। সখীর উপকার করা।
লীলাবতী আমার সখী নয়।
তবে বিপন্নের উপকার করা।
কনক একটু হাসিল। বলিল–কারু উপকার করা আমার কুষ্ঠীতেই লেখেনি রাখালবাবু! সে সব কিছু নয়। কিন্তু আপনি প্রমাণ যদি চান–আমি অকাট্য প্রমাণ দিতে পারি।
রাখাল বলিল, কি প্রমাণ?
কনক বলিল, আপনার পরমবন্ধুর হস্তাক্ষর। –বলিয়া তাড়াতাড়ি বাহিরে গেল। দুই মিনিট পরে ফিরিয়া আসিয়া রাখালের হাতে কয়েকখানি চিঠি দিল।
রাখাল একে একে সেই পত্রগুলি পড়িল, খামগুলি উল্টিটা পাল্টিয়া ডাকঘরের ছাপগুলি পরীক্ষা করিল। অবশেষে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া অন্য দিকে চাহিয়া রহিল।
কনক বলিল, ভাবছেন কি? লীলার উপর আর আপনার কোনও সন্দেহ আছে নাকি?
রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, রাণীমা এসব কথা জানেন?
এখন তিনি সবই জানতে পেরেছেন।
তার এ সম্বন্ধে মত কি?
কনক বলিল, তার মত আপনি কি তাঁর ব্যবহারেই বুঝতে পারেন নি?
রাখাল আশ্চৰ্য্য হইয়া বলিল, কেন? কি ব্যবহার?
কনক বলিল, আমার সঙ্গে দেখা করতে তিনি কি আপনাকে বলে যান নি?
ওঃ হাঁ, ঠিক বটে। আচ্ছা রাণীমা কি বলেছেন কনক?
সকল কথা শুনে, এই চিঠি সব পড়ে, রাণীমা আপনার গিন্নীর বুদ্ধির তারিফ করতে লাগলেন।
রাখাল অধীর হইয়া বলিল, লীলাবতাঁকে আমার গ্রহণ করা সম্বন্ধে তিনি কিছু মত প্রকাশ করেছেন?
কনক বলিল, হ্যাঁ, তা করেছেন বইকি! তিনি বলছিলেন নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে বিনা দোষে ত্যাগ করে রাখাল কখনই অধৰ্ম্ম করবে না।
অবনত মুখে রাখাল চিন্তা করিতে লাগিল। আবার তুমি সুখী হবে। রাণীমার এই আশীৰ্ব্বচনের গূঢ় ইঙ্গিতটুকু সে বুঝিতে পারিল।
কনক বলিল, লীলাকে এখানে পাঠিয়ে দেব?
রাখাল বলিল, না, এখন থাক্। আমার সঙ্গে সে যাবে, তাকে প্রস্তুত থাকতে বলবেন। এখন বিদায় নিই। আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলব না।
.
সেইদিন অপরাহ্নে রাখাল ও তাহার স্ত্রীকে লইয়া গ্রাম হইতে দুইখানি পাল্কী বাহির হইল। কলিকাতায় পৌঁছিয়া সেখানে একটি ক্ষুদ্র বাড়ী ভাড়া লইয়া, মাসখানেক থাকিয়া রাখাল চাকরীর চেষ্টা করিতে লাগিল। রাণীমা লীলাবতীকে কিছু অর্থ দিয়াছিলেন, সুতরাং রাখালকে কোনও কষ্টে পড়িতে হয় নাই। একমাস হাঁটাহাঁটির পর, বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের একটি ছোট ষ্টেশনের ছোটবাবু হইয়া রাখাল কলিকাতা পরিত্যাগ করিল।
.
আরও মাস দুই পরে, লীলাবতী একদিন কনকলতার নিকট হইতে একখানি পত্র পাইল। তাহা পাঠে জানা গেল, কনকও রাণীমার হাতে পায়ে ধরিয়া, ইঁহাদের সহিত কাশী গিয়াছিল। সেখানে পৌঁছিয়া, বউরাণীর পীড়া উত্তরোত্তর বর্ধিত হইতে থাকে। বিগত রাসপূর্ণিমার দিন তাহার কাশীলাভ হইয়াছে। মৃত্যুর দুদিন পূৰ্ব্বে ফুলশয্যা-উৎসবের সেই কড়িগুলি তিনি আঁচলে সৰ্ব্বদা বাঁধিয়া রাখিতেন; এবং তাহারই অনুরোধক্রমে কড়িগুড়িও তাঁহার সহিত চিতায় স্থানলাভ করিয়াছে।