চতুর্থ খণ্ড
০১. চতুরে চতুরে
কলিকাতার উত্তরাংশে কোনও দ্বিতল গৃহের একটি প্রকোষ্ঠে বসিয়া খগেন্দ্রনাথ ওরফে সোণার হরিণ, অতি নিবিষ্টচিত্তে একখানি পত্র পাঠ করিতেছিল। তাহার সম্মুখে টেবিলের উপর ডাকের আর একখানি খোলা খাম পড়িয়া আছে। প্রথম পত্রখানি পড়িয়া, দ্বিতীয়খানি খগেন্দ্র তুলিয়া লইল। এখানি, প্রথমখানির মত বহুপৃষ্ঠাব্যাপী নহে–ক্ষুদ্র, নিম্নলিখিত কয়েক ছত্রে শেষ হইয়াছিল–
বাশুলিপাড়া
৫ই জ্যৈষ্ঠ
প্রিয় খগেনবাবু,
আপনার পত্র পাইলাম। আমি যেরূপ সন্দেহ করিয়াছিলাম, আপনিও সেরূপ করিয়াছেন দেখিয়া সুখী হইলাম। আমাকে যে সকল সংবাদ আপনি জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, তাহা এ পর্যন্ত কিছুই আমি সংগ্রহ করিতে পারি নাই। কল্য দেওয়ানজি কলিকাতা যাত্রা করিবেন, সেখানে ৫/৭ দিন থাকিবেন। তাঁহার ঠিকানা ৬৫নং মানিকতলা ষ্ট্রীট। যদি পারেন, তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আপনার যাহা জ্ঞাতব্য জানিয়া লইবেন। আপনি লিখিয়াছেন আরও কিছুদিন আমার এখানে থাকা আবশ্যক। কিন্তু আজকাল বউরাণী আমার প্রতি তেমন আর প্রসন্ন নহেন। তাঁহারসহচর জুটিয়াছে, সহচরী এখন নিপ্রয়োজন। আপনি দেওয়ানজিকে বলিয়া দেখিবেন। আজ তবে আসি।
আপনার অনুগত
কনক
পত্রখানি পাঠ করিয়া খগেন্দ্র দেওয়ালের ঘড়ির পানে চাহিল–দেখিল বেলা তিনটা বাজিয়াছে। ভাবিল–যাই, এখন গেলে নিশ্চয়ই দেখা পাইব। বিলম্বে হয়ত তিনি বাহির হইয়া যাইবেন।
খগেন্দ্র তখন উঠিয়া, আলমারি খুলিয়া কয়েকটা জামা বাহির করিয়া পরীক্ষা করিতে লাগিল। দেখিল, একটার বুকের কাছটায় একটু ছেঁড়া আছে। কয়েকখানি ধুতি বাহির করিল–যেখানি সৰ্ব্বাপেক্ষা পুরাতন দিস্তাপড়া, সেইখানি রাখিয়া আলমারি বন্ধ করিয়া দিল।
সেই ধুতিখানি পরিয়া, ছেঁড়া জামাটি গায়ে দিয়া, একখানি আধময়লা রেশমী চাদর কাঁধের উপর ফেলিয়া খগেন্দ্র সিঁড়ি দিয়া নামিল। বাহির হইবার পূর্বে হস্তের ছাতাটির প্রতি চাহিয়া দেখে, সেটি উত্তম কাপড়ের ছাউনিযুক্ত–বাটে রূপা লাগানো আছে। ভৃত্য ক্ষুদিরামকে সেইখানে দেখিয়া বলিল–তোর ছাতা আছে?
আজ্ঞে হুজুর।
নিয়ে আয়।
ক্ষুদিরাম ছুটিয়া গিয়া নিজের ছাতাটি আনিয়া দিল। খগেন দেখিল সেটি পুরাতন এবং অল্পমূল্যের বটে–পছন্দ হইল। নিজের ছাতাটি ক্ষুদিরামের হাতে দিয়া বলিল–উপরে রেখে আয়, তোরটা আমি নিয়ে চলোম।
ক্ষুদিরাম প্রভুর মুখপানে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। সহসা দেখিল, বাবুর গায়ের জামাটিও ছেঁড়া। তাই সে আরও বিস্মিত হইল। ব্যাপারটা কি, অনুমান করিবার চেষ্টা করিতেছে, এমন সময় খগেন বলিল–যা না–হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? –বলিয়া খগেন বাহির হইয়া গেল।
ক্ষুদিরাম উপরে গিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া ভাবিল। সে এতদিন এখানে চাকরি করিতেছে–এরূপ বেশে ত বাবুকে কখনও বাহির যাইতে দেখে নাই! ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ তাহার মনে পড়িল তাহাদের গ্রামের শিবদাস মোকও একবার এইরূপ করিয়াছিল। শিবদাসের দোকানের বিলক্ষণ চতি–তাহার কাঁচাগোল্লার বড়ই সুখ্যাতি–আশেপাশের পাঁচখানা গ্রামের লোক তাহার দোকানের বাধা খরিদ্দার। টাকার মত সালসা আর নাই–সেই সান্সার প্রভাবে শিবদাসের চেহারাখানিও দিব্য মোটাসোটা গোলগাল তৈলচিক্কণ। এমন সময় হঠাৎ একদিন তাহার উপর ইনকাম। ট্যাক্সের এক নোটিস আসিয়া উপস্থিত। শিবদাস বড় চতুর লোক। বিলক্ষণ বুঝিল, এ। চেহারা দেখিলে হাকিম শুনিবে না, তাই সে গোটা দুইদিন অস্নাত ও অভুক্ত অবস্থায়। কাটাইয়া, ছিন্ন মলিন বস্ত্র পরিয়া সদরে যাত্রা করে। ইনকাম ট্যাক্স হাকিমের সম্মুখে। দাঁড়াইয়া এরূপ কাতর ক্রন্দন করিতে থাকে যে, তিনি তাহার ট্যাক্স একেবারে মাফ করিয়া দেন। এই ঘটনা স্মরণ হওয়াতে ক্ষুদিরাম অকূলে কূল পাইল। বিজ্ঞভাবে ঘাড়টি নাড়িয়া বলিল–বুঝেছি। বাবু ইনকাম টেকসো হাকিমের কাছে দরবার করতে যাচ্ছেন।
এদিকে খগেন্দ্র বড় রাস্তায় পৌঁছিয়া দেখিল, ধর্মতলার দিকে একখানি ট্রামগাড়ী যাইতেছে। পকেটে পয়সা ছিল, তথাপি ট্রামে উঠিল না। সেই রৌদ্রে, ছাতাটি মাথায় দিয়া পদব্রজে চলিল।
যথাসময়ে খগেন্দ্র ৬৫নং মাণিকতলায় পৌঁছিল। একজন উড়িয়া খানসামাকে দেখিতে পাইয়া বলিল, ওহে, এ বাড়ী কার?
খানসামা বলিল, সুবোধবাবুর।
দেখ, রঘুনাথ মজুমদার মহাশয় এখানে থাকেন কি?
রঘুনাথ মজুমদার? কে তিনি?
বাশুলিপাড়ায় থাকেন।
তখন খানসামা বলিল, ওঃ–বাশুলিপাড়ার দাওয়ানজি?
হ্যাঁ—হ্যাঁ
এসেছেন বটে।
তাকে একবার খবর দিতে পার?
কেন?
কায আছে।
আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
এই কলকাতা থেকেই।
কি বলব?
বোলো যে খগেনবাবু এসেছেন, আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান।
যদি জিজ্ঞাসা করেন খগেনবাবু কে?
বোলো খগেনবাবু উকিল।
এই উকিল কথাটি শুনিয়া খানসামার মনে একটু সম্ভ্রম উপস্থিত হইল। বলিল–আপনি উকিল!
খগেন ঈসৎ হাসিয়া বলিল, হ্যাঁ–কিন্তু আমি না হয়ে তুমি উকিল হলেই ভাল হত। যে রকম জেরাটা করছ!
খানসামা এ রসিকতাটুকু বুঝিতে পারিল না। বলিল–আচ্ছা, আপনি বৈঠকখানায় বসুন–আমি দাওয়ানজিকে খবর দিচ্ছি।
খগেন বৈঠকখানায় প্রবেশ করিয়া টেবিলের নিকট একটি চেয়ারে বসিল। ভিত্তিগুলি সুন্দর সুন্দর চিত্রে সজ্জিত–মধ্যস্থলে একখানি বৃহৎ তৈলচিত্র আছে। মেঝেটি শতরঞ্জ মোড়া। টেবিলের অন্যদিকে জাজিমে মোড়া একখানি তক্তপোষ রহিয়াছে, স্থানে স্থানে কয়েকটি তাকিয়া বালিস। টেবিলের উপর কয়েকখানি বাঙ্গালা মাসিকপত্র পড়িয়া ছিল–তাহারই একখানি তুলিয়া খগেন্দ্র পাঠ করিতে লাগিল।
কয়েক মিনিট পরে খানসামা ফিরিয়া আসিয়া বলিল, বাবু, দাওয়ানজি ঘুমুচ্ছেন।
কখন উঠবেন?
আর বেশী দেরী নেই। আপনি বসবেন কি?
হ্যা আমি রইলাম। তিনি জাগলেই তাঁকে বোলো।
তামাক দেব?
না। বড় গ্রীষ্ম, পাখাটা খুলে দাও।
বৈদ্যুতিক পাখার চাবি খুলিয়া দিয়া খানসামা প্রস্থান করিল।
খগেন্দ্র তখন মাসিকপত্রখানি ফেলিয়া, টেবিলে হেলান দিয়া, হাতের উপর মাথা রাখিয়া চিন্তামগ্ন হইল। ভাবিতে লাগিল যা মনে করেছিলাম তা ত হল না। বউরাণীকে বিধবা বিয়ে করাটা ত ফস্কেই গেল। কোথাকার কে তার ঠিক নেই–উড়ে এসে জুড়ে বসল! কনক ত লিখেছে, তার দৃঢ় বিশ্বাস সে লোকটা ভবেন্দ্র নয়। আর, ঐ সুরবালাটাই বা কে? –গঙ্গায় ভেসে এসে উপস্থিত! অথচ দুইজনে ষড়যন্ত্র করে আসেনি, তাও কনকের বিশ্বাস। আমার বোধ হয় ওটি কনকের ভুল। নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র করে এসেছে। বিধবা বিয়ে ত অদৃষ্টে নেই দেখছি–তবু, ঐ ভবেন্দ্রটা যে কে, যদি ধরতে পারি–তা হলেও কিঞ্চিৎ অর্থাগম হয়। আপাততঃ লাখখানেক টাকার আমার ত বিশেষ দরকার। এ রহস্যটি যদি ভেদ করতে পারি, তবে ভবেন্দ্রকে গিয়ে বলি–বাপু হে–আমি সবই জেনেছি–সাক্ষী–সাবুদও সব মজুত। এখন বার কর দিকিন একটি লাখ টাকা। এখন নগদ এক লক্ষ সেলামী–আর মাসিক হাজার টাকা পেন্সন হলেই আমার হবে। স্বীকার হও, উত্তম–না হও, বল থানায় যাই। তা মাসে হাজার টাকা হলে আমার একরকম করে চলে যাবে। বউরাণীকে বিয়ে করতে পারতাম–ষোল আনার মালিক হতাম। তা যখন হল না–এই হলেই বাঁচি। ঘরপোড়া বাঁশ যা লাভ!
চিন্তাস্রোতে এইরূপ গা ভাসাইয়া খগেন্দ্র কত কি অভিসন্ধি করিতে লাগিল। ক্রমে ঘড়িতে ঠং ঠং করিয়া চারিটা বাজিল। বাহিরে বরফওয়ালা তাহার সাধা গলায় হাঁকিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে পূৰ্ব্বকথিত খানসামা আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইয়া বলিল, দাওয়ানজি উঠেছেন। খবর দিয়েছি।
প্রায় দশ মিনিট পরে, দেওয়ানজি তাহার বিপুল দেহখানি লইয়া চটিজুতা পায়ে খালি গায়ে হেলিতে দুলিতে আসিয়া প্রবেশ করিলেন।
খগেন্দ্র চেয়ার ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া বলিল, আমাকে চিনতে পারেন?
দেওয়ানজি বলিলেন, খগেন্দ্রবাবু? প্রণাম। বোসো বোসো। তারপর খবর ভাল ত?
খগেন্দ্র বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার কি আজই আসা হয়েছে?
হ্যাঁ, আজ বেলা ৯টার সময় এসে পৌঁছেছি। তা, তুমি আমার সন্ধান পেলে কি করে? কনকলতা লিখেছিলেন বুঝি!
আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার শরীর বেশ ভাল আছে?
আর বাবা, ষাট বৎসর বয়স হল, এখন শরীর ভাল আর মন্দ! তোমার খবর কি বল। পশ্চিমে কোথাও যাবার ঠিক করলে?
কই আর করলাম?
দেরী করছ কেন?
খগেন্দ্ৰ মুখখানি বিমর্ষ করিয়া বলিল, অর্থাভাব। পশ্চিমে গিয়ে ওকালতী ব্যবসা ফেঁদে বসতে হলে কিছু টাকা চাই ত। আইনের বই–ই অন্ততঃ দুতিনশো টাকার লাগবে। তা ছাড়া, কাপড়–চোপড়, টেবিল চেয়ার আলমারি–এ সবই ত চাই। তার পর কোথাও গিয়ে বসবামাত্রই কিছু মক্কেলের ভীড় লেগে যাবে না। অন্ততঃ পাঁচ ছমাসের বাসাখরচটা ত হাতে করে নিয়ে যেতে হবে।
দেওয়ানজি মনে মনে বলিলেন, তোমার যে রকম আইনজ্ঞান, পাঁচ ছমাসের কেন, পাঁচ ছবচরের বাসাখরচটা হাতে করে নিয়ে যেতে পারলেই ভাল হয়! প্রকাশ্যে বলিলেন–একটি মাষ্টারি করতে না?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ৪০ টাকা মাইনের একটি মাষ্টারি করতাম এখন বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। মেসের বাসায় থাকি, কায়ক্লেশে যতদূর কম খরচে পারি, চালাচ্ছি। টাকাটা হাতে হলেই বেরিয়ে পড়ব।
কোথা যাবে কিছু স্থির করেছ?
আজ্ঞে হ্যাঁ, সেটা একরকম স্থিরই আছে। গয়া যাব।
গয়া? ওহে কেষ্টদাস, কোথা গেলে, এক ছিলিম তামাক সাজ ত বাপু।
গয়া? বেশ জায়গা–তীর্থস্থান। ওদিকে মামলা মোকদ্দমা খুব হয়?
খগেন্দ্র একটু হাসিয়া বলিল, তা মন্দ নয়। তবে সেখানে একটা ভারি সুবিধে আছে।
দেওয়ানজি বলিলেন, তামাক সেখানকার উৎকৃষ্ট।
খগেন্দ্র একটু হাসিয়া বলিল, আজ্ঞে না, তামাকের কথা বলিনি। একটা খুব সুবিধে সেখানে এই যে, প্রাকটিস যদি জমে গেল, তা হলে ত কথাই নেই; আর তা যদি না জমল, কমিশন করেও খেতে পারব। সেখানে খুব বাটোয়ারা মোকদ্দমা হয়–উঁকিলেরা বড় বড় কমিশন পায়। শুনেছি সেখানে জুনিয়ার উঁকিলেরাও নাকি অনেকে কমিশন করে মাসে দুতিনশো টাকা রোজগার করে। এমন সুযোগটি আর কোনও জেলায় নেই।
দেওয়ানজি বলিলেন, তবে সেই ভাল। গয়াতেই যেও।
আজ্ঞে হ্যাঁ। তাই আপনার কাছে এসেছিলাম একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে।
এই সময় কৃষ্ণদাস ভৃত্য, গড়গড়া হাতে করিয়া কলিকায় ফুৎকার দিতে দিতে প্রবেশ করিল।
নল মুখে দিয়া, দুই চারি টান টানিয়া দেওয়ানজি জিজ্ঞাসা করিলেন, হা, কি বলছিলে?
আজ্ঞে জিজ্ঞাসা করছিলাম, এখন বাবু বাড়ী এসেছেন, কনককে আর বউরাণীর দরকার হবে কি?
দেওয়ানজি গড়গড়ায় আরও দুই চারি টান টানিয়া বলিলেন, তা আমি কি করে বলব বাপু, সে বউরাণী জানেন। বউরাণী যে কনকলতার উপর ইদানীং অসন্তুষ্ট তাহা দেওয়ানজি শুনিয়াছিলেন।
মুখখানি স্নান করিয়া খগেন্দ্র বলিল, আপনারা বড়লোক, আমার বোনটি আপনাদের আশ্রয়ে ছিল, আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। কনক যতদিন সেখানে আছে, ততদিন মেসে থেকে কষ্টে সৃষ্টে কিছু টাকা জমাতে পারি। সে যদি সেখান থেকে চলে আসে, আমায় মেস ছেড়ে দিয়ে বাড়ী ভাড়া করতে হবে; পঞ্চাশটি টাকায় সংসার খরচই কুলোবে না, বরং যা দুপয়সা জমিয়েছিলাম তাও যাবে। তা হলে আমার ওকালতী করা, অবস্থার উন্নতি করা এ সবই আকাশকুসুম হয়ে যাবে। মাষ্টারি করে আধপেটা খেয়েই জীবন কাটাতে হবে। –বলিয়া খগেন্দ্র মাথাটি নীচু করিয়া একটি বড় রকমের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
তাহার অবস্থা দেখিয়া দেওয়ানজির মনে দুঃখ হইল। কিয়ৎক্ষণ নীরবে বসিয়া ধুমপান করিতে লাগিলেন। অবশেষে বলিলেন–আচ্ছা তুমি সে জন্যে ভেব না। আমি গিয়ে বউরাণীকে জিজ্ঞাসা করব এখন। যদিও বা তিনি বলেন যে কনকলতাকে আর আবশ্যক নেই, আমি তাকে অনুরোধ করব, যাতে তোমার ভাগিনী এখন দু এক বছর থাকতে পারেন সে বন্দোবস্ত করে দেব। তার পর তুমি গয়ায় গিয়ে প্র্যাকটিস জমিয়ে, তোমার বোনকে নিয়ে যেও।
খগেনের মুখখানি আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। মনে মনে ভাবিল একটা কায হাসিল হইয়াছে, এখন তথাকথিত ভবেন্দ্র সম্বন্ধে দুই চারিটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া দেখা যাইক। তাই, দুই চারিটি অন্যকথার পর জিজ্ঞাসা করিল–বাবু বরাবরই কি কাশীতে ছিলেন? কাশী হইতেই যে প্রথম সংবাদ আসে, ইহা খগেন্দ্র কনকলতার পত্রে জানিয়াছিল।
দেওয়ানজি বলিলেন, না কাশীতে বেশী দিন ছিলেন না। বাড়ী আসবার আগে দিনকতক কাশীতে ছিলেন মাত্র।
খগেন্দ্র উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিল, কাশী–আহা কাশী বড় সুন্দর স্থান। বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, মাস ছয় আমরা কাশীতে ছিলাম কিনা। দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছেই আমাদের বাসা ছিল। সন্ধ্যার পর দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে বসলে আর উঠে আসতে ইচ্ছে করত না। তা, বাবু কাশীতে কোন্খানে ছিলেন?
দশাশ্বমেধের কাছাকাছি। এক যাত্রীবাড়ীতে।
যাত্রীবাড়ীতে? দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে আমাদের একজন চেনা লোক আছেন যাত্রীওয়ালা–তার নাম রামদাস। বড় ভাল লোক। বাবু কোন্ বাড়ীওয়ালার বাড়ীতে ছিলেন?
এই প্রশ্নটি শুনিয়া দেওয়ানজির গড়গড়ার ডাক বন্ধ হইয়া গেল। তিনি একটু সন্দিগ্ধ ভাবে খগেন্দ্রের মুখের পানে চাহিলেন। শেষে বলিলেন, –সে কথা ত বাবুকে আমি জিজ্ঞাসা করিনি। কেন? কোনও প্রয়োজন আছে? –তখনও তাহার তীক্ষ্ণদৃষ্টি খগেন্দ্রের উপর স্থাপিত।
খগেন্দ্র বুঝিল। তৎক্ষণাৎ অন্য কথা পাড়িল। প্রায় দশ মিনিট পরে বলিল–তা হলে এখন উঠি। আপনি এখন আছেন ত?
হ্যাঁ, দিন চার পাঁচ আছি। কতকগুলো কাযকৰ্ম্ম আছে সেগুলো সেরে তবে বাড়ী যাব।
আচ্ছা–আবার এসে দেখা করব এখন। আপনি বোধ হয় এ কদিন ব্যস্ত থাকবেন। যদি এসে দেখা না পাই–ফিরে যাই–বলা রইল গরীবের কথা ভুলবেন না। –বলিয়া খগেন উঠিয়া দাঁড়াইল।
উঠলে? –আচ্ছা, এস, প্রণাম।
খগেন্দ্র তখন বিদায় লইল। দেওয়ানজি আর এক ছিলিম তামাকের হুকুম করিলেন।
০২. “বঙ্গসাহিত্যে যুগান্তর”
বাড়ী গিয়া খগেন ভাবিতে লাগিল, এ দেওয়ানজি লোকটি সহজ নয়–ইহাকে ভুলাইয়া কথা বাহির করা একেবারে অসম্ভব। জমিদারীর কাৰ্য্য করিয়া যে ব্যক্তি চুল। পাকাইয়াছে–কত লোককে ঠকাইয়াছে–কত জজ–ম্যাজিষ্ট্রেটের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ। করিয়াছে–তাহার চক্ষে ধূলি দেওয়ার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র। সুতরাং অন্য উপায় দেখিতে হইবে।
প্রতিদিন সন্ধ্যার পর খগেন্দ্র বেড়াইতে বাহির হইত, নানারূপ আমোদ–প্রমোদ করিয়া অনেক রাত্রে বাড়ী ফিরিত। আজ আর সে বাহির হইল না। আপনার বসিবার কক্ষে, একখানি ঈজিচেয়ারে পড়িয়া চক্ষু মুদিত করিয়া কেবলই চিন্তা করিতে লাগিল।
তাহার যে মহা বিপদ উপস্থিত। কলিকাতা সহরে এমন ধনী মহাজন অল্পই আছে যাহার কাছে খগেন্দ্র ঋণগ্রস্ত নহে। কেহ কেহ নালিশ করিয়া ডিক্রী পাইয়াছে, কাহারও কাহারও নালিশ এখন বিচারাধীন, অনেকে নালিশ করিবে বলিয়া শাসাইতেছে। যাহারা ডিক্রী পাইয়াছে তাহারা কোনদিন আসবাবপত্র ও বাড়ীখানি ক্রোক করিতে আসে ঠিকানা নাই। দুই একমাসের মধ্যে অন্তত: পঞ্চাশ ষাট হাজার টাকা সংগ্রহ করিতে না পারিলে তাহার উপায় নাই। –খগেন্দ্র মাথায় হাত দিয়া বসিয়া কেবল এই সকল কথাই চিন্তা করিতে লাগিল।
ক্ষুদিরাম চা আনিয়া দেখিল, বাবুর এই অবস্থা! মনে মনে বলিল–সুবিধে হয়নি!–সুবিধে হয়নি!
রাত্রে খগেন্দ্র নাম মাত্র আহারে বসিল। বিছানায় পড়িয়া ঘুমাইল না–কেবল এ পাশ ও পাশ করিতে লাগিল–আর ভাবিতে লাগিল।
রাত্রি যখন বারোটা তখন সে মহা উৎসাহের সহিত উঠিয়া বসিল। আপন মনে বলিতে লাগিলহয়েছে–এইবার নির্ঘাত। বাতি জ্বালিয়া, কাগজ কলম লইয়া লিখিতে বসিল।
বঙ্গসাহিত্যে যুগান্তর
অচিন্তিতপূৰ্ব্ব, অভাবনীয়, স্বপ্নাতীত
নূতন কাণ্ড
ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, ভ্রমণবৃত্তান্ত, জীবনচরিত
ও কিম্বদন্তীর অপূর্ব সমন্বয়!
বঙ্গীয় জমিদার–চরিতমালা
সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা এই বঙ্গভূমিতে, কমলার বরপুত্র ভূম্যধিকারিগণই প্রকৃত ভূষণস্বরূপ। ইহাদের বংশাবলীর ইতিহাস, বঙ্গদেশের ইতিহাসের সর্বপ্রধান অংশ আজ আমরা সেই ইতিহাস উদ্ধার করিবার জন্য বদ্ধপরিকর। এই মহাগ্রন্থে, বঙ্গের বহুসংখ্যক জমিদার বংশের আমূল ইতিহাস প্রকাশিত হইতেছে। সেই সঙ্গে সঙ্গে, উক্ত মৃত মহানুভবগণের প্রতিষ্ঠিত দেবমন্দির, জলাশয়, চতুস্পাঠী প্রভৃতি এবং অন্যান্য পূর্ত কার্য্যেরও সচিত্র বিবরণ প্রদত্ত হইবে। আমাদের প্রতিনিধিগণ বঙ্গের গ্রামে গ্রামে গমন করিয়া এই সকল বিবরণ সংগ্রহ করিয়াছেন এবং এখনও করিতেছেন। প্রধান প্রধান জমিদার বংশের বর্তমান বংশধরগণের সচিত্র জীবনচরিতও পুস্তকে সন্নিবিষ্ট হইতেছে। দেড় সহস্র পৃষ্ঠার অধিক, প্রায় তিনশত হাফটোন ছবি সহ বিপুল ও মহা প্রয়োজনীয় গ্রন্থের মুদ্রাঙ্কণ বহু ব্যয়সাধ্য! আমরা অকাতরে যেরূপ পরিশ্রম ও রাশি রাশি অর্থব্যয় করিতেছি–তাহাতে পুস্তকের মূল্য ১০ টাকা ধার্য্য করিলেও অধিক হইত না। কিন্তু বহি বিক্রয় করিয়া আমরা লাভের প্রত্যাশী নহি, দেশের উপকারই আমাদের উদ্দেশ্য। মুদ্রণাদির ব্যয় স্বরূপ ৪ টাকা মাত্র লইয়া এই মহাগ্রন্থ আমরা জনসমাজে বিতরণ করিব। ভাদ্র সংক্রান্তির মধ্যে পত্র লিখিয়া যাহারা গ্রাহক হইবেন, তাঁহাদের পক্ষেই এই নিয়ম, তাহার পর মূল্য বৃদ্ধি হইবে। ১লা আশ্বিন পুস্তক প্রচারিত হইবে। যাহারা হাতে লইবেন, তাঁহারাই ৪ টাকায় পাইবেন। ডাকমাশুল ও ভি–পি খরচ স্বতন্ত্র।
ক্যালকাটা পাবলিশিং কোং
৪৫, হরিমোহন পালের লেন,
কলিকাতা।
এই মুসাবিদাটি প্রস্তুত করিবার পর খগেন্দ্রের তপ্ত মস্তিষ্ক কতকটা শীতল হইল। তখন সে বাতি নিভাইয়া ঘুমাইল।
পরদিন প্রাতে উঠিয়া, চা পান শেষ করিয়াই খগেন্দ্র বাহির হইয়া পড়িল। মসজিদবাড়ী স্ট্রীটের একটি ছাপাখানায় গিয়া, প্রিন্টারকে ডাকিয়া বলিল, মশায়, আমায় এইটি শীগগির ছেপে দিতে পারেন? –বলিয়া পূর্বোক্ত হ্যাণ্ডবিলখানি, প্রিন্টারের হাতে দিল।
প্রিন্টার সেটি দেখিয়া বলিল, কবে চাই?
আজই দশটার মধ্যে।
প্রিন্টার ঘাড় নাড়িয়া বলিল, দশটার মধ্যে হয়ে উঠবে না। সন্ধ্যার সময় দিতে পারি। কত হাজার ছাপতে হবে?
একশো।
মোটে একশো?
হ্যাঁ।
প্রিন্টার লোকটি কিছুক্ষণ ভাবিল, মাঝে মাঝে খগেন্দ্রের মুখের পানে চাহিতে লাগিল। ক্রমে বলিল–বুঝেছি। এখন একশো ছেপে বিলি করে দেখবেন–যদি তেমন ফল হয়, তবে বেশী ছাপবেন, নয়?
খগেন হাসিয়া বলিল, ঠিক ধরেছেন।
নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় প্রদান করিয়া, প্রিন্টারের মনে একটা আত্মগৌরব উপস্থিত হইল। বলিল–আচ্ছা আর একটা কথা বলব?
কি?
এই যে লিখেছেন পুস্তকের মুদ্রাঙ্কণ আরম্ভ হইয়া গিয়াছে–একটা ব্যবসাদারী মাত্র। ছাপা মোটেই আরম্ভ হয়নি। যদি তেমন অর্ডার আসতে থাকে তবেই ছাপতে আরম্ভ করবেন, নইলে এই পৰ্য্যন্ত।
খগেন্দ্র মনে মনে হাসিল। বলিল–উঃ–আপনার কি বুদ্ধি! ঠিক অবিকলটি ধরেছেন।
প্রিন্টার অত্যন্ত খুশি হইয়া উঠিল। বলিল–আজ্ঞে, এই কায করতে করতে চুল পাকালাম। আচ্ছা, এগারোটার সময় আপনি আসবেন। এরি মধ্যে দুটো প্রুফ আমরা দেখে রাখব। আপনি শেষ প্রুফ দেখে দিয়ে বসে থাকবেন আপনার সামনেই ঝড়াঝড় করে বারোটার মধ্যে ছেপে দেব। কাগজের জন্যে একটা টাকা দিয়ে যান।
খগেন্দ্র একটা টাকা দিয়া সেখান হইতে বাহির হইল। চিৎপুর রোডে তাহার পরিচিত একজন ফোটোগ্রাফার ছিল। তাহার নাম ভুবন। খগেন্দ্র সেই ফোটোগ্রাফারের দোকানে গিয়া উপস্থিত হইল।
খগেন্দ্র প্রবেশ করিবামাত্র ভুবন বলিল, আসুন–আসুন–অনেক দিন পরে যে!
খগেন্দ্র একখানা চেয়ার টানিয়া বসিয়া বলিল, বিশেষ প্রয়োজনে এসেছি। মফস্বলে যেতে পারবে?
কবে?
আজ সন্ধ্যার গাড়ীতে। রীতিমত দক্ষিণা পাবে।
পারব। কি করতে হবে?
একজন জমিদারের ফটো তুলে আনতে হবে–আর তাকে জিজ্ঞাসা করে তাঁর জীবনচরিতও লিখে আনতে হবে।
ভুবন বলিল, ব্যাপার কি?
খগেন্দ্র হাসিতে হাসিতে বলিল, দেশ সুদ্ধ হৈ হৈ পড়ে গেছে–আজ তুমি বললে ব্যাপার কি? আমি যে বই ছাপাচ্ছি–জান না?
না–কি বই ছাপাচ্ছেন?
বঙ্গীয় জমিদার–চরিতমালা। যত সব বড় বড় জমিদারের তাতে জীবনচরিত থাকবে–আর ছবি থাকবে।
বিক্রী হবে?
এরই মধ্যে পাঁচ সাতশো অর্ডার এসে গেছে। অনেক জমিদার উপযাচক হয়ে নিজের নিজের ছবি আর জীবন–চরিত লিখে পাঠাচ্ছে। কোন জমিদার দশ, কেউ বিশ, কেউ পঞ্চাশ কপি বইয়ের অর্ডার দিয়েছে।
ভুবন হাসিয়া বলিল, বন্ধুবান্ধবদের বিলোবে। ফন্দি করেচেন ভাল। আপনার খুব মাথা কিন্তু! তা, আমায় কোথা যেতে হবে। ?
বাশুলিপাড়া।
সে কোথা?
খগেন তখন ভুবনকে বাশুলিপাড়া যাওয়া সম্বন্ধে সমস্ত উপদেশ দিল। জমিদারের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়া বলিল, তুমি কাল গিয়ে পৌঁছবে। যত শীঘ্র পার কায সেরে চলে আসবে, দুচার দিনের বেশী দেরী না হয়।
কেন বলুন দেখি?
সেই জমিদারের এক বুড়ো দেওয়ান আছে–ভারি ধড়িবাজ। সে থাকলে সব পণ্ড করে দেবে। সে না থাকলে যদি পঁচিশখানা বইয়ের অর্ডার আনতে পারতে, সে গিয়ে পৌঁছলে, একখানার বেশী অর্ডার পাবে না।
বুঝেছি। তা, কি কি জিজ্ঞাসা করে লিখে আনব বলে দিন।
খগেন্দ্র বলিল, হ্যাণ্ডবিল ছাপা হচ্ছে–একটার সময় তোমায় এনে দেব এখন। প্রথমে হ্যাণ্ডবিল খানকতক বাবুকে পাঠিয়ে দেবে। তারপর তার ছবি তুলে নেবে–খান চার পাঁচ–নানা রকম পশ্চারে। আর জীবনচরিত সম্বন্ধে এই এই কথাগুলি বিশেষ করে জেনে এস। –বলিয়া খগেন তাহাকে উপযুক্ত উপদেশ দিতে লাগিল।
উঠিবার সময় বলিল–আর একটা কথা। খবর্দার যেন ঘুণাক্ষরে আমার নামটি কোরো না। যদি জিজ্ঞাসা করে কারা এসব করছে–যা মনে আসে একটা বলে দিও, বুঝলে?
বুঝেছি।
যদি আমার কাযটি করে আসতে পার, তা হলে ফী যা তাত পাবেই তার উপর ভাল করে তোমায় খুশী করব। আজ সন্ধ্যার গাড়ীতে তোমার যাওয়া নিশ্চয় ত?
নিশ্চয়।
এই নাও খরচের টাকা। আর ফীর বাবদ কিছু। –বলিয়া খগেন ভুবনের হাতে কয়েকখানি নোট দিল।
চতুর্থ দিবসে ভুবন ফিরিয়া আসিয়া স্টেশন হইতে একেবারে খগেন্দ্রের বাড়ীতে গিয়া নামিল। বলিল–মশাই এমন জায়গাতেও পাঠিয়েছিলেন!
কেন, কি হল?
কিছুই হল না। প্রথমে দুদিন ত বাবুর দেখাই পেলাম না। যখনই খোঁজ নিই, তখনই শুনি বাবু অন্দরমহলে। কাল সকালে বাবুর সঙ্গে দেখা হল। আমাকে ত যাচ্ছেতাই বললেন। আগেই হ্যাণ্ডবিলগুলো তাঁকে পাঠিয়েছিলাম কিনা।
কি বললেন?
বললেন, ও সব তোমাদের জুয়াচুরি। দেশে এত বড় বড় রাজা জমিদার থাকতে আমার কাছে এসেছ কেন? –ছবি ছাপাতে হয়, জীবনচরিত লিখতে হয় বড় বড় রাজা মহারাজের কাছে যাও। বর্ধমান রয়েছেন, কুচবেহার রয়েছেন, নাটোর রয়েছেন, কাশিমবাজার, দীঘাপতিয়া–সেখানে না গিয়ে আমার কাছে এসেছ কেন? আমি ছবিও তুলতে দেব না, জীবনচরিতও বলব না।
অতঃপর ভবেন্দ্ৰ যে জুয়াচোর, সে সম্বন্ধে খগেন্দ্রের কোনও সন্দেহই রহিল না।
সেইদিন বৈকালে দেওয়ানজিকে গিয়া বলিল, গ্রীষ্মের ছুটিতে ইস্কুল বন্ধ হয়েছে। কনককেও অনেকদিন দেখিনি। যদি অনুমতি করেন তবে আপনার সঙ্গে বাশুলিপাড়ায় যাই।
দেওয়ানজি স্নেহপূর্ণ স্বরে বলিলেন, যাবে? বেশ ত। আমি পরশু যাব। আমার সঙ্গে চল।
যথাদিনে খগেন্দ্র দেওয়ানজির সহিত বাশুলিপাড়ায় গিয়া পৌঁছিল।
০৩. পাপের মন
খগেন্দ্র যে সময় বাশুলিপাড়ায় পৌঁছিল, তখন সন্ধ্যা হয় হয়। বৈঠকখানা বাড়ীতে যে কক্ষে পূৰ্ব্বে সে বাস করিয়া গিয়াছে, সেইখানে নিজের জিনিষপত্র রাখিল। একজন ভৃত্য তাহার হস্তপদাদি ধৌত করিবার জন্য জল আনিয়া দিল। অন্তঃপুর হইতে থালায় করিয়া জলযোগের উপকরণ আসিল। আহারাদি করিয়া খগেন্দ্র কাছারির বারান্দায় একখানি বেঞ্চিতে একাকী চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। কনকের সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করিবার অত্যন্ত ইচ্ছা–কিন্তু কেই বা অন্তঃপুরে সংবাদ দেয়, কেই বা বন্দোবস্ত করে! দেওয়ানজি নাই, বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া নিজ বাটীতে প্রস্থান করিয়াছেন। শুনিল, আজ আর তিনি আসিবেন না, কল্য প্রাতে আবার তাঁহার দর্শন পাওয়া যাইবে।
একাকী বসিয়া বসিয়া খগেন্দ্রের বিরক্তি ধরিয়া গেল। উঠিয়া বারান্দায় পায়চারি করিয়া বেড়াইতে লাগিল। আজ শুক্লা চতুর্দশী–কিন্তু আকাশে অল্প অল্প মেঘ থাকাতে জ্যোৎস্নাটি স্নান দেখাইতেছিল। একবার ইচ্ছা হইল, যাই গ্রামের পথে পথে একটু বেড়াইয়া আসি। কিন্তু অধিকাংশ পথেরই দুই পার্শ্বে জঙ্গল, পল্লীগ্রামে সর্পভয়–তাই সে কাৰ্য্য কলিকাতাবাসী যুবকের সাহসে কুলাইল না। পদচারণা করিয়া শ্রান্ত হইয়া খগেন্দ্র আবার বেঞ্চিতে উপবেশন করিল। আপন মনে নানা প্রকার চিন্তা করিতে লাগিল। সুরবালার গঙ্গায় ভাসিয়া আসা, বাগানে হঠাৎ ভবেন্দ্রকে দেখিয়া তাহার ভাবপরিবর্তন, আহারে উপবিষ্ট ভবেন্দ্রের পানে সে রাত্রে সুরবালার একদৃষ্টে চাহিয়া থাকা, পরে কনকের সহিত তাহার কথোপকথন–কনকের পত্রে এ সমস্ত খগেন্দ্র অবগত হইয়াছিল। সকল কথা বারম্বার পর্যালোচনা করিয়া তাহার মনে স্থির বিশ্বাস জন্মিয়াছে, সুরবালার ভাসিয়া আসাটা দৈবাধীন ঘটনা নহে–তথাকথিত ভবেন্দ্র ও তাহার মধ্যে চক্রান্তেরই অংশ বিশেষ। ভবেন্দ্রের পরিচয় আবিষ্কার করা যদি কঠিনও হয়, সুরবালা কে, তাহা ধরিতে পারিলেই ভবেন্দ্রের প্রকৃত ব্যাপার ধরা পড়িয়া যাইবে। কনকের সঙ্গে সাক্ষাৎ একবার বিশেষ আবশ্যক–তাহার কোনও সুযোগ না পাইয়া খগেন্দ্ৰ ছটফট করিতে লাগিল।
খগেন্দ্র যেখানে ছিল, তাহার অল্প দূরেই কাছারি বাড়ী। সেখানে দুই চারিজন লোককে বসিয়া থাকিতে দেখিল। ভাবিল, এখানে একাকী বসিয়া কি করিব–যাই উহাদের সঙ্গে গল্পগুজব করি।
এইরূপে বৃথা কাযে সন্ধ্যা কাটিয়া গেল। রাত্রি দশটার সময় কাছারি বাড়ীতে আমলাদের সঙ্গে বসিয়া আহার করিয়া খগেন আবার বৈঠকখানায় ফিরিয়া আসিল। দেখিল, ভৃত্যগণ কেহ সিঁড়িতে আলো জ্বালিতেছে, কেহ ব্যস্তভাবে উপরে উঠিতেছে, কেহ নামিয়া আসিতেছে। খগেন্দ্র বুঝিল, উপরে বাবুর জন্য শয্যাদি প্রস্তুত হইতেছে।
কিয়ৎক্ষণ পরেই লণ্ঠনধারী বর্কন্দাজের পশ্চাৎ পশ্চাৎ অন্তঃপুরের দিক হইতে কে আসিতেছে দেখা গেল। ভৃত্যগণ বলাবলি করিয়া উঠিল–হুজুর আসিতেছেন।
রাখাল, বারান্দায় পৌঁছিতেই খগেন্দ্র সসম্ভ্রমে দাঁড়াইয়া উঠিল। নিকটে আসিলে মস্তক ঈষৎ অবনত করিয়া বাবুকে নমস্কার করিল।
রাখাল বলিল, আপনি কে?
বর্কন্দাজ আলোটা একটু উচ্চ করিয়া ধরিল। রাখাল দেখিল, এ ব্যক্তি অপূৰ্ব্ব রূপলাবণ্যশালী
খগেন্দ্র নিজের নাম বলিল। রাখাল বিস্মিত দৃষ্টিতে তাহার মুখের পানে চাহিয়া বলিল, দেওয়ানজির সঙ্গে কলকাতা থেকে এসেছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার ভগ্নী রা
খাল বাধা দিয়া বলিল, আমি জানি। তা–আপনার আহারাদি হয়েছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ভৃত্যগণের পানে চাহিয়া বলিলেন, বাবুর বিছানা-টিছানা করে দিয়েছিস?
ভৃত্যগণ বলিল, হুজুর
কোথা?
ঝাড়লণ্ঠনের গুদামের পাশে সেই কোণের ঘরটায়। বাবু আরও একবার এসেছিলেন, সেই ঘরেই শুতেন।
রাখাল বলিল, হ্যাঁ–তা জানি! আপনার কোনও রকম অসুবিধা হচ্ছে না ত? –খগেন্দ্রকে উত্তর দিবার অবসর না দিয়াই রাখাল বর্কন্দাজকে অগ্রসর হইতে ইঙ্গিত করিল। সঙ্গে সঙ্গে বলিল–চলুন দেখি বিছানা–টিছানা কি করেছে।
রাখালের এই ব্যবহার খগেন্দ্রের একেবারে অপ্রত্যাশিত। বাবুকে আসিতে দেখিয়া সে ভাবিয়াছিল, তিনি নমস্কার প্রত্যর্পণ করিয়া বিনা বাক্যব্যয়ে সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া যাইবেন। বার্ষিক লাখ টাকা যাঁহার আয়, তিনি, যাহাকে মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনের ইস্কুলের মাষ্টার বলিয়া জানেন, তাহার ভোজন ও বাসস্থানের সুবিদা অসুবিধার বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হইবেন, ইহা খগেন্দ্র কল্পনাই করে নাই। মূঢ়ের ন্যায় বাবুর পশ্চাতে পশ্চাতে গিয়া নির্দিষ্ট শয়নকক্ষের মধ্যে প্রবেশ করিল।
রাখাল কক্ষখানির চতুর্দিকে মনোযোগের সহিত দৃষ্টিপাত করিল। শয্যার দিকে চাহিয়া বলিল–একটা পুরোনো মশারি দিয়েছিস কেন? আর মশারি ছিল না?
ভৃত্য বলিল, কাল বদলে দেব এখন।
আর, এক কলসী জল রাখিসনি? এই গ্রীষ্মকালরাত্রে যদি পিপাসা পায়, একটু জলের জন্যে কাকে ডাকাডাকি করতে যাবেন? যা–এক কলসী ভাল জল, একটা গেলাস, এনে রেখে দে। আর তক্তপোষখানা আর একটু সরিয়ে ঐদিকে করে দিলে, দুদিকে দুটো জানালার হাওয়া পেতেন–যে গরম!
ভৃত্যগণ তৎক্ষণাৎ তক্তপোষ সরাইয়া দিল। দুই তিন হস্তের ব্যবধানে মাথার কাছে একটা এবং পার্শ্বে একটা লোহার গরাদেযুক্ত বড় জানালা পড়িল।
দেখিয়া শুনিয়া রাখাল বলিল, এবার বিশ্রাম করুন–অনেক রাত্রি হয়েছে। –বলিয়া সে প্রস্থান করিল।
বাবু চলিয়া গেলে, খগেন্দ্র অনেকক্ষণ মাথায় হাত দিয়া শয্যাপ্রান্তে বসিয়া রহিল। ভাবিতে লাগিল, বাবু এ রকম ব্যবহার করিলেন কেন? তাহার মনে কোনও গূঢ় অভিসন্ধি নাই ত? তিনি আমার গোপন অভিপ্রায়টি কোনও সূত্রে অনুমান করিয়াছেন কি? আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন–অর্ধেক কথা আমি বলিতে না বলিতেই, তিনি বলিলেন, জানি। আমি পূৰ্বে আসিয়া যে এই কক্ষে শয়ন করিয়াছিলাম, ভৃত্য তাহা ইঙ্গিত করিবামাত্র আবার বলিলেন, জানি। এতবড় একটা জমিদারের বৈঠকখানা বাড়ী, নিত্য কত লোক আসিতেছে, যাইতেছে, কোন্ ঘরে কে শয়ন করিল তাহার সংবাদ রাখা বাবুর পক্ষে একটু অস্বাভাবিক নহে কি? –যদি বাবু কিছু সন্দেহ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমাকে সহজে ত ছাড়িবেন না! হয় আমার প্রাণহানি পৰ্য্যন্ত করিতে পারেন।
খগেন সেই মানুষ-সমান খোলা জানালা দুটির পানে চাহিয়া দেখিল। মেঘ কাটিয়া গিয়াছে, জ্যোৎস্না টক্ টক্ করিতেছে। এক দিকের জানালার বাহিরে পতিত জমি–কতকগুলা আগাছা জন্মিয়াছে। অল্পদূরেই গোটা দুই তিন বাঁশঝাড়। বাতাসে বংশপত্রগুলার পরস্পর সম্মাতে চিট পিট শব্দ উত্থিত হইতেছে। অপর দিকের জানালাটির বাহিরে চারি পাঁচ হাত অন্তরেই জঙ্গল। কতকগুলা গাবৃভেরাণ্ডা ও শেওড়া গাছ ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। তাহার পশ্চাতে, উচ্চতর বৃক্ষ–অল্প আলোকে ভাল চেনা যাইতেছে না। সেই দিকটা হইতে ঝিঁঝিপোকার অবিশ্রান্ত শব্দ শুনা যাইতেছে। একটা কি রকম গন্ধও সেদিক হইতে আসিতেছে–খগেন্দ্র পল্লীবাসী হইলে বুঝিতে পারিত তাহা ঘেঁটুফুলের গন্ধ। সে দিকটায় চাহিয়া খগেনের মনে একটু একটু ভয় হইতে লাগিল। ভাবিল, আচ্ছা ধর–অনেক রাত্রে, আমি ঘুমাইয়া আছি, ঐ জঙ্গল হইতে বাবুর বেতনভোগী, মাথায় কঁকড়া চুল, ষণ্ডামার্কা একজন বাঙ্গী কি দুলে যদি সড়কি হাতে করিয়া বাহির হইয়া আসে–এই খোলা জানালার গরাদের ভিতর দিয়া, সড়কী চালাইয়া আমার মস্তকের মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দেয়? –ভাবিতে খগেন্দ্রের সৰ্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিল।
একাকী সেই গভীর রাত্রে–তাহার পাপ মনে সন্দেহ ক্রমে বৃদ্ধি হইতে লাগিল। ভাবিল–ভুবন ফটোগ্রাফওয়ালা আসিয়া নিষেধসত্ত্বেও কোন কথা প্রকাশ করে নাই ত? হয়ত বা দেওয়ানজিই আসিয়া বাবুর কাছে গল্প করিয়াছেন–তোমার সম্বন্ধে অনেক খুঁটিনাটি কথা খগেন্দ্র আমায় জিজ্ঞাসা করিতেছিল। তবে ত আর রক্ষা নাই! নিশ্চয়ই আমাকে গোপনে হত্যা করিবার বন্দোবস্ত হইয়াছে। আমার শয়নের কি ব্যবস্থা হইয়াছে। কেবলমাত্র তাহাই দেখিবার জন্য–আমার অসুবিধা নিবারণের জন্য–বাবু আসেন নাই। শুধু আমার গায়ে বাতাস লাগিবে বলিয়াই তক্তপোষ সরাইবার ব্যবস্থা করেন নাই। জানালার কাছে হইলে সড়কী চালাইবার সুবিধা হইবে, এই তাহার অভিসন্ধি। ভয়ে, উৎকণ্ঠায় খগেন্দ্রের গাত্রময় ঝর ঝর করিয়া ঘৰ্ম্ম বহিতে লাগিল।
বসিয়া বসিয়া খগেন্দ্র আবার ভাবিল, এখন কি করা যায়? দুয়ারটি খুলিয়া আস্তে আস্তে বাহির হইয়া, পলায়ন করিব? –আবার মনে হইল, যদি ইহারা আমায় খুন করিবার মলবই করিয়া থাকে–তবে নিশ্চয়ই পাহারা আছে। পলাইতেছি দেখিলেই লাঠির ঘায়ে আমার মাথা ভাঙ্গিয়া ফেলিবে। যদি পলাইতে হয়, তবে সে বরং কল্য দিবাভাগে। ভাবিয়া চিন্তিয়া, খগেন্দ্র উঠিয়া জানালা দুইটি বেশ করিয়া বন্ধ করিয়া দিল। বাতি ধরিয়া দেখিল, জানালার কপাটগুলি মজবুত শাল কাষ্ঠের নির্মিত–কজা ছিটকিনি প্রভৃতিও হাল্কা নহে। বদ্ধ দ্বারের নিকটে আলোক লইয়া গিয়া দেখিল, দ্বার ও অর্গলাটও জানালারই মত সুদৃঢ়; হঠাৎ বাহির হইতে কেহ ভাঙ্গিতে পারিবে না। তখন দ্বার বন্ধ করিয়া খগেন্দ্র মশারির ভিতর প্রবেশ করিল। শয়ন করিল না–বিছানায় বসিয়া রহিল। আবদ্ধ ঘরে জ্যৈষ্ঠ মাসের গুমটে হঠাৎ নিদ্রা আসিবারও সম্ভাবনা ছিল না। হাতপাখা দিয়া নিজেকে বাতাস করিতে করিতে, ঢুলিতে ঢুলিতে, কখনও শুইয়া কখনও বসিয়া, কাছারির পেটা ঘড়িতে ক্রমে বারোটা, একটা, দুইটা, এবং তিনটা বাজা শুনিল।
তাহার পর ঘুমাইয়া পড়িল, কিন্তু সেও অধিকক্ষণ নহে। একটা বিভীষিকাময় স্বপ্ন দেখিয়া জাগিয়া উঠিল। বাহিরে তখন কাক ডাকিতে আরম্ভ করিয়াছে। জানালার ফাঁক দিয়া প্রভাতের আলোক কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিতেছে।
০৪. সাবাস্ কনক–সাবাস্
বেলা সাতটার সময় দেওয়ানজি আসিলেন। খগেন তাঁহার নিকটভগ্নীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার বাসনা জানাইল। দেওয়ানজি বলিলেন, আচ্ছা, আমি বন্দোবস্ত করিয়া দিতেছি।
ঘণ্টাখানেক পরে অন্তঃপুরের ঝি আসিয়া খগেন্দ্রকে লইয়া গেল। একটি কক্ষে . প্রবেশ করিয়া দেখিল, একখানি চেয়ার রহিয়াছে, তাহার নিকটে কনক সহাস্যবদনে দাঁড়াইয়া আছে।
এই যে–আসুন!–বলিয়া কনক তাঁহাকে সস্মিত বদনে অভিবাদন করিল। পৌঁছিয়া দিয়া ঝি চলিয়া গেল।
খগেন কাছে গিয়া মৃদুস্বরে বলিল, গৃহস্থ বাড়ীতে থেকে থেকে অভিনয় করাটা ভুলে গেলে?
কনক অল্প হাসিয়া বলিল, কেন?
আমি তোমার দাদা–গুরুজন–পূজনীয় ব্যক্তি। কতদিন পরে এসেছি–আমায় প্রণাম করলে না? –ঝি কি মনে করলে?
কনক হাসিয়া বলিল, ঝি মনে করলে–-কলকাতার লোকদের কেতাই বুঝি এই রকম; গুরু লঘু জ্ঞান ক্রমেই তাদের লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বসুন। –বলিয়া চেয়ারখানি দেখাইয়া দিল।
নিকটে শতরঞ্জ মোড়া এক তক্তপোষ ছিল, তাহারই প্রান্তে কনক উপবেশন করিয়া বলিল, আমাকে আর কতদিন এখানে রাখবেন? আমার প্রাণ যে হাঁপিয়ে উঠলো!
কেন, এখানে তোমার কিছু কষ্ট হচ্ছে?
কনক মুক্তদ্বারের পানে নিমেষের জন্য চাহিয়া, অভিনয় ভঙ্গিতে বলিল, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে কে বাঁচিতে চায়!
খগেনও চকিতভাবে দ্বারের পানে চাহিয়া তাড়াতাড়ি বলিল, হয়েছে–হয়েছে, তুমি অভিনয় ভোলনি! এখনও বেশ পার।
কনক, বাইজীর অনুকরণে সেলাম করিয়া বলিল, ওস্তাদজী–আপহি কা কুদরৎ।
পরস্পরের শারীরিক স্বাস্থ্য সম্বন্ধে দুই চারিটা বচন-বিনিময়ের পর খগেন্দ্র কিয়ৎক্ষণ নীরব রহিল।
কনক বলিল, ভাবছেন কি?
না–ভাবিনি কিছু। তোমাদের বউরাণীর খবর কি বল।
বউরাণী ত মশগুল হয়ে রয়েছেন।
কি রকম?
কি রকম আর? নতুন প্রেমে পড়লে যে রকম হয়।
তবে যে শুনলাম ওদের দেখাশুনো নেই।
রাত্রে নেই–দিনে ত আছে। দুতিন দিন থেকে দেখছি, বিকেল থেকে সন্ধ্যের পর পৰ্য্যন্ত, অন্দরের বাগানে চাঁদের আলোয় দুজনে পাইচারি করে বেড়ান।
খগেন বলিল, তাতে দোষ কি?
না–দোষ নেই, তবে আপনি বড় আশাটা করেছিলেন–হতাশ হলেন। হতাশের আক্ষেপ–টাক্ষেপ একটা কিছু লিখে ফেলুন। –বলিয়া অভিনয়ের সুরে ঊর্ধ্বমুখী হইয়া বলিল
ওরে দুষ্ট দেশাচার, কি করিলি খগেন দাদার,
কার ধন কারে দিলি, তাহার সে হল না।
আবার কৃত্রিম দুঃখে মুখখানি অবনত করিয়া, অঞ্চলপ্রান্ত চক্ষে দিয়া, কাল্পনিক অশ্রু মুছিতে লাগিল।
খগেন্দ্র বলিল, এখন অভিনয় থাক। কাযের কথা বল দেখি। এ লোকটা কে, কিছু সন্ধান পেলে?
কি করে পাব? আমি কি ডিটেকটিভ?
আগে কোথায় থাকত, এ সব কিছু শোননি?
পশ্চিমের কোন্ এক মঠের মোহান্ত ছিল।
সে মঠের নাম কি? কোথা সে মঠ?
কি করে জানব বলুন?
বউরাণীর সঙ্গে এত গল্প হয় নিশ্চয়ই এতদিন বলেছে। বউরাণীর কাছ থেকে কথায় কথায় জেনে নিতে পার না? মঠের মোহান্ত ছিল, এ কথাই বা তুমি জানলে কি করে?
কাশী থেকে উনি দেওয়ানজিকে প্রথম যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতেই ছিল। সে চিঠি দেওয়ানজি রাণীমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন।
সে চিঠিতে মঠের নাম ঠিকানা লেখা ছিল?
চিঠি ত আমি শুনিনি। রাণীমাই বলেছিলেন, মঠের মোহান্তগিরি ছেড়ে দিয়ে কাশীতে এসে রয়েছেন।
সে চিঠি কোথা? দেওয়ানজি রাণীমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন?
তা ত বলতে পারিনে।
রাণীমা কোন ঘরে শোন? তাঁর বাক্স-টাক্স কোথা থাকে?
কনক হাসিয়া বলিল, কেন, আমাকে কি রোহিণী হতে হবে?
দেখই না চেষ্টা করে।
যখন ধরা পড়ব–গোবিন্দলাল কোথা পাব? আমায় থানায় পাঠিয়ে দেবে যে!
খগেন্দ্র হাসিয়া বলিল, গোবিন্দলাল ত হাতের কাছেই রয়েছে। রাজার ন্যায় ঐশ্বৰ্য্য–বছরে লক্ষ টাকা আয়–তোমার মত একটি রোহিণী পেলে সে ত বেঁচে যায়। সে কথা যাক। আচ্ছা, ঐ সুরবালা সম্বন্ধে তোমার কি এখনও বিশ্বাস, ও আগে। থেকেই এই জাল ভবেন্দ্রকে চিনত?
আমার তাই বিশ্বাস।
তা হলে নিশ্চয়ই ওরা দুজনে ষড়যন্ত্র করে এসেছে। একজন জুয়াচোর এতবড় একটা ফন্দী করে আসবে, সে একলা কখনই আসবে না। অন্তঃপুরের মধ্যে তার একজন গোয়েন্দা আবশ্যক। সুরবালাই সেই গোয়েন্দা।
কনক বলিল, তা যদি হয়, তা হলে সেদিন বাগানে প্রথমে বাবুকে দেখে সুরবালা অমন চমকে উঠবে কেন? যা অভাবনীয়, তাই দেখেই না মানুষ চমকায়!
খগেন্দ্র বলিল, আমারও প্রথম প্রথম তাই মনে হত বটে। কিন্তু অনেক ভেবে চিন্তে, আমি ও সমস্যার একটা উত্তর বের করেছি।
কি বলুন দেখি?
ওরা দুজনে যে সময় ষড়যন্ত্র করেছিল, সে সময় এটা স্থির হয়নি যে ঐ জুয়াচোর সন্ন্যাসী সেজে আসবে। এই স্থির হয়ে থাকবে যে, সাধারণ বেশেই এখানে আসবে–বলবে আমি সন্ন্যাসী ছিলাম, সে সব ছেড়ে–ছুঁড়ে দিয়ে আবার ঘরে ফিরে এলাম। ওদের এ পরামর্শ হবার পরেই, সুরবালা নৌকায় এসে, অন্দরের ঘাটে নেমে জলে ডোবা মড়া সেজে শুয়েছিল। তার মাস দুই পরে জাল ভবেন্দ্র এসেছে। সুরবালার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর হয়ত সে মনে মনে করেছে, এখন সন্ন্যাসী বেশে যাওয়া ভাল–মাস ছয় এখন জপ তপ ব্রহ্মচর্য্য বুজরুকি দেখালে, কেউ আর কোনও সন্দেহ করবে না। সুরবালা যে চমকে উঠেছিল, সে জাল ভবেন্দ্রকে দেখে নয়, তার সন্ন্যাসী বেশ দেখে।
খগেনের কথা শেষ হইলে, কনক দুই মিনিট কাল–গালে হাত দিয়া বসিয়া ভাবিল। শেষে বলিল–ঠিক বলেছেন খগেনবাবু।
খগেন বলিল, তুমি যদি কথায় কথায়, কৌশলে, অন্ততঃ সুরবালার কিছু পরিচয় আদায় করতে পার–
কনক বাধা দিয়া তাড়াতাড়ি বলিল, তা হলে আপনার কাৰ্যসিদ্ধি হয়?
নিশ্চয়। দুজন ষড়যন্ত্রকারীর মধ্যে একজনের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারলেই, অন্যজনেরও সব কথা ধরা পড়বে।
উত্তেজিত স্বরে কনক বলিল, তা যদি হয়, তবে তা হলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।
খগেনও উত্তেজিত হইয়া বলিল, পার?
পারি। সুরবালার বাপের বাড়ী কোথা তা জানি।
কোথা? কোথা? কেমন করে জানলে?
একদিন কথায় কথায় ও বলে ফেলেছিল–আমাদের বসন্তপুরে ছেলেবেলায় দেখেছি–বলেই সামলে নিলে।
সেখানে ওর বাপের বাড়ী কি শ্বশুরবাড়ী কি করে জানলে?
ঐ যে বললে–ছেলেবেলায়।
খগেন্দ্র কুঞ্চিত করিয়া একটু ভাবিয়া বলিল, হ্যাঁ–বাপের বাড়ী হতেও পারে। যদি শ্বশুরবাড়ী হয়, তাতেও ক্ষতি নেই। বসন্তপুর কোথা, কিছু আন্দাজ করতে পার?
ওর কথাবার্তায় ওকে বর্ধমান জেলার লোক বলেই বোধ হয়। রকে বলে ড়–ড়কে বলে র। আমরা কাপড় পরি, ও কাপর পড়ে। –বলিয়া কনক হাসিতে লাগিল।
খগেন্দ্র একমিনিট কাল চিন্তা করিল। তাহার পর, সহাস্যমুখে কনকের পৃষ্ঠে মৃদু আঘাত করিয়া বলিল, সাবাস কনক–সাবাস। এইবার অন্ধকারে পথ পেলাম।
কি করবেন এখন?
আমি আজই কলকাতায় ফিরে যাব। পোষ্ট আপিসের বই থেকে এই বসন্তপুর কোথা, বের করে, সেখানে গিয়ে গোপন অনুসন্ধান করব।
কিন্তু মনে রাখবেন, হয়ত ওর আসল নাম সুরবালা নয়।
সে আমায় বলতে হবে না। সেই গ্রামের কোন্ স্ত্রীলোক, চৈত্রমাসের পূৰ্ব্বে ছিল, চৈত্রমাস থেকে আর গ্রামে নেই–এই খবরটি পেলেই সবই ক্রমে জানতে পারব।
কনক একটু ভাবিয়া বলিল, যদি এ রকম হয়–পাঁচ সাত বছর সে গ্রামও পরিত্যাগ করেছে–এখানে অন্যত্র থেকে এসেছে কলকাতা কি কৃষ্ণনগর?
কপাল টিপিয়া ধরিয়া খগেন্দ্র বলিল, হ্যাঁ–তা হলে মুস্কিল বটে। আচ্ছা–যে শাড়ীখানা পরে ও ভেসে এসেছিল, সে শাড়ীখানা কোথা?
আছে। কেন?
সে শাড়ীখানা আমায় দিতে পার?
সে শাড়ীখানা ওর ঘরে আলনায় কালও আমি দেখেছি।
কোনও অছিলা করে সেখানি চেয়ে এনে আমায় দিতে পার না?
কি করবেন?
বসন্তপুরের ধোপাদের সে শাড়ী দেখালেই, কার শাড়ী তারা বলে দিতে পারবে। শাড়ীখানা আমায় চাই-ই চাই।
আমি বিধবা মানুষ। পাড়ওয়ালা শাড়ী কি অছিলায় চেয়ে আনব?
আচ্ছা, একবার এনে আমায় দেখাও শুধু।
হ্যাঁ–তা অনায়াসে পারি। –বলিয়া কনক উঠিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে শাড়ীটি বস্ত্রের মধ্যে লুকাইয়া আনিয়া দিল।
খগেন আগ্রহের সহিত শাড়ীটির চারিকোণ পরীক্ষা করিল। এককোণে ধোপার চিহ্ন পাইল। নিমেষ মধ্যে, পকেট হইতে ছুরি বাহির করিয়া, সেই অংশটুকু তির্য্যভাবে কাটিয়া লইল।
কনক বলিলও কি করলেন?
খগেন্দ্র কোনও উত্তর না দিয়া কৰ্ত্তিক অংশটুকু নিজের পকেটে পুরিল। তাহার পর শাড়ীর ছিন্ন প্রান্তটি আঙুলে টানিয়া টানিয়া খানিক সূতা বাহির করিয়া ফেলিল। বলিল–এখন আর কাটার মত দেখাচ্ছে না, ছেঁড়ার মত দেখাচ্ছে। যাও যেখানকার শাড়ী সেখানে রেখে এস। আমি এখন উঠি। বিকেলে এখান থেকে রওনা হব।
আজই চললেন
হ্যাঁ–আজই।
আমায় আর কতদিন এখানে থাকতে হবে?
বড় জোর দুমাসের মধ্যেই এই জাল ভবেন্দ্রের সমস্ত নাড়ী–নক্ষত্র আমি যদি জানতে না পারি, তবে আমার নাম খগেন্দ্র নয়। –বলিয়া খগেন্দ্র উৎসাহদীপ্ত মুখে দণ্ডায়মান হইল। পকেট হইতে কতকগুলি নোট বাহির করিয়া বলিল–এই নাও কনক তোমার দুমাসের মাইনের টাকা। আর দুটো মাস তুমি অপেক্ষা করে থাক। তা হলেই কাৰ্যসিদ্ধি।
পরদিন কলিকাতায় পৌঁছিয়া অনুসন্ধানে খগেন্দ্র আবিষ্কার করিল, বর্ধমান জেলায় একটা, ছাপরা জেলায় একটা এবং পূর্ণিমা জেলায় একটা–সৰ্ব্বসুদ্ধ তিনটা মাত্র বসন্তপুর আছে। সুতরাং তৎপরদিন সে নিঃসংশয়ে বর্ধমান জেলার বসন্তপুরে গিয়া উপনীত হইল।
০৫. বসন্তপুরে সোণার হরিণ
বসন্তপুর গ্রামের ডাকঘরটি ঠিক বাজারের মধ্যস্থলে অবস্থিত। তখন বেলা একটা বাজিয়াছে। আকাশে মেঘ করিয়াছে, বায়ু বন্ধ, গ্রীষ্মে প্রাণ অস্থির হইয়া উঠে। ডাক আসিবার সময় হইয়াছে, আপিস কক্ষের বাহিরে বারান্দায় বসিয়া ডাকবাবু অপেক্ষা করিতেছিলেন। ডাকটা আসিলেই চিঠিপত্রগুলা পিয়নের জিম্মা করিয়া দিয়া বাসায় গিয়া তিনি একটু বিশ্রাম করিবেন। মেমারি স্টেশন হইতে ঘোড়ার গাড়ীতে ডাক আসে–চারিজন যাত্রীর বসিবার স্থান সে গাড়ীতে আছে, প্রত্যেককে দুই টাকা ভাড়া দিতে হয়। জানালার ভিতর দিয়া আপিস কক্ষের ঘড়িটি দেখা যাইতেছে। একটা বাজিয়া দশ মিনিট হইল, পনেরো মিনিট হইয়া গেল, তথাপি ডাকগাড়ীখানির দেখা নাই। পোষ্টমাষ্টার চেয়ারে বসিয়া দুলিতেছেন, মাঝে মাঝে জাগিয়া উঠিয়া ঘড়ির পানে চাহিতেছেন, টেবিলের উপর হইতে ভি-পি রেজিষ্টার বহিখানি তুলিয়া নিজেকে বাতাস করিতেছেন, হাই তুলিতেছেন, আবার ঢুলিয়া পড়িতেছেন।
গ্রীষ্ম ক্রমে বাড়িয়া উঠিল, দেড়টাও বাজিয়া গেল। খড়মের খটখট শব্দে হঠাৎ ডাকবাবুর তন্দ্রাভঙ্গ হইল। চাহিয়া দেখিলেন, মুখুয্যে মহাশয়। আজ শনিবার বঙ্গবাসী আসিবার দিন। গায়ে সেই হাতকাটা পিরাণ, বগলে ছাতি, আহারান্তে পাণ চিবাইতে চিবাইতে মুখোপাধ্যায় আসিয়া দর্শন দিলেন। বলিলেন–ডাকগাড়ী এল ভায়া?
ডাকবাবু ভাল করিয়া জাগিয়া উঠিয়া বলিলেন, আসুন মুখুয্যে মশায়, বসতে আজ্ঞা হোক। ওহে পিয়ন, ভিতর থেকে বাবুকে একখানা চেয়ার এনে দাও ত। কই না, ডাকগাড়ীর ত এখনও দেখা নেই।
মুখোপাধ্যায় উপবেশন করিয়া বলিলেন, আজ এত দেরী কেন?
কি জানি, রেলগাড়ী বোধ হয় লেট করে এসেছে।
দুই এক কথার পর পিয়নের দিকে চাহিয়া মুখোপাধ্যায় বলিলেন, ওহে, এক ছিলিম তামাক খাওয়াও না।
পিয়ন তামাক সাজিতে গেল। মুখোপাধ্যায় বলিলেন, গেল সপ্তাহের বঙ্গবাসী পড়েছ?
ডাকবাবু বলিলেন, না।
লেডি ইস্মিথে যে ভয়ানক কাণ্ড! ইংরেজদের অবস্থা বড় সঙ্গীন।
ডাকবাবু নিতান্ত ঔদাস্যের সহিত বলিলেন, বটে!
হা হে, কখন কি হয় বলা যায় না। হয়েছে কি জান? –বলিয়া ফস করিয়া মনি অর্ডারের একখানা শাদা ফৰ্ম্মে, মুখোপাধ্যায় তাড়াতাড়ি যুদ্ধক্ষেত্রের একটা নক্সা আঁকিয়া ফেলিলেন। গত সপ্তাহের বঙ্গবাসী অনুসারে ইংরাজ সৈন্য কিরূপ সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পতিত, তাহাই বুঝাইতে লাগিলেন। ডাক আসিতে বিলম্ব হওয়ায় নিজের অবস্থা কিরূপ সঙ্কটাপন্ন, সেই চিন্তাতেই ডাকবাবু ব্যস্ত ছিলেন–ইংরাজ সৈন্যের সঙ্কটে তাদৃশ মনোযোগ দিলেন না। বুঝান শেষ হইলে মুখোপাধ্যায় বলিলেন, বললে তুমি বিশ্বাস করবে না, ইংরেজদের কি হল কি হল ভেবে ভেবে এ একসপ্তাহ রাত্রে আমার ঘুম। হয়নি।
ইতিমধ্যে তামাক আসিয়াছিল, ডাকবাবু তাহার সদ্ব্যবহারে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁহার হাত হইতে হুঁকাটি লইয়া মুখোপাধ্যায় দুশ্চিন্তা দমনে যত্নবান হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরেই দূরে ডাকগাড়ীর ঘড় ঘড় শব্দ উত্থিত হইল।
ক্রমে গাড়ী আসিয়া পোষ্ট আপিসের সম্মুখে দাঁড়াইল। পক্ষিরাজের সুযোগ্য বংশধর দুইটি, ঘর্মাক্ত কলেবরে দাঁড়াইয়া হাঁপাইতে লাগিল। গাড়ীর ভিতর হইতে তিনজন আরোহী অবতরণ করিল–দুইজন গ্রামের লোক, এক ব্যক্তি অপরিচিত। শেষোক্ত লোকটির সোণার চশমা, আলবার্ট টেরি, সুগৌর কান্তি এবং সুন্দর গঠন দেখিয়া ডাকবাবু ও মুখোপাধ্যায় তাহার মুখের পানে ফ্যালফ্যাল্ করিয়া চাহিয়া রহিলেন। বলা বাহুল্য সে খগেন্দ্র।
গাড়ীর ছাদ হইতে পিয়ন ডাকের ব্যাগ নামাইয়া লইল, ক্যোচমান ও তাহার সহকারী আরোহিগণের জিনিষপত্র নামাইয়া দিল। অপর দুইজন আরোহীকে খগেন্দ্র বলিল, একটু দাঁড়ান। নিজের তোরঙ্গ খুলিয়া একতাড়া কাগজ বাহির করিল। তাহাদের হস্তে এক একখানি কাগজ দিয়া বলিল–এই বইখানি বেরুচ্ছে। ভারি ভাল বই, বিজ্ঞাপনটি অনুগ্রহ করে পড়ে দেখবেন। তাহার পর ডাকঘরের বারান্দায় উঠিয়া, বিনীতভাবে শিরোনমন করিয়া বলিল–মশায়–সঙ্গে সঙ্গে ডাকবাবুকে একখানি, মুখোপাধ্যায়কে একখানি সেই বিজ্ঞাপন দিল। একখানি টুল সেখানে ছিল, বিনা আহ্বানেই তাহার উপর বসিয়া পড়িল।
হাতকাটা পিরাণের বুক–পকেটে চশমার খোল অনুসন্ধান করিতে করিতে মুখোপাধ্যায় বলিলেন, মশায়ের নাম?
আমার নাম শ্রীখগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।
নিবাস?
কলকাতা।
কোথায় যাওয়া হবে?
আপাততঃ আপনাদের এই গ্রামেই এসেছি।
কাদের বাড়ী?
কারু বাড়ীতে নয়।
কি মনে করে আসা হয়েছে?
আজ্ঞে একখানা বই বের করেছি, বিজ্ঞাপনটি পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন। সেই বইয়ের জন্যে মাল মশলা সংগ্রহ করাই উদ্দেশ্য। আর যদি দুচারটে গ্রাহকও জোটাতে পারি। –বলিয়া খগেন্দ্র পোষ্টমাষ্টার ও মুখোপাধ্যায়ের মুখের দিকে পৰ্য্যায়ক্রমে মিনতিপূর্ণ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল। পোষ্টমাষ্টার বিনা বাক্যব্যয়ে ডাকের ব্যাগ কাটিতে নিযুক্ত রহিলেন।
মুখোপাধ্যায় তখন চশমাটি পরিয়া, বিজ্ঞাপনের কাগজখানি চোখের সম্মুখে ধরিয়া পড়িতে লাগিলেন।
বঙ্গসাহিত্যে যুগান্তর
অচিন্তিতপূর্ব অভাবনীয় স্বপ্নাতীত
নূতন কাণ্ড
ইত্যাদি। পাঠশেষে মুখোপাধ্যায় বলিলেন, পয়লা আশ্বিন বেরুবে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
যদি কিছু মনে না করেন ত একটা কথা বলি। –বলিয়া মুখোপাধ্যায় মুখখানি গম্ভীর করিয়া রহিলেন। তাঁহার ভাবটা যেন–-উঃ কলিকালে কি সব অনাচার আরম্ভ হইল!
কি?
মাসের পয়লা তারিখটে ত ভাল দিন নয়, অগস্ত্য–যাত্রা কিনা!
খগেন্দ্র হাসিয়া বলিল, আজ্ঞে সেই জন্যেই ত ঐ তারিখে বের করা।
মুখোপাধ্যায় একটা দ্বিধায় পড়িয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কি রকম?
অগস্ত্য-যাত্রায় যে বেরোয় সে আর ফেরে না–এই শাস্ত্র ত?
হ্যাঁ।
আমার বইখানি, ১লা তারিখে অগস্ত্য–যাত্রায় বেরিয়ে, সবগুলি বিক্রী হয়ে যায়–পাঁচ সাত বছর পরে বইওয়ালাদের আলমারি থেকে, দপ্তরী মিঞার গুদাম থেকে দাগী হয়ে পোকায় কাটা অবস্থায় আমার বাড়ীতে আর ফিরে না আসে–সেই আমার কামনা। –বলিয়া খগেন্দ্র যোড়হস্ত হইয়া মুখোপাধ্যায়ের পানে চাহিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল।
লোকটির সরস কথাবার্তা ও বিনীতভাব দেখিয়া মুখুয্যে মহাশয় প্রীত হইলেন। বলিলেন–তা এখানে কি মাল মশলা সংগ্রহ করবেন?
ঘোড়ার গাড়ীতে সহযাত্রিগণের নিকট হইতে খগেন্দ্র কিছু কিছু সংবাদ সংগ্রহ করিয়াছিল। বলিল–শুনেছি আপনাদের জমিদার রায় মশায়েরা খুব বনিয়াদি বংশ। সারদাবাবুর বংশের একটি বংশের একটি ইতিহাস–বেশী নয় এই পাতা দুই–আর তার একটু জীবনচরিত–ধরুন এই পাতা চার পাঁচ–সংগ্রহ করতে হবে। তার কাছে কখন গেলে দেখা পাওয়া যেতে পারে?
এই সময় একব্যক্তি পোষ্টকার্ড কিনিতে আসিল, তাহার হাতে খগেন্দ্র একখানি বিজ্ঞাপন দিল। মুখোপাধ্যায় উত্তর করিলেন, সকালে আটটা নটার পর প্রায়ই বাবু বৈঠকখানায় বসেন, সেই সময় যাওয়াই সুবিধা। আপনি আছেন ক দিন?
দিন চার পাঁচ থাকতে হবে। আসেপাশের গ্রামগুলোতেও গিয়ে গিয়ে বিজ্ঞাপন বিলি করব। এখানে একটা বাড়ী-টাড়ী ভাড়া পাওয়া যাবে না?
বাড়ী? এখানে ভাড়ার বাড়ী কোথায় পাবেন? এ কি মশায় আপনার কলকাতা সহর?
পোষ্টমাষ্টারবাবু ডাক পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, কই, কৃষ্ণদাসবাবুর বঙ্গবাসী ত আজ আসেনি।
মুখোপাধ্যায় বলিয়া উঠিলেন, আঁ!–আসেনি?
না। কেবল সারদাবাবুর বেঙ্গলী এসেছে। আর কারু কোনও কাগজ আসেনি।
ইংরাজি-অনভিজ্ঞ মুখোপাধ্যায় মহাশয় ভারি হতাশ হইয়া পড়িলেন। বলিলেন–আসেনি? –তাই ত!
খগেন্দ্র বলিল, আপনি কি এবারকার বঙ্গবাসী খুঁজছেন?
হ্যাঁ। আছে?
আছে। বঙ্গবাসী আছে, বসুমতী আছে, হিতবাদীও আছে–কাল আসবার সময় গাড়ীতে সময় কাটাবার জন্যে হ্যারিসন রোডের মোড়ে এক একখানা বিনেছিলাম যে।
মুখোপাধ্যায় যেন কত কৃতার্থ হইয়া বলিলেন, আছে? আছে? কই?
আমার ট্রাঙ্কে আছে। –বলিয়া খগেন্দ্র বাক্স খুলিয়া কাগজ তিনখানি বাহির করিয়া মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের হস্তে দিল। পাইয়া তাঁহার মুখে হাসি আর ধরে না। বলিলেন–দেখ, একেই বলে, যব মালিক দেতা তব ছাপ্পর ফোড়কে দেতা হায়। –একখানি কাগজের জন্যে আকুলি বিকুলি করেছিলাম–একেবারে তিন তিনখানা। আঁ!–তা ভায়া, এ কাগজগুলি আমি এখন বাড়ী নিয়ে গিয়ে পড়িগে। কেমন? পড়ে তোমায় দেব। তুমি কোথায় থাকবে?
খগেন্দ্র বলিল, কোথায় থাকব–তাই ত ভাবছি। ভাড়ার বাড়ী পাওয়া যায় না বললেন–
মুখোপাধ্যায় দাঁড়াইয়া উঠিয়াছিলেন। বলিলেন–হয়েছে। সে ঠিক হবে এখন। ভায়া, তুমি যে রকম সজ্জন ব্যক্তি, আমার বাড়ীতেই তোমায় নিয়ে যেতাম। আমার বৈঠকখানায় একটি মোটে ঘর, আবার কদিন হল আমার ভাগ্নীজামাইটি এসেছে, সঙ্গে তার একটি বন্ধুও আছে। সেখানে থাকতে তোমার কষ্ট হবে। ঐ যে গাছগুলো দেখছ–ঐ–ঐগুলোর আড়ালে একটা সাদা মত বাড়ী দেখা যাচ্ছে, ঐটি আমাদের ইস্কুলঘর। আমি ইস্কুল কমিটির একজন মেম্বর। মাইনর ইস্কুল, বেশ ভাল রেজাল্ট হয়, গত বৎসর একটি ছেলে পাস করে চার টাকা জলপানি পেয়েছে। তা এখন গ্রীষ্মের বন্ধ, ইস্কুল নেই, চল ইস্কুলে একটা ঘর আমি তোমায় ঠিক করে দিচ্ছি। ঐখানে থাকবে, আর আমার বাড়ীতে গরীবের ক্ষুদকুঁড়ো যা জোটে চারটি চারটি খাবে। আমিও ব্রাহ্মণ–আমার নাম শ্রীরামতারণ মুখোপাধ্যায়। –বলিয়া তিনি ব্রাহ্মণত্বের প্রমাণ স্বরূপ, হাতকাটা পিরাণটির বোতামগুলি পটাপট খুলিয়া যজ্ঞোপবীত বাহির করিয়া দেখাইলেন।
খগেন্দ্র তাহাকে নমস্কার করিল ৷ বলিল–বেশ ত আমি ইস্কুলে থাকব এখন, কিন্তু খাওয়া সম্বন্ধে আপনাকে কষ্ট দেওয়া–
মুখোপাধ্যায় বাধা দিয়া বলিলেনকিছু কষ্ট নয়। আমি ত আর তোমায় কালিয়ে পোলাও কাবাব কো খাওয়াচ্ছিনে–সে সব এ পাড়াগাঁয়ে পাবই বা কোথায়? আমরা যেমন খাই সেই রকম ডাল–ভাতই খাওয়াব। আমাদের কোনও কষ্ট নেই তবে তোমার কষ্ট হতে পারে বটে।
খগেন্দ্র বলিল, আমিও ত ডাল–ভাতই খেয়ে থাকি মশায়। রোজ রোজ কালিয়া পোলাও আর পাব কোথা? আমিও গরীব মানুষ–নইলে আর বই ছাপাচ্ছি কেন? পেটের দায়েই ত ছাপাচ্ছি।
আচ্ছা তবে চল। একটা ঘর খালি করে দেব এখন। বিছানা ত তোমার সঙ্গেই রয়েছে। খান তিন চার বেঞ্চি একত্র করে নিলেই তক্তপোষের কায হবে। ইস্কুলে দরোয়ান আছে, জেতে কৈবর্ত, তোমার জলটা আসটা এনে দিতে পারবে। আমার বাড়ীও বেশী দূরে নয়–এস।
একজন লোক ডাকিয়া বাক্স বিছানা তাহার মাথায় দিয়া খগেন্দ্রকে লইয়া মুখুজ্যে মহাশয় অগ্রবর্তী হইলেন।
পথে যাইতে যাইতে ভদ্র বেশধারী যাহাকে দেখিল, তাহাকেই খগেন্দ্র একখানি করিয়া বিজ্ঞাপন বিলি করিল।
স্কুলঘরে পৌঁছিয়া সমস্ত ঠিকঠাক করিয়া দিয়া মুখোপাধ্যায় বলিলেন, এখন তবে আমি চলোম। ভাত চড়িয়ে দিতে বলিগে। ভাত হলেই ডেকে পাঠাব এখন।
খগেন্দ্র বলিল অসময়ে এখন আর সে ভাত খাইবে না। একেবারে রাত্রে যথাসময়ে আহার করিবে।
মুখোপাধ্যায় বলিলেন, বেশ। সন্ধ্যার পর হ্যারিকেন নিয়ে আমার ছেলে আসবে এখন। তার সঙ্গে যাবে। এখন তবে আসি।
খগেন্দ্র বলিল, আপনাকে অনেক কষ্টই দিলাম। আর একটা উপকার যদি করেন।
কি?
অনেকগুলো কাপড় ময়লা হয়ে গেছে। কলকাতা থেকে আসবার সময় ধোপা বেটাও এসে পৌঁছল না–এখানে ভাল ধোপা আছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, এখানে ধোপা আছে একজন, তার নাম নীলমণি। নামেও নীলমণি কাযেও নীলমণি।
কি রকম?
সবে ধন নীলমণি। কাপড় নেহাৎ মন্দ কাঁচে না। তবে তোমাদের কলকাতার ধোপার মত কি পারবে?
তা হোক–এখন কায–চলা গোছ হলেই হল। অনুগ্রহ করে সেই নীলমণিকে যদি খবর দেন।
আচ্ছা, বাড়ী গিয়েই তাকে ডাকিয়ে পাঠাচ্ছি। আসি তবে। –বলিয়া দুর্লভ রত্নের মত সেই সংবাদপত্রগুলি হস্তে করিয়া মুখোপাধ্যায় গৃহাভিমুখে চলিলেন।
খগেন্দ্র ষ্টোভ জ্বালিয়া চায়ের জন্য জল চড়াইয়া দিল। রুটি, মাখন, পটে মীট তাহার টিফিন–বাক্সেই ছিল।
০৬. নব্য দারোগাবাবু
তিনটি দিন কাটিল। এ তিনদিন খগেন্দ্র অদম্য উৎসাহে বঙ্গসাহিত্যে–যুগান্তরের বিজ্ঞাপন বিলি করিতেছে, ভদ্র শূদ্র ছোট বড় অনেক লোকের সহিত মিশিয়াছে–কয়েকটি আড্ডাতে গিয়াও বসিয়াছে। এখনও জমিদার সারদা–চরণবাবুর সহিত সাক্ষাৎ হয়। নাই–তাহার শরীর অসুস্থ। তাঁহার স্বমুখে জীবনচরিত শ্রবণ করিবার অছিলায় খগেন্দ্র বিলম্ব করিতে লাগিল। এ তিন দিনে সে দুইটি তথ্য আবিষ্কার করিয়াছে। প্রথম, গত মাঘ মাস হইতে জমিদারবাবুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা নীবনচন্দ্র এবং কৃষ্ণদাস ঘোষালের যুবতী কন্যা লীলাবতী নিরুদ্দেশ, দ্বিতীয়তঃ যে দিন হইতে ইহারা নিরুদ্দেশ, তাহার পূৰ্ব্ব রাত্রে এই গ্রামের দুলেদের সৈরভির মাকে নবীনবাবুর সহিত গাজনতলার হাটের নিকট একত্র দেখা গিয়াছিল। নবীনচন্দ্রের বয়স আকার প্রকার প্রভৃতি সম্বন্ধেও খগেন্দ্র অনুসন্ধান করিয়াছে। ফলে, তাহার মনে একটা ধারণা জন্মিয়াছে, গঙ্গায় ভাসিয়া আসা সেই সুরবালা লীলাবতী ভিন্ন আর কেহই নহে এবং নবীনচন্দ্রই ভবেন্দ্ৰ সাজিয়া বাশুলিপাড়ায় জমিদারী করিতেছে। এসব এখনও অনুমানমাত্র। তেমন বিশ্বাসজনক প্রমাণ খগেন্দ্র এখনও কিছুই পায় নাই। এমন কি নীলমণি রজককে শাড়ীর সেই ছিন্ন প্রান্তটুকু দেখাইবার অথবা সৈরভির মাতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিবার সুযোগও তাহার হইতেছিল না।
এ কয়দিন মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের গৃহেই খগেন্দ্র দিবাভাগে আহার করিয়াছিল। রাত্রে দোকান হইতে গরম গরম লুচি এবং আলু বেগুন ভাজাইয়া আনিয়া তাহাই খায়। এ সপ্তাহের বঙ্গবাসী সঞ্জীবনী হিতবাদী ও বসুমতী–এই চারিখানি সংবাপত্র বাহির হইবামাত্র পাঠাইয়া দিবার জন্য খগেন্দ্ৰ কলিকাতায় পত্র লিখিয়া দিয়াছে–মুখোপাধ্যায়ও দিবস গণনা করিতেছেন।
চতুর্থ দিন দ্বিপ্রহরে আহারাদি করিয়া খগেন্দ্র পোষ্ট আপিসে গেল, কলিকাতা হইতে আর এক প্যাকেট বিজ্ঞাপন ছাপিয়া আসিবার কথা ছিল। ডাকবাবু সেইমাত্র আহার করিয়া পাণ চিবাইতে চিবাইতে বাহির হইয়া আসিতেছেন। ডাকগাড়ী আসিবার এখনও বিলম্ব আছে–দুইজনে বসিয়া গল্পগুজব করিতে লাগিলেন। ইতিমধ্যে গাজনতলা থানার দারোগাবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
দারোগাবাবু যে–আসুন আসুন–ওরে, আপিসের ভিতর থেকে বড় চেয়ারখানা বের করে আন্। –বলিতে বলিতে ডাকবাবু দাঁড়াইয়া উঠিলেন। একজন রাণার গিয়া ঘোড়ার লাগাম ধরিল। দারোগাবাবু নামিয়া আসিলেন।
খগেন্দ্র দেখিল, দারোগাবাবুটির বয়স অল্প–চতুর্বিংশতির অধিক হইবে না। সরকারী খাকী পোষাকটার জন্যই একটু ভীষণ দেখাইতেছে, নতুবা হাস্যবদন প্রিয়দর্শন যুবক।
ডাকবাবু বলিলেন, এখন আসছেন কোথা থেকে?
নিকটেই একটা গ্রামে গিয়েছিলাম–একটা তদন্ত ছিল। –বলিয়া খাকী পোষাকের পকেট হইতে রুমাল বাহির করিয়া দারোগাবাবু ললাট ও হস্তদ্বয় হইতে ঘৰ্ম্মজল অপনোদন করিতে লাগিলেন।
আহারাদি এখনও হয়নি বোধ হয়?
না।
এইখানেই স্নানটান করুন না–চারটা ভাত চড়িয়ে দিতে বলি।
দারোগাবাবু বিনীত হাস্যের সহিত বলিলেন, না না–সে সব কায নেই। বড় তেষ্টা পেয়েছে–এক গেলাস ঠাণ্ডা জল যদি আনিয়ে দেন।
জল? –কেন তার চেয়ে খানিকটে সরবৎ–বেশ করে নেবু দিয়ে।
আবার অত কষ্ট করবেন?
কিছু কষ্ট না। আমি বাড়ীতে বলে আসি। –খগেনবাবু ততক্ষণ আপনি দারোগাবাবুর সঙ্গে আলাপ করুন। –বলিয়া ডাকবাবু অদৃশ্য হইলেন।
দারোগাবাবু খগেনের দিকে চেয়ারখানি ফিরাইয়া বলিলেন, আপনার পুরো নাম কি?
খগেন্দ্র নাম বলিল।
দারোগাবাবু বলিলেন, আমার নাম শ্রীঅবনীমোহন মিত্র। আপনাকে ত কখনও দেখিনি!
আমি আজ চারদিন মাত্র এখানে এসেছি। আপনি কতদিন আছেন?
আমি? দুবছর হল। প্রথম দারোগাগিরিতে পাকা হয়েই এখানে এসেছি।
এই প্রকার কথোপকথন হইতে হইতে ডাকবাবু ফিরিয়া আসিলেন। বলিলেন–সরবৎ করে আনছে। খগেন্দ্রবাবুর সঙ্গে আলাপ হল? দিন না খগেন্দ্রবাবু, আপনার একখানা বিজ্ঞাপন দারোগাবাবুকে দিন। ইনি সেকালের মুখ্যু দারোগা নন–নব্যতন্ত্রের দারোগা–রীতিমত লেখাপড়া জানা লোক, বি–এ ফেল।
খগেন্দ্র বলিল, বিজ্ঞাপন আর নেই। আজ ডাকে আসবার কথা আছে।
দারোগাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, কি বিজ্ঞাপন মশায়?
ডাকবাবু বলিলেন, উনি যে একখানা বই ছাপাচ্ছেন।
দারোগা বলিলেন, কি? আপনি গ্রন্থকার? কাব্য না উপন্যাস?
খগেন্দ্র হাসিয়া বলিল, কাব্যও নয় উপন্যাসও নয়। বরং কতকটা ইতিহাসের ধরণের–বঙ্গীয় জমিদার–চরিতমালা।
পোষ্ট মাষ্টারের ভৃত্য একটি গেলাসে লেবুর সরবৎ আনিয়া দাঁড়াইল। দারোগাবাবু তাহা পান করিয়া সুস্থ হইয়া বলিলেন–আঃ।
খগেন্দ্র পকেট হইতে নিজের পাণের ডিবাটি বাহির করিয়া, খুলিয়া দারোগাবাবুর সম্মুখে ধরিল
দারোগা বলিলেন, থ্যাঙ্কস। আমি পাণ খাইনে।
খগেন্দ্র বলিল, সে কি মশায়, পাণ খান না কি রকম? পাণ খাওয়াই হল পুলিশের প্রধান কাৰ্য্য।
ডাকবাবু হাসিয়া বলিলেন, না–আমাদের দারোগাবাবু এ পাণও খান না সে সব পাণ–টানও খান না। গভর্ণমেন্ট এইসব লেখাপড়া জানা ভদ্রলোক পুলিশে ঢুকিয়ে ডিপার্টমেন্টটাই মাটি করে ফেললে!–বলিয়া তিনি হা হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন। একটু থামিয়া বলিলেন–কে একজন পয়সা–কড়ির অভাবে কোন্ দারগাকে পাণ খাবার জন্যে একটি বাছুর দিয়েছিল না?
দারোগাবাবু বলিলেন, হ্যাঁ–সে একটা পুরোনো গল্প আছে বটে।
এমন সময় ডাকগাড়ীখানি আসিল। খগেন্দ্রের নামে একতাড়া বিজ্ঞাপন ছাপিয়া আসিয়াছিল, প্যাকেট খুলিয়া খগেন্দ্র দারোগাবাবুকে একখানি দিল।
দারোগাবাবু সেখানি মনোযোগের সহিত পাঠ করিয়া, একটু খুঁটিনাটি ভাবেই খগেন্দ্রের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। এখানে কতদিন আসা হইয়াছে, আর কতদিন থাকা হইবে, এ কয়দিনে কায কতদূর অগ্রসর হইল–ইত্যাদি। প্রস্তাবিত পুস্তক সম্বন্ধেও অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। অবশেষে বলিলেন–ইচ্ছা করেন ত খানকতক বিজ্ঞাপন আমাকে দিতে পারেন। গাজনতলায় অনেক লোকজন আসে–থানায়, পোষ্ট আপিসে, ইস্কুলে–এই রকম জায়গায় টাঙ্গিয়ে দেওয়াব এখন। –বলিয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন।
দারোগাবাবুকে বহু ধন্যবাদ দিয়া খগেন্দ্র তাঁহার হাতে একগোছা বিজ্ঞাপন দিল। সেগুলি পকেটে লইয়া, পোষ্ট মাষ্টারকে অভিবাদনান্তর তিনি ঘোড়া ছুটাইয়া দিলেন।
০৭. জমিদার গৃহে
তিনদিন পরে সংবাদ আসিল, সারদাবাবু একটু ভাল আছেন, আজ বিকালে খগেন্দ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিবেন।
নিজে সঙ্গে করিয়া বাবুর নিকট লইয়া যাইবেন, পূৰ্ব্ব হইতে মুখোপাধ্যায় মহাশয় খগেন্দ্রকে আশ্বাস দিয়া রাখিয়াছিলেন। কিন্তু আজ ডাকে তিন–তিনখানি সংবাদপত্র আসিয়াছে। মুখোপাধ্যায় যুদ্ধকাহিনী পাঠে এমন মশগুল হইয়া পড়িলেন যে তাঁহার আর মাথা তুলিবার অবকাশ নাই; সুতরাং বেলা চারিটার সময় খগেন্দ্র একাকীই জমিদার বাটী অভিমুখে যাত্রা করিল। ইতিমধ্যে লোকমুখে শুনিয়া সারদাবাবুর জীবন–চরিত কতকটা লিখিয়া রাখিয়াছিল, সে কাগজগুলি সঙ্গে করিয়া লইল।
দ্বিতলের একটি সুপ্রশস্ত কক্ষে বাবুর বৈঠকখানা। মেঝের উপর ফরাস বিছানা পাতা রহিয়াছে। মধ্যস্থলে পুরু গালিচার উপর তাকিয়া হেলান দিয়া বাবু উপবিষ্ট। রূপার গুড়গুড়িতে বিষ্ণুপুরের সুগন্ধি তামাক পুড়িতেছে, নলটি হাতে করিয়া বাবু পাত্রমিত্রগণের সহিত গল্প করিতেছেন–মধ্যে মধ্যে ধুমপানও করিতেছেন। ভিত্তিগাত্রে কয়েকখানি বিলাতী ছবি–দুইখানি বৃহদাকার দর্পণ এবং একটি মাৰ্ব্বেল পাথরের ক্লকঘড়ী শোভা পাইতেছে। খগেন্দ্র সেখানে নীত হইয়া নমস্কার করিয়া দাঁড়াইল।
বাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনারই নাম খগেন্দ্রবাবু?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আসুন। বসুন। এ কদিন আমার শরীরটে বড়ই খারাপ ছিল, তাই আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎও করতে পারিনি, আপনার কোনও তত্ত্বও নিতে পারিনি। শুনলাম আমাদের ইস্কুল ঘরেতে আপনি আছেন, কোনও কষ্ট হচ্ছে না ত?
আজ্ঞে না–কোনও কষ্ট হয়নি, বেশ আছি। –বলিয়া খগেন্দ্র বিনীতভাবে সারদাবাবুর পানে চাহিল।
বাবু দুই চারি টান ধুমপান করিয়া বলিলেন, আপনার বাড়ী কলকাতাতেই বুঝি? আপনার বিজ্ঞাপনটি পড়লাম। আপনি বই বের করছেন–বঙ্গীয় জমিদার–চরিতমালা। কেমন?
খগেন্দ্র মাথা নোয়াইয়া অনুচ্চস্বরে বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
সারদাবাবু ওষ্ঠযুগল গুটাইয়া, মাথাটি একদিকে হেলাইয়া চক্ষু ঘুরাইয়া বলিলেন, বঙ্গীয় জমিদার–চরিতমালা। মালা! মালা!
পারিষদগণ এই ভঙ্গী দেখিয়া বুঝিল বাবু শ্লেষ করিতেছেন; কিন্তু শ্লেষের প্রকৃত কারণটি কেহই অনুধাবন করিতে পারিল না। তথাপি তাহারা পরস্পরের প্রতি চাহিয়া চাপা হাসির দৃষ্টি বিনিময় করাটাই সুযুক্তি মনে করিল।
বাবু বলিলেন, মালা!–আচ্ছা মালা কিসের হয় খগেন্দ্রবাবু? ফুলেরই ত হয়?
খগেন্দ্র বলিল, ফুলের হয়–মুক্তার হয়–আরও
বাধা দিয়া বাবু বলিলেন, অর্থাৎ ভাল জিনিষেরই হয়। সুন্দর সুন্দর জিনিষেরই হয়। কেমন কিনা? কিন্তু ধরুন এই ঘঁটে, ছেঁড়া জুতো, তালের আঁটি, ছাই ফেলার কুলো–এমন সব চীজের কি মালা হয় মশায়? আমাদের এই বাঙ্গালা দেশে যত সব জমিদারবাবুরা আছেন, তাঁদের চরিতগুলি কি মালা তৈরী করবার মতন সুন্দর পবিত্র জিনিষ বলে আপনি মনে করেন? –বলিয়া হা হা করিয়া হাসিয়া, বাবু ধূমপানে মনোযোগ করিলেন।
খগেন্দ্র মুহূৰ্ত্তমাত্র চিন্তা করিয়া বলিল, আপনি ঠিক বলেছেন, সুন্দর পবিত্র জিনিষেরই মালা হয়, কুৎসিত জিনিষের হয় না। কিন্তু মালা যে গাঁথে সে নিৰ্বাচনও করে। হাতের কাছে যা পায় তাই নিয়েই গেঁথে ফেলে না। ফুলও ত কত রকমের আছে। গোলাপ, বেল, যুঁই থেকে আরম্ভ করে, ঘেঁটু কাঠমল্লিকা পর্যন্ত। কিন্তু মালীরা বেল যুঁই গোলাপ এই সবগুলিই নিয়ে কায করে। আমিও সেই রকম নির্বাচন করেই এ মালা গাঁথতে বসেছি। এই ধরুন, আমি আপনাকে পূর্বে কখনও চক্ষেও দেখিনি, কিন্তু আপনার সৌরভ, আমি সেই কলকাতায় বসেই পেয়েছি। আপনি এই পাড়াগায়ে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে ফুটে আছেন বটে–কিন্তু সৌরভটুকু লুকোবেন কি করে?
শুনিয়া সারদাবাবু মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিলেন। স্পষ্ট বুঝা গেল, তাঁহার মনটা বেশ খুসী হইয়া উঠিয়াছে। পারিষদগণ প্রশংসমান চক্ষে খগেন্দ্রের পানে চাহিতে লাগিল। একজন বলিল, বাঃ বাঃ অতি সুন্দর উপমাটি হয়েছে। ইনি অতি যথার্থ কথাই বলেছেন। আমাদের বাবুমশায়ের তুল্য গুণবান ভূস্বামী এ অঞ্চলেই নেই।
অতঃপর বিশেষ সহৃদয়তার সহিত বাবু পুস্তকের কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। পাঁচ খণ্ড পুস্তকের গ্রাহক হইতে স্বীকৃত হইলেন। জীবনী সম্বন্ধে, খগেন্দ্র যেটুকু লিখিয়া আনিয়াছিল, তাহা পড়িয়া শুনাইল। বাবু মাঝে মাঝে যে সকল পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করিবার প্রস্তাব করিলেন, খগেন্দ্র সেগুলি নোট করিয়া লইতে লাগিল। দুই তিন বৎসরের পুরাতন একখানি ফোটোগ্রাফ অন্তঃপুরে আছে, সেখানি কল্য প্রাতে খগেন্দ্রকে পাঠাইয়া দিবেন বলিলেন।
অবশেষে খগেন্দ্র বলিল, আপনার কনিষ্ঠ নবীনবাবুর কথা এতে তেমন কিছুই লেখা হয়নি। তার সঙ্গে একবার দেখা হতে পারে?
বাবু যেন একটু বিরক্ত হইয়া বলিলেন, নবীন? সে ত এখানে নেই।
তিনি কোথায়?
কলকাতায়।
কলকাতা? –তা হলে ত আমি নিজে গিয়েই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারব। তাঁর ঠিকানাটি যদি অনুগ্রহ করে
বাবু বলিলেন, সেদিন তার একখানা চিঠি এসেছে। কি একটা ঠিকানা দিয়েছে। কি ঘোষের লেন লিখেছে ভুলে যাচ্ছি। ওহে মাষ্টার
অন্য কক্ষ হইতে এক ব্যক্তি আসিয়া দাঁড়াইল। সারদাবাবু বলিলেন, ছোটবাবু এবার চিঠিতে যে ঠিকানাটি লিখেছেন, একটি কাগজে সেটি টুকে এই বাবুকে এনে দাও ত।
কাগজখানি লইয়া খগেন্দ্র বলিল, ওদিকে আমি প্রায়ই যাই। কলকাতায় ফিরেই তার সঙ্গে দেখা করব। কাল সকালে তা হলে, মনে করে, ফটোগ্রাফখানি পাঠিয়ে দেবেন। এখন তা হলে আসি। নমস্কার। –বলিয়া খগেন্দ্র প্রস্থান করিল।
০৮. গাছে না উঠতেই এক কাঁদি
বাসায় ফিরিয়া খগেন্দ্র বিমর্ষভাবে চিন্তা করিতে বসিয়া গেল। নবীনচন্দ্ৰ কলিকাতায় রহিয়াছে? তবে ত খগেন্দ্রের সকল অনুমানই মিথ্যা হইয়া যায়! সে জাল ভবেন্দ্র তবে কে? সুরবালাই বা কে? জাল ভবেন্দ্র যদি নবীন না হয়, তাহা হইলে সুরবালার লীলাবতী। হওয়ার সম্ভাবনা কোথায়? আর, সুরবালা যদি বাস্তবিকই লীলাবতী হয়, তবে ভবেন্দ্র নবীনচন্দ্র ছাড়া আর কে হইতে পারে? এ কয়দিন খগেন্দ্র যাহা কিছু সিদ্ধান্ত করিয়াছিল, সমস্তই ওলট পালট হইয়া গেল।
রাত্রে তাহার লুচি ও বেগুনভাজা আসিল বটে, কিন্তু অর্ধেক অভুক্ত পড়িয়া রহিল।
অনেক রাত্রে তাহার হঠাৎ মনে হইল, আমি ত একটা মস্ত ভুল করিয়া বসিয়াছি। সুরবালার পিত্রালয় বা শ্বশুরালয় বসন্তপুরে, শুধু এইটুকুর উপর নির্ভর করিয়া আমি এই পোষ্ট অফিস বসন্তপুরে আসিয়াছি। সুরবালার সে বসন্তপুর যদি এমন কোনও বসন্তপুর হয় যেখানে ডাকঘর নাই?
পরদিন প্রাতে উঠিয়া খগেন্দ্র নীলমণি রজককে ডাকিয়া পাঠাইল। ছিন্ন বস্তুটুকু আজ তাহাকে দেখাইয়া সংশয় ভঞ্জন করিবে। সৈরভির মাতার সহিত কথোপকথনের কি উপায় হয়, তাহাও খগেন্দ্র বসিয়া চিন্তা করিতে লাগিল।
ইতিমধ্যে থানা হইতে একজন কনেষ্টবল, দারোগাবাবুর একখানি পত্র আনিয়া খগেন্দ্রকে দিল। দারোগাবাবু লিখিয়াছেন, বিজ্ঞাপনগুলি পাঠ করিয়া অনেকেই পুস্তকখানির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিতেছেন, খগেন্দ্রবাবু যদি আসিয়া দুই চারিদিন গাজনতলায় থাকেন, তবে কিছু গ্রাহক সংগ্রহ হইতে পারে।
দারোগাবাবুকে ধন্যবাদ দিয়া খগেন্দ্র লিখিয়া দিল, শীঘ্র একদিন গিয়া সে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবে। কনেষ্টবল পত্র লইয়া চলিয়া গেল। ধোপাবাড়ী হইতে লোক ফিরিয়া বলিল–বাবুর বস্ত্রাদি এখনও প্রস্তুত হয় নাই। প্রস্তুত করিয়া বিকালে নীলমণি লইয়া আসিবে।
সারাদিন কাটিল। বিকালে গাজনতলা থানা হইতে একজন কনেষ্টবল, দারোগাবাবুর দ্বিতীয় পত্র লইয়া পৌঁছিল। তিনি লিখিয়াছেন, আগামী কল্য প্রাতে দুইজন বড় জমিদার থানায় আসিবেন–তাঁহারা অনেক খণ্ড পুস্তকের গ্রাহক হইবেন আশা আছে। অতএব, কল্য বেলা নয়টা দশটার মধ্যে খগেন্দ্র নিশ্চয়ই যেন থানায় যায়। কোনও মতে অন্যথা না হয়–পত্র পড়িয়া খগেন্দ্র কনেষ্টবলকে বলিল, তুমি বাইরে একটু বস। আমি চা খেয়ে জবাব লিখে দিচ্ছি। –কনেষ্টবল গিয়া বাহিরে বসিল।
খগেন্দ্র চা পান করিতেছে, এমন সময় নীলমণি রজক ধৌত–বস্ত্রের মোট কাঁধে করিয়া প্রবেশ করিল।
বস্ত্র মিলাইয়া খগেন্দ্র বলিল, ওহে রজক, এই টুকরোটি দেখ দেখি। এর কোণে এই যে চিহ্ন রয়েছে, এটি কি তোমার দেওয়া চিহ্ন?
টুকরাটি হাতে করিয়া নীলমণি চিহ্ন দেখিল। বাহিরে চাহিয়া দেখিল কনেষ্টবল বৃক্ষতলে বসিয়া আছে। সন্দিগ্ধভাবে খগেন্দ্রের মুখপানে সে চাহিতে লাগিল।
খগেন্দ্র বলিল, এ চিহ্ন তোমার দেওয়া ত? এ কার বাড়ীর চিহ্ন সেইটি আমি জানতে চাই।
শাড়ীর পাড়টিও নীলমণি চিনিয়াছিল–উহা কৃষ্ণদাস ঘোষালের নিরুদ্দিষ্ট কন্যা লীলাবতীর। তাহার সম্বন্ধে গ্রামে যে সব গুজব আছে, তাহাও সে বিলক্ষণ জানিত। সুতরাং মনে মনে প্রমাদ গণিল। ঢোক গিলিয়া বিকৃত কণ্ঠে বলিল–আজ্ঞে এ মার্কা–কার তা কি করে বলব? –আপনি এ পেলেন কোথায়?
খগেন্দ্র বিরক্ত স্বরে বলিল, যেখানেই পাই, তোমার সে খোঁজে কায কি? যা জিজ্ঞাসা করি তার উত্তর দাও না।
নীলমণি হাতজোড়া করিয়া বলিল, আজ্ঞে–আজ্ঞে–আমি গরীব মানুষ।
খগেন্দ্র রাগিয়া উঠিল। কঠোরস্বরে বলিল–আ মর বেটা! তুই গরীব কি তালেবর তা কে জিজ্ঞাসা করছে? তোর দেওয়া মার্কা কি না সত্যি করে বল।
ধমক খাইয়া নীলমণি কাঁপিতে আরম্ভ করিল। কাতরস্বরে বলিল–বাবুমশায়, কি হয়েছে?
খগেন্দ্র হঠাৎ বলিয়া ফেলিল, খুন হয়েছে।
নীলমণি কাঁদ কাঁদ হইয়া বলিল, অ্যাঁ–অ্যাঁ? দিদিঠাকরুণকে খুন করেছে?
খগেন্দ্র যাহা জানিতে চাহিয়াছিল, তাহা জানিল। তথাপি কৃতনিশ্চয় হইবার জন্য জিজ্ঞাসা করিল, হ্যা খুন করেছে। তোমাদের দিদিঠাকরুণের নাম কি বল দেখি?
নীলেবতী। ঘোষালদের মেয়ে নীলেবতী দিদি। আহাহা, কে খুন করলে বাবুমশায়?
খগেন্দ্রের মনের সকল সন্দেহ দূর হইল। একটু রঙ্গ করিবার অভিপ্রায়ে বলিল, কে আর খুন করবে? তোমাদের জমিদারের ভাই।
ছোটবাবু? –আহাহা!–তা আমরা সেই কালেই জানি। তা বাবুমশায়, কি হবে এখন? আপনি কি ফুলুস?
খগেন্দ্র গম্ভীরভাবে বলিল, হ্যাঁ–আমি পুলিশের ডিটেকটিভ।
আজ্ঞে কি বললেন?
ডিটেকটিভ ডিটেকটিভ–তোরা যাকে টিকটিকি বলিস। –বলিয়া খগেন্দ্র নিজের গোঁফযোড়াটি মুচড়াইতে লাগিল।
নীলমণি বাহিরে কনেষ্টবলের পানে আবার চাহিয়া দেখিল। শেষে খগেন্দ্রের পা দুইটি জড়াইয়া ধরিয়া কাতরস্বরে বলিল, দোহাই হুজুর–আমি গরীব মানুষ–কিছু জানিনে। আমায় যেন সাক্ষীর ফেসাদে ফেলবেন না। বরং হুজুরের কাপড় যা কেচেছি তার দাম চাইনে–সে টাকাটা হুজুরের পাণ খাবার জন্যে দিলাম। দোহাই টিকটিকিবাবু, দয়া করুন।
খগেন্দ্র হাসিয়া বলিল, আচ্ছা–যা যা। এসব কথা খবর্দার কাউকে যেন বলিসনে।
নীলমণি নিজের দুই কাণ ধরিয়া মর্দন করিতে করিতে বলিল, কখনই না হুজুর–কাউকে বলব না–জিভ্যে কেটে ফেললেও না। –বলিয়া সে প্রস্থান করিল।
বাহির হইয়া নীলমণি ধীরপদে অগ্রসর হইল। পশ্চাতে চাহিতে চাহিতে ঘুরপথ দিয়া, একেবারে জমিদার–বাটির খিড়কী দ্বারে উপস্থিত। ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, সারদাবাবু বারান্দায় বসিয়া সায়ংসন্ধ্যা করিবার জন্য হস্তপদাদি প্রক্ষালন করিতেছেন।
নীলমণি ধপাস্ করিয়া উঠানে বসিয়া পড়িয়া বলিল, হুজুর মা বাপ–আপনার অন্নেই প্রতিপালিত হয়েছি, একটা খবর দিতে এলাম–বড়ই বিপদ।
সারদাবাবু বলিলেন, কি রে নীলমণি, কি হয়েছে?
ক্রন্দনের স্বরে নীলমণি বলিল, আজ্ঞে–খুনী মামলা। গাঁয়ে, ফুলুসের কি বলে, সেই তাই এসেছে।
আশ্চর্য্য হইয়া সারদাবাবু বলিলেন, কি এসেছে রে? ব্যাপার কি? পুলিশের কি এসেছে?
আজ্ঞে নামটা ভুলে গেলাম হুজুর। সেই যে দেওয়ালে পাঁচিলে বেড়ায়, মাথা নাড়ে, ন্যাজ নাড়ে।
সারদাবাবু অধিকতর আশ্চর্য্য হইয়া বলিলেন, মাথা নাড়ে ন্যাজ নাড়ে কি বলছিস রে? ক্ষেপে গেলি নাকি?
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নীলমণি বলিল, আজ্ঞে ক্ষেপে যাওয়ারই দাখিল। হ্যাঁ মনে পড়েছে–টিকটিকি। ফুলুসের টিকটিকি গায়ে এসেছে। –বলিয়াই স্কুলঘরে যাহা কিছু ঘটিয়াছিল, সমস্তই নীলমণি বৰ্ণনা করিল। শেষে করযোড়ে বলিল–এ খবরটি যে আমি দিলাম, সেটা যেন প্রকাশ না হুজুর–তা হলে গরীব মারা যাবে। চিরকাল নুন খেয়েছি, সেটা ভুলতে না পেরেই খবরটা দিয়ে গেলাম। ছোটদাদা ঠাকুরের প্রাণ বাচাবার জন্যে যা করতে হয় তা করুন। এখন প্রণাম হই।
নীলমণি চলিয়া গেলে সারদাবাবুর সায়ংসন্ধ্যা করা ঘুরিয়া গেল। পোষ্ট আপিসে দারোগার সহিত খগেন্দ্রের সাক্ষাৎ হওয়া, অদ্য প্রাতে থানা হইতে তাহার নিকট কনেষ্টবল আসা সারদাবাবু শুনিয়াছিলেন। নবীনের কলিকাতার ঠিকানা জানিবার জন্য খগেন্দ্র যে ব্যগ্রতা প্রকাশ করিয়াছিল, তাহাও মনে পড়িল। সুতরাং নীলমণির দেওয়া সংবাদ অবিশ্বাস করার কোনই কারণ পাইলেন না। দ্বিতলের উপরে উঠিয়া জননী ভগিনী প্রভৃতির সহিত কিয়ৎক্ষণ গোপন পরামর্শ করিলেন। অবশেষে বৈঠকখানায় আসিয়া একজন বিশ্বস্ত কর্মচারীকে ডাকিয়া পাঠাইলেন।
অল্পক্ষণ পরামর্শের পর, রাত্রি নয়টার সময়–কর্মচারী বাহির হইয়া গেল। অর্ধঘণ্টা পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল–সে ত পাঁচ হাজারের কম কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। বলছে খুনের বিশিষ্ট প্রমাণ তার হাতে আছে–কেবল স্ত্রীলোকটি কে, সেইটুকু জানতে বাকী ছিল, তাও এখানে এসে জেনেছে। বললে এখন অর্ধেক টাকা–আড়াই হাজার দাখিল করতে হবে–প্রমাণ অভাবের খাতেমা রিপোর্ট দিয়ে বাকী আড়াই হাজার নেবে।
সারদাবাবু অন্তঃপুরে গিয়া আবার পরামর্শ করিলেন। একটা পুঁটুলিতে, দশ টাকার নোটে গিনিতে আড়াই হাজার টাকা বাঁধিয়া আনিয়া কর্মচারীর হস্তে দিলেন।
গভীর রাত্রে খগেন্দ্র টাকাগুলি গণিয়া লইয়া, কর্মচারীকে অভয় দিয়া বিদায় করিল। শয়ন করিয়া আপন মনে হাসিতে লাগিল, আর বলিতে লাগিল, একেই বলে গাছে না উঠতেই এক কাঁদি।
০৯. বন্ধুলাভ
অনেক রাত্রি অবধি খগেন্দ্র ঘুমাইল না। সে মনে এই প্রকার চিন্তা করিতে লাগিল–যখন এতদূর অগ্রসর হইয়াছি, তখন কোন মতেই ছাড়া হইবে না–ঐ জাল ভবেন্দ্র যে কে তাহা আবিষ্কার করিতেই হইবে। পূর্বে মনে করিয়াছিলাম, সে নবীন নহে–কিন্তু ইহা ঠিক কি? কলিকাতা হইতে একখানা চিঠি আসিয়াছে, তাহাতে ঠিকানাটা দেওয়া আছে, কেবলমাত্র এইটুকু হইতেই কেন সিদ্ধান্ত করিব যে নবীন বাশুলিপাড়ায় গিয়া ভবেন্দ্র সাজে নাই। আমি ত এই বসন্তপুরে রহিয়াছি; কলিকাতার ঠিকানা দিয়া কাহাকেও একখানা চিঠি যদি লিখি–অপর খামের মধ্যে তাহা ভরিয়া যদি কলিকাতায় কোনও বন্ধুর নিকট পাঠাইয়া দিই এবং তাহাকে ঐখানি ডাকবাক্সে ফেলিয়া দিতে বলি–তাহা হইলে কি প্রমাণ হয়? কিছুই না। সুতরাং এবার কলিকাতায় গিয়াই অনুসন্ধান করিতে হইবে–ঐ ঠিকানায় নবীন যথার্থ বাস করে কিনা। আচ্ছা–যদি গিয়া দেখি–নবীন সেখানে সশরীরে বর্তমান আছে–তাহা হইলে কি করিব? এই লীলাবতী এখান হইতে কোথা দিয়া কোথায় কোথায় গেল, কি করিল, সেই সমস্ত অনুসন্ধান করিলেই জাল ভবেন্দ্রের আসল পরিচয় পাওয়া যাইবে। সেটা এখান হইতে সারিয়াই যাওয়া কর্তব্য। সৈরভির মাকে জিজ্ঞাসা–বাদ্র করিতে হইবে। কিন্তু সে প্রকৃত কথা বলিবে কি? –লীলাবতী খুন হইয়াছে, আমি ডিটেকটিভ এখানে তদন্তে আসিয়াছি, একথা কল্য গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া যাইবে সন্দেহ নাই। সুতরাং সৈরভির মার কাছে কোনও কথা বাহির করা শক্ত হইবে। এক, যদি আমি সত্য সত্যই পুলিশ হইতাম, সঙ্গে দুই চারিজন কনেষ্টবল চৌকিদার থাকিত, হাতকড়ি থাকিত, হাজতে বন্ধ করিতে পারিতাম, তাহা হইলে ভয় দেখাইয়া স্তোক দিয়া, কোনও রকমে তাহাকে স্বীকার করাইতে পারিতাম। সে সব কিছুই নাই–আমি হইয়াছি ঢাল নাই তরোয়াল নাই নিধিরাম সর্দার। এখন কি করা যায়?
বিছানা হইতে উঠিয়া খগেন্দ্র আলো জ্বালিল। ঘরের মধ্যে কিয়ৎক্ষণ পায়চারি করিয়া বেড়াইল। বেড়াইতে বেড়াইতে হঠাৎ দারোগার লিখিত শেষ চিঠিখানির উপর তাহার দৃষ্টি পড়িল। সেখানি খুলিয়া খগেন্দ্র আর একবার পাঠ করিয়া শেষে আপন মনে বলিতে লাগিল, এই ত এই ত একজন আসল পুলিশ রহিয়াছে। বাক্সে আমার টাকাও যথেষ্ট রহিয়াছে। টাকায় বশীভূত করিয়া এই দারোগার দ্বারাতেই ত কাৰ্য উদ্ধার করিতে পারিতাম! কিন্তু ইনি যে আবার পাণ খান না–কিয়ৎক্ষণ পদচারণা করিয়া, দীপ নিৰ্ব্বাণ করিয়া খগেন্দ্র আবার শয়ন করিল।
শয়ন করিয়া খগেন্দ্র আবার ভাবিতে লাগিল, পাণ খান না–আবার কবিতা পড়েন। আমি পুস্তক ছাপাইতেছি শুনিয়াই প্রথমে জিজ্ঞাসা করিলেন কাব্য না উপন্যাস। আচ্ছা, এক কায করিলে হয় না? লোকটা ত নব্যতন্ত্রের কলেজ–পড়য়া শুনিলাম। আমি যদি একটি বেশ প্রণয়ের গল্প বানাইয়া উহাকে বলিতে পারি–আমি নিজেই যেন নায়ক–এই রহস্যটি উঘাটন করিতে পারিলেই যেন আমাদের মিলন সম্পন্ন হয়–তাহা হইলে নিশ্চয়ই উহার মন ভিজিবে এবং তাহার কনেষ্টবল হাতকড়ি ও হাজত সমস্ত লইয়া আমায় সাহায্য করিতে অগ্রসর হইবে। এই ঠিক হইয়াছে। এখন গল্পটি কিরূপ তৈয়ারি করা যায়? –ঐ সব কথাই কেবল–একটু উলট পালট–কোথাও বা কিঞ্চিৎ পরিবর্তন, কোথাও বা একটু পরিবর্ধন, আবশ্যক মতে অল্পবিস্তর পরিবর্জন। সে ঠিক হইবে এখন।
সে রাত্রে খগেন্দ্র যখন নিদ্রা গেল তখন প্রায় তিনটা বাজিয়াছে।
পরদিন বেলা সাতটার সময় তাহার ঘুম ভাঙ্গিল। চা পান ইত্যাদি শেষ করিয়া পদব্রজে গাজনতলার থানা অভিমুখে সে যাত্রা করিল।
গাজনতলা, বসন্তপুর হইতে দেড়ক্রোশ দূরে অবস্থিত। আট ঘটিকার পর থানায় পৌঁছিয়া শুনিল দারোগাবাবু তখনও অন্তঃপুর হইতে বাহির হন নাই। ভৃত্যমুখে নিজ আগমন সংবাদ পাঠাইয়া, দারোগাবাবুর বৈঠকখানায় খগেন্দ্র উপবেশন করিল।
কিয়ৎক্ষণ পরে দারোগাবাবু গেঞ্জি গায়ে, চটিজুতা পায়ে হাসিতে হাসিতে বাহির হইয়া আসিলেন। তাঁহার হাতে একখানি নূতন মাসিকপত্র। খগেন্দ্রকে অভ্যর্থনা করিয়া বলিলেন–এক পেয়ালা চা খাবেন?
খগেন্দ্র বলিল, ধন্যবাদ। আমি একদফা চা খেয়ে বেরিয়েছি যে!
এতখানি পথ হেঁটে এসেছেন, শ্রান্ত হয়েছেন, আরও এক দফা হোক না মশায়।
খগেন্দ্র সম্মতি জানাইলে, দারোগাবাবু ভৃত্যকে ডাকিয়া চা আনিতে আদেশ করিলেন।
দুই চারিটি শিষ্টাচারের কথার পর দারোগাবাবু বলিলেন, আপনি এত সকালে এসে পড়েছেন! আপনার জমিদার–চরিতমালার খদ্দেররা ত দশটার আগে আগে এসে পৌঁছবে না।
ঈষৎ হাসিয়া খগেন্দ্র বলিল, আমি এই বঙ্গীয় জমিদার-চরিতমালার বিজ্ঞাপন নিয়ে বেরিয়েছি, এটা একটা ভাণ মাত্র।
দারোগাবাবু কয়েক মুহূর্তকাল খগেন্দ্রের মুখপানে সকোতুকে চাহিয়া রহিলেন। শেষে বলিলেন–আমি তা জানি।
এই উত্তরে খগেন্দ্র একটু বিস্মিত ও শঙ্কিত হইল। তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিল, কি জানেন? কেমন করে জানলেন?
দারোগাবাবু বলিলেন, সেদিন পোষ্ট আপিসে আপনার সঙ্গে কথাবার্তা করে আমার মনে একটু সন্দেহ উপস্থিত হয়। আমি তাই আপনার বিজ্ঞাপনের কাগজখানি সেইদিনই কলকাতায় পুলিশ কমিশনারের কাছে পাঠিয়ে দিই। কাল রাত্রে তার কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেয়েছি, ও ঠিকানায় কোন পাবলিশিং ফারম নেই এবং কলকাতার কোনও ছাপাখানায় ও রকম কোন বই কেউ ছাপতে দেয়নি।
খগেন্দ্রের বুকের ভিতরটা গুর গুর করিয়া উঠিল। কিন্তু সে ভাবটা যথাসাধ্য গোপন করিয়া বলিল, আর কি জেনেছেন?
দারোগাবাবু হাসিয়া বলিলেন, আর জেনেছি যে আপনি ফেরারী আসামী নন–বদমায়েসের তালিকাতেও আপনার নাম নেই।
খগেন্দ্র ক্ষীণস্বরে বলিল, আর?
আর কিছু এখনও জানতে পারিনি।
শুনিয়া খগেন্দ্র মনে কতকটা আশ্বাস পাইল। বলিল–আচ্ছা, আমার প্রতি আপনার এরকম গুরুতর সন্দেহই যদি ছিল, তবে আমার কেতাবের খদ্দের জোটাবার জন্যে আপনি চেষ্টা করলেন কেন? –আমাকে ডেকেই বা পাঠালেন কেন?
দারোগা বলিলেন, যখন ডেকে পাঠিয়েছিলাম, তখনও কলকাতা থেকে তার পাইনি। তেমন তেমন টেলিগ্রাম এলে আপনাকে গ্রেপ্তার করার জন্যে কোথায় খুঁজে বেড়াব–তাই ডেকে পাঠিয়েছিলাম। কেতাবের খদ্দের–উদ্দের–আপনার ভাষাতেই বলি, ওগুলো আমার ভান মাত্র। –বলিয়া দারোগাবাবু হা হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন।
খগেন্দ্র কিন্তু হাসিল না। মুখখানি মলিন করিয়া আনত নেত্রে সে নীরব রহিল
দারোগাবাবু মাঝে মাঝে তাহার পানে চাহিতে লাগিলেন। শেষে অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন–খগেনবাবু–আপনি কি রাগ করলেন? দেখুন, আমরা পুলিশের লোক, সন্দেহ করাই আমাদের ব্যবসা। আমি সরকারী চাকরের কর্তব্য পালন করেছি মাত্র। আপনি তাতে দুঃখিত হচ্ছেন কেন?
খগেন্দ্র মুখ না তুলিয়াই বলিল, সে ত ঠিক কথা।
দারোগাবাবু কোমল স্বরে বলিলেন, তবে আপনি মুখখানি অমন বিমর্ষ করে রয়েছেন কেন?
খগেন্দ্র এবার চোখ তুলিল–ধীরে ধীরে বলিল, আপনি আমায় চোর বদমায়েস বলে সন্দেহ করেছিলেন–তার জন্যে আমি দুঃখিত হইনি। আমি একটা আশা করে আপনার কাছে এসেছিলাম–সেই আশা ভঙ্গ হবার উপক্রম দেখেই আমার মনটা কিছু ব্যাকুল হয়েছে।
দারোগাবাবু আশ্চর্য্য হইয়া বলিলেন, আমার কাছে আশা করে এসেছিলেন? কি বিষয়?
কতকগুলি বিষয়ের অনুসন্ধান করবার জন্যেই আমার এ অঞ্চলে আসা। তার উপর আমার সারা জীবনের সুখ দুঃখ নির্ভর করছে। আপনি পুলিশের কর্মচারী–আপনি মনে করলেই তদন্ত করে খবরগুলি আমায় দিতে পারতেন।
দারোগাবাবু বলিলেন, আমি তদন্ত করে আপনাকে খবর দিতে পারতাম? –ব্যাপার কি কিছুই বুঝতে পারছিনে। আচ্ছা, খগেনবাবু, যদি আপনার প্রকৃত নাম খগেনবাবুই হয়–আপনার আশাভঙ্গ হবার কারণটি কি আমায় যদি খুলে বলেন, তা হলে আমি বুঝতে পারি–আপনার কোনও সাহায্য আমার দ্বারা হবে কি না।
খগেন্দ্র বলিল, আপনার মনে এখনও যখন সন্দেহ যে আমি নিজের নাম যা বলেছি তা আমার প্রকৃত নাম নয়, তখন আপনার কাছে আমার সাহায্য লাভের আশা কি?
ভৃত্য চা আনিল। খগেন্দ্র পেয়ালাতে চামচ সঞ্চালন করিতে করিতে বলিল, আমি এখানে সম্পূর্ণ অপরিচিত কাকেই বা ডেকে এনে প্রমাণ করি যে আমার নাম প্রকৃতই খগেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়!
দারোগাবাবু অল্পক্ষণ কি চিন্তা করিয়া বলিলেন, আমার দ্বারায় যদি আপনার কোনও উপকার হয়–আর, আমি ধৰ্ম্মপথে থেকে উপকারটুকু করতে পারি তা হলে নিশ্চয়ই করব। আপনার নামের জন্যে আটকাবে না।
খগেন্দ্র আগ্রহের সহিত বলিল, আপনি ধৰ্ম্মপথে থেকেই আমার উপকার করতে পারেন। শুধু আমার উপকার নয়–বাঙ্গালা দেশের একটি প্রাচীন সম্রান্ত পরিবারও আপনার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে।
দারোগাবাবু বলিলেন, ব্যাপারটা তা হলে আমায় খুলে বলুন।
খগেন্দ্র চায়ের পেয়ালায় মুখ দিল। তিন চারি চুমুক পান করিয়া বলিল–সমস্তই আমি খুলে বলছি–বলিয়া চা–টুকু নিঃশেষ করিয়া পেয়ালা নামাইয়া রাখিয়া, রুমালে মুখ মুছিতে মুছিতে আরম্ভ করিল–একজন পুরুষ আর একজন স্ত্রীলোক কোন স্থানে গিয়ে–একটা বিষম জুয়াচুরি করবার ফন্দীতে আছে। আমি তাদের সে জুয়াচুরিতে বাধা দিতে চাই। স্ত্রীলোকটি যে কে তা আমি এখানে এসে জানতে পেরেছি কিন্তু পুরুষটি যে কে তা এখনও নিশ্চিত ভাবে জানতে পারিনি।
দারোগাবাবু বলিলেন, কোথায় এ জুয়াচুরি হচ্ছে?
খগেন্দ্র বলিল, সেইটি এখন বলব না–মাফ করবেন। তবে এই পর্যন্ত বলতে পারি, এখান থেকে সে স্থান বহুদূর। এ জেলাতে নয়–এ ডিভিজনেও নয়।
স্ত্রীলোকটি কে?
বসন্তপুরের কৃষ্ণদাস ঘোষালের মেয়ে লীলাবতী। কি করে জানতে পারলাম তাও বলি। বলিয়া, শাড়ীর আঁচল হইতে টুকরা কাটিয়া আনা, নীলমণি রজককে তাহা দেখান, এবং নীলমণির স্বীকারোক্তি খগেন্দ্র বর্ণনা করিল।
দারোগা শুনিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন, আপনি ইংরেজি ডিটেকটিভের গল্প খুব পড়েন বুঝি? –আপনি দেখছি একজন দ্বিতীয় শার্লক হোম!
খগেন্দ্র বলিল, শার্লক হোমের প্রতিভা আমাতে থাকলে আর ভাবনা কি ছিল!
দারোগাবাবু মাসিক–পত্রখানির পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি বললেন, পুরুষটি যে কে, তা আপনি নিশ্চিত জানতে পারেন নি। কাউকে আপনার সন্দেহ হয় কি? ।
খগেন্দ্র বলিল, হয়। যে রাত্রে লীলাবতী তার শ্বশুরবাড়ী ময়নামতী গ্রাম থেকে নিরুদ্দেশ হয় সেই রাত্রেই আপনার এই গাজনতলার কাছেই, বসন্তপুরের সৈরভির মা বলে একটা স্ত্রীলোকের সঙ্গে, জমিদার সারদাবাবুর ছোট ভাই নবীনকে একত্র পথ চলতে দেখা গিয়েছিল। নবীনও সেই রাত্রি থেকে নিরুদ্দেশ তাই আমার সন্দেহ, হয়ত বা ঐ নবীনের সঙ্গেই লীলাবতী গৃহত্যাগ করে গিয়েছে–আর তারাই গিয়ে ঐ জুয়াচুরিটি করবার চেষ্টায় আছে।
দারোগাবাবু ভৃত্যকে ডাকিয়া বলিলেন, ওরে–যা ত–মুন্সীবাবুর কাছ কাছ থেকে চার পাঁচ মাসের পুরোণো স্টেশন–ডায়রিগুলি সব নিয়ে আয়।
খগেন বলিল, আপনার স্টেশন–ডায়রিতে এ সম্বন্ধে কিছু আছে নাকি?
দারোগাবাবু সে কথার উত্তর না দিয়া বলিলেন, আপনি যে জুয়াচুরিতে বাধা দিতে চাইছেন–এ সব অনুসন্ধান করছেন–এ শুধু ধৰ্ম্ম ভেবে পরের উপকার করবার জন্যে?
খগেন্দ্র বলিল, মোটেই নয়। আমার ঘোর স্বার্থ আছে।
কি রকম?
খগেন্দ্র তখন যে কল্পিত উপন্যাসটি আরম্ভ করিল তাহা সংক্ষেপে এই–এই জমিদারের একটি মাত্র পুত্র ছিল, পিতামাতার সহিত পুরীধামে রথযাত্রা দেখিতে যাইয়া সে হারাইয়া যায়। সে আজ পঁচিশ বৎসরের কথা। জমিদার বাবুর স্ত্রীবিয়োগ হইলে অধিক বয়সে তিনি দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেন–সে স্ত্রীর গর্ভে একটি কন্যা জন্মে। খগেন্দ্রের সহিত সেই মেয়েটির পরিচয় এবং ভালবাসা। বাড়ীতে মেম রাখিয়া জমিদারবাবুর মেয়েটিকে ইংরাজি পড়াইতেন, খগেন্দ্র তাহাকে বাংলা শিক্ষা দিত। দুই বৎসর হইল জমিদারবাবু পরলোক গমন করিয়াছেন। তিনি উইল করিয়া গিয়াছেন, কন্যাটির ষোল বৎসর বয়স হইলে খগেন্দ্রের সহিত বিবাহ হইবে এবং উভয়ে সম্পত্তি সমভাবে পাইবে। ইতিমধ্যে দেওয়ান বালিকার অভিভাবক স্বরূপ সম্পত্তি রক্ষা করিবেন। মেয়েটির বয়স এখন পনেরো বৎসর, আর এক বৎসর পরেই তাহাদের দুইজনের বহুদিন পোষিত মিলনাশা ফল হইত, কিন্তু দুইমাস হইল এক ব্যক্তি আসিয়া বলিতেছে, আমিই সেই পুরীতে হারাইয়া যাওয়া বংশধর। গ্রামেই দুই চারিজন প্রধান। লোক ও কয়েকজন অসন্তুষ্ট আমলাকে বশ করিয়া বিষয় সম্পত্তি দখলের জন্য সে মোকদ্দমা করিবার আয়োজন করিতেছে। সে আসিবার কিছু পূৰ্ব্বে অন্তঃপুরে এক অপরিচিত স্ত্রীলোক নিজেকে অনাথা বলিয়া পরিচয় দিয়া প্রবেশ করিয়াছিল এবং আশ্রয়ও পাইয়াছিল। সম্প্রতি ধরা পড়িয়াছে যে ঐ স্ত্রীলোকটা সেই পুরুষকে গোপনে গোপনে নানা সংবাদ দিয়া পত্র লেখে। স্ত্রীলোকটা যে লীলাবতী ইহা নীলমণি রজকের দ্বারায় প্রমাণ হইতেছে; কিন্তু পুরুষটা যে কে সেইটি জানিতে পারিলেই কাৰ্যসিদ্ধি হয়।
নব্য দারোগাবাবু এই কাহিনী বিস্ময়–বিস্ফারিত নেত্রে শুনিয়া যাইতেছিলেন। শেষ হইলে বলিলেন–এ যে মশাই রীতিমত একখানি উপন্যাস! আশ্চর্য্য কাণ্ড ত!
খগেন্দ্র দেখিল ঔষধটি বেশ ধরিয়াছে।
একজন কনেষ্টবল এই সময় খানকয়েক স্টেশন–ডায়রি বহি আনিয়া দারোগাবাবুর সম্মুখে রাখিল। তিনি কিছুক্ষণ সেগুলার পাতা উল্টাইয়া একটা স্থান অভিনিবেশ সহকারে পড়িতে লাগিলেন। বহি হইতে চক্ষু না তুলিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন–সে স্ত্রীলোকটার কি নাম বললেন? কার মা?
খগেন্দ্র বলিল, সৈরভির মা।
দারোগাবাবু মৃদু হাস্য করিয়া বলিলেন, এই দেখুন।
খগেন্দ্র দেখিল, ময়নামতী গ্রামের চৌকিদার বছিরদ্দি শেখ লিখাইয়াছে–গত রাত্রে রোধ দিতে বাহির হইয়া ময়নামতী ও গাজনতলায় সরহদ্দের নিকট দুইজন স্ত্রীলোককে সন্দেহজনক অবস্থায় যাইতে দেখে এবং চৌকিদারের জিজ্ঞাসায় তাহারা যাহা যাহা বলিয়াছিল, তাহাও ডায়রিভুক্ত করা হইয়াছে।
খগেন্দ্র পরিশেষে বলিল, তবে ত দেখছি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম। নবীনের সঙ্গে লীলাবতী পালিয়েছে।
দারোগা বলিলেন, আমারও তাই বিশ্বাস।
অনেকক্ষণ ধরিয়া এই প্রসঙ্গ চলিল। যদি মাফ করেন ত জিজ্ঞাসা করি। –ইত্যাকার সসঙ্কোচ ভূমিকা করিয়া মাঝে মাঝে দারোগাবাবু সেই কাল্পনিক মেয়েটির কথাও খগেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। লজ্জায় রাঙা হইয়া, কণ্ঠের স্বর সাধ্যমত কম্পিত করিয়া খগেন্দ্র যে সকল উত্তর দিতে লাগিল, তাহা হইতে দারোগাবাবুর স্পষ্টই ধারণা জন্মিল, মেয়েটি রূপে লক্ষ্মী গুণে স্বরস্বতী; এবং এ দুজনের প্রেমটি স্বর্গেরই জিনিষ–মর্ত্তে তাহার তুলনা নাই।
ফলে দারোগাবাবু প্রতিশ্রুত হইলেন, বে-আইনি না করিয়া, নিজ এলাকা মধ্যে খগেন্দ্রকে যতদূর সাহায্য তিনি করিতে পারেন তাহা করিবেন।
১০. কয়েকখানি পত্র
(১)।
বসন্তপুর
২৫শে জ্যৈষ্ঠ
প্রিয় ভগ্নী কনকলতা
তোমায় শেষ পত্র লিখিবার পর অনেকগুলি নূতন কথা জানিতে পারিয়াছি। এখানকার দারোগাবাবু আমার একজন পরম বন্ধু। তাহার সাহায্যে সৈরভির মাকে রীতিমত জেরা করিয়া অনেক কথা বাহির করা গিয়াছে। মাগী কি সহজে বলে!–যখন কনেষ্টবল তাহাকে হাতকড়ি পরাইতে উদ্যত হইল তখন সকল কথা সে প্রকাশ করিল। নবীনচন্দ্র তাহাকে টাকা খাওয়াইয়া ময়নামতী পাঠাইয়া দিয়াছিল। সেখানে সন্ধ্যার পর পৌঁছিয়া নির্জন পুকুর ঘাটে লীলাবতাঁকে পাইয়া সে বলে, তোমার মা অত্যন্ত পীড়িতা, হঁহারা পাঠাইবেন না জানিয়া গোপনে তিনি পাল্কী পাঠাইয়া দিয়াছেন, ষোলজন বেহারা ও পাল্কী গ্রামের বাহিরে অপেক্ষা করিতেছে, রাত্রি দশটার সময় আমি খিড়কীর দরজার নিকট দাঁড়াইয়া থাকিব, তুমি বাহির হইয়া আসিও, মার সঙ্গে দেখা করাইয়া আবার তাড়াতাড়ি তোমায় ফিরাইয়া আনিব। বোকা মেয়ে সেই কথায় বিশ্বাস করিয়া সৈভির মার সহিত বাহির হয়। গ্রাম হইতে কিছুদূরে, বটবৃক্ষের ছায়ায় গরুর গাড়ী লইয়া নবীন লুকাইয়া ছিল–সে লীলাবতাঁকে ধিরয়া, মুখে কাপড় খুঁজিয়া গরুর গাড়ীতে তুলিয়া প্রস্থান করে। সৈরভির মা বলিল সে গাড়োয়ানের নাম বলাই ঘোষ। দারোগাবাবু বলাই ঘোষকে আনাইয়াও জিজ্ঞাসাবাদ করিয়াছেন। সেও সৈরভির মার উক্তি (মুখে কাপড় খুঁজিয়া জোর করিয়া গাড়ীতে উঠান প্রভৃতি) সমর্থন করে। তাহার নিকট হইতে আরও জানা গিয়াছে, নয়নপুরের নিকট এক বাগানবাড়ীতে ইহারা গিয়া উঠিয়াছিল। আগামী কল্য দারোগাবাবু সহ আমি নয়নপুর যাত্রা করিব। সেখানে যেরূপ শুনিতে পাই তাহা পরে জানাইব।
তোমার স্নেহের খগেন দাদা।
(২)
বসন্তপুর
২৭শে জ্যৈষ্ঠ
কল্যাণবরাসু,
গত পরশু দিবস তোমায় একখানি পত্র লিখিয়াছি, পাইয়া থাকিবে। দারোগাবাবু আমায় সঙ্গে লইয়া যান নাই–তিনি একাই নয়নপুরের বাগান বাড়ীতে অনুসন্ধান করিতে। গিয়াছিলেন। তিনি ফিরিয়া অদ্য বলিলেন, লীলাবতী প্রায় মাসাবধি কাল ঐ বাগানবাড়ীতে আবদ্ধ ছিল। নবীন মাঝে মাঝে আসিত এবং লীলাবতাঁকে অনেক অনুনয় বিনয় করিত। লীলা কিন্তু সর্বদা কাঁদাকাটা করিত এবং নবীনকে দেখিলেই বলিত–যদি আমার কাছে আসিবে ত আমি ছাদ হইতে লাফাইয়া পড়িব। মাসখানেক পরে, এখান হইতে নবীন লীলাবতাঁকে রাত্রিকালে কালনায় লইয়া যায় এবং নৌকাযোগে সেখান হইতে কোথায় যাত্রা করে তাহা এখনও প্রকাশ হয় নাই। দারোগাবাবুর সাহায্য না পাইলে আমি এ সকল কিছুই জানিতে পারিতাম না। সৌভাগ্যক্রমে কালনা থানার ইনস্পেক্টরবাবু আমাদের এই দারোগাবাবুর বন্ধু। তিনি আমায় চিঠি দিয়া সেখানে পাঠাইতেছেন। কালনায় গিয়া তাঁহার সাহায্যে আমি যদি সেই সকল মাঝি–মাল্লাকে বাহির করিতে পারি, তবে সেখান হইতে তাহারা কোথায় গেল কি করিল সবই জানা যাইবে।
এখন যতদূর দেখিতেছি, সম্ভবতঃ সুরবালা ওরফে লীলাবতী ক্রমে নবীনের কবল হইতে পলাইয়া গিয়াছিল এবং পরে ঐ জাল ভবেন্দ্রের সহিত কোথাও একত্র হইয়া ষড়যন্ত্র করিয়া তোমাদের ওখানে পৌঁছিয়াছে। তুমি যদি ইতিমধ্যে কোনও সংবাদ পাইয়া থাক তবে তুমি আমায় কালনার ঠিকানায় পুলিশের ইনস্পেক্টরবাবুর কেয়ারে পত্র লিখিবে।
তোমার স্নেহের খগেন দাদা।
(৩)
বাশুলিপাড়া
৩১শে জ্যৈষ্ঠ
প্রণামপূৰ্ব্বক নিবেদনমিদং
পরম পূজনীয় দাদামহাশয় পত্রদ্বারা আমার বহু বহু প্রণাম জানিবেন। পরে আপনার শ্রীচরণাশীৰ্বাদে এ জনার প্রাণগতিক মঙ্গল হয় বিশেষ। দেখুন ঠিক হল ত? এবার আর বলিতে পারিবেন না যে আপনাকে জ্যেষ্ঠোচিত ভক্তিশ্রদ্ধা প্রদর্শনে আমি ত্রুটি করিতেছি।
আপনার পত্র দুইখানি পাইয়াছি। একটি সংবাদ আমি জানিতে পারিয়াছি। যিনি ভবেন্দ্র সাজিয়াছেন, তিনি পূৰ্ব্বে নাকি তিনতারিয়া মঠের মোহান্ত ছিলেন। বাবু একদিন দেওয়ানজির সহিত কথোপকথন করিতেছিলেন, আমি আড়ালে থাকিয়া শুনিয়াছিলাম। কিন্তু এই তিনতারিয়া কোথায় তাহা কিছুই প্রকাশ করেন নাই।
এ বাটীর সমস্ত মঙ্গল। ভবেন্দ্রবাবু যেই হউন–সত্যই হউন আর জালই হউন–তিনি বউরাণীর সহিত সত্যকার প্রেমেই পড়িয়া গিয়াছেন। মাঝে বউরাণীর জ্বর হইয়াছিল, একদিন অবস্থা একটু শঙ্কাজনক হইয়া উঠে। সেদিন বউরাণীর বিছানার নিকট চেয়ার পাতিয়া তিনি বসিয়াছিলেন–আমি হঠাৎ ঢুকিয়া দেখি তাহার চোখ দিয়া টপ্ টপ করিয়া জল পড়িতেছে। কেহ যদি কাহাকেও সত্য সত্য ভালবাসে, দেখিতে আমার বড় ভাল লাগে। আপনার কুশল সংবাদ লিখিবেন। ইতি
আপনার স্নেহের ভগ্নী
কনকলতা
(৪)
কালনা
৬ই আষাঢ়
কল্যাণীয়াসু,
কয়েক দিন হইল তোমার একখানি পত্র পাইয়াছি। তুমি লিখিয়াছ যে জাল ভবেন্দ্র পূৰ্ব্বে তিনতারিয়া মঠে থাকিত, কিন্তু সে যে কোথায় তাহা আমি কিছুতেই নির্ণয় করিতে পারিতেছি না। সেখানে কোনও ডাকঘর নাই, থাকিলে পোষ্টাল গাইডেই নাম খুঁজিয়া পাইতাম। –যাহা হউক সে অনুসন্ধান শীঘ্রই আমাকে করিতে হইবে।
এখানে আসিয়া ইনস্পেক্টরবাবুর সাহায্যে মাঝি–মাল্লাগণকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া যাহা শুনিয়াছি, তাহাতে রহস্য গভীরতর হইয়া পড়িয়াছে। দরিবুল্লা মাঝির কথায় ইহাই প্রকাশ হইতেছে যে, একজন বাবু একটি রুগ্না স্ত্রীলোককে লইয়া তাহার নৌকায় আহরণ করেন। স্ত্রীলোকটি ঐ বাবুর প্রতি অত্যন্ত বিমুখ ছিল, এবং সর্বদা কাঁদাকাটা করিত। কোনও দিন আহার করিত, কোন দিন করিত না। বাবুকে কাছে যাইতে দিত না। একদিন অপরাহ্নকালে হঠাৎ নৌকায় গোল উঠে, ছুরি আন ছুরি আন। স্ত্রীলোকটি আত্মহত্যা করিবার অভিপ্রায়ে গলায় দড়ি দিয়াছিল। বাবু তাহা দেখিতে পাইয়া গোল করেন। তখন সকলে গিয়া দড়ি কাটিয়া তাহাকে নামাইল। স্ত্রীলোকটি প্রথমতঃ অজ্ঞান অবস্থায় ছিল, অনেক শুশ্রূষায় সন্ধ্যার পরে তাহার চৈতন্য হয়। নৌকার ভিতর একা শয়ন করিত, সেদিনও একাকী ছিল। বাবুটি ছত্রীর বাহিরে শয়ন করিতেন। প্রাতে উঠিয়া স্ত্রীলোকটিকে নৌকায় আর দেখা যায় নাই। একজন দাঁড়ি বলে, দেওয়ানগঞ্জ বা ঐরূপ কোন স্থানে নিকট রাত্রি তৃতীয় প্রহরের সময় জলে ঝপাস করিয়া কি একটা পড়িবার শব্দ সে শুনিয়াছিল, কিন্তু শুশুক লাফাইতেছে ভাবিয়া ওদিকে আর খেয়াল করে নাই।
সুতরাং অনুমান হইতেছে, পলায়ন বা আত্মহত্যা অভিপ্রায়ে লীলাবতীই রাত্রে জলে লাফাইয়া পড়িয়াছিল; ভাসিয়া গিয়া ডাঙ্গায় উঠিয়াছিল। দরিবুল্লা আরও বলে, সেদিন দোল ছিল। পঞ্জিকায় দেখিলাম উহা ২৯শে ফাল্গুন। কোন্ দিন সুরবালাকে বাগানের ঘাটে পাওয়া গিয়াছিল অনুসন্ধান করিয়া আমায় লিখিবে। তাহা হইলেই বুঝা যাইবে, মাঝিগণ বর্ণিত এই বাবু ও স্ত্রীলোক, নবীন ও সুরবালা কিনা।
তোমার দাদা
(৫)
বাশুলিপাড়া
১০ই আষাঢ়
প্রিয় খগেনবাবু,
পত্র পাইলাম। তাড়াতাড়ি এক ছত্র লিখিয়া দিতেছি। দোলের পরদিন প্রাতেই সুরবালাকে বাগানের ঘাটে পাওয়া গিয়াছিল।
আপনার
কনক।
(৬)
কলিকাতা
২০শে আষাঢ়
প্রিয় কনক,
তোমার পত্র পাইয়া অনেকটা হতাশ হইতে হইল। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, সুরবালা ঐ জাল ভবেন্দ্রের সহিত পরামর্শ করিয়া আসে নাই। উহার সম্বন্ধে যত কিছু অনুসন্ধান করিলাম, সকলই ব্যর্থ হইল–জাল ভবেন্দ্র যে কে, তাহার কিছুই নির্ণয় হইল না।
এখানে ফিরিয়া নবীনচন্দ্রের সন্ধানে আমি গিয়াছিলাম। তাঁহার ঠিকানায় গিয়া শুনিলাম, কয়েকদিন পূৰ্বে ঘোড়ার গাড়ী উল্টাইয়া পড়িয়া তিনি বিষম আঘাত পান এবং মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে আছেন। সেখানে কয়েকদিন উপর্যুপরি তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি। গতকল্য তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। মরিবার পূর্বে তিনি উকীল ডাকাইয়া হাসপাতালে এক উইল করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাতে লিখিয়াছেন, লীলাবতীর উপর অত্যাচার করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, সেই পাপেই তাহার এই অপঘাত মৃত্যু হইল। আরও লিখিয়াছেন, ঈশ্বরকৃপায় তিনি তাঁহার দুশ্চেষ্টায় সফল হন নাই–লীলাবতী সতী–নিষ্পাপ শরীর। তাঁহার প্রাপ্য সম্পত্তির অর্ধাংশ, নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ তিনি লীলাবতাঁকে দান করিয়াছেন। অপরাদ্ধ তাঁহার ভ্রাতৃম্পুত্রগণকে বিভাগ করিয়া দিয়াছেন। আমিও সেই উইলে সাক্ষী হইয়াছি।
আমি আগামী কল্য প্রাতে কাশী যাত্রা করিব। সেখানে অনেক সাধু সন্ন্যাসী থাকেন। তিনতারিয়া মঠ কোথায়–আমি সেখানে থাকিয়া অনুসন্ধান করিব। সে মঠে গেলে, ভবেন্দ্ৰ যে কে হয়ত নির্ণীত হইতে পারে।
তোমার স্নেহের
খগেন্দ্র
(৭)
কলিকাতা
১৫ই শ্রাবণ
প্রিয় কনক,
আমার এতদিনের পরিশ্রম সফল হইয়াছে। কাশী হইতে সন্ধান পাইয়া আমি তিনতারিয়া মঠে গিয়াছিলাম। সেখানে জানিলাম, তাহাদের ভূতপূৰ্ব্ব মোহান্ত বাস্তলিপাড়া নিবাসী ভবেন্দ্ৰই ছিলেন। অল্পদিন পরে ফিরিয়া আসিব এইরূপ বলিয়া, গত ফাঙ্গুন মাসে তিনি বঙ্গদেশে যাত্রা করেন। একমাসের অধিক কাল কোনও সংবাদ না পাইয়া তাহার চেলারা অনুসন্ধান করিতে কলিকাতায় আসে। পুলিশ, রেল আপিস, প্রভৃতি স্থানে অনুসন্ধান করিয়া তাহারা জানিতে পারে, ঐ সময় খুস্রুপুর ষ্টেশনে এক সন্ন্যাসীর মৃতদেহ ট্রেণ হইতে নামিয়াছিল। সেই সন্ন্যাসীর পরিত্যক্ত বাক্স প্রভৃতি রেল আপিসে জমা ছিল, তাহা দেখিয়া তাহারা সেই মোহান্তের জিনিষ বলিয়া চিনিতে পারিয়াছে।
এ সম্বন্ধে আরও অধিক অনুসন্ধান করিবার জন্য আমি খুস্রুপুরে গিয়াছিলাম। সেখানে সন্ন্যাসীর মৃতদেহ নামার সংবাদ পাইলাম–আরও জানিলাম–যে সময় ঐ মৃতদেহ নামিয়াছিল, সে রাত্রে ময়নামতীর রাখাল ভট্টাচাৰ্য্য–লীলাবতীর স্বামী–ডিউটিতে ছিল। মৃতদেহ সমস্ত রাত্রি তাহারই জিম্মায় থাকে। কয়েকদিন পরেই চাকরি হইতে অবসর লইয়া রাখাল কাশী যাত্রা করে।
খুস্রুপুর হইতে আমি ময়নামতীতে গিয়াছিলাম। সেখানে রাখালের এক দাদা আছেন। তিনি অদ্যাবধি রাখালের কোনও সংবাদ পান নাই। সে জীবিত কি মৃত তাহাও তিনি অবগত নহেন।
সুতরাং এখন দিনের আলোর মত স্পষ্টই বুঝিতে পারিতেছি, ঐ রাখালই, মৃত সন্ন্যাসীর কাগজপত্র হইতে তাহার নামধাম এবং অন্যান্য কথা অবগত হইয়া ভবেন্দ্র সাজিয়া বাশুলিপাড়ায় গিয়াছে। সেদিন বিকালে গঙ্গার ঘাট হইতে ফিরিবার সময় বাগানে হঠাৎ জাল ভবেন্দ্রকে দেখিয়া সুরবালা কেন চমকাইয়া উঠিয়াছিল, তাহাও বেশ বোঝা যাইতেছে।
আরও কিছু কিছু সংবাদ সংগ্রহ করিতে এখনও বাকী আছে–তাহা শেষ করিয়া আমি বাশুলিপাড়ায় গিয়া কাৰ্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইব।
তোমার স্নেহের
খগেন্দ্র