বিজ্ঞান তো সার্বভৌমিক, তবে বিজ্ঞানের মহাক্ষেত্রে এমন-কি কোনো স্থান আছে যাহা ভারতীয় সাধক ব্যতীত অসম্পূর্ণ থাকিবে? তাহা নিশ্চয়ই আছে। বর্তমানকালে বিজ্ঞানের প্রসার বহুবিস্তৃত হইয়াছে এবং প্রতীচ্যদেশে কার্যের সুবিধার জন্য তাহা বহুধা বিভক্ত হইয়াছে এবং বিভিন্ন শাখার মধ্যে অভেদ্য প্রাচীর উত্থিত হইয়াছে। দৃশ্যজগৎ অতি বিচিত্র এবং বহুরূপী এত বিভিন্নতার মধ্যে যে কিছু সাম্য আছে তাহা বোধগম্য হয় না। সতত চঞ্চল প্রাণী, আর এই চিরমৌন অবিচলিত উদ্ভিদ, ইহাদের মধ্যে কোনো সাদৃশ্য দেখা যায় না। আর এই উদ্ভিদের মধ্যে একই কারণে বিভিন্নরূপে সাড়া দেখা যায়। কিন্তু এত বৈষম্যের মধ্যেও ভারতীয় চিন্তাপ্রণালী একতার সন্ধানে ছুটিয়া জড়, উদ্ভিদ ও জীবের মধ্যে সেতু বাঁধিয়াছে। এতদর্থে ভারতীয় সাধক কখনও তাহার চিন্তা কল্পনার উম্মুক্ত রাজ্যে অবাধে প্রেরণ করিয়াছে এবং পরমুহূর্তের তাহাকে শাসনের অধীনে আনিয়াছে। আদেশের বলে জড়বৎ অঙ্গুলিতে নূতন প্রাণ সঞ্চার করিয়াছে এবং যে স্থলে মানুষের ইন্দ্রিয় পরাস্ত হইয়াছে তথায় কৃত্রিম অতীন্দ্রিয় সৃজন করিয়াছে। তাহা দিয়া এবং অসীম ধৈর্য সম্বল করিয়া অব্যক্ত জগতের সীমাহীন রহস্যের পরীক্ষা প্রণালীতে স্থির প্রতিষ্ঠা করিবার সাহস বাঁধিয়াছে। যাহা চক্ষুর অগোচর ছিল তাহা দৃষ্টিগোচর করিয়াছে। কৃত্রিম চক্ষু পরীক্ষা করিয়া মানুষ্যদৃষ্টির অভাবনীয় এমন এক নূতন রহস্য আবিষ্কার করিয়াছে যে, তাহার দুইটি চক্ষু এক সময়ে জাগরিত থাকে না; পর্যায়ক্রমে একটি ঘুমায়, আর-একটি জাগিয়া থাকে। ধাতুপাত্রে লুক্কায়িত স্মৃতির অদৃশ্য ছাপ প্রকাশিত করিয়া দেখাইয়াছে। অদৃশ্য-আলোক সাহায্যে কৃষ্ণপ্রস্তরের ভিতরের নির্মাণকৌশল বাহির করিয়াছে। আণবিক কারুকার্য ঘূর্ণ্যমান বিদ্যুৎ-ঊর্মির দ্বারা দেখাইয়াছে। বৃক্ষজীবন মানবীয় জীবনের প্রতিকৃতি দেখাইয়া নির্বাক জীবনের উত্তেজনা মানবের অনুভূতির অন্তর্গত করিয়াছে। বৃক্ষের অদৃশ্য বৃদ্ধি মাপিয়া লইয়াছে এবং বিভিন্ন আহার ও ব্যবহারে সেই বৃদ্ধিমাত্রার পরিবর্তন মুহূর্তে ধরিয়াছে। মনুষ্যস্পর্শেও যে বৃক্ষ সংকুচিত হয়, তাহা প্রমাণ করিয়াছে। যে উত্তেজক মানুষকে উৎফুল্ল করে, যে মাদক তাহাকে অবসন্ন করে, যে বিষ তাহার প্রাণনাশ করে, উদ্ভিদেও তাহাদের একই বিধ ক্রিয়া প্রমাণিত করিতে সমর্থ হইয়াছে। বিষে অবসন্ন মুমূর্ষু উদ্ভিদকে ভিন্ন বিষ প্রয়োগ দ্বারা পুনজীবিত করিয়াছে। উদ্ভিদপেশীর স্পন্দন লিপিবদ্ধ করিয়া তাহাতে হৃদয়স্পন্দনের প্রতিচ্ছায়া দেখাইয়াছে। বৃক্ষশরীর স্নায়ুপ্রবাহ আবিষ্কার করিয়া তাহার বেগ নির্ণয় করিয়াছে। প্রমাণ করিয়াছে যে, যে সকল কারণে মানুষের স্নায়ুর উত্তেজনা বর্ধিত বা মন্দীভূত হয় সেই একই কারণে উদ্ভিদ-স্নায়ুর আবেগও উত্তেজিত অথবা প্রশমিত হয়। এই সকল কথা কল্পনাপ্রসূত নহে। যে সকল অনুসন্ধান আমার পরীক্ষাগারে গত তেইশ বৎসর ধরিয়া পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত হইয়াছে ইহা তাহারই অতি সংক্ষিপ্ত ও অপরিপূর্ণ ইতিহাস। যে সকল অনুসন্ধানের কথা বলিলাম তাহাতে নানাপথ দিয়া পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, এমন-কি মনস্তত্ত্ববিদ্যাও এক কেন্দ্রে আসিয়া মিলিত হইয়াছে। বিধাতা যদি বিজ্ঞানের কোনো বিশেষ তীর্থ ভারতীয় সাধকের জন্য নির্দেশ করিয়া থাকেন তবে এই চতুর্বেণী-সংগমেই সেই মহাতীর্থ।
Related Chapters
- ০১. কথারম্ভ
- ০২. যুক্তকর
- ০৩. আকাশ-স্পন্দন ও আকাশ-সম্ভব জগৎ
- ০৪. উদ্ভিদের জন্ম ও মৃত্যু
- ০৫. মন্ত্রের সাধন
- ০৬. অদৃশ্য আলোক
- ০৭. আলোর সাধারণ প্রকৃতি
- ০৮. আলোর বিবিধ বর্ণ
- ০৯. মৃত্তিকা-বর্তুল ও কাচ-বর্তুল
- ১০. সর্বমুখী এবং একমুখী আলো
- ১১. বক-কচ্ছপ সংবাদ
- ১২. তারহীন সংবাদ
- ১৩. পলাতক তুফান
- ১৪. অগ্নি পরীক্ষা
- ১৫. ভাগীরথীর উৎস-সন্ধানে
- ১৬. বিজ্ঞানে সাহিত্য
- ১৭. কবিতা ও বিজ্ঞান
- ১৮. বিজ্ঞানে সাহিত্য – অদৃশ্য আলোক
- ১৯. বৃক্ষজীবনের ইতিহাস
- ২০. বৃক্ষের দৈনন্দিন ইতিহাস
- ২১. ভারতে অনুসন্ধানের বাধা
- ২২. গাছের লেখা
- ২৩. উপসংহার
- ২৪. নির্বাক জীবন
- ২৫. তরুলিপি
- ২৬. গাছ লাজুক কি অ-লাজুক
- ২৭. অনুভূতি কাল নিরূপণ
- ২৮. সাড়ার মাত্রা
- ২৯. বৃক্ষে উত্তেজনাপ্রবাহ
- ৩০. স্বতঃস্পন্দন
- ৩১. বনচাঁড়ালের নৃত্য
- ৩২. মৃত্যুর সাড়া
- ৩৩. নবীন ও প্রবীণ
- ৩৪. দলাদলি
- ৩৫. পরিষদ-গৃহে বক্তৃতা
- ৩৬. বোধন
- ৩৭. জীবনসংগ্রাম
- ৩৮. লোকসেবা
- ৩৯. শিল্পোদ্ধার
- ৪০. মানসিক শক্তির বিকাশ
- ৪১. বিফলতা
- ৪২. মনন ও করণ
- ৪৩. রানী-সন্দর্শন
- ৪৪. নিবেদন
- ৪৫. পরীক্ষা
- ৪৬. জয়-পরাজয়
- ৪৭. পৃথিবী পর্যটন
- ৪৮. বীরনীতি
- ৪৯. বিজ্ঞান-প্রচারে ভারতের দান
- ৫০. আশা ও বিশ্বাস
- ৫১. আবিষ্কার এবং প্রচার
- ৫২. অর্ঘ্য
- ৫৩. দীক্ষা
- ৫৪. আহত উদ্ভিদ
- ৫৬. জীবনের মাপকাঠি
- ৫৭. গাছের উত্তেজনার কথা
- ৫৮. গাছের লিপিযন্ত্র
- ৫৯. গাছের লেখা হইতে তাহার ভিতরকার ইতিহাস উদ্ধার
- ৬০. পাত্রাধার তৈল
- ৬১. আহতের সাড়া
- ৬২. আঘাতে অনুভূতি-শক্তির বিলোপ
- ৬৩. জন্মভূমি
- ৬৪. স্নায়ুসূত্রে উত্তেজনা-প্রবাহ
- ৬৫. স্বতঃস্পন্দন ও ভিতরের শক্তি
- ৬৬. ইন্দ্রিয়-অগ্রাহ্য কিরূপে ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য হইবে?
- ৬৭. বাহিরের শক্তির প্রতিরোধ
- ৬৮. বৃক্ষে স্নায়ুসূত্র
- ৬৯. আণবিক সন্নিবেশে উত্তেজনা-প্রবাহের হ্রাস-বৃদ্ধি
- ৭০. পরীক্ষা
- ৭১. ভিতর ও বাহির
- ৭২. হাজির
- ৭৩. বৃক্ষের অঙ্গভঙ্গী
- ৭৪. সবিতার রথ
- ৭৫. ছাত্রসমাজের প্রতি