৩৯. শিল্পোদ্ধার

সম্প্রতি এই বিষয় লইয়া অনেক আন্দোলন হইয়াছে। কেই কেহ মনে করেন যে, সরকারী একজন ডিরেক্টর নিযুক্ত হইলেই আমাদের দেশের শিল্পোদ্ধার হইবে। ডিরেক্টর মহোদয় সর্বজ্ঞ এবং সর্বশক্তিমান নহেন। এই সমস্ত গুণের সমন্বয়েও বিধাতাপুরুষ আমাদের দুর্গতি দূর করিতে পারেন নাই। ইহা হইতে মনে হয়, আমাদেরও কিছু কর্তব্য আছে যাহাতে আমরা একান্ত বিমুখ। জাপানে অবস্থানের কালে দেখিলাম যে, ভারতবাসী ছাত্রগণ তথাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উচ্চতম স্থান অধিকার করিয়াছে। অথচ কার্যক্ষেত্রে ভারতবাসীর কোনো স্থান নাই। জাপানী কিন্তু ঐ অবস্থাতেই সিদ্ধমনোরথ না হইয়া ক্ষান্ত হয় না। সে নিজের নিষ্ফলতার কারণ অন্যের উপর ন্যস্ত করে না। আমাদের দুরবস্থার প্রকৃত কারণ কি? কারণ এই যে, চরিত্রে আমাদের বল নাই, ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পতন’ এ কথা আমরা কেবল মুখেই বলিয়া থাকি। আমি জানি যে, আমার বন্ধুদের মধ্যে কেহ কেহ স্বদেশী শিল্পের জন্য সর্বস্ব অর্পণ করিয়াছেন। বহুদিনের চেষ্টার পর তাঁহারা বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যবহার্য বস্তু উৎকৃষ্টরূপে প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইয়াছেন। তথাপি তাঁহাদের ব্যবসায় যে স্থায়ী হইবে তাহার কোনো সম্ভাবনা দেখা যায় না। তাহার প্রকৃত কারণ এই যে, এ-পর্যন্ত তাঁহারা একজনও কর্মকুশল ও কর্তব্যশীল পরিচালক দেখিতে পাইলেন না।
কেরানিবাবু শত শত পাওয়া যাইতেছে; তাহাদের কেবল কলমের ও মুখের জোর। বিদেশে দেখিয়াছি, ক্রোড়পতির পুত্রও ব্যবসায় শিক্ষার সময় আপিসে সর্বাপেক্ষা নিম্নতম কার্য গ্রহণ করিয়া ক্রমে ক্রমে সেখানকার সমস্ত কার্য স্বহস্তে করিয়া সম্যক্‌ শিক্ষালাভ করে। আমাদের দেশে অল্পতেই লোকের মান ক্ষয় হয়। আমাদের দেশের ছাত্র, যাহারা আমেরিকা যাইয়া সেখানকার রীতি অনুসারে কোনো কার্যহীন জ্ঞান করে নাই; এমন-কি, দারোয়ানী করিয়া এবং বাসন ধুইয়া বহু কষ্টে শিক্ষালাভ করিয়াছে, এখানে আসিয়াই তাহারা প্রকৃত মনুষ্যত্ব ভুলিয়া বিদেশীর বাহ্য ধরন-ধারণ অবলম্বন করে। তখন তাহাদের পক্ষে অনেক কার্য অপমানকর মনে হয়।
এ সব সম্বন্ধে সম্প্রতি জাপান হইতে প্রত্যাগত জনৈক বন্ধুর নিকট শুনিলাম যে, সেখানে আমাদের সম্বন্ধে দুই-একটি আমোদজনক কথা চলিতেছে। তাহাদিগের অনুগ্রহ ব্যতিরেকে নাকি আমাদের গৃহিণীদের পট্টবস্ত্র হইতে হাতের চুড়ি পর্যন্ত সংগ্রহ হয় না। এখন বাঙালী বাবুদের জন্য তাহাদিগকে হুকার কল্পে পর্যন্ত প্রস্তুতের ভার গ্রহণ করিতে হইয়াছে। এতদিন পর্যন্ত তোমরা ইউরোপের উপেক্ষা বহন করিতে অভ্যস্ত হইয়াছ, এখন হইতে এশিয়ারও হাস্যাস্পদ হইতে চলিলে! আমাদের দূর্বলতা সস্পূর্ণরূপে ত্যাগ না করিলে কোনোদিন কি শিল্পে সার্থকতা লাভ করিতে পারিব?


© 2024 পুরনো বই