০৪. চতুর্থ অধ্যায়

শ্রীভগবানুবাচ।

ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবানহমব্যয়ম্।
বিবস্বান্ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষ্বাকবেহব্রবীৎ || ১ ||

শ্রীভগবান্ বলিলেন,-

এই অব্যয় যোগ আমি সূর্য্যকে বলিয়াছিলাম। সূর্য্য মনুকে বলিয়াছিলেন, মনু ইক্ষ্বাকুকে বলিয়াছিলেন। ১।

এই যোগের ফল অব্যয়, এ জন্য ইহাকে অব্যয় বলা হইয়াছে। ইক্ষ্বাকু মনুর পুত্র, এবং সূর্য্যবংশীয় রাজগণের আদি পুরুষ।

এবং পরম্পরাপ্রাপ্তমিমং রাজর্ষয়ো বিদুঃ।
স কালেনেহ মহতা যোগো নষ্টঃ পরন্তপ || ২ ||

এইরূপ পরম্পরাপ্রাপ্ত হইয়া এই যোগ রাজর্ষিগণ অবগত হইয়াছিলেন। হে পরন্তপ! এক্ষণে মহৎ কালপ্রভাবে সে যোগ নষ্ট হইয়াছে। ২।

(টীকা অনাবশ্যক।)

স এবায়ং ময়া তেহদ্য যোগঃ প্রোক্তঃ পুরাতনঃ।
ভক্তোহসি মে সখা চেতি রহস্যং হ্যেতদুত্তমম্ || ৩ ||

তুমি আমার ভক্ত ও সখা, সেই পুরাতন যোগ অদ্য আমি তোমাকে বলিলাম। এ প্রসঙ্গ উত্তম। ৩।

(টীকা অনাবশ্যক।)

অর্জ্জুন উবাচ।

অপরং ভবতো জন্ম পরং জন্ম বিবস্বতঃ।
কথমেতদ্বিজানীয়াং ত্বমাদৌ প্রোক্তবানিতি || ৪ ||

আপনার জন্ম পরে, সূর্য্যের জন্ম পূর্ব্বে, আপনি যে ইহা পূর্ব্বে বলিয়াছিলেন, তাহা কি প্রকারে বুঝিতে পারিব? ৪।

(টীকা অনাবশ্যক।)

শ্রীভগবানুবাচ।
বহুনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জ্জুন।
তান্যহং বেদ সর্ব্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ || ৫ ||

আমার বহু জন্ম অতীত হইয়াছে, তোমারও হইয়াছে। আমি সেগুলি সকলই অবগত আছি। হে পরন্তপ! তুমি জান না। ৫।

সহসা অবতারবাদের কথা উত্থাপিত হইল। কর্ম্ম ও জ্ঞানের সম্বন্ধ বুঝিবার জন্য উহার প্রয়োজন আছে। আপাততঃ এই শ্লোকগুলির ভাবে বোধ হয়, যেন অর্জ্জুন অবতারতত্ত্ব অবগত ছিলেন না। এ সম্বন্ধে কয়েকটা কথা স্মরণ রাখা কর্ত্তব্য।

প্রথমতঃ, মহাভারতের অনেক স্থলে শ্রীকৃষ্ণ, বিষ্ণু ঈশ্বরের কথা বলা হইয়াছে, ইহা সত্য বটে। কিন্তু কৃষ্ণচরিত্র নামক মৎপ্রণীত গ্রন্থে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছি যে, মহাভারতের সকল অংশ এক সময়ের নহে; এবং যে সকল অংশে কৃষ্ণের অবতারত্ব আরোপিত হইয়াছে, তাহা অপেক্ষাকৃত আধুনিক। দ্বিতীয়তঃ, মহাভারতে দশ অবতারের কথা মাত্র নাই, এবং ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে একত্র বিদ্যমান। তৃতীয়তঃ, দশ অবতারের কথা অপেক্ষাকৃত আধুনিক পুরাণগুলিতে আছে; কিন্তু পুরাণে আবার ভিন্ন প্রকারও আছে। ভাগবতে আছে, অবতার বাইশটি; আবার এ কথাও আছে যে, অবতার অসংখ্যেয়। শ্রীকৃষ্ণও এখানে আটটি, কি দশটি, কি বাইশটির কথা বলিতেছেন না। “বহু” অবতারের কথা বলিতেছেন। ভাগবতের “অসংখ্যেয়” এবং এই “বহু” শব্দ একার্থবাচক সন্দেহ নাই।

অজোহপি সন্নব্যয়াত্মা ভূতানামীশ্বরোহপি সন্।
প্রকৃতিং স্বামধিষ্ঠায় সম্ভবাম্যাত্মমায়য়া || ৬ ||

আমি অজ; আমি অব্যয়াত্মা; সর্ব্বভূতের ঈশ্বর; তাহা হইয়াও আপন প্রকৃতি বশীকৃত করিয়া আপন মায়ায় জন্মগ্রহণ করি। ৬।

অজ-জন্মরহিত।

অব্যয়াত্মা-যাঁহার জ্ঞানশক্তির ক্ষয় নাই (শঙ্কর)।

ঈশ্বর-কর্ম্মপারতন্ত্র্য-রহিত (শ্রীধর)।

প্রকৃতি-ত্রিগুণাত্মিকা মায়া, সর্ব্বজগৎ যাহার বশীভূত।

এতদ্ব্যতীত মূলে যে “অধিষ্ঠায়” শব্দ আছে, শঙ্করাচার্য্য তাহার অর্থ “বশীকৃত্য” লিখিয়াছেন, কিন্তু শ্রীধর স্বামী “স্বীকৃত্য” লিখিয়াছেন। শঙ্করকৃত ব্যাখ্যা অধিকতর সঙ্গত বলিয়া গ্রহণ করা গিয়াছে।

স্থূল কথা এই যে, ভগবানের কথায় এই আপত্তি হইতে পারে, যিনি জন্মরহিত, তাঁহার জন্ম হইল কি প্রকারে? জ্ঞানে মোক্ষ;-যাঁহার জ্ঞান অক্ষয়, তাঁহার জন্ম হইবে কেন? জন্ম কর্ম্মাধীন,-যিনি ঈশ্বর, এ জন্য কর্ম্মের অনধীন, তাঁহার জন্ম কেন?

উত্তরে ভগবান্ যাহা বলিয়াছেন, শঙ্করাচার্য্য তাহার এইরূপ অর্থ করিয়াছেন। আমার যে স্বপ্রকৃতি, অর্থাৎ সত্ত্বরজস্তম ইতি ত্রিগুণাত্মিকা বৈষ্ণবী মায়া, সমস্ত জগৎ যাহার বশে আছে, যদ্দ্বারা মোহিত হইয়া আমাকে বাসুদেব বলিয়া জানিতে পারে না, সেই প্রকৃতিকে বশীভূত করিয়া আমি জন্মগ্রহণ করি। আপনার মায়ায়-কি না, সাধারণ লোক যেমন পরমার্থনিবন্ধন জন্মগ্রহণ করে, এ সেরূপ নহে।

শ্রীধর স্বামী একটু ভিন্ন প্রকার অর্থ করিয়াছেন। তিনি বলেন, ভগবান্ বলিতেছেন যে, আমি আপনার শুদ্ধসত্ত্বাত্মিকা প্রভৃতি স্বীকার করিয়া, বিশুদ্ধ উজ্জ্বল সত্ত্বমূর্ত্তির দ্বারা স্বেচ্ছাক্রমে অবতীর্ণ হই।

কথাগুলি বড় জটিল। পাঠকের বুঝিবার সাহায্যার্থ দুই একটি কথা বলা উচিত।

“মায়া” ঈশ্বরের একটি শক্তি। এই মায়া, হিন্দুদিগের ঈশ্বরতত্ত্বে, বিশেষতঃ উপনিষদে ও দর্শনশাস্ত্রে অতি প্রধান স্থান প্রাপ্ত হইয়াছে। সাধারণতঃ বেদান্তে মায়া কিরূপে পরিচিত হইয়াছে, তাহা অনুসন্ধান করিবার আমাদের প্রয়োজন নাই। এই গীতাতেই মায়া কিরূপ বুঝান হইয়াছে, তাহাই বুঝাইতেছি। পাঠকের স্মরণ থাকিতে পারে যে, তৃতীয় অধ্যায়ের ৪২ শ্লোকের টীকায় আমরা গীতার সপ্তম অধ্যায় হইতে এই শ্লোকটি উদ্ধৃত করিয়াছিলাম,-

ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।
অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা || ৪ ||

ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, আমার ভিন্ন ভিন্ন অষ্ট প্রকার প্রকৃতি। ৪। ইহা বলিয়াই বলিতেছেন-

অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাং।
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদাং ধার্য্যতে জগৎ || ৫ ||

ইহা আমার অপরা বা নিকৃষ্টা প্রকৃতি; আমার পরা বা উৎকৃষ্ট প্রকৃতিও জান। ইনি জীবভূতা, এবং ইনি জগৎ ধারণ করিয়া আছেন। ৫।

তবে ঈশ্বরের যে শক্তি জীবস্বরূপা, এবং যাহা জগৎকে ধারণ করিয়া আছে, তাহাই তাঁহার পরা প্রকৃতি বা মায়া। আপনার জীবস্বরুপা এই শক্তিতে ভগবান্ জীবসৃষ্টি করিয়াছেন, সেই শক্তিকে বশীভূত করিয়া আপনার স্বত্বকে জীবরূপী করিতে পারেন।

ঈশ্বর শরীর ধারণপূর্ব্বক অবতীর্ণ হইতে পারেন না, ইহার বিচার নিষ্প্রয়োজন; কেন না, তিনি ইচ্ছাময় ও সর্ব্বশক্তিমান্,-পারেন না, এমন কথা বলিলে তাঁহার শক্তির সীমা নির্দ্দেশ করা হয়। ঈশ্বর শরীরী হইয়া অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব কি না, সে স্বতন্ত্র কথা। তাহার বিচার আমি গ্রন্থান্তরে78 যথাসাধ্য করিয়াছি-পুনরুক্তির প্রয়োজন নাই। আর শরীর ধারণপূর্ব্বক ঈশ্বর অবতীর্ণ হওয়ার কোন প্রয়োজন আছে কি না, ভগবান্ নিজেই পরশ্লোকদ্বয়ে তাহা বলিতেছেন।

যদা যদা হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভিবতি ভারত।
অভ্যুত্থানধর্ম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্ || ৭ ||
পরিত্রাণায় সাধূনাম্ বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে || ৮ ||

যে যে সময়ে ধর্ম্মের ক্ষীণতা এবং অধর্ম্মের অভ্যুত্থান হয়, আমি সেই সেই সময়ে আপনাকে সৃজন করি। ৭।

সাধুগণের পরিত্রাণহেতু, দুষ্কৃতকারীদিগের বিনাশার্থ এবং ধর্ম্মসংস্থাপনার্থ আমি যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করি 79। ৮।

জন্ম কর্ম্ম চ মে দিব্যমেবং যো বেত্তি তত্ত্বতঃ।
ত্যক্ত্বা দেহং পুনর্জন্ম নৈতি মামেতি সোহর্জ্জুন || ৯ ||

হে অর্জ্জুন! আমার জন্ম কর্ম্ম দিব্য। ইহা যে তত্ত্বত্বঃ জ্ঞাত হয়, সে পুনর্জ্জন্ম প্রাপ্ত হয় না,-আমাকে প্রাপ্ত হয়। ৯।

দিব্য অর্থে “অপ্রাকৃত”, “ঐশ্বর” বা “অলৌকিক”।

ভগবানের মানবিক জন্ম কর্ম্ম তত্ত্বতঃ জানিলে মোক্ষলাভ হইবে কেন? আমি কৃষ্ণচরিত্রবিষয়ক গ্রন্থে এইরূপ বুঝাইয়াছি যে, মনুষ্যত্বের আদর্শ প্রকাশের জন্য ভগবানের মানবদেহ ধারণ। অন্য উদ্দেশ্য সম্ভবে না। আদর্শ মনুষ্য, আদর্শ কর্ম্মী। অতএব কর্ম্মযোগীর পক্ষে আদর্শ কর্ম্মীর কর্ম্ম তত্ত্বতঃ বুঝা আবশ্যক। তদ্ব্যতীত কর্ম্মযোগ অন্ধকারে লোষ্ট্রক্ষেপ। যদি ইহা না স্বীকার করা যায়, তবে কর্ম্মযোগ কথনকালে এই অবতারতত্ত্ব উত্থাপনের কোনও প্রয়োজন দেখা যায় না। যিনি ভগবানের আদর্শকর্ম্মিত্ব বুঝিতে চেষ্টা করিবেন, তিনি কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থ বিস্তারশঃ পাঠ করিলে বুঝিতে পারিবেন। আর একটা অর্থ না হয়, এমন নহে। যাহাকে দার্শনিকেরা জ্ঞানমার্গ কহেন, তাহার অর্থ এইরূপ প্রসিদ্ধ, ব্রহ্মজ্ঞানই মুক্তির পথ। ব্রহ্মকে জানিতে হইবে, কিন্তু ব্রহ্ম কি? ব্রহ্ম নিরাকার, নিরঞ্জন, অপরিচ্ছিন্ন নিত্য, শুদ্ধমুক্ত, সত্য, জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ। এই ব্রহ্মকে জানিলেই মুক্তিলাভ হয়। কিন্তু অবতীর্ণ এবং শরীরবিশিষ্ট যে ঈশ্বর, তাঁহাকে নিরাকার ইত্যাদি বলা যাইতে পারে না। তবে কি অবতীর্ণ এবং শরীরবিশিষ্ট ঈশ্বরের জ্ঞানে কোনও ফলোদয় নাই, তাঁহার উপাসনায় মুক্তির সম্ভাবনা নাই? এই শ্লোকে সে সংশয় নিরাকৃত হইতেছে। অবতীর্ণ এবং শরীরী ঈশ্বরের দিব্য জন্ম কর্ম্ম তত্ত্বতঃ জানিলেও মুক্তিলাভ হইতে পারে। কিন্তু তত্ত্বতঃ জানিতে হইবে। যাহাকে তাহাকে ঈশ্বরের অবতার বলিয়া জানিলে সে লাভ নাই।

বীতরাগভয়ক্রোধা মন্ময়া মামুপাশ্রিতাঃ।
বহবো জ্ঞানতপসা পূতা মদ্ভাবমাগতাঃ || ১০ ||

বীতরাগভয়ক্রোধ, মন্ময়, আমাতে উপাশ্রিত, জ্ঞানতপস্যার দ্বারা পূত অনেকে মদ্ভাবগত হইয়াছে। ১০।

প্রথমে কথার অর্থ। রাগ-অনুরাগ। মন্ময়-ব্রহ্মবিৎ, ঈশ্বরভেদজ্ঞানরহিত। আমাতে উপাশ্রিত। শঙ্কর বলেন, কেবল জ্ঞাননিষ্ঠ; শ্রীধর বলেন, মৎপ্রসাদলব্ধ মদ্ভাবগত, ঈশ্বরভাবগত, মোক্ষপ্রাপ্ত।

ভাষ্যকারেরা বলেন যে, এ কথা এখানে বলিবার কারণ এই যে, আমাতে ভক্তিবাদ এই নূতন প্রচারিত হইতেছে না। পূর্ব্বেও অনেকে ঈদৃশ জ্ঞানতপের দ্বারা মোক্ষলাভ করিয়াছেন। তাহাই বটে, কিন্তু বেশীর ভাগ এইটুকু বুঝা কর্ত্তব্য যে, যাঁহারা আদর্শ কর্ম্মীর কর্ম্মের মর্ম্ম বুঝিয়া কর্ম্ম করিয়াছেন, তাঁহাদেরই কথা হইতেছে। পরবর্ত্তী পঞ্চদশ শ্লোক পাঠ করিলেই ইহা বুঝা যাইবে। ইহা বুঝিতে না পারিলে কর্ম্মযোগের সঙ্গে এই সকল কথার কোনও সম্বন্ধ দেখিতে পাওয়া যাইবে না।

নিষ্কাম কর্ম্মের পক্ষে রাগভয়ক্রোধ থাকিবে না, ঈশ্বরে অভেদ জ্ঞান থাকিবে, এবং জ্ঞান ও তপের (Spiritual culture) দ্বারা চরিত্র বিশুদ্ধীকৃত হইবে। ইহা না হইলে কর্ম্ম নিষ্কাম হইবে না।

সকলেই নিষ্কামকর্ম্মী হইতে পারে না। যাহারা সকাম কর্ম্ম করে, তাহাদের কর্ম্মের কি কোন ফল নাই? ঈশ্বর সকল কর্ম্মের ফলবিধাতা। ইহা পরবর্ত্তী দুই শ্লোকে কথিত হইতেছে।-

যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।
মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ || ১১ ||

যে আমাকে যে ভাবে উপাসনা করে, আমি তাহাকে সেই ভাবেই তুষ্ট করি। মনুষ্য সর্ব্বপ্রকারে আমার পথের অনুবর্ত্তী হয়। ১১।

অগ্রে প্রথম চরণ বুঝা যাউক। অর্জ্জুন বলিতে পারেন, “প্রভো! আসল কথাটা কি, তা ত এখনও বুঝাও নাই। নিষ্কাম কর্ম্মেই তোমাকে পাইব, আর সকাম কর্ম্মে কিছু পাইব না কি? সেগুলো কি পণ্ডশ্রম?” ভগবান্ এই সংশয়চ্ছেদ করিতেছেন। সকলেই একই প্রকার চিত্তভাবের অধীন হইয়া আমার উপাসনা করে না। যে যে-ভাবে আমার উপাসনা করে, তাহাকে সেইরুপ ফল দান করি।যে যাহা কামনা করিয়া আমার উপসনা করে, তাহার সেই কামনা পূর্ণ করি। যে কোনও কামনা করে না,-অর্থাৎ যে নিষ্কাম, সে আমায় পায়। কামনাভাবে তাহার কামনা পূর্ণ হয় না, কিন্তু সে আমায় পায়।

তার পর দ্বিতীয় চরণ। “মনুষ্য সর্ব্বপ্রকারে আমার পথের অনুবর্ত্তী হয়,” এ কথার অর্থ সহসা এই বোধ হয় যে, “আমি যে পথে চলি, মানুষ সর্ব্বপ্রকারে সেই পথে চলে।” এখানে সে অর্থ নহে-গীতাকারের “Idiom” ঠিক আমাদের “Idiom” সঙ্গে মিলিবে, এমন প্রত্যাশা করা যায় না। এ চরণের অর্থ এই যে, “উপাসনার বিষয়ে মনুষ্য যে পথই অবলম্বন করুক না, আমি যে পথে আছি, সেই পথেই মানুষকে আসিতে হইবে।” “মানুষ যে-দেবতারই পূজা করুক না কেন, সে আমারই পূজা করা হইবে; কেন না, এক ভিন্ন দেবতা নাই। আমিই সর্ব্বদেব-অন্য দেবের পূজার ফল আমিই কামনানুরূপ দিই। এমন কি, যদি মানুষ দেবোপাসনা না করিয়া কেবল ইন্দ্রিয়াদির সেবা করে, তবে সেও আমার সেবা। কেন না, জগতে আমি ছাড়া কিছু নাই-ইন্দ্রিয়াদিও আমি, আমিই ইন্দ্রিয়াদিস্বরূপে ইন্দ্রিয়াদির ফল দিই। ইহা নিকৃষ্ট ও দুঃখময় ফল বটে, কিন্তু যেমন উপাসনা ও কামনা, তদনুরূপ ফল দান করি।”

পৃথিবীর বহুবিধ উপাসনাপদ্ধতি প্রচলিত আছে। কেহ নিরাকারের, কেহ সাকারের উপাসনা করেন। কেহ একমাত্র জগদীশ্বরের, কেহ বহু দেবতার উপাসনা করেন; কোনও জাতি ভূতযোনির, কোন জাতি বা পিতৃলোকের, কেহ বা সজীবের, কেহ নির্জীবের, কেহ মনুষ্যের, কেহ গবাদি পশুর, কেহ বা বৃক্ষের প্রস্তরখণ্ডের উপাসনা করে। এই সকলই উপাসনা; কিন্তু ইহার মধ্যে উৎকর্ষাপকর্ষ আছে, অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে। কিন্তু সে উৎকর্ষাপকর্ষ কেবল উপাসকের জ্ঞানের পরিমাণ মাত্র। যে নিতান্ত অজ্ঞ, সে পথিপার্শ্বে পুষ্পচন্দনসিন্দুরাক্ত শিলাখণ্ড দেখিয়া, তাহাতে আবার পুষ্পচন্দন সিন্দুর লেপিয়া যায়; যে কিঞ্চিৎ জানিয়াছে, সে না হয়, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক। কিন্তু ঈশ্বরের প্রকৃতির ঈশ্বরের পরিমাণজ্ঞান সম্বন্ধে দুই জনেই প্রায় তুল্য অন্ধ। যে হিমালয় পর্ব্বতকে বল্মীক-পরিমিত মনে করে, আর যে তাহাতে বপ্রপরিমিত মনে করে, এ উভয়ে সমান অন্ধ। ব্রহ্মবাদীও ঈশ্বরস্বরূপ অবগত নহেন-শিলাখণ্ডের উপাসকও নহে। তবে একজনের উপাসনা ঈশ্বরের নিকট গ্রাহ্য, আর একজনের অগ্রাহ্য, ইহা কি প্রকারে বলা যাইবে? হয় কাহারও উপাসনা ঈশ্বরের গ্রাহ্য নহে, নয় সকল উপাসনাই গ্রাহ্য। স্থূল কথা, উপাসনা আমাদিগের চিত্তবৃত্তির, আমাদের জীবনের পবিত্রতা সাধন জন্য-ঈশ্বরের তুষ্টিসাধন জন্য নহে। যিনি অনন্ত আনন্দময়, যিনি তুষ্ট অতুষ্টির অতীত, উপাসনা দ্বারা আমরা তাঁহার তুষ্টিবিধান করিতে পারি না। তবে ইহা যদি সত্য হয় যে, তিনি বিচারক-কেন না, কর্ম্মের ফলবিধাতা-তবে যাহা তাঁহার বিশুদ্ধ স্বভাবের অনুমোদিত, সেই উপাসনাই তাঁহার গ্রাহ্য হইতে পারে। যে উপাসনা কপট, কেবল লোকের কাছে ধার্ম্মিক বলিয়া প্রতিষ্ঠালাভের উপায়স্বরূপ, তাহা তাঁহার গ্রাহ্য নহে-কেন না, তিনি অন্তর্যামী। আর যে উপাসনা আন্তরিক, তাহা ভ্রান্ত হইলেও তাঁহার কাছে গ্রাহ্য। যিনি নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক বা তপশ্চারী, তাঁহার উপাসনা যদি কেবল লোকের কাছে পসার করিবার জন্য হয়, তাহার অপেক্ষা যে অভাগী পুত্রের মঙ্গল কামনায় ষষ্ঠীতলায় মাথা কুটে, তাহার উপাসনাই অধিক পরিমাণে ভগবানের গ্রাহ্য বলিয়া বোধ হয়।

এই শ্লোকের তাৎপর্য্য বুঝিলে, পৃথিবীতে আর ধর্ম্মগত পার্থক্য থাকে না;-হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টীয়ান, জৈন, নিরাকারবাদী, সাকারবাদী, বহুদেবোপাসক, জড়োপাসক, সকলেই সেই এক ঈশ্বরের উপাসক-যে পথে তিনি আছেন, সেই পথে সকলেই যায়। এই শ্লোকোক্ত ধর্ম্মই জগতে একমাত্র অসাম্প্রদায়িক ধর্ম্ম। এক মাত্র সর্ব্বজনাবলম্বীয় ধর্ম্ম। ইহাও প্রকৃত হিন্দুধর্ম্ম। হিন্দুধর্ম্মের তুল্য উদার ধর্ম্ম আর নাই-আর এই শ্লোকের তুল্য উদার মহাবাক্যও আর নাই।

কাঙ্ক্ষতঃ কর্ম্মণাং সিদ্ধিং যজন্ত ইহ দেবতাঃ।
ক্ষিপ্রং হি মানুষে লোকে সিদ্ধির্ভবতি কর্ম্মজা ||১২ ||

ইহলোকে যাহারা কর্ম্মসিদ্ধি কামনা করে, তাহারা দেবগণের আরাধনা করে। এবং শীঘ্র মনুষ্যলোকেই তাহাদের কর্ম্মসিদ্ধি হয়। ১২।

অর্থাৎ সচরাচর মনুষ্য কর্ম্মফল কামনা করিয়া দেবগণের আরাধনা করে এবং ইহলোকেই সেই অভিলষিত ফল প্রাপ্ত হয়।

সে ফল সামান্য। নিষ্কাম কর্ম্মের ফল অতি মহৎ। তবে মহৎ ফলের আশা না করিয়া, লোকে সামান্য ফলের চেষ্টা করে কেন? মনুষ্যের স্বভাব যে, যে-সুখ শীঘ্র পাওয়া যাইবে, তাহা ক্ষুদ্র হইলেও তাহারই চেষ্টা করে।

চাতুর্ব্বর্ণ্যন ময়া সৃষ্টং গুণকর্ম্মবিভাগশঃ।
তস্য কর্ত্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্ত্তারমব্যয়ম্ || ১৩ ||

গুণ ও কর্ম্মের বিভাগ অনুসারে আমি চারি বর্ণ সৃষ্টি করিয়াছি বটে, কিন্তু আমি তাহার (সৃষ্টি)কর্ত্তা হইলেও আমাকে অকর্ত্তা ও বিকার-রহিত জানিও। ১৩।

হিন্দুশাস্ত্রের সাধারণ উক্তি এই যে ব্রাহ্মণবর্ণ সৃষ্টিকর্ত্তার মুখ হইতে, ক্ষত্রিয় বাহু হইতে, বৈশ্য ঊরু হইতে এবং শূদ্র চরণ হইতে সৃষ্ট হয়। কিন্তু গুণকর্ম্মবিভাগশঃ চাতুর্ব্বর্ণ্য সৃষ্ট হইয়াছে, এই কথা হিন্দুশাস্ত্রের কথিত সাধারণ উক্তির সঙ্গে আপাততঃ সঙ্গত বোধ হয় না। নানা কারণে এ কথাটার বিস্তারিত বিচার আবশ্যক।

প্রথমতঃ দেখা যায়, হিন্দুশাস্ত্রের কথিত সাধারণ উক্তির আদি বিখ্যাত পুরুষসূক্তে।

ঋগ্বেদসংহিতার দশম মণ্ডলের নবতিতম সূক্তকে পুরুষসূক্ত কহে। উহার প্রথম ঋক্ “সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ” ইত্যাদি ব্রাহ্মণগণ আজিও বিষ্ণুপূজাকালে প্রয়োগ করিয়া থাকেন। পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতগণ-যাঁহারা প্রতিপন্ন করিতে চাহেন যে, বৈদিক কালে জাতিভেদ ছিল না-তাঁহারা বলেন যে, এই সূক্ত আধুনিক। আমাদের সে বিচারে প্রয়োজন নাই। বৈদিক সূক্ত সবই অতি প্রাচীন, ইহা কোন মতেই অস্বীকার করা যায় না। আমার বলিবার কথা, ঐ সূক্তে যাহা তাহাতে ঠিক এমন বুঝায় না যে, মুখ হইতে ব্রাহ্মণ উৎপন্ন হইয়াছে, বাহু হইতে ক্ষত্রিয় উৎপন্ন হইয়াছে, ইত্যাদি। সেই ঋক্‌গুলি উদ্ধৃত করিতেছি-

“ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্বাহু রাজন্যঃ কৃতঃ।
ঊরু তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রোহজায়ত ||”

শূদ্রের সম্বন্ধে “অজায়ত” বলা হইয়াছে বটে, কিন্তু ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে যে, ব্রাহ্মণ সেই পুরুষের মুখ হইলেন এবং ক্ষত্রিয় বাহু (কৃত) হইলেন।80 বৈশ্য সম্বন্ধেও বলা হইয়াছে যে, ইঁহার ঊরুই বৈশ্য।

বেদের মধ্যে কেবল তৈত্তিরীয় সংহিতায় পাওয়া যায় যে, প্রজাপতি মুখ হইতে ব্রাহ্মণ, বাহু হইতে ক্ষত্রিয়, মধ্যভাগ হইতে (মধ্যতঃ) বৈশ্য, এবং চরণ হইতে শূদ্র সৃষ্টি করিলেন।

কিন্তু বেদের অন্যান্য ভাগে, চাতুর্ব্বর্ণ্যের সৃষ্টি অন্য প্রকার কথিত হইয়াছে। শতপথব্রাহ্মণে কথিত হইয়াছে, যথা-

“ভূরিতি বৈ প্রজাপতির্বহ্ম অজনয়ত। ভুব ইতি ক্ষত্রং স্বরিতি বিশম্।” শূদ্রের কথা নাই।81

পুনশ্চ তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে-

“ঋগ্‌ভ্যো জাতং বৈশ্যং বর্ণমাহুঃ যজুর্ব্বেদং ক্ষত্রিয়স্যাহুর্যানিম্। সামবেদো ব্রাহ্মণানাং প্রসূতিঃ।82 অর্থাৎ সামবেদ হইতে ব্রাহ্মণের, যজুর্ব্বেদ হইতে ক্ষত্রিয়ের এবং ঋগ্বেদ হইতে বৈশ্যের জন্ম। এখানেও শূদ্রের কথা নাই।

উদাহরণস্বরূপ এই মতগুলি উদ্ধৃত করা গেল। এমন আরও অনেক আছে। সকল উদ্ধৃত করিতে গেলে পাঠকের বিরক্তিকর হইবে। স্থূল কথা, হিন্দুশাস্ত্রে চাতুর্ব্বর্ণ্য উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা প্রকার মত আছে। শ্রীকৃষ্ণও তাহা বলিতেছেন, তাহাও সাধারণ মত হইতে ভিন্ন বলিয়া আপাততঃ বোধ হইতে পারে। তিনি বলেন না যে, আমি আমার অঙ্গবিশেষ হইতে বর্ণবিশেষ সৃষ্টি করিয়াছি। তিনি বলেন, গুণকর্ম্মের বিভাগানুসারে করিয়াছি। প্রথমে দেখা যাউক, গুণ কাহাকে বলে।

সত্ত্বরজস্তম এই তিন গুণ। ভাষ্যকারেরা বলেন, সত্ত্বপ্রধান ব্রাহ্মণ, তাহাদিগের কর্ম্ম শমদমাদি; সত্ত্বরজঃপ্রধান ক্ষত্রিয়, তাহাদিগের কর্ম্ম শৌর্য্য যুদ্ধাদি; রজস্তমঃপ্রধান বৈশ্য, তাহাদিগের কর্ম্ম কৃষিবাণিজ্যাদি; তমঃপ্রধান শূদ্র, তাহাদিগের কর্ম্ম অন্য তিন বর্ণের সেবা। এইরূপ গুণকর্ম্মের বিভাগ অনুসারে সৃষ্টি করিয়াছি, ইহাই ভগবদভিপ্রায়।

এক্ষণে যে জন্মিবে, সে গর্ভে জন্মিবার পূর্ব্বেই সত্ত্বগুণাধিক্য, রজোগুণাধিক্য বা তমোগুণাধিক্য ইত্যাদি প্রকৃতি সৃষ্টি হয়?

যিনি বলিবেন যে, আগে জীবের জন্ম, তার পর তাহার সত্ত্বপ্রধানাদি স্বভাব, তাঁহাকে অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে যে, মনুষ্যের বংশানুসারে নহে, গুণানুসারে তাহার ব্রাহ্মণত্বাদি। ব্রাহ্মণের পুত্র হইলেই তাহাকে ব্রাহ্মণ হইতে হইবে, এমন নহে; সত্ত্বগুণপ্রধান স্বভাব হইলে শূদ্রের পুত্র হইলেও ব্রাহ্মণ হইবে এবং ব্রাহ্মণের পুত্রের তমোগুণপ্রধান স্বভাব হইলে সে শূদ্র হইবে, ভগবদ্বাক্য হইতে ইহাই সহজ উপলব্ধি।

আমি যে একটা নূতন মত নিজে গড়িয়া প্রচার করিতেছি, তাহা নহে। প্রাচীন কালে, শঙ্কর শ্রীধরের অনেক পূর্ব্বে প্রাচীন ঋষিগণও এই মত প্রচার করিয়াছিলেন। ধর্ম্মতত্ত্বে তাহার কিছু প্রমাণ উদ্ধৃত করিয়াছি, যথা-

ক্ষান্তং দান্তং জিতক্রোধং জিতাত্মানং জিতেন্দ্রিয়ম্।
তমেব ব্রাহ্মণং মন্যে শেষাঃ শূদ্রা ইতি স্মৃতাঃ ||

পুনশ্চ-

অগ্নিহোত্রব্রতপরান্ স্বধ্যায়নিরতান্ শুচীন্।
উপবাসরতান্ দান্তাংস্তান্ দেবা ব্রাহ্মণান্ বিদুঃ ||
ন জাতিঃ পূজ্যতে রাজন্ গুণাঃ কল্যাণকারকাঃ।
চণ্ডালমপি বৃত্তস্থং তং দেবা ব্রাহ্মণং বিদুঃ ||
গৌতমসংহিতা।

ক্ষমাবান্, দমশীল, জিতক্রোধ, এবং জিতাত্মা জিতেন্দ্রিয়কেই ব্রাহ্মণ বলিতে হইবে, আর সকলে শূদ্র। যাহারা অগ্নিহোত্রব্রতপর, স্বাধ্যায়নিরত, শুচি, উপবাসরত, দান্ত, দেবতারা তাঁহাদিগকেই ব্রাহ্মণ বলিয়া জানেন। হে রাজন্‌! জাতি পূজ্য নহে, গুণই কল্যাণকারক। চণ্ডালও বৃত্তস্থ হইলে দেবতারা তাহাকে ব্রাহ্মণ বলিয়া জানেন।

পুনশ্চ, মহাভারতের বনপর্ব্বে মার্কণ্ডেয়সমস্যাপর্ব্বাধ্যায়ে ২১৫ অধ্যায়ে ঋষিবাক্য আছে, “পাতিত্যজনক কুক্রিয়াসক্ত, দাম্ভিক ব্রাহ্মণ প্রাজ্ঞ হইলেও শূদ্রসদৃশ হয়, আর যে শূদ্র সত্য, দম ও ধর্ম্মে সতত অনুরক্ত, তাহাকে আমি ব্রাহ্মণ বিবেচনা করি। কারণ, ব্যবহারেই ব্রাহ্মণ হয়।” পুনশ্চ বনপর্ব্বে অজগরপর্ব্বাধ্যায়ে ১৮০ অধ্যায়ে রাজর্ষি নহুষ বলিতেছেন, “বেদমূলক সত্য, দান, ক্ষমা, আনৃশংস্য, অহিংসা ও করুণা শূদ্রেও লক্ষিত হইতেছে। যদ্যপি সত্যাদি ব্রাহ্মণধর্ম্ম শূদ্রেও লক্ষিত হইল, তবে শূদ্রও ব্রাহ্মণ হইতে পারে।” তদুত্তরে যুধিষ্ঠির বলিতেছেন, “অনেক শূদ্রে ব্রাহ্মণলক্ষণ ও অনেক দ্বিজাতিতেও শূদ্রলক্ষণ লক্ষিত হইয়া থাকে, অতএব শূদ্রবংশ হইলেই যে শূদ্র হয়, এবং ব্রাহ্মণবংশ হইলেই যে ব্রাহ্মণ হয়, এরূপ নহে। কিন্তু সে সকল ব্যক্তিতে বৈদিক ব্যবহার লক্ষিত হয়, তাহারাই ব্রাহ্মণ, এবং যে সকল ব্যক্তিতে লক্ষিত না হয়, তাহারাই শূদ্র।”

কিন্তু হইতেছিল নিষ্কাম ও সকাম কর্ম্মের কথা, কর্ম্মের ফলকামনার কথা,-চাতুর্ব্বর্ণ্যের কথা আসিল কেন? কথাটা বলা হইয়াছে যে, কেহ ইহকালে আশুলভ্য ফলের কামনায় দেবাদির যজনা করে, কেহ বা নিষ্কাম কর্ম্ম করিয়া থাকে। লোকের মধ্যে এরূপ বিসদৃশ আচরণ দেখা যায় কেন? তাহাদিগের প্রকৃতিভেদবশতঃ। এই প্রকৃতিভেদই চাতুর্ব্বর্ণ্য বা বর্ণভেদ। কিন্তু এই বর্ণভেদ কেন? ঈশ্বরেচ্ছা। ঈশ্বর ইহা করিয়াছেন। তবে ঈশ্বর কি কর্ম্ম করেন? করেন বৈ কি। কিন্তু এরূপ কর্ম্ম করিয়াও তিনি অকর্ত্তা। কেন না, তিনি অব্যয়। তিনি যদি অব্যয়, তবে তিনি কর্ম্মফলের অধীন হইতে পারেন না-তাঁহার সুখ দুঃখ, হ্রাস বৃদ্ধি নাই। যদি তিনি ফলের অধীন নহেন, তবে তাঁহার কৃত কর্ম্ম নিষ্কাম। তিনি নিষ্কামকর্ম্মী। মনুষ্যও সেই জন্য নিষ্কাম না হইলে ঈশ্বরে মিলিত হইতে পারে না। জীবাত্মা পরমাত্মায় লীন হওয়াই মুক্তি। কিন্তু শুদ্ধসত্ত্ব নিষ্কামস্বভাব পরমাত্মায় সকাম জীবাত্মা লীন হইতে পারে না। নিষ্কামকর্ম্মীই মুক্তির অধিকারী।

ঈশ্বর কর্ম্ম করেন, এ কথা আধুনিক বৈজ্ঞানিকদিগের শিষ্যেরা মানিবেন না। তাঁহারা বলিবেন, ঈশ্বর কর্ম্ম করেন না; যাহা হয়, তাহা তাঁহার সংস্থাপন নিয়মে (Law) নিষ্পন্ন হয়। কিন্তু সেই নিয়ম সংস্থাপনও কর্ম্ম। যাঁহারা বলিবেন, সেই সকল নিয়ম জড়ের গুণ, যদি তাঁহারা জড়কে ঈশ্বরসৃষ্ট বলিয়া স্বীকার করেন, তবে তাঁহারা ঈশ্বরের কর্ম্মকারিত্ব স্বীকার করিলেন। যাঁহারা তাহাও স্বীকার করেন না, তাঁহারা অনীশ্বরবাদী, তাঁহাদের সঙ্গে ঈশ্বরের কর্ম্মকারিত্ব সম্বন্ধে কোন বিচারই নাই।

ন মাং কর্ম্মাণি লিম্পন্তি ন মে কর্ম্মফলে স্পৃহা।
ইতি মাং ষোহভিজানাতি কর্ম্মভির্ণ স বধ্যতে || ১৪ ||

কর্ম্মসকল আমাকে লিপ্ত করে না। আমারও কর্ম্মে ফলস্পৃহা নাই। এইরূপ আমায় যে জানে, সে কর্ম্মের দ্বারা আবদ্ধ হয় না। ১৪।

ঈশ্বরের নিষ্কামকর্ম্মিত্ব না জানিলে, নিষ্কাম কর্ম্ম বুঝা যায় না। তাহা জানিলে কর্ম্ম নিষ্কাম হইবে। তাহা হইলে সকাম কর্ম্মরূপ বন্ধন হইতে অব্যাহতি পাওয়া যায়। পূর্ব্বশ্লোকের যে টীকা দেওয়া গিয়াছে, তাহাতে এ কথা পরিস্ফুট করা গিয়াছে।

এবং জ্ঞাত্বা কৃতং কর্ম্ম পূর্ব্বৈরপি মুমুক্ষুভিঃ।
কুরু কর্ম্মৈব তস্মাত্ত্বং পূর্ব্বৈঃ পূর্ব্বতমং কৃতম্ || ১৫ ||

এইরূপ জানিয়া পূর্ব্বকালের মোক্ষাভিলাষিগণ কর্ম্ম করিয়াছিলেন, তুমি পূর্ব্বগামীদিগের পূর্ব্বকাল-কৃত কর্ম্ম সকল কর। ১৫।

অর্থাৎ প্রাচীন কালে যাঁহারা মোক্ষকাম, তাঁহারা আপনাকে অকর্ত্তা জানিয়া-কর্ম্মের ফলভোগী নহি, ইহা জানিয়া কর্ম্ম করিতেন। তুমিও সেইরূপ কর্ম্ম কর।

কিং কর্ম্ম কিমকর্ম্মেতি কবয়োহপ্যত্র মোহিতাঃ।
তত্তে কর্ম্ম প্রবক্ষ্যামি যজ্‌জ্ঞাত্বা মোক্ষ্যসেহশুভাৎ || ১৬ ||

কর্ম্ম কি, অকর্ম্ম কি, পণ্ডিতেরাও তাহা বুঝিতে পারেন না। অতএব কর্ম্ম কি, তাহা তোমাকে বলিতেছি। তাহা জানিলে অশুভ হইতে মুক্ত হইবে। ১৬।

অকর্ম্ম অর্থে এখানে মন্দ কর্ম্ম নহে-অকর্ম্ম অর্থে কর্ম্মশূন্যতা।

কর্ম্মণো হ্যপি বোদ্ধব্যং বোদ্ধব্যঞ্চ বিকর্ম্মণঃ।
অকর্ম্মণশ্চ বোদ্ধব্যং গহনা কর্ম্মণো গতিঃ || ১৭ ||

কর্ম্ম কি, তাহা বুঝিতে হইবে, বিকর্ম্ম কি, তাহা বুঝিতে হইবে, এবং অকর্ম্ম কি, তাহা বুঝিতে হইব। কর্ম্মের গতি দুর্জ্ঞেয়। ১৭।

কর্ম্ম-অর্থে বিহিত কর্ম্ম, যাহা যথার্থ কর্ম্ম।

বিকর্ম্ম-অবিহিত কর্ম্ম।

অকর্ম্ম-কর্ম্মত্যাগ, কর্ম্মশূন্যতা।

কর্ম্মণ্যকর্ম্ম যঃ পশ্যেদকর্ম্মণি চ কর্ম্ম যঃ।
স বুদ্ধিমান্ মনুষ্যেষু স যুক্তঃ কৃৎস্নকর্ম্মকৃৎ || ১৮ ||

যে কর্ম্মেতেও কর্ম্মশূন্যতা দেখে, এবং অকর্ম্মেও কর্ম্ম দেখে, সেই মনুষ্যের মধ্যে বুদ্ধিমান্। সেই যোগযুক্ত, এবং সেই সর্ব্বকর্ম্মকারী। ১৮।

ভগবদারাধনা কর্ম্ম; কিন্তু তাহাতে কর্ম্মের যে বন্ধকতা, তাহা ঘটে না, এই জন্য তাহাকে কর্ম্মস্বরূপ বিবেচনা করিবে না। আর যে কর্ম্ম বিহিত, তাহা না করিলে তাহার ফলভাগী হইতে হয়, ফলভাগিত্ব মুক্তির রোধক; এ জন্য না করাকেই, অর্থাৎ অকর্ম্মকেই কর্ম্ম বিবেচনা করিবে। শ্রীধরের টীকার মর্ম্মার্থ এই। ইহাতে এ শ্লোক হইতে ইহাই পাওয়া যায় যে, ভগবদারাধনাই কর্ত্তব্য। অন্যান্য অনুষ্ঠান মুক্তির বিঘ্ন।

শঙ্করাচার্য্য অনুরূপ বুঝাইয়াছেন। তিনি এই শ্লোক উপলক্ষে একটি দীর্ঘ এবং জটিল প্রবন্ধ রচনা করিয়াছেন, তাঁহার স্থূল কথা এই-আত্মা ক্রিয়ানির্লিপ্ত; কর্ম্ম ইন্দ্রিয়াদির দ্বারাই কৃত হইয়া থাকে; কিন্তু ভ্রমক্রমেই আত্মাতে কর্ম্মারোপ হইয়া থাকে। যিনি ইহা জানেন, তিনি কর্ম্মে অকর্ম্ম দেখেন। আর ইন্দ্রিয়াদি বিহিতানুষ্ঠানে বিরত হইলেও সেই অকর্ম্মকেও তিনি ইন্দ্রিয়াদির কর্ম্ম দেখেন।

কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে, পরবর্ত্তী শ্লোকের উপর দৃষ্টি রাখিলে একটা সোজা অর্থ পাওয়া যায়। কামসঙ্কল্প-বিবর্জ্জিত, ফলকামনাশূন্য যে কর্ম্ম, সে অকর্ম্ম-কর্ম্মশূন্যতা। আর যিনি অনুষ্ঠেয় কর্ম্মে বিরত, তাঁহার কর্ত্তব্য-বিরতির ফলভাগিত্ব আছেই আছে-অতএব এখানে কর্ম্মশূন্যতাও কর্ম্ম। কেন না, ফলোৎপত্তির কারণ। যিনি ইহা বুঝিতে পারেন, তিনিই জ্ঞানী।

যস্য সর্ব্বে সমারম্ভাঃ কামসঙ্কল্পবর্জ্জিতাঃ।
জ্ঞানাগ্নিদগ্ধকর্ম্মাণং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ || ১৯ ||

যাঁহার সকল চেষ্টা কাম ও সঙ্কল্পবর্জ্জিত, এবং যাঁহার কর্ম্ম জ্ঞানাগ্নিতে দগ্ধ, তাঁহাকেই জ্ঞানিগণ পণ্ডিত বলেন। ১৯।

“কামসঙ্কল্প” এই পদের অর্থের উপর শ্লোকের গৌরব কিয়ৎপরিমাণে নির্ভর করে। শঙ্করাচার্য্যকৃত এই অর্থ,-“কামসঙ্কল্পবর্জ্জিতাঃ”, “কামৈস্তৎকারণৈশ্চ সঙ্কল্পৈবর্জ্জিতাঃ”। শ্রীধরকৃত ব্যাখ্যা এই, “কাম্যতে ইতি কামঃ। ফলং তৎসঙ্কল্পেন বর্জ্জিতাঃ। “মধুসূদন সরস্বতী বলেন, “কামঃ ফলতৃষ্ণা সঙ্কল্পোহহং করোমীতি কর্ত্তৃত্বাভিমানস্তাভ্যাং বর্জ্জিতাঃ”। এইরূপ নানা মুনির নানা মত। মধুসূদন সরস্বতীকৃত সঙ্কল্প শব্দের অর্থ আভিধানিক নহে, কিন্তু এখানে খুব সঙ্গত। শঙ্করাচার্য্যকৃত, কাম এবং তাহার কারণ সঙ্কল্প উভয়-বিবর্জ্জিত হইলে কর্ম্মে প্রবৃত্তির অভাব জন্মিবে। যে কর্ম্ম করিবার অভিলাষ রাখে, এবং ফল কামনা করে না, সে কর্ম্ম করিবে কেন? এ জন্য শঙ্করাচার্য্য নিজেই বলিয়াছেন, “মুধৈব চেষ্টামাত্রম্ অনুষ্ঠীয়ন্তে প্রবৃত্তেন চেল্লোকসংগ্রহার্থং নিবৃত্তেন জীবনযাত্রার্থং।” অর্থাৎ ঈদৃশ ব্যক্তির সমারম্ভসকল অনর্থক চেষ্টা মাত্র। প্রবৃত্তিমার্গে কেবল লোকশিক্ষার্থ, এবং নিবৃত্তিমার্গে কেবল জীবনযাত্রানির্ব্বাহার্থ। পাঠকদিগের নিকট আমার বিনীত নিবেদন যে, তাহা হইলেও কামও সঙ্কল্পবর্জ্জিত হইল না।

মধুসূদন সরস্বতীও “লোকশিক্ষার্থং” ও জীবযাত্রার্থং” কথা দুইটি রাখিয়াছেন, কিন্তু “কামসঙ্কল্পবর্জ্জিত” পদের তিনি যে ব্যাখ্যা করিয়াছেন, তাহা পাঠক নিঃসঙ্কোচে গ্রহণ করিতে পারেন। ফলতৃষ্ণা এবং অহঙ্কাররহিত যে কর্ম্মানুষ্ঠান, তাহাই বিহিত, এবং তাহাই কর্ম্মশূন্যতা।

সচরাচর লোকে ফলকামনাতেই কর্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়-এবং আমি এই কর্ম্ম করিতেছি বা করিয়াছি, এই অহঙ্কার তাহার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। ভগবদভিপ্রায় এই যে, দুইয়ের অভাবই কর্ম্মের লক্ষণ, কর্ম্মে তদুভয়ের অভাবই কর্ম্মশূন্যতা।

এইরূপ বুঝিলেই কি আপত্তির মীমাংসা হইল? হইল বৈ কি। ফলকামনাতেই লোকে সচরাচর কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয় বটে, কিন্তু ফলকামনা ব্যতীত যে কর্ম্মে প্রবৃত্ত হওয়া যায় না, এমন নহে। যদি তাই হইত, তাহা হইলে নিষ্কাম শব্দের অর্থ নাই-এমন বস্তুর অস্তিত্ব নাই। যদি তাই হইত, তাহা হইলে গীতার এক ছত্রেরও কোন মানে নাই। কথাটা পূর্ব্বে বুঝান হয় নাই। এখন বুঝান যাউক।

কতকগুলি কার্য্য আছে, যাহা মনুষ্যের অনুষ্ঠেয়। যে সে কর্ম্মের ফলকামনা করে না, তাহারও পক্ষে অনুষ্ঠেয়। এমন মনুষ্য আছে সন্দেহ নাই, যে জীবন রক্ষা কামনা করে না-মরিতে পারিলেই তাহার সব যন্ত্রণা ফুরায়। কিন্তু আত্মজীবন রক্ষা তাহার অনুষ্ঠেয়। যে শূলরোগী আত্মহত্যা করে, সে পাপ করে সন্দেহ নাই। শত্রুর জীবনরক্ষা সচরাচর কেহ কামনা করে না, কিন্তু শত্রু মজ্জনোন্মুখ বা অন্য প্রকারে মৃত্যুকবলগ্রস্তপ্রায় দেখিলে তাহার রক্ষা আমাদের অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম। শত্রুকে উদ্ধারকালে মনে হইতে পারে, “আমার চেষ্টা নিষ্ফল হইলেই ভাল।” এখানে ফলকামনা নাই, কিন্তু কর্ম্ম আছে।

তবে ইহাও বলা কর্ত্তব্য যে, নিষ্কাম কর্ম্মে ফলসিদ্ধির চেষ্টা নাই, এমন কথা বলাও যায় না, এবং গীতার সে অভিপ্রায়ও নয়। মুক্তিই যাহার উদ্দেশ্য, সে মুক্তি কামনা করে এবং মুক্তি প্রাপ্তির উপযোগী চেষ্টা করে। কাম শব্দ গীতায় বা অন্যত্র এমন অর্থে ব্যবহার হয় না যে, তাহারও ফলসিদ্ধির চেষ্টা বুঝায় না। মনে কর, স্বদেশের বা স্বজাতির হিতসাধন একটি অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম। যে স্বদেশহিতের চেষ্টা করে, সে যে স্বদেশের হিতকামনা করিয়া, সে চেষ্টা করে না, এমন কখনই হইতে পারে না। অতএব কাম শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য্য কি, তাহা বুঝা কর্ত্তব্য।

ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ, এই চারিটি অপবর্গ-পুরুষার্থ। পুরুষার্থে ইহা ভিন্ন আর কোন প্রয়োজন নাই। যাহা ধর্ম্ম, অর্থ অর্থাৎ ঐহিক ধন সৌভাগাদি এবং মোক্ষ, এই তিনের অতিরিক্ত, তাহাই কাম। এই জন্য কাম্য কর্ম্মের দ্বারা স্বর্গাদি লাভ সাধনাকে কাম শব্দে অভিহিত করা যায়। কিন্তু সেই কাম্যকর্ম্মজনিত যে সুখভোগ, সে আপনার সুখ। অতএব কামের উদ্দিষ্ট যে সুখ-তাহা নিজের সুখ-পরের মঙ্গল নহে। যে কর্ম্মের উদ্দেশ্য পরহিতাদি, তাহাই নিষ্কাম। যে কর্ম্মের উদ্দেশ্য নিজহিত, তাহা নিষ্কাম নহে।

কাম শব্দ মহাভারতের অন্যত্র বিশেষ করিয়া বুঝান আছে।

ইন্দ্রিয়াণাঞ্চ পঞ্চনাং মনসো হৃদয়স্য চ।
বিষয়ে বর্ত্তমানানাং যা প্রীতিরূপজায়তে।
স কাম ইতি মে বুদ্ধিঃ কর্ম্মণাং ফলমুত্তমম্ ||

পাঁচটি ইন্দ্রিয়, মন, এবং হৃদয়, স্ব স্ব বিষয়ে বর্ত্তমান থাকিয়া যে প্রীতি উপভোগ, আমার বিবেচনায় তাহাই কাম। তাহাই কর্ম্মের উত্তম ফল।

অতএব কাম অর্থে আত্মসুখ।

এখন সেই স্বদেশহিতৈষীর উদাহরণ মনে কর। যদি স্বদেশহিতৈষী কেবল মাত্র স্বদেশের হিতকামনা করিয়া কর্ম্ম করেন, তবে তাঁহারই কর্ম্ম নিষ্কাম। আর যদি আপনার যশ মান সম্ভ্রম উন্নতি প্রভৃতির বাসনায় স্বদেশের ইষ্টসাধনে প্রবৃত্ত হয়েন, তবে তিনি সকামকর্ম্মা।

==========================

78 কৃষ্ণচরিত্র, প্রথম খণ্ডে।

79 এই সকলের কথাও আমি কৃষ্ণচরিত্রের প্রথম খণ্ডে বিচার করিয়াছি। পুনরুক্তি অনাবশ্যক।

80 ডাক্তার হৌগ এই ঋক্ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন, “Now, according to this passage, which is the most ancient and authoritative, we have on the origin of Brahmanism, and caste in general, the Brahmana has not come from the mouth of this primary being, the Purusha, but the mouth of the latter became the Brahmanichal caste, that is to say, was transformed into it. The passage has no doubt an allegorical sense. (বেদের অনেক সূক্তে তাই) Mouth is the seat of speech. The allegory points out that the Brahmans are teachers and instructors of mankind. The arms are seat of strength. If the two arms of the Purusha are said to have been made of Kshattriya (warrior), that means, then that Kshattriya have to carry arms to defend the empire. That the thighs of the Purusha were transformed into Vaishya, that, as the lower parts of the body are the principal respository of food taken, the Vaisya caste is destined to provide food for the others.” এটুকু বড় কষ্ট কল্পনা,-ঊরুতে ডাল ভাত যায় না-কিন্তু এ সকল স্থানে উদর শব্দের প্রয়োগও হিন্দুশাস্ত্রে দেখা যায়। যথা-মহাভারতের শান্তিপর্ব্বে ৪৭ অধ্যায়ে-

“ব্রহ্ম বক্তং ভুজৌ ক্ষত্রং কৃৎস্নমূরূদরং বিশ:” তার পর, “The creation of the Sudra from the feet of the Purusha indicates that he is destined to be a servant to the others, just as the foot supports the other parts of the body as a firm support.” Dr. Haug on the origin of Brahmanism, p. 4.

Dr. Muir ও বলেন “It is indeed said that the Sudra sprang from Purusha’s feet; but as regards the three superior castes and the members with which they are repectively connected, it is not quite clear which (i.e.) the castes or the members are to be taken as subjects, and which as the predicates, and consequently, whether we are to suppose verse 12, (উদ্ধৃত ঋক্) to declare that the three castes were the three members or conversely that the three members were, or became the three castes.” Sanskrit Texts, Vol. II, p. 15, 2nd edition.

81 ২। ১। ৪। ১১ ইত্যাদি।

82 ৩। ১২। ৯। ২


© 2024 পুরনো বই