০৩. তৃতীয় অধ্যায়

অর্জ্জুন উবাচ।

জ্যায়সী চেৎ কর্ম্মণস্তে মতা বুদ্ধির্জনার্দ্দন।
তৎ কিং ঘোরে মাং নিয়োজরসি কেশব || ১ ||

হে জনার্দ্দন! যদি তোমার মতে কর্ম্ম হইতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, তবে হে কেশব! আমাকে হিংসাত্মক কর্ম্মে কেন নিযুক্ত করিতেছ? ১।

বুদ্ধি অর্থে এখানে আবার কেন জ্ঞান বুঝিতে হইতেছে। ভগবান্ অর্জ্জুনকে যুদ্ধ করিতে বলিয়াছেন, কিন্তু দ্বিতীয়াধ্যায়ের শেষ কয়েক শ্লোকে, অর্থাৎ স্থিতপ্রজ্ঞের লক্ষণে অর্জ্জুন এইরূপ বুঝিয়াছেন যে, জ্ঞান কর্ম্ম হইতে শ্রেষ্ঠ। তাই জিজ্ঞাসা করিতেছেন যে, যদি জ্ঞানই কর্ম্ম হইতে শ্রেষ্ঠ, তবে আমাকে কর্ম্মে, বিশেষ যুদ্ধের ন্যায় নিকৃষ্ট কর্ম্মে কেন নিযুক্ত করিতেছ?

অর্জ্জুনের এইরূপ সংশয় কিরূপে উপস্থিত হইল, শ্রীধর তাহা এইরূপে বুঝাইয়াছেন, “অশোচ্যনন্বশোচস্ত্বম্” (দ্বিতীয়াধ্যায়ের ১১শ শ্লোক দেখ) ইত্যাদি বাক্যের দ্বারা প্রথমে মোক্ষসাধনজন্য দেহাত্মবিবেকবুদ্ধির কথা বলিয়া, তাহার পর “এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধিঃ” ইত্যাদি বাক্যে (দ্বিতীয়াধ্যায়ের ৩৯ শ শ্লোক দেখ) কর্ম্মও কথিত হইয়াছে। কিন্তু এতদুভয় মধ্যে গুণপ্রধান ভাব স্পষ্টতঃ দেখান হয় নাই। তথা বুদ্ধিযুক্ত স্থিতপ্রজ্ঞের নিষ্ক্রিয়ত্ব, নিয়তেন্দ্রিয়ত্ব, নিরহঙ্কারত্ব ইত্যাদি লক্ষণের গুণবাদে “এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ পার্থ” (৭২ শ্লোক দেখ) সপ্রশংস উপসংহারে, বুদ্ধি ও কর্ম্ম, এতন্মধ্যে বুদ্ধির শ্রেষ্ঠত্বই ভবানের অভিপ্রায় বুঝিয়াই অর্জ্জুন এইরুপ জিজ্ঞাসা করিয়াছেন।

বস্তুতঃ দ্বিতীয়াধ্যায়ে স্পষ্টতঃ কোথাও বলেন নাই যে,কর্ম্ম হইতে জ্ঞান শ্রেষ্ঠ।তবে ৪৯ শ্লোকে কিছু গোলযোগ ঘটিয়াছে বটে, “দূরেণ হ্যবরং কর্ম্ম বুদ্ধিযোগাদ্ধনঞ্জয়।”

এখানে ভাষ্যকারেরা যে বুদ্ধি অর্থে ব্যবসায়াত্মিকা কর্ম্মযোগ বুঝাইয়াছেন, তাহাও উক্ত শ্লোকের ব্যাখ্যাকালে বুঝাইয়াছি। সেখানে এই অর্থ পরিত্যাগ করিয়া, বুদ্ধি অর্থে জ্ঞান বুঝিলে আর কোনও গোল থাকে না। নচেৎ এইখানে গোলযোগ উপস্থিত হয়, এ কথাও পূর্ব্বে বলিয়াছি। আনন্দগিরিও এই তৃতীয়ের প্রথম শ্লোকের ভাষ্যের টীকায় “দূরেণ হ্যবরং কর্ম্ম” ইত্যাদি শ্লোকটি বিশেষরূপে নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন।

যাহাই হউক জ্ঞান কর্ম্মের গুণপ্রাধান্য সম্বন্ধে দ্বিতীয়াধ্যায়ের ভগবদুক্তি যাহা আছে, তাহা কিছু “ব্যামিশ্র” (anglice ambiguous) বটে। বোধ হয়, ইচ্ছাপূর্ব্বকই ভগবান্ কথা প্রথমে পরিস্ফুট করেন নাই-এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করিয়াছিলেন। কেন না, এই প্রশ্নের উত্তর উপলক্ষে পরবর্ত্তী কয়েক অধ্যায়ে জ্ঞান-কর্ম্মের তারতম্য ও পরস্পর সম্বন্ধ বিষয়ে যে মীমাংসা হইয়াছে, ইহা মনুষ্যের অনন্ত মঙ্গলকর,এবং ইহাকে অতিমানুষে-বুদ্ধি-প্রসূত বলিয়াই স্বীকার করিতে হয়। আর কোথাও কখনও ভূমণ্ডলে এরূপ সর্ব্বমঙ্গলময় ধর্ম্ম কথিত হয় নাই।

অর্জ্জুন সেই “ব্যামিশ্র” বাক্যের কথাই বিশেষ করিয়া বলিতেছেন-

ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব মে।
তদেকং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়োহহমাপ্নুয়াম্ || ২ ||

ব্যামিশ্র (সন্দেহজনক) বাক্যের দ্বারা আমার মন মুগ্ধ করিতেছ। অতএব যাহার দ্বারা আমি শ্রেয় প্রাপ্ত হইব, সেই একই (এক প্রকার নিষ্ঠাই) আমাকে নিশ্চিত করিয়া বলিয়া দাও। ২।

শ্রীভগবানুবাচ।

লোকেহস্মিন্ দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ।
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্ম্মযোগেন যোগিনাম্ || ৩ ||

হে অনঘ! ইহলোকে দ্বিবিধা নিষ্ঠা আছে, ইহা পূর্ব্বে বলিয়াছি।অর্থাৎ সাংখ্যদিগের জ্ঞানযোগ এবং (কর্ম্ম) যোগীদিগের কর্ম্মযোগ বলিয়াছি। ৩।

এই সকল কথা একবার বুঝান হইয়াছে।পুনরুক্তির প্রয়োজন নাই।

ন কর্ম্মণামনারম্ভান্নৈষ্কর্ম্ম্যং পুরুষোহশ্নুতে।
ন চ সন্ন্যাসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি || ৪ ||

এই কর্ম্মের অনুষ্ঠানই পুরুষ নৈষ্কর্ম্ম্য প্রাপ্ত হয় না। আর কর্ম্মত্যাগই সিদ্ধি পাওয়া যায় না। ৪।

অর্জ্জুনের প্রশ্ন ছিল, যদি কর্ম্ম হইতে জ্ঞান শ্রেষ্ঠ, তবে কর্ম্মে নিয়োগ করিতেছ কেন? ভগবানের উত্তর, জ্ঞান যদি শ্রেষ্ঠই হয়, তাহা হইলে কি তোমাকে কর্ম্ম ত্যাগ করিতে বলিতে হইবে? জ্ঞাননিষ্ঠ হইলেই কি তুমি কর্ম্ম ত্যাগ করিতে পারিবে? তুমি কোন কর্ম্মের অনুষ্ঠান না করিলেই কি নৈষ্কর্ম্ম্য প্রাপ্ত হইবে? না নৈষ্কর্ম্ম্য প্রাপ্ত হইলেই সিদ্ধি প্রাপ্ত হইবে?

কর্ম্মের অনুষ্ঠানে কেন নৈষ্কর্ম্ম্য প্রাপ্ত হইবে না, তাহা ভগবান্ বলিতেছেন,-

ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্ম্মকৃৎ।
কার্য্যতে হ্যবশঃ কর্ম্ম সর্ব্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ || ৫ ||

কেহই কখনও ক্ষণমাত্র কর্ম্ম না করিয়া থাকিতে পারে না। প্রকৃতিজ গুণে সকলেই কর্ম্ম করিতে বাধ্য হয়। ৫।

হে অর্জ্জুন! তুমি বলিতেছ, জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও আমি তোমাকে কর্ম্ম করিতে বলিতেছি, কিন্তু কর্ম্ম না করিয়া থাকিতে পার কৈ? প্রকৃতি ছাড়েন কৈ? নিশ্বাস, প্রশ্বাস, অশন, শয়ন, স্নান, পান, এ সকল কর্ম্ম নয় কি? জ্ঞানমার্গাবলম্বী হইলে এ সকল ত্যাগ করা যায় কি?

জিজ্ঞাসু এখানে বলিতে পারেন যে, যে সকল কর্ম্ম প্রকৃতির বশ হইয়া করিতে হইবে তাহা ত্যাগ করা যায় না বটে; কিন্তু যে সকল কার্য্য আপনার ইচ্ছাধীন, তাহা কি জ্ঞানী বা সন্ন্যাসী পরিত্যাগ করিতে পারেন না?

ইহার সহজ উত্তর এই, অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম কেহই পরিত্যাগ করিতে পারে না। ঈশ্বরচিন্তা স্বেচ্ছাধীন কর্ম্ম, ইহা কি জ্ঞানমার্গাবলম্বী পরিত্যাগ করিতে পারে? তবে জ্ঞানের উদ্দেশ্য কি?

অনেকে বলিবেন, সাধারণতঃ যাহাকে কর্ম্ম বলে, তাহার কথা হইতেছে না। হিন্দুশাস্ত্রে শ্রৌত কর্ম্ম ও স্মার্ত্ত কর্ম্মকেই কর্ম্ম বলে। কিন্তু ইহা সত্য নহে, শ্রৌত কর্ম্ম ও স্মার্ত্ত কর্ম্ম না করিয়া কেহ ক্ষণকাল তিষ্ঠিতে পারে না এবং এই সকল স্বাভাবিক নহে যে, প্রকৃতির তাড়নায় বাধ্য হইয়া তাহা করিতে হয়। অতএব সাধারণতঃ যাহাকে কর্ম্ম বলে-যাহা কিছু করা যায়-তাহারই কথা হইতেছে বটে।ইহা আমি পূর্ব্বেও বলিয়াছে, এক্ষণেও বলিতেছি।গীতার ব্যাখ্যায় কর্ম্ম বলিলে, কর্ম্ম মাত্রই বুঝিতে হইবে; কেবল শ্রৌত স্মার্ত্ত কর্ম্ম যে ভগবানের অভিপ্রেত নহে, তাহা এই শ্লোকেই দেখা যাইতেছে।

কর্ম্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরণ্।
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে || ৬ ||

যে বিমূঢ়াত্মা, মনেতে ইন্দ্রিয়-বিষয় সকল স্মরণ রাখিয়া, কেবল কর্ম্মেন্দ্রিয় সংযত করিয়া অবস্থিতি করে, সে মিথ্যাচারী। ৬।

ভগবান্ বলিয়াছেন যে, কর্ম্মের অননুষ্ঠানেই নৈষ্কর্ম্ম পাওয়া যায় না এবং কর্ম্মত্যাগেই সিদ্ধি পাওয়া যায় না। কর্ম্মের অননুষ্ঠানে যে নৈষ্কর্ম্ম্য ঘটে না, ভগবান্ তাহার এই প্রমাণ দিলেন যে, তুমি কর্ম্মের অনুষ্ঠান না করিলেও স্বভাবগুণেই তোমাকে কর্ম্ম করিতে বাধ্য হইতে হইবে। আর কর্ম্মত্যাগেই যে সিদ্ধি ঘটে না, তাহার এই প্রমাণ দিতেছেন যে, কর্ম্মেন্দ্রিয়সকল সংযত করিয়া, “কর্ম্ম করিব না” বলিয়া বসিয়া থাকিলেও ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়সকল মনে আসিয়া উদিত হইতে পারে। তাহা হইলে সে মিথ্যাচার মাত্র। তাহাতে কোন সিদ্ধির সম্ভাবনা নাই।

যদি কর্ম্মত্যাগও করা যায় না, এবং কর্ম্মত্যাগ করিলেও সিদ্ধি নাই, তবে কর্ত্তব্য কি, তাহাই এক্ষণে কথিত হইতেছে।-

যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জ্জুন।
কর্ম্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্ম্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে || ৭ ||

হে অর্জ্জুন! যে ইন্দ্রিয়সকল মনের দ্বারা নিয়ত করিয়া, অসক্ত হইয়া কর্ম্মেন্দ্রিয়ের দ্বারা কর্ম্মযোগের অনুষ্ঠান করে, সেই শ্রেষ্ঠ। ৭।

নিয়তং কুরু কর্ম্ম ত্বং কর্ম্ম জ্যায়ো হ্যকর্ম্মণঃ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকর্ম্মণঃ || ৮ ||

তুমি নিয়ত কর্ম্ম করিবে। কর্ম্মশূন্যতা হইতে কর্ম্ম শ্রেষ্ঠ। কর্ম্মশূন্যতায় তোমার শরীরযাত্রাও নির্ব্বাহ হইতে পারে না। ৮।

“তৎ কিং কর্ম্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব!” অর্জ্জুনের এই প্রশ্নের, ভগবান্ এই উত্তর দিলেন। উত্তর এই যে, কর্ম্মত্যাগ কেহই করিতে পারে না, এবং কর্ম্ম ত্যাগ করিলেই সিদ্ধি ঘটে না। কর্ম্ম না করিলে তোমার জীবনযাত্রা নির্ব্বাহের সম্ভাবনা নাই। অতএব কর্ম্ম করিবে। তবে যদি কর্ম্ম করিতেই হইল, তবে যে প্রকারে করিলে কর্ম্ম মঙ্গলকর হয়, তাহাই করিবে। কর্ম্ম যাহাতে শ্রেয়ঃসাধক হয়, তাহার দুইটি নিয়ম কথিত হইল। প্রথম, ইন্দ্রিয়সকল66 মনের দ্বারা সংযত করিয়া; দ্বিতীয় অনাসক্ত হইয়া কর্ম্ম করিবে। তদতিরিক্ত আর একটি নিয়ম আছে; তাহাই সর্ব্বোৎকৃষ্ট ও সর্ব্বশ্রেষ্ঠ এবং কর্ম্মযোগের কেন্দ্রীভূত। তাহা পরবর্ত্তী শ্লোকে কথিত হইতেছে।

যজ্ঞার্থাৎ কর্ম্মণোহয়ং লোকোহয়ং কর্ম্মবন্ধনঃ।
তদর্থং কর্ম্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর || ৯ ||

যজ্ঞার্থ যে কর্ম্ম, তদ্ভিন্ন অন্যত্র কর্ম্ম ইহলোকে বন্ধনের কারণ। হে কৌন্তেয়! তুমি সেই জন্য (যজ্ঞার্থে) অনাসক্ত হইয়া কর্ম্মানুষ্ঠান কর। ৯।

যজ্ঞ শব্দের অর্থের উপর এই শ্লোকের ব্যাখ্যা নির্ভর করে। সচরাচর বেদোক্ত ক্রিয়াকলাপকে পূর্ব্বে যজ্ঞ বলিত, যথা-অশ্বমেধাদি। এক্ষণে সর্ব্বপ্রকার শাস্ত্রোক্ত ক্রিয়াকলাপকেই যজ্ঞ বলে।

প্রাচীন ভাষ্যকার শঙ্কর ও শ্রীধর এ অর্থ গ্রহণ করেন না। শঙ্কর বলেন,-“যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুরিতি শ্রুতের্যজ্ঞ ঈশ্বরঃ”। শ্রীধর সেই অর্থ গ্রহণ করেন। মধুসূদন সরস্বতীও এইরূপ অর্থ করেন। রামানুজ তাহা বলেন না। তিনি দ্রব্যার্জনাদিক কর্ম্মকে যজ্ঞ বলেন।

শঙ্করাদি-কথিত যজ্ঞ শব্দের অর্থ এই হয় যে, ঈশ্বরারাধনার্থ যে কর্ম্ম, তাহা ভিন্ন অন্য সকল কর্ম্ম, তাহা কেবল কর্ম্মফল ভোগের জন্য বন্ধন মাত্র। অতএব অনাসক্ত হইয়া কেবল ঈশ্বরোদ্দেশেই কর্ম্ম করিবে।

তাহা হইলে বিচার্য্য শ্লোকের অর্থ এই হয় যে, ঈশ্বরারাধনার্থ যে কর্ম্ম, তাহা ভিন্ন অন্য সকল কর্ম্ম, কর্ম্মফলভোগের বন্ধন মাত্র। অতএব কেবল ঈশ্বরারাধনার্থই কর্ম্ম করিবে।

এ স্থলে জিজ্ঞাস্য হইতে পারে, তাও কি হয়? ভগবান্‌ই স্বয়ং বলিতেছেন, নিতান্ত পক্ষে প্রকৃতিতাড়িত হইয়া এবং জীবনযাত্রা নির্ব্বাহার্থও কর্ম্ম করিতে হইবে। ঈশ্বরারাধনা কি সে সকল কর্ম্মের উদ্দেশ্য হইতে পারে? আমি জীবনযাত্রা নির্ব্বাহার্থ স্নান পান, আহার ব্যায়ামাদি করি, তাহাতে ঈশ্বরারাধনার কি সম্বন্ধ থাকিতে পারে?

এ কথা বুঝিবার আগে স্থির করিতে হয়, ঈশ্বরারাধনা কি? মনুষ্যের আরাধনা করিতে গেলে, আমরা আরাধ্য ব্যক্তির স্তবস্তুতি করি। কিন্তু ঈশ্বরকে সেরূপ তোষামোদপ্রিয় ক্ষুদ্রচেতা মনে করা যায় না। তাঁহার স্তবস্তুতি করিলে যদি আমাদের নিজের সুখ, কি চিত্তোন্নতি হয়, তবে এরূপ স্তবস্তুতি করার পক্ষে কোন আপত্তিই নাই, এবং এরূপ স্থলে ইহা অবশ্য কর্ত্তব্য। কিন্তু তাই বলিয়া ইহাকে প্রকৃত ঈশ্বরারাধনা বলা যায় না। সেইরূপ যাহাকে সাধারণতঃ “যাগযজ্ঞ” বলে, পুষ্প চন্দন, নৈবেদ্য, হোম, বলি, উৎসব, এ সকলও ঈশ্বরারাধনা নহে।

ঈশ্বরের তুষ্টিসাধন ঈশ্বরারাধনা বটে, কিন্তু তোষামোদে তাঁহার তুষ্টিসাধন হইতে পারে না। তাঁহার অভিপ্রেত কার্য্যের সম্পাদন, তাঁহার নিয়ম প্রতিপালনই তাঁহার তুষ্টিসাধন-তাহাই প্রকৃত ঈশ্বরারাধনা। এই তাঁহার অভিপ্রেত কার্য্যের সম্পাদন ও তাঁহার নিয়ম প্রতিপালন কাহাকে বলি? বিষ্ণুপুরাণে প্রহ্লাদ এক কথায় এই প্রশ্নের সুন্দর উত্তর দিয়াছেন-

“সর্ব্বত্র দৈত্যাঃ সমতামুপেত
সমত্বমারাধনমচ্যুতস্য ||”

সর্ব্বভূতে সমদৃষ্টিই প্রকৃত ঈশ্বরারাধনা; আমরা ক্রমশঃ ভূয়ো ভূয়ঃ দেখিব, গীতোক্ত ঈশ্বরারাধনাও তাই-সর্ব্বভূতে সমদৃষ্টি, সর্ব্বভূতে আত্মবৎ জ্ঞান, এবং সর্ব্বভূতের হিতসাধন।

অতএব কর্ম্মযোগীর কর্ম্মের একমাত্র উদ্দেশ্য সর্ব্বভূতের হিতসাধন।

যে কর্ম্মকর্ত্তা, সে নিজেও সর্ব্বভূতের অন্তর্গত। অতএব আত্মরক্ষাও ঈশ্বরাভিপ্রেত। জগদীশ্বর আত্মরক্ষার ভার, সকলকেই নিজের উপর দিয়াছেন। এ সকল কথা আমি সবিস্তারে ধর্ম্মতত্ত্বে বুঝাইয়াছি, পুনরুক্তির প্রয়োজন নাই।

এই নবম শ্লোকে বলা হইতেছে যে, “যজ্ঞ” (যে অর্থেই হউক) ভিন্ন অন্যত্র কর্ম্ম বন্ধন মাত্র। “বন্ধন” কি, এইটা বুঝাইতে বাকি আছে। অন্যবিধ কর্ম্ম নিষ্ফল হয় বা পাপজনক, এমন কথা বলা হইতেছে না-বলা হইতেছে, তাহা বন্ধনস্বরূপ। এই বন্ধন বুঝিতে জন্মান্তরবাদ স্মরণ করিতে হইবে। কর্ম্ম করিলেই জন্মান্তরে তাহার ফল ভোগ করিতে হইবে। কর্ম্মফল-সুফলই হউক, আর কুফলই হউক, তাহা ভোগ করিবার জন্য জীবকে জন্মান্তর গ্রহণ করিতে হইবে। যত দিন জন্মের পর জন্ম হইবে, তত দিন জীবের মুক্তি নাই। মুক্তি প্রতিবন্ধক বলিয়াই কর্ম্ম বন্ধন মাত্র।

এক্ষণে জিজ্ঞাস্য হইতে পারে,-যদি জন্মান্তর না থাকে? তাহা হইলেও গীতোক্ত নিষ্কাম কর্ম্মই কি ধর্ম্মানুমোদিত? না, নিষ্কাম কর্ম্মও যা, সকাম কর্ম্মও তা?

আমি ধর্ম্মতত্ত্বে এ কথার উত্তর দিয়াছি। নিষ্কাম কর্ম্ম ভিন্ন মনুষ্যত্ব নাই। মনুষ্যত্ব ব্যতীত ইহজন্মে বা ইহলোকে স্থায়ী সুখ নাই। অতএব গীতোক্ত এই ধর্ম্ম বিশ্বজনীন।

সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ।
অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোহস্ত্বিষ্টকামধুক্ || ১০ ||

পূর্ব্বকালে প্রজাপতি প্রজাগণের সহিত যজ্ঞের সৃষ্টি করিয়া কহিলেন, “ইহার দ্বারা তোমরা বর্দ্ধিত হইবে, ইহা তোমাদিগের অভীষ্টপ্রদ হইবে”। ১০।

এখানে ‘যজ্ঞ’ শব্দে আর ‘ঈশ্বর’ নহে বা ঈশ্বরারাধনা নহে। কেবল যজ্ঞই অর্থাৎ শ্রৌত স্মার্ত্ত কর্ম্মই যজ্ঞ; এবং পরবর্ত্তী ১২শ, ১৩শ, ‍১৪শ এবং ১৫শ শ্লোকেতে যজ্ঞ শব্দে কেবল ঐ যজ্ঞই বুঝায়। এক শ্লোকে একার্থে একটি শব্দ কোন অর্থবিশেষে ব্যবহৃত করিয়া, তাহার পরছত্রেই ভিন্নার্থে কেহ ব্যবহার করে না। এ জন্য অনেক আধুনিক পণ্ডিত নবম শ্লোকে যজ্ঞার্থে যজ্ঞই বুঝেন। কাশীনাথ ত্র্যম্বক তেলাঙ্ স্বকৃত অনুবাদে যজ্ঞার্থে sacrifice লিখিয়াছেন। তাহার পর দশম শ্লোকের টীকায় লিখিয়াছেন-“Probably the sacrifice spoken of in that passage (নবম শ্লোকে) must be taken to be the same as those referred to in this passage.”ডেবিস্ সাহেবও তৎপথাবলম্বী। শঙ্করের ভাষ্য দেখিয়াও গ্রাহ্য করেন নাই, নোটে এরূপ ভাব ব্যক্ত করিয়াছেন। এদিকে কামধুকের স্থানেKamduk লিখিয়া বসিয়াছেন! একবার নহে, বার বার!!!

এতক্ষণ ভগবান্ সকাম কর্ম্মের নিন্দা ও নিষ্কাম কর্ম্মের প্রশংসা করিতেছিলেন। কিন্তু যজ্ঞ সকাম। অতএব যজ্ঞার্থে ঈশ্বর না বুঝিলে ইহাই বুঝিতে হয়, ভগবান্ সকাম কর্ম্ম করিতে উপদেশ দিতেছেন। তাই নবমে যজ্ঞার্থে ঈশ্বর, ইহা ভগবান্ শঙ্করাচার্য্য বেদ হইতে বাহির করিয়াছেন। চতুর্ব্বেদ তাঁহার কণ্ঠস্থ।

এক্ষণে এই শ্লোকটা সম্বন্ধে একটা কথা বুঝাইবার প্রয়োজন আছে। বলা হইতেছে, প্রজাপতি যজ্ঞের সহিত সৃষ্টি করিয়াছিলেন। এমন কেহই বুঝিবেন না যে, যজ্ঞ একটা জীব বা জিনিষ; প্রজাপতি যখন মনুষ্য সৃষ্টি করিলেন, তখন তাহাকেও সৃষ্টি করিলেন। ইহার অর্থ এই যে, বেদে যজ্ঞবিধি আছে, এবং যখন প্রজাপতি প্রজা সৃষ্টি করিলেন, তখন সেই বেদও ছিল। গোঁড়া হিন্দু এইটুকুতেই সন্তুষ্ট হইবেন, কিন্তু আমার অধিকাংশ পাঠক সে শ্রেণীর লোক নহেন। আমার পাঠকেরা বলিবেন, প্রথমতঃ প্রজাসৃষ্টিই মানি না-মনুষ্য ত বানরের বিবর্ত্তন। তার পর বেদ নিত্য বা অপৌরুষেয় বা প্রজাসৃষ্টির সমসাময়িক, ইহাও মানিনা। পরিশেষে প্রজাপতি যে প্রজা সৃষ্টি যজ্ঞ সম্বন্ধে একটি বক্তৃতা করিয়া শুনাইলেন, ইহাও মানি না।

মানিবার আবশ্যকতা নাই। আমিও মানি না। শ্রীকৃষ্ণও মানিতে বলিতেছেন না। ক্রমশঃ বুঝা যাইবে। এই সকল কথার আলোচনা, আর পরবর্ত্তী কয়েকটি শ্লোকের প্রকৃত তাৎপর্য্য আমি ষোড়শ শ্লোকের পর বলিব।

পুনশ্চ লৌকিক বিশ্বাসের পর নির্ভর করিয়া বলিতেছেন,-

দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ।
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্স্যথ || ১১ ||

তোমার যজ্ঞের দ্বারা দেবতাদিগকে সংবর্দ্ধিত কর; দেবগণ তোমাদিগকে সংবর্দ্ধিত করুন। পরস্পর এইরূপ সংবর্দ্ধিত করিযা পরম শ্রেয়ঃ লাভ করিবে। ১১।

টীকায় শ্রীধর স্বামী বলেন, “তোমরা হবির্ভাগের দ্বারা দেবগণকে সংবর্দ্ধিত করিবে, দেবগণও বৃষ্ট্যাদির দ্বারা অন্নোৎপত্তি করিয়া তোমাদিগকে সংবর্দ্ধিত করিবেন”। আমরা ত অন্ন না খাইলে বাঁচি না, ইহা জানা আছে। দেবতারাও না কি যজ্ঞের ঘি খাইয়া থাকেন, খাইলে তাঁহাদের পুষ্টিসাধন হয়। বেদে এরূপ কথা আছে। থাকুক।

ইষ্টান্ ভোগান্ হি বো দেবা দাস্যতে যজ্ঞভাবিতাঃ।
তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙ্‌ক্তে স্তেন এব সঃ || ১২ ||

যজ্ঞের দ্বারা সংবর্দ্ধিত দেবগণ, যে অভীষ্ট ভোগ তোমাদিগকে দিবেন, তাঁহাদিগকে তদ্দত্ত (অন্ন) না দিয়া, যে খায়, সে চোর। ১২।

শঙ্কর ও শ্রীধর স্বামী বলেন, (বলিবার বিশেষ প্রয়োজন দেখা যায় না) “পঞ্চযজ্ঞাদিভিরদত্ত্বা”, পঞ্চযজ্ঞাদির দ্বারা না দিয়া খায়, সে চোর। পঞ্চ যজ্ঞ যথা।

অধ্যাপনং ব্রহ্মযজ্ঞঃ পিতৃযজ্ঞস্তু তর্পণম্।
হোমো দৈবো বলির্ভৌতো নৃযজ্ঞোহতিথিভোজনম্ ||

অর্থাৎ ব্রহ্মযজ্ঞ বা অধ্যাপন, পিতৃযজ্ঞ বা তর্পণ, দৈব যজ্ঞ বা হোম, ভূতযজ্ঞ বা বলি, এবং নরযজ্ঞ বা অতিথি-ভোজন। ইহা স্মরণ রাখা কর্ত্তব্য যে, শ্রীধর “পঞ্চযজ্ঞৈরদত্ত্বা” বলেন না, “পঞ্চযজ্ঞাদিভিরদত্ত্বা” বলেন।

যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্ব্বকিল্বিযৈঃ।
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ || ১৩ ||

যে সজ্জনগণ যজ্ঞাবশিষ্ট ভোজন করেন, তাঁহারা সর্ব্বপাপ হইতে মুক্ত হয়েন। যাহারা কেবল আপনার জন্য পাক করে, সেই পাপিষ্ঠেরা পাপ ভোজন করে। ১৩।

অন্নাদ্ভবন্তি ভূতানি পর্জ্জন্যাদন্নসম্ভবঃ।
যজ্ঞাদ্ভবতি পর্জ্জন্যো যজ্ঞঃ কর্ম্মসমুদ্ভবঃ || ১৪ ||

অন্ন হইতে ভূতসকল উৎপন্ন; পর্জ্জন্য হইতে অন্ন জন্মে; যজ্ঞ হইতে পর্জ্জন্য জন্মে। কর্ম্ম হইতে যজ্ঞের উৎপত্তি। ১৪।

পর্জ্জন্য একটি বৈদিক দেবতা। তিনি বৃষ্টি করেন। এখানে পর্জ্জন্য অর্থে বৃষ্টি বুঝিলেই হইবে।

অন্ন হইতে জীবের উৎপত্তি। কথাটা ঠিক বৈজ্ঞানিক না হউক, অসত্য নয় এবং বোধগম্য বলে। টীকাকারেরা বুঝাইয়াছেন, অন্ন রূপান্তরে শত্রু শোণিত হয়, তাহা হইতে জীব জন্মে। ইহাই যথেষ্ট।

তার পর বৃষ্টি হইতে অন্ন। তাহাও স্বীকার করা যাইতে পারে; কেন না, বৃষ্টি না হইলে ফসল হয় না। কিন্তু যজ্ঞ হইতে বৃষ্টি এ কথাটা বৈজ্ঞানিক স্বীকার করিবেন না। টীকাকারেরা বলেন, যজ্ঞের ধূমে মেঘ জন্মে। অন্য ধূমেও মেঘ জন্মিতে পারে। অধিকাংশ মেঘ ধূম ব্যতীত জন্মে। যে দেশে যজ্ঞ হয় না, সে দেশেও মেঘ ও বৃষ্টি হয়। সে যাহা হউক, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এ স্থলে আলোচিত হইতেছে না। তবে কি ভগবদুক্তি অসত্য ও অবৈজ্ঞানিক? ক্রমশঃ তাহাই বুঝাইতেছি।

কর্ম্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্।
তস্মাৎ সর্ব্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্ || ১৫ ||

কর্ম্ম ব্রহ্ম হইতে উদ্ভূত জানিও; ব্রহ্ম অক্ষর হইতে সমুদ্ভূত; অতএব সর্ব্বগত ব্রহ্ম নিত্য যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত। ১৫।

.

.

.(মিসিং)

.

.

তবে পাঠক বলিতে পারেন যে, যাহা তুমি ভগবদুক্তি বলিতেছ, তাহা ভ্রমশূন্য ও অসত্যশূন্য হওয়াই উচিত। অবৈজ্ঞানিক হইলে অসত্য হইল। ঈশ্বরের অসত্য কথা কি প্রকারে সম্ভবে?

কিন্তু এই সাতটি শ্লোক যে ভগবদুক্তি, তাহা আমি বলিতে পারি না। আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, গীতায় যাহা কিছু আছে, তাহাই যে ভগবদুক্তি, এমন কথা বিশ্বাস করা উচিত নহে। আমি বলিয়াছি যে, কৃষ্ণকথিত ধর্ম্ম অন্য কর্ত্তৃক সঙ্কলিত হইয়াছে। যিনি সঙ্কলন করিয়াছেন, তাঁহার নিজের মতামত অবশ্য ছিল। তিনি যে নিজ-সঙ্কলিত গ্রন্থে কোথাও নিজের মত চালান নাই, ইহা সম্ভব নহে। শ্রীধর স্বামীর ন্যায় টীকাকারও সঙ্কলনকর্ত্তা সম্বন্ধে “প্রায়শঃ শ্রীকৃষ্ণমুখাদ্বিনিঃসৃতানেব শ্লোকানলিখৎ,” ইহা বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন যে, “কাংশ্চিৎ তৎসঙ্গতয়ে স্বয়ঞ্চ ব্যরচয়ৎ।” এখানে দেখিতে পাইতেছি, কৃষ্ণোক্ত নিষ্কাম ধর্ম্মের এই সাতটি শ্লোকের বিশেষ বিরোধ। এজন্য ইহা ভগবদুক্তি নহে-সঙ্কলনকর্ত্তার মত-ইহাই আমার বিশ্বাস।

তবে ইহাও আমার বক্তব্য যে, ইহা যদি প্রকৃতপক্ষে কৃষ্ণোক্তিই হয়, তবে যে এ সকল কথা ঊনবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানসঙ্গত হওয়া উচিত ছিল, এমন বিশ্বাস আমার নাই। আমি ‘কৃষ্ণচরিত্রে’ দেখাইয়াছি যে, কৃষ্ণ মানুষী শক্তির দ্বারা পার্থিব কর্ম্মসকল নির্ব্বাহ করেন, ঐশী শক্তি দ্বারা নহে। মনুষ্যত্বের আদর্শের বিকাশ ভিন্ন, ঈশ্বরের মনুষ্যদেহ গ্রহণ করা বুঝা যায় না। কৃষ্ণ যদি মানবশরীরধারী ঈশ্বর হয়েন, তবে তাঁহার মানুষী শক্তি ভিন্ন ঐশী শক্তির দ্বারা কার্য্য করা অসম্ভব; কেন না, কোন মানুষেরই ঐশী শক্তি নাই-মানুষের আদর্শেও থাকিতে পারে না। কেবল মানুষী শক্তির ফল যে ধর্ম্মতত্ত্ব, তাহাতে তিন সহস্র বৎসর পরবর্ত্তী বৈজ্ঞানিক সত্য প্রত্যাশা করা যায় না। ঈশ্বরের তাহা অভিপ্রেত নহে।

আর এই বৈজ্ঞানিকতা সম্বন্ধে আর একটি কথা আছে। মনে কর, এখন ঈশ্বর অনুগ্রহ করিয়া নূতন ধর্ম্মতত্ত্ব প্রচার করিলেন। এখনকার লোকের বোধগম্য বিজ্ঞান অতিক্রম করিয়া, নিজের সর্ব্বজ্ঞতাপ্রভাবে আর তিন চারি হাজার বৎসর পরে বিজ্ঞান যে অবস্থায় দাঁড়াইবে, তাহার সহিত সুসঙ্গতি রাখিলেন। বিজ্ঞানের যেরূপ দ্রুতগতি, তাহাতে তিন চারি হাজার বৎসর পরে বিজ্ঞানে যে কি না করিবে, তাহা বলা যায় না। তখন হয়ত মনুষ্য, জীবন্ত মনুষ্য হাতে গড়িয়া সৃষ্টি করিবে, ইথরের তরঙ্গে চড়িয়া সপ্তর্ষিমণ্ডল68 বা রোহিণী নক্ষত্র69 বেড়াইয়া আসিবে, হিমালয়ের উপর দাঁড়াইয়া মঙ্গলাদি গ্রহ-উপগ্রহবাসী কিম্ভূতকিমাকার জীবগণের সঙ্গে কথোপকথন বা যুদ্ধ করিবে, এ বেলা ও বেলা সূর্য্যলোকে অগ্নিভোজনের নিমন্ত্রণ রাখিতে যাইবে। মনে কর, ভগবান্, সর্ব্বজ্ঞতাপ্রযুক্ত এই ভাবী বিজ্ঞানের সঙ্গে সুসঙ্গতি রাখিয়া তদুপযোগী ভাষায় নূতন ধর্ম্মতত্ত্ব প্রচার করিলেন। করিলে, শুনিবে কে? বুঝিবে কে? অনুবর্ত্তী হইবে কে? কেহ না। এই জন্য ঈশ্বরোক্তি সময়োপযোগী ভাষায় প্রচারিত হওয়া উচিত। তার পর ক্রমশঃ মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধির সঙ্গে সেই প্রাচীন কালোপযোগী ভাষার দেশ কাল পাত্রের উপযোগী ব্যাখ্যা হইতে পারে। সেই জন্যই শঙ্করাদি দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতকৃত গীতাভাষ্য থাকিতেও, আমার ন্যায় মূর্খ অভিনব ভাষ্যরচনায় সাহসী।

এই সাতটি শ্লোক যে বৈজ্ঞানিক অসত্যে কলঙ্কিত, এই প্রথম আপত্তির আমি এই তিনটি উত্তর দিলাম। দ্বিতীয় আপত্তি এই উপস্থিত হইতে পারে যে, এই সাতটি শ্লোক গীতোক্ত নিষ্কাম ধর্ম্মের বিরোধী। এ আপত্তি অতি যথার্থ। তবে এই কয়টি শ্লোক কেন এখানে আসিল, এ প্রশ্নের উত্তর শঙ্কর ও শ্রীধর যেরূপ দিয়াছেন, তাহা নবম শ্লোকের টীকায় বলিয়াছি। মধুসূদন সরস্বতী যে উত্তর দিয়াছেন, তাহা অপেক্ষাকৃত সঙ্গত বোধ হইতে পারে। পরিব্রাজক শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন সেন তাহার মর্ম্মার্থ অতি বিশদরূপে বুঝিয়াছেন, অতএব তাঁহার কৃত গীতার্থ সন্দীপনী নাম্নী টীকা হইতে ঐ অংশ উদ্ধৃত করিতেছি।

“সহযজ্ঞ” অর্থাৎ কর্ম্মাধিকারী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যকে সম্বোধন করিয়া প্রজাপতি যাহা বলিয়াছেন, তাহাতে কাম্য কর্ম্মেরই উদ্ঘোষণা হইল। কিন্তু “মা কর্ম্মফলহেতুর্ভূঃ” এই বচনে কাম্য কর্ম্মের নিষেধও করা হইয়াছে, এবং গীতাতেও কাম্য কর্ম্মের প্রসঙ্গ নাই, এজন্য ব্রহ্মার উক্তি এ স্থলে নিতান্ত অসঙ্গত বলিয়া বোধ হইতেছে; কিন্তু বিচার করিয়া দেখিলে এ আশঙ্কা বিদূরিত হইবে। “প্রজাগণ, তোমরা কামনা করিয়া ফলপ্রাপ্তির জন্য যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিও”- ব্রহ্মা এ কথা বলেন নাই। কর্ত্তব্যানুরোধে কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিবে, ইহাই ব্রহ্মার উদ্দেশ্য। কিন্তু এই কর্ম্মসাধন মধ্যে যে দিব্য শক্তি নিহিত আছে, তাহারই ঘোষণার্থ ব্রহ্মা বলিলেন, “তোমরা নিয়মিত যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিও। তাহারই অলৌকিক প্রভাবে তোমরা যখন যাহা বাসনা করিবে, তাহা সিদ্ধ হইতে থাকিবে। লোকে আম্রেরই জন্য যেমন আম্রবৃক্ষ রোপণ করে, কিন্তু ছায়া ও মুকুলের সদ্গন্ধ তাহারা বিনা চেষ্টাতেই পাইয়া থাকে, সেইরূপ কর্ত্তব্যের অনুরোধেই কর্ম্ম সাধন করিবে, কিন্তু অনুষ্ঠানের ফল কামনা না করিলেও, উহা স্বতএব প্রাপ্ত হইবে। ফলে ইচ্ছা না থাকিলেও কর্ম্মের স্বভাবগুণেই ফল উৎপন্ন হইয়া থাকে।”

আমার বোধ হয়, আমার পাঠকের নিকট শঙ্কর ও শ্রীধরের উত্তরের ন্যায়, এ উত্তরও সন্তোষজনক হইবে না। কিন্তু বিচারে বা প্রতিবাদে আমার কোন প্রয়োজন নাই। এই সাতটি শ্লোকের ভিতর একটি রহস্য আছে, দেখাইয়া দিয়া ক্ষান্ত হইব।

গীতাকার বলিতেছেন যে-

সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ।70

এই কথা গীতাকার নিজে হইতে বলেন নাই। এইরূপ বিশ্বাস প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল। মনুসংহিতায় আছে,

কর্ম্মাত্মনাঞ্চ দেবানাং সোহসৃজৎ প্রাণিনাং প্রভুঃ।
সাধ্যানাঞ্চ গণং সূক্ষ্মং যজ্ঞষ্ণ্বৈব সনাতনম্ ||
১-২২। ইত্যাদি।

যজ্ঞের দ্বারা দেবগণ পরিতুষ্ট ও প্রসন্ন হয়েন, এবং যজ্ঞকারীকে অভিমত ফল দান করেন, ইহা বৈদিক ধর্ম্মের স্থূলাংশ। ইহাই লৌকিক ধর্ম্ম।

এখন পূর্ব্বপ্রচলিত প্রাচীন লৌকিক ধর্ম্মের প্রতি ধর্ম্মসংস্কারকের কিরূপ আচরণ করা কর্ত্তব্য? এমন লৌকিক ধর্ম্মে নাই, এবং হইতেও পারে না যে, তাহাতে উপধর্ম্মের কোনও সম্বন্ধ নাই। যিনি ধর্ম্মসংস্করণে প্রবৃত্ত, তিনি সেই লৌকিক বিশ্বাসভুক্ত উপধর্ম্মের প্রতি কিরূপ আচরণ করিবেন?

কেহ কেহ বলেন, তাহার একেবারে উচ্ছেদ কর্ত্তব্য। মহম্মদ তাহাই করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার ও তাঁহার পরবর্ত্তী মহাপুরুষগণের তরবারির জোর তত বেশী না থাকিলে, তিনি কৃতকার্য্য হইতে পারিতেন না। যীশুখ্রীষ্ট নিজে যীহুদা ধর্ম্মের উপরেই আপনার প্রচারিত ধর্ম্মতত্ত্ব সংস্থাপিত করিয়াছিলেন। তার পর খ্রীষ্টীয় ধর্ম্ম যে রোমক সাম্রাজ্য হইতে প্রাচীন উপ ধর্ম্মকে একেবারে দূরীকৃত করিয়াছিল, তাহার একমাত্র কারণ এই যে, রোমক সাম্রাজ্যের প্রাচীন ধর্ম্ম তখন একেবারে জীবনশূন্য হইয়াছিল। যাহা জীবনশূন্য, তাহার মৃত দেহটা ফেলিয়া দেওয়া বড় কঠিন কাজ নহে। পক্ষান্তরে শাক্যসিংহের ধর্ম্ম, প্রাচীন ধর্ম্মের সঙ্গে কখনও যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয় নাই।

গীতাকারও বৈদিক ধর্ম্মের প্রতি খড়্গহস্ত নহেন। তিনি জানিতেন যে, তাঁহার কথিত নিষ্কাম কর্ম্মযোগ ও জ্ঞানযোগ কখনও লৌকিক ধর্ম্মের সমস্ত স্থান অধিকার করিতে পারিবে না। তবে লৌকিক ধর্ম্ম বজায় থাকিলে, ইহার দ্বারা প্রকৃষ্টরূপে সেই লৌকিক ধর্ম্মের বিশুদ্ধিসাধন হইতে পারিবে। এ জন্য তিনি সম্বন্ধবিচ্ছেদ করিতে ইচ্ছুক নহেন। যাঁহারা বৈদিক ধর্ম্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উপস্থিত করিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে তাঁহাকে আমরা গণনা করিয়াছি। কিন্তু তাঁহার কৃত যে বিদ্রোহ, তাহার সীমা এই পর্য্যন্ত যে, বেদে ধর্ম্ম আছে, তাহা অসম্পূর্ণ; নিষ্কাম কর্ম্মযোগাদির দ্বারা তাহা সম্পূর্ণ করিতে হইবে। এই জন্য তিনি বৈদিক সকাম ধর্ম্মকে নিকৃষ্ট বলিয়াছেন। কিন্তু নিকৃষ্ট বলিয়া যে তাহার কোনও প্রকার গুণ নাই, এমন কথা বলেন নাই। তাহার গুণ সম্বন্ধে এখানে গীতাকার যাহা বলেন, বুঝাইতেছি।

যাহারা কর্ম্ম করে (সকলেই কর্ম্ম করে), তাহাদিগকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হইতেছে। প্রথম, যাহারা নিষ্কামকর্ম্মী, এবং যাহারা নিষ্কাম কর্ম্মযোগের দ্বারা জ্ঞানমার্গে আরোহণ করিয়াছে, তাহাদের সপ্তদশ শ্লোকে “আত্মরতি” বা “আত্মারাম” বলা হইয়াছে। দ্বিতীয়, যাহারা কেবল আপন ইন্দ্রিয়সুখের জন্য কর্ম্ম করে, ষোড়শ শ্লোকে তাহাদিগকে “ইন্দ্রিয়ারাম” বলা হইয়াছে। তদ্ভিন্ন তৃতীয় শ্রেণীর লোক আছে, তাহারা প্রচলিত ধর্ম্মানুসারে যজ্ঞাদি করিয়া যজ্ঞাবশিষ্ট ভোজন করে। দশম হইতে পঞ্চদশ শ্লোকে তাহাদেরই কথা বলা হইল। তাহাদের অন্ততঃ এই প্রশংসা করা যাইতে পারে যে, তাহারা “ইন্দ্রিয়ারাম” নহে-প্রচলিত ধর্ম্মানুসারে চলিয়া থাকে।যদিও তাহাদের ধর্ম্ম উপধর্ম্ম মাত্র, তথাপি তাহারা ঈশ্বরোপাসক; কেন না ঈশ্বর যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত। এই কথার তাৎপর্য্য আমরা পরে বুঝিব। দেখিব যে, কৃষ্ণ বলিতেছেন যে, আমি ভিন্ন দেবতা নাই। যাহারা অন্য দেবতার উপাসনা করে, তাহারা আমারই উপাসনা করে। সে উপাসনাকে তিনি অবৈধ উপাসনা বলিয়াছেন। কিন্তু তথাপি তাহাও তাঁহার উপাসনা, এবং তিনিই তাহার ফলদাতা, ইহাও বলিয়াছেন।

এখন জিজ্ঞাস্য, কাহাদের মতটা উদার? যাঁহারা বলেন যে, অবৈধ উপাসনার অনন্ত নরকের পথ, না যাঁহারা বলেন যে, বৈধ হউক আর অবৈধ হউক, উপাসনা মাত্র ঈশ্বরের গ্রাহ্য? কি বৈধ আর অবৈধ, তাহা জ্ঞানের উপর নির্ভর করে। কাহাদের মত উদার? যাঁহারা বলেন, জ্ঞানের অভাব জন্য উপাসক ঈশ্বর কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইবে, না যাঁহারা বলেন যে, ঈশ্বর জ্ঞানের মাপ করেন না, উপাসকের হৃদয়ের ভাব দেখেন? কে নরকে যাইবে,-যে বলে যে, নিরাকারের উপাসনা না করিলেই অনন্ত নরক, না যে যেমন বুঝে, তেমনই উপাসনা করে?

গঙ্গা বা Caspian Sea বা আমাদের লালদীঘি, সবই জল। কিন্তু জল গঙ্গা নহে, Caspian Sea নহে বা লালদীঘি নহে। “জল মনুষ্যজীবনের পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজনীয়,” বলিলে কখনও বুঝাইবে না যে, গঙ্গা মনুষ্য জীবনের পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজনীয় বা Caspian Sea তজ্জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয় বা লালদীঘি তজ্জন্য প্রয়োজনীয়। অতএব বিষ্ণু সর্ব্বব্যাপক বলিয়া যজ্ঞ বিষ্ণু অতএব “যজ্ঞার্থে” বলিলে “বিষ্ণ্বর্থে” বুঝিতে হইবে এ কথা খাটে না।

আর কোনও অর্থ শঙ্করাচার্য্যের অভিপ্রেত হইতে পারে কি না এখন দেখা যাউক। আর কোন অভিপ্রায়ই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না-তবে শতপথব্রাহ্মণ হইতে যাহা উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতে যা হউক, একটা কিছু পাওয়া যায়। সে কথার তাৎপর্য্য এই যে, ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবগণ কুরুক্ষেত্র যজ্ঞ করেন। সেই দেবগণের মধ্যে বিষ্ণুষ্ঞ্বৈব এক জন। সেই যজ্ঞে ইনি অন্য দেবতাদিগের উপর প্রাধান্য লাভ করেন এবং তজ্জন্য যজ্ঞ বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন। অতএব এই বিষ্ণুই ঈশ্বর নহেন। আর পাঁচটা দেবতার মধ্যে এক জন মাত্র-আদৌ আর পাঁচটা দেবতার সঙ্গে সমান। শঙ্করাচার্য্যকৃত ব্যাখ্যা এই যে, “যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুরিতি শ্রুতের্যজ্ঞ ঈশ্বরঃ।” এখন যাঁহারা বলিলেন যে, “যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ” ইহা স্বীকার করিলে, যজ্ঞ ঈশ্বর, ইহা যে বেদে কথিত হইয়াছে, এমন কথা কোনও মতেই স্বীকার করা যায় না।

শঙ্করাচার্য্যের ন্যায় পণ্ডিত দুই সহস্র বৎসরের মধ্যে ভারতবর্ষে কেহ জন্মিয়াছেন কি না সন্দেহ। এক্ষণে ভারতবর্ষে কেহই নাই যে, তাঁহার পাদুকা বহন করিবার যোগ্য। তবে দেশ কাল পাত্র বিবেচনা করিয়া আমাদের স্মরণ করিতে হইবে যে, গীতা যে আদ্যন্ত সমস্ত শ্রীকৃষ্ণের মুখপদ্ম-বিনির্গত, ইহা তিনি বিশ্বাস করিতেন বা করিতে বাধ্য। কাজেই এখানে অপরের উক্তি কিছু আছে বা জোড়াতাড়া আছে, এমন কথা তিনি মুখেও আনিতে পারেন না। পক্ষান্তরে যদি যজ্ঞের প্রচলিত অর্থ গ্রহণ করেন, তাহা হইলে বৈদিক ক্রিয়াকলাপের অর্থাৎ সকাম কর্ম্মের উৎসাহ দেওয়া হয়। তাহাতে অর্থবিরোধ উপস্থিত হয়। কেন না, এ পর্য্যন্ত শ্রীকৃষ্ণ সকাম কর্ম্ম অপ্রশংসিত ও নিস্কাম কর্ম্ম অনুজ্ঞাত করিয়া আসিতেছেন।এই জন্য এখানে যজ্ঞার্থে ঈশ্বর বলিবার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। তাহা বলিয়াও পরবর্ত্তী কয়টি শ্লোকের কোন উপায় হয় নাই। সে সকলে যজ্ঞার্থ কাম্য কর্ম্মই বুঝাইতে হইয়াছে। গীতায় এইরূপ কাম্য কর্ম্মের বিধি থাকার কারণ ষোড়শ শ্লোকের ভাষ্যে শঙ্করাচার্য্য বলিয়াছেন যে, প্রথমে আত্মজ্ঞাননিষ্ঠাযোগ্যতা প্রাপ্তির জন্য অনাত্মজ্ঞ ব্যক্তি কর্ম্মযোগানুষ্ঠান করিবে। ইহার জন্য “ন কর্ম্মণামনারম্ভাৎ” ইত্যাদি যুক্তি পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে; কিন্তু অনাত্মজ্ঞানের কর্ম্ম না করার অনেক দোষ আছে, ইহাই কথিত হইতেছে।

শ্রীধর স্বামী শঙ্করাচার্য্যের অনুবর্ত্তী। তিনি নবম শ্লোকের ব্যাখ্যায় যজ্ঞার্থে ঈশ্বরই বুঝিয়াছেন। তিনি বলেন যে, সামান্যতঃ অকর্ম্ম (কর্ম্মশূন্যতা) হইতে কাম্য কর্ম্ম শ্রেষ্ঠ, এই জন্য পরবর্ত্তী শ্লোক কয়টি কথিত হইয়াছে।

সেই পরবর্ত্তী শ্লোক কি, তাহা পাঠক নিম্নে জানিতে পারিবেন। তাহার ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে যদি আমরা কেহ শঙ্করাচার্য্যকৃত নবম শ্লোকের যজ্ঞ শব্দের ব্যাখ্যা গ্রহণ করিতে ইচ্ছুক না হই, তবে তাহার আর একটা সদার্থের সন্ধান করা আমাদের কর্ত্তব্য।

যজ্ঞ শব্দের মৌলিক অর্থই এখানে গ্রহণ করিলে ক্ষতি কি? যজ্ ধাতু দেবপূজার্থে। অতএব যজ্ঞের মৌলিক অর্থ দেবোপাসনা। যেখানে বহু দেবতার উপাসনা স্বীকৃত, সেখানে সকল দেবতার পূজা যজ্ঞ। কিন্তু যেখানে এক ঈশ্বরই সর্ব্বদেবময়, যথা-

“যেহপ্যন্যদেবতাভক্তা যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্ব্বকম্ ||” ২৩ ||
গীতা, ৯অ।

সেখানে যজ্ঞার্থে ঈশ্বরারাধনা। ভগবান্ তাহাই স্বয়ং বলিতেছেন-

“অহং হি সর্ব্বজযজ্ঞানাং ভোক্তা চ প্রভুরেব চ।” ২৪ ||
গীতা, ৯অ।

যজ্ ধাতু এবং যজ্ঞ শব্দ এইরূপ ঈশ্বরারাধনার্থে পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হইয়াছে। উপরিধৃত শ্লোকে তিনটি উদাহরণ আছে। আরও অনেক দেওয়া যাইতে পারে-

“ভূতানি যান্তি ভূতেজ্যা যান্তি মদ্‌যাজিনোহপি মাম্।”
গীতা, ২৫, ১০অ।
“যজ্ঞানাং জপজ্ঞোহস্মি স্থাবরাণাং হিমালয়ঃ।”
গীতা, ২৫, ১০অ।

অন্য গ্রন্থেও যজ্ঞ শব্দের ঈশ্বরারাধনার্থে ব্যবহার অনেক দেখা যায়। যথা মহাভারতে-

“বাক্‌যজ্ঞেনার্চ্চিতো দেবঃ প্রীয়তাং মে জনার্দ্দন।”
শান্তিপর্ব্ব, ৪৭ অধ্যায়।

এখন এই নবম শ্লোকে যজ্ঞ শব্দে ঈশ্বরারাধনা বুঝিলে কি প্রত্যবায় আছে? তাহা করিলে, এই শ্লোকের সদর্থও হয়, সুসঙ্গত অর্থও হয়।

কিন্তু যজ্ঞ শব্দের এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করিবার পক্ষে কিছু আপত্তি আছে। একটি আপত্তি এইঃ-এই শ্লোকের পরবর্ত্তী কয় শ্লোকে যজ্ঞ শব্দটি ব্যবহৃত হইয়াছে; সেখানে যজ্ঞ শব্দে ঈশ্বর, এমন অর্থ বুঝায় না। “সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ”, “যজ্ঞভাবিতাঃ দেবাঃ,” “যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ,” “যজ্ঞ কর্ম্মসমুদ্ভবঃ,” “যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্” ইত্যাদি প্রয়োগে যজ্ঞ শব্দে বিষ্ণু বা ঈশ্বর বুঝাইতে পারে না। এখন ৯ম শ্লোকে যজ্ঞ শব্দ এক অর্থে ব্যবহার করিয়া,তাহার পরেই দশম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ, চতুর্দ্দশ পঞ্চদশ শ্লোকে ভিন্নার্থে সেই শব্দ ব্যবহার করা নিতান্ত অসম্ভব।সামান্য লেখকও এরুপ করে না, গীতাপ্রণেতা যে এরুপ করিবেন, ইহা নিতান্ত অসম্ভব। হয় গীতাকর্ত্তা রচনায় নিতান্ত অপটু, নয় শঙ্করাদিকৃত যজ্ঞ শব্দের এই অর্থ ভ্রান্ত। এ দুইয়ের একটাও স্বীকার করা যায় না। যদি তা না যায়, তবে স্বীকার করিতে হইবে যে, হয় নবম হইতে পঞ্চদশ পর্য্যন্ত একার্থেই যজ্ঞ শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে, নয় নবম শ্লোকের পর একটা জোড়াতাড়া আছে।

প্রথমতঃ দেখা যাইতেছে, যজ্ঞ বিষ্ণুর নাম নয়। অভিধানে কোথাও নাই যে, যজ্ঞ বিষ্ণুর নাম। কোথাও এমন প্রয়োগও নাই। ‘হে যজ্ঞ!’ বলিলে কেহই বুঝিবে না যে, ‘হে বিষ্ণো!’ বলিয়া ডাকিতেছি। “বিষ্ণুর দশ অবতার” এ কথার পরিবর্ত্তে কখনও বলা যায় না যে, যজ্ঞের দশ অবতার”। “যজ্ঞ, শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী বনমালী” বলিলে, লোকে হাসিবে। তবে শঙ্করাচার্য্য কেন বলেন যে, যজ্ঞার্থে বিষ্ণু? কেন বলেন, তাহা তিনি বলিয়াছেন। “যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুরিতি শ্রুতেঃ-যজ্ঞ বিষ্ণু, ইহা বেদে আছে।

শতপথব্রাহ্মণে71 কথিত আছে যে, অগ্নি, ইন্দ্র, সোম, মঘ, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবগণ কুরুক্ষেত্রে যজ্ঞ করিয়াছিলেন। তাঁহারা যজ্ঞকালে এই প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, আমাদিগের মধ্যে যিনি শ্রম, তপ, শ্রদ্ধা, যজ্ঞ, আহুতির দ্বারা যজ্ঞের ফল প্রথমে অবগত হইতে পারিবেন; তিনি আমাদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হইবেন। বিষ্ণু তাহা প্রথমে পাইলেন। তিনি দেবতাদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হইলেন। এক্ষণে শতপথব্রাহ্মণ হইতে উদ্ধৃত করিতেছি।

“তদ্বিষ্ণুঃ প্রথমঃ প্রাপ। স দেবানাং শ্রোষ্ঠোহভবৎ। তস্মাদাহুর্বিষ্ণুর্দেবানাং শ্রেষ্ঠ ইতি। সঃ যঃ স বিষ্ণুর্যজ্ঞঃ সঃ। স যঃ স যজ্ঞোহসৌ স আদিত্যঃ।

অর্থ-ইহা বিষ্ণু প্রথমে পাইলেন। তিনি দেবতাদিগের শ্রেষ্ঠ হইলেন। তাই বলে, বিষ্ণু দেবতাদিগের শ্রেষ্ঠ যে, সেই বিষ্ণু, যজ্ঞ সেই। যে সেই যজ্ঞ, সেই আদিত্য।

পুনশ্চ তৈত্তিরীয়সংহিতায় “শিপিবিষ্ণায়” শব্দের এইরূপ ব্যাখ্যা আছে-“যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ পশবঃ শিপিঃ। যজ্ঞ এব পশুষু প্রতিতিষ্ঠতি।”72 ভট্ট ভাস্কর মিশ্রও লিখিয়াছেন, “যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ পশবঃ শিপিরিতি শ্রুতেঃ।”

অতএব শঙ্করাচার্য্যের কথা ঠিক-শ্রুতিতে যজ্ঞকে বিষ্ণু বলা হইয়াছে। কিন্তু কি অর্থে? একটা অর্থ হইতে পারে যে, বিষ্ণু যজ্ঞ, কেন না, সর্ব্বব্যাপী। ভট্ট ভাস্কর মিশ্রও তাই বলিয়াছেন। তিনি বলনে, “বিষ্ণুঃ পশবঃ শিপিরিতি শ্রুতে সর্ব্বপ্রাণাদ্যন্তর্যামিত্বেন প্রবিষ্ট ইত্যর্থঃ।”

এই গীতার ভিতর সন্ধান করিলেই পাওয়া যাইবে,-

“অহং ক্রতুরহং যজ্ঞঃ স্বধাহমমহমৌষধম্।
মন্ত্রোহহমহমেবাজ্যমহমগ্নিরহং হুতম্ ||”
গীতা, ৯অ, ১৬।

আমি ক্রতু, আমি যজ্ঞ, আমি স্বধা, আমি ঔষধ, আমি মন্ত্র, আমি ঘৃত, আমি অগ্নি, আমি হবন।

যদি তাই হয়, তবে বিষ্ণু যজ্ঞ, কিন্তু যজ্ঞ বিষ্ণু নহে। বিষ্ণু সর্ব্বময়, এজন্য তিনি মন্ত্র, তিনি ঘৃত, তিনি অগ্নি; কিন্তু মন্ত্রও বিষ্ণু নহে, ঘৃতও বিষ্ণু নহে, অগ্নিও বিষ্ণুও নহে। অতএব বিষ্ণু, যজ্ঞ, কিন্তু যজ্ঞ বিষ্ণু নহে, ইহা যদি সত্য হয়, তবে শঙ্করাচার্য্যের ব্যাখ্যা খাটে না।

যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ।
আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টস্তস্য কার্য্যং ন বিদ্যতে || ১৭ ||

যে মনুষ্যের আত্মাতেই রতি, যিনি আত্মতৃপ্ত, আত্মাতেই যিনি সন্তুষ্ট তাঁহার কার্য্য নাই। ১৭।

দ্বিবিধ মনুষ্য, এক ইন্দ্রিয়ারাম (১৫ শ্লোক দেখ), দ্বিতীয় আত্মারাম। যে আত্মজ্ঞাননিষ্ঠ সেই আত্মারাম; সাংখ্যযোগ তাহারই জন্য। এই শ্লোকে তাহারই কথা হইতেছে।

ইতিপূর্ব্বে বলা হইয়াছে যে, কেহই কর্ম্ম না করিয়া ক্ষণমাত্র থাকিতে পারে না। কর্ম্ম ব্যতীত কাহারও জীবনযাত্রাও নির্ব্বাহ হয় না। আবার এখন বলা যাইতেছে যে, ব্যক্তিবিশেষের কর্ম্ম নাই। অতএব কর্ম্ম বা কার্য্য শব্দের বিশেষ বুঝিতে হইবে। বৈদিকাদি সকাম কর্ম্মই এখানে অভিপ্রেত। ভাবার্থ এই যে, যে আত্মতত্ত্বজ্ঞ, তাহার পক্ষে উপরিকথিত যজ্ঞাদির প্রয়োজন নাই।

নৈব তস্য কৃতেনার্থো নাকৃতেনেহ কশ্চন।
ন চাস্য সর্ব্বভূতেষু কশ্চিদর্থব্যপাশ্রয়ঃ || ১৮ ||

তাঁহার কর্ম্মের কোন প্রয়োজন নাই; এবং কর্ম্ম অকারণেও কোন প্রত্যবায় নাই। সর্ব্বভূতমধ্যে কাহারও আশ্রয় ইঁহার প্রয়োজন নাই। ১৮।

তস্মাদসক্তঃ সততং কার্য্যং কর্ম্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম্ম পরমাপ্লোতি পুরুষঃ || ১৯ ||

অতএব সতত অসক্ত হইয়া কর্ত্তব্য কার্য্য সম্পাদন করিবে। পুরুষ অসক্ত হইয়া কর্ম্ম করিলে মুক্তি লাভ করে। ১৯।

‘অসক্ত’ অর্থে আসক্তিশূন্য অর্থাৎ ফলকামনাশূন্য। পাঠক দেখিবেন যে, ৮ম বা ৯ম শ্লোকের পর ১৮শ শ্লোক পর্য্যন্ত বাদ দিয়া পড়িলে, এই ‘তস্মাৎ’ (অতএব) শব্দ অতিশয় সুসঙ্গত হয়। মধ্যে যে কয়টি শ্লোক আছে, এবং যাহার ব্যাখ্যায় এত গোলযোগ উপস্থিত হইয়াছে, তাহার পর এই ‘তস্মাৎ’ শব্দ বড় সঙ্গত বোধ হয় না। ৮ম শ্লোকে বলা হইল যে, কর্ম্ম না করিলে তোমার শরীরযাত্রাও নির্ব্বাহিত হইতে পারে না। ৯ম শ্লোকে বলা হইল যে, ঈশ্বর আরাধনা ভিন্ন অন্যত্র কর্ম্ম বন্ধনের কারণ মাত্র। অতএব তুমি অনাসক্ত হইয়া কর্ম্ম কর, অনাসক্ত হইয়া ঈশ্বরারাধনার্থ যে কর্ম্ম, তাহার দ্বারা মনুষ্য মুক্তি লাভ করে। ৮ম, তার পর ৯ম তার পর ১৯শ শ্লোক পড়িলে এইরূপ সদর্থ হয়। মধ্যবর্ত্তী নয়টি শ্লোক কিছু অসংলগ্ন বোধ হয়। মধ্যবর্ত্তী কয়টি শ্লোকের যে ব্যাখ্যা হয় না, এমতও নহে। তাহা উপরে দেখাইয়াছি। অতএব এ নয়টি শ্লোক যে প্রক্ষিপ্ত, ইহা সাহস করিয়া বলিতে পারি না।

কর্ম্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্ত্তুর্হসি || ২০ ||

জনকাদি কর্ম্মের দ্বারাই জ্ঞান লাভ করিয়াছেন। তুমিও লোকসংগ্রহের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কর্ম্ম কর। ২০।

এই ‘লোকসংগ্রহ’ শব্দের অর্থ ভাষ্যকারেরা বুঝেন, দৃষ্টান্তের দ্বারা লোকের ধর্ম্মে প্রবর্ত্তন। শ্রীধর স্বামী বলেন যে, লোককে স্বধর্ম্মে প্রবর্ত্তন, অর্থাৎ আমি কর্ম্ম করিলে সকলে কর্ম্ম করিবে, না করিলে অজ্ঞেরা জ্ঞানীর দৃষ্টান্তের অনুবর্ত্তী হইয়া নিজ ধর্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক পতিত হইবে, এই লোকরক্ষণই লোকসংগ্রহ।শঙ্করও এইরুপ বুঝাইয়াছেন।শঙ্করাচার্য্য বলেন, লোকের উন্মার্গপ্রবৃত্তি নিবারণ লোকসংগ্রহ। পরশ্লোকে গীতাকার এই কথা পরিষ্কার করিতেছেন।

যদ্‌যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ত্ততে || ২১ ||

যে যে কর্ম্ম শ্রেষ্ঠ লোকে আচরণ করেন, ইতর লোকেও তাহাই করে। তাঁহারা যাহা প্রামাণ্য বলিয়া বিবেচনা করেন, লোকে তাহারই অনুবর্ত্তী হয়। ২১।

পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে যে, আত্মজ্ঞানীদিগের কর্ম্ম নাই। এক্ষণে কথিত হইতেছে যে, কর্ম্ম না থাকিলেও তাঁহাদের কর্ম্ম করা কর্ত্তব্য। কেন না, তাঁহারা কর্ম্ম না করিলে সাধারণ লোক যাহারা আত্মজ্ঞানী নহে, তাহারাও দৃষ্টান্তে অনুবর্ত্তী হইয়া কর্ম্ম হইতে বিরত হইবে।কর্ম্ম হইতে বিরত হইলে স্ব স্ব ধর্ম্ম হইতে বিচ্যুত হইবে। অতএব সকলেরই কর্ম্ম করা কর্ত্তব্য।

ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা জ্ঞানমার্গাবলম্বী ছিলেন। জ্ঞানমার্গাবলম্বীর কর্ম্ম নাই, ইহা স্থির করিয়া তাঁহারা কর্ম্মে বীতশ্রদ্ধ ছিলেন। এবং সেই দৃষ্টান্তের অনুবর্ত্তী হইয়া সমস্ত ভারতবর্ষই কর্ম্মে অনুরাগশূন্য, সুতরাং অকর্ম্মা লোকের দ্বারা পরিপূর্ণ হইয়া এই অধঃপতন দশা প্রাপ্ত হইয়াছে। ভগবান্ উপরিলিখিত যে মহাবাক্যের দ্বারা কর্ম্মবাদ ও জ্ঞানবাদের সামঞ্জস্য বা একীকরণ করিলেন, ভারতবর্ষীয়েরা তাহা স্মরণ রাখিলে, তদনুবর্ত্তী হইয়া কর্ম্ম করিলে, জ্ঞান ও কর্ম্ম উভয়ই তাঁহাদের তুল্যরূপে উদ্দেশ্য হইলে, তাঁহারা কখনই আজিকার দিনের সভ্যতর জাতি হইতে নিকৃষ্টদশাগ্রস্ত হইতেন না-পরাধীন, পরমুখাপেক্ষী, পরজাতিদত্তশিক্ষাবিপদ্‌গ্রস্ত হইতেন না।

শ্রীকৃষ্ণ যে কেবল এই গীতাতেই কর্ম্মের মহিমা কীর্ত্তিত করিয়াছেন, এমন নহে; মহাভারতে উদ্যোগপর্ব্বে সঞ্জয়যানপর্ব্বাধ্যায়েও তিনি ঐরূপ করিয়াছেন। তাহা গ্রন্থান্তরে উদ্ধৃত করিয়াছি, এখানেও উদ্ধৃত করিলামঃ-

“শুচি ও কুটুম্বপরিপালক হইয়া বেদাধ্যয়ন করতঃ জীবন যাপন করিবে, এইরূপ শাস্ত্রনির্দ্দিষ্ট বিধি বিদ্যমান থাকিলেও ব্রাহ্মণগণের নানাপ্রকার বুদ্ধি জন্মিয়া থাকে। কেহ কর্ম্মবশতঃ, কেহ বা কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া একমাত্র বেদজ্ঞান দ্বারা মোক্ষলাভ হয়, এইরূপ স্বীকার করিয়া থাকেন। কিন্তু যেমন ভোজন না করিলে তৃপ্তি লাভ হয় না, তদ্রূপ কর্ম্মানুষ্ঠান না করিলে কেবল বেদজ্ঞ হইলে ব্রাহ্মণগণের কদাচ মোক্ষ লাভ হয় না। যে সমস্ত বিদ্যা দ্বারা কর্ম্ম সংসাধন হইয়া থাকে, তাহাই ফলবতী; যাহাতে কোনও কর্ম্মানুষ্ঠানের বিধি নাই, সে বিদ্যা নিতান্ত নিষ্ফল। অতএব যেমন পিপাসার্ত্ত ব্যক্তির জল পান করিবা মাত্র পিপাসা শান্তি হয়, তদ্রূপ ইহকালে যে সকল কর্ম্মের ফল প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে, তাহারই অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য। হে সঞ্জয়! কর্ম্মবশতঃই এইরূপ বিধি বিহিত হইয়াছে, সুতরাং কর্ম্মই সর্ব্বপ্রধান। যে ব্যক্তি কর্ম্ম অপেক্ষা অন্য কোনও বিষয়কে উৎকৃষ্ট বিবেচনা করিয়া থাকে, তাহার সমস্ত কর্ম্মই নিষ্ফল হয়;

“দেখ, দেবগণ কর্ম্মবলে প্রভাবসম্পন্ন হইয়াছেন। সমীরণ কর্ম্মবলে সতত সঞ্চরণ করিতেছেন; দিবাকর কর্ম্মবলে আলস্যশূন্য হইয়া অহোরাত্র পরিভ্রমণ করিতেছেন; চন্দ্রমা কর্ম্মবলে নক্ষত্রমণ্ডলী পরিবৃত হইয়া মাসার্দ্ধ উদিত হইতেছেন; হুতাশন কর্ম্মবলে প্রজাগণের কর্ম্ম সংসাধন করিয়া নিরবিচ্ছন্ন উত্তাপ প্রদান করিতেছেন; পৃথিবী কর্ম্মবলে নিতান্ত দুর্ভর ভার অনায়াসেই বহন করিতেছেন; স্রোতস্বতী সকল কর্ম্মবলে প্রাণিগণের তৃপ্তি

সাধন করিয়া সলিলরাশি ধারন করিতেছে।অমিতবলশালী দেররাজ ইন্দ্র দেবগণের মধ্যে প্রাধান্য লাভ করিবার নিমিত্ত ব্রহ্মচর্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। তিনি সেই কর্ম্মবলে দশ দিক্ ও নভোমণ্ডল হইতে বারি বর্ষণ করিয়া থাকেন এবং অপ্রমত্তচিত্তে ভোগাভিলাষ বিসর্জ্জন ও প্রিয় বস্তুসমুদয় পরিত্যাগ করিয়া শ্রেষ্ঠত্ব লাভ এবং দম, ক্ষমা, সমতা, সত্য ও ধর্ম্ম প্রতিপালনপূর্ব্বক দেবরাজ্য অধিকার করিয়াছেন। ভগবান্ বৃহস্পতি সমাহিত হইয়া ইন্দ্রিয় নিরোধনপূর্ব্বক ব্রহ্মচর্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত তিনি দেবগণের আচার্য্যপদ প্রাপ্ত হইয়াছেন। রুদ্র, আদিত্য, যম, কুবের, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, অপ্সর, বিশ্বাবসু ও নক্ষত্রগণ কর্ম্মপ্রভাবে বিরাজিত রহিয়াছেন, মহর্ষিগণ ব্রহ্মবিদ্যা, ব্রহ্মচর্য্য ও অন্যান্য ক্রিয়াকলাপের অনুষ্ঠান করিয়া শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিয়াছেন।”

আত্মজ্ঞানী ব্যক্তিদিগেরও কর্ম্ম করা কর্ত্তব্য, ইহা বলিয়া ভগবান্ কর্ম্মপরায়ণতার মাহাত্মা আরও পরিস্ফুট করিবার জন্য নিজের কথা বলিতেছেন-

ন মে পার্থাস্তি কর্ত্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত্ত কর্ম্মণি || ২২ ||
যদি হ্যহং বর্ত্তেয়ং জাতু কর্ম্মণ্যতন্দ্রিতঃ।
মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ || ২৩ ||

হে পার্থ! এই তিন লোকে আমার কিছু মাত্র কর্ত্তব্য নাই। অপ্রাপ্ত অথবা প্রাপ্তব্য কিছুই নাই, তথাপি আমি কর্ম্ম করিয়া থাকি। ২২।

কর্ম্মে অনলস না হইয়া যদি আমি কখনও কর্ম্ম না করি, তবে হে পার্থ! মনুষ্য সকলে সর্ব্বপ্রকারে আমারই পথের অনুবর্ত্তী হইবে। ২৩।

এখানে বক্তা স্বয়ং ভগবান্ জগদীশ্বর। ঈশ্বরের কোনও প্রয়োজন নাই, কোনও বিকার নাই, সুখ দুঃখ কিছুই নাই, অতএব তাঁহার কোনও কর্ম্ম নাই। তিনি জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন এবং জগৎ চলিবার নিয়মও করিয়াছেন, সেই নিয়মের বলে জগৎ চলিতেছে; তাহাতে তাঁহার হস্তক্ষেপণের কোনও প্রয়োজন নাই। এ জন্য তাঁহার কর্ম্ম নাই। তবে তিনি যদি মনুষ্যত্বের আদর্শ প্রচার জন্য ইচ্ছাক্রমে মনুষ্যশরীর ধারণ করেন, তাহা হইলে তিনি মনুষ্যধর্ম্মী বলিয়া তাঁহার কর্ম্মও আছে। যদি তিনি নিজের ঐশী শক্তির দ্বারা সকল প্রয়োজন সিদ্ধ করিতে পারেন, তথাপি মনুষ্যধর্ম্মিত্বহেতু কর্ম্মের দ্বারাই তাঁহাকে প্রয়োজন সিদ্ধ করিতে হয়। তিনি আদর্শ মনুষ্য, কাজে কাজেই তিনি আদর্শ কর্ম্মী। অতএব তিনি কদাচ আলস্যপরবশ হইয়া কর্ম্ম না করিলে, লোকেও আদর্শ মনুষ্যের দৃষ্টান্তের অনুবর্ত্তনে অলস ও কর্ম্মে অমনোযোগী হইবে। যে অলস ও কর্ম্মে অমনোযোগী, সে উৎসন্ন যায়। তাই ভগবান্ পুনশ্চ বলিতেছেন,-

উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্য্যাং কর্ম্ম চেদহম্।
সঙ্করস্য চ কর্ত্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ || ২৪ ||

যদি আমি কর্ম্ম না করি, তাহা হইলে এই লোকসকল আমি উৎসন্ন দিব। সঙ্করের কর্ত্তা হইব এবং এই প্রজা সকলের মালিন্যহেতু হইব। ২৪।

ভাষ্যকারেরা এই সঙ্কর শব্দে বর্ণসঙ্করই বুঝিয়াছেন। হিন্দুরা জাতিগত বিশুদ্ধি রক্ষার জন্য অতিশয় যত্নশীল; এ জন্য বর্ণসঙ্কর একটি কদর্য্য সামাজিক দোষ বলিয়া প্রাচীন হিন্দুদিগের বিশ্বাস। মনু বলেন, নিকৃষ্ট বর্ণসঙ্কর জাতি রাজ্যনাশের কারণ, এবং এই গীতাতেই আছে- “সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্ননাং কুলস্য চ।”

কিন্তু আমরা হঠাৎ বুঝিতে পারি না যে, সংসারে এত গুরুতর অমঙ্গল থাকিতে ঈশ্বরের আলস্যে বর্ণসঙ্করোৎপত্তির ভয়টাই এত প্রবল কেন? এমন ত কিছু বুঝিতে পারি না যে, ঈশ্বর বা শ্রীকৃষ্ণ ব্রাহ্মণ ধরিয়া ব্রাহ্মণীর নিকট, ক্ষত্রিয়কে ধরিয়া ক্ষত্রিয়ার নিকট, বৈশ্যকে ধরিয়া বৈশ্যার নিকট এবং শূদ্রকে ধরিয়া শূদ্রার নিকট প্রেরণ করিয়া বর্ণসাঙ্কর্য্য নিবারণ করেন। দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ, লোকক্ষয়, সর্ব্বদেশব্যাপী রোগ, হত্যা, চৌর্য্য এবং দান, তপস্যা প্রভৃতি ধর্ম্মের তিরোভাব ঈশ্বরের আলস্যে, এ সকলের কোনও শঙ্কার কথা না বলিয়া, বর্ণসাঙ্কর্য্যের ভয়ে শ্রীকৃষ্ণ এত ত্রস্ত কেন? সঙ্কর জাতির বাহুল্য যে আধুনিক সমাজের উপকারী, ইহাও সপ্রমাণ করা যাইতে পারে। অতএব সঙ্কর অর্থে বর্ণসঙ্কর বুঝিলে, এই শ্লোকের অর্থ আমাদিগের ক্ষুদ্রবুদ্ধিগম্য হয় না।

কিন্তু সঙ্কর শব্দে বর্ণসঙ্করই বুঝিতে হইবে, সংস্কৃত ভাষায় এমন কিছু নিশ্চয়তা নাই। সঙ্কর অর্থে মিলন, মিশ্রণ। ভিন্নজাতীয় বা বিরুদ্ধভাবাপন্ন পদার্থের একত্রীকরণ ঘটিলে সাঙ্কর্য্য উপস্থিত হয়। তাহার ফল বিশৃঙ্খলা, ইংরেজিতে যাহাকে disorder বলে। শ্রীকৃষ্ণোক্তির তাৎপর্য্য এই আমি বুঝি যে, তিনি কর্ম্মবিরত হইলে, সামাজিক বিশৃঙ্খলতা ঘটিবে। আদর্শ পুরুষের দৃষ্টান্তে সকলেই আলস্যপরবশ এবং কর্ম্মে অমনোযোগী হইলে সামাজিক বিশৃঙ্খলতা যথার্থই সম্ভব।

সক্তাঃ কর্ম্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্ব্বন্তি ভারত।
কুর্য্যাদ্বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্ || ২৫ ||

হে ভারত! যেমন অবিদ্বানেরা কর্ম্মে আসক্তিবিশিষ্ট হইয়া কর্ম্ম করিয়া থাকে, তেমনই লোকসংগ্রহচিকীর্ষু বিদ্বানেরা অনাসক্ত হইয়া কর্ম্ম করিবেন। ২৫।

অবিদ্বানেরা ফলকামনা করিয়া কর্ম্ম করেন, বিদ্বানেরা লোকরক্ষার্থে অর্থাৎ ধর্ম্মার্থে ফলকামনা পরিত্যাগ করিয়া কর্ম্ম করিবেন।

ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্ম্মসঙ্গিনাম্।
যোজয়েৎ সর্ব্বকর্ম্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্ || ২৬ ||

বিদ্বানেরা কর্ম্মে আসক্ত অজ্ঞানদিগের বুদ্ধিভেদ জন্মাইবেন না। আপনারা অবহিত হইয়া ও সর্ব্ব কর্ম্ম করিয়া, তাহাদিগকে কর্ম্মে নিযুক্ত করিবেন। ২৬।

যাঁহারা জ্ঞানী, তাঁহারা কর্ম্ম না করিলে অজ্ঞানেরা বিবেচনা করিতে পারে যে, আমাদিগেরও এই সসকল কর্ম্ম কর্ত্তব্য নহে।অতয়েব জ্ঞানীদিগের দৃষ্টান্তদোষে অজ্ঞানদিগের এইরূপ বুদ্ধিভেদ জন্মিতে পারে।

প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্ম্মাণি সর্ব্বশঃ।
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্ত্তাহমিতি মন্যতে || ২৭ ||

প্রকৃতির গুণসকলের দ্বারা সর্ব্বপ্রকার কর্ম্ম ক্রিয়মাণ। কিন্তু যাহার বুদ্ধি অহঙ্কারে বিমুগ্ধ, সে আপনাকে কর্ত্তা মনে করে। ২৭।

তত্ত্ববিত্তু মহাবাহো গুণকর্ম্মবিভাগয়োঃ।
গুণা গুণেষু বর্ত্তন্ত ইতি মত্বা ন সজ্জতে || ২৮ ||

হে মহাবাহো! গুণকর্ম্মবিভাগের তত্ত্ব যাঁহারা জানেন, তাঁহারা বুঝেন যে, ইন্দ্রিয়সকলই বিষয়ে বর্ত্তমান; এ জন্য তাঁহারা কর্ম্মে আসক্ত হন না। ২৮।

যাঁহারা শরীর হইতে ভিন্ন আত্মা মানেন না, তাঁহারা উপরিবিখ্যাত দুই শ্লোকের দুই অর্থ বুঝিবেন না। ঐ দুই শ্লোক এবং তৎপূর্ব্বে বিদ্বান্ এবং অবিদ্বান্, জ্ঞানী অজ্ঞান ইত্যাদি শব্দ যে ব্যবহৃত হইয়াছে, সে সকল এই আত্মজ্ঞান লইয়া। যাঁহার আত্মজ্ঞান আছে, অর্থাৎ যিনি জানেন যে, শরীর হইতে পৃথক্ অবিনাশী আত্মা আছেন, তাঁহাকেই বিদ্বান্ বা জ্ঞানী বলা হইতেছে। বলা হইতেছে যে, অবিদ্বান্ বা অজ্ঞানেরা কর্ম্মে আসক্ত বা ফলকামনাবিশিষ্ট, এবং বিদ্বান্ জ্ঞানীরা কর্ম্মে অনাসক্ত বা ফলকামনাশূন্য। কিন্তু এই প্রভেদ ঘটে কেন? আত্মজ্ঞান থাকিলেই ফলকামনা পরিত্যাগ করে, এবং আত্মজ্ঞান না থাকিলেই ফলকামনাবিশিষ্ট হয়, এই প্রভেদ ঘটে কেন, তাহাই এই দুই শ্লোকে বুঝান হইতেছে। ইন্দ্রিয়ের যাহা ভোগ্য, তাহাকেই বিষয় বলে।কেন না, তাহাই ইন্দ্রিয়ের বিষয়। ইন্দ্রিয়ে ও বিষয়ে যে সংযোগ সংঘটন, তাহাই কর্ম্ম। যাহার আত্মজ্ঞান নাই, যে আত্মার অস্তিত্ব অবগত নহে, সে জানে যে, ইন্দ্রিয়ের ও বিষয়ে যে সংঘটন, তাহা আমা হইতেই ঘটিল; অতএব আমিই কর্ম্মের কর্ত্তা। “আমিই কর্ম্মের কর্ত্তা” এই বিবেচনাই অহঙ্কার। সে বুঝে যে, আমি কর্ম্ম করিয়াছি, এ জন্য আমিই কর্ম্মের ফল ভোগ করিব; তাই সে ফল কামনা করে। আর যাঁহার আত্মজ্ঞান আছে, আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস আছে; ইন্দ্রিয়সকল আত্মার কোন অংশ নহে, ইহা যাঁহার বোধ আছে, তিনি জানেন যে, ইন্দ্রিয় বা প্রকৃতিই কর্ম্ম করিল। কেন না, তদ্দ্বারাই বিষয়ের সহিত ইন্দ্রিয়ের সুযোগ সংঘটিত হইল। আত্মা কর্ম্ম করেন নাই, সুতরাং আত্মা তাহা ফলভোগী নহেন। আত্মাই আমি; অতএব আমি তাহার ফলভোগ করিব না, এই বোধে, তাঁহারা ফল কামনা করেন না। অতএব আত্মতত্ত্বজ্ঞানই নিষ্কাম কর্ম্মের মূল। এবং এই তত্ত্বের দ্বারা জ্ঞানযোগের এবং কর্ম্মযোগের সমুচ্চয় হইতেছে। জ্ঞান ব্যতীত কর্ম্ম নিষ্কাম হয় না, এবং নিষ্কাম কর্ম্ম ব্যতীত জ্ঞানের পরিপাক হয় না। নিষ্কাম কর্ম্মও অভ্যস্ত না হইলে ঘটে না। আমরা পরে দেখিব যে, কথিত হইতেছে-কর্ম্ম হইতেই জ্ঞানে আরোহণ করিতে হয়। সে কথা বলিবার কারণ এইখানে নির্দ্দিষ্ট হইল।

প্রকৃতের্গুণসংমূঢ়াঃ সজ্জন্তে গুণকর্ম্মসু।
তানকৃৎস্নবিদো মন্দান্ কৃৎস্নবিন্ন বিচালয়েৎ || ২৯ ||

যাহারা প্রকৃতির গুণে বিমূঢ়, তাহারা ইন্দ্রিয়ের কর্ম্মে অনুরাগযুক্ত হয়। এই সকল মন্দবুদ্ধি অল্পজ্ঞান ব্যক্তিদিগকে জ্ঞানিগণ বিচালিত করিবেন না। ২৯।

অর্থাৎ তাহাদিগকে কর্ম্মফলকামনা পরিত্যাগ করিতে বলিলে, তাহা তাহারা পারিবে না। তবে উপদেশ বা দৃষ্টান্তের ফলে এমত ঘটিতে পারে যে, তাহারা সকাম কর্ম্ম পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিবে। সকাম কর্ম্ম অভ্যস্ত না হইলে, নিষ্কাম কর্ম্ম সম্ভবে না; এই জন্য তাহাদিগের বুদ্ধি বিচালিত করা বা বুদ্ধিভেদ জন্মান নিষিদ্ধ হইতেছে।

ময়ি সর্ব্বাণি কর্ম্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।
নিরাশীনির্ম্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ || ৩০ ||

আমাতে সমস্ত কর্ম্ম সমর্পণ করিয়া অধ্যাত্ম-জ্ঞানের দ্বারা নিস্পৃহ মমতাশূন্য ও শোকশূন্য হইয়া যুদ্ধ কর। ৩০।

গোড়ার কথাটা এই হইয়াছিল যে, অর্জ্জুন আত্মীয় স্বজনকে হত্যা করিয়া তাদৃশ পাপকর্ম্মের দ্বারা রাজ্য লাভ করিতে অনিচ্ছুক; অতএব যুদ্ধ করিবেন না স্থির করিলেন। তদুত্তরে ভগবান্ প্রথমে আত্মজ্ঞানে তাঁহাকে উপদিষ্ট করিলেন। তার পর কর্ম্মের মাহাত্ম্য ও অবশ্যকর্ত্তব্যতা বুঝাইলেন। বুঝাইলেন যে, সকলকে কর্ম্ম করিতেই হয়।অন্য কর্ম্ম না করিলেও জীবনযাত্রা নির্ব্বাহের জন্য কর্ম্ম করিতে হয়। তবে যাহার আত্মজ্ঞান নাই, সে মূর্খ ফলকামনা করিয়া কর্ম্ম করে, আর যে আত্মজ্ঞানী, সে নিষ্কাম হইয়া কর্ম্ম করে; কিন্তু নিষ্কাম হইয়াই হউক, আর সকাম হইয়াই হউক, অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম করিতেই হইবে। যদি করিতেই হইল, তবে নিষ্কাম হইয়া করাই ভাল; কেন না, নিষ্কাম কর্ম্মই পরম ধর্ম্ম। অতএব তুমি নিষ্কাম হইয়া, ফলকামনা পরিত্যাগ করিয়া, রাজ্যলাভ হইবে, না হইবে, সে চিন্তা না করিয়া, কর্ম্মের ফলাফল ঈশ্বরে অর্পণ করিয়া, যুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম বলিয়া নির্ব্বিকারচিত্তে যুদ্ধ কর।

যে মে মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ।
শ্রদ্ধাবন্তোহনসূয়ন্তো মুচ্যন্তে তেহপি কর্ম্মভিঃ || ৩১ ||

যে সকল মনুষ্য শ্রদ্ধাবান্ ও অসূয়াশূন্য হইয়া আমার এই মতের নিত্য অনুষ্ঠান করে, তাহারা কর্ম্ম হইতে অর্থাৎ কর্ম্মফলভোগ হইতে মুক্ত হয়। ৩১।

যে ত্বেতদভ্যসূয়ন্ত্যো নানুতিষ্ঠন্তি মে মতম্।
সর্ব্বজ্ঞানবিমূঢ়াংস্তান্ বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ || ৩২ ||

যাহারা অসূয়াপরবশ হইয়া আমার এই মতের অনুষ্ঠান করে না, তাহাদিগকে সর্ব্বজ্ঞানবিমূঢ়, বিনষ্ট এবং বিবেকশূন্য বলিয়া জানিও। ৩২।

সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি।
প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি || ৩৩ ||

জ্ঞানবান্‌ও, যাহা আপন প্রকৃতির অনুকূল, সেইরূপই চেষ্টা করে। জীবগণ প্রকৃতিরই অনুগামী হয়। নিগ্রহে কোন ফল হয় না। ৩৩।

ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ।
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেত্তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ || ৩৪ ||

ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে ইন্দ্রিয়ের রাগদ্বেষ অবশ্যম্ভাবী। তাহার বশগামী হইও না; কেন না, তাহা শ্রেয়োমার্গের বিঘ্নকারক। ৩৪।

শ্রেয়ান্ স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ || ৩৫ ||

পরধর্ম্মের সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান অপেক্ষা স্বধর্ম্মের অসম্পূর্ণ অনুষ্ঠানও ভাল। বরং স্বধর্ম্মে নিধনও ভাল, পরধর্ম্ম ভয়াবহ। ৩৫।

ভগবদ্বাক্যের যাথার্থ্য এবং সার্ব্বজনীনতার প্রমাণস্বরূপ পরবর্ত্তী দেশী বিদেশী ইতিহাস হইতে তিনটি উদাহরণ প্রয়োগ করিব।

প্রথম, রাজার স্বধর্ম্ম-রাজ্যশাসন ও প্রজাপালন। তিনি ধর্ম্মপ্রচারক বা ধর্ম্মনিয়ন্তা নহেন। এখানে Religion অর্থে ধর্ম্ম শব্দ ব্যবহার করিতেছি। কিন্তু মধ্যকালে ইউরোপে রাজগণ ধর্ম্মনিয়ন্তৃত্ব গ্রহণ করায় মনুষ্যজাতির কি ভয়ানক অমঙ্গল ঘটিয়াছিল, তাহা ইতিহাসে সুপরিচিত। উদাহরণস্বরূপ St. Bartholomew, Sicilian Vespers এবং স্পেনের Inquisition, এই তিনটি নামের উত্থাপনই যথেষ্ট। কথিত আছে, পঞ্চম চার্লসের সময়ে এক Netherland দেশে দশ লক্ষ মনুষ্য কেবল রাজার ধর্ম্ম হইতে ভিন্নধর্ম্মাবলম্বী বলিয়া প্রাণে নিহত হইয়াছিল। আজকাল ইংরেজরাজ্যে ভারতবর্ষে রাজার এরূপ পরধর্ম্মাবলম্বন প্রবৃত্তি থাকিলে ভারতবর্ষে কয় জন হিন্দু থাকিত?

দ্বিতীয় উদাহরণ, বাঙ্গালা দেশে ইংরেজরাজত্বের প্রথম সময়ে। রাজার ধর্ম্ম ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম। বাণিজ্য বৈশ্যের ধর্ম্ম। রাজা এই সময়ে বৈশ্যধর্ম্মাবলম্বন করিয়াছিলেন-East India Company বাণিজ্যব্যবসায়ী হইয়াছিলেন। ইহার ফল ঘটিয়াছিল বাঙ্গালার শিল্পনাশ, বাণিজ্যনাশ, অর্থনাশ। বাঙ্গালার কার্পাসবস্ত্র, পট্টবস্ত্র, রেশম, পিত্তল, কাঁসা, সব ধ্বংসপুরে গেল;-আভ্যন্তরিক বাণিজ্য কতক একেবারে অন্তর্হিত হইল, কতক অন্যের হাতে গেল; বাঙ্গালা এমন দারিদ্র্য-সমুদ্রে ডুবিল যে, আর উঠিল না। কোম্পানিকেও শেষ বাণিজ্য ছাড়িতে হইল। মানুষ সব ছাড়ে, আফিঙ্গ ছাড়ে না। সে বাণিজ্যেরও এখনও আফিঙ্গটুকু আছে।

তৃতীয় উদাহরণ, আমেরিকার স্ত্রীজাতির আধুনিক স্বধর্ম্মত্যাগে ও পৌরুষ কর্ম্মে প্রবৃত্তি। ইহাতে ঘটিতেছে, স্ত্রীজাতির বৈষয়িক ভিন্ন প্রকার অবনতি, গৃহে উচ্ছৃঙ্খলতা এবং জাতীয় সুখহানি। যে স্ত্রীলোক স্বগর্ভসম্ভূত শিশুকে স্তন্যদানে অসমর্থা, তাহাকে স্মরণ করিয়া, সহমরণাভিলাষিণী হিন্দুমহিলা অবশ্যই বলিবেন,

স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ।
ধূমেনাব্রিয়তো বহ্নির্যথাদর্শো মলেন চ।
যথোল্বেণাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্ || ৩৮ ||

যেমন ধূমে বহ্নি আবৃত, মলে দর্পণ এবং গর্ভ জরায়ুর দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই কামের দ্বারা (জ্ঞান) আবৃত থাকে। ৩৮।

“জ্ঞান” শব্দটি মূলে নাই,-তৎপরিবর্ত্তে “ইদম্” আছে। কিন্তু পরশ্লোকে “জ্ঞান” শব্দই আবৃতের বিশেষ্য; এ জন্য এ শ্লোকের অনুবাদেও সেইরূপ করা গেল।

৩৩ শ্লোকে কথিত হইয়াছে যে, জ্ঞানবান্‌ও আপন প্রকৃতির অনুরূপ চেষ্টা করে।

“সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি”

তেত্রিশ, চৌত্রিশ, পঁয়ত্রিশ-এই তিন শ্লোকে যাহা কথিত হইল, তাহার মর্ম্মার্থ বুঝাইতেছি। সকলেই আপন আপন প্রকৃতির বশ, ইহা পূর্ব্বে কথিত হইয়াছে। জ্ঞানবান্‌ও আপন স্বভাবের অনুকূল যে কার্য্য, তাহাই করিয়া থাকেন।নিষেধ বা পীড়নের দ্বারাও আপন স্বভাবের প্রতিকুল কার্য্যে কাহাকে নিযুক্ত বা সুদক্ষ করা যায় না।কিন্তু লোকে যদি ইন্দ্রিয়ের বশীভূত হয়, তবে সে স্বধর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া পরধর্ম্মের অনুসরণ করিয়া থাকে। স্বধর্ম্ম কি, তাহা পূর্ব্বে বুঝাইয়াছি। বর্ণাশ্রমধর্ম্ম সে স্বধর্ম্ম, এমন অর্থ করা যায় না। কেন না, যে সকল সমাজের মধ্যে বর্ণাশ্রমধর্ম্ম নাই, সে সকল সমাজের প্রতি এই উপদেশ অপ্রযোক্তব্য হয়। কিন্তু ভগবদুক্ত ধর্ম্ম সার্ব্বজনীন, মনুষ্য মাত্রেরই রক্ষা ও পরিত্রাণের উপায়। অতএব স্বধর্ম্ম এইরূপই বুঝিতে হইবে যে, ইহজীবনে যে, যে কর্ম্মকে আপনার অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে, তাহাই তাহার স্বধর্ম্ম। যে সমাজে বর্ণাশ্রমধর্ম্ম প্রচলিত, এবং যে সমাজে সে ধর্ম্ম প্রচলিত নহে, এতদুভয়ের মধ্যে প্রভেদ এই যে, বর্ণাশ্রমধর্ম্মীরা পুরুষপরম্পরায় একজাতীয় কার্য্যকেই আপনার অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম বলিয়া গ্রহণ করিতে বাধ্য হন। অন্য সমাজে, লোক আপন আপন ইচ্ছা, প্রবৃত্তি, সুযোগ এবং শক্তি অনুসারে কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়। শক্তি ও প্রবৃত্তির অনুযায়ী বলিয়া অথবা আজীবন অভ্যস্ত বলিয়া স্বধর্ম্মই লোকের অনুকূল। কিন্তু অনেক সময়ে দেখা যায়, ইন্দ্রিয়াদির বশীভূত হইয়া, ধনাদির লোভে বিমুগ্ধ হইয়া, স্বধর্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক লোকে পরধর্ম্ম অবলম্বন করে। তাহাদের প্রায় ঘোরতর অমঙ্গল ঘটিয়া থাকে। প্রাচীন ভাষ্যকারেরা এই অমঙ্গল পারলৌকিক অবস্থা সম্বন্ধেই বুঝেন। কিন্তু ইহলোকেও যে স্বধর্ম্মত্যাগ এবং পরধর্ম্ম অবলম্বন অমঙ্গলের কারণ, তাহা আমরা পুনঃ পুনঃ দেখিতে পাই। যে সকল পুরুষ স্বধর্ম্মে থাকিয়া, তাহা সদনুষ্ঠান জন্য প্রাণপণ যত্ন করেন, এবং তাহার সাধন জন্য মৃত্যু পর্য্যন্ত স্বীকার করেন, তাঁহারাই ইহলোকে বীর বলিয়া বিখ্যাত হইয়া থাকেন; এবং স্বধর্ম্মের অনুষ্ঠানে কৃতকার্য্য হইতে পারিলে, তাঁহারাই ইহলোকে যথার্থ সুখী হয়েন। কিন্তু পরধর্ম্ম অবলম্বন করিয়া অর্থাৎ যাহা নিজের অনুষ্ঠেয় নয়, এমন কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া, তাহা সুসম্পন্ন করিতে পারিলেও, কেহ যে সুখী বা যশস্বী হইতে পারিয়াছেন, এমন দেখা যায় না। অতএব পরধর্ম্মের সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান অপেক্ষা স্বধর্ম্মের অসম্পূর্ণ অনুষ্ঠানও ভাল। বরং স্বধর্ম্মে মরণও ভাল, তথাপি পরধর্ম্ম অবলম্বনীয় নহে।

অর্জ্জুন উবাচ।

অথ কেন প্রযুক্তোহয়ং পাপঞ্চরতি পুরুষঃ।
অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিযোজিতঃ || ৩৬ ||

পরে অর্জ্জুন বলিতেছেন-

হে বার্ষ্ণেয়! পুরুষ কাহার দ্বারা প্রযুক্ত হইয়া পাপাচরণ করে? কাহার নিয়োগে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলের দ্বারা পাপে নিযুক্ত হয়? ৩৬।

পূর্ব্বে কথা হইয়াছে যে, ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে ইন্দ্রিয়ের রাগদ্বেষ অবশ্যম্ভাবী। পুরুষের ইচ্ছা না থাকিলেও সে স্বধর্ম্মচ্যুত হইয়া উঠে, ইহাই এরূপ কথায় বুঝায়। অর্জ্জুন এক্ষণে জিজ্ঞাসা করিতেছেন যে, কেন এরূপ ঘটিয়া থাকে? কে এরূপ করায়?

শ্রীভগবানুবাচ।

কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ।
মহাশনো মহাপাপ্‌মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্ || ৩৭ ||

ইহা কাম। ইহা ক্রোধ। ইহা রজোগুণোৎপন্ন মহাশন এবং অত্যুগ্র। ইহলোকে ইহাকে শত্রু বিবেচনা করিবে। ৩৭।

আগে শব্দার্থ সকল বুঝা যাউক। রজোগুণ কি তাহা স্থানান্তরে কথিত হইবে। মহাশন অর্থে যে অধিক আহার করে। কাম দুষ্পূরণীয়, এ জন্য মহাশন।

পাঠক দেখিবেন যে, কাম ক্রোধ উভয়েরই নামোল্লেখ হইয়াছে। কিন্তু একবচন ব্যবহৃত হইয়াছে। ইহাতে বুঝায় যে, কাম ও ক্রোধ একই; দুইটি পৃথক্ রিপুর কথা হইতেছে না। ভাষ্যকারেরা বুঝাইয়াছেন যে, কাম প্রতিহত হইলে অর্থাৎ বাধা পাইলে ক্রোধে পরিণত হয়; অতএব কাম ক্রোধ একই।

তবে কথাটা এই হইল যে, স্বধর্ম্মানুষ্ঠানই শ্রেয়, কিন্তু ইহা সকলে পারে না। কেন না, স্বভাবই বলবান্; স্বভাবের বশীভূত বলিয়াই লোকে অনিচ্ছুক হইয়াই পরধর্ম্মাশ্রয় করে; পাপাচরণ করে। ইহার কারণ, কামের বলশালিতা। কাম অর্থে রিপুবিশেষ না বুঝিয়া সাধারণতঃ ইন্দ্রিয় মাত্রেরই বিষয়াকাঙ্ক্ষা বুঝিলে, এই সকল শ্লোকের প্রকৃত উদার তাৎপর্য্য বুঝিতে পারা যাইবে।

জ্ঞানবান্ জ্ঞান থাকিতে কেন এরূপ করে? তাহাই বুঝাইবার জন্য বলিতেছেন যে, জ্ঞান এই কামের দ্বারা আবৃত থাকে; জ্ঞান এ অবস্থায় অকর্ম্মণ্য হয়।

উপমা তিনটি অতি চমৎকার; কিন্তু উপমার কৌশল বুঝাইবার পূর্ব্বে বলা আবশ্যক। “মল” শব্দে শঙ্করাচার্য্য “মল” অর্থাৎ মলই বুঝিয়াছেন। কিন্তু শ্রীধর স্বামী বলেন, “মলেন” কি না “আগন্তুকেন”। এ অবস্থায় দর্পণস্থ প্রতিবিম্ব যে “মল” শব্দের অভিপ্রেত, ইহাই বুঝিতে হইতেছে।

উপমা তিনটির প্রতি দৃষ্টি করা যাউক। যাহা উপমিত, এবং যাহা উপমেয়, উভয়ই স্বাভাবিক। বহ্নির স্বাভাবিক আবরণ ধূম; দর্পণ থাকিলেই ছায়া বা প্রতিবিম্ব থাকিবে, নহিলে দর্পণত্ব নাই; এবং গর্ভেরও স্বাভাবিক আবরণ জরায়ু। তেমনই জ্ঞানের আবরণ কামও স্বাভাবিক। ইহা পূর্ব্বেই কথিত আছে। উপমেয় ও উপমিত উভয়ই প্রকাশাত্মক; বহ্নি প্রকাশাত্মক; দর্পণ প্রকাশাত্মক, গর্ভ প্রকাশাত্মক;-তেমনই জ্ঞানও প্রকাশাত্মক। প্রকাশের জন্য প্রয়োজন, ক্রিয়াবিশেষ। ফুৎকারাদির দ্বারা ধূমাবরণ, অপসারণের দ্বারা বিম্বাবরণ এবং প্রসবের দ্বারা উল্বণাবরণ বিনষ্ট হইয়া অগ্নি, দর্পণ, ও গর্ভের প্রকাশ হয়, তেমনই ইন্দ্রিয় দমনের দ্বারা কামাবরণ বিনষ্ট হইয়া জ্ঞানের প্রকাশ পায়। ইহা ৪১ শ্লোকে দেখিব।

আবৃতং জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা।
কামরূপেণ কৌন্তেয় দুষ্পূরেণানলেন চ || ৩৯ ||

হে কৌন্তেয়! জ্ঞানীদিগের নিত্যশত্রু, কামরূপে দুষ্পূর এবং অগ্নিতুল্য হইয়া জ্ঞানকে আবৃত রাখে। ৩৯।

কামই জ্ঞানই নিত্যশত্রু।73 ভোগকালে সুখদায়ক, পরিণামে সুখদায়ক এবং ভোগকালেও যাহা নিষ্প্রয়োজনীয়, তাহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত করিয়া সুখদায়ক, এই জন্য নিত্যশত্রু। ইহা দুষ্পূর-কেন না, কিছুতেই ইহার পূরণ নাই; এবং ইহা সন্তাপহেতু, এই জন্য অগ্নিতুল্য।

ইন্দ্রিয়াণি মনো বুদ্ধিরস্যাধিষ্ঠানমুচ্যতে।
এতৈর্বিমোহয়ত্যেষ জ্ঞানমাবৃত্য দেহিনম্ || ৪০ ||

ইন্দ্রিয় সকল মন ও বুদ্ধি ইহার অধিষ্ঠান বলিয়া কথিত হইয়াছে। জ্ঞানকে আবৃত রাখিয়া, এই সকলের দ্বারা ইহা (কাম) আত্মাকে মুগ্ধ করে। ৪০।

এই কাম কাহাকে আশ্রয় করিয়া থাকে? ইন্দ্রিয় সকলকে এবং মন ও বুদ্ধিকে। আত্মা হইতে পৃথক্। আত্মাকে আশ্রয় করিতে পারে না। আত্মাকে বিমুগ্ধ করিয়া রাখে।

তস্মাত্ত্বমিন্দ্রিয়াণ্যাদৌ নিয়ম্য ভারতর্ষভ।
পাপ্‌মানং প্রজহি হ্যেনং জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্ || ৪১ ||

অতএব হে ভরতশ্রেষ্ঠ! তুমি আগে ইন্দ্রিয়গণকে নিয়ত করিয়া, জ্ঞানবিজ্ঞানবিনাশী পাপস্বরূপ কামকে বিনষ্ট (বা ত্যাগ) কর। ৪১।

যদি ইন্দ্রিয়গণই কামের অধিষ্ঠানভূমি, তবে আগে ইন্দ্রিয়গণকে নিয়ত করিতে হইবে। তাহা হইলে কামকে বিনষ্ট করা হইবে।

জ্ঞান বা বিজ্ঞানে প্রভেদ কি? শ্রীধর বলেন, জ্ঞান আত্মবিষয়ক, বিজ্ঞান শাস্ত্রীয় অথবা “জ্ঞান শাস্ত্রাচার্য্যের উপদেশজাত, বিজ্ঞান নিদিধ্যাসজাত।” শঙ্করাচার্য্য বলেন, “জ্ঞান শাস্ত্র হইতে আচার্য্যলব্ধ আত্মাদির অবরোধ। আর তাহার বিশেষ প্রকার অনুভবই বিজ্ঞান।” পাঠক এই ব্যাখ্যা অপেক্ষা শ্রীধর স্বামীর ব্যাখ্যা প্রাঞ্জল বলিয়া গ্রহণ করিবেন। আমি বুঝি যে, এইটুকু বুঝিতে পারিলেই আমাদের মত লোকের পক্ষে যথেষ্ট হইবে যে, কাম সর্ব্বপ্রকার জ্ঞান ও আত্মার উন্নতির বিনাশক।

ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্বুদ্ধের্যঃ পরতস্তু সঃ || ৪২ ||
এবং বুদ্ধেঃ পরং বুদ্ধ্বা সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা।
জহি শত্রুং মহাবাহো কামরূপং দুরাসদম্ || ৪৩ ||

ইন্দ্রিয় সকল শ্রেষ্ঠ বলিয়া কথিত; ইন্দ্রিয় সকল হইতে মন শ্রেষ্ঠ; মন হইতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ; বুদ্ধি হইতে তিনি শ্রেষ্ঠ। ৪২।

এইরূপ বুদ্ধির দ্বারা পরমাত্মাকে বুঝিয়া আপনাকে স্তম্ভিত করিয়া, হে মহাবাহো! তুমি কামরূপ দুরাসদ74 শত্রুকে জয় কর। ৪৩।

পাঠক প্রথম ৪২ শ্লোকের প্রতি মনোযোগ করুন। ইহা অনুবাদে দুর্বোধ্য।

বলা হইতেছে যে, ইন্দ্রিয়গণ শ্রেষ্ঠ বলিয়া কথিত। মন ইন্দ্রিয় হইতে শ্রেষ্ঠ, ইত্যাদি। তবে ইন্দ্রিয়গণ তাহা হইতে শ্রেষ্ঠ? ভাষ্যকারেরা বলেন, দেহাদি হইতে। তাহাই শ্লোকের অভিপ্রায় বটে, কিন্তু আধুনিক পাঠক জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, ইন্দ্রিয় কি দেহাদি হইতে স্বতন্ত্র?

অতএব প্রথমে বুঝিতে হয়, ইন্দ্রিয় কি। দর্শনশাস্ত্রে কহে, চক্ষুঃশ্রবণাদি পাঁচটি জ্ঞানেনন্দ্রিয়, হস্তপদাদি পাঁচটি কর্ম্মেন্দ্রিয়, এবং মন অন্তরিন্দ্রিয়। কিন্তু এ শ্লোকে মনকে ইন্দ্রিয় হইতে পৃথক্ বলা হইতেছে। সুতরাং জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্ম্মেন্দ্রিয়ই এখানে অভিপ্রেত।

দেহাদি হইতে ইহা শ্রেষ্ঠ হইল কিসে? ভাষ্যকারেরা বলেন, ইন্দ্রিয় সকল সূক্ষ্ম ও প্রকাশক, দেহাদি ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য। কিন্তু এ কথা কেবল জ্ঞানেন্দ্রিয় সম্বন্ধেই সত্য। আর জ্ঞানেন্দ্রিয় সকল দেহাদি হইতে স্বতন্ত্র নহে। তবে স্পষ্টতঃ ভাষ্যকারেরা দেহাদি শব্দের দ্বারা স্থূল পদার্থ বা স্থূল ভূত অভিপ্রেত করিয়াছেন। স্থূল কথা এই যে, ইন্দ্রিয়ের বিষয় হইতে ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ।

বক্তার অভিপ্রায় কি, তাহা মূলে যে “আহুঃ” পদ আছে, তাহার প্রতি মনোযোগ করিলে সন্ধান পাওয়া যাইবে। বক্তা নিজের মত বলিয়া ইহা বলিতেছেন না, এইরূপ কথিত হইয়াছে বলিয়া বলিতেছেন। কে এরূপ বলিয়াছে? সাংখ্যদর্শন স্মরণ করিলেই এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাইবে। তাহা বুঝাইতেছি।

সাংখ্যদর্শনে সমস্ত পদার্থ পঞ্চবিংশতি গণে বিভক্ত হইয়াছে। পর্য্যায়ক্রমে পঞ্চবিংশতি গণ এইরূপ।

১। প্রকৃতি। ৪ হইতে ১৯। পঞ্চ তন্মাত্র ও একাদশ ইন্দ্রিয়।
২। মহৎ। ২০-২৪। পঞ্চ স্থূল ভূত।
৩। অহঙ্কার। ২৫ পুরুষ।

এই পর্য্যায়ের তাৎপর্য্য এই যে, প্রকৃতি হইতে মহৎ, মহৎ হইতে অহঙ্কার, অহঙ্কার হইতে পঞ্চ তন্মাত্র ও একাদশ ইন্দ্রিয়; পঞ্চ তন্মাত্র হইতে স্থূল ভূত। পুরুষ পরমাত্মা।

এই পর্য্যায়ানুসারে স্থূল ভূত (ক্ষিত্যাদি, সুতরাং পাঞ্চভৌতিক দেহাদি) হইতে ইন্দ্রিয় শ্রেষ্ঠ। এখানে মন ইন্দ্রিয় হইতে পৃথক্; কিন্তু সাংখ্যমতানুদসারে মন ইন্দ্রিয় হইলে অন্যান্য ইন্দ্রিয় হইতে শ্রেষ্ঠ; কেন না, অন্যগুলি বহিরিন্দ্রিয়; দ্বিতীয় গণ, অহঙ্কারকে বিজ্ঞানভিক্ষু সাংখ্যপ্রবচনভাষ্যে বুদ্ধি বলিয়াছেন। অতএব বুদ্ধি মন হইতে শ্রেষ্ঠ।

কিন্তু এমন বলিতে পারা যায় না, এই সাংখ্যদর্শন গীতাপ্রণয়নকালে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। তবে গীতাপ্রণয়নকালে ইহা হইতে ভিন্ন প্রকার সাংখ্যমত প্রচলিত ছিল, তাহার প্রমাণ গীতাতেই আছে। তাহারই সম্প্রসারণে কপিল-প্রচারিত সাংখ্য। গীতার সপ্তমাধ্যায়ের চতুর্থ শ্লোকে এইরূপ গণ কথিত হইয়াছে,- ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ। অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা || ৪ ||

আটটি মাত্র গণ কথিত হইল; পাঁচটি স্থূল ভূত, মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার। শঙ্করাচার্য্য বলেন, পঞ্চ ভূতের গণনাতেই পঞ্চ তন্মাত্র এবং ইন্দ্রিয় সকলের গণনা হইল বুঝিতে হইবে।75 আর পাঠক ইহাও দেখিবেন যে, ভগবান্ বলিতেছেন যে, এই আট প্রকার আমার প্রকৃতি। অতএব কাপিল সাংখ্যের সঙ্গে এ মতের প্রভেদও অতি গুরুতর।

যাহা হউক, শ্লোকোক্ত পারম্পর্য্য কতক বুঝা গেল। কিন্তু বুদ্ধির আর একটি অর্থে আছে। নিশ্চয়াত্মিকা অন্তঃকরণবৃত্তিকে বুদ্ধি বলা যায়।76 এই অর্থে বুদ্ধি শব্দ যে গীতাতেই ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহা দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখিয়াছি। শ্লোকের অবশিষ্টাংশ বুঝিবার জন্য এই অর্থ স্মরণ করিতে হইবে। ইন্দ্রিয়দমনের উপায় কথিত হইতেছে। অন্য সমস্ত অন্তঃকরণপ্রবৃত্তি হইতে শ্রেষ্ঠ যে এই নিশ্চয়াত্মিকা বৃত্তি, পরমাত্মা তাহা হইতে শ্রেষ্ঠ। এখন ৪৩ শ্লোক সহজে বুঝিব। এই নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা সেই পরমাত্মাকে বুঝিয়া, আপনাকে নিশ্চল করিয়া কামকে পরাজিত করিতে হইবে। ইহার অপেক্ষা ইন্দ্রিয়জয়ের উৎকৃষ্ট উপায় আর কোথাও কখন কথিত হইয়াছে, এমন জানি না।77
ইতি মহাভারতে শতসাহস্র্যাং সংহিতায়াং বৈয়াসিক্যাং
ভীষ্মপর্ব্বণি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং
যোগশাস্ত্রে কর্ম্মযোগো নাম তৃতীয়োহধ্যায়ঃ।

========================
66 ভাষ্যকারেরা বলেন,-কেবল জ্ঞানেন্দ্রিয়সকল।

68 Great Bears.

69 Plerades.

70 ইহার অনুবাদ পূর্ব্বে দেওয়া হইয়াছে।

71 ১৪।১।১

72 ইহা আমি Muir সংগ্রহ হইতে তুলিলাম। কিন্তু একটু সন্দেহের বিষয় আছে।

73 ভাষ্যকারেরা এইরূপ বলেন।

74 দুরাসদ শব্দে দুর্ব্বিজ্ঞেয়, শ্রীধর স্বামী বুঝিয়াছেন।

75 অপি চ ত্রয়োদশ অধ্যায়ে ৫।৬ শ্লোকে বলিতেছেন,
মহাভূতান্যহঙ্কারো বুদ্ধিরব্যক্তমেব চ।
ইন্দ্রিয়াণি দশৈকঞ্চ পঞ্চ চেন্দ্রিয়গোচরা: || ৫ ||
ইচ্ছা দ্বেষ: সুখং দু:খং সংঘাতশ্চেতনা ধৃতি:।
এতৎ ক্ষেত্রং সমাসেন সবিকারমুদাহৃতম্ || ৬ ||
ইহাতে কাপিল সাংখ্যের ১৩টি গণ আছে, মন ও আত্মা, আরও সাতটি আছে। ইহা গণ বা পদার্থ বলিয়া কথিত হইতেছে না; সমস্ত জগৎকে এই কয় শ্রেণীতে বিভক্ত করিবার উদ্দেশ্য নাই অতএব কপিল সাংখ্য নহে; বরং কাপিল সাংখ্যের মূল এইখানে আছে, এমন কথা বলা যাইতে পারে।

76 বেদান্তসার-২৮।

77 সভ্যসমাজে মনুষ্যের একটি ইন্দ্রিয় এত প্রবল দেখা যায় যে, “ইন্দ্রিয়দোষ” বলিলে সেই ইন্দ্রিয়ের দোষই বুঝায়। ইহার প্রাবল্য নিবারণের উপায় অনেকে জিজ্ঞাসা করিয়া থাকেন, অনেকে জিজ্ঞাসু হইয়াও লজ্জার অনুরোধে প্রশ্ন করিতে পারেন না। অনেকে এমনও আছেন যে, ঈশ্বরে বিশ্বাসহীন বা তাঁহাকে নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধির দ্বারা ধারণ করিতে অক্ষম। অতএব ইন্দ্রিয়দমনের ক্ষুদ্রতর যে সকল উপায় আছে, তাহা নিম্নে লিখিত হইল।

(১) শারীরিক ব্যায়াম। ইহাতে শারীরিক ও মানসিক উভয়বিধ স্বাস্থ্য সাধিত হয়। শারীরিক ও মানসিক উভয়বিধ স্বাস্থ্য থাকিলে ইন্দ্রিয়ের দূষণীয় বেগ জন্মিতে পারে না।

(২) আহারের নিয়ম। উত্তেজক পানাহার পরিত্যাগ করিবে। মদ্যাদি বিশেষ নিষেধ। মৎস্য, মাংস একেবারে নিষেধ করা যায় না; বিশেষত: মৎস্যের অনেক সদ্‌গুণ আছে; কিন্তু মৎস্য ইন্দ্রিয়ের বিশেষ উত্তেজক। অতএব মৎস্য মাংসের অল্প ভোজনই ভাল। মৎস্য মাংসের এই দোষ জন্যই ব্রহ্মচারীর পক্ষে হিন্দুশাস্ত্রে নিষিদ্ধ হইয়াছে।

(৩) আলস্য পরিত্যাগ। আলস্য ইন্দ্রিয়দোষের একটি অতিশয় গুরুতর কারণ। আলস্যে কুচিন্তার অবসর পাওয়া যায়,-অন্য চিন্তার অভাব থাকিলে ইন্দ্রিয়সুখচিন্তাই বলবতী হয়। অন্য কর্ম্ম না থাকিলে, ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তি চেষ্টাই প্রবল হয়। যাঁহার বিষয়কর্ম্ম আছে, তিনি বিষয়কর্ম্মে বিশেষ মনোনিবেশ করিবেন এবং অবসরকালেও বিষয়কর্ম্মের উন্নতিচেষ্টা করিবেন। তাহাতে দ্বিবিধ শুভ ফল ফলিবে; ইন্দ্রিয়ও শাসিত থাকিবে এবং বিষয়কর্ম্মেরও উন্নতি ঘটিবে। তবে এরূপ বিষয়কর্ম্ম-চিন্তার দোষ এই ঘটে যে, লোক অত্যন্ত বিষয়ী হইয়া উঠে। সেটা মানসিক অবনতির কারণ হয়। অতএব যাঁহারা পারেন, তাঁহারা অবসরকালে সুসাহিত্য পাঠ বা বৈজ্ঞানিক আলোচনা করিবেন। যাঁহারা শিক্ষার অভাবে তাহাতে অক্ষম অননুরাগী, তাঁহারা আপনার কার্য্য শেষ করিয়া পরের কার্য্য করিবেন। পরিবারবর্গের সহিত কথোপকথন, বালকবালিকাদিগের বিদ্যাশিক্ষার তত্ত্বাবধান, আপনার আয়ব্যয়ের তত্ত্বাবধান এবং প্রতিবাসিগণের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের তত্ত্বাবধানের সকলেই সমস্ত অবসরকাল অতিবাহিত করিতে পারেন। ইহাতে যাঁহাদের মন না যায়, তাঁহারা কোনও গুরুতর পরকার্য্যে নিযুক্ত হইতে পারেন। অনেকে একটা স্কুল বা একটা ডাক্তারখানা স্থাপন ও রক্ষণে ব্রতী হইয়া অনেক পাপ হইতে মুক্ত হইয়াছেন।

(৪) অতি প্রধান উপায় কুসংসর্গ পরিত্যাগ। যাহারা ইন্দ্রিয়পরবশ, অশ্লীলভাষী, অশ্লীল আমোদ-প্রমোদে অনুরক্ত, তাহাদের ছায়াও পরিত্যাগ করিবে। ইহাদের দৃষ্টান্ত, প্ররোচনা ও কথোপকথনে দেবর্ষিগণও কলুষিত হইতে পারেন। সভ্য সমাজে বাসের একটি প্রধান অমঙ্গলই এই কুসংসর্গ।

(৫) সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ উপায়-কেবল ঈশ্বরচিন্তার নীচে-পবিত্র দাম্পত্য-প্রণয়। এ বিষয়ে অধিক লিখিবার প্রয়োজন নাই। এই সকল কথা যদিও গীতাব্যাখ্যার পক্ষে অপ্রাসঙ্গিক, তথাপি ইহা লোকের পক্ষে অশেষ মঙ্গলকর বলিয়া এ স্থানে লিখিত হইল।


© 2024 পুরনো বই