০১৯.রাহুর মস্তকচ্ছেদ । দেবাসুর-সংগ্রাম

ঊনবিংশ অধ্যায়

উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, অনন্তর সমস্ত দৈত্যগণ একত্রিত হইয়া নানাপ্রকার অস্ত্র-শস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক দেবগণকে আক্রমণ করিল। তদবলোকনে মহাপ্রভাবশালী ভগবান নারায়ণ নরদেব সমভিব্যাহারে দানবেন্দ্রদিগকে বঞ্চনা করিয়া অমৃত হরণ করিলেন। অনন্তর দেবগণ বিষ্ণুর নিকট হইতে সেই অমৃত লইয়া পরমাহ্লাদে পান করিতে বসিলেন। দেবগণ অমৃত পান করিতে আরম্ভ করিলে রাহু নামে এক দুষ্ট দানব অবসর বুঝিয়া দেবরূপ ধারণপূর্ব্বক সুরগণের সহিত অমৃতপান করিতে বসিয়াছিল। অমৃত রাহুর কণ্ঠদেশমাত্র গমন করিয়াছে, এমত সময়ে চন্দ্র ও সূর্য্য দেবতাদিগের হিতসাধনার্থে ঐ গুপ্তবিষয় ব্যক্ত করিয়া দিলেন। ভগবান্ চক্রপাণি স্বীয় সুদর্শনাস্ত্র দ্বারা তৎক্ষণাৎ সেই দুষ্ট দানবের শিরচ্ছেদন করিলেন।

রাহুর পর্ব্বত-শিখরাকার প্রকাণ্ড মস্তক ছেদনমাত্রে গগনমণ্ডলে আরোহণ করিয়া ভীষণ-নাদে গর্জ্জন করিতে লাগিল। তাহার কবন্ধকলেবর সকাননা, সদ্বীপা, সপর্ব্বতা বসুন্ধরাকে কম্পিত করিয়া ভূপৃষ্ঠে পতিত হইল। তদবধি চন্দ্র ও সূর্য্যের সহিত রাহুমুখের চিরশত্রুতা জন্মিল। এই নিমিত্তই অদ্যাপি ঐ রাহু মুখ তাঁহাদিগকে গ্রাস করিয়া থাকে। পরিশেষে ভগবান্ নারায়ণ মোহিনীবেশ পরিত্যাগ করিয়া অস্ত্র-শস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক দানবগণকে আক্রমণ করিলেন।

দেবাসুর-সংগ্রাম

তদনন্তর লবণার্ণব-তীরে দেবাসুরগণের ঘোরতর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। প্রাস, তোমর, ভিন্দিপাল প্রভৃতি সহস্র সহস্র তীক্ষ্মাগ্র শস্ত্রবর্ষণে রণস্থল আচ্ছন্ন হইল। খড়্গ, চক্র, গদা, শক্তি প্রভৃতি শস্ত্রাঘাতে দানবগণ রুধির বমনপূর্ব্বক মূর্চ্ছিত হইয়া রণশায়ী হইল। তাহাদিগের তপ্ত-কাঞ্চনাকার মস্তক কপাল পট্টিশাঘাতে ছিন্নভিন্ন হইয়া অনবরত ধরণীতলে পতিত হইতে লাগিল। যুদ্ধে হত দানবগণ রুধিরাক্ত-কলেবর হইয়া ধাতুরাগরঞ্জিত গিরিকূটের [পর্ব্বতশৃঙ্গের] ন্যায় ভূমিশয্যায় শয়ান রহিল। পরস্পরের শস্ত্র প্রহার দেখিয়া রণস্থলে হাহাকার শব্দ উঠিল। দেবগণ দূর হইতে লৌহময় পরিঘাঘাত ও নিকটে দৃঢ়মুষ্টি প্রহার করিয়া রণ করিতে আরম্ভ করিলেন। দানবেরাও ঐরূপ যুদ্ধ করিতে লাগিল। সংগ্রামের কলকলধ্বনি গগনমণ্ডল আচ্ছাদিত করিল। চারিদিকে কেবল ‘ছিন্ধি, ভিন্ধি, প্রধাব ঘাতয়, পাতয়, মারয়’ [ছেদন কর, ভগ্ন কর, বেগে দৌড়াইয়া অগ্রসর হও, আঘাত কর, পাতিত কর, বধ কর] ইত্যাদি ঘোরতর শব্দমাত্র শ্রুত হইতে লাগিল।
এইরূপে ভয়ঙ্কর সংগ্রাম হইতেছে, এমত সময়ে নর ও নারায়ণ রণস্থলে আগমন করিলেন। ভগবান্ নারায়ণ নরদেবের হস্তে দিব্য ধনুঃ সন্দর্শন করিয়া দানবকুল-ধূমকেতু স্বীয় চক্রাস্ত্র স্মরণ করিলেন। মহাপ্রভাবশালী, সূর্য্যসম-তেজস্বী, অপ্রতিহতবীর্য্য, ভীমদর্শন সেই অরিনিসূদন সুদর্শনচক্র স্মরণ মাত্রে নভোমণ্ডল হইতে অবতীর্ণ হইল। আজানুলম্বিতবাহু, ভগবান চক্রপাণি সেই প্রজ্বলিত হুতাশনাকার, ভয়ঙ্কর চক্র বিপক্ষপক্ষে প্রক্ষেপ করিলেন। নারায়ণ-বিক্ষিপ্ত ভীষণ সুদর্শনাস্ত্র মহাবেগে ধাবমান হইয়া সহস্র সহস্র দানবদলের প্রাণসংহার করিল। কোন স্থলে সমুজ্জ্বল হুতাসনের ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া দৈত্যকুল নিপাত করিল, কোথাও বা আকাশমণ্ডলে ও ধরাতলে পরিভ্রমণপূর্ব্বক পিশাচের ন্যায় তাহাদিগের রুধির পান করিতে লাগিল।

নবমেঘাকৃতি, মহাবল-পরাক্রান্ত দানবেরাও আকাশে উত্থিত হইয়া সহস্র সহস্র পর্ব্বত-নিক্ষেপ দ্বারা দেবগণকে আকুলিত করিল। তৎকালে ভগ্নসানু অতি প্রকাণ্ড মহীধরগণ পরস্পরাভিঘাতে ভয়ঙ্কর শব্দ করিয়া ঘোরতর মেঘের ন্যায় চতুর্দ্দিকে পতিত হইতে লাগিল। দুর্দ্দান্ত দানবগণ এইরূপ গভীর গর্জ্জনপূর্ব্বক নিরন্তর পর্ব্বত-বর্ষণ করিয়া সকাননা, সদ্বীপা মেদিনীকে কম্পান্বিত করিল। তখন নরদেব সুবর্ণমুখ শিলীমুখ [শাণিত শর– চোখা বাণ ] দ্বারা দানববিক্ষিপ্ত পর্ব্বতসমূহ বিদারণপূর্ব্বক নভোমণ্ডল ব্যাপ্ত করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত দানবগণ দেবগণ কর্ত্তৃক ভগ্নবল হইয়া এবং আকাশমণ্ডলে জ্বলন্তাগ্নিসদৃশ সুদর্শন-চক্রকে ক্রুদ্ধ দেখিয়া কেহ ভূগর্ভে, কেহ বা লবণার্ণগর্ভে প্রবিষ্ট হইল।

সুরগণ এইরূপে জয়লাভ করিয়া যথোচিত সৎকারপুবঃসর মন্দরগিরিকে স্বস্থানে সংস্থাপন করিলেন। জলধরগণ নভোমণ্ডল এবং সুরলোক নিনাদিত করিয়া যথাস্থানে প্রতিগমন করিল। অনন্তর ইন্দ্রাদি দেবগণ আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া সেই অমৃতপূর্ণ কমণ্ডলু সুরক্ষিত করিয়া নারায়ণের নিকট সমর্পণ করিলেন।


© 2024 পুরনো বই