ত্রয়োদশ অধ্যায়
শৌনক কহিলেন, “হে সৌতে! মহারাজ জনমেজয় কি নিমিত্ত সর্পযজ্ঞ করিয়া সর্পগণকে ধ্বংস করিয়াছিলেন এবং কি কারণেই বা তপোধনাগ্রগণ্য আস্তীক মুনি প্রদীপ্ত হুতাশন হইতে ভুজঙ্গমদিগকে রক্ষা করিয়াছিলেন, তাহা সবিশেষ বর্ণন কর। যে রাজা সর্পসত্রের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, তিনি কাহার পুৎত্র এবং সেই দ্বিজবর আস্তীক মুনিই বা কাহার পুৎত্র, ইহাও বর্ণন কর।” “হে মুনিবর! আমি আপনার নিকট অতি বিস্তীর্ণ আস্তীকোপাখ্যান আনুপূর্ব্বিক বর্ণনা করিতেছি, শ্রবণ করুন।” শৌনক কহিলেন, “হে সূতপুৎত্র! প্রাচীন মহর্ষি আস্তীকের ঐ মনোহর উপাখ্যান আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ জন্মিয়াছে।”
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, আমার পিতা নৈমিষারণ্যবাসী বিপ্রগণ কর্ত্তৃক অভ্যর্থিত হইয়া সর্ব্বপাপবিনাশক ব্যাসোক্ত ঐ পুরাতন ইতিহাস তাঁহাদিগকে শ্রবণ করাইয়াছিলেন। আমি তৎসমীপে যে প্রকার শ্রবণ করিয়াছি, অবিকল সেইরূপ বর্ণন করিতেছি, শ্রবণ করুন। তপোধন আস্তীকের পিতা জরৎকারু মুনি সাক্ষাৎ প্রজাপতিসদৃশ ব্রহ্মচারী, ঊর্দ্ধরেতা ও পরম ধার্ম্মিক ছিলেন। তিনি সর্ব্বদা ব্রতানুষ্ঠান, উগ্রতপস্যা ও আহারসংযমে একান্ত তৎপর থাকিতেন। সেই তপোবলসম্পন্ন মহাত্মা সর্ব্বদা তীর্থপর্য্যটন ও তীর্থে অবগাহন করিয়া অবনীমণ্ডল পরিভ্রমণ করিতেন এবং যেস্থানে সায়ংকাল উপস্থিত হইত, সেই স্থানে অবস্থিতি করিতেন। এইরূপে বহুকাল আহার নিদ্রা পরিত্যাগ ইতস্ততঃ পর্য্যটন করিয়া তিনি শীর্ণকলেবর হইয়া ছিলেন; তথাপি বায়ুমাত্র ভক্ষণপূর্ব্বক কঠোর ব্রতের অনুষ্ঠান করিতেন।
একদা জরৎকারু মুনি ভ্রমণ করিতে করিতে কোন স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, কতিপয় ব্যক্তি ঊর্দ্ধপাদ ও অধোমস্তক হইয়া মহাগর্ত্তে লম্বমান রহিয়াছেন; তদ্দর্শনে তিনি কৃপাপরবশ হইয়া তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসিলেন; “আপনারা কে? কি নিমিত্তই বা মূষিকচ্ছিন্নমূল উশীরস্তম্ব [বেণার মূলের গুচ্ছ] মাত্র অবলম্বন করিয়া অধোমুখে এই মহাগর্ভে লম্বমান রহিয়াছেন?”
পিতৃগণ কহিলেন, “আমরা যাযাবর [অতিশয় পর্য্যটনশীল- যাহারা একস্থানে স্থির থাকে না।] নামে ঋষি; সন্তানক্ষয় হওয়াতে অধঃপতিত হইতেছি। আমার নিতান্ত হতভাগ্য! আমাদিগের জরৎকারু নামে এক পুৎত্র আছে, সেই দুর্ম্মতি পুৎত্রার্থ দার পরিগ্রহ না করিয়া সংসারসুখে জলাঞ্জলি প্রদানপূর্ব্বক অহর্নিশ কেবল তপস্যায় কালাতিপাত করিতেছে। সুতরাং কুলক্ষয় উপস্থিত দেখিয়া এই মহাগর্ত্তে লম্বমান রহিয়াছি; আমাদিগের বংশবর্দ্ধন জরৎকারু থাকিতেও আমরা অনাথ ও দুষ্কৃতীর ন্যায় হইয়াছি; তুমি কে, কি নিমিত্তই বা আমাদিগের দুঃখ দেখিয়া বান্ধবের ন্যায় অনুশোচনা করিতেছ, জানিতে বাসনা করি।”
জরৎকারু তাঁহাদিগের কাতরোক্তি শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “আপনারা আমার পূর্ব্বপুরুষ, আমারই নাম জরৎকারু; এক্ষণে আজ্ঞা করুন, কি করিব?” পিতৃগণ কহিলেন, “বৎস! তোমার এবং আমাদিগের পারত্রিক মঙ্গল-সম্পাদন করিবার নিমিত্ত কুলরক্ষা-বিষয়ে যত্নবান হও। লোকে পুৎত্রৎপাদন দ্বারা যেরূপ সদ্গতিসম্পন্ন হয়, ধর্ম্মফল দ্বারা সেরূপ সদ্গতি লাভ করিতে পারে না। অতএব হে পুৎত্র! আমাদিগের নির্দ্দেশানুসারে দারপরিগ্রহ করিয়া সন্তানোৎপাদনে যত্নবান্ হও। ইহা করিলেই আমদিগের পরম হিতসাধন করা হইবে।”
জরৎকারু কহিলেন, “আমি সম্ভোগার্থে দারপরিগ্রহ বা জীবিকার্থে ধনোপার্জ্জন করিব না, কেবল আপনাদিগের হিতসাধনার্থে বিবাহ করিতে সম্মত হইলাম; কিন্তু তদ্বিষয়ে এই এক প্রতিজ্ঞা রহিল যে, যদি কন্যা আমার সনাম্নী হয় এবং তাহার বন্ধুবান্ধবগণ স্বেচ্ছাপূর্ব্বক আমাকে সেই কন্যা ভিক্ষাস্বরূপ সম্প্রদান করে, তাহা হইলেই আমি তাহাকে যথাবিধি বিবাহ করিব; কিন্তু আমি অত্যন্ত দরিদ্র, বোধ করি, দরিদ্রকে কন্যা সম্প্রদান করিতে কেহই সম্মত হইবে না। হে পিতামহগণ! আমি এই নিয়মে দারপরিগ্রহ করিতে যত্নবান্ হইব, অন্যথা এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতে পারিব না। এইরূপে পরিণীতা ভার্য্যার গর্ভে সন্তান জন্মিলে আপনারা উদ্ধার হইবেন এবং অক্ষয় স্বর্গলাভ করিয়া পরম-সুখে কালযাপন করিতে পারিবেন।”