“ভগবান্ কহিলেন, ‘হে অর্জুন! তুমি আমার প্রতি অনুরক্ত ও আমার আশ্রিত হইয়া যোগাভ্যাসপূর্বক যে প্রকারে আমাকে সম্পূর্ণরূপে অবগত হইতে পারিবে, তাহা শ্রবণ কর। আমি যে অনুভবসহকৃত (অনুভবের সহিত আচরিত) জ্ঞান সম্যক্রূপে কীর্তন করিতে প্রবৃত্ত হইতেছি, ইহা বিদিত হইলে, শ্রেয়োবিষয়ে (মুক্তিরূপ মঙ্গল সম্বন্ধ) আর কিছুই জ্ঞাত হইতে অবশিষ্ট থাকে না। সহস্র সহস্র মনুষ্যমধ্যে কোন ব্যক্তি আত্মজ্ঞানের নিমিত্ত যত্নবান হয়; আর যত্মশীল সিদ্ধ ব্যক্তিগণের মধ্যে কোন ব্যক্তি প্রকৃতরূপে আমাকে জ্ঞাত হইতে সমর্থ হয়। আমার মায়ারূপ প্রকৃতি ভূমি, জল, অনল, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার, এই আট প্রকারে বিভক্ত এতদ্ভিন্ন আমার একটি জীবস্বরূপ পরা (সর্বশ্রেষ্ঠ) প্রকৃতি আছে, উহা এই জগৎ ধারণ করিয়া রহিয়াছে। হে পার্থ! স্থাবরজঙ্গমাত্মক ভূত-সমুদয় এই ক্ষেত্র (প্রকৃতি) ও ক্ষেত্রজ্ঞ(জীবাত্মা)স্বরূপ প্রকৃতিদ্বয় হইতে সমুৎপন্ন হইতেছে। অতএব আমিই এই সমস্ত বিশ্বের পরম কারণ ও আমিই ইহার প্রলয়কর্ত্তা (লয়কারক); হে ধনঞ্জয়! আমা ভিন্ন ইহার সৃষ্টি-সংহারের (উৎপত্তির উপসংহারের–প্রবাহনিবৃতির) আর শ্রেষ্ঠ স্বতন্ত্র কারণ নাই। যেমন সূত্রে মণি সকল গ্রথিত থাকে, তদ্রুপ আমাতেই এই বিশ্ব গ্রথিত রহিয়াছে। হে অর্জুন! আমি সলিলে রসরূপে, চন্দ্র-সূর্য্যে প্রভাবরূপে, সমুদয় বেদে ওঁকাররূপে, আকাশে শব্দরূপে, মনুষ্য সকলে পৌরুষরূপে, পৃথিবীতে পবিত্র গন্ধরূপে, অনলে তেজোরূপে, সর্বভূতে জীবনরূপে ও তপস্বিগণে তপস্যারূপে অবস্থান করিতেছি। হে পার্থ! তুমি আমাকে সর্বভূতের সনাতন (নিত্য–ক্ষয়রহিত) বীজ বলিয়া বিদিত হও। আমি বুদ্ধিমানদিগের বুদ্ধি, তেজস্বীদিগের তেজ, বলবানের দুরাকাঙ্খাশূন্য বল ও সর্বভূতের বল ও ধর্মানুগত কাম। যে সমস্ত সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভাব আছে, তাহা আমা হইতে উৎপন্ন এবং আমারই অধীন; কিন্তু আমি কদাচ ঐ সকলের বশীভূত নহি। জগতীস্থ (ব্রহ্মাণ্ডস্থিত) সমুদয় লোক এই ত্রিগুণাত্মক (সত্ব, রজঃ ও তমঃ–এই ত্রিগুণগঠিত) ভাবে বিমোহিত হইয়া আমাকে ইহাদের অতিরিক্ত অবিনাশী বলিয়া বিদিত হইতে সমর্থ হয় না।
“অলৌকিক গুণময়ী নিতান্ত দুস্তরা আমার এক মায়া আছে; যাহারা আমাকে আশ্রয় করে, তাহারাই ঐ মায়া অতিক্রম করিতে সমর্থ হয়। ঐ মায়া কর্তৃক যাহাদিগের জ্ঞান অপহৃত হইয়াছে এবং যাহারা অসুরভাব অবলম্বন করিয়াছে, সেই সমস্ত দুষ্কর্মকারী নরাধম মূর্খ কদাচ আমাকে প্রাপ্ত হয় না। আর্ত্ত (পীড়িত–কাতর), আত্মজ্ঞানাভিলাষী, অর্থাভিলাষী ও জ্ঞানী, হে অর্জুন! এই চাই প্রকার পুণ্যবান লোক আমার আরাধনা করিয়া থাকে; তন্মধ্যে অতিমাত্র ভক্ত ও যোগযুক্ত জ্ঞানীই শ্রেষ্ঠ। আমি জ্ঞানবানের এবং জ্ঞানবান্ আমার একান্ত প্রিয়। পূর্বোক্ত চারি প্রকার উপাসকই মোক্ষ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন; কিন্তু আমার মতে জ্ঞানীই আত্মস্বরূপ; তিনি মদেকচিত্ত (একমাত্র ভগবানেই অর্পিতচিত্ত) হইয়া আমাকে একমাত্র উত্তম গতি অবধারণ করিয়া আশ্রয় করিয়া থাকেন। বহুজন্ম অতিক্রান্ত হইলে জ্ঞানবান্ ব্যক্তি বাসুদেবই এই সচরাচর বিশ্ব, এইরূপ বিবেচনা করিয়া আমাকে প্রাপ্ত হয়েন; কিন্তু তাদৃশ মহাত্মা নিতান্ত দুর্লভ। অন্য উপাসকেরা স্বীয় প্রকৃতির বশীভূত ও নানা প্রকার কামনা দ্বারা হতজ্ঞান হইয়া প্রসিদ্ধ (গতানুগতিক–রুচিকর) নিয়ম অবলম্বনপূর্বক ভূত, প্রেত প্রভৃতি ক্ষুদ্র দেবতাদিগের আরাধনা করিয়া থাকে। যে যে ভক্ত শ্রদ্ধাসহকারে যে কোন দেবতার অর্চনা করিতে অভিলাষ করেন, আমিই তাঁহাদিগকে সেই অচলা শ্রদ্ধা প্রদান করিয়া থাকি, তাঁহারা সেই শ্রদ্ধাসহকারে সেই সকল দেবতার আরাধনা করিতে প্রবৃত্ত হন; তৎপরে আমা হইতেই হিতকর অভিলষিতসকল প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। কিন্তু সেই সমস্ত অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিদিগের দেবতালব্ধ (দেবতা হইতে প্রাপ্ত) ফল-সমুদয় ক্ষয় হইয়া যায়। দেবযাজী ব্যক্তিরা দেবতা প্রাপ্ত হয়, আর আমার ভক্তগণ আমাকেই প্রাপ্ত হইয়া থাকে। আমি অব্যক্ত; কিন্তু নির্বোধ মনুষ্যেরা আমার অব্যয় ও অতি উৎকৃষ্ট স্বরূপ অবগত না হইয়া আমাকে মনুষ্য, মীন ও কূর্মাদিভাবাপন্ন মনে করে। আমি যোগমায়ায় প্রচ্ছন্ন হইয়া আছি, সকলের সমক্ষে কদাচ প্রকাশমান হই না; এই নিমিত্ত মূঢ়েরা আমাকে জন্মহীন ও অব্যয় বলিয়া অবগত নহে। হে অর্জুন! আমি ভূত, ভবিষ্যত ও বর্তমান এই তিন বিষয়ই বিদিত আছি, কিন্তু আমাকে কেহই জ্ঞাত নহে। হে অর্জুন! জন্মগ্রহণ করিলে ভূতসকল ইচ্ছাদ্বেষসমুত্থিত শীতোষ্ণাদিদ্বন্দ্ব নিমিত্ত মোহে বিমোহিত হইয়া থাকে; কিন্তু যে সমস্ত পুণ্যাত্মাদিগের পাপ বিনষ্ট ও শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্ব-নিমিত্ত মোহ অপগত হইয়াছে, সেই সমস্ত কঠোর-ব্রতপরায়ণ মহাত্মারাই আমার আরাধনা করেন। যাঁহারা আমাকে আশ্রয় করিয়া জরা-মৃত্যু হইতে বিনির্মুক্ত হইবার জন্য যত্ন করেন, তাঁহারাই সমগ্র অধ্যাত্মবিষয়, নিখিল কর্ম ও সনাতন ব্রহ্ম অবগত হইতে সমর্থ হয়েন। যাহারা অধিভূত, অধিদৈব ও অধিযজ্ঞের সহিত আমাকে সম্যক্ বিদিত হইয়াছেন, সেই সমস্ত মহাহিতচিত্ত ব্যক্তি মৃত্যুকালেও আমাকে বিস্মৃত হয়েন না।’ ”