২.৪ রেলওয়ে

দুর্গোৎসবের ছুটীতে হাওড়া হতে এলাহাবাদ পর্য্যন্ত রেলওয়ে খুলেছে; রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাল কাল অক্ষরে ছাপানো ইংরাজী বাঙ্গালায় এস্তাহার মারা গেছে। অনেকেই আমোদ করে বেড়াতে যাচ্চেন-তীর্থযাত্রীও বিস্তর। শ্ৰীপাট নিমতলার প্রেমানন্দ দাস বাবাজীও এই অকাশে বারাণসী দর্শন কত্তে কৃতসঙ্কল্প হয়েছিলেন। প্রেমানন্দ বাবাজী শ্রীপাট জোড়াসাঁকোর প্রধান মঠের একজন কেষ্টবিষ্ণুর মধ্যে; বাবাজীর অনেক শিষ্য-সেবক ও বিষয়-আশয়ও প্রচুর ছিল; বাবাজীর শরীর স্কুল ভুঁড়িটি বড় তাকিয়ার মত প্রকাণ্ড; হাত পাগুলিও তদনুরূপ মাংসল ও মেদময়। বাবাজীর বর্ণ কষ্টিপাথরের মত, হুঁকোর খোলের মত ও ধানসিদ্ধ হাঁড়ির মত কুচকুচে কালো। মস্তক কেশহীন করে কামান, মধ্যস্থলে লম্বাচুলের চৈতন্যচুটকি সর্ব্বদা খোঁপার মত বাঁধা থাকতো; বাবাজী বহুকাল কচ্ছ দিয়ে কাপড় পরা পরিহার করেছিলেন, সুতরাং কৌপীনের উপর নানারঙ্গের বহির্বাস ব্যবহার কভেন। সর্ব্বদা সর্ব্বাঙ্গে গোপীমৃত্তিকা মাখা ছিল ও গলায় পদ্মবীচি তুলসী প্রভৃতি নানা প্রকার মালা সৰ্ব্বদা পরে থাকত্তেন। তাতে একটি লাল বাতের বড় বালিসের মত জপমালার থলি পিতলের কড়ায় আবক্ষ ঝুলতে।

বাবাজী একটি ভাল দিন স্থির করে প্রত্যুষেই দৈনন্দিন কাৰ্য্য সমাপন কল্লেন ও তাড়াতাড়ি যথাকথঞ্চি বাড়ীর বিগ্রহের প্রসাদ পেয়ে, দুই শিষ্য ও তল্পিদার ও ছড়িদার সঙ্গে লয়ে, মঠ হতে বেরিয়ে গাড়ীর সন্ধানে চিৎপুররোডে উপস্থিত হলেন। পাঠকবর্গ মনে করুন, যেন স্কুল অফিস খোলবার এখনো বিলম্ব আছে, রামলীলার মেলার এখনো উপসংহার হয়নি। সুতরাং রাস্তায় গহনার কেরাঞ্চী থাকবার সম্ভাবনা কি। বাবাজী অনেক অনুসন্ধান করে শেষে এক গাড়ীর আড্ডায় প্রবেশ করে, অনেক কষা-মাজার পর একজনকে ভাড়া যেতে সম্মত কল্লেন। এদিকে গাড়ী প্রস্তুত হতে লাগলো, বাবাজী তারি অপেক্ষায় এক বেশ্যালয়ের বারাণ্ডার নীচে দাঁড়িয়ে রইলেন।

শ্রীপাট কুমারনগরের জ্ঞানানন্দ বাবাজী প্রেমানন্দ বাবাজীর পরম বন্ধু ছিলেন। তিনিও রেলগাড়ী চড়ে বারাণসী দর্শনে ইচ্ছুক হয়ে, কিছু পূর্ব্বেই বাবাজীর শ্রীপাটে উপস্থিত হয়ে, সেবাদাসীর কাছে শুনলেন যে, বাবাজীও সেই মানসে কিছু পূর্ব্বেই বেরিয়ে গেচেন। সুতরাং এরই অনুসন্ধান কত্তে কত্তে সেইখানেই উভয়ের সাক্ষাৎ হলো। জ্ঞানানন্দ বাবাজী যার পর নাই কৃশ ছিলেন; দশবৎসরের জ্বর ও কাসী রোগ ভোগ করে শরীর শুকিয়ে কঞ্চি ও কাঠির মত পাকিয়ে গেছিল, চক্ষু দুটি কোটরে বসে গেছে, মাংস-মেদের লেশমাত্র শরীরে নাই, কেবল কখন কঙ্কালমাত্রে ঠেকেচে; তায় এক মাথা রুক্ষ তৈলহীন চুল, একখানা মোটা লুই দুপাট করে গায়ে জড়ানো, হাতে একগাছা বেঁউড় বাঁশের বাঁকা লাঠি ও পায়ে একজোড়া জগন্নাথি উড়ে জুতো। অনবরত কালচেন ও গয়ের ফেলচেন এবং মধ্যে মধ্যে শামুক হতে এক এক টিপ নস্য লওয়া হচ্ছে। অনবরত নস্য নিয়ে নাকের নলি এমনি অসাড় হয়ে গেছে যে, নাক দিয়ে অনবরত নস্য ও সর্দ্দিমিশ্রিত কফজল গড়াচ্ছে, কিন্তু তিনি তা টেরও পাচ্চেন না, এমন কি, এর দরুণ তাঁরে ক্রমে থোনা হয়ে পড়তে হয়েছিল এবং আলজিভও খারপ হয়ে যাওয়ায় সর্ব্বদাই ভেটকী মাছের মত হা করে থাকত্তেন। প্রেমানন্দ জ্ঞানানন্দের সাক্ষাৎ পেয়ে বড়ই আদিত হলেন। প্রথমে পরস্পরে কোলাকুলি হলো, শেষে কুশল-প্রশ্নদির পর দুই বন্ধুতে দুই ভেয়ের মত একত্রে বারাণসী দর্শন কত্তে যাওয়াই স্থির কল্লেন!

এদিকে কেরাঞ্চী প্রস্তুত হয়ে বাবাজীদের নিকটস্থ হলে, তল্পিদার তল্পি নিয়ে ছাদে, ছড়িদার ও সেবায়েৎ পেছোনে ও দুই শিষ্য কোচ বক্সে উঠলো। বাবাজীরা দুজনে গাড়ীর মধ্যে প্রবেশ কল্লেন। প্রেমানন্দ গাড়ীতে পদার্পণ করবামাত্র গাড়ীখানি মড় মড় করে উঠলো, সামনের দিকে জ্ঞানানন্দ বসে পড়লেন। উপরের বারাণ্ডায় কতকগুলি বেশ্যা দাঁড়িয়েছিল, তারা বাবাজীকে দেখে পরস্পর “ভাই একটা একগাড়ী গোঁসাই দেখেছিস! মিন্সে যেন কুম্ভকর্ণ!” প্রভৃতি বলাবলি করতে লাগলো। গাড়োয়ান গাড়ীতে উঠে সপাসপ করে চাবুক দিয়ে ঘোড়ায় বাস হ্যাঁচকাতে হ্যাঁচকাতে জিভে ট্যাক্ ট্যাক্ শব্দ করে চাবুক মাথার উপরে ঘোরাতে লাগলো, কিন্তু ঘোড়ার সাধ্য কি যে, এক পা নড়ে! কেবল অনবরত লাথি ছুড়তে লাগলো ও মধ্যে মধ্যে বাতকর্ম্ম করে আসোর জম্‌কিয়ে দিলে।

পাঠকবর্গের স্মরণ থাকতে পারে যে, আমরা পূর্ব্বেই বলে গেচি, কলিকাতা আজব শহর। ক্রমে রাস্তায় লোক জমে গেল। এই ভিড়ের মধ্যে একটা চীনের বাদামওয়ালা ছোঁড়া বলে উঠলো, ‘ওরে গাড়োয়ান। এক দিকে একটা ধূম্মলোচন ও আর এক দিকে একটা চিম্‌ড়ে সওয়ারি, আগে পাষাণ ভেঙ্গে নে, তবে চলবে।’ অমনি উপর থেকে বেশ্যারা বলে উঠলো, ‘ওরে এই রোগা মিন্সেটার গলায় গোটাকতক পাথর বেঁধে দে, তা হলে, পাষাণ ভাঙ্গা হবে।’ প্রেমানন্দ এই সকল কথাতে বিরক্ত হয়ে ঘৃণা ও ক্রোধে জ্বলে উঠে, খানিকক্ষণ ঘাড় গুঁজে রইলেন; শেষে ঈষৎ ঘাড় উঁচু করে জ্ঞানানন্দকে বল্লেন, ‘ভায়া! সহরের স্ত্রীলোকগুলা কি ব্যাপিকা দেখেচো’ ও শেষে ‘প্রভো! তোমার ইচ্ছা’ বলে হাই তুল্লেন! জ্ঞানানন্দও হাই তুল্লেন ও দুবার তুড়ি দিয়ে একটিপ নস্য নিয়ে বল্লেন, “ঠিক বলেঁচো দা দাঁ, ওরাঁ ভঁর্তার কাঁছে উঁপদেশ পাঁঞি নাঁঞি, ওঁঞাদের রাঁমা রঁঞ্জিকার পাঁঠ দেঁওঞা উঁচিত।”

প্রেমানন্দ রামারঞ্জিকার নাম শুনে বড়ই পুলকিত হয়ে বল্লেন, ‘ভায়া না হলে মনের কথা কে বলে? রামারঞ্জিকার মত পুঁথি ত্রিজগতে নাই। প্রভো তোমার ইচ্ছা জ্ঞানানন্দ এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে একটিপ নস্য নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে মাথাটা চুল্কে বল্লেন, দাঁ দাঁ, শুঁনেছি বিবিরাঁ নাঁকি রাঁমারঁঞ্জিকা পঁড়ছেঁ। প্রেমানন্দ অমনি আহ্লাদে “আরে ভায়া, রামারঞ্জিকা পুঁথির মত ত্রিজগতে হান পুঁথি নাঞি! প্রভো, তোমার ইচ্ছা।”

এদিকে অনেক কসলতের পর কেরাঞ্চি গুড়িগুড়ি চলতে লাগলেন; তল্পিদারেরা গাড়ীর ছাদে বসে গাঁজা টিপতে লাগলো! মধ্যে শরতের মেঘে এক পসলা ভারি বৃষ্টি আরম্ভ হলো, বাবাজীর গাড়ীর দরজা ঠেলে দিয়ে অন্ধকারে বারোইয়ারির গুদম্‌জাত সংগুলির মত আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলেন। খানিকক্ষণ এইরূপে নিস্তব্ধ হয়ে থেকে জ্ঞানানন্দ বাবাজী একবার গাড়ীর ফাটলে চক্ষু দিয়ে বৃষ্টি কিরূপ পড়চে তা দেখে নিয়ে একটিপ নস্য নিলেন ও বারদুই কেসে বল্লেন, “দাঁ, দাঁ, এঁকটা সংকীৰ্ত্তন হঁক শুঁধু শুঁধু বসে কাল কাঁটান হচ্ছে ঞন্না।” প্রেমানন্দ সঙ্গীতবিদ্যার বড় ভক্ত ছিলেন, নিজে ভাল গাইতে পারুন আর নাই পারুন, আড়ালে ও নিজ্জনে সৰ্ব্বদা গলাবাজী কত্তেন ও দিবারাত্র গুগুণোনির কামাই ছিল না। এ ছাড়া বাবাজী সঙ্গীতবিষয়ক একখানা বইও ছাপিয়েছেন এবং ঐ সকল গান প্রথম প্রথম দু-এক গোড়ার বাড়ী মজলিস করে গায়ক দিয়ে গাওয়ানো হয়, সুতরাং জ্ঞানানন্দের কথাতে বই প্রফুল্লিত হয়ে মল্লার ভেজে গান ধনে পাঠশালার ছেলেরা যেমন ঘোষবার সময়ে সম্বার পোড়োর সঙ্গে গোলে হরিবোল দিয়ে গণ্ডায় এ বলে সায় দিয়ে যায়, সেই প্রকার জ্ঞানানন্দ প্রেমানন্দের সঙ্গীত শুনে উৎসাহিত হয়ে মধ্যে মধ্যে দুই একটা তান মারতে লাগলেন। ভাঙ্গা ও খোন, আওয়াজের একত্র চাকারে গাড়োয়ান গাড়ী থামিয়ে ফেলে, তল্পিদার তড়াক করে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে দরজা খুলে দেখে যে, বাবাজীর প্রেমোন্মত্ত হয়ে চৎকার করে গান ধরেচেন। রাস্তার ধারে পাহারাওয়ালারা তামাক খেতে খেতে ঢুলতেছিল, গাড়ীর ভেতরের বেতরে আওয়াজে চমকে উঠে কলকে ফেলে দৌড়ে গাড়ীর কাছে উপস্থিত হলো; দোকানদারেরা দোকান থেকে গলা বাড়িয়ে উঁকি  মেরে দেখতে লাগলো কিন্তু বাবাজীরা প্রভুপ্রেমগানে এমনি মেতে গিয়েছেন যে, তখনো তান মারা থামে নি। শেষে সহসা গাড়ী থামায় ও লোকের গোলে চৈতন্য হলো ও পাহারাওয়ালাকে দেখে কিঞ্চিং অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। সেই সময় ব্লাস্তা দিয়ে একটা নগদ মুটে ঝাঁকি। কাঁধে করে বেকার চলে যাচ্চিল, এই ব্যাপার দেখে সে থমকে দাঁড়িয়ে ‘পুঙ্গির ভাই গাড়িমদ্দি ক্যালাবতী লাগাইচেন’ বলে চলে গেল। পাহারাওয়ালাকে কল্‌কে পরিত্যাগ করে আসতে হয়েছিল বলে সেও বাবাজীদের বিচক্ষণ লাঞ্ছনা করে পুনরায় দোকানে গিয়ে বসলো; রেলওয়ে ব্যাগ হাতে একজন সহুরে বাবু অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত গাড়ীর অপেক্ষায় এক দোকানে বসেছিলে, বৃষ্টিতে তার রেলওয়ে টমিসে উপস্থিত হবার বিলক্ষণ ব্যাঘাত কতেছিল, এক্ষণে বাবাদের গাড়োয়ানের সঙ্গে ঐ অবকাশে ভাড়া-চুক্তি করে, হুড়মুড় করে গাড়ীর মধ্যে ঢুকে পড়লেন! এদিকে গাড়োয়ানও গাড়ী হাঁকিয়ে দিলে। তল্পিদার খানিক দৌড়ে দৌড়ে শেষে গাড়ীর পিছনে উঠে পড়লে।

আমাদের নব্যবাবুকে একজন বিখ্যাত লোক বল্লেও বলা যায়; বিশেষতঃ তিনি সহরের নিকটবর্ত্তী একটি প্রসিদ্ধ স্থলে একটি ব্রাহ্মসভা স্থাপন করে, স্বয়ং তার সম্পাদক হয়েছিলেন, এ সওয়ায় সেই গ্রামেই একটি ভারি মাইনের চাকরী ছিল। নববাবু “রিফৰ্ম্মড ক্লাসের টেক্কা ও সমাজের রঙ্গের গোলামহরূপ” ছিলেন। দিবারাত্রি “সামগ্রী” কত্তেন, ও সর্ব্বদাই ভরপূর থাকত্তেন–শনিবার ও রবিবার কিছু বেশী মাত্রায় “কারগো” নিতেন, মধ্যে মধ্যে “বানচাল হওয়ারও বাকি থাকতো না। প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের “ফরণিচর” ও “লাইব্রেরীর” বই কিনতে বাবু ছুটি নিয়ে শহরে এসেছিলেন। ক দিন খোঁড়া ব্রহ্মের সমাজেই প্রকৃতির প্রীতি ও প্রিয়কাৰ্য্য সাধন করে, বিলক্ষণ ব্রহ্মানন্দ লাভ করা হয়। মাতাল বাবু গাড়ীর মধ্যে ঢুকে প্রথমে প্রেমানন্দ বাবাজীর ভুঁড়ির উপর টলে পড়লেন, আবার ধাক্কা পেয়ে জ্ঞানানন্দের মুখের উপর পড়ে পুনরায় প্রেমানন্দের ভুঁড়িতে টলে পড়লেন। বাবাজীরা উভয়ে তটস্থ হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি কত্তে লাগলেন। মাতাল কোথায় বসবেন, তা স্থির কত্তে না পেরে মোছলমানদের গাজীমিয়ার ধ্বজার মত, একবার এ পাশ একবার ও পাশ কত্তে লাগলেন।

বাবাজীরা যাতালবাবুর সঙ্গে, এক খাঁচায় পোয়া বাজ ও পায়রার মত বসবাস করুন ছক্কড়খানি ভরপুর বোঝাইয়ে নবাবী চালে চলুক; তল্পিদারেরা অনবরত গাঁজা ফুঁকতে থাক। এ দিকে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায়, সহর আবার পূর্ব্বানুরূপ গুলজার হয়েচে। মধ্যাবস্থ গৃহস্থের বাজার কত্তে বেরিয়েচেন; সঙ্গে চাকর ও চাকরাণীরা ধামা ও চাঙ্গায়ী নিয়ে পেচু পেচু চলেছে, চিৎপুর রোডে মেঘ কল্লে কাদা হয়, সুতরাং কাদার জন্য পথিকদের চলবার বড়ই কষ্ট কচ্চে; কেউ পয়নালার উপর দিয়ে, কেউ খানার বার দিয়ে, জুতো হাতে করে কাপড় তুলে চলেছেন। আলু পটল! ঘি চাই! গুড় ও ঘোল! ফিরিওয়ালারা চীৎকার কত্তে কতে যাচ্চে; পাছে পাছে মেচুনীরা চুপড়ি মাথায় নিয়ে, হাত নেড়ে, হন হন করে ছুটেছে, কার সঙ্গে মেছোর কাঁধে বড় বড় ভেট্‌কী ও মৌলবীর মত চাঁপদাড়ী ও জামাজোড়া-পরা চিংড়িভরা বাজরা ও ভার। রাজার বাজার, লালাবাবুর বাজার, পোস্তা ও কাপুড়েপটি জনতায় পরিপূর্ণ। দোকানে বিবিধ সামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে, দোকানদারেরা ব্যতিব্যস্ত, খদ্দেরদের বেজায় ভিড়। শীতলঠাকুর নিয়ে ডোমের পণ্ডিত মন্দিরার সঙ্গে গান করে ভিক্ষা কচ্চে, খঞ্জনী ও একতারা নিয়ে বষ্টম ও নেড়ানেড়িরা গান কচ্চে; চার পাচজন ‘তিন দিবস আহার হয় নাই’ ‘বিদেশী ব্রাহ্মণকে কিছু দান কর দাতালোক!’ বলে ঘুরচে। অনেকের মৌতাতের সময় উত্তীর্ণ হয়েচে; অন্য কোন উপায় নাই, কিছু উপার্জনও হয় নাই, মদওয়ালাও ধার দেওয়া বন্ধ করেচে, গত কল গায়ের চাদরখানিতে চলেচে–আজ আর সম্বলমাত্র নাই। ম্যাথরেরা ময়লা ফেলে এসে মদের দোকেনে ঢুকে কসে রম টানছে, ও মুদ্দাফরাসদের সঙ্গে উভয়ের অবলম্বিত পেশার কোন্‌টা উত্তম, তারি তক্‌বার হচ্ছে। শুঁড়ি মধ্যস্থ হয়ে কখন মুদ্দাফরাশের কাজটাকে ম্যাথরের পেশা হতে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করে, মুদ্দাফরাশকে সন্তুষ্ট কচ্চেন; কখন ম্যাথরের পেশাটাকে শ্রেষ্ঠ বলে মানচেন! ঢুলি, ডোম, কাওয়া ও দুলে বেহারারা কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধের ন্যায় উভয় দলের সহায়তা কচ্চে। হয় ত এমন সময়ে একদল ঝুমুর বা গদাইনাচ আসরে উপস্থিত হবামাত্র, তর্কাগ্নিতে একবারে জল দেওয়া হলো-মদের দোকান বড়ই সরগরম। সহরের দেবতারা পর্য্যন্ত রোজগেরে। কালী ও পঞ্চানন্দ প্রসাদী পাঁঠার ভাগা দিয়ে বসেছেন; অনেক ভদ্দরলোকের বাড়ী উঠনো বরাদ্দ করা আছে; কোথাও রসুই করা মাংসেরও সরবরাহ হয়; খদ্দের দলে মাতাল, বেণে ও বেশ্যাই বারো আনা। আজকাল পাঁঠা বড় দুষ্প্রাপ্য ও অগ্নিমূল্য হওয়ায় কোথাও কোথাও পাঁঠী পর্য্যন্ত বলি হয়; কোন স্থলে পোষা বিড়াল ও কুকুর পর্য্যন্ত কেটে মাংসের ভাগায় মিশাল দেওয়া হয়! যে মুখে বাজারের বসুইকরা মাংস অক্লেশে চলে যায়, সেথায় বিড়াল কুকুর ফেলবার সামগ্রী নয়। জলচর ও খেচরের মধ্যে নৌকা ও ঘুড়ি ও চতুম্পদের মধ্যে কেবল খাট খাওয়া নাই।

পাঠকগণ! এতক্ষণ আপনাদের প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দের গাড়ী রেলওয়ে টরমিনসে পৌঁছুলে প্রায় দেখুন! আপনাদের বৈঠকখানার ঘড়ী নটা বাজিয়ে দিয়ে, পুনরায় অবিশ্রান্ত টুকটাক করে চলছে, আপনারা নিয়মাতিরিক্ত পরিশ্রম করে ক্লান্ত হন, চন্দ্র ও সূর্য্য অস্তাচলে আরাম করেন, কিন্তু সময় এক পরিমাণে চলচে, ক্ষণকালের তরে অবসর, অবকাশ বা আরামের অপেক্ষা বা প্রার্থনা করে না। কিন্তু হায়! আমরা কখন কখন এই অমূল্য সময়ের এমনই অপব্যয় করে থাকি, শেষে ভেবে দেখে তার জন্য যে কত তীব্রতর পরিতাপ সহ্য কত্তে হয়, তার ইয়ত্তা করা যায় না।

এদিকে সেই ছক্কড়ের ভিতরে সেই ব্রাহ্মবাবুর শেষে থপ করে জ্ঞানানন্দের কোলে বসে পড়লেন; ব্রাহ্মবাবুর চাপনে জ্ঞানানন্দ মৃতপ্রায় হয়ে গুড়িশুড়ি মেরে গাড়ীর পেনেলসই হয়ে রইলেন; বাবু সরে সামলে বসে খানিক একদৃষ্টে প্রেমানন্দের পানে চেয়ে ফিক করে হেসে, রেলওয়ে ব্যাগটি পায়দানে নাবিয়ে, জ্ঞানানন্দের দিকে একবার কটাক্ষ করে নিয়ে পকেট হতে প্রেসিডেন্সি মেডিকেল হল লেবেল দেওয়া একটি ফায়েল বার করে, শিশির সমুদার আরকটুকু গলায় ঢেলে দিয়ে খানিক মুখ বিকৃত করে, রুমালে মুখ মুচে, জামার জেল হতে দু ডুমে সুপুরি বন্ধ করে চিবুতে লাগলেন। প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দ ব্রহ্মবাবুর গাড়ীতে ওঠাতে বড় বিরক্ত হয়েছিলেন এবং উভয়ে আড়ষ্ট হয়ে তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ কত্তেছিলেন, কারণ বাবুর একটি কালো বনাতের পেণ্টুলেন ও চাপকান পরা ছিল। তার উপর একটা নীল মেরিনের চায়নাকোট, মাথায় একটা বিভর হেয়ারের চোঙ্গাকাঁটা ট্যাসল লাগানো ক্যাটিকৃষ্ট ক্যাপ ও গলায় লাল ও হলদে জালবোনা কম্ফর্টার, হাতে একটা কার্পেটের ব্যাগ ও একটা বিলিতী ওকের গাঁট বাহির করা কেঁদো কোঁৎকা, এতদ্ভিন্ন বাবুর সঙ্গে একটা ওয়াচ ছিল, তার নিদর্শন স্বরূপ একটি চাবি ও দুটি শিল চুলের গার্ডচেনে ঝুলচে। হাতের আঙ্গুলে একটি আংটিও পরা ছিল, জ্ঞানানন্দ ঠাউরে ঠাউরে দেখলেন যে, সেটির ওপরে ওঁ তৎ সৎ’ খোদা রয়েছে। ব্রাহ্মবাবু আরকের ঝাঁজ সামলে প্রেসিডেন্সি ডাক্তারখানার লেবেল মারা ফায়েলটা গাড়ী হতে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে দেখলেন, প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দ একদৃষ্টে তার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ কচ্চেন। সুতরাং কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে একটু মুচকে হেসে জ্ঞানানন্দকে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “প্রভু আপনার নাম?” জ্ঞানানন্দবাবুকে তার দিকে ফিরে কথা কবার উদ্যম দেখেই শঙ্কিত হয়েছিলেন, এখন প্রথম একবার একটিপ নস্য নিলেন, শামুকটা বার দুচ্চার টুকলেন, শেষে অতিকষ্টে বল্লেন, “আমার নাম পুঁচ করেচেন ঞ আমার নাম শ্রীজ্ঞানানন্দ দাস দেব, নিবাস শ্ৰীপাট কুমারনগর।” মাতালবাবু নাম শুনে পুনরায় একটু মুচকে হেসে জিজ্ঞাসা কল্লে, “দেব বাবাজীর গমন কোথায় হবে,” জ্ঞানানন্দ এ কথার কি উত্তর দিবেন তা স্থির কত্তে না পেরে প্রেমানন্দের মুখপানে চেয়ে রহিলেন। প্রেমানন্দ জ্ঞানানন্দ হতে চালাক চোস্ত ও ধড়িবাজ লোক; অনেকস্থলে পোড়খাওয়া হয়েচে, সুতরাং এই অবসরে বল্লেন, “বাবু আমরা দুই জনেই গোঁসাইগগাবিন্দ মানুষ। ইচ্ছা, বারাণসী দর্শন করে বৃন্দাবন যাব, বাবুর নাম?” মাতালবাবু পুনরায় কিঞ্চিৎ হাসলেন ও পকেট হতে দু ডুমো সুপুরি মুখে দিয়ে বল্লেন, “আমার নাম কৈলাসমোহন, বাড়ী এইখানেই, কৰ্ম্মস্থানে যাওয়া হচ্ছে।” প্রেমানন্দবাবুর নাম শুনে কিঞ্চিৎ গম্ভীর ভাব ধারণ করে বল্লেন, “ভাল ভাল, উত্তম!” ব্রহ্মবাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা কল্লেন, “দেব বাবাজী কি আপনার ভ্রাতা?” এতে প্রেমানন্দ বল্লেন, “হাঁ বাপু, একপ্রকার ভ্রাতা বল্লেও বলা যায়; বিশেষতঃ সহধর্মী; আরো জ্ঞানানন্দ ভায়া বিখ্যাত বংশীয়—পূজ্যপাদ জয়দেব গোস্বামী ওনার পূৰ্ব্বপিতামহ।” মাতালবাবু এই কথায় ফিক করে হাসলেন ও প্রেমানন্দকে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “উনি তো জয়দেবের বংশ, প্রভু কার বংশ? বোধ হয়, নিতাই চৈতন্যের স্ববংশীয় হবেন!” এই কথায় রহস্য বিবেচনায় প্রেমানন্দ চুপ করে গোঁ হয়ে বসে রইলেন; মনে মনে যে যার পর নাই বিরক্ত হয়েছিলেন, তা তাঁর মুখ দেখে ব্রাহ্মবাবু জানতে পেরে, অপ্রস্তুত হবার পরিবর্তে বরং মনে মনে আল্লাদিত হয়ে, বাবাজীদের যথাসাধ্য বিরক্ত কত্তে কতনিশ্চয় হয়ে, প্রেমানন্দের দিকে ফিরে বল্লেন, “প্রভু! দিব্বি সেজেচেন। সহসা আপনারে দেখে আমার মনে হচ্ছে, যেন কোথাও যাত্রা হবে, আপনারা সেজে গুঁজে চলেছেন। প্রভু একটি গান করুন দেখি, মধ্যে আপনাদের ভানের ধমকে তো একবার রাস্তায় মহামারী ব্যাপার ঘটে উঠেছিল; দেখা যাক, আবার কি হয়। শুনেচি, প্রভু সাক্ষাৎ তানস্থান।” প্রেমানন্দের সঙ্গে বাবুর এই প্রকার যত কথাবার্ত্তা হচ্ছে, জ্ঞানানন্দ ততই ভয় পাচ্চেন ও মধ্যে মধ্যে গাড়ীর পার্শ্ব দিয়ে দেখছেন, রেলওয়ে টরমিনস কত দূর; শীঘ্র পৌঁছুলে উভয়ের এই ভয়ানক বেল্লিকের হাত হতে পরিত্রাণ হয়।

এদিকে ব্রাহ্মবাবুর কথায় প্রেমানন্দ বড়ই শঙ্কিত হতে লাগলেন; ছেলেবেলা তার মাতাল, ঘোড়া ও সাহেবদের উপর বিজাতীয় স্মৃণা ও ভয় ছিল; তিনি অনেকবার মাতালের ভয়ানক অত্যাচারের গল্প শুনেছিলেন, একবার একজন মাতালবাবু তার কপালের তিলকমাটির হরিমন্দিরটি জিভ দিয়ে চেটে নিয়েছিলো। কিছু দিন হলো—আর এক প্রিয়ত্যি একটা বেতো ঘোড়ার নার্থিতে অসময়ে প্রাণত্যাগ করেন। সুতরাং তিনি অতি বিনীতভাবে বল্লেন, “বাবু! আমরা গোঁসাইগোবিন্দ লোক, সঙ্গীতের আমরা কি ধার ধারি? তবে ‘প্রেমসে কহে রাধাবিনোদ’ হরিভক্তের প্রেমের তারই প্রেমে দুটো সংকীৰ্ত্তন করে মনকে শান্তা করে থাকি।” ক্রমে ব্রাহ্মবাবু সেই ক্ষণমাত্ৰসেবিত আরকের তেজ অনুভব কত্তে লাগলেন, ঘাড়টি দুলতে লাগলো, চক্ষু দুটি পাকলো হয়ে জিভ কথঞ্চিৎ আড় হতে লাগলো; অনেকক্ষণের পর ‘ঠিক বলেচো বাপ!’ বলে গাড়ীর গদী ঠেস দিয়ে হেলে পড়লেন এবং খানিকক্ষণ এই অবস্থায় থেকে পুনরায় উঠে প্রেমানন্দের দিকে ওৎ করে ঝুঁকতে লাগলেন ও শেষে তার হাতটি ধরে বল্লেন, “বাবাজি! আমরা ইয়ার লোক, প্রাণ গড়ের মাঠের মত খোলা! শোনো একটা গাই, আমিও বিস্তর ঢপের গীত জানি; প্রভুর সেবাদাসী আছে তো?” এই কথা বলে হা! হা! হা! হেলে টলে জ্ঞানানন্দের মুখের উপর পড়ে, হাত নেড়ে চীৎকার করে, এই গান ধরলেন,–

চায় মন চিরদিন পূজিতে সেই পুতুলে।
রং-চঙ্গে চক্‌চকে, সাধে কি ছেলে ভুলে।।
ডাক রাং অভর চিক্‌মিক্‌ ঝিক্‌মিক্‌ করে।
তায় সোণালী রূপালী চুমকি বসান আলো করে।।
আহ্লাদে পেহ্লাদে কেলে, তামাকখেগো বুড়ো ফেলে।
কও কেমনে রহিব, খেলাঘর কিসে চলে।
চিরপরিচিত প্রণয় সহজে কি ভগ্ন হয়।
থেকে থেকে মন ধায় চোরাসিঙ্গী পাটের চুলে।।
শর্ম্মার সাহস বড়, ভুতের নামে জড়োসড়ো,
ঘরে আছেন গুণবতী গঙ্গাজলে গোবর গুলে।

সঙ্গীত শেষ হবার পূর্ব্বেই কেরাঞ্চী রেলওয়ে টরমিনসে উপস্থিত হলো! ব্রাহ্মবাবু টলতে টলতে গাড়ী থাম্‌বার পূর্ব্বেই প্রেমানন্দের নাকটা খামচে নিয়ে ও জ্ঞানানন্দের চুলগুলা ধরে, গাভী হতে তড়াক করে লাফিয়ে পড়লেন।

আজ আরমাণি ঘাট লোকারণ্য : গাড়ী-পাল্কীর যেরূপ ভিড়, লোকেরও সেইরূপ রল্লা। বাবাজীর সেই ভিড়ের মধ্যে অতি কষ্টে কেরাঞ্চী হতে অবতীর্ণ হলেন। তল্পিদার ছড়িদার সেবাৎ ও শিষ্যেরা পরস্পরের পদানুরূপ ‘প্রোসেসন’ বেঁধে প্রভুদ্বয়কে মধ্যে করে, শ্রেণী দিয়ে চল্লেন। জ্ঞানানন্দ ও প্রেমানন্দ হাত ধরাধরি করে হেতে দুলতে যাওয়ায় বোধ হতে লাগলো যেন, একটা অরশুলা ও কাঁচাপোকা একত্র হয়ে চলেছে।

টুনুনাং ণ্টাং টুনুনাং ণ্টাং করে রেলওয়ে ষ্টিম ফেরী ময়ূরপঙ্খীর ছাড়বার সঙ্কেত-ঘণ্টা বাজচে, থার্ডক্লাস বুকিং অফিসে লোকের ঠেল মেরেচে; রেলওয়ের চাপরাসীরা সপাসপ বেত মাচ্চে, ধাক্কা দিচ্চে ও গুঁতো লাগাচ্ছে; তথাপি নিবৃত্তি নাই। ‘মশাই শ্রীরামপুর!’ ‘বালি বালি!’ ‘বর্দ্ধমান মশাই।’ ‘আমার বর্দ্ধমানেরটা দিন না,’ ইত্যাদি রূপ শব্দ উঠচে, চারিদিকে কাঠের বেড়াঘেরা, বুকিং ক্লার্ক সন্ধিপূজার অবসরমতে ঝোপ বুঝে কোপ ফেলচেন! কারো টাকা নিয়ে চার আনার টিকিট ও দুই দোয়ানি দেওয়া হচ্ছে, বাকি চাবামাত্র ‘চোপ রও’ ও ‘নিকালো,’ কারো শ্রীরামপুরের দাম নিয়ে বালির টিকিট বেরুচ্চে, কেউ টিকিটের দাম দিয়ে দশ মিনিট চীৎকার কচ্চে, কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র নাই। কর্ত্তা কম্ফটর মাথায় জড়িয়ে ঝড়াক ঝড়াক করে কেবল টিকিটে নম্বর দেবার কল নাড়চেন, সিস দিচ্চেন ও উপরি পয়সা পকেটে ফেলছেন। পাইখানার কাটা দরজার মত ক্ষুদে জানালাটুকুতে অনেকে হুজুরের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না যে, কথা কয়ে আপনার কাজ সারবে! যদি কেহ চীৎকার করে, ক্লার্কবাবুর চিত্তাকর্ষণ কত্তে চেষ্টা করে, তবে তখনি রেলওয়ে পুলিসের পাহারাওয়াল ও জমাদারো গলা টিপে তাড়িয়ে দেবে। এদিকে সেকেণ্ডক্লাস ও গুড্‌স লগেজ ডিপার্টমেন্টেও এইপ্রকার গোল; সেখানে ক্লার্কবাবুরাও কতক এই প্রকার, কিন্তু এত নয়। ফাষ্টক্লাস সাহেব বিবির স্থলে সেখানে টুঁ শব্দটি নাই, ক্লার্ক রিক্তহস্তে টিকিট বেচতে আসেন ও সেইমুখেই ফিরে যান; পান তামাকের পয়সারও বিলক্ষণ অপ্রতুল থাকে। বাবাজীর নটবরবেশে থার্ডক্লাস বুকিং আফিসের নিকট যাচ্চেন, এমন সময় টনাং ণ্টাং টুনুনাং ণ্টাং শব্দে ঘণ্টা বেজে উঠলো, ফোঁস ফোঁস শব্দে ষ্টিমারের ষ্টিম ছাড়তে লাগলো। লোকেরা রল্লা বেঁধে জ্যেটি দিয়ে ইষ্টিমারে উঠতে লাগলো। “জলদি! চলো চলো!” শব্দে রেলওয়ে পুলিসের লোকেরা হাঁকতে লাগলো। বাবাজীরা অতি কষ্টে সেই ভিড়ের মধ্যে ঢুকে টিকিট চাইলেন। বুকিং ক্লার্ক বাবাজীদের চেহারা দেখে ফিক করে হেসে হাত বাড়িয়ে টাকা চেয়ে টিকিট কাটতে লাগলেন। এদিকে ঝ্যপ ঝ্যপ ঝ্যপ শব্দে ইষ্টিমারের হুইল ঘুরে ছেড়ে দিলে। এদিকে প্রেমানন্দ, “মশাই টিকিটগুলি শীঘ্ৰ দিন, শীঘ্র দিন, ইষ্টিম খুল্লো, ইষ্টিম চল্লো,” বলে চীৎকার কত্তে লাগলেন। কিন্তু কাটাকপাটের হুজুরের ভ্রূক্ষেপ নাই; সিস দিয়ে মদন আগুন জ্বচে দ্বিগুণ কল্লে কি গুণ ঐ বিদেশী গান ধরলেন। ‘মশাই শুনচেন কি? ইষ্টিম খুলে গেল, এর পর গাড়ী পাওয়া ভার হবে, এ কি অত্যাচার মশাই।’ প্রেমানন্দের মুখে বারবার এই কথা শুনে, ক্লার্ক ‘আরে থামো না ঠাকুর’ বলে, এক দাবড়ি দিয়ে অনেকক্ষণের পর কাটাদরজা হতে হাত বাড়িয়ে টিকিটগুলি দিয়ে দরজাটি বন্ধ করে পুনরায় ‘ইচ্ছা হয় যে প্রাণ সঁপে সই হইগে দাসী, মদন আগুন’ গান ধল্লেন। প্রেমানন্দ বল্লেন, ‘মশাই বাকী পয়সা দিন, বলি দরজা দিলেন যে?’ সে কথায় কে ভ্রূক্ষেপ করে? জমাদার ‘ভিড় সাফ করো, নিকালে নিকালো’ বলে ক্লার্ক সেই কাটগড়ার ভিতর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন; রেল-পুলিসের পাহারাওয়ালা ধাক্কা দিয়ে বাবাজীদের দলবলসমেত টর্‌মিনস হতে বার করে দিলে–প্রেমানন্দ মনে মনে বড়ই রাগত হয়ে মধ্যে মধ্যে ফিরে ফিরে বুকিং অফিসের দিকে চাইতে লাগলেন। এদিকে ক্লার্ক কাটাদরজার ফাটল দিয়ে, মদন আগুনের শেষটুকু গাইতে গাইতে, উঁকি মাত্তে লাগলেন।

বাবাজীরা কি করেন, অগত্যা টরমিনস পরিহার করে, অন্য ঘাটে নৌকার চেষ্টায় বেরুলেন–ভাগ্যক্রমে সেই সময়ে পাশের ঘাটের গহনার ইষ্টিমারখানি খোলে নাই। বাবাজীরা আপনাপন অদৃষ্টকে ধন্যবাদ দিয়া অতিকষ্টে সেই ইষ্টিমারে উঠে পেরিয়ে পড়লেন। গহনার ইষ্টিমারে অসংখ্য লোক ওঠাতে বাবাজীরা লোকের চপটানে ছাপাখানার ‘হটপ্রেসের ফরমার’ মত ও পাটকষা ইঙ্কু কলের গাঁটের মত, জাত সহ্য করে, পারে পড়ে কথঞ্চিৎ আরাম পেলেন এবং নদীতীরে অতি অল্পক্ষণ বিশ্রাম করেই, এষ্টেশনে উপস্থিত হলেন। টুনুনাং টাং টুনুনাং স্টাং শব্দে একবার ঘণ্টা বাজলো। বাবাজীরা একবার ঘণ্টা বাজার উপেক্ষা করার ক্লেশ ভুগে এসেছেন। সুতরাং এবার মুকিয়ে তল্পিতল্পা নিয়ে ট্রেণের অপেক্ষা কত্তে লাগলেন-প্রেমানন্দ ঘাড় বাঁকিয়ে ট্রেণের পথ দেখছেন, জ্ঞানানন্দ নস্য লবার জন্য শামুকটা ট্যাঁক হতে বার করবার সময়ে দেখেন যে, তাঁর টাকার গেঁজেটি নাই; অমনি ‘দাঁদাঁ সর্ব্বনাশ হঁলো। আঁমার গেঁজেটি নাই’ বলে কাঁদতে লাগলেন। প্রেমানন্দ ভায়ার চীৎকার ক্রন্দনে যার পর নাই শোকার্ত্ত হয়ে, চীৎকার করে গোল কত্তে আরম্ভ কল্লেন; কিন্তু রেলওয়ে পুলিসের পাহারাওয়ালা ও জমাদাবেরা ‘চপরাও’, ‘চপরাও’ করে উঠলো; সুতরাং পাছে পুনরায় এষ্টেশন হতে বার করে দেয়, এই ভয়ে আর বড় উচ্চবাচ্য না করে, মনের খেদ মনেই সম্বরণ কল্লেন। জ্ঞানানন্দ মধ্যে মধ্যে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে লাগলেন ও ততই নন্য নিয়ে শামুকটা খালি করে তুল্লেন।

এদিকে হস্‌ হস্‌ হস্‌ করে ট্রেণ টরমিন্‌সে উপস্থিত হলো, টুনাং ণ্টাং, টুনাং ণ্টাং করে পুনরায় ঘণ্টা বাজলো; লোকেরা বল্লা করে গাড়ী চড়তে লাগলে, থার্ডক্লাসের মধ্যে গার্ড ও দুজন বরকন্দাজের সহায়তায় লোক পোরা হতে লাগলো; ভিতর থেকে ‘আর কোথা আসচো।’ ‘সাহেব আর জায়গা নাই!’ ‘আমার বুঁচকি! ‘আমার বুচকিটা দাও’ ‘ছেলেটি দেখো’, ‘আ মলো মিন্সে! ছেলের ঘাড়ে বসেছিস যে?’ ইত্যাদিরূপ চীৎকার হতে লাগলো, কিন্তু রেলওয়ে কর্ম্মচারীরা বিধিবদ্ধ নিয়মের অনুগত বলেই তাদৃশ চীৎকারে কর্ণপাত কল্লেন না। এক একখানি থার্ডক্লাস কাকড়ার গর্ত্তের আকার ধারণ কল্লে, তথাপিও মধ্যে মধ্যে দু-একজন এষ্টেশনমাষ্টার ও গার্ড গাড়ীর কাছে এসে উঁকি মাচ্চেন—যদি নিশ্বাস ফেলবার স্থান থাকে; তা হলে আরও কতকগুলো যাত্রীকে ভরে দেওয়া হয়। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর যে সকল হতভাগ্য ইংরাজ ব্লাকহোলের যন্ত্রণা হতে জীবিত বেরিয়েছিলেন, তারা এই ইষ্ট ইণ্ডিয়ান কোম্পানীর থার্ডক্লাস দেখলে, একদিন, একদিন এদের এজেন্ট ও লোকোমোটিব সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টকে সাহস করে বলতে পাত্তেন যে, “আপনাদের থার্ডক্লাস-যাত্রীদের ক্লেশ ব্লাকহোলবদ্ধ সাহেবদের যন্ত্রণা হতে বড় কম নয়!”

এদিকে প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দও দলবল নিয়ে একখানি গাড়ীতে উঠলেন, ধপাধপ গাড়ীর দরজা বন্ধ হতে লাগলো ‘হরকরা চাই মশাই! হরকরা হরকরা-ডেলিনুসার। ডেরিনুস!’ এইরূপ চীৎকার কত্তে কত্তে কাগজ হাতে নেড়েরা ঘুরছে-–“লাবেল! ভাল লাবেল!” এই বলে লাল খেরোর দোবুজান কাঁধে হকার চাচারা বই বেচ্চেন। টুনুনাং ণ্টাং, টুনুনাং ণ্টাং করে পুনরায় ঘণ্টা বাজলো, এষ্টেশনমাষ্টার খুদে সাদা নিশেন হাতে করে মাথায় কার জড়িয়ে বেরুলেন; “অলরাইট বাবু! বলে গার্ড হুজুরের নিকটস্থ হলো ‘অলরাইট গুডমর্ণিঙ স্যার’ বলে এষ্টেশনমাষ্টার নিশেনটা তুল্লেন—এঞ্জিনের দিকে গার্ড হাত তুলে, যাবার সঙ্কেত করে, পকেট হতে খুদে বাঁশীটি নিয়ে সিসের মত শব্দ কল্লে; ঘটাঘট্‌ ঘটাস্‌ ঘড় ঘড় ঘটাস্‌ শব্দে গাড়ী নড়ে উঠে হস্‌ হস্‌ হস্‌ করে বেরিয়ে গেল।

এদিকে বাবাজীরা চাটগাঁ ও চন্দননগরের আমদানী পেরু ও মোরোগের মত থার্ডক্লাসে বদ্ধ হয়ে বিজাতীয় যন্ত্রণাভোগ কত্তে কত্তে চল্লেন—জ্ঞানানন্দ বাবাজীর মুখের কাছে দু’জন পেঁড়োর আয়মাদার আবক্ষ-লম্বিত শ্বেতশ্মশ্রু সহ বিরাজ করায় রোসুনের সৌরভে জয়দেবের বংশধর যার পর নাই বিরক্ত হয়েছিলেন! মধ্যে মধ্যে আয়মাদারের চামরের মত দাড়ি বাতাসে উড়ে জ্ঞানানন্দের মুখে পড়ছে, জ্ঞানানন্দ ঘণীয় মুখ ফেরাবেন কি পেছন দিকে দুজন চীনেম্যান হাতরুমালে খানার ভাত ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেমানন্দ গাড়ীতে প্রবেশ করেচেন বটে কিন্তু তখনো পদার্পণ কত্তে পারেন নাই। একটা ধোপর মোটের সঙ্গে ও গাড়ীর পেনেলের সঙ্গে তার ভুঁড়িটি এমনি ঠেস মেরে গেছে যে, গাড়ীতে প্রবেশ করে অবধি তিনি শূন্যেই রয়েচেন! মধ্যে মধ্যে ভুঁড়ি চড়চড় কলে এক একবার কারু কাঁধ ও কারু মাথার ওপোর হাত দিয়ে অবলম্বন কত্তে চেষ্টা কচ্চেন, কিন্তু ওৎ সাবস্ত হয়ে উঠছে না, তার পাশে পাশে এক মাগী একটি কচি ছেলে নিয়ে দাঁড়িয়েছে, বাবাজী হাত ফ্যালবার পূর্ব্বেই মাগী ‘বাবাজী কর কি, আমার ছেলেটি দেখো’ বলে চীৎকার করে উঠচে, অমনি গাড়ীর সমুদায় লোক সেইদিকে দৃষ্টিপাত করায় বাবাজী অপ্রস্তুত হয়ে হাত দুটি জড়োসড়ো করে ধোপার বুঁচকী ও আপনার ভুঁড়ির ওপর লক্ষ্য কচ্চেন —ঘৰ্ম্মে সর্ব্বাঙ্গ ভেসে যাচ্চে। গাড়ীর মধ্যে একদল ‘গঙ্গাভক্তি-তরঙ্গিণী’ যাত্রার দল ছিল, তার মধ্যে একটা ফোচকে ছোঁড়া, ‘বাবাজীর ভুঁড়িটা বুঝি ফেঁসে যায়’ বলে, পাপিয়ার ডাক ডেকে ওঠায় গাড়ীর মধ্যে একটা হাসির গর্‌রা পড়ে গেল। “প্রভো! তোমার ইচ্ছা” বলে, প্রেমানন্দ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। এদিকে গাড়ী ক্রমে বেগ সম্বরণ করে থামলো, বাইরে ‘বালি! বালি। বালি!’ শব্দ হতে লাগলো।

বালি একটা বিখ্যাত স্থান! টেকচাঁদের বালির বেণীবাবুও বিখ্যাত লোক —“আলালের ঘরের দুলাল” মতিলাল বালি হতেই তরিবত পান; বিশেষতঃ বালির ব্রিজটাও বেশ! বালির যাত্রীরা বালিতে নাবলেন। ধোপা ও গঙ্গাভক্তির দলটা বালিতে নাবায়, প্রেমানন্দও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। দলের ছোঁড়াগুলো নাব্বার সময় প্রেমানন্দের ভুঁড়িতে একটা করে চিমটি কেটে গেল। উত্তরপাড়া বালির লাগোয়া। আজকাল জয়কৃষ্ণের কল্যাণে উত্তরপাড়া বিলক্ষণ বিখ্যাত স্থান। বিশেষতঃ উত্তরপাড়ার মডেল জমিদারের নর্ম্ম্যাল স্কুল প্রায় স্কুলের কোর্সলেকচরের ডিগ্রী ও ডিপ্লোমা-হোল্‌ডার; শুনতে পাই, গুরুজীর দু-একটি ছাত্র প্রকৃত বেয়াল্লিশকর্ম্মা হয়ে বেরিয়েছেন।

ক্রমে ষ্টেশনের রেলকাটা ঘণ্টা টুং টাং টাং আওয়াজ দিলে অরোহীরা টিকিটঘরের দরজা খুঁজে না পাওয়াতে কুলি, মজুর, চাপরাসী এবং আরোহীদের জিজ্ঞাসা কচ্চেন, “মশায়! টিকিট কোথায় পাওয়া যায়?” তার মধ্যে একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ, বোধহয় কলিকাতার সিঙ্গি মহাশয়দের বাড়ীতে পূজার বার্ষিক এবং একখানি পেতলের থালা মায় চিনি সমেত পাবার প্রত্যাশায়, কলকাতায় আসছিলেন। তিনি বল্লেন, “এই ঘরে টিকিট পাওয়া যায়, তা কি তুমি জান না?” তাদের মধ্যে একটি নব্যবয়স্ক বালক ঠাকুরমার গলার একগাছি দানা এবং দাদা মহাশয়ের আমলের রূপার পুরাতন পৈঁচে, কাণের একটি পাশা ও কতকগুলি টাকা, কাপড়চোপড়, প্রভৃতি খাবার-দাবার, শিশি বোতল ইত্যাদিতে পূর্ণিত একটি ব্যাগ হস্তে দৌড়ে বাড়াচ্ছেন। প্রতুদিগের গাড়ীতে কিঞ্চিৎ স্থান দেখে অতি কুষ্ঠিতভাবে বল্লেন, “দয়াময় যদি অনুগ্রহ করে এই গাড়ীতে আমাকে একটু স্থান দেন?” বেচারীর অবস্থা ও উৎকণ্ঠিত চেহারা দেখিয়া জ্ঞানানন্দ ও প্রেমানন্দ বাবাজী বল্লেন, “বাবু, তুমি এই গাড়ীতে এস।” বালকটি অতি কুষ্ঠিতভাবে জিজ্ঞাসা কল্লেন, “মহাশয়! আপনারা কে এবং কোন বংশ?” তাতে জ্ঞানানন্দ ও প্রেমানন্দ উত্তর কল্লেন, “বাবু, আমরা বৈষ্ণব—নিত্যানন্দবংশ।” এই কথা শ্রবণমাত্র বালকটি গোস্বামী জ্ঞান করে সাষ্টাব্দ হয়ে তাদের পদধূলি নিতে উদ্যত হলেন; কিন্তু গলদেশে পৈতা দেখে বাবাজীরা নিষেধ করে বল্লেন, “হাঁ হাঁ, আমরা বৈষ্ণব, তুমি ব্রাহ্মণ দেখচি।” বালক বল্লে, “আপনারা বৈষ্ণব হউন, তাতে কোন ক্ষতি নেই, আপনাদের আচরণ দেখে আমার এতদূর পর্য্যন্ত ভক্তি জন্মেছিল যে, আপনাদের পদধূলি লই।”

প্রেমানন্দ বল্লেন, “হাঁ-হাঁ-হাঁ বাপু, স্থির হও; বাপু, তুমি কোথায় যাবে, কোন ষ্টেশনে তুমি নাব্বে?”

বালক। “আজ্ঞে আমি জামাই-ষ্টেশনে নাব্বো।”

প্রেমা। “বাপু, জামাই-ষ্টেশন কোন জেলায়?”

বালক। “প্রভু! আপনি এত বড় বিদ্যাদিগগজ, অদ্যাবধি জামাই-ষ্টেশন কাকে বলে জানেন না?”

প্রেমা। “বাপু, আমাদের রেলে গতিবিধি অতি বিরল। কালে-ভদ্রে কখন কখন নবদ্বীপ অঞ্চলে গিয়া থাকি। কুলের মহাপ্রভু পাট এবং শ্রীপাট খড়দহে শ্যামসুন্দরের পাদপদ্ম দর্শন মানসে যাওয়া আসা হয়, এই মাত্র। তবে নূতন রেলগাড়ী খোলাতে বিশ্বনাথ এবং গোবিনজী গোপীনাথের শ্রীপাদপদ্ম দর্শন করবার মনন করেছি। তা এখন কত দূর কি হয়, তা বলিতে পারি না।”

বালক রেলওয়ে হুইশিল ও গাজ মোশন কম দেখিয়া মনে মনে বিবেচনা কল্লে যে, এইবার আমার নিকটবর্ত্তী ষ্টেশনে নামিতে হইবে। পরে বাবাজীদের দিকে চেয়ে একটু মুচকি হেসে বলে, “জামাই-ষ্টেশন কাহাকে বলে এই দেখুন, যেখানে আমি নামিয়া যাইব, অর্থাৎ কোন্নগর ষ্টেশন। এই স্থানে অনেক ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থের পুত্রকন্যার বিবাহ হয় এবং সময়ে সময়ে অনেক অফিসের কর্ম্মচারী জামাইবাবুরা এই ষ্টেশনে অবতীর্ণ হন, সেই কারণে কোন্নগর ষ্টেশনকে জামাই ষ্টেশন বলা হয়।”

ক্রমে গাড়ী প্ল্যাটফরমে এসে পড়লো, চড়কগাছের মত মস্ত বাহাদুরী কাঠের উপরে ডান হাতে বাঁ হাতে তোলা দুখানি তক্তা এবং রেড, গ্রীন, হোয়াইট লাইটের প্ল্যাস দেওয়া ল্যাম্পগুলি যথাস্থানে রাখা হয়েচে। আরোহীরা নামিয়া গেল ও উঠিল। গার্ড একবার ব্রেকভ্যান থেকে নেমে এসে, ষ্টেশনমাষ্টার, বুকিং ক্লার্ক ও সিগনালারের সঙ্গে খানিক হাসি-মস্করা করে, রেলওয়ের চামড়ানির্ম্মিত লেটার ব্যাগ এবং পার্শ্বেল ইত্যাদি সমস্ত ব্রেকভানে তুলে নিয়ে বল্লেন, ‘ওয়েল হাউফার?’ কাল চাপকান পরা, মাথায় কাল টুপিতে “ই, আই, আর” লেখা, নিগুঁপো নাটাগড়ে আমদানী পাড়াগেঁয়ে বাবু ঈষৎ হাস্য করে বল্লেন, “চাপরাসি! ঠিক হয়, ঘণ্টা মারো।” ষ্টেশনমাষ্টারের অর্ডারে রেলকাটা তারে ঝোলান ঘণ্টা একটি লোহার হাতুড়ী দ্বারা আহত হয়ে টং টং টং করে আওয়াজ দিলে। ষ্টেশনমাষ্টার আপন গলার মালাগাছটি লজ্জাসহকারে আপন চাপকানের ভিতর গুঁজতে গুঁজতে অর্ডার দিলেন, ‘অলরাইট।’ সে অপ্রতিভ ভাবটি শুধু চাপানের প্রথমের বোতামটি ছিঁড়িয়া যাওয়ার জন্য ঘটেছিল, নচেৎ মালাগাছটি কেউ দেখতে পেত না। কাটা পোষাকের উপর দৃশ্যমান মালাগাছটি বাবুকে একটু লজ্জা দিচ্ছিল, তাইতে তিনি সেটি লুকোবার চেষ্টায় ছিলেন।

ক্রমে রেলগাড়ী হুস্‌ হুস্‌ করে চলতে লাগলো। জ্ঞানানন্দ এবং প্রেমানন্দ বাবাজীদের যেন দোলায় চড়া ছেলের মত নিদ্রা আকর্ষণ হলো; কখনো বা ঘোর, কখনো বা জাগ্রত। এই প্রকার অবস্থায় রেলগাড়ী বরাবর চলে গিয়ে মধ্যবর্ত্তী ছোট ষ্টেশনে অল্পক্ষণ দাঁড়াল; সুতরাং সেখানে বেশী কলরব নেই বলে বাবাজীদের নিদ্রাভঙ্গ হলো না। তারপর যখন গাড়ী বর্দ্ধমানে পৌঁছে, সেই সময় বাবাজীদের নিদ্রা ভাঙ্গে।

বর্দ্ধমান ষ্টেশন অতি প্রশস্ত এবং সেখানে বিস্তর জনতা; সেখানে অনেক লোকজনের আমদানী এবং ধানচাল প্রভৃতি মালামালে বেশী হিড়িক! সুতরাং গাড়ী সেখানে বেশীক্ষণ ধরে। ঐ গোলমালে বাবাজীদের নিদ্রাভঙ্গ হয়ে তখন চৈতন্য হলো। প্রেমানন্দ জ্ঞানানন্দকে বল্লেন, “ভায়া! এ কোথায় আসা গেল?”

জ্ঞানানন্দ চক্ষুরুন্মীলন করিয়া কহিলেন, “দাঁদাঁ, কিছুই বুঝতে পাঁচ্ছি নাঞ।”

“পান চুরুট পান চুরুট ডাব চাই! সীতাভোগ, মিহিদানা চাই, বৰ্দ্ধমেনে খাজা।”

“বর্দ্ধমান–বর্দ্ধমান–বর্দ্ধমান!!”

ইত্যাদিরূপ চীৎকার শুনে প্রেমানন্দ জিজ্ঞাসা কল্লেন, “এটা কোন ষ্টেশন বাবু।”

বিক্ৰীওয়ালা। “মশায়! এটা বর্দ্ধমানরাজ; সীতাভেগ, খাজা, জলপান কিঞ্চিৎ চাই?”

প্রেম। “বাপু, এখানে গঙ্গাজল পাওয়া যায়?”

বিকীওয়ালা। (প্রভুত্ব চেহারা দেখিয়া) “প্রভু, এ স্থানে কি গঙ্গাজল মিলে? এখানে সমস্তই পুকুরের জল ব্যবহার হয়।”

প্রেমা। “আচ্ছা তবে থাক্ বাবু।”

জ্ঞানা। “দাঁদাঁ, শুঁনেছি বঁর্দ্ধমান রাঁজটা অঁতি সুঁন্দর স্থাঁন, রাঁজার কাঁণ্ড কাঁরখানা, ঠাকুরবাঁড়ী দেঁবালয় অঁতিথিশালা প্রঁভৃতি নাঁনারঁকম পুঁণ্যাহ কাৰ্য্য আঁছেঞ এঁবং তাঁহাঁর সঁহিত রাঁজার নিঁজ আঁমোঁদেঁর জন্যে গোঁলাবঁ বাঁগ, পঁশুশালা, কাঁচের ঘর প্রভৃতি নাঁনারকঁম দ্রষ্টব্য জিনিষ আঁছেঞ, এঁবং এঁবং ঞ আরও শুঁনিয়াছি, পূঁর্ব্ব রাঁজাদিগের খোদিঁত অঁতি বিস্তৃত পুষ্করিণী আঁছেঞ। এঁই সঁমস্ত আমাদিঁগের দেঁখা নিঁতান্ত আঁবশ্যকঞ; যঁখনঞ এঁতদূর এসেছি তঁখঁন এঁ জীবনে বোঁধ হঁয় আঁরর হঁবে নাঞ।

প্রেমানন্দ বল্লেন, “ভায়া। যাহাদিগের দর্শন প্রার্থনায় এতদূর কষ্ট করে আসা গেছে, তাঁহাদিগের শ্রীপাদপদ্ম-দর্শনই মোক্ষ। যদি প্রভুর ইচ্চায় বেঁচে থাকা যায়, প্রত্যাগমনের সময়ে সমস্ত দ্রব্য দেখিয়া নয়নের সার্থকতা লাভ করে স্বদেশে যাব।”

রেলওয়ের গাড়ী টুং টাং শব্দে সেখান থেকে ছাড়লো। জ্ঞানানন্দ বাবাজী, কথঞ্চিৎ নিদ্রাভ হওয়াতে খানা আওয়াজে, বেঞ্চির উপর শুয়ে একটি গান ধল্লেন।

গান

“যঁদি গৌঁর কৃঁপা কঁর আঁমায় আঁপনার গুণে।
জঁগাই মাঁধাই উঁদ্ধারিতে স্থাঁন দিঁলে শ্ৰীচঁরণে।
যঁদি প্রঁভু কৃপা কঁরে স্থান না দাঁও রাঙ্গাচঁরণে;
এ নামে কঁলঙ্ক রঁবে তোঁমার এ তিন ভুঁবনে॥”

এরূপ গান কর্‌তে কর্‌তে জ্ঞানানন্দ শামুক থেকে একটীপ নস্য নিয়ে ‘দীন দয়াময় প্রভু তোমার ইচ্ছা’ বলে শয়ন কল্লেন। ক্রমে রেলগাড়ী মধ্যবর্ত্তী ছোট ছোট ষ্টেশনে দু’ এক মিনিট থেমে, পূৰ্ব্বকার মত দু’ একজন গরীব রকমের বিক্রীওয়ালা দুটা একটা ডাক দিয়ে চলে গেল। চাপরাশীরা বেলকাটা ঘণ্টায় আওয়াজ দিলে, আরোহী অতি কম। বোধ হয় কোন ষ্টেশনে একজনও হয় না। এইরূপে যেতে যেতে গাড়ী জামালপুরে গিয়ে পৌঁছিলো। পাঠকগণ! জানবেন, এর মধ্যে এমন কোন বিশেষ ষ্টেশন নাই যার বর্ণনা আমরা করি। বাবাজীদের নামবার অবকাশ নাই। ক্রমে গাড়ী জামালপুরে এসে পৌঁছেছে; জামালপুরে গাড়ী অন্ততঃ আধ ঘণ্টা অবস্থান করবে; কারণ জামালপুর ষ্টেশনে ইঞ্জিন, কয়লা, জল ইত্যাদি বদল কত্তে হবে। ইত্যবসরে প্রেমানন্দ ও জ্ঞানানন্দ বাবাজী গাড়ী থেকে অবতীর্ণ হয়ে, একবার ষ্টেশন এবং পাহাড় পর্ব্বত আদির দৃশ্য দর্শন কত্তে গেলেন। গাড়ী অনেকক্ষণ সেখানে থামে। বাবাজীরা ইতস্ততঃ দর্শন করিয়া, গাড়ী ছাড়িয়া যাইবে বলিয়া, তাড়াতাড়ি ষ্টেশনে প্রত্যাগমন করিলেন। আসিয়া দেখিলেন, লালপেড়ে সাড়ীপরা, হাতে একগাছি সাদা শাঁখা একহাতে রুলি একটি স্ত্রীলোক উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতেছে। “ও মা আমার কি হলো, খোকার গলায় মাদুলি কৈ, সম্পূর্ণ কোথায়? ও পিসি। একবার দেখ! মেয়েটা এই যে খোকার হাত ধরে বেড়াচ্ছিল; ও সম্পূর্ণ ও সম্পূর্ণ”—-বলে স্ত্রীলোকটি উচ্চৈস্বরে চীৎকার কত্তে লাগলো। বাবাজীরা আপন কম্পার্টমেন্টে এসে উপস্থিত হয়ে গাড়ীর কাটা দরজা গিয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগলেন। গাড়ীও পূৰ্ব্বেকার মত হস হস করে চলতে লাগলো।

বাবাজীরা যে সকল ইষ্টেশন পার হতে লাগলেন, সেই সকলেরই ইষ্টেশনমাষ্টার, সিগনেলার, বুকিংক্লার্ক ও এপ্রিন্টীসদের এক প্রকার চরিত্র, একপ্রকার মহিমা কেউ মধ্যে মধ্যে অকারণে পুলিসম্যান পুলিসম্যান করে চীৎকার করে, সহসা ভদ্দরলোকের অপমান কত্তে উদ্যত হচ্ছেন। কেউ দুটি গরীব ব্যাওয়ার জীবনসৰ্বস্ব পুটুলিটি নিয়ে টানাটানি কচ্চেন। কোথাও বাঙ্গাল গোচের যাত্রী ও কোমোরে টাকার গেঁজেওয়ালা যাত্রীর টিকিট নিজে পকেটে ফেলে পুনরায় টিকিটের জন্য পেড়াপেড়ি করা হচ্চে–পাশে পুলিসম্যান হাজির। কোন ষ্টেশনের ষ্টেশনমাষ্টার, কম্ফর্টার মাথায় জড়িয়ে চীনে কোটের পকেটে হাত পুরে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্চেন—এপ্রিণ্টীস ও কুলিদের ওপর মিছে কাজের ফরমাস করা হচ্ছে; হঠাৎ হুজুরের কম্যাণ্ডিং আসপেকট দেখে একদিন ‘ইনি কে হে?’ বলে অভ্যাগত লোকে পরস্পর হুইস্‌পর কত্তে পারে। বলতে কি, হুজুর তো কম লোক নন–দি এষ্টেশন মাষ্টার!

সে সকল মহাত্মারা ছেলে-বেলা কলকেতার চীনে বাজারে “কম স্যার। গুড সপ স্যার। টেক্‌ টেক্‌ টেক্ নটেক্‌ নটেক্‌ একবার তো সী!” বলে সমস্ত দিন চীৎকার করে থাকেন, যে মহাত্মারা সেলর ও সোলজারদের গাড়ী ভাড়া করে মদের দোকান, ‘এম্পটিহাউস’ সাতপুকুর ও দমদমায় নিয়ে বেড়ান ও ক্লায়েন্টের অবস্থা বুঝে বিনানুমতিতে পকেট হাতড়ান; কাঁচপোকার আরসুলা ধরবার রূপান্তরের মত তাঁদের মধ্যে অনেকেই চেহারা বদলে ‘দি এষ্টেশন মাষ্টার’ হয়ে পড়েছেন, যে সকল ভদ্দরলোক একবার রেলট্রেণে চড়েছেন, যাদের সঙ্গে একবারমাত্ত এই মহাপুরুষরা কন্‌ট্যাকটে এসেছেন, তাঁরাই এই ভয়ানক কর্ম্মচারীদের নামে সর্ব্বদাই “কমপ্লেন” করে থাকেন। ভদ্দরতা এঁদের নিকটে যেন ‘পুলিসম্যানের’ ভয়েই এগুতে ভয় করেন। শিষ্টাচার ও সরলতার এঁরা নামও শোনেন নাই। কেবল লাল, সাদা, গ্রীন সিগন্যাল, এষ্টেশন, টিকিট ও অত্যাচারই এদের চিরাধ্য বস্তু। ইহাঁরা স্বজাতির অপমান কতেই বিলক্ষণ অগ্রসর ও দক্ষ।

জামালপুর-টানেল পাহাড় ভেদ করে প্রস্তুত একটা রাস্তা; যেমন আমাদিগের দেশে মস্ত খিলানওয়ালা বাড়ীর নিচে দিয়ে অনেকদূর যেতে হয়, টানেল সেই প্রকার। তবে বাড়ীর লম্বা খিলেনপথে জল পড়ে না; এই টানেলের উপরিস্থিত নদ, নদী, বৃষ্টির জল এবং পাহাড়ের ঝরণা প্রভৃতির জল তাহার ভিতর চুয়াইয়া পড়ে, তাহাকেই টানেল কহে। ট্রেণ সেই টানেল অতিক্রম কবার সময়, জ্ঞানানন্দ বল্লেন, “দাঁদাঁ এ কি আশ্চর্য্যঁ দিঁনে রাতঁ। মেঁঘ নাঞি, বৃষ্টি নাঞি, এ অন্ধকারের ভিতর কোঁথায় যাঁচ্চিঞ?”

প্রেমানন্দ বল্লেন “ভাই, এটা আমি কিছু বুঝতে পাচ্ছি না; তবে শুনেছিলাম যে, তিন পাহাড়ের ভিতর দিয়ে একটা রাস্তা আছে। এটা তবে তাই বুঝি! আহা, ইংরাজ বাহাদুরদিগের কি অসীম ক্ষমতা! আমাদের পূর্ব্বেকার রামায়ণ মহাভারত ইত্যাদি গ্রন্থে কথিত আছে, পুষ্পকরথ, এবং নানাপ্রকার অদ্ভুত ব্যাপার, যেমন হনুমানের গন্ধমাদন পৰ্ব্বত আনা, সাগরবন্ধন ইত্যাদি মহা মহা ব্যাপার আছে, তাহা সত্য হইলেও হইতে পারে। কিন্তু এরূপ অদ্ভুত ব্যাপার কদাচ কোথাও শোনাও যায় নাই, দেখাও যায় নাই, ধন্য ইংরাজের বলবুদ্ধি! প্রভু, সকলই তোমার ইচ্ছা। এই বলতে বলতে প্রেমানন্দ পুনরায় নিদ্রায় অভিভূত হলেন। গাড়ী মধ্যবর্ত্তী এষ্টেশনে মাঝে মাঝে থেমে, একেবারে মোগলসরাই এষ্টেশনে এসে পৌঁছুলো। পৌঁছবামাত্রই পুলিসম্যান, টিকিটকলেক্টর, ইঞ্জিনীয়ার প্রভৃতি, ম্যাথর, সুইপার এবং যাঁহারা গাড়ীর সমস্ত তদন্ত করেন, নিকটবর্ত্তী হয়ে, আপন আপা কাৰ্য্যে নিযুক্ত হলেন। বাবাজীরা নিজের পোটলা পুঁটলী নিয়ে, অতি যত্নের সহিত (হুঁকো কলকে ইত্যাদি কোন জিনিষের ভুল না হয়) সমস্ত দ্রব্য নিয়ে প্লাটফরমে নেমে ও রেখে হাঁপ ছাড়লেন। প্রেমানন্দ বল্লেন, “হা প্রভু বিশ্বনাথ! এইবার যদি অদৃষ্টক্রমে আপনার দর্শক পাই। এখনো বলতে পারি নে, যতক্ষণ কাশীধামে পৌঁছে আপনার মস্তকে গঙ্গাজল বিল্বপত্রাদি ছড়াইয়া প্রণিপাত না কত্তে পারি, ততক্ষণ বল্‌তে পারিনে।”

সেখানে নৌকার মাঝী, মুটে, গঙ্গাপুত্র, পাণ্ডা, পূজারী ইত্যাদি সকলে আপন আপন খাতা সঙ্গে নিয়ে, কলিকাতাবাসী এবং অপরাপর স্থানবাসী বাবুদিগের পিতৃপিতামহাদি চৌদ্দপুরুষের নামস্বাক্ষরিত উইকাটা খাতা (কোনখানা বা সাদা কাগজ, কোনখানা বা হলদে কাগজ, কাহার বা লেখা বোঝা যায়, কাহার বা পড়া যায় না) নিয়ে, বাপ পিতামহের নামধাম জিজ্ঞাসা করে, আপনাপন যজমান সংগ্রহ কচ্চেন।

এদিকে নৌকাওয়ালারা পুটুলি নিয়ে টানাটানি কচ্চে; কাহার পুটুলি এ নৌকা হতে ওদিকে গেছে, কাহার বা অজ্ঞাতসারে কে নিয়ে গেলে টের পাওয়া গেল না। পরে ভাড়ার জন্য নৌকাওয়ালাদের সহিত গেলযোগ কত্তে কত্তে ব্যাসকাশীতে (অর্থাৎ যাকে রামনগর বলে থাকে, কাশীব্র ও-পার, হয় ত সেইখানেতেই) অবস্থিতি কত্ত হলো। অনেক আকিঞ্চন এবং টানাটানির পর একখানি ময়ূরমুখওয়ালা নৌকো পেয়ে, পরমানন্দে জ্ঞানানন্দ ও প্রেমানন্দ সমস্ত দ্রব্যাদি নিয়ে সেই নৌকায় উঠলেন।

নৌকায় আরোহণ করে গঙ্গার জল হস্তে নিয়ে, আপন আপন শিরে ছড়িয়ে, “সৰ্ব্বতীর্থময়ী গঙ্গা। সদ্যদুঃখবিনাশিনী, সুখদা মোক্ষদা গঙ্গা গজৈব পরম গতি। মাতঃ ভাগীরথি?” এই কথা বলে, কাশীর ওপারে প্রস্তরনির্ম্মিত অতি উচ্চ অট্টালিকা এবং ঘাটের সিঁড়ি সকল দর্শন করে, জ্ঞানানন্দ বাবাজী প্রেমানন্দ বাবাজীকে বল্লেন, “দাঁদাঁ! উঃ কতঁ উঁচুঁ বাঁড়ী সকঁলঞ, আরঁ কতঁ প্রশস্তঁ ঘাঁট, কঁলিকাঁতায়ঞ কিঁম্বা অঁন্যান্য দেঁশে দ্যাখাঁ গেঁছে বঁটেঞ কিন্তু এঁরূপ নয়ঞ।”

প্রেমানন্দ বল্লেন, “ভায়া! দেখ পাহাড়ের দেশ, এ স্থলে মৃত্তিকা অতি বিরল; সুতরাং পাথরের বাড়ী, পাথরের ঘাট, পাথরময় কাশী, সমস্তই পাথরের।” এই কথা বলতে বলতে দশাশ্বমেধ ঘাটে নৌকা উত্তীর্ণ হলো; বাবাজীরা নৌকা থেকে অবতীর্ণ হতে না হতে, পুৰ্ব্বেকার মত পূজারী, পাণ্ডা কুলি ও যাত্ৰাওয়ালা প্রভৃতি সকলে নৌকোর নিকটে এসে কেউ পুটুলি টানছে, কেউ বা জিজ্ঞাসা কচ্চে, “মশাই, কোথা থেকে আসা হচ্ছে, আপনি কার যজমান, কার ছেলে, নিবাস কোথায়, পরিচয় দিন, তা হলে আমরা সকলেই জাতে পারব যে, আপনি কার যজমান।”

প্রেমানন্দ বাবাজী বল্লেন, “মহাশয়! আমি অতি অল্প বয়সে পিতৃহীন, সুতরাং আমি জ্ঞাত নই যে, আমার বাপ পিতামহ কখন কাশীতে এসেছিলেন কি না। কারণ, তখন নৌকোতে আসতে হতো এবং আমার কেউ নেই যে, আমাকে বলে দিয়ে থাকবে যে, ফলনা অমুক তুমুক। অতএব আমি আর কিছুই জানি না।”

এই কথা শুনে, দলমধ্যস্থ এক জন অতি বলবান পুরুষ, “তবে এ যজমান আমার, আমি একে সুফল দান করব।” এই কথা বলে, তিনি আপন ঝুলি হতে নারিকেল, আতপ চাল ইত্যাদি বাহির করে, বাবাজীদের হাতে দিয়ে বল্লেন, ‘আপনারা সমস্ত দ্রব্য এইখানে রাখুন’; এবং তাহার সঙ্গী গুণ্ডাদিগকে বল্লেন, “দেখ, খুব খবরদার।” অন্য অন্য পাণ্ডা প্রভৃতি ও পূজারিগণ যেন অতি দীন নেড়ি কুকুরের মত তফাৎ থেকে বিদ্রুপ টিটকিরি ইত্যাদি কত্তে লাগলো; পাণ্ডাজী নিজের গায়ের পাঞ্জাবী আস্তেন জামা এবং পাগড়ীটি গঙ্গাতীরে রেখে বাবাজীদিগকে জলে দাঁড় করিয়ে, যথাযোগ্য মন্ত্রপূত কল্লেন, এবং বল্লেন, “সুফলের দক্ষিণ দিয়ে মণিকর্ণিকার জল স্পর্শ কিম্বা অবগাহন করে চল বাবা বিশ্বনাথজীর পূজা করবে, ষোড়শোপচারে হইবে, না মধ্যবিত্ত?”

বাবাজীরা বল্লেন, “আমরা অতি দীন-হীন গৃহস্থলোক, আমরা কি ষোড়শোপচারে বাবার পূজা কত্তে পারি? এর মধ্যে যেরূপ হয়, সংক্ষেপে বাবার যথাযোগ্য পুজা আপনি আমাদে করিয়ে দিবেন।”

পাণ্ডাজী বল্লেন, “চলো চলো।”

বাবাজীরা আপন আপন তল্পিতল্পা নিয়ে, পাণ্ডাজীর সুশিক্ষিত গুণ্ডাদ্বয় সমভিব্যাহারে বাবার মন্দিরে উপনীত হয়ে, ‘বাবা বিশ্বনাথ’ বলে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত কল্লেন। পাণ্ডাজীর কৃপায় ফুল, বিল্বপত্র, গঙ্গাজল ইত্যাদি সমস্ত দ্রব্যের আয়োজন করা হয়েচে। পাণ্ডাজী, বাবার পুজো করিয়ে, “বাসা কি আমাদের বাড়ীতে লওয়া হবে, না আপন ইচ্ছায় করে নেবে; আচ্ছা আমার সঙ্গে এসো।” এই কথা বলে বাবাজীদের সঙ্গে নিয়ে, একটি দোকানে এসে তিন দিবসের জন্য ঘর ভাড়া করে দিলেন।

বাবাজীরা লুচি এবং মিষ্টান্নভক্ত বেশী, সুতরাং ভাতের প্রত্যাশা রাখেন না। সমস্ত দিন ঘুরে ফিরে, কাশীর সমস্ত দেখে বেড়াতে লাগলেন। একজন যাত্রাওয়ালা বাবাজীদের নূতন চেহারা দেখে এসে বল্লেন, “আপনারা নূতন এসেছেন, বোধ হয় আজ কিম্বা কাল। আপনাদের এখনও কিছু দেখা হয় নাই, আসুন, আমি আপনাদের নিয়ে সমস্ত দেখিয়ে শুনিয়ে দিই। আপনারা কি এই বাড়ীতে থাকেন?” এই কথা বলে যাত্রাওয়ালা নিজ দলস্থ দু’ একটি সঙ্গীকে ইঙ্গিত করে দিয়ে, তাদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। “এই দেখুন, বাবা বিশ্বনাথের মন্দি রাজা রণজিৎ সিংহের নিৰ্ম্মিত, এই দেখুন ‘সাণ্ডায়েল’–এই অন্নপূর্ণার মন্দির।”

“এইবার চলুন দুর্গাবাড়ী দর্শন করে আসবেন। দুর্গাবাড়ী এই স্থান হতে কিঞ্চিৎ দূর, অতএব আপনারা পোঁটলা পুঁটলি যা কিছু আছে, সেই সমস্ত সমিভ্যারে নিয়ে চলুন। কারণ, এ স্থানে কার কাছে রেখে যাবেন?”

যাত্রাওয়ালার এইরূপ কথা অনুসারে বাবাজীর। আপন পুটলি এবং জীবনসর্ব্বস্ব হরিনামের ঝুলি এবং মালা যাহার ভিতর খুঁজিলে বোধ হয় একখানি মনোহারির দোকান সমেত অবস্থিতি করে; চাই কি সময়ে দুটা চারটা মিষ্টান্নও পাওয়া যায়। কারণ, যদি হরিনাম কত্তে কত্তে গলা শুকিয়ে উঠে, এক আঁধটি বদনে ফেলে দিয়ে ‘হরেকৃষ্ণ’ বলে জল পান করে থাকে।

যাত্রাওয়ালাদের সঙ্গে বাবার দুর্গাবাড়ী দর্শনে যাত্রা কল্লেন। পরে দুর্গাবাড়ী বানরের উৎপাতে এবং যাত্ৰাওয়ালাকে কৃপাতে বাবাজীদের দুর্দ্দশার কত দূর শেষ হলো, সে কথা আর আমরা অধিক লিখিতে পারলাম না।

।।সম্পূর্ণ।।


© 2024 পুরনো বই