ধৃতরাষ্ট্র উবাচ।
ধর্ম্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্ব্বত সঞ্জয় || ১ ||
ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন হে সঞ্জয়! পুণ্যক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধার্থী সমবেত আমার পক্ষ ও পাণ্ডবেরা কি করিল? ১।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা মহাভারতের ভীষ্মপর্ব্বের অন্তর্গত। ভীষ্মপর্ব্বের ৩ অধ্যায় হইতে ৪৩ অধ্যায় পর্য্যন্ত-এই অংশের নাম ভগবদ্গীতাপর্ব্বাধ্যায়; কিন্তু ভগবদ্গীতার আরম্ভ পঞ্চবিংশতিতম অধ্যায়ে। তৎপূর্ব্বে যাহা ঘটিয়াছে, তাহা সকল পাঠক জানিতে না পারেন, এজন্য তাহা সংক্ষেপে বলিতেছি; কেন না, তাহা না বলিলে, ধৃতরাষ্ট্র কেন এই প্রশ্ন করিলেন, এবং সঞ্জয়ই বা কে, তাহা অনেক পাঠক বুঝিবেন না।
যুধিষ্ঠিরের রাজ্যসমৃদ্ধি দেখিয়া, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুর্য্যোধন তাহা অপহরণ করিবার অভিপ্রায়ে যুধিষ্ঠিরকে কপটদ্যূতে আহ্বান করেন। যুধিষ্ঠির কপটদ্যূতে পরাজিত হইয়া এই পণে আবদ্ধ হয়েন যে, দ্বাদশ বৎসর তিনি ও তাঁহার ভ্রাতৃগণ বনবাস করিবেন, তার পর এক বৎসর অজ্ঞাতবাস করিবেন। এই ত্রয়োদশ বৎসর দুর্য্যোধন তাঁহাদিগের রাজ্য ভোগ করিবেন। তার পর পাণ্ডবেরা এই পণ রক্ষা করিতে পারিলে আপনাদিগের রাজ্য পুনঃপ্রাপ্ত হইবেন। পাণ্ডবেরা দ্বাদশ বৎসর বনবাসে এবং এক বৎসর অজ্ঞাতবাসে যাপন করিলেন, কিন্তু দুর্য্যোধন তার পর রাজ্য প্রত্যর্পণ করিতে অস্বীকৃত হইলেন। কাজেই পাণ্ডবেরা যুদ্ধ করিয়া স্বরাজ্যের উদ্ধার করিতে প্রস্তুত হইলেন। উভয় পক্ষ সেনা সংগ্রহ করিলেন। উভয়পক্ষীয় সেনা যুদ্ধার্থ কুরুক্ষেত্রে সমবেত হইল। যখন উভয় সেনা পরস্পর সম্মুখীন হইয়াছে, কিন্তু যুদ্ধ আরম্ভ হয় নাই, তখন এই গীতার আরম্ভ।
ধৃতরাষ্ট্র স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত নহেন-তিনি হস্তিনানগরে আপনার রাজভবনে আছেন। তাহার কারন, তিনি জন্মান্ধ, কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত থাকিয়া যুদ্ধদর্শন-সুখেও বঞ্চিত। কিন্তু যুদ্ধে কি হয়, তাহা জানিবার জন্য বিশেষ ব্যগ্র। যুদ্ধের পূর্ব্বে ভগবান্ ব্যাসদেব তাঁহার সম্ভাষণে আসিয়াছিলেন, তিনি অনুগ্রহ করিয়া ধৃতরাষ্ট্রকে দিব্য চক্ষু প্রদান করিতে ইচ্ছা করিলেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র তাহাতে অস্বীকৃত হইলেন, বলিলেন যে, “আমি জ্ঞাতিবধ সন্দর্শন করিতে অভিলাষ করি না, আপনার তেজঃপ্রভাবে আদ্যোপান্ত এই যুদ্ধ-বৃত্তান্ত শ্রবণ করিব।” তখন ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রী সঞ্জয়কে বর দান করিলেন। বর-প্রভাবে সঞ্জয় হস্তিনাপুরে থাকিয়াও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধবৃত্তান্ত সকল দিব্য চক্ষে দেখিতে পাইলেন, দেখিয়া ধৃতরাষ্ট্রকে শুনাইতে লাগিলেন। ধৃতরাষ্ট্র মধ্যে মধ্যে প্রশ্ন করিতেছেন, সঞ্জয় উত্তর দিতেছেন। মহাভারতের যুদ্ধপর্ব্বগুলি এই প্রণালীতে লিখিত। সকলই সঞ্জয়োক্তি। এক্ষণে উভয়পক্ষীয় সেনা যুদ্ধার্থ পরস্পর সম্মুখীন হইয়াছে শুনিয়া ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করিতেছেন, উভয় পক্ষ কি করিলেন। গীতার এইরূপ আরম্ভ।
এই দিব্য চক্ষুর কথাটা অনৈসর্গিক, পাঠককে বিশ্বাস করিতে বলি না। গীতোক্ত ধর্ম্মের সঙ্গে ইহার কোন সম্বন্ধ নাই।
যে ধর্ম্মব্যাখ্যা গীতার উদ্দেশ্য, প্রথমাধ্যায়ে তাহার কিছুই নাই। কি প্রসঙ্গোপ-লক্ষ্যে এই তত্ত্ব উত্থাপিত হইয়াছিল, প্রথমাধ্যায়ে এবং দ্বিতীয়াধ্যায়ের প্রথম একাদশ শ্লোকে কেবল তাহারই পরিচয় আছে। গীতার মর্ম্ম হৃদয়ঙ্গম করিবার জন্য এতদংশের কোন প্রয়োজন নাই। পাঠক ইচ্ছা করিলে এতদংশ পরিত্যাগ করিতে পারেন। আমার যে উদ্দেশ্য, তাহাতে এতদংশের কোন টীকা লিখিবারও প্রয়োজন নাই; ভগবান্ শঙ্করাচার্য্যও এতদংশ পরিত্যাগ করিয়াছেন। তবে শ্রেণীবিশেষের পাঠক কোন কোন বিষয়ে কিছু জানিতে ইচ্ছা করিতে পারেন। এজন্য দুই একটা কথা লেখা গেল।
কুরুক্ষেত্র একটি চক্র বা জনপদ। ঐ চক্র এখনকার স্থানেশ্বর বা থানেশ্বর নগরের দক্ষিণবর্ত্তী। আম্বালা নগর হইতে উহা ১৫ ক্রোশ দক্ষিণ। পানিপাট হইতে উহা ২০ ক্রোশ উত্তর। কুরুক্ষেত্র ও পানিপাট ভারতবর্ষের যুদ্ধক্ষেত্র, ভারতের ভাগ্য অনেক বার ঐ ক্ষেত্রে নিষ্পত্তি পাইয়াছে। “ক্ষেত্র” নাম শুনিয়া ভরসা করি, কেহ একখানি মাঠ বুঝিবেন না। কুরুক্ষেত্র প্রাচীন কালেই পঞ্চ যোজন দৈর্ঘ্যে এবং পঞ্চ যোজন প্রস্থে। এই জন্য উহাকে সমন্তপঞ্চক বলা যাইত। চক্রের সীমা এখন আরও বাড়িয়া গিয়াছে।
কুরু নামে এক জন চন্দ্রবংশীয় রাজা ছিলেন। তাঁহা হইতেই এই চক্রের নাম কুরুক্ষেত্র হইয়াছে। তিনি দুর্য্যোধনাদির ও পাণ্ডবদিগের পূর্ব্বপুরুষ; এজন্য দুর্য্যোধনাদিকে কৌরব বলা হয়, এবং কখন কখন পাণ্ডবদিগকেও বলা হয়। তিনি এই স্থানে তপস্যা করিয়া বর লাভ করিয়াছিলেন, এই জন্য ইহার নাম কুরুক্ষেত্র। মহাভারতে কথিত হইয়াছে যে, তাঁহার তপস্যার কারণেই উহা পুণ্যতীর্থ। ফলে চিরকালই কুরুক্ষেত্র পুণ্যক্ষেত্র বা ধর্ম্মক্ষেত্র বলিয়া প্রসিদ্ধ। শতপথ ব্রাহ্মণে আছে, “দেবাঃ হ বৈ সত্রং নিষেদুরগ্নিরিন্দ্রঃ সোমো মখো বিষ্ণুর্বিশ্বেদেবা অন্যত্রেবাশ্বিভ্যাম্। তেষাং কুরুক্ষেত্রং দেবযজনমাস। তস্মাদাহুঃ কুরুক্ষেত্রং দেবযজনম্।” অর্থাৎ দেবতারা এইখানে যজ্ঞ করিয়াছিলেন, এজন্য ইহাকে “দেবতাদিগের যজ্ঞস্থান” বলে।
মহাভারতের বনপর্ব্বের তীর্থযাত্রা পর্ব্বাধ্যায়ে কথিত হইয়াছে যে, কুরুক্ষেত্র ত্রিলোকীর মধ্যে প্রধান তীর্থ। বনপর্ব্বে কুরুক্ষেত্রের সীমা এইরূপ লেখা আছে-“উত্তরে সরস্বতী, দক্ষিণে দৃষদ্বতী; কুরুক্ষেত্র এই উভয় নদীর মধ্যবর্ত্তী।” (৮৩ অধ্যায়) মনুসংহিতায় বিখ্যাত ব্রহ্মাবর্ত্তেরও ঠিক সেই সীমা নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে।-
সরস্বতীদৃষদ্বত্যোর্দেবনদ্যোর্যন্তরং।
তং দেবনির্ম্মিতং দেশং ব্রহ্মাবর্তং প্রচক্ষতে || ২। ১৭।
অতএব কুরুক্ষেত্র এবং ব্রহ্মাবর্ত্ত একই। কালিদাসের নিম্নলিখিত কবিতাতে তাহাই বুঝা যাইতেছে।
ব্রহ্মাবর্ত্তং জনপদমথচ্ছায়য়া গাহমানঃ
ক্ষেত্রং ক্ষত্রপ্রঘনপিশুনং কৌরবং তদ্ভজেথাঃ।
রাজন্যানাং শিতশরশতৈর্যত্র গাণ্ডীবধন্বা
ধারাপাতৈস্ত্বমিব কমলান্যভ্যবর্ষন্ মুখানি ||
-মেঘদূত ৪৯।
কিন্তু মনুতে আবার অন্য প্রকার আছে। যথা-
কুরুক্ষেত্রঞ্চ মৎস্যাশ্চ পঞ্চলাঃ শূরসেনকাঃ।
এষ ব্রহ্মর্ষিদেশো বৈ ব্রহ্মাবর্ত্তাদনন্তরঃ ||
অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়ে চৈনিক পরিব্রাজক হিউন্থসাঙ্ও ইহাকে স্বীয় গ্রন্থে “ধর্ম্মক্ষেত্র” বলিয়াছেন।1
কুরুক্ষেত্র আজিও পুণ্যতীর্থ বলিয়া ভারতবর্ষে পরিচিত; অনেক যোগী সন্ন্যাসী তথা পরিভ্রমণ করেন। কুরুক্ষেত্রে অনেক ভিন্ন ভিন্ন তীর্থ আছে। তাহার মধ্যে কতকগুলি মহাভারতের যুদ্ধের স্মরাক স্বরূপ। যে স্থানে অভিমন্যু সপ্তরথিকর্ত্তৃক অন্যায়-যুদ্ধে নিহত হইয়াছিলেন, সে স্থানকে এক্ষণে ‘অভিমন্যুক্ষেত্র’ বা ‘অমিন’ বলিয়া থাকে। যেখানে আজিও পুত্রহীনারা পুত্রকামনায় অদিতির মন্দিরে অদিতির উপাসনা করে। যেখানে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিহত যোদ্ধাদিগের সৎকার সমাপন হইয়াছিল, ক্ষেত্রের যে ভাগ সেই বীরগণের অস্থিতে সমাকীর্ণ হইয়াছিল, এখনও তাহাকে ‘অস্থিপুর’ বলে। যেখানে সাত্যকিতে ও ভূরিশ্রবাতে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়, এবং অর্জ্জুন সাত্যকির রক্ষার্থ অন্যায় করিয়া ভূরিশ্রবার বাহুচ্ছেদ করেন, সে স্থানকে এক্ষণে ‘ভোর’ বলে। জনপ্রবাদ আছে যে, ভূরিশ্রবার সালঙ্কার ছিন্ন হস্ত পক্ষীতে লইয়া যায়। সেই ছিন্ন হস্তের অলঙ্কারে একখণ্ড বহুমূল্য হীরক ছিল। তাহাই কহীনুর, এক্ষণে ভারতেশ্বরীর অঙ্গে শোভা পাইতেছে। কথাটা যে সত্য, তাহার অবশ্য কোন প্রমাণ নাই।
কুরুক্ষেত্রের নাম বাঙ্গালীমাত্রেরই মুখে আছে। একটা কিছু গোল দেখিলে বাঙ্গালীর মেয়েরাও বলে, “কুরুক্ষেত্র হইতেছে”। অথচ কুরুক্ষেত্রের সবিশেষ তত্ত্ব কেহই জানে না। বিশেষ টম্সন, হুইলর প্রভৃতি ইংরেজ লেখকেরা সবিশেষ না জানিয়া অনেক গোলযোগ বাধাইয়াছেন। তাই কুরুক্ষেত্রের কথা এখানে এত সবিস্তারে লেখা গেল।2
সঞ্জয় উবাচ।
দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্য্যোধনস্তদা।
আচার্য্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ || ২ ||
সঞ্জয় বলিলেন-
ব্যূহিত পাণ্ডবসৈন্য দেখিয়া রাজা দুর্য্যোধন আচার্য্যের নিকটে গিয়া বলিলেন। ২।
দুর্য্যোধনাদির অস্ত্রবিদ্যার আচার্য্য ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণ। ইনি পাণ্ডবদিগেরও গুরু। ইনি ব্রাহ্মণ। কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় অদ্বিতীয়। শস্ত্রবিদ্যা ক্ষত্রিয়দিগেরই ছিল, এমন নহে। দ্রোণাচার্য্য, পরশুরাম, কৃপাচার্য্য, অশ্বত্থামা, ইঁহারা সকলেই ব্রাহ্মণ, অথচ সচরাচর ক্ষত্রিয়দিগের অপেক্ষা যুদ্ধে শ্রেষ্ঠ বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। যখন পশ্চাৎ স্বধর্ম্মপালনের কথা উঠিবে, তখন এই কথা স্মরণ করিতে হইবে।
যুদ্ধার্থ সৈন্য-সন্নিবেশকে ব্যূহ বলে।
সমগ্রস্য তু সৈন্যস্য বিন্যাসঃ স্থানভেদতঃ।
স ব্যূহ ইতি বিখ্যাতো যুদ্ধেষু পৃথিবীভূজাম্ ||
আধুনিক ইউরোপীয় সমরে সেনাপতির ব্যূহরচনাই প্রধান কার্য্য।
পশ্যৈতাং পাণ্ডুপুত্রাণামাচার্য্য মহতীং চমূম্।
ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা || ৩ ||
হে আচার্য্য! আপনার শিষ্য ধীমান্ দ্রুপদপুত্রের দ্বারা ব্যূহিতা পাণ্ডবদিগের মহতী সেনা দর্শন করুন। ৩।
দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন, পাণ্ডবদিগের একজন সেনাপতি। তিনিই ব্যূহ রচনা করিয়াছিলেন। কথিত আছে, ইঁহার পিতা দ্রোণবধ কামনায় যজ্ঞ করিলে ইঁহার জন্ম হয়। ইনিও দ্রোণের শিষ্য বলিয়া বর্ণিত হইতেছেন। এ কথাটা স্বধর্ম্মপালন বুঝিবার সময়ে স্মরণ করিতে হইবে। নিজ বধার্থ উৎপন্ন শত্রুকে দ্রোণ শিক্ষা দিয়াছিলেন। আচার্য্যের ধর্ম্ম বিদ্যা দান।
অত্র শূরা মহেষ্বাসা ভীমার্জ্জুনসমা যুধি।
যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ || ৪ ||
ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশীরাজশ্চ বীর্য্যবান্।
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ || ৫ ||
যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্য্যবান্।
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্ব এব মহারথাঃ || ৬ ||
ইহার মধ্যে শূর, বাণক্ষেপে মহান্, যুদ্ধে ভীমার্জ্জুনতুল্য, যুযুধান, (১) বিরাট, (২) মহারথ দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, (৩) চেকিতান, বীর্য্যবান্ কাশীরাজ, পুরুজিৎ, কুন্তিভোজ, (৪) নরশ্রেষ্ঠ শৈব্য, বিক্রমশালী যুধামন্যু, বীর্য্যবান্ উত্তমৌজা সুভদ্রাপুত্র, (৫) দ্রৌপদীর পুত্রগণ, ইঁহারা সকলে মহারথ। ৪।৫।৬।
(১) যুযুধান-যদুবংশীয় মহাবীর সাত্যকি।
(২) দ্রুপদ, বিরাট, সাত্যকি, ধৃষ্টকেত প্রভৃতি সকলে অক্ষৌহিণীপতি।
(৩) ধৃষ্টকেতু মহাভারতে চেদিদেশের অধিপতি বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন।
অন্যবিধ বর্ণনাও আছে (মহা, উদ্যোগ, ১৭১ অধ্যায়)।
(৪) কুন্তিভোজ বংশের নাম। বৃদ্ধ কুন্তিভোজ বসুদেবের পিতা শূরের পিতৃষ্বসৃপুত্র। পাণ্ডবমাতা কুন্তী তাঁহার ভবনে প্রতিপালিতা হয়েন। পুরুজিৎ এ সম্বন্ধে পাণ্ডব-মাতুল।
(৫) বিখ্যাত অভিমন্যু।
অস্মাকন্তু বিশিষ্টা যে তান্নিবোধ দ্বিজোত্তম।
নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে || ৭ ||
হে দ্বিজোত্তম! আমাদিগের মধ্যে যাঁহারা প্রধান, আমার সৈন্যোর নায়ক, তাঁহাদিগকে অবগত হউন। আপনার অবগতির জন্য সে সকল আপনাকে বলিতেছি। ৭ |
ভবান্ ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ।
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তির্জয়দ্রথঃ ||
আপনি, ভীষ্ম, কর্ণ, যুদ্ধজয়ী কৃপ, (৬) অশ্বত্থামা, (৭) বিকর্ণ, সোমদত্তপুত্র (৮) ও জয়দ্রথ (৯)। ৮।
(৬) ইনিও ব্রাহ্মণ এবং অস্ত্রবিদ্যায় কৌরবদিগের আচার্য্য আচার্য্য।
(৭) দ্রোণপুত্র।
(৮) ইনিও বিখ্যাত ভূরিশ্রবা।
(৯) দুর্য্যোধনের ভগিনীপতি।
অন্যে চ বহবঃ শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ।
নানাশস্ত্রপ্রহরণাঃ সর্ব্বে যুদ্ধবিশারদাঃ || ৯ ||
আরও অনেক অনেক বীর আমার জন্য ত্যক্তজীবন হইয়াছেন (অর্থাৎ জীবনত্যাগে প্রস্তুত হইয়াছেন)। তাঁহারা সকলে নানাস্ত্রধারী এবং যুদ্ধবিশারদ।৯।
গীতায় প্রথমাধ্যায়ে ধর্ম্মতত্ত্ব কিছু নাই। কিন্তু প্রথম অধ্যায় কাব্যাংশে বড় উৎকৃষ্ট। উপরে উভয় পক্ষের বহু গুণবান্ সেনানায়কদিগের নাম যে পাঠককে স্মরণ করাইয়া দেওয়া হইল, ইহা কবির একটা কৌশল। পশ্চাতে অর্জ্জুনের যে করুণাময়ী মনোমোহিনী ভক্তি লিখিত হইয়াছে, তাহা পাঠকের হৃদয়ঙ্গম করাইবার জন্য এখন হইতে উদ্যোগ হইতেছে।
অপর্য্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্।
পর্য্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্ || ১০ ||
ভীষ্মাভিরক্ষিত আমাদের সেই সৈন্য অসমর্থ। আর ইহাদিগের ভীমাভিরক্ষিত সৈন্য সমর্থ।১০।
পর্য্যাপ্ত এবং অপর্য্যাপ্ত শব্দের অর্থ শ্রীধর স্বামীর টীকানুসারে করা গেল। অন্যে অর্থে করিয়াছেন-পরিমিত এবং অপরিমিত।
অয়নেষু চ সর্ব্বেষু যথাভাগমবস্থিতাঃ।
ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্তু ভবন্তঃ সর্ব্ব এব হি || ১১ ||
আপনারা সকলে স্ব-স্ব বিভাগানুসারে সকল ব্যূহদ্বারে অবস্থিতি করিয়া ভীষ্মকে রক্ষা করুন।১১।
ভীষ্ম দুর্য্যোধনের সেনাপতি।
তস্য সংজনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ।
সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্নৌ প্রতাপবান্ || ১২ ||
(তখন) প্রতাপবান্ কুরুবৃদ্ধ পিতামহ (ভীষ্ম) দুর্য্যোধনের হর্ষ জন্মাইয়া উচ্চ সিংহনাদ করতঃ শঙ্খধ্বনি করিলেন।১২।
পূর্ব্বকালে রথিগণ যুদ্ধের পূর্ব্বে শঙ্খধ্বনি করিতেন। ভীষ্ম দুর্য্যোধনের পিতামহের ভাই।
ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্য্যশ্চ পণবানকগোমুখাঃ।
সহসৈবাভ্যহনন্ত স শব্দস্তুমূলোহভবৎ || ১৩ ||
তখন শঙ্খ, ভেরী, পণব, আনক, গোমুখ সকল (বাদ্যযন্ত্র) সহসা আহত হইলে সে শব্দ তুমুল হইয়া উঠিল।১৩।
ততঃ শ্বেতৈর্হয়ৈর্যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ।
মাধবঃ পাণ্ডবশ্চৈব দিবৌ শঙ্খৌ প্রদধ্নতুঃ || ১৪ ||
তখন শ্বেতাশ্বযুক্ত মহারথে স্থিত কৃষ্ণার্জ্জুন দিব্য শঙ্খ বাজাইলেন।১৪।
পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ।
পৌন্ড্রং দধ্নৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্ম্মা বৃকোদরঃ || ১৫ ||
অনন্তবিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ।
নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষমণিপুষ্পকৌ || ১৬ ||
কৃষ্ণ পাঞ্চজন্য নামে শঙ্খ, অর্জ্জুন দেবদত্ত এবং ভীমকর্ম্মা ভীম পৌন্ড্র নামে মহাশঙ্খ বাজাইলেন। কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয়, নকুল সুঘোষ, এবং সহদেব মণিপুষ্পক (নামে) শঙ্খ বাজাইলেন।১৫।১৬।
কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখণ্ডী চ মহারথঃ।
ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ || ১৭ || দ্রুপদো দ্রৌপদদেয়াশ্চ সর্ব্বশঃ পৃথিবীপতে। সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দুধ্নুঃ পৃথক্ পৃথক্ || ১৮ ||
পরম ধনুর্দ্ধর কাশীরাজ, মহারথ শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, অপরাজিত সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, মহাবাহু সুভদ্রাপুত্র,-হে পৃথিবীপতে! ইঁহারা সকলেই পৃথক্ পৃথক্ শঙ্খ বাজাইলেন।১৭।১৮।
স ঘোষো ধার্ত্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ।
নভেশ্চ পৃথিবীঞ্চৈব তুমুলোহভ্যনুনাদয়ন্ || ১৯ ||4
সেই শব্দ ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদিগের হৃদয় বিদীর্ণ করিল ও আকাশ এবং পৃথিবীকে তুমুল ধ্বনিত করিল।১৯।
অথ ব্যবস্থিতান্ দৃষ্ট্বা ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ কপিধ্বজঃ।
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পাণ্ডবঃ।
হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে || ২০ ||
পরে হে মহীপতে!5 ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগকে ব্যবস্থিত দেখিয়া অস্ত্রনিক্ষেপে প্রবৃত্ত কপিধ্বজ অর্জ্জুন ধনু উত্তোলন করিয়া হৃষীকেশকে এই কথা বলিলেন।২০
“ব্যবস্থিত” শব্দের ব্যাখ্যায় শ্রীধর স্বামী লিখিয়াছেন “যুদ্ধোদ্যোগে অবস্থিত।”
অর্জ্জুন উবাচ।
সেনয়োরুভয়োর্ম্মধ্যে রথং স্থাপয় মেহচ্যুত || ২১ ||
যাবদেতান্নিরীক্ষেহহং যোদ্ধুকামানবস্থিতান্।
কৈর্ময়া সহ যোদ্ধব্যমস্মিন্ রণসমুদ্যমে || ২২ ||
যোৎস্যমানানবেক্ষেহহং য এতেহত্রসমাগতাঃ।
ধার্ত্তরাষ্ট্রস্য দুর্ব্বুদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ || ২৩ ||
অর্জ্জুন বলিলেন-
যাহারা যুদ্ধ-কামনায় অবস্থিত, আমি যাবৎ তাহাদিগকে নিরীক্ষণ করি, এই রণসমুদ্যমে কাহাদিগের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করিতে হইবে (যাবৎ তাহা দেখি), যাহারা দুর্বুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্রপুত্রের প্রিয়চিকীর্ষায় এইখানে যুদ্ধে সমাগত হইয়াছে, সেই সকল যুদ্ধার্থীদিগকে (যাবৎ) আমি দেখি, (তাবৎ) তুমি উভয় সেনার মধ্যে আমার রথ স্থাপন কর। ২১।২২।২৩।
সঞ্জয় উবাচ।
এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম || ২৪ ||
ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখতঃ সর্ব্বেষাঞ্চ মহীক্ষিতাম্।
উবাচ পার্থ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি || ২৫ ||
সঞ্জয় বলিলেন-
হে ভারত!6 অর্জ্জুন কর্ত্তৃক হৃষীকেশ এইরূপ অভিহিত হইয়া উভয় সেনার মধ্যে ভীষ্মদ্রোণপ্রমুখ সকল রাজগণের সম্মুখে সেই উৎকৃষ্ট রথ স্থাপন করিয়া কহিলেন, হে পার্থ সমবেত কুরুগণকে এই নিরীক্ষণ কর।২৪।২৫
তত্রাপশ্যৎ স্থিতান্ পার্থঃ পশ্যৈতান্ পিতৃনথ পিতামহান্।
আচার্য্যান্মাতুলান্ ভ্রাতৃন্ পুত্রান্ পৌত্রান্ সখীংস্তথা ||
শ্বশুরান সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি || ২৬ ||
তখন অর্জ্জুন সেইখানে স্থিত উভয় সেনায় পিতৃব্যগণ, পিতামহগণ, আচার্য্যগণ, মাতুলগণ, ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ, পৌত্রগণ, শ্বশুরগণ, সখিগণ7 এবং সুহৃদ্গণকে দেখিলেন।২৬।
তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্ব্বান্ বন্ধূনবস্থিতান্।
কৃপয়া পরয়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীৎ || ২৭ ||
সেই কুন্তীপুত্র সেই সকল বন্ধুগণকে অবস্থিত দেখিয়া, পরম কৃপাবিষ্ট হইয়া বিষাদপূর্ব্বক এই কথা বলিলেন।২৭।
অর্জ্জুন উবাচ
দৃষ্ট্বেমান্ স্বজনান্ কৃষ্ণ যুযুৎসূন্ সমবস্থিতান্।8
সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি || ২৮ ||
অর্জ্জুন বলিলেন-
হে কৃষ্ণ! এই যথেচ্ছু সম্মুখে অবস্থিত স্বজনগণকে দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন হইতেছে এবং মুখ শুষ্ক হইতেছে।২৮।
বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে।
গাণ্ডীবং স্রসংতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিদহ্যতে || ২৯ ||
আমার দেহ কাঁপিতেছে, রোমহর্ষ জন্মিতেছে, হস্ত হইতে গাণ্ডীব খসিয়া পড়িতেছে এবং চর্ম্ম জ্বালা করিতেছে।২৯।
ন চ শক্লোম্যবস্থাতুং ভ্রমতীব চ মে মনঃ।
নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব || ৩০ ||
হে কেশব! আমি আর থাকিতে পারিতেছি না, আমার মন যেন ভ্রান্ত হইতেছে, আমি দুর্লক্ষণ সকল দর্শন করিতেছি।৩০।
ন চ শ্রেয়োহনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ || ৩১ ||
যুদ্ধে আত্মীয়বর্গকে বিনাশ করায় আমি কোন মঙ্গল দেখি না-হে কৃষ্ণ! আমি জয় চাহি না, রাজ্যসুখ চাহি না।৩১।
কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা।
যেষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ || ৩২ ||
ত ইহেনবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্ত্বা ধনানি চ।
আচার্য্যাঃ পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ || ৩৩ ||
মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সম্বন্ধিনস্তথা।
এতান্ন হন্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোহপি মধুসূধন || ৩৪ ||
যাহাদিগের জন্য রাজ্য, ভোগ, সুখ কামনা করা যায়, সেই আচার্য্য, পিতা, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালা এবং কুটুম্বগণ যখন ধন প্রাণ ত্যাগ করিয়া এই যুদ্ধে অবস্থিত, তখন হে গোবিন্দ! আমাদের রাজ্যেই কাজ কি, ভোগেই কাজ কি, জীবনেই কাজ কি? হে মধুসূদন! আমি হত হই হইব, তথাপিও তাহাদিগকে মারিতে ইচ্ছা করি না।৩২।৩৩।৩৪।
“আমি হত হই হইব (ঘ্নতোহপি)” কথার তাৎপর্য্য এই যে, “আমি না মারিলে তাহারা আমাকে মারিয়া ফেলিতে পারে বটে। যদি তাই হয়, সেও ভাল, তথাপি আমি তাহাদিগকে মারিব না। বস্তুতঃ ভীষ্ম, দ্রোণের সহিত অর্জ্জুন এই ভাবেই যুদ্ধ করিয়াছিলেন। অর্জ্জুনের “মৃদু যুদ্ধের” কথা আমরা অনেক বার শুনিতে পাই।
অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিন্নু মহীকৃতে।
নিহত্য ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দ্দন || ৩৫ ||
পৃথিবীর কথা দূরে থাক, ত্রৈলোক্যের রাজ্যের জন্যই বা ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগণকে বধ করিলে কি সুখ হইবে, জনার্দ্দন? ।৩৫।
পাপমেবাশ্রয়েদদ্মান্ হত্বৈতানাততায়িনঃ
তস্মান্নার্হা বয়ং হন্তুং ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ সবান্ধবান্।9
স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব || ৩৬ ||
এই আততায়ীদিগকে বিনাশ করিলে আমাদিগকে পাপ আশ্রয় করিবে, অতএব আমরা সবান্ধব ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদিগকে বিনাশ করিতে পারিব না। হে মাধব! স্বজন হত্যা করিয়া আমরা কি প্রকারে সুখী হইব? ৩৬।
ছয় জনকে আততায়ী বলে-
অগ্নিদো গরদশ্চৈব শস্ত্রপাণির্ধনাপহঃ।
ক্ষেত্রদারাপহারী চ ষড়েতে আততায়িনঃ ||
যে ঘরে আগুন দেয়, যে বিষ দেয়, শস্ত্রপাণি, ধনাপহারী, ভূমি যে অপহরণ করে ও বনিতা অপহরণ করে, এই ছয় জন আততায়ী অর্থশাস্ত্রানুসারে আততায়ী বধ্য। টীকাকারেরা অর্জ্জুনের বাক্যের এইরূপ অর্থ করেন যে, যদিও অর্থশাস্ত্রানুসারে আততায়ী বধ্য, তথাপি ধর্ম্মশাস্ত্রানুসারে গুরু প্রভৃতি অবধ্য। ধর্ম্মশাস্ত্রের কাছে অর্থশাস্ত্র দুর্ব্বল, সুতরাং দ্রোণ ভীষ্মাদি আততায়ী হইলেও তাঁহাদিগের বধে পাপাশ্রয় হইবে। একালে আমরা “Law” এবং “Moralityর” মধ্যে প্রভেদ করি, এ বিচার ঠিক সেইরূপ “Law”র উপর “Morals”ইংরেজের পিনাল কোডেও লিখে যে, অবস্থাবিশেষে আততায়ীর বধজন্য দণ্ড নাই। কিন্তু সেই সকল অবস্থায় আততায়ীর বধ সর্ব্বত্র আধুনিক নীতিশাস্ত্রসঙ্গত নহে।
আনন্দগিরি এই শ্লোকের আর একটা অর্থ করিয়াছেন। তিনি বলেন, এমনও বুঝাইতে পারে যে, গুরু প্রভৃতি বধ করিলে আমরাই আততায়ী হইব; সুতরাং আমাদের পাপাশ্রয় করিবে। “গুরুভ্রাতৃসুহৃৎপ্রভৃতীনেতান্ হত্বা বয়মাততায়িনঃ স্যামঃ।”
যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্ || ৩৭ ||
কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্ত্তিতুং।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দ্দন || ৩৮ ||
যদ্যপি ইহারা লোভে হতজ্ঞান হইয়া কুলক্ষয়দোষ এবং মিত্রদ্রোহে যে পাতক, তাহা দেখিতেছে না, কিন্তু হে জনার্দ্দন! আমরা কুলক্ষয় করার দোষ দেখিতেছি, আমরা সে পাপ হইতে নিবৃত্তিবুদ্ধিবিশিষ্ট কেন না হইব? ৩৭।৩৮।
কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্ম্মাঃ সনাতনাঃ।
ধর্ম্মে নষ্টে ও কুলং কৃৎস্নমধর্ম্মোহভিভবত্যুত || ৩৯ ||
কুলক্ষয়ে সনাতন কুলধর্ম্ম নষ্ট হয়। ধর্ম্ম নষ্ট হইলে অবশিষ্ট কুল অধর্ম্মে অভিভূত হয়।৩৯।
সনাতন কুলধর্ম্ম-অর্থাৎ পূর্ব্বপুরুষপরম্পরা-প্রাপ্ত কুলধর্ম্ম।
অধর্ম্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ।
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ || ৪০ ||
হে কৃষ্ণ! অধর্ম্মাভিভবে কুলস্ত্রীগণ দুষ্টা হয়, স্ত্রীগণ দুষ্টা হইলে, হে বার্ষ্ণেয়!10 বর্ণসঙ্কর জন্মায়।৪০।
সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ || ৪১ ||
এই সঙ্কর কুলনাশকারীদিগের ও তাহাদের কুলের নরকের নিমিত্ত হয়। পিণ্ডোদকক্রিয়ার লোপ হেতু তাহাদিগের পিতৃগণ পতিত হয়।৪১।
দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণসঙ্কররকারকৈঃ।
উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্ম্মাঃ কুলধর্ম্মাশ্চ শাশ্বতাঃ || ৪২ ||
এইরূপ কুলঘ্নদিগের বর্ণসঙ্করকারক এই দোষে জাতিধর্ম্ম এবং সনাতন কুলধর্ম্ম উৎসন্ন যায়।৪২।
উৎসন্নকুলধর্ম্মানাং মনুষ্যাণাং জনার্দ্দন।
নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রম || ৪৩ ||
হে জনার্দ্দন! আমরা শুনিয়াছি যে, যে মনুষ্যদিগের কুলধর্ম উৎসন্ন যায়, তাহাদিগের নিয়ত নরকে বাস হয়।৪৩।
৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, এই পাঁচটি শ্লোক আধুনিক কৃতবিদ্য পাঠকদিগের কানে ভাল লাগিবে না। ইহা বর্ণসঙ্কর-বিরোধী প্রাচীন কুসংস্কারপূর্ণ বলিয়া বোধ হইবে, তার উপর “লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ” প্রভৃতি অলঙ্কারও আছে। বর্ণসঙ্করের উপর গীতকারের বিশেষ বিদ্বেষ দেখা যায়। ইনি স্বয়ং ভগবানের মুখেও বর্ণসঙ্করের নিন্দা সন্নিবিষ্ট করিয়াছেন। আমরা যখন তদ্বিষয়িণী ভগবদুক্তির সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইব, তখন তদুক্তির তাৎপর্য্য বুঝিবার চেষ্টা করিব। এক্ষণে অর্জ্জুনোক্তির স্থূল মর্ম্ম বুঝিলেই যথেষ্ট হইল। কুলের পুরুষগণ মরিলে কুলস্ত্রীগণ যে ব্যভিচারিণী হয়, ইহা সচরাচর দেখা যায়। কুলস্ত্রীগণ ব্যভিচারিণী হইলে তাহাদিগের গর্ভে নীচ লোকের ঔরসে সন্তান জন্মিতে থাকে। বংশ নীচ সন্ততিতে পরিপূর্ণ হয়, কাজেই কুলধর্ম্ম লোপ পায়। বর্ণসঙ্করে যাঁহারা দোষ না দেখেন, এবং পিণ্ডাদির স্বর্গকারকতায় যাঁহারা বিশ্বাসবান্ নহেন-স্বর্গ নরকাদিও যাঁহারা মানেন না, তাঁহারাও বোধ করি, এতটুকু স্বীকার করিবেন।11বাকীটুকু কালোচিত ভাষা এবং অলঙ্কার। কথাটা অতি মোটা কথা বটে। কথাটা অর্জ্জুনের মুখে বসাইবার একটু কারণ আছে-অর্জ্জুনের এই “কুলধর্ম্মের” বড়াইয়ের উত্তরে ভগবান্ “স্বধর্ম্মের” কথাটা তুলিবেন। এটুকু গ্রন্থকারের কৌশল। “ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন রাজ্যং সুখানি চ” এই অমৃতময় বাক্যের পর বলিবার যোগ্য কথা এ নহে।
অহো বত মহৎ পাপং কর্ত্তুং ব্যবসিতা বয়ং।
যদ্রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ || ৪৪ ||
হায়! আমরা রাজ্যসুখলাভে স্বজনকে বধ করিতে উদ্যত হইয়াছি-মহৎ পাপ করিতে অধ্যবসায় করিয়াছি।৪৪।
যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ।
ধার্ত্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ || ৪৫ ||
যদি আমি প্রতীকারপরাঙ্মুখ এবং অশস্ত্র হইলে শস্ত্রধারী ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ যুদ্ধে আমাকে বিনাশ করে, তাহাও আমার পক্ষে অপেক্ষাকৃত মঙ্গলকর হইবে।৪৫।
সঞ্জয় উবাচ।
এবমুক্ত্বার্জ্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ।
বিসৃজ্য সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ || ৪৬ ||
সঞ্জয় বলিলেন-
অর্জ্জুন এইরূপ বলিয়া শোকাকুল মানসে ধনুর্ব্বাণ পরিত্যাগ করিয়া সংগ্রামস্থলে রথোপস্থে উপবেশন করিলেন।৪৬।
শ্রীভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে
শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসম্বাদে অর্জ্জুনবিষাদে 13
নাম প্রথমোহধ্যায়ঃ।
বলিয়াছি, গীতার প্রথম অধ্যায়ে ধর্ম্মতত্ত্ব কিছু নাই, কিন্তু এই অধ্যায় একখানি উৎকৃষ্ট কাব্য। কাব্যর উপাদান সকল এখানে বড় সুন্দর সাজান হইয়াছে। কুরুক্ষেত্রে উভয় সেনা সুসজ্জিত হইয়া পরস্পর সম্মুখীন হইয়াছে। পাণ্ডবদিগের মহতী সেনা ব্যূহবদ্ধা হইয়াছে দেখিয়া রাজা দুর্য্যোধন, পরম রণপণ্ডিত আপনার আচার্য্যকে দেখাইলেন। একটু ভীত হইয়া আচার্য্যকে বলিলেন, “আপনারা আমার সেনাপতি ভীষ্মকে রক্ষা করিবেন।” কিন্তু সেই বৃদ্ধ ভীষ্ম যুবার অপেক্ষাও উদ্যমশীল-তিনি সেই সময়ে সিংহনাদ করিয়া শঙ্খধ্বনি করিলেন-(শঙ্খ তখনকার bugle) । তাঁহার শঙ্খধ্বনি শুনিয়া উৎসাহে বা প্রত্যুত্তরে উভয় সৈন্যস্থ যোদ্ধৃগণ সকলেই শঙ্খধ্বনি করিলেন। তখন উভয় দলে নানাবিধ রণবাদ্য বাজিয়া উঠিল-শঙ্খে, ভেরীতে, অন্যান্য বাদ্যের কোলাহলে গগন বিদীর্ণ হইল-আকাশ পৃথিবী তুমুল হইয়া উঠিল। সেই মহোৎসাহের সময়ে স্থিরচিত্ত অর্জ্জুন-যাঁহার উপরে কৌরব-জয়ের ভার-আপনার সারথি কৃষ্ণকে বলিলেন-“একবার উভয় সেনার মধ্যে রথ রাখ দেখি,-দেখি, কাহার সঙ্গে আমায় যুদ্ধ করিতে হইবে।” কৃষ্ণ, শ্বেতাশ্বযুক্ত মহারথ উভয় সেনার মধ্যে স্থাপিত করিলেন,-সর্ব্বজ্ঞ সর্ব্বকর্ত্তা বলিলেন, “এই দেখ।” অর্জ্জুন দেখিলেন, দুই দিকেই ত আপনার জন,-পিতৃব্য, পিতামহ, পুত্র, পৌত্র, মাতুল, শ্বশুর, শ্যালক, সুহৃৎ, সখা-তাঁহার গা কাঁপিয়া উঠিল, শরীরে রোমাঞ্চ হইল, মুখ শুকাইল, দেহ অবসন্ন হইল, মাথা ঘুরিল, হাত হইতে সেই মহাধনু গাণ্ডীব খসিয়া পড়িল। বলিলেন, “কৃষ্ণ! রাজ্য যাদের জন্য, তাদের মারিয়া রাজ্যে কি ফল?-আমি যুদ্ধ করিব না।” এই সংগ্রামক্ষেত্র, দুই দিকে দুই মহতী সেনা, এই তুমুল কোলাহল, রণবাদ্য এবং ঘোরতর উৎসাহ-সেই সময়ে এই মহাবীরের প্রথমে স্থৈর্য্য, তার পর তাঁহার হৃদয়ে সেই করুণ এবং মহান্ প্রশান্ত ভাব-এরূপ মহচ্চিত্র সাহিত্যজগতে দুর্লভ। “ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ”-ঈদৃশী অমৃতময়ী বাণী আর কে কোথায় শুনিয়াছে?
1 M. Stanislaus Julien অনুবাদে লিখিয়াছেন “Le champ due boneheur.”
2 সাহেবদিগের ভ্রমের উদাহরণস্বরূপ গীতার অনুবাদক গীতার অনুবাদক টম্সনের টীকা হইতে দুই ছত্র উদ্ধৃত করিতেছি। কুরুক্ষেত্র সম্বন্ধে লিখিতেছেন;-“A part of Dharmmakshetra, the flat plain around Delhi, which city is often identified with Hastinapur, the Capital of Kurukshetra.”
এইটুকুর ভিতর ৫টি ভুল। (১) ধর্ম্মক্ষেত্র নামে স্বতন্ত্র ক্ষেত্র নাই। (২) কুরুক্ষেত্র ধর্ম্মক্ষেত্রের অংশ মাত্র নহে। (৩) “The flat plain around Delhi” কুরুক্ষেত্র নহে। (৪) দিল্লী হস্তিনাপুর নহে। (৫) হস্তিনাপুর কুরুক্ষেত্রের রাজধানী নহে। এতটুকুর ভিতর এতগুলি ভুল একত্র করা যায়, আমরা জানিতাম না।
3 সৌমদত্তিস্তথৈব চ ইতি পাঠান্তর আছে।
4 তুমুলো ব্যনুনাদয়ন্ ইতি পাঠান্তর আছে।
5 বোধ করি পাঠকের স্মরণ আছে যে, সঞ্জয়োক্তি চলিতেছে। সঞ্জয় কুরুক্ষেত্রের বৃত্তান্ত ধৃতরাষ্ট্রকে শুনাইতেছেন।
6 বোধ করি পাঠকের স্মরণ আছে যে, সঞ্জয়োক্তি চলিতেছে। সঞ্জয় কুরুক্ষেত্রের বৃত্তান্ত ধৃতরাষ্ট্রকে শুনাইতেছেন।
7 ধৃতরাষ্ট্র এবং অর্জ্জুন উভয়েই “ভারত” বলিয়া এই গ্রন্থে সম্বোধন করা হইয়াছে, তাহার কারণ, ইঁহারা দুষ্মন্তপুত্র ভরতের বংশ।
8 দৃষ্ট্বেমং স্বজনং কৃষ্ণ যুযুৎসুং সমুপস্থিতম্ ইতি পাঠান্তর আছে।
9 স্ববান্ধবান্ ইতি পাঠান্তর আছে।
10 কৃষ্ণ বৃষ্ণিবংশসম্ভূত, এজন্য বার্ঞেয়।
11 The women, for instance, whose husbands, friends or relations have been all slain in battle, no longer restrained by law, seek husbands among other and lower castes, or tribes, causing a mixture of blood, which many nations at all ages have regarded as a most serious evil; but particularly those who-like the Aryans, the Jews and the Scotch-were at first surrounded by foreigners very different to themselves, and thus preserved the distinction and genealogies of their races more effectively than by other. (Thomson’s Translation of the Bhagavadgita, p.7.)
By the destruction of the males the rites of both tribe and family would cease, because women were not allowed to perform them; and confusion of castes would arise, for the women would marry men of another caste. Such marriages were considered impure (Manu, x. 1-40). Such marriages produced elsewhere a confusion of classes. Livy tells us that the Roman patricians at the instance of Canuleius complained of the intermarriages of the plebian class with their own, affirming that “omnia humanaque turbari, ut qui natus sit, ignored, cujus sanguinis, quorum sacrorum sit.” (Davies’ Translation of the Bhagavadgita, p. 26.)
In bringing forward these and other melancholy superstitions of Brahmanism in the mouth of Arjuna, we are not suppose that our poet-though as much Brahman as Philosophrer in many unimportant points of belief-himself received and approved of them. (Thomson, p. 7.)
13 কোন কোন পুস্তকে “সৈন্যদর্শনং” ইতি পাঠ আছে।