আর একবার যে আমরা ভূতনাবানো দেখেছিলেম, সেও বড় চমৎকার। আমাদের পাড়ার একজনের বড় ভয়ানক রোগ হয়। স্যাকরারা বিলক্ষণ সঙ্গতিপন্ন, সুতরাং রোগের চিকিৎসা কত্তে ত্রুটি কল্লে না, ইংরেজ-ডাক্তার বদ্দি ও হাকিমের ম্যালা করে ফেল্লে; প্রায় তিন বৎসর ধরে চিকিৎস হলো, কিন্তু রোগের কেউ কিছু কত্তে পাল্লে না। রোগ ক্রমশঃ বৃদ্ধি হচ্ছে দেখে বাড়ীর মেয়েমহল তুলসী দেওয়া-কালীঘাটে সস্তেন—কালভৈরবে স্তবপাঠ-তুক্তাক—সাফরিদ-নারাণ–বালওড়-বালসী— শোপুর–নুরপুর ও হালুমপুর প্রভৃতি বিখ্যাত জায়গার চন্নামেন্তো ও মাদুলি ধারণ হলো, তারকেশ্বরে হত্যে দিতে লোক গেল-বাড়ীর বড় গিন্নী কালীঘাটে বুক চিরে রক্ত দিতে ও মাথায় ও হাতে ধূনো পোড়াতে গেলেন—শেষে একজন ভূতচালা আনা হয়।
ভূতচালার ভূতের ডাক্তারি পর্য্যন্ত করা আছে। আজকাল দু-এক বাঙ্গালী ডাকতার মধ্যে মধ্যে পেসেণ্টের বাড়ী ভূত সেজে দেখা দেন—চাদরের বদলে দড়ি ও পেরেক সহিত মশারি গায়ে, কখন বা উলঙ্গ হয়েও আসেন, কেবল মন্ত্রের বদলে চার পাঁচ জন রোজায় ধরাধরি করে আনতে হয়। এঁরা কলকেতা মেডিকেল কলেজের এজুকেটেড ভূত। ভূতচালা চণ্ডীমণ্ডপে বাসা পেলেন, ভূত আসবার প্রোগ্রাম স্থির হলো—আজ সন্ধ্যার পরেই ভূত নামবেন, পাড়ায় দু-চার বাড়ীতে খবর দেওয়া হলো—ভূত মনের কথা ও রুগীর ঔষধ বলে দেবে। ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে গেল, কুঠীওয়ালারা ঘরে ফিল্লেন-বারফট্কারা বেরুলেন, বিগ্রহের উত্তরাঢ়ি কায়েতের মত (দর্শন মাত্র) সেতল খেলেন, গীর্জ্জের ঘড়ীতে ঢং ঢং ঢং করে নটা বেজে গেল, গুম করে তোপ পড়লো। ছেলেরা “বোমকালী কলকেতাওয়ালী” বলে হাততালি দে উঠলো,–ভূতনাবানো আসরে নাবলেন!
আমাদের প্রতিবাসী, ভূতনাবানোর কথাপ্রমাণ ও বাড়ীর গিন্নিদের মুখে শুনে ভূতের আহার জন্য আয়োজন কত্তে ত্রুটী করে নাই; বড়বাজারের সমস্ত উত্তমোত্তম মেঠাই; ক্ষীরের নানারকম পেয় ও লেহ্যরা পদার্পণ কল্লেন। বোধ হয়, আমাদের মত প্রকৃত ফলারের দশ জনে তাদের শেষ কত্তে পারে না; রোজা ও তাঁর দুই চেলায় কি করবেন! রোজা ঘরে ঢুকে একটি পিঁড়েয় বসে ঘরের ভিতরে সকলের পরিচয় নিতে লাগলেন—অনেকের আপদমস্তক ঠাউরে দেখে নিলেন—দুই এক জন কলেজ বয় ও মোটা মোটা লাঠিওয়ালারা নিমন্ত্রিতদের প্রতি তাঁর যে বড় ঘৃণা জন্মেছিল, তা তাঁর সে সময়ের চাউনিতেই জানা গেল।
রোজার সঙ্গে দুটি চেলামাত্র, কিন্তু ঘরে প্রায় জন চল্লিশ ভূত দেখবার উমেদার উপস্থিত, সুতরাং ভূত প্রথমে আসতে অস্বীকার করেছিলেন। তদুপলক্ষে রোজাও “কাল ও কৃশ্চানীর” উপলক্ষে একটু বক্তৃতা কোত্তে ভোলেন নাই—শেষে দর্শকদের প্রগাঢ় ভক্তি ও ঘরের আলো নিবিয়ে অন্ধকার করবার সম্মতিতে, রোজা ভূত আন্তে রাজি হলেন–চেলারা খাবার দাবার সাজানো থালা যে সে বসলেন, দরজায় হুড়কো পড়লো, আলো নিবিয়ে দেওয়া হলো; রোজ্য কোশা-কুশী ও আসন নিয়ে শুদ্ধাচারে ভূত ডাকতে বলেন। আমরা ভূতের ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে বারোইয়ারির গুদোমজাৎ সংগুলির মত অন্ধকারে বসে রইলেম!
পাঠক! আপনার স্মরণ থাকতে পারে, আমরা পূর্ব্বেই বলেছি যে, আমাদের ঠাকুরমা ভূত ও পেতনীর ভয় নিবারণের জন্য একটি ছোট জয়ঢাকের মত মাদুলীতে ভূকৈলেসের মহাপুরুষের পায়ের ধূলো পূরে আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দেন, তা সওয়ায় আমাদের গলায় গুটি বারো রকমারি পদক ও মাদুলী ছিল, দুটি বাঘের নখ ছিল, আর কুমীরের দাঁত, মাছের আঁশ ও গণ্ডারের চামড়াও কোমরের গেটে সাবধানে রাখা হয়। আর হাতে একখানা বাজুর মত কবচ ও তারকেশ্বরের উদ্দেশে সোণার তাগা বাঁধা ছিল। খুব ছেলেবেলা আমাদের একবার বড় ব্যায়রাম হয়, তাতেই আমাদের পায়ে চোরের সিধের বেড়ী পরিয়ে দেওয়া হয় ও মাথায় পঞ্চানন্দের একটি জট থাকে; জট্টি তেল ও ধুলোতে জড়িয়ে গিয়ে রাম ছাগলের গলায় নুন্নশীর মত ঝুলতো! কিন্তু আমরা স্কুলের অবস্থাতেই অল্পবয়সে অ্যাম-বিশেষণের দাস হয়ে ব্রাহ্ম-সমাজে গিয়ে একখানা ছাবান হেডিংওয়ালা কাগজে নাম সই করি; তাতেই শুনলেম যে আমাদের ব্রাহ্ম হওয়া হলো। সুতরাং তারই কিছু পূর্ব্বে স্কুলের পণ্ডিতের মুখে মহাপুরুষের দুর্দশা শুনে পূর্বোক্ত কবচ, মাদুলী প্রভৃতি খুলে ফেলেছিলাম! আজ সেইগুলি আবার স্মরণ হলো, মনে কল্লেম, যদি ভূত নাবানো সত্যই হয়, তা হলে সেগুলি পোরে আসতে পাল্পে ভূতে কিছু কত্তে পারবে না। এই বিবেচনা করে, সেইগুলির তত্ত্ব করে, কিন্তু পাওয়া গেল না—সেগুলি আমাদের পৌত্তরের ভাতের সময়ে একটা চাকর চুরি করে; চুরিটি ধরবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি হয় নি। গিন্নী শনিবারে একটা সুপুরি, পয়সা ও সওয়া কুনকে চেলের মুদে বাঁধেন; ন্যেপীর মা বলে আমাদের বহুকালের এক বুড়ী দাসী ছিল, সে সেই মুদোটি নে জানের বাড়ী যায়, জান গুনে বলে দেয়, “চোর বাড়ীর লোক, বড় কালও নয় সুন্দরও নয়। শামবর্ণ, মানুষটি একহারা, মাজারি গোঁফ, মাথায় টাক থাকতেও পারে”–না থাকতেও পায়ে” জানের গোণাতে আমাদেরও চাকরটিকেই চোর স্থির করে ছাড়িয়ে দেওয়া যায়। সুতরাং সে মাদুলীগুলি পাওয়া গেল না, বরং ভূতের ভয় বেড়ে উঠলো।
ব্রাহ্ম হলেও যে ভুতে ধরবে না, এটিরও নিশ্চয় নাই। সে দিন কলকেতার ব্রাহ্মসমাজের এক জন ডাইরেক্টরের স্ত্রীকে ডাইনে পায়—নানা দেশদেশান্তর থেকে রোজা আনিয়ে কত ঝাড়ান-ঝোড়ান, সরষেপড়া জলপড়া ও লঙ্কাপড়া দিতে ভাল হয়। অনেক ব্রাহ্মের বাড়ীতে ভূতচতুর্দ্দশীর প্রদীপ দিতে দেখা যায়।
এদিকে রোজ খানিকক্ষণ ডাকতে ডাকতে ভূতের আসবার পূর্ব্বলক্ষণ হতে লাগলো। গোহাড়, ঢিল, ইট ও জুতো হাঁড়ি বাড়ীর চতুর্দ্দিকে পড়তে লাগলো। ঘরের ভেতর গুপ গুপ করে কে যেন নাচছে বোধ হতে লাগলো; খানিকক্ষণ এই রকম ভূমিকার পর মড়া করে একটা শব্দ হলো; ভূতের বসবার জন্য ঘরের ভিতর যে পিঁড়েখানা রাখা হয়েছিল, শব্দে বোধ হলো সেইখানি দুচীর হয়ে ভেঙ্গে গেল—রোজা সভয়ে বলে উঠলেন–শ্ৰীযুৎ এয়েচেন।
আমরা ছেলেবেলা আমাদের বুড়ো ঠাকুরমার কাছে শুনেছিলেম যে ভূতে ও পেত্নীতে খোঁনা কথা কয় সেটি আমাদের সংস্কারবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, আজ তার পরীক্ষা হলো। ভূত পিঁড়ে ফাটিয়েই খোঁনা কথা কইতে লাগলেন প্রথমে এসেই কলেজ-বয়দের দলের দুই একজনের নাম ধরে ডাকলেন, তাদের নাস্তিক ও কৃশ্চান বলে ডাক দিলেন। শেষে ভূতত্ত্ব নিবন্ধন ঘাড় ভাঙ্গবার ভয় পৰ্য্যন্ত দেখাতে ত্রুটি করেন নাই। ভূতের খোঁনা কথা ও অপরিচিতের নাম বলাতেই বাড়ীর কর্ত্তা বড় ভয় পেলেন জোড় হাত করে (অন্ধকারে জোড় হাত দেখা অসম্ভব কিন্তু ভূত অন্ধকারে দিব্বি দেখতে পান সুতরাং কর্ম্মকর্ত্তা অন্ধকারেও জোড় হস্তে কথা কয়েছিলেন, এ আমাদের কেবল ভাবে বোধ হলে ক্ষমা চাইলেন, কিন্তু ভূত সর মর্ডাণ্ট ওয়েলসের মত যা ধরেন, তার সমূলচ্ছেদ না করে ছাড়েন না। সুতরাং আমাদের ঘাড় ভঙ্গিবার প্রতিজ্ঞা অন্যথা হলো না, শেষে রোজা ও বুড়ো বুড়ো দর্শক ও বাড়ীওয়ালার অনেক সাধ্যসাধনার পর ভূত মহোদ ষষ্টীবাটায় আগত জামাইয়ের মত, যৎকিঞ্চিৎ জলযোগ কত্তে সম্মত হলেন, আমরাও পালাবার পথ আঁচতে লাগলেম।
লুচির চটকানো চিবানোর চপ চপর ও সাপটা ফলারের হাপুর হুপুর শব্দ থামতে প্রায় আধ ঘণ্টা লাগলো, শেষে ভূত জলযোগ করে গাঁজা ও তামাক খাচ্ছেন, এমন সময়ে পাশ থেকে ওলাউঠো রুগীর বমির ভূমিকাত মত উঁকীর শব্দ শোনা যেতে লাগলো। ক্রমে উঁকীর চোটে ভুতের বাকরোধ হয়ে পড়লো–বমি! হুড় হুড় করে বমি! গৃহস্থ মনে কল্লেন, ভুত মহাশয় বুঝি বমি কচ্চেন; সুতরাং তাড়াতাড়ি আলো জ্বালিয়ে আনালেন! শেষে দেখি কি চেলা ও রোজা খোদই বমি কচ্চেন, ভূত সরে গেচেন। আমরা পূৰ্ব্বে শুনিনে যে, গেরস্তর অগোচরে একজন মেডিকেল কলেজের ছোকরা ভূতের জন্য সংগৃহীত উপচারে ‘টার্টার এমেটিক্’ মিশিয়ে দিয়েছিলেন; রোজা ও চেলারা তাই প্রসাদ পাওয়াতেই তাদের এই দুর্দশা, সুতরাং ভূতনাবানোর উপর আমাদের যে ভক্তি ছিল, সেটুকু উবে গেল! সুতরাং শেষে আমরা এই স্থির কল্লেম যে, ইংরেজি ভুতেদের কাছে দেশী ভূত খবরে আসে না।
এ সওয়ায় আমরা আরও দুস্টারি জায়গায় ভূতনাবানো দেখেচি, পাঠকরাও বিস্তর দেখেছেন, সুতরাং সে সকল এখানে উত্থাপন করা অনাবশ্যক, ভূনানো ও ‘হোসেন খাঁ’ কেবল জুচ্চরী ও হুজুকের আনুষঙ্গিক বলেই আমরা উল্লেখ কল্লেম।