আমরা ছেলেবেলাতেই জ্যাঠার শিরোমণি ছিলেম; স্কুল ছাড়াতে জ্যাঠামি, ভাতের ফ্যানের মতন, উথলে উঠলো; (বোধ হয় পাঠকেরা এই হুতোমপ্যাঁচার নক্সাতেই আমাদের জ্যাঠামির দৌড় বুঝতে পেরে থাকবেন) আমরা প্রলয়-জ্যাঠা হয়ে উঠলেম—কেউ কেউ আদর করে ‘চালাকদাস’ বলে ডাকতে লাগলেন।
ছেলেবেলা থেকেই আমাদের বাঙ্গালা ভাষার উপর বিলক্ষণ ভক্তি ছিল, শেখবারও অনিচ্ছা ছিল না। আমরা পূর্ব্বেই বলেছি যে, আমাদের বুড়ো ঠাকুরমা ঘুমোবার পূর্ব্বেই নানাপ্রকার উপকথা কইতেন। কবিকঙ্কণ, কৃত্তিবাস ও কাশীদাসের পয়ার আওড়াতেন। আমরাও সেইরূপ মুখস্থ করে স্কুলে, বাড়ীতে ও মার কাছে আওড়াতেম–মা শুনে বড় খুসী হতেন ও কখন কখন আমাদের উৎসাহ দেবার জন্যে ফি পয়ার পিছু একটি করে সন্দেশ প্রাইজ দিতেন; অধিক মিষ্টি খেলে তোৎলা হতে হয়, ছেলেবেলায় আমাদের এ সংস্কার ছিল; সুতরাং কিছু আমরা আপনারা খেতুম, কিছু কাগ ও পায়রাদের জন্যে ছাদে ছড়িয়ে দিতুম। আর আমাদের মঞ্জুরী বলে দিব্বি একটি সাদা বেড়াল ছিল, (আহা! কাল সকালে সেটি মরে গ্যাছে—বাচ্চাও নাই) বাকী সে প্রসাদ পেতো। সংস্কৃত শেখাবার জন্যে আমাদের এক জন পণ্ডিত ছিলেন, তিনি আমাদের লেখা-পড়া শেখাবার জন্যে বড় পরিশ্রম কত্তেন। ক্রমে আমরা চার বছরে মুগ্ধবোধ পার হলেম, মাঘের দুই পাত ও রঘুর তিন পাত পড়েই আমাদের জ্যাঠামোর সুত্র হলো; টিকী, ফোঁটা ও রাঙ্গা বনাতওয়ালা টুলো ভট্টাচাৰ্য্য দেখলেই তক্ক কৰ্ত্তে যাই, ছোঁড়াগোচের ঐ রকম বেয়াড়া বেশ দেখতে পেলেই তর্কে হারিয়ে টিকী কেটে নিই; কাগজে প্রস্তাব লিখি–পয়ার লিখতে চেষ্টা করি ও অন্যের লেখা প্রস্তাব থেকে চুরি করে আপনার বলে অহঙ্কার করি—সংস্কৃত কলেজ থেকে দূরে থেকেও ক্রমে আরও ঠিক একজন। সংস্কৃত কলেজের ছোকরা হয়ে পড়লেম; গৌরবলাভেচ্ছা হিন্দুকুশ ও হিমালয় পর্ব্বত থেকেও উঁচু হয়ে উঠলো—কখন বোধ হতে লাগলো, কিছুদিনের মধ্যে আমরা দ্বিতীয় কালিদাস হবো; (ওঃ বিষ্ণু, কালিদাস বড় লম্পট ছিলেন) তা হওয়া হবে না, তবে ব্রিটনের বিখ্যাত পণ্ডিত জনসন? (তিনি বড় গরীবের ছেলে ছিলেন, সেটি বড় অসঙ্গত হয়)। রামমোহন রায়? হাঁ, একদিন রামমোহন রায় হওয়া যায় কিন্তু বিলেতে মত্তে পারবো না।
ক্রমে কি উপায়ে আমাদের পাঁচজনে চিনবে, সেই চেষ্টাই বলবর্তী হলো; তারি সার্থকতার জন্য আমরা বিদ্যোৎসাহী সাজলেম—গ্রন্থকার হয়ে পড়লেম—সম্পাদক হতে ইচ্ছা হলো—সভা কল্লেম—ব্রাহ্ম হলেম-তত্ত্ববোধিনী সভায় যাই—বিধবাবিয়ের দলাদলি করি ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত প্রভৃতি বিখ্যাত দলের লোকদের উপাসনা করি—আন্তরিক ইচ্ছে যে, লোকে জানুক যে, আমরাও ঐ দলের ছোট খাট কেষ্ট বিষ্টুর মধ্যে।
হায়! অল্পবয়সে এক একবার অবিবেচনার দাস হয়ে আমরা যে সকল পাগলামো করেছি, এখন সেইগুলি স্মরণ হলে কান্না ও হাসি পায়; অবিরি এখন যে পাগলামী প্রকাশ কচ্চি, এর জন্য বৃদ্ধবয়সে অনুতাপ তোলা রইলো! মৃত্যু-শয্যার পাশে যবে এইগুলির ভয়ানক ছবি দেখা যাবে, ভয়ে ও লজ্জায় শরীর দাহ কত্তে থাকবে, তখন সেই অনন্য-আশ্রয় পরমেশ্বর ভিন্ন আর জুড়াবার স্থান পাওয়া যাবে না! বাপ-মার কাছে মার খেয়ে ছেলেরা যেমন তাঁদেরই নাম করে, ‘বাবা গো–মা গো, বলে কাঁদে, আমরা তেমনি সেই ঈশ্বরের অজ্ঞা লঙ্ঘননিবন্ধন বিপদে পড়ে তার নাম ধরেই,—পাঠক! তোমায় ভেংচুতে ভেংচুতে ও কলা দেখাতে দেখাতে তরে যাব।
প্রলয় গৰ্ম্মিতে আমরা একদিন মোটা চাদর গায়ে দিয়ে ফিলজফর সেজে বেড়াচ্ছি, এমন সময়ে নদে অঞ্চলের একজন মুহুরি বল্লে যে, “আমাদের দেশে হুজুক উঠেছে, ১৫ই কার্ত্তিক রবিবার দিন দশ বছরের মধ্যের মরা মানুষরা যমালয় থেকে ফিরে আস্বে”—জন্মের মধ্যে কৰ্ম্ম নিমুর চৈত্র মাসে রাসের মত সহরের বেণেবাবুরা সিংহবাহিনী ঠাকরুণের পালায় যেমন ছোট আদালতের দু চার কয়েদী খালাস কবেন, সেই রকম স্বর্গের কোন দেবতা আপনার ছেলের বিবাহ উপলক্ষে যমালয়ের কতকগুলি কয়েদী খালাস করবেন; নদের রামশর্মা অচার্য্যি স্বয়ং গুণে বলেছেন। আমরা এই অপরূপ হুজুক শুনে তাক হয়ে রইলেম! এদিকে সহরেও ক্রমে গোল উঠলো ‘১৫ই কার্ত্তিক মরা ফিরবে।’ বাঙ্গালা খবরের কাগজওয়ালারা কাগজ পুরাবার জিনিস পেলেন—একটি গেরো দিলে পূর্ব্বের গেরোটি যেমন আল্গা হয়ে যায়, বিধবাবিবাহ প্রচার করাতে সহরের ছোট ছোট বিধবাদের বিদ্যাসাগরের প্রতি যে ভক্তিটুকু জন্মেছিল, সেটুকু সেই প্রলয় হুজুকে ঋতুগত থারমোমিটরের পারার মত একেবারে অনেক ডিগ্রী নেবে গিয়ে, বিলক্ষণ টিলে হয়ে পড়লো।
সহরে যেখানে যাই সেইখানেই মরা ফেরবার মিছে হুজুক! আশা নির্ব্বোধ স্ত্রী ও পুরুষদলের প্রিয়সহচরী হলেন। জোচ্চোর ও বদমাইসেরা সময় পেয়ে গোছাল গোছাল জায়গায় মরা ফেরা সেজে যেতে লাগলো; অনেক গেরেস্তোর ধর্ম্ম নষ্ট হলো—অনেকের টাকা ও গয়না গেল। ক্রমে আষাঢ়ান্ত বেলার সন্ধ্যার মত–শোকাতুরের সময়ের মত, ১৫ই কার্ত্তিক নবাবিচালে এসে পড়লেন। দুর্গোৎসবের সময়ে সন্ধিপূজোর ঠিক শুভক্ষণের জন্য পৌত্তলিকেরা যেমন প্রতীক্ষা করে থাকেন, ডাক্তারের জন্য মুমূর্ষ রোগীর আত্মীয়েরা যেমন প্রতীক্ষা করে থাকেন ও স্কুলবয় ও কুঠিওয়ালারা যেমন ছুটীর দিন প্রতীক্ষা করেন—বিধবা ও পুত্রসহোদরবিহীন নির্ব্বোধ পরিবারেরা সেই রকম ১৫ই কার্ত্তিকের অপেক্ষা কবেছিলো। ১৫ই কার্ত্তিকই দিল্লীর লাড্ডু হয়ে পড়লেন—যাঁরা পূর্ব্বে বিশ্বাস করেন নি, ১৫ই কার্ত্তিকের আড়ম্বর ও অনেকের অতুল বিশ্বাস দেখে তাঁরাও দলে মিশলেন। ছেলেবেলা আমাদের একটি চিনের খরগোশ ছিল; আজ বছর অষ্টেক হলো, সেটি মরেচে–ভাঙ্গা পিঁজয়ের মাটী ঝেড়ে ঝুড়ে, তুলো পেড়ে বিছানা টিছানা করে তার অপেক্ষায় রইলেম।
১৫ই কার্ত্তিক মরা ফিরবে কথা ছিল, আজ ১৫ই কার্ত্তিক। অনেকে মরার অপেক্ষায় নিমতলা ও কাশীমিত্রের ঘাটে বসে রইলেন। ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে গেল, রাত্রি দশটা বাজে, মরা ফির্ল না; অনেকে মরার অপেক্ষায় থেকে মড়ার মত হয়ে রাত্তিরে ফিরে এলেন; মরা ফেরার হুজুক থেমে গেল।