রাবণের কথা তোমরা সকলেই জান। রাবণের পিতার নাম বিশ্রবা, মায়ের নাম কৈকসী। বিশ্রবা পরম ধার্মিক মুনি ছিলেন। রাবণ আর তাহার ভাইবোনেরা জন্মিবার পূর্বেই তিনি বলিয়াছিলেন যে, ইহাদের সকলের ছোটটি খুব ধার্মিক হইবে, আর সকলেই ভয়ংকর দুষ্ট রাক্ষস হইবে।
মুনি যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাই হইল। রাবণ, কুম্ভকর্ণ আর তাহাদের বোন সূর্পনখা, ইহাদের এক একটা এমনি বিকট আর দুষ্ট রাক্ষস হইল যে কি বলিব। ইহাদের ছোট ভাই বিভীষণও রাক্ষস ছিল বটে কিন্তু সে যারপরনাই ভালো লোক ছিল।
রাবণের দশটা মাথা আর কুড়িটা হাত ছিল। দাঁতগুলো ছিল থামের মতো বড়-বড়। চুলগুলি আগুনের শিখার মতো লাল, আর শরীরটা কালো পর্বতের মতো বিশাল। তাহার জন্মের সময় পৃথিবী কাঁপিয়াছিল, সূর্য ময়লা হইয়া গিয়াছিল আর সমুদ্রের জল তোলপাড় হইয়া উঠিয়াছিল। দশটা মাথা দেখিয়া তাহার পিতা তাহার নাম রাখিয়াছিলেন দশগ্রীব’। উহাই উহার আসল নাম, রাবণ নাম পরে হইয়াছিল।
ছেলেবেলায় রাবণ ভাইদিগকে লইয়া দশ হাজার বৎসর ভয়ংকর তপস্যা করিয়াছিল। এই দশ হাজার বৎসর সে আহার করে নাই। এক এক হাজার বৎসর যাইত আর নিজের এক একটি মাথা কাটিয়া সে আগুনে আহুতি দিত। নয় হাজার বৎসরে নয়টি মাথা সে এইরূপ করিয়া আগুনে দিল। তারপর দশ হাজার বৎসর পূর্ণ হইলে, যেই সে তাহার বাকি একটি মাথাও কাটিতে যাইবে, আমনি ব্রহ্মা আসিয়া বলিলেন, “দশগ্রীব, আমি খুশি হইয়াছি, এখন তুমি বর লও।”
দশগ্রীব বলিল, “আমাকে অমর করিয়া দিন।” ব্রহ্মা বলিলেন, “সেটি হইবে না, অন্য বর লও।” দশগ্রীব বলিল, “তবে এই বর দিন যে দানব, দৈত্য, যক্ষ, রক্ষ, নাগ, পক্ষী ইহাদের কেহই আমাকে মারিতে পরিবে না।” ব্রহ্মা বলিলেন, “আচ্ছা তাহাই হইবে। তাহা ছাড়া তোমার যে মাথাগুলি কাটিয়া দিয়াছ তাহাও ফিরিয়া পাইবে, ইহার ওপর আবার যখন যেরূপ তোমার ইচ্ছা হয়, তেমনি চেহারা করিতে পরিবে।”
কুম্ভকর্ণ আর বিভীষণও এই দশ হাজার বৎসর খুব তপস্যা করিয়াছিল, সুতরাং ব্রহ্মা তাহাদিগকেও বর দিতে গেলেন। বিভীষণ বলিল, “আমাকে দয়া করে এই বর দিন, যেন আমার ধর্মে মতি থাকে।” এ কথায় ব্রহ্মা অতিশয় তুষ্ট হইয়া তাহাকে সে বর তো দিলেনই
উপেন্দ্র—৯০ তাহা ছাড়া তাহাকে অমর করিয়া দিলেন।
কুম্ভকর্ণকে বর দিবার সময় দেবতারা ব্রহ্মাকে বলিলেন, “প্রভু এমন কাজ করিবেন না, এ বেটা বর পাইলে আমাদের সকলকে খাইয়া ফেলিবে। এর মধ্যেই কতজনকে ধরিয়া খাইয়াছে।
তাইতো, এখন কি করা যায়? তপস্যা করিয়াছে কাজেই বর দিতেই হইবে, আবার বর দিলেও বিপদের কথা, তখন ব্রহ্মা বুদ্ধি করিয়া সরস্বতীকে কুম্ভকর্ণের মুখের ভিতরে ঢুকাইয়া দিলেন। সরস্বতী ঢুকিতেই তাহার মাথায় কি যে গোল লাগিয়া গেল, আর বেচারা ঠিক করিয়া কথা কহিতে পারিল না। ব্রহ্মা বলিলেন, “কুম্ভকর্ণ, কি চাহ?” কুম্ভকর্ণ বলিল, “আমি খালি ঘুমাইতে চাই। ছয়মাস ঘুমাইয়া একদিন উঠিয়া খাইব।” ব্রহ্মা বলিলেন, “বেশ কথা, তাই হোক।” এই বলিয়া ব্রহ্মা দেবতাদিগকে লইয়া চলিয়া গেলেন, আর কুম্ভকর্ণ মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে ভাবিল, ‘তাইতো। এটা কি করিলাম? দেবতা বেটারা আমাকে ফাঁকি দিয়া গেল নাকি?”
যা হোক, আমরা দশগ্রীবের কথা বলিতেছি। সে তো বর পাইয়া নিতান্তই ভয়ংকর হইয়া উঠিল; এখন আর কেহ তাহার কোনো কথায় ‘না’ বলিতে ভরসা পায় না। দশগ্রীবের এক দাদা ছিলেন, তাঁহার নাম কুবের। তিনিও বিশ্রবা মুনির পুত্র, তাঁহার মাতা, ভরদ্বাজ মুনির কন্যা দেববর্ণিনী। কুবের লঙ্কায় বাস করিতেন। দশগ্রীব তাঁহাকে বলিয়া পাঠাইল, “দাদা লঙ্কাপুরীখানি আমাকে ছাড়িয়া দাও।”
কাজেই তখন কুবের আর কি করেন? ভালোয় ভালোয় না দিলে জোর করিয়া কাড়িয়া নিবে। তাহার চেয়ে তিনি কৈলাস পর্বতে বাস করিতে লাগিলেন। দশগ্রীবও তখন পরম আনন্দে রাক্ষসের দলসমেত লঙ্কায় আসিয়া রাজা হইয়া বসিল।
ইহার কিছুদিন পরেই দশগ্রীব বিদ্যুজ্জিহ্ নামক দানবের সহিত সুর্পনখার বিবাহ দিল। তাহাদের তিন ভাইয়ের বিবাহ হইতেও আর বেশি বিলম্ব হইল না। কিন্তু হায়, শুভকার্য শেষ হইতে না হইতেই ব্রহ্মার আজ্ঞায় ঘোর নিদ্রা আসিয়া কুম্ভকর্ণকে ধরিয়া বসিল। তাহার চোখ বুজিয়া আসিল, মাথা ঢুলিয়া পড়িল, সে বিকট মুখে ভীষণ হাই তুলিয়া বলিল, “দাদা, বড়ই ঘুম পাইয়াছে আমার শয়নের জন্য ঘর করিয়া দাও।” তখনই রাবণের হুকুমে চমৎকার ঘর প্রস্তুত হইল। তাহার ভিতরে গিয়া সেই যে কুম্ভকর্ণ শুইল, হাজার হাজার বৎসরেও আর উঠিল না।
এদিকে দশগ্রীবের জ্বালায় ত্রিভুবন অস্থির! সে দেবতা গন্ধর্ব, মুনি-ঋষি কাহাকেও মানে না, এক ধার হইতে সকলকে মারিয়া তাহাদের বাড়ি, ঘর, বাগান সব চুরমার করিতে আরম্ভ করিয়াছে। কুবের তাহাতে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া তাহাকে বারণ করিবার জন্য দূত পাঠাইলেন। সে দূতের কথা দশগ্রীব তো শুনিলই না; লাভের মধ্যে বেচারাকে কাটিয়া রাক্ষসদিগকে খাইতে দিল। তারপর রথে চড়িয়া এই বলিয়া সে বাহির হইল, “আমি ত্রিভুবন জয় করিব।”
বাহির হইয়াই সে সকলের আগে গিয়া কুবেরের নিকট উপস্থিত হইল, তাহার উপরেই রাগটা বেশি। কুবেরের যক্ষ অনেক যুদ্ধ করিয়াও তাহার কিছুই করিতে পারিল না। দশগ্রীবের সঙ্গে ভীষণ রাক্ষসেরা গিয়াছিল; তাহারা যক্ষদের এমনি দুর্গতি করিল যে তাহা আর বলিবার নহে। যক্ষেরা সোজাসুজি সরলভাবে যুদ্ধ করে, আর রাক্ষসেরা নানারকম ফাঁকি দেয়; কাজেই যক্ষেরা হারিয়া গেল। কুবের নিজে আসিয়াও বিশেষ কিছুই করিতে পারলেন না। দশগ্রীব তাঁহাকে অস্ত্রের আঘাতে অজ্ঞান করিয়া, তাঁহার ‘পুষ্পক’ নামক রথখানি লইয়া চলিয়া গেল। সে রথ বড়ই আশ্চর্য ছিল। তাহাতে সঙ্গে দানা, পানি, সইস, কোচমান কিছুরই দরকার হইত না। যেখানে যাইবার হুকুম পাইত অমনি সে উড়িয়া গিয়া সেখানে হাজির হইত।
সেই পুষ্পকরথে চড়িয়া দশগ্রীব স্বর্গের বিশাল শরবনে গিয়া উপস্থিত হইল। পর্বতের উপরে সে অতি পবিত্র বন, কার্তিকেয়ের জন্মস্থান, তাহার উপর দিয়া কোনো রথেরই যাইবার হুকুম নাই! বিশেষত শিব আর পার্বতী তখন সেখানে ছিলেন। কাজে কাজেই পুষ্পক রথ সেখানে গিয়া আটকাইয়া গেল। ইহাতে দশগ্রীব যারপরনাই আশ্চর্য হইয়া নানারূপ চিন্তা করিতেছে, এমন সময় শিবের দূত নন্দী আসিয়া তাহাকে বলিল, “দশগ্রীব, মহাদেব এখানে আছেন, তুমি ফিরিয়া যাও।”
নন্দীর চেহারা বড়ই অদ্ভুত ছিল। ছোট্টো-খাট্টো পিঙ্গলবর্ণ লোকটি, হাত দুখানি এতটুকু, মাথাটি নেড়া, মুখখানি বানরের মতো। দশগ্রীব তাহার কথা শুনিবে কি, সে হাসিয়া অস্থির। কিন্তু নন্দী ছাড়িবার পাত্র নহে। সে ছোট হইলেও দেখিতে বড়ই ষণ্ডা, তাহাতে আবার হাতে ভয়ংকর শূল। দশগ্রীব রাগের ভরে রথ হইতে নামিয়া সবে বলিয়াছিল, “কে রে তোর মহাদেব?” অমনি নন্দী তাহাকে দুই ধমক লাগাইয়া দিল। তখন সে ভারি চটিয়া বলিল, “বটে? আমাকে যাইতে দিবি না? আচ্ছা, দাঁড়া তোদের পাহাড় আমি তুলিয়া নিব।” এই বলিয়া সত সত্যই সে গুঁড়িহাতে সেই পর্বতের তলা ধরিয়া টানাটানি করিতে লাগিল। সেকি যেমন তেমন টান? টানের চোটে পর্বত নড়িয়া উঠিল, শিবের ভূতগুলি ভয়ে কাঁপিতে লাগিল, পার্বতী যারপরনাই ব্যস্ত হইয়া মহাদেবকে জড়াইয়া ধরিতে গেলেন। মহাদেব কিন্তু কিছুমাত্র ব্যস্ত হইলেন না।
তিনি কেবল পায়ের বুড়ো আঙুলটি দিয়া পর্বতখানিকে একটু চাপিয়া ধরিলেন তাহাতেই সে তাহার জায়গায় বসিয়া গেল, আর অমনি দরজার কামড়ে দুষ্টু খোকার আঙুল আটকাইবার মতন দশগ্রীব মহাশয়ের হাতখানিও পর্বতের চাপনে আটকাইয়া গেল।
তখন তো দশগ্রীব দশমুখে ভ্যাঁ ভ্যাঁ শব্দে চ্যাঁচাইয়া অস্থির! চীৎকারে ত্রিভুবন কাঁপিতে লাগিল; সাগর উছলিয়া উঠিল, দেবতারা ছুটিয়া পথে বাহির হইলেন!
হাজার বৎসর ধরিয়া দশগ্রীব ঐরূপ চ্যাঁচাইয়াছিল, আর মহাদেবকে ক্রমাগত মিনতি করিয়াছিল। মহাদেবের দয়ার কথা সকলেই জানে। বেচারার এই কষ্ট দেখিয়া তিনি আর চুপ করিয়া থাকিতে পারলেন না। তিনি তাহাকে ছাড়িয়া তো দিলেনই, তাহার উপর আবার ভারি ভারি কয়েকটি অস্ত্রও তাহাকে দিয়া দিলেন, আর বলিলেন, “দশগ্রীব, তুমি চমৎকার চ্যাঁচাইয়াছিলে, তোমার চীৎকারে সকলেই ভয় পাইয়াছিল। অতএব এখন হইতে তোমার নাম ‘রাবণ’ (যে চীৎকারে লোকের ভয় লাগাইয়া দেয়) হইল।” দশগ্রীব দেখিল, পাহাড় চাপা পড়িয়া মোটের উপর তাহার লাভই হইয়াছে, কাজেই সে খুব খুশি হইয়া সেখান হইতে চলিয়া আসিল।
দশগ্রীব শিবের নিকট বর পাইয়া রাবণ হইল, অস্ত্রশস্ত্রও অনেকগুলি পাইল। তখন হইতে সে ব্রহ্মাণ্ডময় কেবল ঘুরিয়া বেড়ায়, আর রাজরাজড়া যাহাকে সামনে পায় তাহাকেই বলে, “হয় যুদ্ধ কর না হয় হার মান।”
উষীরবীজ নামে একটা জায়গায় মরুত্ত নামে এক রাজা যজ্ঞ করিতেছেন, রাবণ পুষ্পক রথে চড়িয়া হেঁইয়ো হেঁইয়ো শব্দে সেখানে আসিয়া উপস্থিত। যজ্ঞের স্থানে দেবতাদের অনেকেই ছিলেন, রাবণকে দেখিয়াই ভয়ে তাঁহাদের মুখ শুকাইয়া গেল। ছুটিয়া যে পলাইবেন, এতটুকুও তাহাদের ভরসা হইল না; কি জানি পাছে ধরিয়া ফেলে। তাই তাহারা সেইখানেই নানা জন্তুর বেশ ধরিয়া লুকাইয়া রহিলেন। ইন্দ্র হইলেন ময়ূর, ধর্ম হইলেন কাক, কুবের হইলেন গিরগিটি, বরুণ হইলেন হাঁস।
এদিকে মরুত্তের সঙ্গে রাবণের খুবই যুদ্ধ বাধিবার জোগাড় দেখা যাইতেছে, গালাগালি আরম্ভ হইয়াছে মারামারিরও বিলম্ব নাই, এমন সময় মরুত্তের গুরু সম্বর্ত মুনি তাঁহাকে বলিলেন, “মহারাজ! যুদ্ধ করিয়া কাজ নাই কেননা তাহা হইলে তোমার যজ্ঞ নষ্ট হইয়া যাইবে, তাহাতে সর্বনাশ হইবে।” কাজেই মরুত্ত চুপ করিয়া গেলেন, আর রাবণ “জিতিয়াছি জিতিয়াছি” বলিয়া খুবই বাহাদুরী করিতে লাগিল। তারপর সেখানে যত মুনি উপস্থিত ছিলেন, তাহাদের সকলকে খাইয়া যারপরনাই খুশি হইয়া সে সেখান হইতে চলিয়া গেল।
তখন দেবতামহাশয়েরা আবার যার যার বেশ ধরিয়া মনে করিলেন, “বাবা, বড্ড বাঁচিয়া গিয়াছি।” যে সকল জন্তুর সাজ তাঁহারা নিয়াছিলেন, তাহাদের উপরে অবশ্য তাঁহারা খুবই খুশি হইলেন, আর তাহাদিগকে বর দিতে লাগিলেন।
ইন্দ্র ময়ূরকে বলিলেন, “তোমার সাপের ভয় থাকিবে না, আর আমার যেমন হাজার চোখ, তোমার লেজেও তেমনি হাজার চোখ হইবে।” ময়ূরের লেজে আগে শুধুই নীলবর্ণ ছিল, তখন হইতে তাহাতে চমৎকার চক্র দেখা দিল।
ধর্ম কাককে বলিলেন, “তোমার আর কোনো অসুখ হইবে না। মরণের ভয়ও তোমার দূর হইল; কেবল মানুষে যদি মারে তবেই তোমার মৃত্যু হইবে।”
বরুণ হাঁসকে বলিলেন, “তোমার গায়ের রঙ ধব্ধবে সাদা হইবে। তখন হইতে হাঁস সাদা হইয়াছে, আগে তাহার আগাগোড়া সাদা ছিল না, পাখার আগা নীল, আর কোলের দিকে ছেয়ে রঙের ছিল।
কুবের গিরগিটিকে বলিলেন, “তোমার মাথা সোনার মতো হইবে।” সেই হইতে গিরগিটির মাথায় সোনালি রঙ।
এদিকে রাবণের আর গর্বের সীমাই নাই। দুষ্মন্ত, সুরথ, গাধি, গয়, পুরুরবা প্রভৃতি বড় বড় রাজারা তাহার নিকট হার মানিয়া গেলেন। অন্যের তো কথাই নাই। কিন্তু অযোধ্যার রাজা অনরণ্য কিছুতেই তাঁহার নিকট হার মানিতে রাজি হইলেন না। তিনি আগেই অনেক সৈন্য প্রস্তুত করিয়া রাখিয়াছিলেন, রাবণ তাঁহার রাজ্যে আসিবামাত্র সেইসকল সৈন্য লইয়া তিনি তাহার সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। হায়, তাঁহার সে সৈন্য রাবণের সৈন্যদের কাছে দুদণ্ডের মধ্যেই শেষ হইয়া গেল, নিজেও রাবণের হাতে ভয়ানক আঘাত পাইয়া রথ হইতে পড়িয়া কাঁপিতে লাগিলেন। রাবণ তখন তাঁহাকে বিদ্রুপ করিয়া বলিল, “কি? আমার সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া এখন কেমন হইল?” অনরণ্য বলিলেন, “মরিতে তো একদিন সকলকেই হয়, কিন্তু আমি তোমার কাছে হটি নাই, যুদ্ধ করিয়া প্রাণ দিতেছি আর আমি এ কথা তোমাকে বলিতেছি যে, আমাদের এই বংশে দশরথের পুত্র রামের জন্ম হইবে, সেই রামের হাতে তুমি তোমার উচিত সাজা পাইবে।”
রাজার কথা শেষ হইতে না হইতেই দেবতারা তাঁহার উপরে পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। স্বর্গে দুন্দুভি বাজিয়া উঠিল। দেখিতে দেখিতে রাজাও দেহ ছাড়িয়া সেখানে চলিয়া গেলেন।
একবার রাবণ মানুষ তাড়াইয়া ফিরিতে ফিরিতে দেখিলেন যে মেঘের উপর দিয়া নারদ মুনি হরিনাম গান করিতে করিতে আসিতেছেন। রাবণ তাঁহাকে নমস্কার করিয়া বলিল, “কি ঠাকুর মহাশয়, মঙ্গল তো? কিজন্য আসিয়াছেন?
নারদ বলিলেন, “আসিয়াছি যে বাপু, একটা কথা আছে। এইসব মানুষ যখন মৃত্যুর বশ, তখন এরা তো মরিয়াই রহিয়াছে; ইহাদিগকে মারিবার জন্য তুমি আবার এত পরিশ্রম কেন করিতেছ? ইহারা আপনা আপনিই একদিন যমের বাড়ি যাইবে! বাস্তবিক যমই যত নষ্টের গোড়া। অতএব, সেই বেটাকে যদি জব্দ করিতে পার, তবে সকলকেই জয় করা হইবে।”
রাবণ বলিল, “বড় ভালো কথা বলিয়াছেন, ঠাকুর মহাশয়! আমি এখনি যাইতেছি।” বলিয়াই আর এক মুহূর্তও দেরি নাই, অমনি রাবণ যমপুরীর পথ ধরিয়াছে। তখন নারদ ভাবিলেন, ‘এবারে মজাটা হইবে ভালো। যাই, একবার দেখিয়া আসি।”
নারদ রাবণের আগেই গিয়া যমের নিকট উপস্থিত হইলেন। যম বিচারাসনে বসিয়া অগ্নিসাক্ষী করিয়া সকলের পাপপুণ্যের বিচার করিতেছিলেন, নারদকে দেখিয়া ব্যস্তভাবে উঠিয়া নমস্কারপূর্বক বলিলেন, “মুনিঠাকুরের আজ কি চাই?”
নারদ বলিলেন, “সাবধান হও বাছা, রাবণ তোমাকে জয় করিতে আসিতেছে। মুশকিল হইতে আটক নাই কিন্তু বেটা বড় বেখাপ্পা লোক।”
বলিতে বলিতেই রাবণের ঝক্ঝকে পুষ্পক রথও আসিয়া দেখা দিল। রথ হইতে নামিয়াই সে দেখিল যে নরকের কুণ্ডে দলে দলে পাপী সকল যমদূতগণের তাড়নায় চীৎকার করিতেছে। অমনি আর কথাবার্তা নাই, সে যমদূতগুলিকে বিধিমতে ঠ্যাঙাইয়া সকল পাপীকে ছাড়িয়া দিল। সে বেচারারা হঠাৎ ছাড়া পাইয়া যে কি আশ্চর্য আর খুশি হইল, তাহা আর বলিবার নয়। তখন যে যুদ্ধ আরম্ভ হইল, সে বড়ই ভয়ংকর। যমপুরীতে অসংখ্য সিপাহী সান্ত্রী থাকে, তাহদের এক একজন ভয়ানক যোদ্ধা। তাহারা রাবণ আর তাহার লোকগুলিকে মারিয়া রক্তারক্তি করিয়া দিল। মার খাইয়াও কিন্তু রাবণ যুদ্ধ করিতে ছাড়ে না। শূল শক্তি প্রাস গদা গাছ পাথর কত যে ছুঁড়িল তাহার লেখাজোখা নাই। তখন যমের লোকেরা আর রাক্ষসকে ছাড়িয়া কেবল রাবণের উপরেই এমন ভয়ানক অস্ত্র বৃষ্টি করিতে লাগিল যে, তাহাতে পুষ্পক রথ অবধি ডুবিয়া গিয়া রাবণের দম আটকিয়া মরিবার গতিক। দুর্দশার একশেষ। রক্তধারায় দেহ ভাসিয়া গেল; কবচ কোথায় গিয়াছে তাহার ঠিক নাই। তখন কাজেই তাহাকে রথ হইতে নামিয়া আসিতে হইল।
এতক্ষণে আর রাবণের বুঝিতে বাকি রহিল না যে এবারে একটু বেগতিক, একটা বড়রকমের অস্ত্র না ছাড়িতে পারিলে আর চলিতেছে না। কাজেই সে তখন ধনুকে পাশুপত অস্ত্র জুড়িয়া যমের লোকদিগকে বলিল, “দাঁড়া বেটারা, এবারে তোদের দেখাইতেছি।” এই বলিয়া সে সেই ভয়ংকর অস্ত্র ছুঁড়িবামাত্রই, তাহার তেজে যমের সকল সিপাহী ভস্ম হইয়া গেল। তখন রাবণের আর রাক্ষসগণের সিংহনাদে ব্রহ্মাণ্ড ফাটে আর কি?
সেই সিংহনাদ শুনিয়াই যম বুঝিতে পারিলেন যে রাক্ষসদিগের জয় হইয়াছে। তখন
কাজেই রথে চড়িয়া তাঁহাকে স্বয়ংই বাহির হইতে হইল! সে যে কি ভয়ংকর রথ সে কথা আমি বলিয়া বুঝাইতে পারিব না। তাহার উপর আবার স্বয়ং মৃত্যু প্রাস মুদগর লইয়া ভীষণ বেশে যমের সম্মুখে দাঁড়াইয়া, কালদণ্ড প্রভৃতি ভয়ংকর অস্ত্রসকল ধূ ধূ করিয়া জ্বলিতেছে।
সেই রথ আর তাহার ভিতর মৃত্যুকে দেখিয়াই রাবণের লোকেরা “বাপ রে। আমাদের যুদ্ধে কাজ নাই” বলিয়াই ঊর্দ্ধশ্বাসে চম্পট দিল। কিন্তু রাবণ তাহাতে ভয় না পাইয়া যমের সঙ্গে খুবই যুদ্ধ করিতে লাগিল। অস্ত্রের ভয় তো তাহার নাই, কারণ সে জানে যে ব্রহ্মার বরের জোরে সে মরিবে না! কাজেই অনেক খোঁচা যেমন খাইল, খোঁচা দিলও ততোধিক। খোঁচা খাইয়া যম রাগে অস্থির হইয়া উঠিলেন, তাঁহার মুখ দিয়া আগুন বাহির হইতে লাগিল।
তখন মৃত্যু যমকে বলিল, “আমাকে আজ্ঞা করুন আমি এখনই এই দুষ্টকে মারিয়া দিতেছি। আমি ভালো করিয়া তাকাইলে আর ইহাকে এক মুহূর্তও বাঁচিতে হইবে না।” যম বলিলেন, “দেখ না, আমি ইহাকে কি সাজা দিই।” এই বলিয়াই তিনি রাগে দুই চোখ লাল করিয়া তাঁহার সেই ভীষণ ‘কালদণ্ড’ হাতে নিলেন। সে দণ্ড যাহার উপর পড়ে তাহার আর রক্ষা থাকে না।
যমকে কালদণ্ড তুলিতে দেখিয়া ভয়ে সকলের প্রাণ উড়িয়া গেল, কে কোন দিক দিয়া পলাইবে তাহার ঠিক নাই, দেবতাদের অবধি বুক ধড়াস্ ধড়াস্ করিতেছে। তখন ব্রহ্মা নিতান্ত ব্যস্তভাবে ছুটয়া আসিয়া যমকে বলিলেন, “সর্বনাশ, কর কি? এই কালদণ্ড তুমি ছুঁড়িলেই যে আমার কথা মিথ্যা হইয়া যাইবে। কালদণ্ড আমিই গড়িয়াছি, রাবণকেও আমি বর দিয়াছি। আমিই বলিয়াছি যে কালদণ্ড কিছুতেই ব্যর্থ হইবে না। আবার আমিই বলিয়াছি যে রাবণ কোনো দেবতার হাতে মরিবে না। এখন এই অস্ত্রে যদি রাবণ মরে, তাহা হইলেও আমার কথা মিথ্যা হয়, যদিনা মরে তাহা হইলেও আমার কথা মিথ্যা হয়। লক্ষ্মীটি আমাব মান রাখ, এ অস্ত্র তুমি ছুঁড়িও না।”
কাজেই যম তখন আর কি করেন? তিনি বলিলেন, “আপনি হইতেছেন আমাদের প্রভু, সুতরাং আপনার হুকুম মানিতেই হইবে। কিন্তু যদি এ দুষ্টকে মারিতেই না পারিলাম, তবে আর আমার এখানে থাকিয়াই কি ফল?” এই বলিয়া যম সেখান হইতে চলিয়া গেলেন। তাহা দেখিয়া রাবণ হাততালি দিয়া নাচিতে নাচিতে বলিল, “দুয়ো! দুয়ো! হারিয়া গেলি! হারিয়া গেলি!” ততক্ষণে অন্য রাক্ষসদেরও খুবই সাহস হইয়াছে, আর তাহারা আসিয়া, “জয় রাবণের জয়।”—বলিয়া আকাশ ফাটাইতে আরম্ভ করিয়াছে।
ব্রহ্মার কথায় যম যুদ্ধ ছড়িয়া দিলেন। রাবণ ভাবিল, সেটি তাহার নিজেরই বাহাদুরী। তখন আর তাহার গর্বের সীমাই রহিল না। সে বাছিয়া বাছিয়া বড়-বড় যোদ্ধাদের সহিত বিবাদ করিয়া বেড়াইতে লাগিল। বরুণের পুত্রগণ তাহার নিকট হারিয়া গেলেন, বরুণ নিজে ব্রহ্মার বাড়িতে গান শুনিতে যাওয়ায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না, তাই তাঁহার মান বাঁচিল। সূর্য যুদ্ধ না করিয়াই বলিলেন, “আমি হার মানিতেছি।” রাবণের ভগ্নিপতি বিদ্যুজিহ্ বেচারাও তাহার হাতে মারা গেল।
কিন্তু সকল জায়গায়ই যে রাবণ বাহাদুরী পাইয়াছিল তাহা নহে। বলির বাড়িতে গিয়া সে অনেক বড়াই করিয়াছিল। বলি তাহাকে ধরিয়া নিজের কোলে বসাইয়া বলিলেন, “কি চাও বাপু?” রাবণ বলিল, “শুনিয়াছি বিষ্ণু নাকি আপনাকে আটকাইয়া রাখিয়াছেন। আমি আপনাকে ছাড়াইয়া দিতে পারি।”
এ কথা শুনিয়া বলির ভারি হাসি পাইল। তারপর তিনি কথায় কথায় তাহাকে বলিলেন, “ঐ যে ঝক্ঝকে চাকাটি দেখিতেছ ওটি আমার কাছে লইয়া আইস তো?” এ কথায় রাবণ নিতান্ত অবহেলার সহিত গিয়া সেই জিনিসটি উঠাইল, কিন্তু কিছুতেই সেটিকে লইয়া আসিতে পারিল না। সে লজ্জিত হইয়া প্রাণপণে টানাটানি করিতে করিতে শেষে অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া গেল।
খানিক পরে রাবণের জ্ঞান হইয়াছে, কিন্তু তখন আর লজ্জায় বেচারা মাথা তুলিতে পারে না। তখন বলি তাহাকে বলিলেন, “এই চাকাটি আমার পুর্বপুরুষ হিরণ্যকশিপুর কুণ্ডল।”
আর একবার রাবণ পশ্চিম সমুদ্রে গিয়া একটি দ্বীপে আগুনের মতো তেজস্বী এক ভয়ংকর পুরুষকে দেখিল। তাঁহাকে দেখিয়াই রাবণ বলিল, “যুদ্ধ দাও।” তারপর সে তাঁহাকে কত শূল, কত শক্তি, কত ঋষ্টি, কত পট্টিশের ঘা মারিল, কিন্তু তাঁহার কিছুই করিতে পারিল না। তখন সেই ভয়ংকর পুরুষ রাবণকে টিকটিকির মতন ধরিয়া দুহাতে এমনি চাপিয়া দিলেন যে তাহাতেই তাহার প্রাণ যায় যায়। তারপর তিনি তাহাকে মাটিতে ফেলিয়া পাতালে চলিয়া গেলেন। কিঞ্চিৎ পরে রাবণ উঠিয়া রাক্ষসদিগকে জিজ্ঞাসা করিল, “সেই ভয়ংকর লোকটা কোথায় গেল?” রাক্ষসেরা একটা গর্ত দেখাইয়া বলিল, “সে ইহারই ভিতরে ঢুকিয়া গিয়াছে।” অমনি রাবণও তাড়াতাড়ি সেই গর্তের ভিতর ঢুকিল। তারপর পাতালের মধ্যে খুঁজিতে খুজিতে এক জায়গায় গিয়া দেখিল সেই মহাপুরুষ একটা খাটের উপর ঘুমাইয়া আছেন। সেখানে গিয়া রাবণ সবে দুষ্ট ফন্দি আঁটিতেছে, এমন সময় সেই ভয়ংকর পুরুষ হো হো শব্দে হাসিয়া উঠিলেন, আর তাহাতেই রাবণ কানে তালা লাগিয়া মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া গেল। তখন ভয়ংকর পুরুষ তাহাকে বলিলেন, “আর কেন? এই বেলা চলিয়া যাও! ব্রহ্মা তোমাকে অমর হইবার বর দিয়াছেন। কাজেই তোমাকে বধ করা হইল না।” এই ভয়ংকর পুরুষ ছিলেন ভগবান কপিল।
আর একবার রাবণ গিয়াছিল মাহিষ্মতীর রাজা অর্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে। মাহিষ্মতীতে গিয়া সে অর্জুনের মন্ত্রীদিগকে বলিল, “তোমাদের রাজা কোথায়? আমি তাহার সহিত যুদ্ধ করিব।” মন্ত্রীরা বলিলেন, “তিনি বাড়ি নাই।”
এ কথায় রাবণ সেখান হইতে বিন্ধ্যপর্বতে চলিয়া আসিল। বিন্ধ্য অতি সুন্দর পর্বত। সেই পর্বতের নীচ দিয়া নর্মদা নদী বহিতেছে, তাহার শোভা দেখিলে চক্ষু জুড়াইয়া যায়। এমন নির্মল জল, এমন শীতল বায়ু, এতরকমের ফুল আর অতি অল্পস্থানেই আছে। রাবণ মনের সুখে সে জলে নামিয়া স্নান করিল।
ঠিক সেই সময়ে একটা ভারি আশ্চর্য ঘটনা ঘটিতেছিল। নর্মদার জল স্বভাবতই পূর্ব হইতে পশ্চিম দিকে বহিয়া থাকে, কিন্তু সেদিন দেখা গেল যে তাহা এক একবার হঠাৎ উঁচু হইয়া পশ্চিম হইতে পূর্ব দিকে ফিরিয়া আসিতেছে। ইহাতে রাবণ যারপরনাই আশ্চর্য হইয়া শুক সারণকে বলিল, “দেখ তো ব্যাপারটা কি?”
শুক সারণ তখনই পশ্চিম দিকে চলিয়া গেল, আর খানিক পরেই ব্যস্তভাবে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, মহারাজ, প্রকাণ্ড শালগাছের মতো উঁচু একটা লোক নর্মদায় নামিয়া স্নান করিতেছে। উহার এক হাজারটা হাত। সেই হাজার হাতে সে এক একবার নদীর জল আগলাইয়া ঠেলিয়া দিতেছে, আর তাহাতেই সে জল এত উঁচু হইয়া ফিরিয়া আসিতেছে।
এ কথা শুনিয়া রাবণ বলিয়া উঠিল—“অর্জুন”। তারপর আর এক মুহূর্তও বিলম্ব না করিয়া অমনি গদা ঘুরাইতে ঘুরাইতে অর্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে চলিল। অর্জুনের লোকেরা খাইয়া নাকাল করিয়াছিল।
অর্জুন একথা শুনিতে পাইয়া বিশাল গদা হাতে ছুটয়া আসিলেন। রাক্ষসেরা তাঁহাকে বাধা দিয়াছিল, কিন্তু সেই গদার সম্মুখে তাহারা কিছুতেই টিকিতে না পারিয়া শেষে ছুটিয়া পলাইল। তখন রাবণ আর অর্জুনের যে যুদ্ধ হইল, সে বড়ই ভয়ানক। দুজনেরই যেমন বিশাল দেহ, হাতে তেমনি ভীষণ গদা। রাবণ ভয়ানক তেজের সহিত অনেকক্ষণ যুদ্ধ করিয়াছিল, কিন্তু শেষে অর্জুনের গদার ঘায়ে অস্থির হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে বসিয়া পড়িল। অর্জুনও অমনি তাহাকে ধরিয়া এমনি বাঁধন বাঁধিলেন যে সে কথা আর বলিবার নয়; তাহা দেখিয়া দেবতাগণের কি আনন্দই হইল। তাহারা যে যত পরিলেন, অর্জুনের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করিলেন।
এদিকে রাক্ষসেরা আসিয়া অর্জুনের হাত হইতে রাবণকে ছাড়াইয়া নিতে কত চেষ্টাই করিল, কিন্তু সে কি তাহাদের কাজ? অর্জুন তাহাদিগকে বিধিমতে ঠ্যাঙইয়া রাবণকে লইয়া ঘরে চলিয়া গেলেন।
এখন রাবণের তো আর সংকটের সীমাই নাই, এ সংকট হইতে তাহাকে কে বাঁচায়? বাঁচাইবার লোক একটিমাত্র আছেন, তিনি হইতেছেন উহার পিতামহ পুলস্ত্য মুনি। মুনিঠাকুর নাতির মায়া এড়াইতে না পারিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া অর্জুনকে বলিলেন, “বাছ, আমার নাতিটিকে ছাড়িয়া দাও। উহাকে যে সাজা দিয়াছ তাহাতেই তোমার খুব নাম হইবে, আর উহাকে রাখিয়া লাভ কি?”
এ কথায় অর্জুন খুশি হইয়া তখনই রাবণকে ছাড়িয়া দিলেন; সে লজ্জায় মাথা হেট করিয়া চোরের মতো সেখান হইতে চলিয়া আসিল। কিন্তু দুষ্ট লোকের লজ্জা আর কতকাল থাকে? দুদিন পরেই দেখা গেল যে, রাবণ আবার রাজাদিগকে খোঁচাইয়া ফিরিতেছে।
মুনির কথায় অর্জুন রাবণকে ছাড়িয়া দিলেন, আবার তাহার সহিত বন্ধুতাও করিলেন। কাজেই তখন আর তাহার দর্পের সীমা রহিল না। যে কোনো বীরের নাম শুনিলেই সে তাহার সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া উপস্থিত হয় আর তর্জন গর্জন করিয়া আকাশ ফাটাইয়া দেয়। এমনি করিয়া একদিন সে কিষ্কিন্ধ্যায় গিয়া তর্জন গর্জন করিতে লাগিল,—“বালী কোথায়? আমি যুদ্ধ করিব।”
বালী তখন বাড়ি ছিল না, সমুদ্রের ধারে সন্ধ্যা করিতে গিয়াছিল। অন্য বানরেরা রাবণকে বলিল, “বালী সন্ধ্যা করিতে গিয়াছেন, এখনই আসিবেন। ততক্ষণ তুমি এই বিচিত্র সংসারখানি একবার শেষ দেখা দেখিয়া লও; কারণ বালী আসিলে তোমার প্রাণের আশা তিলমাত্রও থাকিবে না। আর, যদি তোমার নিতান্তই শীঘ্র শীঘ্র মরিবার প্রয়োজন হইয়া থাকে, তবে না হয় দক্ষিণ সমুদ্রে গিয়া তাঁহাকে খুঁজিয়া লও।”
রাবণ তখনই বানরদিগকে বকিতে বকিতে পুষ্পকরথ হাঁকাইয়া চলিয়া গেল, আর খানিক দূর গিয়াই দেখিল, বালী সোনার পাহাড়ের ন্যায় সমুদ্রের ধারে বসিয়া আছে। তাহার
মুখখানি সকালবেলার সূর্যের মতো লাল আর উজ্জ্বল দেখা যাইতেছে। রাবণ ভাবিল, চুপি চুপি গিয়া বানরকে হঠাৎ জাপটিয়া ধরিতে হইবে। এই বলিয়া সে খুবই চুপি চুপি যাইতে লাগিল; সে জানে না যে, বালী ইহার আগেই তাহাকে দেখিতে পাইয়াছে। আর তাহার মনের কথাটি ঠিক বুঝিয়া লইয়া তাহারই জন্য চুপ করিয়া বসিয়া আছে—একটিবার হাতের কাছে পাইলেই তামাশাটা দেখাইয়া দিবে।
চোখে ভ্রুকূটি, মুখে ঘামাচি, হাত দুটি বিষম ব্যগ্রভাবে বাড়ান, এমনিভাবে আসিয়া রাবণ চোরের মতো বালীর পিছনে দাঁড়াইল; ভাবিল, ‘এইবার ধরি!’ কিন্তু হায়, তাহার আগেই বালী তাহাকে ধরিয়া বগলে পুরিয়া ফেলিল। সে একটিবার পিছনবাগে তাকাইয়াও দেখে নাই, অথচ ঠিক ফড়িংটির মতো রাক্ষসের বাছাকে ধরিয়া বগলে পুরিয়াছে। রাবণের সঙ্গের রাক্ষসগুলি অবশ্য তখন বড়ই ব্যস্ত হইয়া বালীকে মারিতে গিয়াছিল, কিন্তু বালীর কয়েকটা হাত-পা নাড়া খাইয়াই তাহারা কাঁপিয়া অস্থির, যুদ্ধ আর করিবে কি?
এদিকে রাবণ বালীর বগলে থাকিয়া প্রাণপণে তাহাকে আঁচড় কামড় দিতেছে, কিন্তু বালীর কাছে তাহা পিঁপড়ের কামড়ের মতোও ঠেকিতেছে না। বালী সেসব অগ্রাহ্য করিয়া নিজের সন্ধ্যাবন্দনায় মন দিল। দক্ষিণ সাগরের সন্ধ্যা শেষ হইলে, রাবণকে বগলে লইয়াই সে শূন্যপথে পশ্চিম সমুদ্রে গিয়া সন্ধ্যা করিতে লাগিল। তারপর উত্তর সমুদ্রে আর পূর্ব সমুদ্রেও ঠিক সেইরূপ সন্ধ্যা শেষ না করিয়া সে কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরিল না। ততক্ষণে সেই বগলের চাপে আর গন্ধে আর ঘামে রাবণের কি দশা হইয়াছিল, বুঝিয়া লও।
কিষ্কিন্ধ্যায় বালী রাবণকে বগল হইতে বাহির করিয়া হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?” রাবণ যাতনায় মিটিমিটি চোখে বলিল, “আমি লঙ্কার রাজা রাবণ, আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিলাম। আপনি আমাকে পশুর মতো ধরিয়া এত পথ ঘুরাইয়া আনিলেন, আপনার কি আশ্চর্য ক্ষমতা! আমি আপনার সঙ্গে বন্ধুতা করিব।” সুতরাং তখন দুজনে বন্ধুতা হইয়া গেল। কাজেই সাজা পাইয়াও রাবণের শিক্ষা হইল না। সে আবার ব্রহ্মাণ্ডময় খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিল, কোন ছলে কাহারও সহিত যুদ্ধ করিয়া একটু বাহাদুরী লইতে পারে কি না।
ঘুরিতে ঘুরিতে আবার একদিন নারদ মুনির সঙ্গে রাবণের দেখা হইয়াছে। রাবণ বলিল, “মুনিঠাকুর, বলুন তো, কোন দেশের লোকের গায়ে সকলের চেয়ে বেশি জোর? তাহাদের সহিত আমি যুদ্ধ করিব।” মুনি বলিলেন, “ক্ষীরোদ সমুদ্রে শ্বেতদ্বীপ নামে একটি প্রকাণ্ড দ্বীপ আছে। সেই দ্বীপের লোকের মতো বলবান আর ধার্মিক মানুষ পৃথিবীতে আর কোথাও নাই।” এ কথা শুনিবামাত্রই রাবণ শ্বেতদ্বীপের দিকে পুষ্পকরথ চালাইয়া দিল, মুনিঠাকুরও একটু চিন্তা করিয়া তামাশা দেখিবার জন্য সেইখানেই চলিয়া গেলেন।
তারপর রাক্ষসেরা তো সিংহনাদ করিতে করিতে শ্বেতদ্বীপে গিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কিন্তু সে স্থানের এমনি তেজ যে তাহারা কিছুতেই সেখানে টিকিয়া থাকিতে পারিতেছে না। হাওয়ায় পুষ্পক রথ উড়াইয়া নিল, রাক্ষসেরা সকলে ভয়ে পলায়ন করিল। কাজেই তখন আর কি করে? সে রথ আর লোকজন সব ছাড়িয়া দিয়া নিজেই গিয়া দ্বীপের ভিতরে প্রবেশ করিল।
সেখানে কয়েকটি মেয়ে বেড়াইতেছিল। তাহারা দেখিল, দশ মাথা আর কুড়ি হাতওয়ালা
উপেন্দ্র—৯১ একটা লোক পথ দিয়া যাইতেছে, আর প্রাণপণে নিজের চেহারাটাকে ভয়ংকর করিবার চেষ্টা করিতেছে। এসব দেখিয়া তাহাদের বড়ই হাসি পাওয়ায় তাহাদের একজন আসিয়া রাবণের হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে বাপু? তোমার বাবার নাম কি? এখানে আসিয়াছ কি করিতে?” এ কথায় রাবণের একটু রাগ হইল। সে খুব গম্ভীর সুরে উত্তর দিল, “আমি বিশ্রবার পুত্র রাবণ। এখানে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছি, কাহাকেও দেখিতে পাইতেছি না।”
শুনিয়া মেয়েরা সকলে খিল খিল করিয়া হাসিতে লাগিল। তারপর তাহাদের একজন এক হাতে রাবণের কোমর ধরিয়া অন্য মেয়েদের সামনে নিয়া তাহাকে ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিল, “দেখ দেখ, আমি কেমন একটা কালো পোকা ধরিয়াছি; এর আবার দশটা মাথা, কুড়িটা হাত!” বলিয়াই সে সেটা আর একজনকে ছুঁড়িয়া দিল, সে আবার দিল আরেকজনের হাতে ছুঁড়িয়া। তখন তো রাবণকে লইয়া খুবই একটা লোফালুফির ধুম পড়িয়া গেল। মেয়েদের তাহাতে আমোদের সীমাই নাই, কিন্তু রাবণ বেচারার প্রাণ লইয়া টানাটানি। কাজেই তখন সে আর কি করে? সে দশ মুখের তিনশত বিশ দাঁতে ‘কট্টাশ!’ করিয়া এক মেয়ের হাতে এক কামড় বসাইয়া দিল। সে মেয়ে তো তখনই “মা-া-া-া গো-া-া!” বলিয়া তাহাকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া প্রাণপণে হাত ঝাড়িতে লাগিল। ততক্ষণে আরেকটি মেয়ে তাহাকে ধরিয়া শূন্যে লইয়া গিয়াছিল, তাহার হাতে সে দিল ভয়ানক আঁচড়াইয়া! সে মেয়েটি তখন তাড়াতাড়ি তাহাকে ছুঁড়িয়া একেবারে সমুদ্রের মাঝখানে ফেলিয়া দিল।
নারদমুনি অবশ্য এতক্ষণ সেইখানে দাঁড়াইয়া তামাশা দেখিতেছিলেন, আর আনন্দে অস্থির হইয়া কেবলই হো হো শব্দে হাস্য আর করতালি দিয়া নৃত্য করিতেছিলেন।
বলাবাহুল্য, রাবণের যুদ্ধের সাধ সেদিন সেই সমুদ্রের জল খাইয়া মিটিয়াছিল।