এক রাজা ছিলেন, তাঁহার নাম ছিল শূরসেন! রাজার পুত্র না থাকায় তাঁহার মনে বড়ই দুঃখ ছিল। সেই দুঃখ দূর করিবার জন্য তিনি অনেক দান ধ্যান, অনেক যাগযজ্ঞ করিলেন। তাহার ফলে শেষে তাঁহার একটি পুত্র হইল বটে, কিন্তু সে সাধারণ লোকের ছেলেপিলের মতন নহে। সে একটি ভীষণ সর্প! যদিও মানুষের মতো কথা কয়!
রাজা মনের দুঃখে বলিলেন, “হায়, হায়! এই সর্প লইয়া আমি কি করিব? ইহার চেয়ে যে পুত্র না হওয়া আমার অনেক ভালো ছিল।” কিন্তু সাপ সে কথা ভাবিলই না, সে রাজাকে বলিল, “বাবা, আমার চূড়াকরণ, উপনয়ন করাইলে না? আমার হাতেখড়ি দিলে না? বেদ পড়াইলে না? তাহা হইলে যে আমি মূর্খ থাকিয়া যাইব।”
রাজা আর কি করেন? তিনি ব্রাহ্মণ ডাকিয়া সব করাইলেন। সেই সাপ তখন দেখিতে দেখিতে সকল শাস্ত্র শেষ করিয়া মস্ত বড় পণ্ডিত হইয়া উঠিল। তারপর একদিন সে রাজাকে বলিল, “বাবা, আমার বিবাহ দিলে না? তাহা হইলে যে লোকে আমাকে ছেলেমানুষ ভাবিবে, আমার কথা গ্রাহ্য করিবে না। আর তোমারও বংশ লোপ হইয়া যাইবে, তাহার দরুন শেষে তোমাকে নরকে যাইতে হইবে।”
রাজার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। তিনি বলিলেন, “বাছা, তুমি যদি মানুষ হইতে তবে তো কোনো মুশকিল ছিল না, কিন্তু তুমি যে সাপ, তোমাকে দেখিলে পালোয়ানেরাও ছুটিয়া পলায়। তোমাকে কে তাহার মেয়ে দিতে চাহিবে বল?”
সাপ বলিল, “নাই বা চাহিল। রাজাদের তো জোর করিয়া মেয়ে ধরিয়া আনিয়াও বিবাহ হইতে পারে, তাই কেন কর না? আমার যদি বিবাহ না হয়, তবে আমি নিশ্চয় গঙ্গায় ডুবিয়া মরিব।”
এ কথায় রাজামহাশয় তো বড়ই সংকটে পড়িলেন।
এখন উপায় কি? শেষে অনেক ভাবিয়া তিনি তাঁহার অমাত্যদিগকে বলিলেন, “আমার পুত্র এখন বড় হইয়াছে, আর খুব উপযুক্তও বটে! তোমরা তাহার বিবাহের চেষ্টা দেখ।”
রাজার যে একটি ছেলে আছে অমাত্যরা সকলেই তাহা জানে, কিন্তু সেটি যে একটি সাপ, সে কথা তাহাদের কেহই জানে না। সে কথাটি রাজামহাশয় গোপন রাখিয়াছেন। কাজেই রাজার কথা শুনিয়া তাহারা খুব উৎসাহের সহিত বলিল, “মহারাজ! আপনার যখন ছেলে, তখন আর চেষ্টার বিশেষ দরকার কি? দেশ-বিদেশে আপনার নাম; আপনি যাহার নিকট চাহিকেন, সেই মেয়ে দিবে।”
রাজার একটি খুব পুরাতন বিশ্বাসী কর্মচারী ছিল, কিন্তু সে রাজার কথার ভাবে বুঝিয়া লইল যে ইহার মধ্যে কিছু চেষ্টার দরকার আছে। সে বলিল, “মহারাজ! আপনার মনের কথা আমি বুঝিয়াছি। আপনার অনুমতি হইলে, আমি কন্যার চেষ্টায় যাইতে পারি। পূর্বদেশে বিজয় নামে এক রাজা আছেন, তাঁহার রাজ্য ধন লোকজন হাতি ঘোড়ার সীমা নাই। তাঁহার আটটি মহাবল পুত্র আর ভোগবতী নামে সাক্ষাৎ লক্ষ্মীর মতো একটি কন্যা আছেন। সেই কন্যাই আপনার বউ হইবার উপযুক্ত।”
সে কথায় রাজা ভারি খুশি হইয়া তখনই বিস্তর টাকাকড়ি ও লোকজন সঙ্গে দিয়া কর্মচারীটিকে পূর্বদেশে রওয়ানা করিয়া দিলেন। কর্মচারী রাজা বিজয়ের সভায় উপস্থিত হইয়া শূরসেনের পুত্রের জন্য তাহার কন্যা ভোগবতীকে প্রার্থনা করিল। সেই সাপকে সে জন্মেও চক্ষে দেখে নাই, জানেও না যে সেটা সাপ। সে তাহাকে মানুষ ভাবিয়া আন্দাজি তাহার কত প্রশংসাই যে করিল, তাহা আর বলিবার নয়। তাহার একটি কথাও সত্য নহে, কিন্তু রাজা বিজয় তাহার আগাগোড়াই বিশ্বাস করিলেন, কাজেই বিবাহের কথা স্থির হইতে আর বিলম্ব হইল না। তারপর আর দু-একবার লোক আসা যাওয়া করিলেন। বিজয় এ কথায়ও রাজি হইলেন যে, বর বিবাহ করিতে আসিবেন না, নিজের অস্ত্র পাঠাইয়া দিবেন, তাহার সঙ্গেই কন্যার বিবাহ হইবে। ক্ষত্রিয়দের মধ্যে এরূপ ঘটনা ঢের হইয়া থাকে, কাজেই তেমনি করিয়া কিছুদিনের মধ্যেই ভোগবতীর বিবাহ হইয়া গেল। কেহই জানিল না যে সে বিবাহ একটা সাপের সঙ্গে হইয়াছে; ভোগবতীও তাহা জানিল না।
সে শ্বশুরবাড়ি গেলে পর প্রথমে কেহই তাহাকে সেই সাপের কথা জানাইতে সাহস পায় নাই। কিন্তু শেষে যখন সে সকল কথা জানিল, আর সাপকে দেখিল, তখন সেই সাপকেই তাহার যারপরনাই ভালো লাগিল। সে দিনরাত পরম যত্নে তাহার সেবা করে, অতি মিষ্টভাবে তাহার সঙ্গে কথাবার্তা কহে, আর গান গাহিয়া, বাজনা বাজাইয়া, খেলা করিয়া, বিধিমতে তাহাকে খুশি রাখে।
তখন একদিন সাপ তাহাকে বলিল, “ভোগবতী, আমি তোমার উপর বড়ই সন্তুষ্ট হইয়াছি; পূর্বের কথা এখন আমার মনে হইতেছে। আমি অনন্তের পুত্র মহাবল নাগ; মহাদেবের হাতে আমি থাকিতাম। তখন তুমি আমার স্ত্রী ছিলে। একদিন শিব আমার উপর চটিয়া আমাকে এই শাপ দেন যে, ‘তোমাকে মানুষের ঘরে সাপ হইয়া জন্মাইতে হইবে।’ তখন তুমি আর আমি দুজনে মিলিয়া শিবকে অনেক মিনতি করায় তিনি বলিলেন, ‘আচ্ছা, তোমরা দুজনে যখন গৌতমী নদীতে গিয়া আমার পূজা করিবে, তখন তোমাদের শাপ কাটিয়া যাইবে।’ এখন তুমি আমাকে গৌতমী নদীতে লইয়া চল।”
ভোগবতী তখনই তাহাকে লইয়া গৌতমীতে যাত্রা করিল, আর সেখানে গিয়া শিবের পূজা করিতেই সেই সাপের আবার দেবতার মতো সুন্দর চেহারা হইল।
তখন সে শূরসেনের নিকট গিয়া বলিল, “বাবা, এখন আমার পৃথিবীতে থাকার প্রয়োজন শেষ হইয়াছে; অনুমতি কর, আমি শিবের নিকট যাই।”
শূরসেন বলিলেন, “বাবা, তুমি হইলে যুবরাজ; কিছুদিন এখানে থাকিয়া রাজ্যভোগ কর, তোমার ছেলেপিলে হউক, আমরা দেখিয়া চক্ষু জুড়াই। তারপর আমার মৃত্যু হইলে শেষে শিবের নিকট যাইও!”
সে কথায় সম্মত হইয়া মহাবল সুখে রাজ্যভোগ করিতে লাগিল।