ব্রতকাল—অঘ্রান মাসের সংক্রান্তি থেকে আরম্ভ করে সারা পৌষ মাস ভোর রোজ তুঁষ-তুঁষুলি ব্রত করতে হয়। চার বৎসর পালন করার পর হয় ব্রত উদযাপন।
ব্রত উদযাপন—উদযাপনের সময় কোথাও কোথাও ব্রাহ্মণকে দিয়ে করানো হয় নারায়ণ-শিলার পুজো আর হোম। ষোড়শোপচারে পুজোই প্রশস্ত, অভাবে পঞ্চোপচারে পুজো করাও চলে। পুজোর পর ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়ে, ব্রাহ্মণকে দিতে হয় কাপড়, চাদর, আর একটি টাকা দক্ষিণা।
ব্রত অনুষ্ঠান—ব্রত অনুষ্ঠানের জন্যে চাই আলোচালের তুঁষ, এক রঙের কালো গাইয়ের গোবর, সরষে ফুল, আর দূর্বা। কোথাও কোথাও এসব জিনিসের উপর আবার দেয় মুলোর ফুল।
গোবরের সঙ্গে তুঁষ মিশিয়ে ভালো করে মাখবে, তারপর তা দিয়ে নাড়ু তৈরি করবে ছবুড়ি ছগণ্ডা অর্থাৎ ১৪৪টা। প্রত্যেকটি নাড়ুর মাথায় পাঁচগাছি করে দূর্বা গুঁজে দিয়ে, নাড়ুগুলো রাখবে একটা মালসায়। কোথাও কোথাও সেঁজুতির কিছু দুর্বা তুলে রাখার বিধি আছে; তা থেকে দেয় পাঁচগাছি দূর্বা।
নাড়ু তৈরির নিয়মও সব জায়গায় এক রকমের নয়—কোথাও নাড়ু করে ৩১টি, কোথাও ৬২টি, কোথাও বা ১৪৪টি।
পূব কী উত্তরমুখে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে পুজো করতে হয়। যারা ৩১টি নাড়ু করবে তারা রোজ একটি করে নাড়ু নিয়ে পুজো করবে। যারা ৬২টি নাড়ু করবে তারা পুজো করবে রোজ দুটি নাড়ু দিয়ে। আর যারা ১৪৪টি নাড়ু করবে তারা রোজ নেবে ৪টি করে নাড়ু। কোথাও কোথাও আবার শনি-মঙ্গলবারে ৬টি নাড়ু নিয়ে পুজো করে।
নাড়ু আর সরষের ফুল (এবং তার সঙ্গে মুলোর ফুলও) হাতে নিয়ে মন্ত্র পড়বে। মন্ত্র:
তুঁষ-তুঁষুলি কাঁধে ছাতি
বাপ মার ধন যাতাযাতি
স্বামীর ধন নিজবতী।
ঘর করব নগরে
মরব গিয়ে সাগরে
জন্মাব উত্তম ব্রাহ্মণ কুলে।
তুঁষুলি গো রাই, তুঁষুলি গো ভাই,
তোমায় বেত্ত করে কী বর পাই
ছবুড়ি ছগণ্ডা ক্ষীরের নাড়ু খাই।
বেত্ত করলে কী হয়
আড়ি মাপা সিঁদুর চায়।
দরবার আলো পুত পায়।
হেঁসেল আলো বউ পায়।
সভা আলো জামাই পায়।
মেঝে আলো ঝি পায়।
আলনায় কাপড় দলমল করে,
সিঁথে সিঁদুর ঝকমক করে,
মুখে পান টপ টপ করে।
গোয়ালে গোরু মরাই ধান
বৎসর বৎসর পুত্র দান।
হবে পুত্র মরবে না
চক্ষের জল পড়বে না।
স্বামীর কোলে পুত্র দিয়ে
মরণ হয় যেন একগলা গঙ্গাজলে।
পুজো হয়ে গেলে নাড়ুগুলো একটা আলাদা হাঁড়িতে তুলে রাখবে।
তারপর মন্ত্র পড়ে নমস্কার করবে। মন্ত্র:
গৌরী গো মা, তোমার কাছে
মাগি এই বর,
স্বামী-পুত্র নিয়ে যেন
সুখে করি ঘর।।
এইভাবে সারা মাস পুজোর পর পৌষ-সংক্রান্তির দিন ৪টি নাড়ু বেশি থাকবে সে কয়টিকেও ফুল-দুর্বা দিয়ে পুজো করে রেখে দেবে সেই আলাদা হাঁড়িটাতে।
তারপর সেই পৌষ-সংক্রান্তির দিনই চাল কী ময়দা দিয়ে ছোটো ছোটো ছবুড়ি ছগণ্ডা (১৪৪টি) নাড়ু করে, নতুন হাঁড়িতে দুধ দিয়ে হাঁড়ি উনুনে চড়িয়ে দেবে। দুধ ফুটলে নাড়ুগুলো দেবে তার মধ্যে ছেড়ে। বেশ সেদ্ধ হয়ে গেলে পর নাবিয়ে নেবে।
তারপর সুবিধেমতো সময় নাড়ু খাবে। খাবার সময় নাড়ুর হাঁড়ি থাকবে পেছন দিকে, তাতে দেবে আগুন। কোথাও কোথাও কুলকাঠের আগুন দেবার নিয়ম আছে।
নাড়ু খাবার সময় মন্ত্র বলবে। মন্ত্র:
তুঁষুলি গো রাই, তুঁষুলি গো ভাই,
তোমার দৌলতে আমি ছবুড়ি ছগণ্ডা খাই।।
খাওয়ার পর সেই আগুনের হাঁড়ি মাথায় করে নিয়ে গিয়ে পুকুরে (বা নদীতে) ভাসিয়ে দিয়ে বলবে। মন্ত্র:
তুঁষ-তুঁষুলি গেল ভেসে,
বাপ-মার ধন এল হেসে।।
তুঁষ-তুঁষুলি গেল ভেসে,
আমার স্বামীর ধন এল হেসে।।
তারপর আবার ‘গৌরী গো মা, তোমার কাছে মাগি এই বর’ ইত্যাদি মন্ত্র পড়ে নমস্কার করবে।
তুঁষ-তুঁষুলি ব্রত সমাপ্ত।