এক ছিল বুড়ি। তার ছিল এক ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল—আর কারও সঙ্গে নয়—একেবারে সাক্ষাৎ যমরাজের সঙ্গে। শ্বশুরবাড়ি তার যমপুরী। যমরাজ সেই যে তাকে বিয়ে করে নিয়ে গেলেন, আর মর্ত্যে বাপের বাড়ি পাঠালেন না।
বুড়িকে কে আর মেয়ের মতো যত্নআত্তি করে? বুড়ি তাই ছেলের বিয়ে দিয়ে টুকটুকে বউ ঘরে আনলে। যেমন সুন্দরী বউ, তেমনি তার মিষ্টি স্বভাব। রাতদিন প্রাণপাত করে বউ শাশুড়ির সেবা করে। সংসারের কাজেকর্মেও বউ যেন দশভুজা। কুটোগাছটি নড়তে পায় না।
দেখতে দেখতে কার্তিক মাস এসে পড়ল। উঠোনের মাঝখানে পুকুর করে বউ বসল পুজোয়। তাই না দেখে শাশুড়ির মনে জাগল সন্দেহ—বউ বুঝি কি তুকতাক করতে বসেছে। ভাবলে মনে মনে—তাই যদি না হবে তবে কী গুণে কাক, চিল অবধি বউ-এর এমন বশ হয়েছে। বাজখাঁই গলায় হাঁকলে তখন বুড়ি, ‘ওলো, ও পোড়ারমুখী, কী হচ্ছে ও? কী হিল বিলচ্ছিস, কী বিড় বিড়চ্ছিস, শুনি? বলি আমায় খাবি, না আমার মেয়েকে খাবি? বল দেখি, লা পোড়ারমুখী ডাইনি?’
বউ উত্তর দিলে, ‘মা যমপুকুর ব্রত করছি।’
যমপুকুর ব্রত! জন্মেও শোনেনি বুড়ি সে কথা। রেগে আগুন তেলে বেগুন বুড়ি ছুট্টে এসে বউকে মারলে এক লাথি, দিলে ছাই-পাঁশ দিয়ে পুকুর বুঁজিয়ে, ধমক দিয়ে বললে, ‘খবরদার’! ফের যদি দেখি তবে তোরই একদিন কি আমারই একদিন।’
হাপুস নয়নে কেঁদে যমরাজকে সাক্ষী মেনে বউ বললে, ‘হে ধর্মরাজ! তুমি সাক্ষী রইলে—আমি এক বছর যমপুকুর ব্রত করলুম।’
এমনি করে দিন যায়। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আবার আসে কার্তিক মাস। বউ কী করে? শাশুড়ির ভয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে ছোট্ট পুকুর কাটে; কলাগাছের আড়ালে লুকিয়ে বসে সেখানে করে যমপুকুর ব্রত। একটি একটি করে শেষ হয়ে আসতে থাকে কার্তিক মাসের দিনগুলো।
বুড়ির মাথায় বুঝি টনক নড়ে। একদিন বউকে ডেকে সাড়া না পেয়ে লাঠিগাছায় ভর দিতে দিতে বুড়ি এসে হাজির হয় পুকুরপাড়ে। সেখানে এসে দেখে বউ কলাগাছের আড়ালে বসে কী যেন করছে একমনে। সন্দেহ জাগে বুড়ির মনে। কিছু না বলে চুপি চুপি গিয়ে বউ-এর পেছনে লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়ায় বুড়ি; দেখে—বউ মন্ত্র পড়ে কাক, বক, চিল, কত কীসের পায়ে ফুল দিচ্ছে। সব দেখে শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বুড়ি, হাঁক দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ লা, সর্বনাশী! হচ্ছে কী ও সব? কী হিল বিলচ্ছিস? কী বিড় বিড়চ্ছিস? বলি—আমায় খাবি, না আমার ছেলেকে খাবি?’
ভয়ে ভয়ে মুখ তুলে বউ বলে, ‘কিচ্ছু নয়, মা, যমপুকুর ব্রত করছি।’
আরও রেগে যায় বুড়ি। বউকে মারে লাথি; জঞ্জাল দিয়ে, থুতু ফেলে পুকুর বুঁজিয়ে দেয়। তারপর রাগে গরগর করতে করতে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে ফিরে আসে ঘরে।
হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে মাথা খুঁড়ে যমরাজকে ডেকে বলে বউ, ‘হে ধর্মরাজ। সাক্ষী রইলে তুমি—এই দুবছর আমি যমপুকুর ব্রত করলুম।’
এইভাবে কাটতে থাকে দিন। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আশ্বিন গিয়ে ফের আসে কার্তিক মাস। বউ এবার লুকিয়ে হেঁসেলে উনুনের পাশে বসে যমপুকুর ব্রত করতে লাগল। কার্তিক মাসও শেষ হয় হয়, আর মোটে কটা দিন বাকি, এমন সময় একদিন বুড়ি সব দেখতে পেয়ে বউকে এই মারে তো এই মারে! তারপর অকথ্য কুকথ্য বলতে বলতে লাথি মেরে পুকুর ভেঙে বুঁজিয়ে দেয়।
তিন তিন বছর এই অলক্ষুণে কান্ড! বউ-এর চোখের জল আর বাঁধ মানে না। হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে গলায় আঁচল জড়িয়ে জোড়হাত করে বউ বলে, ‘হে ধর্মরাজ! তুমি সাক্ষী রইলে—আমি তিন বছর যমপুকুর ব্রত করলুম।’
এমনি করে দেখতে দেখতে সেবছরও গেল কেটে; আবার এল কার্তিক মাস। নির্জন জায়গা খুঁজে বাড়ির পেছন দিকে ছাইগাদার ধারে এসে বউ পুকুর করলে সেখানে বসে করতে লাগল যমপুকুর ব্রত।
কার্তিক মাসের সঙ্গে সঙ্গে বুড়ির মাথায়ও টনক নড়েছে। বাড়ির চারদিক খুঁজে দেখলে বুড়ি—না:, এবার কোথাও আর পুকুর হয়নি। হয়নি যাক, বাঁচা গেছে! স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললে বুড়ি। কিন্তু তবুও কেন মনের খুঁতখুতুনি যায় না? অবাক হয়ে ভাবে বুড়ি, আর মনে মনে শাপশাপান্ত করে বউ-এর উদ্দেশ্যে।
মাস শেষ হতে আর একদিন মোটে বাকি। হঠাৎ বুড়ির চোখে পড়ল বউ ফুল, জল নিয়ে চলেছে কোথায়। চুপি চুপি তার পেছু নিলে বুড়ি; এসে দেখলে বউ ছাইগাদার ধারে বসে পুকুর করে পুজো করছে।
আর যায় কোথা! লাঠি ঠকঠক করতে করতে তেড়ে এসে বউকে মারলে এক লাথি, শুরু করে দিলে বউ-এর বাপ-মা তুলে গালাগাল, লাথি মেরে পুকুর ভেঙে ছাই দিয়ে তা বুঁজিয়ে দিয়ে রাগে গজর গজর করতে করতে ফিরে এল ঘরে।
বুড়ো হাড়ের কী তেজ! বেদম লেগেছিল বউ-এর। যন্ত্রণায় কাতরে উঠে কাঁদতে কাঁদতে পুকুর ভাসিয়ে দিলে বউ বেচারা। অনেকক্ষণ কাঁদবার পর উঠে বসে গলায় আঁচল দিয়ে কাতরসুরে বললে বউ, ‘হে ধর্মরাজ! সাক্ষী রইলে তুমি—চার বছর যমপুকুর ব্রত করে আজ ব্রত উদযাপন করলুম আমি।’
তারপর নমস্কার করে গায়ের মাথার ছাই ঝেড়ে ফেলে আস্তে আস্তে ঘরে ফিরে এল সে। দুঃখকষ্টের মধ্যে দিয়ে এইভাবে হল তার ব্রত উদযাপন।
তারপর একে একে কেটে গেল কয়েকটা বছর। বুড়িকে ধরলে কঠিন রোগে। বেটা আর বেটার বউ-এর সেবাশুশ্রূষার তিলমাত্র বিরাম নেই। খবর পেয়ে যমপুরী থেকে মেয়েও এসেছে ছুটে। রাতদিন চলছে ঝাড়-ফুঁক, টোটকা-টাটকা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না—একদিন দুপুরবেলা বুড়ি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে গেল।
বাড়িময় উঠল কান্নার রোল। পাড়াপড়শিরা সব ছুটে এল। সবাই বোঝাতে লাগল—‘উপযুক্ত বয়সে গেছেন, সেজন্যে শোক করতে নেই; এখন পরলোকে তাঁর তৃপ্তির জন্যে শ্রাদ্ধ শান্তির ব্যবস্থা করো।’
এক মায়ের এক ছেলে, ঘটা করে মায়ের শ্রাদ্ধ করলে। এক মায়ের এক মেয়ে, মায়ের শ্রাদ্ধশান্তির পর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গেল। তবুও বেটার বউ-এর চোখের জল বাঁধ মানে না। কেন তা ধি সে নিজেই জানে?
মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যমপুরী। সেখানে গিয়ে পৌঁছুতেই যমরাজ তাকে ডেকে বললেন, ‘দেখো, তোমার মায়ের অসুখের সময় অনেক দিন তুমি মর্ত্যে তোমার বাপের বাড়িতে ছিলে; তাই এখন দিন কতক যমপুরীর দক্ষিণ দুয়োরের দিকে যেও না,—আর তিনদিকে আগের মতোই স্বচ্ছন্দে বেড়িয়ে বেড়িয়ো, তাতে কোনও বাধা নেই।’
বুড়ির মেয়ে যমরাজের বউ এ কথা শুনে ঘাড় তুলে একবার স্বামীর চোখে চোখে চাইলে, তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে মাটির দিকে চেয়ে আস্তে করে একবার মাথা নাড়লে—সায় দিলে, কী দিলে না ঠিক বুঝতে পারা গেল না।
এমনি করে দু-চার দিন কেটে গেল। বুড়ির মেয়ের মনে থেকে থেকে জাগতে লাগল সেই একই প্রশ্ন—যমরাজ কেন দক্ষিণ দুয়োরের দিকে যেতে বারণ করলেন। শেষে আর কৌতূহল দমন করতে পারল না সে,—একদিন লুকিয়ে দেখতে পেল কী আছে যমপুরীর দক্ষিণ দুয়োরের দিকে।
তখন বিকেলবেলা। বুড়ির মেয়ে যমরাজের বউ যেই না যমপুরীর দক্ষিণ দুয়োর পার হয়েছে অমনি তার চোখে পড়ল এক ভীষণ নোঙরা কৃমিকুন্ড, কানে এল সেখানকার লক্ষ লক্ষ পাপীর বুকফাটা কান্না আর কাতর আর্তনাদ! শিউরে উঠে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে যাবে সে এমন সময় থমকে দাঁড়াল সে চেনা গলার আওয়াজ পেয়ে। স্পষ্ট শুনতে পেল তার মা তার ভাইয়ের নাম ধরে চেঁচিয়ে বলছে, ‘ওরে, আমায় বাঁচা! এ নরককুন্ডে পচে মরছি আমি! বাঁচা, আমায় বাঁচা! আর কখখনো এমন কাজ করব না।’
ভালো করে নিরীখ করে দেখলে বুড়ির মেয়ে—কাতারে কাতারে পাপী হাবুডুবু খাচ্ছে সেই ভয়ানক নরককুন্ডের মধ্যে। কাৎরে কাৎরে ডাকছে এই ভাবে, আর ঠিক তার পরমুহূর্তেই ভীমের মতো জোয়ানমর্দ যত যমদূতের ডাঙস খেয়ে তলিয়ে যাচ্ছে সে নরককুন্ডের তলায়! আবার খাবি খেয়ে যেই না মাথা তুলে চেঁচিয়েছে অমনি যমদূতেরা তাদের মাথায় দুম করে মেরেছে ডাঙস, আর অমনি তলিয়ে যাচ্ছে ডাঙস খেয়ে। একতিল বিরাম নেই এই ওঠা-নামার, একতিল বিরাম নেই তাদের কাৎরানির!
এই ভয়ানক কান্ড দেখেশুনে হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধুলো বুড়ির মেয়ের। মায়ের জন্যে প্রাণ করতে লাগল আকুলি বিকুলি। কোনোরকম পা টেনে টেনে চলতে চলতে ফিরে এল সে যমপুরীর ভেতর। বিছানায় শুয়ে ছটফট করে কাটাল সারারাত।
পরদিন দুপুরবেলা যমরাজ যখন খেতে বসেছেন তখন আস্তে আস্তে এসে গলায় আঁচল দিয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে যোড়হাতে সামনে দাঁড়াল সে। বউ-এর চোখে জল দেখে যমরাজ অভয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তাকে, ‘তোমার চোখে জল কেন? কী দুঃখ তোমার, নির্ভয়ে বলো আমায়।’
ধরা গলায় ধীরে ধীরে নিবেদন করলে সে স্বামীর পায়ে, ‘তোমার পায়ে অপরাধিনী আমি। আমায় ক্ষমা করো। তুমি আমায় দক্ষিণ দুয়োরের দিকে যেতে বারণ করেছিলে। তাইতেই বুঝি কৌতূহল বাঁধ মানল না আমার, সেখানে গেলুম আমি। গিয়ে যা দেখলুম তা বলতে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে আমার! দেখলুম দূতেরা সব আমার মায়ের মাথায় ডাঙস মেরে মেরে বারবার তাঁকে ডুবিয়ে দিচ্ছে নরককুন্ডের মধ্যে, আর পর মুহূর্তেই খাবি খেয়ে মা আমার মাথা উঁচিয়ে কাৎরে চেঁচাচ্ছেন—‘ওরে, আমায় বাঁচা বাপধন! আর কখনো এমন পাপ করব না।’ দয়া করে আমায় বলে দাও কী করলে এ নরকযন্ত্রণা থেকে উদ্ধার পাবেন আমার মা। বলে দাও গো, পায়ে পড়ি তোমার।’ বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে উঠল বুড়ির মেয়ে যমরাজের বউ।
বউয়ের কান্নায় নরম হয়ে পড়লেন যমরাজ। ভেবেচিন্তে বললেন, ‘তোমার মা আমার শাশুড়ি। তাঁকে নরক যন্ত্রণা দেওয়া কি আমার সাধ? কিন্তু কী করি? আমি যে ধর্মরাজ। ধর্মের বিধির একচুল এদিক ওদিক করি সে সাধ্য আমার নেই। তোমার মা তাঁর পাপের ফলভোগ করছেন।’
বউ জিজ্ঞেস করলে, ‘পাপের ফলভোগ থেকে উদ্ধারের উপায় কী?’
যমরাজ বললেন, ‘উপায়? উপায় হচ্ছে পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠান।’
বউ জিজ্ঞেস করলে, ‘কোন পুণ্যকর্মের অনুষ্ঠানে মা উদ্ধার পাবেন বলে দাও। যত কঠিনই হোক আমি তা করবই।’
যমরাজ বললেন, ‘দেখো, তোমার বউ ঠাকরুণ বিয়ের কনে হয়ে এসে বছর বছর যমপুকুর ব্রত করতেন, আর তোমার মা তাঁকে লাথি মেরে গালাগাল করে থুতু, জঞ্জাল—এসব ফেলে যমপুকুর বুঁজিয়ে দিতেন, ব্রত করে দিতেন লন্ডভন্ড। সেই পাপে তাঁর এই সাজা।’
এ কথা শুনে বউ স্বামীর পা জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘একটা কিছু উপায় তোমায় করতেই হবে, নইলে এ মুখ আর তোমায় দেখাব না।’
যমরাজ তখন ভেবেচিন্তে বললেন, ‘দেখো, তোমার বউ-ঠাকরুণ যদি তোমার মায়ের নামে সঙ্কল্প করে যমপুকুর ব্রত করেন তবেই তোমার মায়ের উদ্ধার হবে। কিন্তু তোমার মা মিছিমিছি তাঁকে যে কষ্ট দিয়েছেন তাতে তিনি কি তোমার মায়ের নামে সঙ্কল্প করে ব্রত করতে রাজি হবেন? দেখো চেষ্টা করে।’
এ কথা শুনে বুড়ির মেয়ের বড়ো ভাবনা হল—বউ-ঠাকরুণ যদি রাজি না হয়!
তার মনের কথা আঁচ করে যমরাজ বললেন, ‘দেখো, একটা উপায় হতে পারে। তুমি বাপের বাড়ি গিয়ে বউ-ঠাকরুণের সেবাশুশ্রূষা করে তাঁর সঙ্গে খুব ভাব জমিয়ে বসো। তিনি এখন পোয়াতি। দশমাসে প্রসব-বেদনা হলে তাঁকে যমপুকুর ব্রত করতে বলবে। তাতে তিনি রাজি হবেন মনে হয়।’
খানিকটা আশ্বস্ত হল বুড়ির মেয়ে যমরাজের বউ। পরক্ষণেই আবার মনে উদয় হলো এক ভাবনা। জিগ্যেস করলে সে স্বামীকে, ‘কিন্তু আমার যত্ন-আত্তিতেও যদি বউ-ঠাকরুণ রাজি না হয়? যে জ্বালা জ্বালিয়েছে তাকে মা!’
যমরাজ বললেন, ‘সেজন্যে ভেবো না। প্রসব-বেদনা উঠলেই আমি গিয়ে বউ-ঠাকরুণকে ভর করে থাকব; ব্রত শেষ না হওয়া অবধি তাঁর পেটের ছেলে বার হবে না। তিনি ব্রত শুরু করলেই তোমার মা নরককুন্ড ছেড়ে উঠতে থাকবেন, ব্রত শেষ হলেই তাঁর উদ্ধার পূর্ণ হবে, আর সঙ্গে সঙ্গে বউ-ঠাকরুণের কোল-আলো-করা চাঁদপানা ছেলে হবে।’
এ কথায় সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হয়ে বুড়ির মেয়ে যমরাজের বউ শুভক্ষণ দেখে বাপের বাড়ি যাত্রা করলে। সেখানে এসে ভাইকে সে বললে, ‘বউ-ঠাকরুণ একা মানুষ, তায় পোয়াতি; তাই এলুম তোমাদের দেখাশুনো করতে।’ তারপর সংসারের ভার নিজের হাতে নিয়ে, বউকে সে খুব যত্ন-আত্তি করতে লাগল। বউকে আর নিজ হাতে কুটোগাছটিও নড়াতে হয় না, সব কাজই করে ননদ। ননদের যত্নে বউ ভারি খুশি হল।
পাঁচ মাস পড়তেই ননদ দিলে বউয়ের কাঁচা সাধ, আট মাসেতে দিলে ভাজা সাধ, তারপর নয় মাসেতে খুব ধূমধাম করে পঞ্চামৃত সাধ দিলে।
দশমাস দশদিনে বউয়ের প্রসব-বেদনা দেখা দিল। এতদিনে ননদ পাড়লে তাঁর কাছে আসল কথা। তাকে খুব আদর করে বললে, ‘দেখ, বউ, তুই মার নামে সঙ্কল্প করে চারটি যমপুকুর কর।’
ননদের কথায় বউ মুখ ভার করে বললে, ‘মা গো মা, ফের যমপুকুর করব! তুমি তো জানো না, ঠাকুরঝি, যমপুকুর করার জন্যে কী কষ্ট আমায় দিয়ে গেছেন মা। সে কি ভোলবার জিনিস, ঠাকুরঝি? মর্মে মর্মে গাঁথা হয়ে গেছে সে সব—চিরজন্মের মতো। যখনই ব্রত করতে বসতুম, মা এসে থুথু দিয়ে, জঞ্জাল দিয়ে…’
তাড়াতাড়ি বউয়ের মুখ চাপা দিয়ে ননদ বললে, ‘সব জানি, বউ, সব জানি। কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে, তা নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ কী বল? মা তো আর ইহলোকে নাই। এখন যদি তুই…’
ননদের কথা শেষ করতে দেয় না বউ। মুখ ঘুরিয়ে বলে, ‘তা হয় না, ঠাকুরঝি।’
অনেক সাধ্যসাধনা করে বুড়ির মেয়ে, কিন্তু বউয়ের সেই এককথা—‘তা হয় না, ঠাকুরঝি।’
দু-চোখে অন্ধকার দেখে বুড়ির মেয়ে, মনে মনে স্মরণ করে স্বামীকে। টনক নড়ে যমরাজের। হঠাৎ ব্যথা ওঠে বউয়ের, দেখতে দেখতে আসতে শুরু করে জোর ব্যথার পর জোর ব্যথা, তবু ছেলে বেরোয় না পেট থেকে, ব্যথায় কাঁদতে থাকে বউ। ননদ বলে, ‘তুই যমপুকুর কর, বউ; এক্ষুণি ছেলে হবে।’
যমপুকুর! রাগে মুখ ঘুরিয়ে নেয় বউ, তেজ করে বলে, ‘কখখনো নয়, প্রাণ গেলেও নয়।’
ব্যথা বেড়েই চলে। ধাক্কায় ধাক্কায় ব্যথা, জোর জোর ব্যথা। মুষড়ে পড়তে থাকে বউ। ‘যমপুকুর কর, বউ! যমপুকুর কর,’—বারবার বলতে থাকে ননদ। শুনেই রাগে মুখ ঘোরায় বউ, ফের ককিয়ে ওঠে ব্যথার ধাক্কায়। ‘মিছে কেন কষ্ট পাচ্ছিস, বউ?’—বুঝিয়ে বলে ননদ, ‘পুজো কর, এক্ষুণি খালাস হবি, এক্ষুনি ছেলে হবে।’
যন্ত্রণায় কাটা ছাগলের মতো ছটফট করছে তখন বউ। ননদের কথায় এবার ধড়মড় করে উঠে পড়ে, তাড়াতাড়ি উঠোনে এসে করে চারটে পুকুর, শাশুড়ির নামে করে যমপুকুর ব্রত।
যেমনি ব্রত শেষ হয় অমনি আসে যেন এক জোর ধাক্কা, ইনিয়ে বিনিয়ে যায় বউয়ের সারাশরীর, চাঁদের মতো কোল আলো করা ছেলে হয় বউয়ের, সুখের আবেশে ঘুমের পাহাড় ভেঙে পড়ে তার চোখদুটিতে, তারই মধ্যে কানে আসতে থাকে ছেলের ওঁয়া ওঁয়া কান্নার মধুর রব।
এদিকে নরককুন্ড থেকে বউয়ের শাশুড়িও পায় মুক্তি, মর্ত্যের দিকে চাইতেই চোখ পড়ে তার নাতির মুখেরপরে, নাতির মুখ দেখে হাসতে হাসতে স্বর্গে উঠে যায় বুড়ি।
উলু দিয়ে ওঠে বুড়ির মেয়ে যমরাজের বউ।
পাড়াপড়শিরা সব আসে ছুটে। ছেলে দেখে পঞ্চমুখে করতে থাকে সুখ্যাতি।
প্রাণপাত করে বউয়ের সেবা করে ননদ। দেখতে দেখতে এসে পড়ে ষষ্ঠীপুজোর দিন। ঘটা করে হয় ষষ্ঠীপুজো। দাদা-বউদিকে প্রণাম করে বুড়ির মেয়ে ফিরে যায় তার শ্বশুরবাড়ি।
তাই কথায় বলে যমপুকুর ব্রত করলে যমের তাড়না সইতে হয় না; শ্বশুর-শাশুড়ি জল পায়, হাসতে হাসতে স্বর্গে যায়।
যমপুকুর ব্রতকথা সমাপ্ত।