সাবিত্রী চতুর্দশী ব্রতকথা

পুরাকালে আমাদের দেশে অশ্বপতি নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর সুশাসনে প্রজারা তাঁকে পিতার মতো ভক্তি করত। কিন্তু রাজার মনে সুখ ছিল না। তিনি ছিলেন নি:সন্তান।

অবশেষে একদিন সন্তান-কামনায় তিনি রাজ্য ছেড়ে বনে গিয়ে সাবিত্রী দেবীর আরাধনায় প্রবৃত্ত হলেন। দীর্ঘ আঠারো বৎসর ধরে চলল তাঁর কঠোর তপস্যা। তখন দেবীর কৃপা হল। দেহজ্যোতিতে অন্ধকার বনভূমি আলোকিত করে রাজার সম্মুখে আবির্ভূতা হয়ে তিনি তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বললেন। রাজা করজোড়ে দেবীকে তাঁর মনোবাসনা নিবেদন করতে, দেবী বললেন, ‘তথাস্তু। ভগবান ব্রহ্মদেবের আদেশে সত্বরই তোমার এক অলৌকিক রূপলাবণ্যময়ী কন্যাসন্তান লাভ হবে।’

‘তাই হোক!’ বলে দেবীকে প্রণাম করে মাথা তুলতেই রাজা দেখেন দেবী কখন অন্তর্দ্ধান করেছেন।

প্রফুল্লচিত্তে রাজা আবার রাজধানীতে ফিরে এলেন। তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পাটরানি মালবীর কোল আলো করে এল একটি মেয়ে। ঊষার মতো তার রূপের ছটা। রাজ্যময় আনন্দ-উৎসব পড়ে গেল। সাবিত্রীদেবীর বরে কন্যাসন্তান লাভ হয়েছে বলে রাজা-রানি আদর করে নাম রাখলেন তার সাবিত্রী।

বহু আরাধনার এই একটিমাত্র সন্তান। আদরে যত্নে দিনদিন শশিকলার মতো বাড়তে লাগল সে। ক্রমে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে এসে পদার্পণ করলে সাবিত্রী। পূর্ণিমার চাঁদও ম্লান হয়ে যায় তার রূপের ছটায়। কন্যার বিয়ের জন্যে স্বয়ংবর-সভা ডাকলেন রাজা। দেশ-দেশান্তর থেকে এলেন তরুণ রাজা আর রাজকুমারগণ। কিন্তু সাবিত্রীর দিকে চোখ তুলে চাইতেই তাঁদের সব চোখ ঝলসে যায় তার রূপের ছটায়। মনে হয় সদ্য স্বর্গ থেকে নেমে এলেন বুঝি কোনো দেবী। করজোড়ে ‘মা’ বলে নমস্কার করে তাড়াতাড়ি সরে পড়েন তাঁরা সবাই।

দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়তে থাকেন রাজা অশ্বপতি আর রানি মালবী। এত রূপ, এমন গুণ, তাই কি শেষে হল মেয়ের কাল?

দিনের পর দিন গড়িয়ে চলে। প্রভাতসূর্যের রশ্মিমালার মতো ঝলমল করে যেন প্রহরে প্রহরে বেড়ে উঠতে থাকে সাবিত্রীর রূপ। যৌবনে এসে পদার্পণ করেন তিনি। দেবর্ষি নারদ এসে রাজাকে পরামর্শ দেন, ‘মহারাজ! দেবকন্যার মতো আপনার এ মেয়ে। তাকেই দিন মনমতো স্বামী খুঁজে নেবার অধিকার। প্রেরণ করুন মেয়েকে দেশভ্রমণে।’

তাই হয়। রাজ্যময় পড়ে যায় ‘সাজ সাজ’ রব। দাসদাসী, লোকজন সঙ্গে করে একদিন শুভক্ষণে গৃহদেবতা ও পিতামাতার চরণ বন্দনা করে দেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন সাবিত্রী।

কত নগর, কত জনপদ ভ্রমণ করেন তিনি, করেন কত তীর্থ পর্যটন। যেখান দিয়ে চলে যায় তাঁর রথ, করজোড়ে তাঁর উদ্দেশ্যে নমস্কার করে সরে যায় যত পথের লোক—এমনি তাঁর রূপবৈভব, এমনি তাঁর মহিমময় গাম্ভীর্য।

এমনি করে চলতে চলতে একদিন তিনি এলেন এক তপোবনে। মহারাজ দ্যুমৎসেন রাজ্যহারা হয়ে অন্ধ অবস্থায় মহিষী শৈব্যা আর পুত্র সত্যবানকে নিয়ে তাপসজীবন যাপন করছিলেন সেখানে। তরুণ সূর্যের মতো ভাস্বর সত্যবান। তাঁরই সঙ্গে চার চোখের মিলন হল সাবিত্রীর। মনে মনে তাঁকে পতিত্বে বরণ করলেন তিনি।

আর দেশভ্রমণের প্রয়োজন কী? গৃহে ফেরার আদেশ দিলেন সাবিত্রী সঙ্গের লোকজন সবাইকে।

নয়নের নিধি একমাত্র কন্যা ফিরে এসেছে ঘরে। রাজা-রানির আনন্দ আর ধরে না। তবুও মনে জাগে সংশয়,—অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে তো? এমন সময় সংবাদ এল দেবর্ষি নারদ মহারাজ অশ্বপতির সাক্ষাৎপ্রার্থী।

ত্রস্তব্যস্ত হয়ে রাজসভায় ছুটে এসে পাদ্যঅর্ঘ্য দানে দেবর্ষিকে অভ্যর্থনা করলেন রাজা। যথারীতি কুশল প্রশ্নাদির পর সাবিত্রীর কথা জিজ্ঞেস করলেন দেবর্ষি। মহারাজ অশ্বপতি অন্তঃপুরে সংবাদ প্রেরণ করতেই, সাবিত্রী এসে পিতা ও দেবর্ষির পাদবন্দনা করে নতমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আশীর্বাদের পালা সাঙ্গ হল। সংশয়াতুর কন্ঠে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন রাজা, ‘অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে, মা?’

মনে মনে লজ্জায় মরে গিয়ে নতমুখে উত্তর দিলেন সাবিত্রী, ‘হ্যাঁ, বাবা।’

আশায় উদবেলিত হয়ে উঠল রাজার প্রাণ। ‘তাঁর পরিচয়?’—সানন্দে প্রশ্ন করলেন তিনি মেয়েকে।

তেমনি নতমুখেই অতি ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন সাবিত্রী, ‘মহারাজ দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবান। কুমারের যখন শৈশবকাল তখনই শত্রুকতৃক বিতাড়িত হয়ে, আজ প্রায় এই বিশ বছর যাবৎ অন্ধ অবস্থায় মহিষী ও কুমারের সঙ্গে তপোবনবাসী হয়ে আছেন মহারাজ দ্যুমৎসেন…

‘আ-হা-হা!’ —সাবিত্রীর কথা শেষ না হতেই খেদোক্তি বেরিয়ে এল দেবর্ষি নারদের কন্ঠ থেকে।

চমকিত হয়ে সভাজন সবাই চোখ তুলে চাইলেন নারদের দিকে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে রাজার দিকে চেয়ে বলতে লাগলেন নারদ, ‘মহারাজ! মহা ভুল করেছেন মা সাবিত্রী আমার।’

‘কেন?’—জিজ্ঞেস করলেন রাজা, ‘কুমার সত্যবান কি বিজ্ঞ ও বীরপুরুষ নন? হৃদয়বান ও রূপবান নন কি তিনি?’

‘সকল রকম সদগুণেই বিভূষিত তিনি’—উত্তর দিলে দেবর্ষি নারদ, ‘রূপবানও বটেন—তরুণ সূর্যের মতো। কোথায় তাঁর সমকক্ষ ক্ষত্রিয়কুমার এই মর্ত্যলোকে? কিন্তু স্বল্প তাঁর পরমায়ু; আজ থেকে ঠিক বৎসরকাল পূর্ণ হলেই কালপূর্ণ হবে তাঁর।’

হতাশায় প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন রাজা অশ্বপতি। ‘অপর কোনো তরুণকে পতিত্বে বরণ করো তুমি, মা আমার।’—কাতরকন্ঠে উপদেশ দিলেন তিনি কন্যাকে।

এ কথায় সংকোচের বাঁধ কেটে গেল সাবিত্রীর। নম্র অথচ দৃঢ়কন্ঠেপ্রত্যুত্তর দিলেন তিনি, ‘বাবা, ‘দিলুম’ কথাটা লোকে শুধু একবারই বলে। যা দিলুম তা আর কখনও ফিরিয়ে নিতে পারিনে—লোভেও নয়, ভয়েও নয়। নারী একবারই হৃদয় দান করে থাকে। পতিই নারীর একমাত্র গতি। এ দান আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।’

সাবিত্রীর মুখে সতীধর্মের মাহাত্ম্য শুনে দেবর্ষি নারদ পরম পরিতুষ্ট হয়ে এ বিয়েতে মত দিয়ে তাঁকে আশীর্বাদ করে চলে গেলেন। তারপর শুভদিনে রাজা অশ্বপতি তপোবনে গিয়ে ধূমধাম করে সত্যবানকে কন্যাদান করে চোখের জল মুছতে মুছতে ফিরে এলেন নিজ রাজধানীতে।

রাজকন্যার বেশ খুলে ফেলে তপোবনবাসিনী সাবিত্রী ধরলেন তাপসীর বেশ। বসন-ভূষণ সব বিলিয়ে দিলেন তাপসকন্যা আর তাপসবধূদের মধ্যে। শ্বশুর, শাশুড়ি, আর স্বামীর সেবায় সম্পূর্ণভাবে নিজেকে উৎসর্গ করে দিলেন তিনি। ‘বৎসরকাল পূর্ণ হলেই কালপূর্ণ হবে তাঁর’ —দেবর্ষির এই কথা অনুক্ষণ তাঁর হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বেজে বেজে ফিরতে লাগল নীরব শোকের মূর্চ্ছনার মতো। মনের ভয় তবুও মনেই রইল চাপা। সারাক্ষণ শুধু তাঁর এক চিন্তা— কী করে হবে এ নির্মম বিধিলিপির খন্ডন!

কতটুকু সময় আর একটি বৎসর! দিনের পর দিন গড়িয়ে চলতে চলতে প্রায় পূর্ণ হয়ে এল কালচক্রের আবর্তন। আর তিনটি দিন মোটে বাকি। শ্বশুর-শাশুড়ির অনুমতি নিয়ে ত্রিযামা ব্রত গ্রহণ করলেন সাবিত্রী। তৃতীয় দিনের দিন যথারীতি সমিধ আহরণের জন্যে পিতামাতার অনুমতি নিয়ে বনগমনের উদ্যোগ করলেন সত্যবান। সাবিত্রীর পণ এক মুহূর্তও সেদিন চোখের আড়াল করবেন না তিনি স্বামীকে। তিনিও চাইলেন সঙ্গে যেতে। তাঁর উপবাস-খিন্ন দেহলতার দিকে চেয়ে সস্নেহে তাঁকে নিবৃত্ত করতে চাইলেন সত্যবান। কিন্তু সাবিত্রীর আগ্রহাতিশয্যে তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি তাঁকে স্বামীর সঙ্গে বন-গমনের অনুমতি দিলেন। কী জানি কোথা থেকে আচম্বিতে এসে দেখা দেয় কোন ঘোর বিপদ! তাই স্বামীর একেবারে পাশ ঘেঁষে দুর্গম বনপথে পথ চলতে লাগলেন সাবিত্রী। তাঁর ব্রতশুদ্ধ দেহপ্রভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল বনপথ।

ক্রমে গভীর অরণ্যে এসে উপনীত হলেন দুজনে। সেখানে সাবিত্রীকে নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে, কুঠার হাতে বড়ো একটা গাছে গিয়ে উঠলেন সত্যবান। শুরু হল কাঠ কাটা। নীচে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সাবিত্রী কর্মরত স্বামীর দিকে। হঠাৎ মাথার মধ্যে যন্ত্রণা বোধ হল সত্যবানের। দেখতে দেখতে বেড়ে চলল সে যন্ত্রণা। নিরুপায় হয়ে শেষে অতি কষ্টে গাছ বেয়ে নীচে নেমে পড়লেন তিনি। পা টলছিল তখন সত্যবানের। ছুটে গিয়ে তাঁকে ধরে ফেললেন সাবিত্রী। তারপর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে সত্যবানকে শুইয়ে দিয়ে সযত্নে কোলের পরে টেনে নিলেন তাঁর মাথা। সঙ্গে সঙ্গেই অচৈতন্য হয়ে পড়লেন সত্যবান। নিরুপায়ের মতো আকাশের দিকে চোখ তুলে চাইতে গিয়েই সাবিত্রী দেখেন, সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন স্বয়ং যমরাজ!

‘ভদ্রে! আমি যম,’—সাবিত্রীর মুখে কোনও কথা ফোটবার আগেই বললেন যমরাজ, ‘মরণের অধিপতি আমি। নিয়ে যেতে এসেছি তোমার স্বামীকে। ছেড়ে দাও তাঁকে।’

ব্রতশুদ্ধা সাবিত্রীর আজ যমরাজকেও কোনও ভয় নেই। করজোড়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘ধর্মরাজ! আপনি স্বয়ং এসেছেন আমার স্বামীকে নিয়ে যেতে?’

যমরাজ বললেন, ‘সত্যবানের মতো পবিত্রাত্মাকে আমার দূতেরা স্পর্শ করতে পারে না। তাই আমি নিজেই এসেছি।’

এই বলে যমরাজ সত্যবানের দেহ থেকে অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ তাঁর আত্মাকে বার করে এনে তাকে পাশবদ্ধ করলেন, তারপর চলতে লাগলেন দক্ষিণদিকে।

সাবিত্রীও চলতে লাগলেন তাঁর পিছু পিছু। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে যমরাজ পিছু ফিরে বললেন সাবিত্রীকে, ‘ভদ্রে! গৃহে ফিরে যাও। আমাকে অনুসরণ করে কোনও ফল নেই।’

করজোড়ে নিবেদন করলেন সাবিত্রী, ‘ধর্মরাজ! শাস্ত্রবাক্য এই যে, একত্রে সপ্তপদ গমন করলে পরস্পরের মধ্যে মৈত্রী হয়। আমাকে তাই আপনার মিত্র বলে গণনা করতে হবে। মিত্রবাক্য ধীরভাবে শ্রবণ করা কর্তব্য। সুতরাং আমার কথা শ্রবণ করুন। নারীর কর্তব্য স্বামীর অনুগমন করা। আপনার আর আমার মধ্যে যখন মৈত্রী ঘটেছে তখন আপনার পক্ষে আমাকে আমার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হবার উপদেশ দান করা ধর্মসংগত কাজ হবে না।’

সাবিত্রীর কথায় পরম প্রীতিলাভ করে যম বললেন, ‘মা, তোমার মতো ধর্মজ্ঞান মরজগতে সুদুর্লভ। তোমার কথায় আমি পরম প্রীতিলাভ করেছি। একমাত্র তোমার স্বামী সত্যবানের জীবন ছাড়া আর যে বর তোমার ইচ্ছা তুমি গ্রহণ করতে পারো।’

যমরাজের কথায় কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয়ে সাবিত্রী বললেন, ‘আমার শ্বশুর ঠাকুর বৃদ্ধ বয়সে অন্ধ হয়ে বড়োই কষ্টে কালযাপন করছেন। আপনি যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাকেন তবে এই বর দিন যে, তিনি যেন তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরে পান।’

‘তথাস্তু’ বলে যমরাজ আবার দক্ষিণদিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। কিছুদূর গিয়েই পিছন ফিরে তিনি দেখেন সাবিত্রী তাঁর অনুসরণ করছেন। তাঁর দিকে চেয়ে তিনি তখন বললেন, ‘তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছো, মা। এবার ঘরে ফিরে যাও।’

সাবিত্রী বললেন, ‘ভগবান! স্বামী সঙ্গে পথ-পর্যটনে সতী নারীর ক্লান্তি কোথায়? তিনি যেখানে যাচ্ছেন আমিও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই যাচ্ছি। এই তো নারীধর্ম, ধর্মরাজ।’

এ কথায় যমরাজ আরও প্রসন্ন হয়ে বললেন, ‘মা, তোমার স্বামীর জীবন ছাড়া আর যে বর তুমি চাইবে তাই আমি দেব। তুমি বর প্রার্থনা করো।’

সাবিত্রী বললেন, ‘আমার শ্বশুর ঠাকুর বৃদ্ধবয়সে রাজ্যহারা হয়ে বড়োই কষ্টে জীবনযাপন করছেন। তিনি যেন তাঁর হৃতরাজ্য ফিরে পান।’

‘তথাস্তু’ বলে যমরাজ আবার যমপুরীর পথ ধরলেন। কিন্তু সাবিত্রী তাঁর অনুসরণে বিরত হলেন না। যমরাজ তখন সত্যবানের জীবন ছাড়া তাঁকে অন্য যে-কোনও বর প্রার্থনা করতে বললেন। সাবিত্রী বললেন, ‘আমার পিতা অপুত্রক। আপনার বরে তাঁর যেন শতপুত্র লাভ হয়।’

‘তথাস্তু’ বলে যমরাজ আবার যমপুরীর দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই ফিরে দেখেন সাবিত্রী আগের মতোই তাঁর অনুসরণ করে চলেছেন। তিনি সাবিত্রীকে বললেন, ‘মা, এবার গৃহে ফিরে যাও।’

সাবিত্রী বললেন, ‘ধর্মরাজ! শাস্ত্রে বলে স্বামীহীন গৃহ শ্মশানতুল্য। স্বামীই স্ত্রীর গৃহ। আমি সেই স্বামীর সঙ্গে সঙ্গেই চলেছি। আপনি সাক্ষাৎ ধর্ম। আমি সেই ধর্মেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছি। স্বামীসঙ্গ এবং ধর্মসঙ্গ ত্যাগ করে, সাক্ষাৎ ধর্ম আপনি, আমাকে বলছেন স্বামীহীন শ্মশান-গৃহে ফিরে যেতে?’

সাবিত্রীর কথায় প্রসন্ন হয়ে যমরাজ তাঁকে তাঁর স্বামীর জীবন ছাড়া অন্য যে-কোনও বর প্রার্থনা করতে বললেন। করজোড়ে সাবিত্রী তখন নিবেদন করলেন, ‘ধর্মরাজ! আপনার বরে আমার স্বামীর ঔরসে আমি যেন শতপুত্রের জননী হতে পারি।’

‘তথাস্তু’ বলে পুনরায় যমরাজ যমপুরীর পথ ধরলেন। তবুও সাবিত্রী তাঁর সঙ্গ পরিত্যাগ করলেন না। কিছুদূর গিয়ে যমরাজ তাঁর দিকে ফিরে বললেন, ‘আর কেন আমায় অনুসরণ করছ, মা? এবার গৃহে ফিরে যাও স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা কর গে।’

করজোড়ে সাবিত্রী বললেন, ‘সে কী কথা, ধর্মরাজ। আপনাতেও কি মিথ্যা সম্ভবে? আমার স্বামীর জীবন ভিক্ষা না দিলে কী করে তাঁর ঔরসে আমার গর্ভে শতপুত্র জন্মগ্রহণ করবে, ধর্মরাজ?

তাই তো! সাবিত্রীর কথায় যেন চমকে উঠলেন যমরাজ নিজেই। ধর্মের স্খলন কি কখনও সম্ভবপর! ‘তবে তাই হোক!’—বলে যমরাজ সত্যবানের আত্মাকে পাশমুক্ত করে দিয়ে বললেন, ‘মা, এই আমি তোমায় তোমার স্বামীকে ফিরিয়ে দিলুম। তোমার সতীধর্মের তেজঃপ্রভাবে আজ সাক্ষাৎ ধর্মও তোমার কাছে পরাভূত। আমার বরে তোমরা দুজনে চারশো বছর পরমায়ু লাভ করে সুখে শান্তিতে তোমাদের মর্ত্যলোকের জীবনযাত্রা নির্বাহ করবে। এবার গৃহে ফিরে যাও, মা।’

এই বলে প্রফুল্লচিত্তে যমরাজ অন্তর্ধান করলেন। সাবিত্রী ত্বরিতপদে ফিরে চললেন যেখানে গভীর বনের মধ্যে পড়ে ছিল সত্যবানের শবদেহ। সেখানে এসেই সযত্নে আবার তিনি কোলের পরে টেনে নিয়ে বসলেন সত্যবানের মাথা। অল্পক্ষণের মধ্যেই সত্যবানের জ্ঞান ফিরে এল। চোখ মেলে তিনি চেয়ে দেখেন—নিশীথ রাতের অন্ধকারে আবৃত হয়ে পড়েছে বনস্থলী। তারই মধ্যে অপলক বিদ্যুৎশিখার মতো তাঁর শিয়রে জেগে রয়েছেন উপবাস-খিন্না সতী সাবিত্রী।

‘উঃ কী ঘুম ঘুমিয়েছি আমি!’—অস্ফুষ্ট স্বরে বললেন সত্যবান; ‘জাগাওনি কেন আমায়? অন্ধকার হয়ে গেছে কখন চারধার।’ অন্ধকারের কথার সঙ্গে সঙ্গে কী যেন মনে পড়ল তাঁর; দুর্বল দেহে খেলে গেল আতঙ্কের শিহরণ; বলতে লাগলেন তিনি মুখ ফুটে, ‘উঃ, কী এক দুঃস্বপ্ন দেখছিলুম এতক্ষণ! কে এক আদিত্যবর্ণ শ্যামকান্ত মহাপুরুষ, পরিধানে তাঁর রক্ত পট্টবসন, কর্ণে কুন্ডল, বাহুতে বলয় ও অঙ্গদ, মস্তকে মণিমন্ডিত স্বর্ণমুকুট, হস্তে পাশ, আমায় বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি দক্ষিণ দিকে। আর তুমি, মণিহারা ফণীর মতো চলেছ তাঁর পিছু-পিছু। সত্যি? না, শুধু স্বপ্ন? বলো তো আমায় ঠিক করে। কে তিনি মহাপুরুষ?’

‘তিনি আমাদের পরম বন্ধু’—বলে তাঁর উদ্দেশ্যে করজোড়ে প্রণতি জানালেন সাবিত্রী। তারপর স্বামীর দিকে চেয়ে বললেন, ‘অনেক রাত হয়ে গেছে, প্রিয়তম। কী জানি কত কী ভেবে ভেবে সারা হচ্ছেন সবাই তপোবনে। এসো আমার কাঁধে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে চলো গৃহপানে কাল প্রত্যুষে সব কথা খুলে বলব তোমায়।’

সংক্ষেপে এই হল সাবিত্রী ব্রতকথা। বলা বাহুল্য ধর্মরাজ যমের সব কটি বরই অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়ে উঠেছিল।

জ্যৈষ্ঠ মাসে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে উপবাস করে যে নারী বটবৃক্ষমূলে সাবিত্রীর পুজো করে, সে কখনও বিধবা হয় না।

এই পুজোয় পাঁচ রঙের গুঁড়ো (পঞ্চবর্ণ গুঁড়িকা) দিয়ে মন্ডল এঁকে, তার মধ্যে ঘট স্থাপন করতে হয়। তাছাড়া পুঁততে হয় বটগাছের ডাল; তাতে থাকা চাই পাতা।

এসব ছাড়া সাবিত্রী চতুর্দশী ব্রতপালনে আরও অনেক রকমের আয়োজন দরকার। সেজন্যে পুরোহিত ডেকে সব বিধিব্যবস্থা করতে হয়।

পুজো শেষ হলে পর সতী-শিরোমণি সাবিত্রীকে স্মরণ করে এই স্বস্তিবাচন উচ্চারণ করতে হয়:

এ তিন ভুবনে তুমি সতী পতিব্রতা।
পবিত্র হইবে লোক শুনি তব কথা।।
বিশেষ করিলে ব্রত চতুর্দশী দিনে।
পাইলে এ চারি বর তাহার কারণে।।

সাবিত্রী চতুর্দশী ব্রতকথা সমাপ্ত।


© 2024 পুরনো বই