এক ব্রাহ্মণ, ছেলে ও বউ নিয়ে ঘর করেন, তাঁর স্ত্রী নেই। একদিন তাঁর মাংস খেতে সাধ হল। তিনি খানিকটা হরিণ-মাংস এনে বউকে বললেন, ‘বউমা, আজ হরিণের মাংস এনেছি, বেশ ভালো করে রাঁধো।’ বউ মাংস রাঁধতে বসল। তারপর মাংস রান্না হলে বউ ঝিকে বললেন—‘ঝি! দ্যাখদেখি মাংসে নুন ঠিক হয়েছে কি না।’ মাংস খেয়ে ঝি বললে, ‘উঃ, যে গরম দিয়েছ, এর কিছুই স্বাদ পেলাম না, —আর একটু দাও দেখি।’ বউ আর একটু দিলে। সেবার মাংস খেয়ে ঝি বললে, ‘কীরকম কীরকম লাগছে, কিছু ঠিক করতে পারছি না।’ ঝি কোনো দিন মাংস খায়নি, তার বড়ো লোভ হল; সে বার বার মাংস চেয়ে খেতে লাগল। এমনি করে চাকতে চাকতে প্রায় সব মাংস খেয়ে ফেললে। তখন বউ বললে, ‘ঝি, তুই সর্বনাশ করলি! আমি এখন মাংস কোথায় পাই?’ ঝি বললে, ‘তাই তো, কী হবে! দেখি, যদি বাজারে মাংস পাই’—এই বলে ঝি মাংস আনতে গেল। ঝি কোথাও মাংস পেলে না। শেষে, রাস্তায় একটা মরা বাছুর পড়ে ছিল, তারই খানিকটা মাংস লুকিয়ে কেটে নিয়ে বাড়িতে এল।
বউ তাড়াতাড়ি করে সেই মাংস রাঁধতে লাগল। অনেকক্ষণ ধরে সিদ্ধ করলে, তবুও মাংস সিদ্ধ হল না। তখন বউ বললে, ‘ঝি, তুই কী মাংস আনলি? এখনও যে সিদ্ধ হল না। এখনি সব খেতে বসবেন, আমি কোথা থেকে মাংস দোব?’ খানিক পরে তার শ্বশুর এসে বললেন, ‘বউমা, রান্নার কতদূর, বড়ো বেলা হয়েছে।’ বউ-এর তো মুখ শুকিয়ে গেল। তখন বউ ঝিকে বললে, ‘ঝি! তুই ঠিক করে বল, এ কীসের মাংস এনেছিস? ঝি বললে, ‘আমি জানি না বাপু, যেন কী রকম সন্দেহ হচ্ছে! তা নইলে এখনও মাংস সিদ্ধ হচ্ছে না কেন?’ বউ বলে, ‘সর্বনাশ করেছিস! সন্দেহ হচ্ছে কীরে! এখন এ মাংস কী রকম করে ব্রাহ্মণের পাতে দিই; এ কিছুতেই সিদ্ধ হল না, এখন উপায়!’ ঝি বললে, ‘তাই তো বউঠাকরুণ, কী হবে!’ দুজনে গালে হাত দিয়ে বসে ভাবতে লাগল। শেষে বউ একটা মতলব ঠাউরে বললে, ‘দ্যাখ ঝি, তুই চারিদিকে জল ঢেলে পিছল করে রাখ, আমি যেমনি পরিবেশন করতে যাব, অমনি পা পিছলে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাব। তখনই তুই রান্নাঘরে ঢুকে জল এনে আমার মুখে চোখে দিবি। তাহলেই সব ভাত-ব্যঞ্জন নষ্ট হয়ে যাবে।’
এই ঠিক করে, শ্বশুর খেতে বসলে পর, বউ থালা করে ভাত-ব্যঞ্জন নিয়ে আসতে আসতে, পা পিছলে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। অন্ন-ব্যঞ্জন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ঝি তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘরে ঢুকে জল এনে বউয়ের চোখে-মুখে দিতে লাগল। তারপর অনেক কষ্টে বউয়ের জ্ঞান হল শ্বশুরের আর খাওয়া হল না; কোনো রকমে জাত রক্ষা হল। বউ তখন কীসের মাংস ঝি এনেছিল খোঁজ করতে স্বামীকে পাঠালে। তখন খোঁজ-খবর করাতে ঝিয়ের মরা বাছুর কাটার কথা প্রকাশ হয়ে পড়ল। সে দিন ষষ্ঠী, বউ মূলো, কলা ও পান দিয়ে মা ষষ্ঠীর পুজো করে মরা বাছুরের উপর ফুল জল ছড়িয়ে দিলে। তখনি মরা গোরু বেঁচে উঠল। সকলে অবাক হয়ে গেল, চারিদিকে ধন্যি ধন্যি পড়ে গেল। বউ তখন শ্বশুরের কাছে আগাগোড়া সব ঘটনা বললে। শ্বশুর শুনে বললেন, ‘আহা বউমা আমার স্বয়ং লক্ষ্মী ঠাকরুণ।’ ষষ্ঠী ঠাকরুণের উপর তাঁর খুব ভক্তি হল। তিনি খুব ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করে তাঁর মাহাত্ম্য প্রচার করলেন। বউয়ের বাছুর বাঁচানোর কথা চারিদিকে আন্দোলন হতে লাগল। তখন তিনি বললেন, ‘অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন মাছ-মাংস খেলে গোমাংস খাওয়ার পাপ হবে। সে দিন মা ষষ্ঠীর পুজো করে মাংসের বদলে মুলোর ব্যঞ্জন দিয়ে রুটি খাবে। এর নাম থাকল মুলা ষষ্ঠী।’ সেই অবধি অগ্রহায়ণ মাসে মুলা ষষ্ঠী প্রচার হল।
মুলা ষষ্ঠীর কথা সমাপ্ত।