এক দেশে এক সওদাগর ছিলেন। তাঁর প্রথম স্ত্রী, অতি সুন্দর দুটি ছেলে-মেয়ে রেখে মারা যান। কিছুদিন পরে সওদাগর আবার দ্বিতীয় সংসার করলেন। তাঁর গর্ভেও একটি মেয়ে আর একটি ছেলে হল। মা-মরা ছেলে-মেয়ে দুটিকে সওদাগর বড়ো ভালোবাসতেন। পাড়াপড়শিরাও সুন্দর চাঁদের মতন ছেলে-মেয়ে দুটিকে দেখতে পেলেই কোলে তুলে নিত। দেখে দেখে নূতন বউয়ের বড়োই অসহ্য হতে লাগল। ‘হা কপাল, পোড়াকপালির পেটে জন্মেছে বলে আমার বাছাদের কেউ দেখতে পারে না। আমার ছেলেরাই বা কার পাতে বিষ গুলে দিয়েছে! যাইহোক, আমি এর প্রতিশোধ নিতে ছাড়বো না।’ একদিন গিন্নি সওদাগরকে বললেন, ‘ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঘরে বসে থাকলে তো আর পেট ভরবে না। বাণিজ্য করতে যাও না। ছেলে-মেয়ে বুকে করে পড়ে থাকলে কী হবে?’ তাই শুনে সওদাগরের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল।
ছেলে-মেয়ে দুটিকে কৈকেয়ীর হাতে সঁপে দিয়ে কেমন করে যান। গৃহিণীর সদব্যবহারের কথা সওদাগরের কিছু জানতে বাকি ছিল না। কী করেন, না গেলেও তো নয়। কাজে কাজেই যাওয়াই স্থির করলেন। ময়রাকে, গয়লাকে চুপি চুপি বললেন, ‘ভাই, আমার বড়ো ছেলে আর মেয়েকে তোমরা খেতে দিও, আমি এসে তোমাদের সবঋণ পরিশোধ করব। আর আগেও তোমাদের কিছু দিয়ে যাচ্ছি।’ সওদাগর ছেলে-মেয়ে দুটিকে কোলে করে চোখের জল চোখে মেরে, নানা কথায় ভুলিয়ে রেখে, কোল থেকে নামিয়ে দিলেন। তারপর মা মঙ্গলচন্ডীর নাম স্মরণ করে নৌকায় চড়ে বিদেশে যাত্রা করলেন।
এদিকে সওদাগর-গিন্নি অমনি রাখাল ছাড়িয়ে দিলেন। বড়ো ছেলে-মেয়ে দুটি সকাল হলে ছাগল-গোরু নিয়ে মাঠে চরাতে যায়; আর বেলা তৃতীয় প্রহরের সময়ে একে একে এসে দুই ভাই-বোনে দুটি পাতের-নাতের খেয়ে আবার মাঠে যায়। তাদের তাতেও কোনো কষ্ট নেই। ছেলে-মেয়ে দুটি দিন দিন যেন শুক্লপক্ষের চাঁদের মতো বাড়তে লাগল। সৎমা ভাবলেন, ‘তাই তো, এত দুধ, ঘি, সর খেয়েও আমার বাছারা দিন দিন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে, আর ওই সতীনের কাঁটা দুটো দিন দিন দস্যি হয়ে উঠছে।’ তিনি একদিন নিজের ছেলে-মেয়েকে গোয়েন্দা করে, তাদের সঙ্গে মাঠে পাঠিয়ে দিলেন। সেদিন তৃতীয় প্রহরেও তারা ঘরে ফিরল না দেখে গিন্নির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ‘হায় হায়! কেন তাদের সঙ্গে বাছাদের পাঠালাম! তাদের সব সয়, না খেয়েও তারা সাত দিন কাটাতে পারে; তা বলে আমার সোনার বাছারা এত কষ্ট সইতে পারবে কেন? আহা! তাদের না-জানি কতই কষ্ট হচ্ছে। মুখখানি শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। আর তাদের কখনও ওই লক্ষ্মীছাড়াদের সঙ্গে যেতে দেব না।’ দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হল, চার ভাই-বোনে গোরু-ছাগল নিয়ে বাড়ি এল। গিন্নি দু-কোলে দুই ছেলে মেয়ে তুলে নিলেন, আর বড়ো ছেলে-মেয়েকে যৎপরোনাস্তি গালাগালি দিতে লাগলেন। ছোটো ছেলে-মেয়ে বললে, ‘মা! দাদা-দিদিকে গালাগালি দিচ্ছ কেন? ওরা আমাদের কত ভালোবাসে। আজ ওদের সঙ্গে গিয়ে গয়লাবাড়িতে কত দুধ-ক্ষীর খেয়েছি, ময়রাবাড়ির কত কী ভালো ভালো খাবার খেয়েছি। আমরা তার নাম পর্যন্ত জানি না। আর ওপাড়ার সঙ্গীদের বাড়িতে কী একটা নূতন জিনিস খেয়েছি মা! সে জিনিস আমরা কখনো দেখিনি। দাদা-দিদি বলে আমরা ওই রকম খাবার রোজ রোজ খাই।’ মা শুনে অবাক হলেন; ‘হায়! হায়! তাই হতভাগারা দিন দিন এত রাক্ষসমূর্তি হচ্ছে!’ গিন্নি সেই দিনই গয়লাকে, ময়রাকে ডেকে বললেন, ‘দেখো, তোমরা যে আমার ছেলে-মেয়েদের খাবার দাও, তাতে আমি অসুখি নই। বোধ হয় কর্তা তোমাদের ওসব দিতে বলে গেছেন; কিন্তু এখনকার কথা তোমরা জানো না! আজ আমি চিঠি পেয়েছি—সেখানে তাঁর ভয়ানক অসুখ হয়েছে। লিখেছেন—যদি এযাত্রা বাঁচি তো পুনর্জন্ম। আবার পথে তাঁর দুখানা বাণিজ্যতরী ডুবে গিয়েছে। তোমাদের আর কী বলব, আমরা এখন অকূল সমুদ্রে ভাসছি। তোমরা আর আমার ছেলে মেয়েদের ধারে খাবার দিও না। আর যা দিয়েছ তার জন্যেও আমি দায়ী নই।’ সেই দিন থেকে ছেলে মেয়েদের দুধ খাওয়া বন্ধ হল। গিন্নী পাড়ায় পাড়ায় বললেন, ‘দেখো, তোমরা আমার ছেলেদের যা তা খাইও না। আমার বাছাদের অসুখ করে।’ কাজে কাজেই ছেলে মেয়ে দুটির ভালো ভালো খাওয়া চারিদিক হতে বন্ধ হয়ে গেল। আর খেতে পায় না, একবেলা দুটি মুড়ি, একবেলা দুটি শাকভাত খেয়ে, ছেলে-মেয়ে দুটি শুকিয়ে যেতে লাগল।
একদিন দুটি ভাই বোনে গোরু চরাতে গিয়ে ক্ষুধায় আকুল হয়ে একটা গাছতলায় শুয়ে পড়ল, আর তাদের গোরু ছাগলগুলি কোন দিকে চলে গেল। সন্ধ্যার সময় উঠে দেখে গোরু, ছাগল মাঠে নেই। দুটি ভাই বোনে কেঁদে কেঁদে খুঁজে বেড়াতে লাগল, কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। তখন একজনদের বাড়ির কানাচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা কাঁদতে লাগল। সে দিন অঘ্রাণ মাসের রবিবার। তাদের বাড়ির গিন্নিরা, ছেলে-মেয়ে নিয়ে নাটাই ব্রত করাবেন, এমন সময়ে ছেলে-মেয়ে দুটি তাদের বাড়ির ভেতর গিয়ে কাঁদতে লাগল। তখন সেই গৃহস্থেরা সকলে তাদের যত্ন করে, কাছে ডেকে সমস্ত কথা জিজ্ঞেস করে সব জানতে পারলেন। তারপর তাদের বললেন, ‘তোমাদের কোনো ভয় নেই। এই ছেলেদের সঙ্গে নাটাই ব্রত করো, সকল দুঃখ দূর হবে।’ সকলে কিছু কিছু করে দিয়ে তাদের জন্য আলাদা চাপাটি তৈরি করে দুটি ভাই বোনকে ব্রত করালেন। তারপর তাদের বললেন, ‘তোমরা নাটাই দেবীর কাছে বর মেগে নাও।’ তারা বললে, ‘হে মা নাটাই ঠাকরুণ! আমাদের যেন গোরু ছাগল পাওয়া যায়। তা না হলে আমরা ঘরে ফিরে যেতে পারব না।’ সকলে হাসতে লাগল, বললে, ‘ও কি বর মাগা হচ্ছে খ্যাপা ছেলে! বলো আমাদের বাবা সাত ডিঙি ধন নিয়ে গিয়েছেন, চৌদ্দ ডিঙি নিয়ে আমাদের হিরের বালা, মুক্তার মালা, টুকটুকে বউ জামাই নিয়ে, শীঘ্র বাড়ি আসুন, আমাদের দুঃখ দূর হোক।’ তখন তারা তাই বললে। পুজোর পর কিছু কিছু প্রসাদ খেয়ে রাত্রে তাদের বাড়িতে শুয়ে রইল। সকলে প্রাণভরে আশীর্বাদ করতে লাগলেন। বললেন, ‘কাল তোমাদের সুপ্রভাত হবে। নাটাই দেবী নিশ্চয়ই তোমাদের কৃপা করবেন।’ তার পরদিন সকালে গিন্নি বললেন, ‘কাল তোমাদের ভালো খাওয়া হয়নি, সকাল সকাল ভাত রেঁধে দি, খেয়ে এখানে দুদিন থাক।’ তাঁদের যত্নে ছেলে-মেয়ে দুটি সেইখানেই রইল।
ওদিকে সওদাগর চৌদ্দ ডিঙি ধন, হিরের বালা, মুক্তার মালা, রাঙা বউ, সুন্দর বর নিয়ে ঘরে ফিরে আসছেন। কতক্ষণে ছেলেমেয়ে চারটিকে দেখবেন। আকুল প্রাণে এদিক ওদিক চাইছেন। বাড়িতে আসবামাত্র গিন্নি চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন, ‘ওগো আমার সোনার চাঁদদের হারিয়েছি গো! আমার মরণ কেন হল না গো!’ সওদাগর খানিক চুপ করে বসে থেকে গিন্নিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘আর কাঁদলে কী হবে, আমার যেমন কপাল, আমি কোথায় তাদের বিয়ে দেব বলে সুন্দর বর, সুন্দর বউ আনলাম, না কোথায় এই সর্বনাশের কথা শুনতে হল! তাদের কি অসুখ হয়েছিল?’ গিন্নি কী উত্তর দেবেন ঠিক করতে না পেরে অনবরত কাঁদতে লাগলেন। মেয়েটি বাপের কোলে বসে বলতে লাগল, ‘বাবা, দাদা দিদি গোরু চরাতে গিয়েছিল, তাদের বাঘে খেয়ে ফেলেছে।’ (গৃহিণী ছেলে মেয়ে না পাওয়াতে এরূপ গুজব রটিয়েছিলেন।) সওদাগর মেয়েটিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। নৌকার লোকেরা ধন দৌলৎ সব বয়ে এনে বড়িতে দিয়ে গেল। দেখতে দেখতে রাত হল। সওদাগর বাড়ি ফিরলেন না। গিন্নী ভাবলেন, ‘ভাগ্যে কী আছে, এই বেলা কিছু ধনরত্ন নিয়ে ওই বনের ধারে পুঁতে রেখে আসি।’ গিন্নি কোদাল নিয়ে গর্ত করলেন, তারপর ঝোড়ায় করে সোনা, রুপা, টাকা এনে সেই গর্তে ফেলে রাখলেন। সেখানে একটা পাতকূয়া ছিল, বার বার আসা-যাওয়াতে গিন্নি পা পিছলে সেই পাতকূয়ার ভেতর পড়ে গেলেন, আর উঠতে পারলেন না। সেইখানে তাঁর মৃত্যু হল। ওদিকে সওদাগর হাটে-মাঠে, পথে-ঘাটে ছেলেদের নাম করে কেঁদে কেঁদে বেড়াতে লাগলেন। এমনি করে করে তিন দিন কেটে গেল। তখন দেখতে পেলেন অনেক দূরে গোরু বাছুর, ছাগল নিয়ে ছেলে-মেয়ে দুটি গান গাইতে গাইতে বাড়ি আসছে। সওদাগর ছুটে গিয়ে ছেলেমেয়ে দুটিকে কোলে তুলে নিলেন। তাদের মুখে সব কথা শুনলেন। রাগে তার গা ফুলতে লাগল। তিনি তাড়াতাড়ি গাই-বাছুর, ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে আসতে লাগলেন। তখন বেলা আড়াই প্রহর। বাড়ির কাছে এসে দেখেন, বনের ধারে অনেক লোক জমা হয়েছে! তাঁর ছোটো ছেলে মেয়ে মা মা বলে চিৎকার করে কাঁদছে। তিনি কাছে এসে সমস্ত জানতে পারলেন। তখন ছোটো ছেলে মেয়ে দুটিকে সান্ত্বনা দিয়ে বাড়িতে আনলেন। কিছুদিন পরে বড়ো ছেলে-মেয়ে দুটির বিয়ে দিলেন। সে গৃহস্থ হতে তিনি ছেলে মেয়ে পেয়েছেন, তাদের অনেক ধন-দৌলত দিলেন। সওদাগর নাটাইচন্ডীর মাহাত্ম্য দেখে আশ্চর্য হলেন। তিনি বৌকে ও মেয়েকে এই ব্রত করালেন। পাড়ায় সকলেই নাটাইব্রত আরম্ভ করলে। ক্রমে দেশ-বিদেশে এই কথা রাষ্ট্র হল। এই রকমে নাটাইচন্ডী ব্রত পৃথিবীতে প্রচার হল।
নাটাইচন্ডীর ব্রতকথা সমাপ্ত।