এক দেশে এক রাজা ছিলেন, তাঁর পাঁচ মেয়ে। রাজা একদিন রানি, দাস-দাসী ও মেয়েদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কার ভাগ্যে খাও? রাজার মন রাখবার জন্যে সকলেই বললে আমরা মহারাজের ভাগ্যে খাই। কেবল তাঁর ছোটোমেয়ে বললে, মানুষ উপলক্ষ মাত্র, মা লক্ষ্মী সকলকে খাওয়া-পরা দেন। মানুষ নিজের ভাগ্যেই খায়। রাজা ছোটোমেয়ের কথা শুনে ভারি রেগে গেলেন; বললেন, ‘তোর এত বড়ো স্পর্ধা! তুই আমার মুখের সামনে বললি আমি নিজের ভাগ্যে খাই! ভালো আমিও দেখব তুই কেমন করে নিজের ভাগ্যে খাস। আমি প্রতিজ্ঞা করলুম, কাল সকালে যার মুখ দেখব, তারই সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। দেখব তোর লক্ষ্মীই বা কেমন! আর তোর কপালই বা কেমন!’ রানি, রাজার এই কথা শুনে নগরের সকলকে সকালে উঠতে, হাটবাজার দোকান খুলতে বারণ করে পাঠালেন।
এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ, রাজার প্রতিজ্ঞার কথা শুনে ভাবলেন, ‘রাজা যদিও মেয়ের উপর রেগেছেন, তা বলে একেবারে যে তাড়িয়ে দেবেন, তা হতে পারে না। অন্তত যৌতুক-স্বরূপ কিছু ধন জামাইকে দেবেন।’ ব্রাহ্মণ তাঁর ছেলেটিকে সঙ্গে করে ভোরবেলা রাজবাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন। ব্রাহ্মণ নিজে একটু দূরে লুকিয়ে রইলেন। রাজা সকালে উঠে ব্রাহ্মণপুত্রকে দেখে, জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি এখানে কেন? কী চাও?’ তখন ব্রাহ্মণ ছুটে এসে বললেন, ‘মহারাজ! আপনি যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, প্রথমে যাকে দেখবেন তাকেই কন্যা দান করবেন; এটি আমার ছেলে, আপনি আগে এর মুখ দেখেছেন।’ রাজা নিজের প্রতিজ্ঞা স্মরণ করে ছোটোমেয়েটিকে যৎকিঞ্চিৎ যৌতুক দিয়ে ব্রাহ্মণপুত্রকে দান করলেন। রাজা মেয়েকে এই কথাটি বললেন, ‘যাও বাছা, এত দিন আমার ভাগ্যে খাচ্ছিলে, এখন নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করো।’ রাজকন্যা বাপের এই কথা শুনে কিছু না-বলে প্রণাম করে বিদায় গ্রহণ করলেন। রাজকন্যা স্বামী ও শ্বশুরের পেছনে পেছনে গিয়ে অনেক দূরে অন্য রাজার দেশে বনের মধ্যে একটি কুঁড়েঘরে গেলেন। শাশুড়ি বরণ করে বউকে ঘরে তুললেন। রাজকন্যা হাসিমুখে ওই কুঁড়েঘর, ছড়া ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে রইলেন। রাজকন্যা শ্বশুর, শাশুড়ি ও স্বামীকে খুব ভক্তি করেন; দুঃখেকষ্টে দিন কাটান, তাঁদের খাওয়া হলে পাতে যা কিছু থাকে তাই আপনি খান।
একদিন রাজকন্যা শ্বশুর ও স্বামীকে বললেন, ‘দেখুন আপনারা শুধু হাতে ঘরে আসবেন না। সামনে যা দেখতে পাবেন তাই নিয়ে আসবেন। রাস্তায় একটি কুটি পেলেও যত্ন করে নিয়ে আসবেন।’ তাঁরাও বউটির কথামতো যেদিন যা পান ঘরে নিয়ে আসেন। একদিন তাঁর স্বামী একটা মরা কেউটেসাপ এনে রাজকন্যাকে বললেন, ‘এই দেখো কি এনেচি?’ বউ বললেন, ‘তা বেশ করেছ, ওই মাচার উপর ফেলে রাখো।’ কিছুদিন পরে সেই দেশের রাজার ছেলের বড়ো ব্যারাম হল। কত ডাক্তার কবিরাজ এল, কেউ ভালো করতে পারলে না। একজন ভালো কবিরাজ এসে বললেন, ‘আমি এখনই এই ছেলেকে ভালো করতে পারি, কিন্তু একটি মরা কেউটেসাপের মাথা চাই।’ রাজা ভাবলেন মরা কেউটেসাপের মাথা আর কোথায় পাব যে, আমার ছেলে প্রাণ পাবে! মন্ত্রী তখন ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলেন—‘যে একটা মরা কেউটেসাপের মাথা দিতে পারবে, সে যা চাইবে তাকে তাই দেওয়া হবে।’ তখন রাজকন্যা তাড়াতাড়ি শ্বশুরকে বললেন, ‘বাবা, ঢেঁড়া ধরুন, আমি কেউটেসাপের মাথা দেব।’ শ্বশুর ঢেঁড়া ধরলেন, বউ অমনি সেই কেউটেসাপটা এনে দিলেন। তারা সাপটা নিয়ে চলে গেল। কবিরাজ ওষুধ খাওয়ালেন, রাজার ছেলে ভালো হল।
কিছুদিন পরে রাজা ব্রাহ্মণকে ডেকে পাঠালেন। বউ বলে দিলেন, ‘বাবা, রাজা যদি কিছু দেন আপনি নেবেন না। মা লক্ষ্মী না-দিলে সে ধন থাকবে না। আপনি এই কথা বলবেন—‘আমি কিছুই চাই না, কেবল কার্তিক মাসের অমাবস্যার রাতে রাজবাড়িতে বা কোনো প্রজার বাড়িতে কেউ আলো জ্বালতে পারবে না।’ ব্রাহ্মণ রাজবাড়িতে গিয়ে একথা বলতে রাজা ঢেঁড়া পিটে দিলেন, ‘কার্তিক মাসে অমাবস্যার রাতে আমার রাজ্যে কেউ আলো জ্বালতে পারবে না।’ কার্তিক মাস অমাবস্যা, লক্ষ্মীপূজা, কারো বাড়িতে একটিও আলো নাই। ব্রাহ্মণের বউটি ঘরটি বেশ পরিষ্কার করে আলপনা দিয়ে, চৌকি পেতে, ঘট বসিয়ে, নৈবেদ্য করে, ফুল, চন্দন, ফুলের মালা, সব আয়োজন করে, সমস্ত দিন উপবাস করে, চারিদিকে আলো জ্বেলে মা লক্ষ্মীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
মা লক্ষ্মী প্যাঁচার পিঠে চড়ে রাজ্যের চারদিকে ঘুরে বেড়ালেন, কোথাও আলো দেখতে না-পেয়ে সে রাজ্য থেকে অন্তর্ধান হলেন। প্যাঁচা বনের ভিতর আলো দেখতে পেয়ে সেই কুঁড়েঘরে মা লক্ষ্মীকে নিয়ে গেল। লক্ষ্মী আসতেই রাজকন্যা জোড়হাত করে, ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলেন। লক্ষ্মী বললেন, ‘কী আশ্চর্য! পৃথিবীতে আজ আমার পূজা হয়, কিন্তু আজ যেখানে যাচ্ছি সেখানেই দেখছি অন্ধকার। তাই তোমার এখানে আলো দেখতে পেয়ে এসেছি।’ রাজকন্যা লক্ষ্মীকে ঘরে নিয়ে গিয়ে চৌকিতে বসিয়ে ভক্তিভরে পূজা করলেন। বললেন, ‘মাগো! কী দিয়ে আপনার পূজা করব মা, আমরা বড়ো গরিব, এই সামান্য আয়োজনে সন্তুষ্ট হন।’ মা লক্ষ্মী খুশি হয়ে বললেন, ‘আর তোমাদের কোনো কষ্ট থাকবে না। আমার পায়ের নূপুর রেখে যাব। ভাদ্র মাসে, কার্তিক মাসে, পৌষ মাসে, চৈত্র মাসে এমনি করে আমার পূজা করো। কখনও ঝন ঝন খন খন করো না, নখে কুটো ছিঁড়ো না, নেই নেই করো না, শুদ্ধ আচারে থাকবে,’ এই বলে মা লক্ষ্মী চলে গেলেন। লক্ষ্মীর কৃপায় তাঁদের কুঁড়েঘরের বদলে রাজার মতন বাড়ি হল, হাতিশালে হাতি হল, ঘোড়াশালে ঘোড়া হল, অতুলঐশ্বর্য হল! রাজকন্যা বেশ মনের সুখে ঘরকন্না করতে লাগলেন।
একদিন রাজকন্যা শ্বশুরকে বললেন, ‘দেখুন, এখন আমরা খুব বড়ো মানুষ হয়েছি, সুতরাং দেশের লোককে, গরিব দুঃখীকে কিছু দান করা উচিত। আপনি একটি পুকুর প্রতিষ্ঠা করুন, দেশ-বিদেশের ব্রাহ্মণ-পন্ডিতদের নিমন্ত্রণ করুন।’ রাজকন্যার কথায় ব্রাহ্মণ পুকুর কাটালেন। পুকুর প্রতিষ্ঠার দিন, দেশ-বিদেশ থেকে দলে দলে ব্রাহ্মণ-পন্ডিত, দেশের সকল লোক, ফকির, কাঙাল সব আসতে লাগল। বাড়িতে লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন হল। রাজকন্যা জানালার পাশে বসে লোকজনের খাওয়া-দাওয়া দেখতে লাগলেন। রাজকন্যার বাপ লক্ষ্মীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করায় লক্ষ্মীর কোপে পড়ে রাজ্য-ধন সব হারিয়েছেন। এমনকি নিজের পেটের অন্নের জন্য লোকের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষে করতে লাগলেন। রাজকন্যার দানের কথা শুনে তিনি সেখানে গেলেন।
রাজকন্যা জানালার ভিতর থেকে বাপকে দেখতে পেয়ে চিনতে পারলেন। তখন তিনি শ্বশুরকে বললেন, ‘বাবা, ওই লোকটিকে আমার কাছে ডেকে আনুন।’ শ্বশুর তাঁকে ডেকে রাজকন্যার কাছে নিয়ে এলেন। রাজা আপনার মেয়েকে চিনতে পারলেন না। মেয়ে বাপের পা ধুইয়ে গামছা দিয়ে মুছিয়ে দিলেন। বসতে রূপার পিঁড়ি দিলেন, সোনার গেলাসে জল ও সোনার থালে ভাত দিলেন। রাজা মনে মনে ভাবলেন, ইনি আমায় এত যত্ন করছেন কেন? রাজা একগ্রাস করে ভাত খান, আর এক-একবার রাজকন্যার মুখের দিকে চান। তিনি দেখলেন এঁর মুখটি ঠিক তাঁর ছোটোমেয়ের মতো। তখন তাঁর চক্ষের জলে বুক ভেসে যেতে লাগল। রাজকন্যাও বাপকে কাঁদতে দেখে নিজেও কাঁদতে লাগলেন। শেষে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কাঁদছেন কেন? আপনার দুঃখের কারণ কী?’ রাজা তখন বললেন, ‘মাগো! বলতে বুক ফেটে যায়, আমিও এক সময় রাজা ছিলুম। আমার অন্নে কত লোক প্রতিপালিত হয়েছে; আজ আমি নিজের পেটের অন্নের জন্য পথের কাঙালি। আর ঠিক আপনার মতো আমার একটি মেয়ে ছিল। হায়! আমি তাকে অতিনিষ্ঠুরের মতো এক দরিদ্র ব্রাহ্মণপুত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলাম; এখন সে বেঁচে আছে কিনা কোনো সন্ধান পাইনি। হায়! না-জানি সে কত কষ্ট পেয়ে মরে গেছে।’
তখন রাজকন্যা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘বাবা! আমিই সেই আপনার হতভাগিনী কন্যা; যাকে আপনি নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে বলেছিলেন। এখন দেখুন, মানুষ নিমিত্ত মাত্র, মা লক্ষ্মী সকলকে আহার দেন। যে যার ভাগ্যে খায়।’ রাজা শুনে আরও কেঁদে বললেন, ‘মা! আমাকে আর লজ্জা দিস না। আমার অপরাধ হয়েছে, তখন বুঝতে পারিনি, এখন বেশ বুঝতে পাচ্ছি। আমায় মাপ কর মা, আমি মহাপাপিষ্ঠ। মাগো আজ আমি হারানো ধন পেলুম।’ এই বলে তিনি কাঁদতে লাগলেন। মেয়ে বললেন, ‘বাবা, মা লক্ষ্মী আপনার প্রতি বাম হওয়াতে আপনার এত কষ্ট হয়েছে; আপনি লক্ষ্মীপূজা করুন, আপনার আবার রাজ্য-ধন সব হবে।’ রাজা মেয়ের কাছে বিদেয় নিয়ে বাড়ি গিয়ে রানিকে সব বললেন। তারপর রানি এই কথা শুনে মেয়েকে আনালেন। অনেক দিনের পর মেয়েকে পেয়ে মা কাঁদতে লাগলেন। মায়ে-ঝিয়ে কত দুঃখের সুখের কথা হল। রাজা লক্ষ্মীর পূজা আরম্ভ করলেন। লক্ষ্মীর কৃপায় আবার রাজ্য, ধনদৌলত সব হল। আবার সুখের দিন এল। তারপর তিনি কিছুদিন সুখে রাজত্ব করে, মেয়ে-জামাইকে রাজ্য দিয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। মা লক্ষ্মীর কৃপায় মেয়ে-জামাই সেই দেশের রাজা-রানি হলেন। কিছুদিন রাজত্ব করে তাঁদের স্বর্গে যাবার সময় হলে, তাঁরা তাঁদের ছেলে-মেয়েকে লক্ষ্মীপূজার কথা বলে গেলেন। সেই থেকে পৃথিবীতে লক্ষ্মীপূজা প্রচার হল।
কার্তিক মাসের লক্ষ্মীপূজার কথা সমাপ্ত।