কথামুখ
প্রাচ্যতত্ত্ববিদ যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির উদ্ধৃতি দিয়েই শুরু করি—‘পূজা মাত্রই ব্রত, ব্রত মাত্রেই সংকল্প প্রধান। ব্রতধারণ দ্বারা আত্মার প্রসন্নতা হয়, চিত্তের সংযম অভ্যাস হয়, ইষ্টের প্রতি একাগ্র ভক্তি এবং সমুদয় নর-নারীর প্রতি উদার ভাব জাগ্রত হয়… ব্রত মাত্রেই দেবার্চনা আছে, দেবার্চনা মাত্রই ব্রত’ (বারোমাসে তেরো পার্বণ, বঙ্গদর্পণ, প্রথম, পৃ. ২৩৫ দ্রষ্টব্য)। ঋগবেদে ‘ব্রত’ পদটি কর্ম অর্থে প্রযুক্ত হয়েছে একাধিকবার। হয়তো এর মূলে অভিপ্রায় ছিল, সব ধরনের কর্মই যেন যথাবিধি নিয়ম মেনে অনুষ্ঠিত হয় (ঋগবেদ ২/৮/৩)। পরবর্তীকালে শাস্ত্রবিহিত নিয়ম ও উপবাসাদি লক্ষণান্বিত ধর্মাচরণকেই ব্রত বলা হল (অমরকোষ-টীকা দ্রষ্টব্য)।
বিবিদিষু পাঠক জানতে চাইতে পারেন ‘মেয়েদের ব্রতকথা’ নামকরণ কতদূর সংগত। বিশেষত আধুনিক যুগে মেয়েরা যখন পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে টক্কর দিয়ে ঘরে-বাইরে কর্মরতা এবং সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন তখন এই বিবিদিষা যে একেবারেই ভিত্তিহীন নয়—তা বলাই বাহুল্য। শাস্ত্রে তো স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্রতোদযাপনের কথাই বলা হয়েছে। স্বয়ং অগ্নি তো বশিষ্ঠকে বলেছিলেন লিঙ্গনির্বিশেষে ব্রত বিধেয়।
শাস্ত্রোদিত নিয়মকে ব্রত ও তপস্যা বলে। দমাদি ব্রতেরই বিশেষ বিশেষ নিয়ম। উপবাসাদি দ্বারা কর্তার সন্তাপ হয়—একারণে ব্রতকে তপ বলে এবং সকল ইন্দ্রিয়ের নিয়মন করে বলে ব্রতের নামান্তর নিয়ম। ব্রতানুষ্ঠানে দেবতারা প্রীত হয়ে ভুক্তি, মুক্তি প্রদান করেন। আমরা সহৃদয় পাঠককে মূল অগ্নিপুরাণে নিয়ে যাই, যেখানে অগ্নি-বশিষ্ঠের কথোপকথন সরাসরি উল্লিখিত:
তিথি-বারর্র্ক্ষ্যু-দিবস-মাসত্বব্দার্কসংক্রমে।
নৃ-স্ত্রীব্রতাদি বক্ষ্যামি বশিষ্ঠ শৃণু তৎ ক্রমাৎ
শাস্ত্রোদিতো হি নিয়মো ব্রতং তচ্চ তপো মতম।
নিয়মাস্তু বিশেষাস্তু ব্রতস্যৈব দমাদয়ঃ
ব্রতং হি কতৃসন্তাপাৎ তপ ইত্যভিধীয়তে।
ইন্দ্রিয়গ্রামনিয়মানিয়মশ্চাভিধীয়তে
অনগ্নয়স্তু যে বিপ্রাস্তেষাং শ্রেয়োভিধীয়তে।
ব্রতোপবাসনিয়মৈর্নানাদানস্তথা দ্বিজঃ
তে স্যুর্দেবাদয়ঃ প্রীতা ভুক্তি-মুক্তিপ্রদায়কা:।
(১৭৫তম অধ্যায়, ১-৫ শ্লোক)
সংক্ষেপে ব্রতাচরণ কীর্তি, সন্ততি, বিদ্যা, সৌভাগ্য, আরোগ্য, বৃদ্ধি এবং ভুক্তি ও মুক্তির জন্য সকলেরই অনুষ্ঠেয়। সুতরাং এহেন ব্রতানুষ্ঠান কেবল মেয়েদেরই অনুষ্ঠেয় এই ভাবনা কীভাবে সমাজে বদ্ধমূল হল!
লক্ষ্মণসেনের সভাপণ্ডিত গোবর্ধন আচার্য (দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর আর্যাসপ্তশতীতে বলেছেন মেয়েরা হলেন বাড়ির শ্রী ‘গেহে শ্রীরিব’ (২০১)। আমার মনে হয়, নারীশিক্ষার প্রচলন যখন ছিল না তখনকার দিনে সময় কাটানো এক কঠিন সমস্যা ছিল বললে অত্যুক্তি হয় না। বর্তমান যুগের মায়েরা যেমন সন্তানদের স্কুলে পৌঁছে সেই প্রতিষ্ঠানের সিঁড়িতে বসেই দিনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দেন—অতীতে এরকমটি ছিল না। অথচ ভাববিনিময়ের জন্য, সংসারের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের জন্য অনেক পড়শির একত্রিত হওয়াও নিতান্ত জরুরি। প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ব্রত উদযাপনের মধ্যে দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যেরও বিকাশ হয়। আধুনিক বিজ্ঞানও শরীরের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যকে সমান বা ততোধিক গুরুত্ব দেয়।
নৈতিক আদর্শের গুরুত্বও ব্রতানুষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য। হাতে কাজ না থাকলে ঘুম পাওয়ার প্রসঙ্গ এনে রবীন্দ্রনাথ সহজপাঠেই বুঝিয়েছেন কাজের অপরিহার্যতা। সুচিন্তিত কল্যাণকর বিষয়ে মনকে নিবিষ্ট করতে পারলে মন-পাখি অচঞ্চল ও স্থির হয়। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট কাজ (ব্রত) উদযাপিত হলে এবং যথাসাধ্য আমন্ত্রিত অতিথি-অভ্যাগতের উপস্থিতিতে গৃহপ্রাঙ্গণ মুখরিত হলে যে আনন্দের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়—তাতে মেয়েদের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে থাকে। ‘গৃহিণী গৃহমুচ্যতে’ বা ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ প্রভৃতি ভাবনাও পরিবারের সকলের মঙ্গলকামনায় মেয়েদের এগিয়ে রেখেছে।
একা খেয়ে যেমন আনন্দ নেই, একা থেকেও তেমন আনন্দ নেই। মানুষ মানুষকেই চায়, ব্রতানুষ্ঠান অপরকে পাওয়ার অনুষ্ঠান। বাড়ির কর্তারাও খুশিমনে মেয়েদের ব্যস্ত রাখতে এই ব্যাপারে দ্বিধা করতেন না। মেয়েরাও নির্দিষ্ট ব্রত উদযাপনে ইচ্ছাপূরণের সংকল্পে মেতে থাকতেন বরাবর। মেয়েদের ব্রতাচরণের সবচেয়ে খুশির দিকটা ছেলেবেলায় উপভোগ করতাম—যা কিনা এখনকার শৈশব অনতিক্রান্তরাও অনুভব করে থাকে। যেমন কখন ব্রতপারণ বা ব্রতসমাপ্তি বা ব্রতান্তভোজন হবে সেদিকে মুখিয়ে থাকা। ওই সাবু-নারকেল-দুধ-কলা মিশ্রিত মেনুটি বা দই-চিঁড়ে-ঘৃত-মধু মিশ্রিত মেনুটি কতই-না লোভনীয়! সত্যি কথা বলতে কী এই রেসিপি আজও বাজার মাতিয়ে রেখেছে। শেয়ার বাজারের ওঠাপড়া থাকলেও দশকর্মভান্ডারের বাড়বাড়ন্ত প্রত্যেকেরই নজর কাড়ে।
ব্রতকথা বাংলার লোকসাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যেসব দেবীর গরিমা এখানে বর্ণিত হয়েছে তাঁরা সকলেই পুরাণাদি শাস্ত্রে উল্লিখিত দেবী নন। প্রবাদপ্রতিম লোকসাহিত্যবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য স্মরণ করিয়েছেন, ‘ব্রতকথায় একই দেবতার দুইটি গুণ পরিকল্পিত হয়—অনিষ্ট করিবার শক্তি তাঁহার যেমন আছে, ইষ্ট করিবার শক্তি তাঁহার তেমনই আছে, কোন প্রকার অবহেলা করিলে তিনি যেমন ক্রুদ্ধ হইয়া অনিষ্টসাধন করিয়া থাকেন, আবার তাঁহাকে কোনরকমে প্রসন্ন করিতে পারিলে, তিনি তুষ্ট হইয়া প্রভূত কল্যাণসাধনও করিয়া থাকেন। দেবদেবী সম্পর্কিত এই বিশ্বাসই ব্রতকথার ভিতর দিয়া প্রচার করা হইয়া থাকে…অর্থাৎ দেবতা যখন ইষ্টসাধন করেন, তখন হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, গোয়ালে গোরু, মরাইয়ে ধান ইত্যাদিই বাড়িবে…এবং দেবতা যখন অনিষ্টসাধন করেন, তখন হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, গোয়ালে গোরু মরিবে, মরাইয়ে ধান শূন্য হইবে…অনেক ব্রত কেবলমাত্র ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া ব্যতীত আর কিছুই নহে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, বৈশাখ মাসে যে কয়টি প্রধান ব্রত উদযাপন করা হইয়া থাকে, যেমন—পুণ্যিপুকুরব্রত, অশ্বত্থপাতা ব্রত, পৃথিবী ব্রত ইত্যাদি সব কয়টিই ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া দ্বারা বৃষ্টিপাত করাইয়া ধরিত্রীর শস্যসম্পদ রক্ষা করিবার প্রবৃত্তি হইতে জাত’ (বাংলার লোকসাহিত্য, প্রথম খন্ড, পৃ. ৫০২-৫১২ দ্রষ্টব্য)।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সংকলিত মেয়েদের ব্রতকথা শীর্ষক গ্রন্থে লক্ষ্মী, মঙ্গলচন্ডী, ষষ্ঠী, মনসা প্রভৃতি ভেদে নারীদেবীর প্রসঙ্গ এসেছে। স্বভাবতই এদের উৎসসন্ধানে প্রবৃত্ত হয়ে পুরাণসাহিত্যের দ্বারস্থ হয়েছি (পরবর্তী অনুচ্ছেদে বর্ণিত)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সংকলক কিন্তু সংস্কৃতবর্জিত সহজ গল্পকথার আদলে সমস্ত ব্রতকথা সংকলন করেছেন। কথ্যভাষায় সংকলিত হওয়ায় এবং সংস্কৃত মন্ত্রাদি অনুল্লেখের দরুন এগুলি সাধারণের কাছে সুবোধ্য এবং চিত্তাকর্ষক হয়েছে নি:সন্দেহে। তবে কুলকে কলঙ্করহিত করার দায়িত্ব কেবল মেয়েদের উপর ন্যস্ত করে যে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে—তা নি:সন্দেহে বলা চলে (কুলুই মঙ্গলবারের কথা)।
পাঠক প্রথমেই চলুন সূচিপত্র নির্দেশিত লক্ষ্মীর প্রসঙ্গে। লক্ষ্মীর সম্বন্ধে সাকুল্যে ছ-টি ব্রতকথা সংকলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘লক্ষ্মী, তুমি শ্রী, তুমি সৌন্দর্য, আইস, তুমি আমাদের হৃদয়-কমলাসনে অধিষ্ঠান করো। তুমি যাহার হৃদয়ে বিরাজ কর, তাহার আর দারিদ্র্যভয় নাই; জগতের সর্বত্রই তাহার ঐশ্বর্য। যাহারা লক্ষ্মীছাড়া, তাহারা হৃদয়ের মধ্যে দুর্ভিক্ষ পোষণ করিয়া টাকার থলি ও স্থূল উদর বহন করিয়া বেড়ায়। তাহারা অতিশয় দরিদ্র, তাহারা মরুভূমিতে বাস করে; তাহাদের বাসস্থানে ঘাস জন্মায় না, তরুলতা নাই, বসন্ত আসে না।
তুমি বিষ্ণুর গেহিনী। জগতের সর্বত্র তোমার মাতৃস্নেহ। তুমি এই জগতের শীর্ণ কঠিন কঙ্কাল প্রফুল্ল কোমল সৌন্দর্যের দ্বারা আচ্ছন্ন করিতেছ। তোমার মধুর করুণ বাণীর দ্বারা জগৎপরিবারের বিরোধ বিদ্বেষ দূর করিতেছ। তুমি জননী কিনা, তাই তুমি শাসন, হিংসা, ঈর্ষা দেখিতে পার না। তুমি বিশ্বচরাচরকে তোমার বিকশিত কমলদলের মধ্যে আচ্ছন্ন করিয়া অনুপম সুগন্ধে মগ্ন করিয়া রাখিতে চাও। সেই সুগন্ধ এখনি পাইতেছি; অশ্রুপূর্ণ নেত্রে বলিতেছি, ‘কোথায় গো! সেই রাঙা চরণ দুখানি আমার হৃদয়ের মধ্যে একবার স্থাপন করো, তোমার স্নেহহস্তের কোমল স্পর্শে আমার হৃদয়ের পাষাণ-কঠিনতা দূর করো। তোমার চরণ-রেণুর-সুগন্ধে সুবাসিত হইয়া আমার হৃদয়ের পুষ্পগুলি তোমার জগতে তোমার সুগন্ধ দান করিতে থাকুক!
এই যে তোমার পদ্মবনের গন্ধ কোথা হইতে জগতে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। চরাচর উন্মত্ত হইয়া মধুকরের মতো দল বাঁধিয়া গুন গুন গান করিতে করিতে সুনীল আকাশে চারিদিক হইতে উড়িয়া চলিয়াছে’! (রবীন্দ্ররচনাবলী, পঞ্চদশ খন্ড, পৃ. ৫৬)।
ব্রতপরায়ণার অবগতির জন্য জানানো প্রয়োজন যে, বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মীর ইঙ্গিত বেদ-এ পাওয়া যায়। ঋগবেদ-এ আছে স্ত্রী বা লক্ষ্মী তাঁর দক্ষিণে থাকেন (১/১৫৬/২)। পুরাণাদি শাস্ত্রগ্রন্থে লক্ষ্মীর উল্লেখ বহুবার হয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ জানিয়েছে ব্রত হল বাঞ্ছিত সিদ্ধির বীজ ‘সর্ববাঞ্ছিতসিদ্ধীনাং বীজং জন্মনি জন্মনি’ (গণেশ খন্ড, ৪/৮২)। সেখানে নারায়ণ নারদকে মঙ্গলচন্ডীর উপাখ্যান শুনিয়েছেন। দক্ষা অর্থে চন্ডী এবং কল্যাণ অর্থে মঙ্গল। মঙ্গলকর বস্তুপ্রদানে দক্ষা বলেই ইনি মঙ্গলচন্ডী নামে প্রসিদ্ধা—
দক্ষায়াং বর্ততে চন্ডী কল্যাণেষু চ মঙ্গলম।
মঙ্গলেষু চ যা দক্ষা সা চ মঙ্গলচন্ডিকা
(ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, ৪৪/৩)
মতান্তরে পূজ্যাদের অন্যতমা বলে চন্ডী এবং মহীপুত্র মঙ্গলের আরাধ্যা তাই মঙ্গলচন্ডী। মতান্তরে সপ্তদ্বীপা পৃথিবীর অধীশ্বর মনুষ্যরাজ মঙ্গলের অভীষ্টদায়িনী এবং আরাধ্যা—এজন্য মঙ্গলচন্ডী। কৃপারূপিণী দুর্গাদেবীর মূর্তিভেদ মূলপ্রকৃতি ঈশ্বরী মঙ্গলচন্ডী। শোনা যায়, স্বয়ং মহাদেব ত্রিপুর-বধের জন্য তাঁর পূজা করেছিলেন। মহাদেবের স্তবে দেবী প্রীত হন। যে ব্যক্তি প্রতি মঙ্গলবারে একাগ্রচিত্তে মঙ্গলচন্ডী দেবীর স্তবগাথা শুনে থাকেন তার নিরন্তর মঙ্গল অবশ্যম্ভাবী। প্রথমবার মহাদেব, দ্বিতীয়বার মঙ্গলগ্রহ, তৃতীয়বার মঙ্গলরাজা এবং সর্বোপরি চতুর্থবারে মঙ্গলবারগুলিতে মায়েরা মঙ্গলচন্ডীর পূজা নিরবচ্ছিন্ন ধারায় বজায় রেখেছেন—
প্রথমে পূজিতা দেবী শিবেন সর্বমঙ্গলা।
দ্বিতীয়ে পূজিতা দেবী মঙ্গলেন গ্রহেণ চ
তৃতীয়ে পূজিতা ভদ্রে মঙ্গলেন নৃপেণ চ।
চতুর্থে মঙ্গলে বারে সুন্দরীভিশ্চ পূজিতা
(ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, ৪৪/৩৭-৩৮)।
দেবর্ষি নারায়ণের কাছে জানতে চেয়েছেন যথাক্রমে মঙ্গলচন্ডী, ষষ্ঠী, মনসা প্রমুখ দেবীদের চরিত্র। তাঁদের নামের এবং পূজনের মাহাত্ম্য। নারায়ণ বলে চলেছেন। ষষ্ঠী হলেন বালকগণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বিষ্ণুমায়া প্রকৃতির ষষ্ঠকলা বলে ষষ্ঠী নামে সম্বোধিতা হয়েছেন। এই দেবী নিরন্তর শিশুসান্নিধ্যে থাকতেই পছন্দ করেন। প্রিয়ব্রত নামে স্বায়ম্ভূব মনুর পুত্রকে ষষ্ঠী জানিয়েছেন যে, তিনি ব্রহ্মার মনসিজা। বিধাতা আপন মন থেকে তাকে সৃজন করে কার্তিককে সম্প্রদান করেছেন। ইনি ষোড়শমাতৃকার মধ্যে স্কন্দপত্নী সুব্রতা দেবসেনা নামে এক মাতৃকা। জগতে ষষ্ঠী হল এঁরই নামান্তর। ইনি নি:সন্তানকে সন্তান, দরিদ্রকে ধনসম্পদ এবং কর্মহীনকে কর্ম প্রদান করে থাকেন। রাজা প্রিয়ব্রত প্রতিমাসের শুক্লপক্ষীয় ষষ্ঠী তিথিতে মহামহোৎসবে তাঁর রাজ্যে ষষ্ঠীদেবীর আরাধনায় নিজে যেমন উদ্যোগী হন তেমন প্রজাবৃন্দকে নবজাতকের কল্যাণকামনায় ষষ্ঠ এবং একবিংশতি দিনে শ্রদ্ধা সহকারে ষষ্ঠীদেবীর পূজার নির্দেশ দেন। সুতরাং সন্তানের কল্যাণার্থে ‘ওঁ হ্রীং ষষ্ঠীদেব্যৈ স্বাহা’ এই আট অক্ষরবিশিষ্ট মহামন্ত্র প্রবর্তিত হল—
ব্রহ্মণো মানসী কন্যা দেবসেনামীশ্বরী।
সৃষ্টা মাং মনসো ধাতা দদৌ স্কন্দায় ভূমিপ
মাতৃকাসু চ বিখ্যাতা স্কন্দসেনা চ সুব্রতা।
বিশ্বে ষষ্ঠীতি বিখ্যাতা ষষ্ঠাংশা প্রকৃতের্যতঃ
অপুত্রায় পুত্রদাহং প্রিয়দাত্র্যপ্রিয়ায় চ।
ধনদা চ দরিদ্রেভ্যোকর্মিণে শুভকর্মদা
(ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, ৪৩/২৫-২৭)।
প্রাচীনকালে জলাজঙ্গল পরিবেষ্টিত ভূভাগে সর্পভীতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। সাপের কামড়ে মৃত্যু আকছার হত বলে প্রজাকল্যাণে ব্রতী কশ্যপমুনি প্রজাপতি ব্রহ্মার আদেশে বেদোক্ত বীজানুসারে মন্ত্র সৃজন করলেন। মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা ধ্যানকালে কশ্যপ মুনির মন থেকে উৎপন্ন হওয়ায় ‘মনসা’ নামে প্রসিদ্ধ হন। বিষহরণে সমর্থা বলে ইনি ‘বিষহরী’, মহাদেবের কাছে সিদ্ধিযোগ লাভ করায় ‘সিদ্ধযোগিনী’, আস্তিকমুনির জননী হওয়ায় ‘আস্তিকমাতা’, মুনিশ্রেষ্ঠ যোগীবর জরৎকারুর স্ত্রী বলে ইনি ‘জরৎকারুপ্রিয়া’ (ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, প্রকৃতিখন্ড, ৪৫-৪৬তম অধ্যায়)।
পরবর্তীকালে ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’ এই সমস্ত দেবীদের কাহিনির বহুল প্রচারের জন্য লোকজীবনকে স্পর্শ করে বিবিধ আভানক বর্ণিত হয়েছে। যেমন মা মনসা বলছেন, তিনি ফণীমনসা গাছে সর্বদা অধিষ্ঠান করেন। দশহরা ও নাগপঞ্চমীর দিনে ওই গাছ এনে যেন তাঁর পূজা করা হয় ইত্যাদি। পাঠক সবিস্ময়ে লক্ষ্য করেন, লক্ষ্মী, মঙ্গলচন্ডী, ষষ্ঠী প্রভৃতি দেবীদের রকমফের এবং লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, সকল ব্রতকথারই মূল অভিপ্রায় আত্মকল্যাণের সঙ্গে পারিবারিক কল্যাণ। দুঃখের দুর্গম পথে প্রতিনিয়ত জর্জরিত মানুষ দেবীদের ভরসার আধাররূপে কল্পনা করেছেন মানবজীবনকে ঋদ্ধ করবার বাসনায়। আমার প্রতিবেশিনী অমুক ব্রত উদযাপন করে এই পেয়েছেন, এর যে কত সুদূরপ্রসারী ফল—তা ব্রতকথার আভানকেই স্পষ্ট।
কাঁথা, কুঁড়েঘর, সাত ছেঁড়া কাপড়, ময়লা চিরকুট চাদর, দরিদ্রদশা, একবেলা দুটি মুড়ি, একবেলা দুটি শাক-ভাত এধরনের দুর্দশা থেকে বর মেগে নেওয়া আবার ব্রত সমাপনে দুঃখু ঘুচে যাওয়া এবং সর্বোপরি দেবীর কৃপায় রাজা-রাণী হওয়া—প্রভৃতি অতিকষ্টে অন্ন জোটানো মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করে যায়। এ ছাড়া খুদকুঁড়ো, লাউপাতা, লাউ, কলাগাছ, কলমিশাক, তিলফুল, ডালিম গাছ ধানের খেত, সরষের খেত, কড়াইসুঁটির খেত, পান্তাভাত, গোয়ালকাড়া, গোরু-ছাগল চরানো, হাল-হেলে কিনে দেওয়া, বীজধান নিয়ে যাওয়া, ক্ষেত্রদেবীকে মনপ্রাণে ডাকা, তেল-হলুদ মাখা, পুকুরপাড়ে হাঁড়ি রেখে নাইতে যাওয়া, নদীতে জাল ফেলা, চারিদিকে সাপের ফোঁস ফোঁস, কলা পেটোর ডিঙ্গি, মানের পাতা, গোয়ালের পেছনের ছাইগাদা, হাঁটুর ভেতর হাত গলিয়ে খেতে বসা, বনজঙ্গল, বাঘ-ভালুকের ভয়, বাঁশপাতা, উনুন জ্বালা—প্রভৃতি নি:সন্দেহে গ্রাম্য লোকজীবনের চিত্রপট।
একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, ব্রতকথার উদ্ভব আমজনতার কথা ভেবে। কিন্তু এর চৌহদ্দি ক্রমসম্প্রসারিত হয়ে সবশ্রেণির মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে কেবলমাত্র কথকতার গুণে। জাতপাতের আবেগ দিয়ে নয়, সমৃদ্ধকামী মানুষের কাছে কেবল বিশ্বাসের ডানায় ভর করে আভানকগুলি যে বিপুলভাবে জনসম্মোহনে একশোভাগ সফল তা নির্দ্বিধায় বলা চলে। হবেই না বা কেন! চিঁড়ে, মুড়ি, মুড়কি, খই, দুধ, দই, ছাতু, নাড়ু, কলা, পিটে, পাটালি, সন্দেশ, নারকেল, মুগকলাই, চালভাজা, দুধের সর, ফলার, গঙ্গার তীর—বিশেষ বিশেষ তিথিতে মাঝে-মধ্যে এসবে কে-না তৃপ্ত হন! রাজা, রানি, কোটাল, সন্ন্যাসী, গয়লা, ময়রা, কামার, নাপতিনী, শ্বশুর-শাশুড়ি, বউমা, বউঠাকরুন, ঝাড়ুদার, বনকন্যা, সওদাগর, কবিরাজ, পুরোহিত, কর্তা, গিন্নি, নাতি, নাত-বউ, ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণী, ঝি, কানা, খোঁড়া ভেদে সকল শ্রেণির মানুষ ব্রতকথায় স্থান করে নিয়েছে। ব্রতকথার ফলাফল একারণে আমাদের সমাজের মানচিত্রে এক নতুন মাত্রা আরোপ করে।
তবে ব্রতকথাকার দক্ষিণাদানের প্রসঙ্গে যেভাবে সোনা, রুপা দানের কথা বলেছেন বর্তমানে তা আমাদের সাধ্যের বাইরে। যেমন সোনার বেলপাতা (শিবব্রত), সোনার বেল (পুণ্যিপুকুর ব্রত), সোনার পাতা পাঁচটি (অশ্বত্থপাতা ব্রত), সোনা বা রুপার চরণ (হরির চরণ ব্রত), একছড়া সোনার কলা (কলাছড়া ব্রত), সোনার পদ্মপাতা (পৃথিবী ব্রত) প্রভৃতি। অভাবে কাঞ্চনমূল্য দানও গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষের কাছে অসম্ভব বললেই চলে। তথাপি ‘অভাবে দাম ধরে দিতে হয়’ ঘোষণায় (পৃথিবী ব্রত) মানুষজন স্বস্তি পান এবং বৈকল্পিক ব্যবস্থায় নমনীয় মনোভাবের পরিচয়ে তৃপ্ত হন। সত্যি কথা বলতে কি জুতো, ছাতা, কাপড়, চাদর, গামছা, পাঁচনবাড়ি এসব দিয়েই ইদানীংকালে ‘নমো নমঃ’ করে ব্রত উদযাপিত হয়ে থাকে।
পরিশেষে বলি, আলপনা-সজ্জিত গৃহাঙ্গনে নৈবেদ্যর ডালা সাজিয়ে যথাশক্তি ব্রতোৎসবে কৃতাঞ্জলিপুটে মায়েরা যখন গরদের লালপেড়ে শাড়িতে (অভাবে সাধারণ সাদাজমির লালপেড়ে শাড়িতে) সমগ্র পরিবারের ভুক্তি-মুক্তি প্রার্থনা করেন—তখন তা ব্যক্তি বা পরিবার বিশেষকে ছাপিয়ে এক নৈর্ব্যক্তিক আনন্দের জন্ম দেয়—যা যুক্তিতর্কের সীমারেখার অনেক অনেক দূরে। সুতরাং ‘নীতিযুক্তং মনোহরং বচনং শ্রুতিসুন্দরম’ পাঠের জন্য আমরা প্রবৃত্ত হই। বন্দে ব্রতকথাম।
অমিত ভট্টাচার্য
ভূমিকা
ধর্মগত-প্রাণা হিন্দু ললনাগণ ধর্ম ও অর্থ কামনায় আজীবন নানাবিধ ব্রত-নিয়মের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। ব্রত শব্দের অর্থ পাপক্ষয়কর পুণ্যজনক নিয়ম। এই নিয়মের বশবর্তী হইয়া আমাদের গৃহলক্ষ্মীগণ নানাবিধ পুণ্যকর্ম করিয়া গৃহের অশেষ মঙ্গলসাধন করিয়া থাকেন। তাঁহারা স্বামী-পুত্র লইয়া সুখে সংসার করিবেন বলিয়া, বাল্যে—কুমারী অবস্থা হইতেই—শিবপূজা, পুণ্যিপুকুর, যমপুকুর, গোকুল, হরির চরণ, সেঁজুতি প্রভৃতি নানারূপ ব্রত করিয়া থাকেন। বিবাহের পর—এয়ো সংক্রান্তি, অক্ষয় সিন্দূর, গুপ্তধন, ফলগচানে প্রভৃতি পুণ্যব্রত করেন। কিন্তু ইহাতেও তাঁহাদের ধর্ম-জীবনের আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত হয় না। তখন তাঁহারা সাবিত্রী, পঞ্চমী, তালনবমী, দূর্বাষ্টমী, অনন্তচতুর্দশী প্রভৃতি শাস্ত্রসংগত বৃহৎ যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া জীবন সার্থক জ্ঞান করেন। এতদ্ভিন্ন লক্ষ্মীপূজা, ষষ্ঠীপূজা, মঙ্গলচন্ডী, ইতু, সো-দো, মনসা প্রভৃতি নৈমিত্তিক নানাবিধ ব্রত অর্চনাদি করিয়া তাঁহাদের হৃদয় ধর্মময় করিয়া থাকেন।
সুতরাং দেখা যাইতেছে আমাদের দেশের কুললক্ষ্মীগণ আমাদেরই মঙ্গলের নিমিত্ত চিরকাল কুমারী অবস্থা হইতেই আজীবন নিত্য নিত্য নানাবিধ পুণ্যব্রত করিয়া সংসারে সুখ ও শান্তি স্থাপনা করিয়া আসিতেছেন। এই ব্রত-নিয়ম-উপবাস অবলম্বনে হিন্দু রমণীগণ বাল্যকাল হইতেই স্বামীভক্তি, গুরুভক্তি, ধর্মে বিশ্বাস, গৃহধর্মে আস্থা, ইন্দ্রিয় সংযম প্রভৃতি সদগুণ শিক্ষা করিয়া সচ্চরিত্রা ও পতিপরায়ণা হইয়া থাকেন। তাঁহাদের চরিত্র গঠনের নিমিত্ত আর্যঋষিগণ এই সকল ব্রতের উপদেশপূর্ণ শাস্ত্রীয় কথার সৃষ্টি করিয়াছেন; আর কতকগুলি সুধামাখা নীতিপূর্ণ কথা ব্রতপরায়ণা রমণীগণের দ্বারাই রচিত হইয়াছে। এই সমস্ত মেয়েলি কথা শুনিয়া রমণীগণের চিত্ত অধিকতররূপে ব্রত উপবাস করিতে অগ্রসর হয়। ইহার পুণ্য-কাহিনিতে অবলা-হৃদয় স্বতঃই ভক্তিরসে উচ্ছ্বসিত হইয়া থাকে।
সুতরাং এই ব্রতকথাগুলির রচনা-কৌশল ও রহস্য, ইহার আভ্যন্তরিক মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস, বৈচিত্র্য ও মূলতত্ত্ব আলোচনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায় যে, এক ব্রত ভিন্ন অবলা রমণীর হৃদয় ধর্মময় করিবার ও চরিত্র গঠন করিবার অন্য উপায় নাই। তাঁহাদের হৃদয়ে ধর্ম ও নীতি শিক্ষা দিবার নিমিত্ত আধুনিক কিণ্ডারর্গাটেন প্রণালী শিক্ষার মতো আমাদের পূর্বপুরুষগণ বহুপ্রাচীনকাল হইতে এই ব্রতপদ্ধতির নিয়ম প্রচলন করিয়া গিয়াছেন। সেগুলিকে অবজ্ঞার চক্ষে দেখা বা উপেক্ষা করা কোনো হিন্দু সন্তানেরই কর্তব্য নহে। এই অপূর্ব শিক্ষারীতির গুণেই আমাদের সংসার এত সুধাময় হইয়াছে। গৃহে গৃহে আনন্দস্রোত প্রবাহিত করিবার পক্ষে সমাজবিহিত চিরন্তন এমন সুন্দর প্রথা আর কোনো দেশে নাই।
কিন্তু দুঃখের বিষয় কালের স্বধর্মে ইহার গতি অন্যরূপ হইতেছে। ইংরেজি শিক্ষার প্রভাব এক্ষণে আমাদের অন্তঃপুরে প্রবেশলাভ করিয়াছে। ইহার বিষময় ফলে হিন্দু রমণীগণের ধর্মানুষ্ঠান ক্রমশ শিথিল হইয়া আসিতেছে। ধর্ম ও পুণ্য অর্জনের একমাত্র উপায়স্বরূপ বার-ব্রত-নিয়মাদি আমাদের দেশ হইতে ক্রমশ লোপ পাইতে বসিয়াছে। পুরোহিত-সাপেক্ষ যাজ্ঞিক ব্রতের শাস্ত্রীয় সংস্কৃত কথা আছে; কিন্তু লক্ষ্মী, মনসা, ইতু, সো-দো, ষষ্ঠী প্রভৃতি পারিবারিক ব্রতের মেয়েলি কথাগুলি এক্ষণে বিস্মৃতির গর্ভে নিমজ্জিত হইতে বসিয়াছে। এই সকল মেয়েলি কথায় অভিজ্ঞা প্রাচীনা রমণী এক্ষণে আর দেখিতে পাওয়া যায় না। সেকালে কত প্রাচীনা গৃহিণী, ব্রতপরায়ণা রমণীবৃন্দে পরিবেষ্টিতা হইয়া, বৃহৎ অঙ্গনে ব্রতকথা শুনাইতেন। পল্লির কত ব্রতপরায়ণা শুদ্ধান্তচারিণী মহিলা এসকল কথা শ্রবণ করিবার নিমিত্ত উৎকর্ণ হইয়া সমস্ত দিন উপবাস করিয়া বসিয়া থাকিতেন। হায়, সেদিন আর নাই! এক্ষণে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে সমস্ত লোপ পাইতে বসিয়াছে। কিছুদিন পরে ইহার কণামাত্রও খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। লুপ্তপ্রায় এই ব্রতকথাগুলিকে ধ্বংসের হস্ত হইতে উদ্ধার করাই বর্তমান গ্রন্থের উদ্দেশ্য।
এই সমস্ত ব্রতকথা সংগ্রহ করিতে কতদূর কৃতকার্য হইয়াছি তাহা বলিতে পারি না। কারণ এই সমস্ত মেয়েলি কথা এক-এক দেশে এক-এক প্রকার। বিশেষত পূর্ববঙ্গের সঙ্গে এদশের কথার আদৌ মিল নাই। এমনকি ব্রতের নাম ও পদ্ধতি পর্যন্ত স্বতন্ত্র। ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রমণীগণের দ্বারা রচিত হইয়াছে বলিয়া ইহা বিভিন্নাকার ধারণ করিয়াছে। তজ্জন্য আমি হুগলি, বর্ধমান, যশোহর, রাজশাহি, ঢাকা, ময়মনসিংহ, কামাখ্যা প্রভৃতি বহু-স্থান হইতে এই সমস্ত কথা সংগ্রহ করিয়া উপদেশ ও নীতিপূর্ণ কথাগুলি নির্বাচন করিয়া লিপিবদ্ধ করিলাম।
সংগৃহীত কথাগুলি ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে বিভক্ত করা হইয়াছে; যেমন লক্ষ্মীর কথার মধ্যে ভাদ্র, কার্তিক, পৌষ, চৈত্র, কোজাগরী প্রভৃতি সমস্ত লক্ষ্মীর কথা একস্থানে সন্নিবেশিত হইয়াছে। এইরূপ মঙ্গলচন্ডীর অন্তর্গত হরিষ মঙ্গলচন্ডী, জয় মঙ্গলবার, বারোমেসে মঙ্গলচন্ডী প্রভৃতি প্রদত্ত হইয়াছে। ষষ্ঠীর মধ্যে অরণ্য ষষ্ঠী, চাপড়া ষষ্ঠী, শীতল ষষ্ঠী, অশোক ষষ্ঠী প্রভৃতি সমস্ত ষষ্ঠী একস্থানে সজ্জিত হইয়াছে। অবশিষ্ট কথাগুলি বিবিধ শিরোনামে সন্নিবেশিত হইয়াছে; যেমন—মনসা, ইতু, অমাবস্যা, পূর্ণিমা প্রভৃতি।
ব্রতকথাগুলিকে দিব্য আভরণে সজ্জীকৃত করিবার মানসে কতকগুলি সুন্দর সুন্দর হাফটোন চিত্র প্রদত্ত হইয়াছে। এই পুস্তকখানির অঙ্গসৌষ্ঠবের নিমিত্ত যত্ন, পরিশ্রম ও অর্থব্যয় কিছুরই ত্রুটি করা হয় নাই। এক্ষণে যাঁহাদের জন্য এই গ্রন্থখানি রচিত হইল, সেই পতিপরায়ণা লক্ষ্মীস্বরূপা রমণীগণের নিকট আদৃত হইলেই শ্রম সফল জ্ঞান করিব।
গ্রন্থকার
.
লক্ষ্মীপূজা প্রায় প্রত্যেক মাসেই হইয়া থাকে। বৃহস্পতিবারই লক্ষ্মীপূজার প্রশস্ত দিন। অনেকে রবিবারেও করিয়া থাকেন। কোজাগরী ও কার্তিক মাসের পূজা রাত্রিকালে যথাদিনে হইয়া থাকে। আমাদের দেশে সাধারণত নিম্নলিখিত মাসে মা লক্ষ্মীর পূজা হইয়া থাকে:
ভাদ্র মাস
কার্তিক মাস (অমাবস্যা রাত্রিতে)
পৌষ মাস
চৈত্র মাস
কোজাগরী (আশ্বিন পূর্ণিমার রাত্রিতে)
ক্ষেত্র ব্রত (অগ্রহায়ণে)।