প্রশান্ত মিত্র দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে বসেছিলেন। ঘণ্টাখানেক আগে ইন্দিরা নিজে ওই চেয়ার পেতে তাকে ধরে ধরে এনে বসিয়ে দিয়ে গেছেন। এখানে বসে ইচ্ছে করলে রাস্তার লোক-চলাচল দেখা যায়। ইচ্ছে করলে সামনের আকাশের খানিকটা দেখা যায়। ইচ্ছে করলে রাস্তার উল্টোদিকের বাড়ি কটার জানলা দরজা বা বারান্দার মুখগুলো দেখা যায়। আর কিছুই হচ্ছে না করলে ইজিচেয়ারে মাথা রেখে চোখ বুজে চুপচাপ শুয়ে থাকা যায়।
বেরুবার আগে ইন্দিরা এই শেষের নির্দেশই দিয়ে গেছেন। কিছু চিন্তা করবে না, কিছু ভাববে না, মনটাকে একেবারে ফাঁকা করে দিয়ে চুপচাপ চোখ বুজে শুয়ে থাকবে, আমি এক ঘণ্টার মধ্যে মার্কেটিং সেরে ফিরে আসছি–ঘরে কি আছে আর কি নেই কদিনের মধ্যে তো আর হুশ ছিল না–ছেলেমেয়ে দুটোরও যাদি বিবেচনা বলে কিছু থাকত-বাবার জন্যে কেবল চিন্তা করতেই ওস্তাদ তারা, ফাঁক পেলেই ছুটছাট বেরিয়ে পড়েছে–নিজে না বেরিয়ে করি কি! মহেশ কাছেই থাকবে, কিছু দরকার হলে ওকে বলো, আর খবরদার টেলিফোন এলে তুমি চেয়ার হেড়ে নড়বে না–মহেশ ধরবে, কেউ খোঁজ নিলে কি বলতে হবে ওর এতদিনে মুখস্থ হয়ে গেছে। ঠিক আছে?
প্রশান্ত মিত্র হেসে মাথা নাড়লেন, ঠিক আছে। বললেন, আমার চিন্তা নিয়ে বেরিয়ে তুমি আবার গাড়ি-চাপা পড়ো না।
ইন্দিরা ব্যস্ত পায়ে চলে গেলেন। কিন্তু আধ মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরলেন। হাতে একটা ছোট টুল। পায়ের সামনে ওটা পেতে দিয়ে বললেন, যখন ইচ্ছে হবে পা তুলে বোসো–আর ভালো কথা, আমি বেরুচ্ছি, এই ফাঁকে লুকিয়ে একটা সিগারেট খেলেও কিন্তু ধরা পড়ে যাবে–মহেশ ঠিক আমাকে বলে দেবে।
প্রশান্ত মিত্র মুখ টিপে হেসে বললেন, পি. এমএর আদেশ শিরোধার্য।
-আ-হা, পি. এমএর কথা কত শোনো তুমি! এ-কানে ঢুকলে ও-কান দিবে বেরোয়–শুনলে আর এই বিপাকে পড়তে হত না।
চলে গেলেন। পি, এম অর্থাৎ প্রাইম মিনিস্টার। নামে মিল, তাই ইন্দিরা গাঙ্গ। যেদিন থেকে প্রধানমন্ত্রী সেই দিন থেকে ঘরের এই রসিকতা চাল। প্রশান্তবাবু সময়ে সময়ে এখনো ঠাট্টা করেন, ইন্দিরা সাম্রাজ্যের তবু একবার পতন হয়েছিল, মিত্র সাম্রাজ্যের পতন বলে কোনো কথা নেই। তাই পেয়ে ছেলেমেয়ে দুটো পর্যন্ত ওই নাম নিয়ে ঠাট্টা-তামাসা করে।
গত চার সপ্তাহ ধরে বাড়ির বাতাসে চাপা উত্তেজনা থিতিয়ে ছিল। সম্ভাব্য শোকের উত্তেজনা। শোক ঠেকানোর উত্তেজনাও বলা যেতে পাবে। মোট কথা, সমস্ত ব্যাপারটাই প্রশান্তবাবুর বিবেচনায় একধরণের উত্তেজনা গোছেরই মনে হয়েছিল। হঠাৎ সত্যি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। বিনা নোটিসে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠেছিল। বাঁ-কাঁধে আর বুকের বাঁদিকে একটা যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল। বেজায় গরম লাগছিল। ঘাম হচ্ছিল। সমস্ত শরাবে যেন পিন ফোঁটানো হচ্ছিল। এ রোগ তিনি চেনেন। বাবা এই রোগে গেছেন। এক শালা গেল বছর এই রোগে গেছে। অন্তরঙ্গ এক খুড়তুতো ভাই ছমাস আগে গেছে। গত দেড় বছরের মধ্যে দুজন সতীর্থ অর্থাৎ প্রবীণ সাহিত্যিক আর একজন কবিবন্ধু এই রোগে চোখ বুজেছে।
তাই সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকে ডেকে তিনি কি হয়েছে বলেছেন। তারপর শুধু বলেছেন, মনে রেখো, যাই হোক কক্ষনো হাসপাতালে নয়।
তারপর আর কথা বলার শক্তি ছিল না। কিন্তু জ্ঞান পুরোমাত্রায় ছিল। দশ মিনিটের মধ্যে পাড়ার ডাক্তার এসেছে। আধঘণ্টার মধ্যে দুজন বড় ডাক্তার। যে লোকের নাম ডাক আছে তার বেলায় অন্তত তড়িঘড়ি বড় ডাক্তার কলকাতায় মেলে। পটাপট কটা ইনজেকশান দেওয়া হল প্রশান্তবাবু টের পেয়েছেন। তারপর দুটো দিন ঘুম আর ঘুমের ঘোরে কেটেছে।
তৃতীয় দিনে একটু সুস্থ হবার পর থেকে চিকিৎসার আড়ম্বর আর সেই সঙ্গে এই চাপা উত্তেজনা দেখে যাচ্ছেন। দুদিনের সমাচারও শুনেছেন। দুজন বড় ডাক্তারই রোগীকে তক্ষুনি হাসপাতালে সরাতে চেয়েছিল। ইন্দিরা বেঁকে বসতে তা হয়নি। দুজন ডাক্তারই দস্তুরমতো অসন্তুষ্ট তাতে। তারা ছেলেমেয়েকে ডেকে বলেছে, এ অবস্থায় পেশেন্টকে বাড়িতে রাখা নির্বোধের কাজ হবে। ছেলেমেয়ে ঘাবড়ে গিয়ে মাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল। ইন্দিরার এক কথা, চিকিংসা বাড়িতেই হবে–তার জন্যে দশগুণ খরচ হয় হোক-হাসপাতালে নয়।
হাসপাতালে কেন নয় ছেলেমেয়েও মোটামুটি আঁচ করতে পারে। না থেকে শুরু করে আত্মীয়-পরিজন আর বাবার বন্ধুদের এই রোগে যে কজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাদের একজনও জীবিত অবস্থায় ফেরেনি। বাবা খোলাখুলি বলতেন, যাবার সময় হলে কোনো পাতাল থেকেই কেউ ফিরবে না–আর কিছু হলে কেউ হাসপাতালে নেবার নামও করবি না।
প্রশান্তবাবু নিজেও জানতেন হাসপাতাল সম্পর্কে এরকম একটা ধারণা থাকা কোনো শিক্ষিত মানুষের উচিত নয়। এমন অনেক রোগ আছে যার যথাযথ চিকিৎসা আর আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা শুধু হাসপাতালেই হতে পারে। কিন্তু হাসপাতাল নামটই তাঁর ব্যক্তিগত অ্যালার্জির মতো। ইন্দিরারও ভয়, জ্ঞান হবার পর স্বামটি যদি দেখেন হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে আছেন, তক্ষুনি আবার অঘটন ঘটে যেতে পারে।
যাই হোক, প্রশান্ত মিত্র বাড়ির শয্যাতেই ফাড়াকাটিয়ে উঠলেন। ফতা কাটিয়ে উঠেছেন এ ধারণা শুধু তার নিজের-বাড়িতে আর একজনেরও না। তার ওপর বড় ডাক্তাররা নাকি বলে গেছেন, আরো কিছুদিন না গেলে একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। এই আরো কিছুদিনটা কত দিন তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রশান্তবাবুর।
দুশ্চিন্তা নিজের শারীরিক দিক ভেবে নয়, চিকিৎসার আড়ম্বর, স্ত্রী ছেলেমেয়ে আর খুব ঘনিষ্ঠ দুচারজনের গার্জেনগিরির দাপটে। ডাক্তাররা সম্পূর্ণ সুস্থ ঘোষণা করলেও আর চলাফেরা কাজকর্মের স্বাধীনতা দিলেও এরা তা মানবে কিনা সন্দেহ। একটু অনিয়ম করা হয়েছে মনে হলে ইন্দিরা স্নেহমাখা ধমকের সুরে কথা বলেন, ছেলে সুশান্ত আর মেয়ে অনীতা সোজাসুজি ধমকায়, বলে, আর তোমার কথামতো কোনো কিছু চলবে না জেনে রাখো। আর খুব ঘনিষ্ঠরা খবর নিতে এলে ছেলেমেয়ে তাদের কাছে নালিশ জানায়, এই এই অনিয়ম করা হচ্ছিল বা হতে যাচ্ছিল। শুনে তারাও শুভার্থীর মতো হিতোপদেশ দিয়ে যায়।
ডাক্তারদের সিদ্ধান্ত মাইলড করোনারি অ্যাটাক। কিন্তু স্ত্রী ছেলেমেয়েদের দুশ্চিন্তার কারণে আর প্রচারণে রোগীর অবস্থা সকলের কাছেই সংকটজনক হয়ে উঠেছিল। রেডিও থেকে ফোনে বাড়ির লোকের মুখেই খবর নেওয়া হয়েছে। তারা জেনেছে। অবস্থা সংকটজনক–এবং সেই প্রচারই করেছে। খবরের কাজগুলোতেও একইভাবে এই সংকটজনক অবস্থার খবরই ছড়িয়েছে। ছেলের সঙ্গে কথা বলে কোনো কোনো কাগজের প্রতিনিধি এও লিখেছে, মনস্তাত্ত্বিক চবিত্রচিত্রনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক প্রশান্ত মিত্রর নিষেধেই তাকে হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে সরানো সম্ভব হয়নি। শেষের সময় যদি উপস্থিত হয়েই থাকে, তিনি স্বগৃহেই তার জন্য প্রস্তুত। পরে অপ্রত হেলে অবশ্য সরোষে মাথা ঝাঁকিয়ে প্রতিবাদ করেছে, কাগজগুলো মিথ্যেবাদী, আমি কখনো এরকম কথা বলিনি।
প্রশান্তবাবু হাসি মুখেই জবাব দিয়েছেন, বলে থাকলেও তো সত্যি কথাই বলেছিস, তোর রাগ হবার কি হল।
এমন প্রচারের যা ফল, তার উত্তেজনা ঠাণ্ডা হতে সময় একটু লাগবেই। প্রথম দিনকতক তো বাড়ির সামনেই কত চেনা অচেনা মেয়েপুরুষের ভিড়। অবস্থা জানানোর জন্য সুশান্তর দুই বন্ধুকে নিচের দরজায় মোতায়েন রাখতে হয়েছে। এদিকে মুহুর্মুহু টেলিফোন। প্রশান্তবাবুর লেখার ঘর থেকে টেলিফোন অবশ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কারণ শোবার ঘরের পরেই লেখার ঘর। তবু ফোন এলে এ ঘর থেকেও রিং শোনা যায়। ফোনে খবর জানানোর দায়িত্ব অনীতার অথবা ইন্দিরার। তৃতীয় দিনে একটু সুস্থ হবার পর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পঞ্চাশ-ষাটটা করে ফোন আসার খবর প্রশান্তবাবু পেয়েছেন। ফোনে কারা কারা খবর নিচ্ছে নোট রাখা উচিত এবং এই উচিত কাজে গাফিলতি হয়নি। সমবয়সী আর অনুজ লেখক, পাবলিশার, ছোট বড় মাসিক সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদক, সিনেমার পরিচালক প্রযোজক, প্রশান্তবাবুর। স্নেহভাজন অভিনেতা অভিনেত্রী গায়ক গায়িকারা সকলেই বাড়িতে এসে খবর নেবার কর্তব্য পালন করে চলেছে। রোগীর সঙ্গে দেখা করা নিষেধ। ফলে তাদের রোগীর খবর জানানোর দায়িত্ব ইন্দিরার বা ছেলেমেয়ের। প্রত্যহ কারা কারা খবর নিতে এলো। ইন্দিরা সন্ধ্যার পর সময় বুঝে স্বামীকে বলেন।
এমন একটা অবস্থার মধ্যে পড়ে প্রশান্ত মিত্র হাল ছেড়ে আসমর্পণ করা ছাড়া আর কি করতে পারেন? প্রচুর সিগারেট খেতেন। পনের দিনের মাথায় ডাক্তার তিনটে পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছে। এ সপ্তাহ থেকে পাঁচটা। তাতেও ইন্দিরা আর ছেলেমেয়ের। বেজায় আপত্তি। একটু আধটু ড্রিংক করা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছল। ডাক্তারের মতে এ রোগে সিগারেটের থেকে ড্রিংক কম ক্ষতিকর–আরো কিছু দিন গেলে একটু আধটু খাওয়া চলতে পারে। ইন্দিরা আর ছেলেমেয়ে ওই ডাক্তারের ওপর রেগে আগুন। তাদের ধারণা, ডাক্তার নিজে খায় বলেই অমন উদার। ছেলে তার এক বন্ধুর ডাক্তার বাবার সঙ্গে কথা বলে বাড়িতে এসে ঘোষণা করল, এই ডাক্তার আর চলবে না, বাবার মুখ চেয়ে ফতোয়া দেয়, আমি খুব ভালো করে জেনে এসেছি ড্রিংক সিগারেট কোনোটাই একদম চলা উচিত নয়।
মেয়ে আর মায়ের কাছে এই ফতোয়াই অভ্রান্ত। প্রশান্তবাবু মনে মনে বিরক্ত। বাপের পয়সায় ছেলে দিনের মধ্যে কপ্যাকেট সিগারেট ওড়ায় ঠিক নেই–লুকিয়ে চুরিয়ে ড্রিংকও একটু আধটু চলে কিনা সে সম্পর্কেও একেবারে নিঃসংশয় নন। কিন্তু মুখে তিনি বাদ প্রতিবাদ কিছু করেন না। এখন বে-কায়দায় পড়েছেন–সময় হলে নিজের যা করার করেই যাবেন এ ওরাও ভালো করেই জানে। জানে বলেই এত কড়া নজরে এখন।
কাঠের টুলে দুপা তুলে দিয়ে দূরের আকাশের দিকে চেয়ে গা ছেড়েই শুয়েছিলেন প্রশান্ত মিত্র। মাথার মধ্যে সেই হিজিবিজি ব্যাপারটা শুরু হয়ে গেল। হিজিবিজি ব্যাপার বলতে কতকগুলো এলোমোলো চিন্তা। কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই, এমন সব আধা ঘুমের মধ্যে যেমন অজস্র ছাড়া-ছাড়া চিত্র ভেসে ওঠে আবার মিলিয়ে যায়, তেমনি কাউকে বলেন নি, একেবারে ছেলেবেলা থেকে এ-রকমটা হয়ে আসছে।
একশ বিক্ষিপ্ত চিন্তার মিছিল মগজের মধ্যে যেন মুর্তি ধরে সার বেঁধে চলতে থাকে। মনষের চরিত্র বিস্তারে সিদ্ধহস্ত শিল্পী তিনি। যে চরিত্র কলমের ডগায় অবয়ব ধরে, তার ভেতর-বার পাঠককে আয়নায় দেখিয়ে দিতে পারেন। অতিবড় রূঢ় সমালোচকও চরিত্র বিশ্লেষণে প্রশান্ত মিত্রর মুক্তি নেই ভাবেন। অনেক সময়েই তারা লেখেন, ফের চরিত্রের গভীরতম অন্তঃপুরে অনায়াসে ঢুকে পড়ার যাদুকাঠিটি এই এক লেখকের হাতের মুঠোয়। আর তারই মগজের মধ্যে এমন এমন এলোমেলো হিজিবিজি ন্তির মিছিল সার বেঁধে চলতে থাকে এ নিজের কাছেই বরাবর একটা কৌতুকের ব্যাপার!
নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন প্রশান্তবাবু। মাথায় একটা মতলব এসেছে। ওই এলোমেলে, অথচ জীবন্ত চিন্তার মিছিলকে যদি কাগজে কলমে ধরে রাখা যায় তো কি দাঁড়ায়? যেমন ভাবা তেমনি কাজ। মহেশকে ডেকে হুকুম করলেন, আমার কালো নোটবই অর পেনটা দিয়ে যা–
মহেশ দ্বিধান্বিত। মনিব এটা উচিত কাজ করছেন না, আর মা শুনলে বকবেন এ সে-ও জানে।
কি বললাম কানে গেল?
মেজাজের আভাস পেয়ে মহেশ ঘর থেকে মস্ত কালো নোটবই আর কলম রেখে গেল। এ নেটবইটা বাড়ির সকলেরই খুব চেনা, কিন্তু কেউ আর এখন এটা খোলে না। লেখার কোনো প্ল্যান বা প্লট মাথায় এলে এতে লিখে রাখেন। কিন্তু নোট করার পদ্ধতি এন বিচিত্রি যে দেখে বা পড়ে কারোই তেমন বোধগম্য হবে না। জ্যামিতিক নক্সার মতো মনে হবে। তার মধ্যে দুচারটে নাম, দুচার অক্ষরে একটা-দুটো ঘটনা, তার মধ্যে অ্যারো টেনে কোথাও সার্কেল কোথাও ট্রায়েঙ্গেল কোথাও বা রেকট্যানে তিনশ পাতার লম্বা বাঁধানো এই নোটবইয়ের প্রায় দুশ পাতা এই গোছের প্লটের নক্সায় বোঝাই। আর তার প্রায় সবগুলোতেই লাল দাগ, মারা। অর্থাৎ যে প্লট বা প্ল্যানগুলো নিয়ে গল্প বা উপন্যাস লেখা হয়ে গেছে তাতে ওই লাল দাগ পড়ে। ইন্দিরা আর ছেলেমেয়েও তার এই প্ল্যান অথবা প্লটের বই নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। কিন্তু কিছুই বোধগম্য হয় না বলে কৌতূহল গেছে।
নোটবইটা খুলে হোট টুলের ওপর রেখে আজ আর কোনো প্লটের হক কাটতে বসলেন না প্রশান্ত মিত্র! ওই চিন্তার এলেমেলো মিছিল যেমন আসে তেমনি সাজানোর সংকল্প। …খুব ছেলেবেলা থেকেই ধরা যেতে পারে। চোখ বুজলে সেই নবছরে ছেলেটাকে তিনি স্পষ্ট দেখতে পান। তার উদ্ভট চিন্তার কারিকুরিও।
…ইস্কুল যেতে ইচ্ছে করছে না। অঙ্কের মাস্টারটা বেত নিয়ে ক্লাস ঢোকে। অঙ্ক ভুল হলে শপাশপ মারে। হি-হি-হি-হি-ওই মাস্টারের পিতেই বৃষ্টির মতো বেতের ঘা পড়ছে। যন্ত্রণায় মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। হি-হি-হি-কিছু দেখতে পাচ্ছে না বুঝতেও পারছে না। অদৃশ্য মানুষ হয়ে কে মারছে জানবে কি করে?..-টা যাচ্ছে তাই। অতবড় পাটালি থেকে এক ডেলা মাত্র ভেঙে দিল। কি দারুণ খেতে। বেশ খেলে পেট কামড়াবে না হাতি। বড় হয়ে অনেক টাকা রোজগার করতে হবে। এর প্রাণের সাধে পাটালি খেতে হবে। ওই ঘাড় গোঁজা ধ্যাবড়া মোটা জলের কল। বিচ্ছিবি। ভূতেরা নিশ্চয় ওই রকম দেখতে। ও-মা! তীবের মতে সাইকেলটা যে গায়ের ও এসে পড়ছে। দাঁড়াব? হুটব? দাঁড়াব? দাঁড়াব? না ছুটি। গেল গেল গেল! সব অন্ধকার। দারুণ যন্ত্রণা। মাটি থেকে কে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। অন্ধকার এক কমছে। দাওয়ায় আঠের-উনিশ বছরের যে মেয়েটা সে-ই বুকের সঙ্গে পেটে নিয়ে ছুটে বাড়িতে ঢুকছে। তার বুকটা কি নরম আর কেমন অদ্ভুত লাগছে। হি-হি-হি হি। এ-মা ব্যাটাছেলে সাইকেল চাপা পড়ে। পাশের বাড়ির খুটা ছুটে ভিতরে পালিয়ে গেল। ধরা গেল না। হাত পা গা মুখের ছাল উঠে একাকার আর ওই মেয়ের হাসি ধরতে পারলে মজা বুঝবে। …আচ্ছা, ওই যে মেয়েটা বুকে জাপটে তুলে নিয়ে গেছল, খুকুটা বড় হলে তার মতো হবে? ওরও ওই রকম বুক হবে? মা মাসি খুড়ি জেঠ নয়, তাদের থেকে ঢেব কমবয়সী মেয়েদের সক্কলের মধ্যে কিছু একটা মজা লুকিয়ে আছে। খুব জানতে ইচ্ছে করে। বুঝতে ইচ্ছে করে। খুকুটা বেজায় ছোট। তবু ওকেই একদিন ধরে গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে আর টিপেটুপে দেখতে হবে …।
প্রশান্তবাবু কলম রাখলেন। ঠোঁটের ফাঁকে এক টুকরো হানি। একটা আস্ত না হোক আধখানা সিগারেট খেলে ভালো লাগত। থাকগে। ইন্দিরা চেঁচামেচি করবে। এই কড়াকড়ি কদিন আব চলবে। পাঁচ সাত মিনিট ইজিচেয়ারে মাথা রেখে পড়ে রইলেন। এবারে ঠোঁটের ফাঁকে আগের থেকে একটু বেশি হাসি। সোজা হলেন। নোটবইয়ের পাতা উল্টে কলম নিয়ে আবার ঝুঁকে বসলেন।
…মফঃস্বলের কলেজ নয় তো যেন স্কুল! এক ঘর ছেলে আর সাত-সাতটা মেয়ের চোখের ওপর নাম ধরে দাঁড় করিয়ে পড়া জিজ্ঞেস করা। আগের দিন কোলরিজের রাইন অফ দি এনসেন্ট মেরিনার শেষ করে আজই আবার ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর ইয়ারো আনভিজিটেড ইয়ারো ভিজিটেড ধরে এতটা এগিয়ে যাওয়া হয়েছে সেদিকে কাল মন যখন ছিলই না, চুপ করে না থেকে বোকার মতো কেন জবাব দিতে গেল। ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর কাব্য-প্রকৃতির প্রশ্নের জবাবে কোলরিজের কাব্য-প্রকৃতি দিয়ে উত্তর শুরু করলে ক্লাসসুদ্ধ সক্কলে হেসে উঠবে না তো কি? অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করেই যে ওই তাঁদর প্রেফেসার এই একজনকেই ধরেছে তাতে কোন ভুল নেই। সক্কলের সঙ্গে মেয়েদের আলাদা বেঞ্চ থেকে গায়ত্রীও নাস্তানাবুদ মুখখানার দিকে চেয়ে কম হাসছিল না–এটাই বেশি যন্তন্নার মতো। বয়সে দুতিন মাসের বড় আর দিদির সঙ্গে ভাব বলে গায়ত্রীরও কথাবার্তায় দিদি-দিদি ভাব। বিকেলে বাড়ি এসে কিনা বলল, এই হাঁদারাম, ক্লাসে তোমার মনটা থাকে কোথায়?…ফস করে যদি মুখের ওপর বলে বসতে পারত কোথায় থাকে? ক্লাসে বসে আয়েস করে এই গায়ত্রীর মুখখানাই তো দেখছিল।…শুধু মুখখানা? কত কিছু দেখার মধ্যে ডুবে গেলে ক্লাসে অমন ভুলের মাশুল দিতে হয়?…রং একটু কালো হলেও এই সুঠাম ঢলেশ্বরীর পাশে অন্য মেয়েগুলো সব পাকাটি।…হকির নক আউট ফাইনালে নিজের দোষেই কলেজ টিমের হার হয়ে গেল। দুদুটো সোজা গোল মিস করে বসল। বিজয়ীর কাপ হাতে গায়ত্রীকে শৌর্যের মূর্তিখানা দেখানো গেল না। ..কলেজ ম্যাগাজিনে গল্পটা ছাপা হয়েছে আর গায়ত্রীও সেটা পড়েছে নিশ্চয়। নইলে বারো গজ দূরে মেয়েদের আলাদা জায়গায় বসে টেরিয়ে টেরিয়ে তাকাচ্ছিল আর ঠোঁট টিপে হাসছিল কেন? সুলতা সিংহ আর রঞ্জিতা বোস ক্লাস শেষ হতে বলেই গেল, জিত গল্পটা দারুণ হয়েছে। না, প্রেম বা বিয়ের গপপ নয়, একটি খুব সাধারণ ছেলে শুধু হৃদয়ের আশ্চর্য প্রসাদগুণে কেমন করে এক অহংকারী মেয়ের চোখে অসাধারণ হয়ে উঠল– সেই গল্প। বিকেলে গায়ত্রী বাড়ি এলো। ওর সামনেই হেসে হেসে দিদিকে বলল, তোমার ভাই এঁচড়ে পেকে গেছে রমাদি, মেয়ে কাকে বলে জানে না, মেয়ে নিয়ে গপপ লেখা শুরু করেছে। …ক্লাসে গায়ত্রীর সেই চাউনি আর টিপটিপ হাসি দেখেই ভিতরটা কেমন গরম গরম লাগছিল। এই কথা আর এই হাসির পর একটা উষ্ণ বাষ্প ভেতরে কেঁদোচ্ছে। রাতে শুতে যাবার আগে পর্যন্ত ওই কথা আর এই হাসি একটা স্পর্শ হয়ে এক অব্যক্ত যন্তন্নার আগল ভেঙে চলেছে। কত জানে গায়ত্রী যদি জানত। বুক আর দুটো হাতের চাপে পাশবালিশটার দফা প্রায় রফা। কিন্তু এটা কি পাশবালিশ নাকি?..রাত দুটো। আর পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে ক্লাবের ওরা চুপিসাড়ে এসে জানলায় একবার টর্চ ফেলবে। ফেলল। বালিশের তলা থেকে নিজের টর্চ বার করে একবার জ্বেলে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে পাঁচিল টপকে রাস্তায়। ভূতুড়ে অন্ধকারে সকলে। মিলে সোজা আড্ডা-বাগানে। গা ছমছম করছে। গোটা বাগানটাই কোনো এক কালের কবরে ছাওয়া। নিজেদেরই পায়ের খসখস শব্দ, অথচ মনে হচ্ছে অশরীরীরা যেন আপত্তি জানাচ্ছে। ছেলেবেলার সেই ঘাড়-গোজা থ্যাবড়া মোটা কলের মতো ভূতগুলো অন্ধকারের শরীর ধরে আশপাশে ঘুরঘুর করছে। ধ্যেৎ। এতগুলো জোয়ান ছেলে। একসঙ্গে, ভূতের নিকুচি করেছে। একজন টর্চের আলো ফেলতে সামনেই ওই মস্ত লম্বা লোহার বামটা দেখা গেল। মণ পনের ওজন হবে ভেবেছিল। আঠেরো জনে মিলে হিমসিম খেয়ে ওটা কাঁধে তুলতে মনে হল বিশ মণের কম হবে না। আধমাইল পথ ভেঙে রাতের অন্ধকারে লোহার বামটা ক্লাবঘরের পিছনে এনে ফেলতে সকলের কালঘাম ছোটার দাখিল। কাজ সেরে আবার যে-যার বাড়ি। বিছানা। কালই ওই লোহার বীমটা ঠেলায় করে গণেশ সাহার দোকনে চলে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখন ঘরের দোরে। লোহালক্করের আগুন দাম। পনের ষোল মণ ওজন ধরেই গণেশ সাহা অনেক টাকা কবুল করেছে। সেই টাকায় ক্লাবের ব্যায়ামের সরঞ্জাম আসবে। নিজর সেই স্বাস্থ্যশ্রী বিছানায় শুয়ে চোখ চেয়েই কল্পনা করতে পারছে। দেখতে পাচ্ছে। গায়ত্রও তার মুগ্ধ চোখে পলক পড়ে না। আঃ, কেলো হারামজাদা আজ আবার পাশবালিশটা দিতে ভুলেছে। কাল ওর মাথাটা ভাঙবে। টর্চ জ্বেলে পাশবালিশটা নিয়ে আসতে হল। তারপর ওই মেয়ের আর কত তফাতে থাকবে সাধ্যি?…কত রোগের কত ওষুধ বেরুচ্ছে, টাইফয়েডের ওষুধ এখনো নেই কেন? এখন পর্যন্ত কেবল কাজ ভরসা আর সেবা ভরসা কেন? তাহলেও এই সেবাটুকুর ভার কেবল একজন পেলেই গায়ত্রী ম্যাজিকের মতো সেরে উঠতে পারে। কল্পনায় সেবার ভার নেবার সঙ্গে সঙ্গে দেখছে গায়ত্রী সেরে উঠছে।…এ কি হল! এনসেন্ট মেরিনারের নাবিকরা পাপ করেছে। তাদের সামনে। মঙ্গলের দূত গুলিবিদ্ধ বিশাল অ্যালবেট্রস পাখিটা মরে পড়ে আছে। ক্ষুধায় তৃষ্ণায়। দুর্যোগে নাবিকেরা সব পাগল। তারা হিংসা ভুলে আকুল হয়ে ঈশ্বরকে ডাকহে। শান্তির অনুভূতি ফিরে আসছে।… কবরের শান্তি ভঙ্গ করা হয়েছে। বিক্ষুব্ধ অশরীরীরা সব মশারির বাইরে অন্ধকারে ঘুরঘুর করছে। তারা প্রতিশোধ নেবে।…একজনের লাভের পাপ, বাসনার পাপ গায়ত্রীকে স্পর্শ করেছে। গায়ত্রী চরম প্রতিশোধ নিল। গায়ত্রী শ্মশানের আগুনে নিজেকে শুচিশুদ্ধ করে নিল। আরামের শয্যায় শুয়ে ভিতরটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে এই একজনের। ওই নাবিকদের মতো আকুল হয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে চেষ্টা করছে। মা–মাগো! ভোররাতে দুচোখে ঘুম নামল। মনে হল বালিশে নয়, মায়ের কোলে শুয়ে আছি।… … …
নোটবই আর কলম বন্ধ করে প্রশান্তবাবু আবার ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে দিলেন। ভিতরটা বেশ হালকা লাগছে। আরো মিনিট দশেক বাদে ইন্দিরা ফিরলেন। টুলে নোটবই আর কলম দেখে আঁতকে উঠলেন।–এইজন্যেই তো আমি বেরুতে চাই না, এরই মধ্যে নোটবই আর কলম নিয়ে তুমি লেখার ছক কাটতে বসে গেলে? ঘুরে দাঁড়িয়ে ইন্দিরা ঝাঝালো গলায় ডেকে উঠলেন, মহেশ!
সন্ত্রস্ত মহেশ তক্ষুনি হাজির। ইন্দিরা কিছু বলার আগেই প্রশান্তবাবু আদেশ দিলেন, দরকার নেই, যা—
মহেশ সরে যেতে হাসিমুখে স্ত্রীর দিকে ফিরলেন, মহেশও আমার ওপরে। গার্জেনগিরি করতে পারেনি কেন সেই কৈফিয়ত তলব করতে যাচ্ছিলেন?
ইন্দিরা মনে মনে অপ্রস্তুত একটু। ফলে জবাবের ঝাঁঝ আরো বেশি। তুমিই বা এমন অবুঝপনা করবে কেন–এখন তোমার লেখার প্লট ঠিক করার সময়?
কালো নোটবই মানেই লেখার প্লটের নক্সা বা খসড়া ভাবেন। জবাব না দিয়ে প্রশান্ত মিত্র গম্ভীর মুখে চেয়ার চেড়ে উঠলেন। ডাকলেন, এসো
ফোনটা যে ঘরে সরানো হয়েছে সেই ঘরে চললেন। ইন্দিরা পিছনে। দ্রুত এগিয়ে হাত ধরতে পারলেন না। হঠাৎ কি হল ভেবে পেলেন না। স্বামীর এই গোছের গাম্ভীর্যকে একটু সমীহ করেন।
ঘরে ঢুকে প্রশান্তবাবু ফোনের রিসিভার তুলে নিলেন। ডায়েল করলেন। ইন্দিরা এখনো কিছু না বুঝে চেয়ে আছেন। একটু বাদেই স্বামীর কথা থেকে বুঝলেন, কাকে ফোন করা হল এবং লাইনের ও-ধারে কে। হার্ট স্পেশালিস্ট, যিনি গত একমাসের মধ্যে অনেক দিন বাড়ি এসে রোগী দেখে গেছেন।
সাড়া পেয়েই প্রশান্তবাবু বললেন, আমার স্ত্রীর আমার বিরুদ্ধে ভীষণ নালিশ আছে।…এঁর মুখেই শুনে আপনার যা বলার ওঁকে বলুন আমার মনে হচ্ছে। একাসেরও পরে এমন কড়াকড়ি চললে আবার আমাকে বিছানা নিতে হবে।
রিসিভারটা ইন্দিরার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তার বিড়ম্বিত মুখখানা মিষ্টি লাগছে। অপেক্ষা না করে গম্ভীর মুখেই প্রশান্তবাবু ঘর থেকে নিজের শোবার ঘরে চলে এলেন।
মিনিট পাঁচেক বাদে ইন্দিরা এলেন। অনুযোগের সুরে বললেন, তুমি ডাক্তারকে ঘুষ খাইয়ে রেখেছিলে নাকি?
প্রশান্তবাবু শব্দ করেই হেসে উঠলেন। নালিশের জবাবে পেশালিস্ট ডাক্তার কি বলে থাকতে পারেন এই থেকেই বোঝা গেল।
ইন্দিরা এবারে উৎসুক একটু।–তা এতবড় অসুখ থেকে উঠেই হঠাৎ কি? মা এল তোমার?
ভিতরে ভিতরে একটু বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেলেও প্রশান্তবাবু নির্লিপ্ত জবাব নিজে নোটবইটা খুলে নিজেই দেখো কি প্লট।
পাছে সত্যি ওটা খোলে সেই জন্যেই বলা কাজ হল। ইন্দিরা বললেন, আ-হ, তোমার ওই নক্সা আর আঁকিবুকি দেখে কি বুঝব। শুনিই না কি প্লট, এই এ নিয়ে কিছু না তো?
প্রশান্তবাবু হাসি মুখেই মাথা নাড়লেন। এ-সব কিছু না।
পরদিন। বিকেলে আগের দিনের মতোই প্রশান্তবাবু বারান্দার ইজিচেয়ারে বসেহন। কাঠের টুলের ওপর নোটবই কম। ইন্দিরা আজ এ নিয়ে কোনো আপত্তি তোলেননি। বড় ডাক্তার কাল বলেছেন, একটু একটু করে নিজের কাজের মধ্যে ফিরে আসতে চাওয়াটাই সব থেকে সুস্থতার লক্ষণ। পাশের মোড়ায় বসে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলেছেন। তারপর স্বামীর বিমনা ভাব লক্ষ্য করে উঠে গেছেন। নতুন কিছু সৃষ্টির আগের এই তন্ময়তা খুব ভালো চেনেন।
প্রশান্ত মিত্র সত্যিই বিমনা আর তন্ময় হয়ে পড়েছেন কোনো সৃষ্টির তাগিদে ন গজের মধ্যে সেই হিজিবিজি ব্যাপারটা শুরু হয়ে গেছে। চিন্তার এলোমেলো মিহি সচল অবাক ছবির মতো সার বেঁধে চলেছে। তারই ভিতর থেকে চোখের সামনে একখানা মুখ ধরে রাখার চেষ্টা। তারই ভিতরের আর একখানা মুখ।
খুব স্পষ্ট করে ধরা গেল। প্রশান্তবাবুর ঠোঁটের ফাঁকে হাসির টুকরো। নোটবই খুলে কলম নিয়ে কুঁকলেন।
…তাড়াতাড়ি দাড়ি কাটতে গিয়ে গাল কেটে গেল। কাটুক। গলাটাই কাটতে ইচ্ছে করছে। নাকেমুখে গুঁজে এক্ষনি দশটা-পাঁচটার অফিসে ছোটো। চাকরি না। তো ফাঁসির দড়ি। ভাবতে গেলে কান্না পায়। পায়ের তলায় মাটি সরে সরে যায়। গলা বুক শুকিয়ে আসে। দুচোখ সত্যি সত্যি জলে ভরে যায়। রাগে নিজের ওপরেই হিংস্র কিছু করে বসতে ইচ্ছে করে। সকলের অগোচরে বাথরুমে ছুটে যেতে হয়। চোখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে আসতে হয়। তারপর চোখ মুখ মুছে পাউডার বুলিয়ে নিলেই সক্কলের চোখে সপ্রতিভ স্মার্ট। …যে কাণ্ড এ পর্যন্ত অনেকবার ঘটে গেছে। আবারও সেই কাণ্ড! সেকশন অফিসারের সঙ্গে সামান্য কারণে কথা-কাটাকাটি, তারপরেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সোজা বাস্তায়। মুক্তির স্বাদ। তারই সঙ্গে অনিশ্চয়তার আতঙ্ক। মুক্তির স্বাদ থেকে দিনে দিনে আতঙ্কটাই বড় হয়ে উঠছে। শুভার্থীজনেদের উপদেশ শ্লেষের মতো কানে বেঁধে। লিখে আবার এ-দেশের মানুষ খেতে পরতে পায়। নিজের চেষ্টায় আর রোজগারের সর্বস্ব খুইয়ে এ-পর্যন্ত চার-চারটে উপন্যাস ছাপা হয়েছে কিন্তু এতটুক আলোর হদিস কোথাও নেই। কেউ চেনে না। কেউ জানে না। পাবলিশারের কাছে খোঁজ নিতে গেলেও মুখঝামটা খেতে হয়–বই বিক্রি হয় নি। হলেও হিসেব চাইলে আবার মুখঝামটা। মাসিকে সাহিকে লেখা পাঠালে অবধারিত ফেরত। পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকের দরজায় ধর্না দিলেও কেউ উল্টে দেখতে চায় না। সম্মানবোধ প্রহর, অথচ সর্বদা মাথা নিচু। আত্মীয়-পরিজনের করুণার পাত্র। …নির্জন দুপুরে ছাতে উঠেছে। তারপর সভয়ে সরে গেছে। নিচের দিকে তাকাতে কে যেন মন্ত্রণা দিচ্ছিল, ইচ্ছে করলে এক্ষুণি সব যন্ত্রণার শেষ হতে পারে।…মায়ের ঠাকুরঘর। ভিতরে ঢুকে নিঃশব্ধে দরজা দুটো ভেজিয়ে দিল। তারপর মায়ের পটের সামনে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। মা-গো শুধু এই দাও, যেন কোনদিন কারো গলগ্রহ হতে না হয়..মা কি শুনল? নইলে দুমাস না যেতে হ্যাং অমন যোগাযোগ কেন? যেখানে ফিচার লিখে ভিক্ষের মতো পাচিশ তিরিশ টাকা করে হাত পেতে নিতে হত, সেখান থেকেই গল্প লেখার আমন্ত্রণ পেল কেন–গল্পের পরে উপন্যাস লেখার ফরমাস!…সেই থেকে বৃত্তবদল। বাজারে ফি বছর দুতিনটে করে উপন্যাসের জমজমাট বিক্রি। কটি উপন্যাস সিনেমায় পরপর হাট। প্রকাশকরা যেচে আসছে। ছবির প্রযোজকরা খাতির করছে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাছেও খাতির কদর বেড়ে চলেছে।..সুরা সরকারের ফোন। খিলখিল হাসি। আপনি প্রোডিউসারের কাছে আপনার গল্পের নায়িকা হিসাবে আমার নাম সাজেস্ট করেছেন শুনলাম, অনেক ধন্যবাদ। মঞ্জুশ্রী ওর সামনাসামনি অভিমান, কিছু বলছেন না নেই আমার অভিনয় আপনার ভালো লাগেনি! এই শটটা আর একবার নিয়ে দেখব?…রাতের শয্যায় কল্পনার পথ ধরে ওই দুই অভিনেত্রীকেই চোখের সামনে দেখা যায়। কখনো সুরমা সরকার। কখনো মঞ্জুশ্রী গুপ্ত। ভেতরটা লালায়িত হয়ে ওঠে। হাত দুটো পাশবালিশের ওপর নিশপিশ করে। ইচ্ছে করলেই কল্পনায় ওদের খুব কাছে টেনে আনা যায়। তারপরেই হাতের ধাক্কায় পাশবালিশটা ছিটকে মাটিতে পড়ল। আবার? আবার পাপ? গায়ত্রীকে। মনে নেই? গায়ত্রী কিভাবে শুচিশুদ্ধ হল মনে নেই?…সমস্ত রাগ গিয়ে পড়েছে। ইন্দিরার ওপর। ওধারে ঘুমে বিভোর হয়ে লতিয়ে পড়ে আছে। ও জেগে থাকলে তো এরকমটা হয় না। ভালো যাকে বাসে সে ইন্দিরা ছাড়া আর কে? ফের মিথ্যে? অন্তত নির্জলা সত্যি কি?…ইন্দিরা যখন তোমার বুকে মাথা গুঁজে ঘুমোয় তখনো কি এক-একসময় ওই রমণী-দেহকে কেন্দ্র করে সিনেমার অভিনেত্রী ছেড়ে তোমার বইয়ের নায়িকারা পর্যন্ত কেউ কেউ ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে এসে হাজির হয় না?…
প্রশান্ত মিত্র নোটবই বন্ধ করলেন। কলমও। সিগারেট না খেয়ে পারা যাচ্ছে। না। হাঁক দিলেন, মহেশ!
মহেশ এলো।
–তোর মা কোথায়?
–এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা কইছেন।
–চলে গেলে ডেকে দিস।
সাত আট মিনিটের মধ্যে ইন্দিরা এলেন। –ডাকছিলে?
–হ্যাঁ। বড় তেষ্টা।
–সে কি! ইন্দিরা সচকিত। –মহেশ কোথায়, এক গেলাস জলও দিতে পারেনি?
–জলের তেষ্টা নয়। সিগারেটের।
ইন্দিরা থমকে দাঁড়ালেন। চোখে চোখ।–আজ এরই মধ্যে একটা বেশি খেয়েছ না?
মুখ কাচুমাচু প্রশান্তবাবুর।–তাহলে অন্তত আধখানা…
ইন্দিরা হেসে ফেললেন।–কি যে করো না তুমি! সত্যি আধখানা কেটে আনছি।
দু মিনিটের মধ্যে ফিরলেন। হাতে আধখানা সিগারেট আর দেশলাই।
প্রশান্তবাবু সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে বড় টান দিলেন। ইন্দিরা মোড়া টেনে। বসলেন।
–কে এসেছিল?
–এই বাংলার সম্পাদক সঞ্জয় ঘোষ। তোমার শরীরের খবর নিচ্ছিলেন, কিন্তু আসল মতলব কবে থেকে তোমাকে লেখানো যাবে জানা। ওঠার আগে বলেই গেলেন, এবারে প্রথম যে লেখাটি ধরবে সেটা তার–তোমাকে যেন বলে রাখি।
আধখানা সিগারেট আর দুতিন টানে ফুরিয়ে এলো। ইন্দিরা বললেন, তার খানিক আগে তোমাদের প্রোডিউসার বিজন চাকলাদার ফোন করেছিলেন, তোমার কি গল্প নিয়ে জরুরী আলোচনা দরকার। আমি বলে দিয়েছি সামনের সপ্তাহের আগে হবে না–তাও কেমন থাকো না থাকো ফোন করে আগে জেনে নিতে।
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে প্রশান্তবাবু বললেন, আসতে বললেই পারতে, টাকাও তো দরকার।
-থাক। যা আছে ওই দুটোর উচ্ছন্নে যাবার মতো যথেষ্ট। নিজের বিশ্রামের কথা ভাবো।
প্রশান্তবাবু হাসলেন।ওদের ওপর তোমার এত রাগ কেন? সুশান্ত চাকরি করবে কি করে, চাকরির নামেই আমার তো হৃৎকম্প হত। আর অনীতা-তো বলেই দিয়েছে এম. এ পাশ করার পর বিয়ের কথা।
ইন্দিরা অখুশি মুখ করে জবাব দিলেন, জানি না বাপু, কারো মতিগতি বুঝি না।
কটা দিন ভেতরটা বেশ হালকা লাগছিল প্রশান্তবাবুর। মনের বিজ্ঞানীরা বলেন, নিজের ভেতর দেখা গেলে অনেক দুর্বোধ্য বা অগোচরের জট খুলে যায়, স্নায়ু শিথিল হয়, বশেও থাকে। প্রশান্তবাবুর সদ্য অনুভূতিও অনেকটা সেই গোছের। কিন্তু পরের ছসাত দিন আর ওই নোটবই খুলে বসার অবকাশ পেলেন না। ছেলেমেয়ে আর সপরিবারে শ্যালক এসেছে দিল্লি থেকে। ভগ্নিপতির অসুস্থতার খবর পাওয়ার পর থেকেই আসতে চেষ্টা করছিল।
ছদিন বাদে তারা চলে যাবার পর এতবড় বাড়ি আবার খালি। বিকেলের দিকে ইন্দিরা কি কাজ সারতে বেরিয়েছেন। ছেলেমেয়েও বাড়ি নেই। প্রশান্তবাবু বারান্দায় ইজিচেয়ারে। সামনের কাঠের টুলে সেই মোটা বাঁধানো নোটবই আর কলম। ওটা খুলে বসার জন্য ভেতরটা অনেকক্ষণ ধরে লালায়িত হয়ে উঠেছিল। এই রকম নিরিবিলি ফুরসতের অপেক্ষাতেই ছিলেন। ভিতরের যে মানুষটা ওই হিজিবিজি চিন্তার মিছিলের নায়ক, আয়নায় দেখার মতো তাকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কারণ প্রশান্তবাবুর মতো সেও এক পরিণতির মোহনার দিকে পা বাড়িয়েছে। তফাৎ শুধু, তার সত্তা সকলের দেখা সকলের জানা প্রশান্ত মিত্রর থেকে বরাবরকার মতো আজও বিচ্ছিন্ন। নোটবই খুলে প্রশান্তবাবু কলম নিয়ে ঝুঁকলেন।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে! কতক্ষণ আর কতটা এমনি নামের আশ্রয়ে একাগ্র হতে পারলে ভিতরটাকে নিরাসক্ত নির্লিপ্ত করা যায়? হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ…। টেলিফোন।…হ্যালো। হ্যাঁ বুঝেছি। শুনুন বনবাবু, বই পেয়েছি। গুনে দেখেছি সমস্ত বইয়ে তিরিশটা ছাপার ভুল। আর আপনাকে বই দেব কিনা ভাবতে হবে। আপনার পাবলিসিটিও আমার খুব পছন্দ হচ্ছে না। যাক, পুরো তিন এডিশনের টাকা পাঠিয়ে দিন। আচ্ছা।…হরে রাম হরে রাম…বই লেখাটা নেশা না টাকা রোজগার নেশা? একটার সঙ্গে আর একটা। তফাৎ করা যায় না। যেমন গোলাপ আর তার গন্ধ। তফাং করা যায় না। এই পৃথিবীতে আসা কেন? গাদা গাদা বই লিখতে? আর টাকা রোজগার করতে? ঠিক আছে, অনেক ই অঢেল টাকা–তারপর কি? তারপরে কিছু না থাকলে ভিতরটা আশ্রয়। খোঁজে কেন? সেটা কেমন আশ্রয়? তার ঠিকানা কি? হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে…। টেলিফোন। হ্যালো…না, অনীতা বাড়ি নেই। জানি না। জানি না। ..মেয়েটার চালচলন আবার অন্যরকম ঠেকছে। আবার কার সঙ্গে গিয়ে ভিড়ল কে জানে? প্রায়ই এই গলার ফোন আসে। একবার ঘা খেয়েও মেয়েটার শিক্ষা হয়নি। বিকেলে বেরোয় রাত করে ফেরে। খুব বুদ্ধিমতী ভাবে নিজেকে। সকালের কাগজ খুলেই অঘটনের ছড়াছাড়ি। সেভাবে কাগজ পড়ে না, সাবধান হওয়ার দরকারও ভাবে না। অঘটনের বরাত যেন সব সময়েই অন্যদের, ওদের নয়!…শুধু মেয়ে কেন, ছেলেটাও কোন রাস্তায় হাঁটছে ঠিক নেই। মেয়েদের ফোন তো লেগেই আছে। বাপ প্রেমের গল্প লেখে আর বাপের পয়সায় খেয়ে ছেলে প্রেম করে। মা সেভাবে বেঁকে না বসলে একবার তো কোন যাত্রাপার্টির মেয়ে এনে ঘরে ঢুকিয়েছিল প্রায়! যাকগে, ভেবে কি হবে? যার যেমন অদৃষ্ট। হরে কৃষ্ণ হরে রাম, রাম রাম…। টেলিফোন। হ্যাঁ-লো।…হা শর্মাজী বলুন। ছবি সুপারহট শুনেছি। থ্যাঙ্ক ইউ, কিন্তু গল্পের পিছনে আপনি এভাবে লেগেছিলেন বলেই এতটা সাকসেস।…কোন গল্পটা? ও হ্যাঁ…না এখনো কনট্রাক্ট হয়নি, ফ্রী আছে। বেশ তো, কিন্তু এতবড় সাকসেসের পর নতুন গল্পে লেখকও একটু বাড়তি মর্যাদার আশা খে-হাঃ হাঃ হাঃ।…বাংলার সঙ্গে হিন্দীও কনট্রাক্ট হবে? ওয়া শুরফুল! ঠিক আছে, একটা দিন দেখে সকালের দিকে চলে আসুন, নময়ার নমস্কার।..বাংলা হিন্দী একসঙ্গে কনট্রাক্ট মানে খুব কম হলেও পঞ্চাশ হাজার টাকা। সাদা কালো আদাআধি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দক্ষিণের বাতাসটুক বেশ মিষ্টি লাগছে। বাঃ ভারী সুন্দর দেখতে তো মেয়েটা! ফর্সা লম্বা সুঠাম স্বাস্থ্য। মেয়েটা নয়, কারো ঘরের বউ হবে। রাস্তার অনেক জোড়া চোখ টেনে হেসে হেসে আর এক মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলেছে।…ধেং! সুন্দর মেয়ে মিষ্টি মেয়ে দেখতে সকলেরই ভালো লাগে–ভালো কথা। কিন্তু তিরিশ বছর আগের চোখ দিয়ে দেখা কেন? ছিঃ! হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে
পরদিন সকালে বেশ হাসি-হাসি মুখে ইন্দিরা ঘরে ঢুকলেন। তার হাতে একখানা এই বাংলা মাসিকপত্র। কাছে এসে ওটা খুলে প্রশান্তবাবুর সামনে ধরলেন। তাতে ছবিসহ অনন্য লেখক প্রশান্ত মিত্রর দ্রুত আরোগ্য-সংবাদ। ফাঁকে ফাঁকে তার প্রতিভার প্রশস্তি! বিশেষ করে তার চরিত্রচিত্রণ আর বিশ্লেষণ ক্ষমতার ঢালাও প্রশংসা।
হাসিমুখে এই বাংলা ইন্দিরাকে ফেরত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশান্তবাবুর কি মনে হল। চট করে উঠে কালো নোটবই আর কলমটা নিয়ে পাশের লেখার ঘরে। চলে গেলেন। এতে কিছু লিখে আবার চার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন।
ইন্দিরা অবাক একটু।–কি হল, এই থেকেই আবার নতুন কিছু প্লট মাথায় এসে গেল নাকি!
প্রশান্ত মিত্রর ঠোঁটের হাসিটুকু রহস্যের মতো। নোটবই যথাস্থানে অর্থাৎ ডেকে রাখতে রাখতে জবাব দিলেন, ওই তেলের প্লট নিয়ে গপপ তো কত বারই লেখা হয়ে গেছে!
.
দিন কুড়ি বাদে নীল আকাশ থেকে আচমকা বাজ পড়ার মতোই ঘটে গেল– ব্যাপারটা। লেখক প্রশান্ত মিত্র চিকিৎসার চার ঘণ্টা সময় দিলেন না। ডাক্তাররা বললেন, ম্যাসিভ স্ট্রোক। বাংলা সাহিত্য জগতে নিখাদ শোকের ছায়া নেমে এলো। প্রশান্ত মিত্র নেই।
দিন যায়। একটা মাস গড়ালো। শোকের স্তব্ধতা থেকে ইন্দিরাকেও আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতে হল। এই নিয়ম।
কদিন ধরে টেলিভিশনের লোক এসে এসে ঘুরে যাচ্ছে। তাদের প্রস্তাব, প্রয়াত অনন্য লেখকের সাহিত্যজীবন আর ঘরের জীবন নিয়ে স্বয়ং ইন্দিরা মিত্র একটা প্রোগ্রাম করুন। এই প্রোগ্রাম শত সহস্র দর্শক শ্রোতার কাছে পরম সমাদরের জিনিস হবে।
কিন্তু গোড়ায় গোড়ায় ইন্দিরা টিভির লোকের সঙ্গে দেখাই করেন নি। ছেলেমেয়ে অনুরোধ করেও ফিরে গেছে। আজ আবার এসেছে। সুশান্ত অনীতা দুজনেই তাগিদ। দিচ্ছে, নিচে এসে ভদ্রলোকের সঙ্গে একটু আলাপ করো না মা, এই নিয়ে তিন দিন এলেন।
-বসতে বল।
ইন্দিরা উঠলেন। পরনের শাড়িটা খুব পরিষ্কার নয়। বদলালেন। সেই মুহূর্তে স্বামীর সেই নোটবইটার কথা মনে হল তার। চরিত্রচিত্রণের প্রসঙ্গে কি-ভাবে না কেটে স্বামী কি করতেন, দেখাবেন।
বার করলেন। শেষের দিকের কটা দিন কি আঁকিবুকি করেছেন দেখার জন্য ওটা খুললেন। তারপরেই অবাক একটু। আঁকিবুকি নয়, লেখা। বিছানায় বসে পড়তে লাগলেন। যত পড়ছেন ততো গম্ভীর।
একেবারে শেষের কটা লাইন–ওপরে তারিখ দেওয়া। …মানুষের চরিত্র নিয়ে। সমস্ত লেখক জীবন ধরে যে এভাবে ভাওতাবাজী করে গেলাম, নিজেই জানতাম না। যে লোক নিজের চরিত্রের ঠিকানা জানে না, হদিস জানে না, সেই লোক অনন্য চরিত্রস্রষ্টা–এর থেকে হাসির ব্যাপার আর কি হতে পারে!
ইন্দিরা নিষ্প্রাণ স্তব্ধ মূর্তির মতো বসে আছেন। ছেলে আবার তাগিদ দিতে এলো, মা এলে না?
-না, চলে যেতে বল।
মায়ের এই মুখ দেখে আর তার হাতে এবার কালো নোটবই দেখে ছেলে স্মৃতির শোক ভাবল। বলল, তাহলে আর এক দিন আসতে বলি?
–কোন দিন না। আমার দ্বারা এ-সব হবে না বলে দে।
নোটবইটা হাতে নিয়ে ইন্দিরাই আগে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।