চকিত উত্তেজনা ঘোরালো হয়ে উঠতে পারত। সুবেশা, চোখে ঘোর-লাগানোরমণীর। অপমানে পথ-চলতি খদ্দেরের রোষ আরো লোক টেনে আনতে পারত। জনতার মেজাজ চড়লে ছোট দোকানের ছোট্ট আশা নির্মূল হতে পারত। তবু, কোনো পরিণাম না ভেবেই এই কাণ্ড করে বসল সদানন্দ।
পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়িয়ে একাগ্র মনোযোগে শৌখিন বেসাতির সামগ্রী সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছিল সে। আট-দশজন ফুটপাথের খদ্দের জিনিস দেখছে, যাচাই বাছাই করছে জেনেও ফিরে তাকায় নি। যেন দোকান গোছানোটাই আপাতত বড় কাজ। এমন কি তার অস্তিত্ব সম্বন্ধেও এই খদ্দেররা বা উৎসুক দর্শকরা সচেতন ছিল না। হঠাৎ হকচকিয়ে গিয়ে তারা ওই সতেরো আঠারো বছরের জোয়ান ছেলেটার কাণ্ডকারখানা দেখছিল, আর কটুভাষণ শুনছিল। আর উদগ্র বিস্ময়ে অতি আধুনিকাটির শুকনো বিড়ম্বিত মুখখানি পর্যবেক্ষণ করছিল। মেয়েটার আসল চেহারা বুঝে নিতে চেষ্টা করছিল তারা।
ফুটপাথ বিপনীর মালিক সদানন্দর দিকে কারো চোখ ছিল না। মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এই দ্বিতীয় নাটকের জন্যেও কেউ প্রস্তুত ছিল না।
ঘুরে দাঁড়িয়ে সদানন্দ আচমকা গর্জনে ছেলের টুটি কামড়ে ছিঁড়তে এল যেন। কৌতূহলী ক্রেতা আর দর্শকরা আঁতকে উঠল একেবারে। জোয়ান ছেলেটা হতভম্ব। এমন কি, যাকে কেন্দ্র করে এই পরিস্থিতি, সেই সুবেশা প্রসাধনপটিয়সী তন্বী-সদৃশাটিও বিমূঢ় হঠাৎ।
ছেলেকে যেন ছিঁড়েই ফেলবে সদানন্দ, গর্জে উঠে ছেলের দিকে ঝুঁকতে চেষ্টা করল সে।–চোপ! পাজী বদমাস অভদ্র ইতর কোথাকার, আজ তোকে আমি খুন করব! সরে আয় বলছি এদিকে, লোকের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতে পর্যন্ত শেখো নি উল্লুক কোথাকার, সরে যা ওদিকে! নইলে আজ তোকে–
তারপর খদ্দেরের ঘাড়ে পড়ার ভয়েই হয়ত উদ্যত ঘুসিটা নামিয়ে নিল। হতভম্ব ছেলেটাও কুঁকড়ে গিয়ে নিজের অগোচরে কোণের দিক ঘেঁষে বাপের নাগালের বাইরে সরে দাঁড়াল। চুপসে গেলেও তার বিস্ময়ের ঘোর কাটে নি।
দুহাত জুড়ে সদানন্দ কাকুতি মিনতি করে বলল–অপরাধ নেবেন না মা-লক্ষ্মী, ছেলের বাপের দিকে চেয়ে ওকে ক্ষমা করুন। এই পাঁচ টাকার নোটটা আপনিই দিয়েছিলেন তো… দিয়ে আপনি অন্য জিনিস দেখছিলেন দেখে আমি একটু এদিকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, ওই পাজীটা না দেখেই…ইয়ে, তাহলে পার্সটার দাম হল গিয়ে দুটাকা বারো আনা, আপনি ফেরত পাবেন গিয়ে দুটাকা চার আনা…
বলতে বলতে তাড়াতাড়ি কাঠের বাক্সটা খুলে একটা দুটাকার নোট আর খুচরো চার আন্ম–পয়সা মেয়েটির হাতে দিয়ে আবার হাত জোড় করল।–দোষ নেবেন না মা লক্ষ্মী, আপনারও খেয়াল ছিল না, আমিও ওদিকে জিনিস সামলাচ্ছিলাম…পাজী ছেলেটার কাণ্ডজ্ঞান নেই, এবারের মতো ক্ষমা করুন।
মা-লক্ষ্মী ক্ষমা করলেও সমবেত উৎসুক দর্শকরা হয়ত অত সহজে ক্ষমা করত, যদি না প্রসাধনবিলাসিনীটি অমন বিমূঢ় চোখে মলিন অথচ কমনীয়দর্শন প্রৌঢ়টির দিকে ফ্যালফ্যাল করে খানিক চেয়ে থেকে ফেরত টাকা ও খুচরো পয়সা ভ্যানিটি ব্যাগে পুরতে পুরতে দ্রুত প্রস্থান করত সেখান থেকে। আর, যদি না ছেলের অপরাধের দরুন অতটাই আন্তরিকতা ফুটে উঠত প্রৌঢ় সদানন্দর মুখে। উৎসুক দর্শকদের মধ্যে দুই-একজন মন্তব্য করতে ছাড়ল না তবু। ছেলেটার দিকে চেয়ে বলল-খদ্দেরের সঙ্গে বিশেষ করে মহিলার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করলে মারের চোটে হাড় গোড় গুড়োবে কোন দিন, দোকান করাও বেরিয়ে যাবে।….
আর একজন বলল–মেয়েটা ভালো তাই, নইলে থাপ্পড়ের চোটে দাঁত নড়ে যেত।
ছেলেটি সভয়ে বোবার মতো দাঁড়িয়েই আছে, সদানন্দর দুই হাত তখনো উত্তেজনাপিপাসু সমবেতদের উদ্দেশে যুক্ত। ফলে আর গণ্ডগোলের আশা ছেড়ে তারা একে একে চলে গেল।
রাত বাড়ছে। সাদাটে আলোর ছটায় মহানগরীর অভিজাত যৌবন বাড়ছে। নতুন খদ্দের আসছে, যাচ্ছে। বাঙালীর থেকে অবাঙালীর আনাগোনা বেশী এদিকটায়। যেতে আসতে তারা থমকে দাঁড়াচ্ছে। শৌখিন সিগারেট কেস দেখছে, পার্স দেখছে, ঘড়ির ব্যাণ্ড দেখছে, গগল্স দেখছে। শো-কেসে আর সামনের খোলা কেসে এ-রকম হরেক সখের সামগ্রী সাজানো আছে। এখানে কেনার থেকে দেখার লোকই বেশি। কিন্তু কিছু বিক্রী হলে অন্য জায়গা থেকে চড়া দামেই বিকোয়। কেউ দাঁড়িয়ে দেখছে, কেউ কিছু হাতে নিয়ে পরখ করছে, আর কেউ বা দাম জিজ্ঞাসা করছে। কিনছেও কেউ কেউ। দোকান আপাতত সদানন্দ একাই চালাচ্ছে। থমথমে মুখ। ছেলের দিকে একবারও তাকায় নি এতক্ষণের মধ্যে।
ছেলে বিষ্ণু ওধারের টুলটায় চুপচাপ বসে আছে সেই থেকে। তার দোকানের দিকে চোখ নেই, কে কি দেখছে বা নিচ্ছে সেদিকে লক্ষ্য নেই, সে শুধু বাপের দিকেই চেয়ে আছে। ঘুরে ফিরে বাপকেই দেখছে।
বাপের সেই আচমকা গর্জনে সে ঘাবড়ে গিয়েছিল, তারপর জনতার রাগের ফলাফল ভেবে সে ভয়ও পেয়েছিল। কিন্তু সব সত্ত্বেও কি যেন ভোজবাজীর ব্যাপার ঘটে গেছে একটা। গোটা ব্যাপারটা তার কাছে দুর্বোধ্য এখনো।
অনেকদিন শিকারীর মতো ওত পেতে থেকে আজ মেয়েটাকে ধরেছিল বিষ্ণু। তার স্থির বিশ্বাস ছিল হাতেনাতেই ধরেছে, গেল বারের মতো এই দিনেও সে দাম না দিয়েই জিনিস ব্যাগে পূরে চলে যাচ্ছে। বাবা অবশ্য বলে, গেল বারেও দাম দিয়েছে। কিন্তু বিষ্ণুর সন্দেহ যায় নি। গেল বারের সেই দিনে খদ্দেরের ভিড় একটু বেশি ছিল। দু-চারটে চলনসই রকমের সুশ্রী মেয়ে এসে দাঁড়ালেই দু-দশজন পুরুষও এসে দাঁড়ায়, সেটা বিষ্ণু লক্ষ্য করেছে। সেদিনও তাই হয়েছিল। ওই মেয়েটা কলম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। একটা কলম মোটামুটি পছন্দ হয়েছিল। একটু বাদে বিষ্ণু দেখে সেই মেয়েটাও নেই, কলমটাও নেই। বিষ্ণু তপ্তমুখে তক্ষুণি বাপকে বলল–ওই মেয়েটা কলমের দাম দিয়ে গেল না?
সাধারণ স্থলে উল্টে বকুনি খাবার কথা বিষ্ণুর। কিন্তু শোনামাত্র বাবা কেমন যেন। হকচকিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল–কোন কলমের দাম?…ও, দিয়েছে বোধ হয়।…হ্যাঁ দিয়েছে।
কিন্তু বিষ্ণুর সংশয় যায় নি। তার ধারণা মেয়েটা অত্যন্ত খারাপ, প্রায়ই তাকে এক একটা লোকের সঙ্গে কেমন ধরনের সাজগোজ করে ঘোরাফেরা করতে দেখে। অত রঙ-করা ঠোঁটের হাসি বিশ্রী দেখায়। দশহাত দূরের ওই যাদুলালের আইসক্রিম সোড়া লিমনেড আর সিগারেটের দোকানে সু-সঙ্গী প্রায়ই রাত নটা দশটার সময়েও দেখা যায় তাকে। দুজনেই সোডা লিমনেড খায়, কিন্তু সঙ্গী কি খায় এক নজর তাকিয়েই বিষ্ণু বুঝতে পারে। যাদুলালের দোকানে শৌখিন অবাঙালী খদ্দেরের ভিড় বেশি কেন, বিষ্ণু তা খুব ভালো করেই জানে। সোডা লিমনেডের বোতলে অন্য মালও রাখে সে। খদ্দের বুঝে বার করে দেয়। ওই রকম লোক যার সঙ্গী, সে আর কেমন মেয়ে হবে? এই বিরূপ ধারণা থেকেই বিষ্ণুর বিশ্বাস, কলমটা খোয়াই গেছে, দাম না দিয়েই মেয়েটা কলম নিয়ে সরে পড়েছে। বাবার খেয়াল নেই, তাই বলছে দাম দিয়ে। গেছে।
আজ আবার সেই মেয়ে যখন মেয়েদের শৌখিন পার্সগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করছিল –বিষ্ণু তখন থেকেই মনে মনে প্রস্তুত। সে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাবা পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে অন্য কাজ করতে লাগল বলে বিষ্ণুর মনোযোগ অত প্রখর। কিন্তু চেয়ে ছিল আর একদিকে, এই শ্যেন প্রতীক্ষা বুঝতে দিতে সে রাজী নয়। তারপর মেয়েটা পা বাড়াবার উপক্রম করতেই এক লাফে উঠে এসে সরাসরি হাত চেপে ধরেছিল। তার।
-দাম না দিয়ে ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছেন যে? দুটাকা বারো আনা দাম ওটার, অমনি নেবার জন্যে নয়–
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার পুরু প্রসাধন-খচিত মুখও বিবর্ণ। বিড়ম্বনার ভাব কাটাতে চেষ্টা করে শুকনো ব্যস্ততায় বলল–দাম দিই নি বুঝি, ভুল হয়ে গেছে।
তাড়াতাড়ি ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে দাম দেবার জন্যে তার মধ্যে হাত পুরে দিল। কিন্তু শূন্য হাতটাই উঠে এল আবার। এবারের বিস্ময় আরো শুকনো, আরো শঙ্কামিশ্রিত। এই যাঃ, নোটটা…আশ্চর্য, নোটটা তো
-নোটটা হাওয়া হয়ে উড়ে গেছে। সেদিন আমাদের চার টাকা দামের কলমটাও অমনি খোয়া গেছে আপনার হাতে, ওসব চালাকি রেখে দামটা গুনে দিয়ে। যান–
অন্যান্য খদ্দেররা উৎসুক হয়ে উঠেছিল। আর দু-পাঁচজন দাঁড়িয়েও গিয়েছিল। এরই মধ্যে বাবার ওই আচমকা গর্জন, আর ওই মূর্তি
.
রাত হয়েছে, আর একটু বাদে দোকান বন্ধ করে ঘরে ফিরবে তারা। সদানন্দ এতক্ষণ। বাদে ছেলের দিকে তাকালো হঠাৎ। মোলায়েম করে জিজ্ঞাসা করল–কি রে রাগ। হয়েছে খুব?
বাবাকে আজ বেশ কিছুদিন ধরেই বিমর্ষ, চিন্তাচ্ছন্ন দেখছে সে। ঘণ্টা আড়াই আগে আজ ওই ব্যাপার ঘটে না গেলে তার মুখের নিবিড় বেদনার ছায়াটাই হয়ত বিষ্ণু আগে লক্ষ্য করত। ওধারের টুল থেকে সে বাবার দিকে থমকে চেয়ে রইল একটু, তারপর ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করল–মেয়েটা টাকা দিয়েছিল?
সদানন্দ মাথা নাড়ল।…দেয় নি।
কিন্তু এই উত্তরটুকুই যে সব নয়, খেয়াল করল না। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল একটু। খানিক বাদে সচকিত হল। ছেলে তেমনি স্থির চোখে দেখছে তাকে। তার মনে পাঁচ রকমের প্রশ্ন উদয় হতে পারে, সেটা খেয়াল হল। এ-রকম একটা মেয়ের জন্য এই দরদ স্বাভাবিক নয়।
একটু থেমে আস্তে আস্তে বলল তোর একটা বোন ছিল তোর থেকে পাঁচ বছরের বড়। তোর মনে নেই, তোর মাত্র দু বছর বয়েস তখন।…এই মেয়েটাকে দেখার পর থেকে আমার কেবলই মনে হয়, মেয়েটা থাকলে এ রকমটাই হয়ত দেখতে হত…
মা-বাবার মনে কিছু একটা দুর্ঘটনার চাপা ব্যথা আছে, তার আভাস চিৎ কখনো ছেলে পায়। তবে জীবন ধারণের সতেরো ঝাটে থাকে বলে খেয়াল করে না। রাগ বা অভিমান ভুলে বিষ্ণু উদগ্রীব মুখে জিজ্ঞাসা করল–সে কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভাব বদলালো সদানন্দর। সংক্ষিপ্ত জবাব দিল-মরে গেছে।
একটু বাদে আবার অন্যমনস্কর মতো বলল–তোর মাকে এ সব বলিস না কিছু, বড় ভালোবাসত, মনে পড়লে খুব মন খারাপ হবে।
বাপের কথা শুনে বিষ্ণু মনে মনে নিশ্চিন্ত হল। বোন ছিল শুনে সে-ই কিনা ভেবে ঘাবড়ে গিয়েছিল। মরা মেয়েকে মনে পড়ার দরুন কতবড় বিপদে ফেলার ব্যবস্থা করছিল ওকে, সে-কথা ভেবে ভিতরে ভিতরে উষ্ণও হয়ে উঠল একটু। তবু এই নিয়ে আর আঘাত দিতে মন সরল না। বিষ্ণুর সব আক্রোশ গিয়ে পড়ল ওই মেয়েটার ওপর, যে মেয়েটা দু-দুবার ঠকিয়ে গেল তাদের। সব-জায়গায় এ-ই করে বেড়ায় নিশ্চয়। বাপের অসাক্ষাতে কোনোদিন বাগে পেলে দেখে নেবে। বয়েস হলে। লোকের, জ্ঞানগম্যিও কমে যায় বোধ হয়, চুরি করতে দেখেও কবেকার কোন মরা মেয়ের শোক উথলে ওঠে।
বাপ ছেলে দুজনে ঘরের উদ্দেশে পা বাড়িয়েছে। সামনের রাস্তাটা পার হবার মুখে এক সঙ্গে দুজনারই পা যেন মাটির সঙ্গে আটকে গেল হঠাৎ।
রাস্তার এক আড়ালে একটা দেয়ালের ধার ঘেঁষে সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। একা। তাদের দেখে দুপ এগিয়েও থমকে দাঁড়াল। বিষ্ণুর মনে হল তাকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেল। মনে হল, বাবার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে একা পেলে কাছে আসত, বলত কিছু।
তার জামাটা ধরে একটা টান দিয়ে রুক্ষস্বরে সদানন্দ বলল–দাঁড়ালি কেন, চল–
হন হন করে রাস্তাটা পার হয়ে গেল সে। দ্রুত পা চালিয়ে তবে বিষ্ণু বাপের নাগাল পেল।
ছেলেকে গোটাগুটি সত্য বলে নি সদানন্দ। মেয়ে সত্যিই মরে গেছে কিনা জানে না। সকলের অগোচরে স্ত্রী অনেক সময় গজগজ করেছে, কতকাল আর ওই পোড়ারমুখির জ্বালা বুকে চেপে বসে থাকবে, আর কতকাল ভাববে?
সদানন্দ কখনো চুপ, কখনো বলেছে–ও মরে গেছে শুনলে আর ভাবতাম না, জ্বালাও জুড়তে….
একটানা ষোলটা বছরের ঘাত-প্রতিঘাত গেছে এই জীবনের ওপর দিয়ে, তবু ক্ষতটা মনে হয় সেদিনের। একেবারে তাজা। সংসারের দুঃখে-দারিদে বরং অনেকটা ভুলেছে, কিন্তু সদানন্দ ভুলতে পারে নি। ছেলের কাছে যাই বল, সাত বছরের সেই দুরন্ত সুশ্রী মেয়েটা আসলে চোখের মণি ছিল তারই।
ওই মেয়েরও আগে ছেলে ছিল আর একটা। তারপর মেয়ে। মেয়ে হওয়ার পর স্ত্রীর স্বাস্থ্য ভেঙেছিল। পাঁচ বছর বাদে বিষ্ণু এসেছে। আর তার দুবছর যেতে কোলে। আর এক ছেলে এসেছে। এই তিন ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে সেই সচ্ছলতার দিনেও হিমসিম অবস্থা। মোটামুটি লেখাপড়া শিখেছিল সদানন্দ, পদ্মা-পারের একটা ছোট ব্যাঙ্কে কেরানীর চাকরি করত। বেতন সামান্য। তবু ভদ্রঘরের ছেলে সদানন্দ, ভদ্রবংশের সন্তান।
স্ত্রীর এক নিঃসন্তান বড় ভাই থাকত লাহোরে। তাদের তুলনায় বেশ অবস্থাপন্ন। দেশে কিছু হল না দেখে বিদেশে গিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল। খুব ছোট থেকে বড় হয়েছে। সে একবার পদ্মা পেরিয়ে এসে মাস খানেকের জন্য বোনের অতিথি। হল। মামার সঙ্গে ওই সাত বছরের মেয়ের ভারি ভাব হয়ে গেল। মিষ্টিমুখ মেয়েটা সকলেরই চোখে পড়ত। মামারও মন টানলো। বোনের অবস্থা দেখে নিজেই প্রস্তাব দিল, মেয়েটাকে সে নিয়ে যেতে পারে, মামীর কাছে মানুষ হবে, লেখাপড়া শিখবে। বছরে একবার করে না-হয় বাবা-মায়ের কাছে আসবে। আর তাহলে ভালো বিয়ে-থাও হবে মেয়ের।
স্ত্রী তক্ষুণি মেয়ে দেবার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠল। নিজেদের তো এমনিতেই দিন চলে না। মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের লোভ সে কিছুতেই সামলাতে পারল না। তাছাড়া নিঃসন্তান অবস্থাপন্ন বড় ভাইয়ের সঙ্গে এ-রকম একটা যোগাযোগ স্থাপিত হলে আখেরে অনেক দিকে সুবিধে হতে পারে।
কিন্তু সদানন্দ খুঁতখুঁত করেছিল। বড় ছেলেটাকে এমনকি দুবছরের ছেলেটাকে নিতে চাইলেও হয়ত তাতে অত মন খারাপ হত না। কিন্তু স্ত্রীর ভয়েই শেষ পর্যন্ত বাধ সাধতে পারল না সে।
ওরা রওনা হবার দিন সকালেই বাড়ি থেকে পালাল। ফিরে আ তে স্ত্রীও মন খারাপ করে জানালো, যাবার আগে মেয়েটা নাকি হাপুস নয়নে কেঁদেছে আর বাবাকে খুঁজেছে।
এর তিন মাসের মধ্যে মাত্র কয়েকদিনের জ্বরে বড় ছেলেটা চোখ বুজল। আর ছমাসের মধ্যে সমস্ত দেশের শান্তি লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। দেশ বিভাগের ফলে দেশের অগণিত মানুষের হৃৎপিণ্ড টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সমস্ত পরিবারটিকে টেনে হিঁচড়ে সদানন্দ যখন কলকাতায় এনে ফেলল, তখনো যেন বিকারের ঘোর কাটে নি। তখনো মনে হয়েছে কিছু একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে, এই নাড়ীছেঁড়া দুর্বিপাকের সবটাই সত্যি নয়।
স্নায়ুগুলো বশে আনতে অনেক সময় লেগেছে। এর ওপর জীবনধারণের রসদের চিন্তা করতে হয়েছে। আর, এরই মধ্যে এক একটা খবর কানে এসেছে। শুধু পূর্ববঙ্গে নয় অনেক জায়গাতেই মরণযজ্ঞের নরকোৎসব হয়ে গেছে। পাঞ্জাবে-লাহোরেও হয়েছে।
সম্বন্ধীর কাছে একে একে অনেকগুলো চিঠি লিখেছে সে, অনেক ভাবে খবর নিতেও চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা যেন দুনিয়া থেকেই মুছে গেছে। একটানা সোল বছরে তাদের একটা খবরও পায় নি।
.
দোকানের ওই অভিজাত এলাকায় মেয়েটাকে সে বিষ্ণুর আগেই দেখেছিল। মেয়ের সাত বছর বয়েসের সঙ্গে আরো ষোলটা বছর যোগ করে তাকে চেনার কথা নয়। সদানন্দ চেনে নি। এমন কি প্রথম দর্শনে বাঙালী মেয়ে বলেই মনে হয় নি তার। তাছাড়া, অবাঙালী সঙ্গীর সঙ্গেই ঘোরাফেরা করতে দেখছে তাকে। কিন্তু ওকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সদানন্দ চমকে উঠেছিল কেন? পদ্মাপারের সাত বছরের একটা মেয়ের। স্মৃতি বুকের তলায় আকুলি-বিকুলি করে উঠেছিল কেন?
আশ্চর্য! সদানন্দ জানে না কেন।
এখনো একটুও নিঃসংশয় নয়, হয়ত একটা উদ্ভট কল্পনা নিয়েই আছে সে। তবু মোহগ্রস্তের মতো নিজের অগোচরে ওই মেয়ের অনুসরণ করেছে, তার পিছু পিছু ঘুরেছে; ওর অসুন্দর জীবনযাত্রার চিত্রটি কল্পনা করে এক অস্বাভাবিক বেদনায় শ্বাস রুদ্ধ হয়েছে। তারপর কতবার সঙ্গীর সঙ্গে ওই মেয়ে পাশের সোডা-লিমনেডের দোকানে এসে দাঁড়িয়েছে, তার এখানেও এসেছে, দাম না দিয়ে কলম নিয়ে চলে গেছে, আর মানিব্যাগ নিতে গিয়ে ধরা পড়েছে। নিজের সঙ্গে অনেক যুঝেছে সদানন্দ, যুঝেছে আর ভাবতে চেষ্টা করেছে, সবই তার আজগুবী কল্পনা, নিছক মিথ্যে।
দুপুরের মধ্যে মেয়েটা অনেকবার দোকানের পাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করে গেল। আজ আর অত প্রসাধন নেই। মুখে চোখ-তাতানো সাজসজ্জা নেই। কি এক অমোঘ আকর্ষণেই মেয়েটা যেন বার বার এই ফুটপাথ দিয়ে আসা-যাওয়া করছে। আর, প্রতিবারই খুব ভালো করে লক্ষ্য করছে সদানন্দকে। কিন্তু ভরসা করে কাছে আসছে। না, আসতে পারছে না।
সদানন্দ সমস্ত মুখ থমথমে গম্ভীর। তার গালের একটা দিক ওই মেয়েটার দৃষ্টির ঘায়ে কটকট করে উঠছে–যেখানে পুরনো পোড়ার বড় ক্ষতচিহ্ন রয়েছে একটা। সাত বছরের মেয়ে সারি করে বাপের তামাকের জ্বলন্ত কলকেয় ফুঁ দিতে নিয়ে এসেছিল। সদানন্দ শুয়েছিল তখন। গরম সামলাতে না পারার দরুন সেই আগুনসুদ্ধ কলকে বাপের গালের ওপর পড়েছিল। একটা মস্ত অঘটনই ঘটে যেতে পারত। মা মেয়েটাকে মেরে একেবারে আধমরা করেছিল সেদিন।
ছেলে বিষ্ণু সকাল থেকে বারকতক মেয়েটাকে লক্ষ্য করেছে, আর আড়ে আড়ে বাপকে দেখছে। আজও মেয়েটার ওপর মনে মনে জ্বলছে সে।
দুপুরে সদানন্দ উঠে বড় রাস্তার ওধারের পুকুরটার দিকে চলল। রোজই দুপুরে সেখানে গিয়ে গাছের ছায়ায় খানিক বসে জিরোয়। মাছ-ধরা দেখে, কখনো বা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়।
বাধা পড়ল। মেয়েটা আজও যেন তার প্রতীক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। এখনো খায়। নি বোধ হয়। মুখ শুকনো। কিন্তু শুকনো মুখেও কি এক আশার তাড়না স্পষ্ট যেন। সদানন্দ দাঁড়িয়ে গেল, পায়ে পায়ে মেয়েটা তার দিকেই এগিয়ে আসছে।
সামনে এসে দ্বিধা কাটিয়ে মেয়েটা বলল–আপনি কাল আমাকে বাঁচালেন কেন? আমি তো সত্যি পার্সটা চুরি করেছিলাম…।
সদানন্দর জানা দরকার, সদানন্দর বোঝা দরকার কতখানি উদ্ভট কল্পনায় ডুবে আছে সে। মেয়েটাকে খুব ভালো করেই দেখল। দেখে আঁতকে উঠল। ঘষা মোছা প্রসাধনের আড়ালে যেন এক আর্তনারী সম্বল খুঁজছে–আশ্বাস চাইছে। মুখে বলল–আমার একটা ছোট মেয়ে ছিল, মনে হয়েছে, বড় হলে সে তোমার মতোই হত–এই জন্যে।
মেয়েটার দুই চোখে শুকনো মুখে আগ্রহের আলো জ্বলে উঠল যেন। গালের ক্ষতচিহ্নটার দিকে চেয়ে কি এক বিস্মৃতির পরদা আকুল আগ্রহে ছিঁড়েখুঁড়ে সরাতে চেষ্টা করছে সে। জিজ্ঞাসা করল–মেয়েটা কোথায়? হারিয়ে গেছে?
সদানন্দর না জানলেই নয়, সংশয় না, ঘুচলেই নয়। মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, তাই।
–কোথায় ছিল সে? কোথা থেকে হারিয়েছে?
সদানন্দর মনে হল, এমন মর্মছেঁড়া আকুতি সে আর দেখে নি। মনে হল, জীবনের সব সম্বল, সব আশা খুইয়ে এক মুমূর্য নারী যেন শেষ আশায় দুহাত বাড়িয়ে তাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে। সদানন্দ-নীরব। দেখছে।
–কি নাম ছিল তার? তার নাম কি…তার নাম কি…
আবার কি যেন স্মরণ করার প্রাণান্তকর চেষ্টায় চোখমুখ কুঁচকে গেল তার। তারপরেই উদ্ভাসিত হঠাৎ–তার নাম কি ঝুমুর?
একটা ঝাঁকুনি খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল সদানন্দ। আত্মস্থ হল। দিশা ফিরল। কঠিন বাস্তবের ওপর দুই পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। ঠাণ্ডা নির্লিপ্ত মুখে মাথা নাড়ল। নাম ঝুমুর ছিল না। ঈষৎ রুক্ষ কণ্ঠে বলল–তুমি এ-রকম করছ কেন? আমার মেয়ে তো মরে গেছে–অনেক কাল আগেই মরে গেছে, বুঝলে?
মুহূর্তের মধ্যে সব আশা আর সব আগ্রহের অবসান হয়ে গেল। নিঃসাড় বিবর্ণ পাণ্ডুর মুখে মেয়েটা চেয়ে আছে তার দিকে। সদানন্দ আর অপেক্ষা করল না। কোথায় যাচ্ছিল ভুলে গেছে। দোকানেই ফিরে এল আবার।
তারপরেও মেয়েটা বার কয়েক এখান দিয়ে যাতায়াত করেছে। খুব সচেতন ভাবে নয়। চেয়ে চেয়ে দেখেছে। তাও আত্মবিস্মৃতের মতোই। তার যেন এখনো কিছু বুঝতে বাকি, জানতে বাকি।
.
রাত্রি।
আর একটু বাদেই দোকান গুটোবে তারা। বিষ্ণু সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল, কারণ দোকান বলতে গেলে আজ একাই চালাতে হয়েছে তাকে। এই ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকেও বাবার মুখের দিকে চেয়ে কেমন শঙ্কা বোধ করেছে। বাবার এমন অন্যমনস্ক গাম্ভীর্য আর যেন দেখে নি সে।
হঠাৎ রাস্তার ওধারে অদূরের পুকুরটার দিকে একটা গণ্ডগোল উঠল। লোকজন দৌড়োদৌড়ি ছুটোছুটি করতে লাগল। বড় রকমের উত্তেজনার কিছু একটা ব্যাপার ঘটেছে ওইখানটায়। ভিড় বাড়ছে, পুলিশও দৌড়চ্ছে দেখা গেল।
বিষ্ণুও ছুটল কি ব্যাপার দেখতে। বিশ পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে ফিরে এল আবার। দুচোখ কপালে তুলে বলল–বাবা, সেই বদমায়েস ইয়ে, সেই মেয়েটা জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে, তার লাশ তোলা হয়েছে দেখে এলাম–
– আরো কি বলতে গিয়ে বিষ্ণু বাপের মুখের দিকে চেয়ে থমকে গেল হঠাৎ।
সদানন্দ অন্যদিকে চোখ রেখে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে।