জানালার তলার পাট দুটো বন্ধ করে দিয়ে সেখানে বসে বসে মালা ভাবছিল, পুরুষের কি হৃদয় বলে বস্তু নেই?
মামার কথাগুলো মালা শুনেছে। এক মামী ছাড়া আর কারো শোনার কথা নয়। মামীকেই বাইরে দরজার আড়ালে পরদার এধারে দাঁড়িয়ে বলছিল। মালাও শুনছিল। তার শোনার তাগিদ ছিল। তার হাতে মামার জন্যে এক পেয়ালা দুধ ছিল। কেউ দেখে ফেললেও কিছু ভাবত না।
বেশী কিছু কথা নয়। মামা বেশী কথা বলে না। ও-বাড়িতে গিয়েছিল। ছেলের সঙ্গেই কথা হয়েছে। ছেলে দু-চার কথায় তাকে বিদায় করেছে। তার জ্যাঠামশাইয়ের অনুপস্থিতিতে তদবিরে গিয়েছিল বলেও প্রচ্ছন্ন বিরক্তি প্রকাশ করেছে। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, জ্যাঠামশাইয়ের বিবেচনার ওপর আর কারো কোনো কথা নেই। কিছু অনুরোধ করার থাকলে তাকেই বলা দরকার।
মামা তবু আশা ছাড়তে পারে নি, তবু চলে আসতে পারে নি। বলেছে–তার কাছেই তো যাব বাবা, তবু তুমি মেয়েটিকে একবার দেখো না।
মামার শেষ আশা, তাকে ডেকে এনে সামনাসামনি একবার দেখাতে পারলে আর তারপর ঘরের অবস্থাটা খোলাখুলি ব্যক্ত করতে পারলে হয়ত শুভ সম্ভাবনাটা একেবারে ভেস্তে নাও যেতে পারে।
ছেলে কিন্তু সাফ জবাব দিয়েছে, তার দরকার নেই। সে স্পষ্টই বিরক্ত হয়েছে। ঘর থেকে চলে যেতে বলতে পারে নি। গম্ভীর মুখে নিজের কাজ নিয়ে বসেছে। সেটুকুই যথেষ্ট ইঙ্গিত। মামা চলে এসেছে।
মামা অপমানিত বোধ করেছে। যেটুকু করেছে, দায় উদ্ধারের আশাতেই করেছে। আর মামীর তাড়ায় করেছে। এতদিন এই চেষ্টা করছিল না বলে মনে মনে মালাই ক্ষুণ্ণ হয়েছিল মামার ওপর। তার স্থির বিশ্বাস ছিল আসল লোকটার কাছে গিয়ে পড়লে তার জ্যাঠামশাইয়ের হিসেবনিকেশ সব শূন্যে মিলিয়ে যাবে। টাকা চাইলেই আকাশ থেকে টাকা পড়ে না, সেটা সে অন্তত বুঝবে। আজ সকালেও মনে মনে মামা-মামীর বুদ্ধির তারিফ করছিল সে। তারা যে ওই জ্যাঠামশাইটির অনুপস্থিতির প্রতীক্ষায় ছিল, আগে বোঝে নি। কাল রাতে নমিদি কথায় কথায় বলে গেছে, বাবা মক্কেলের কাজে চার-পাঁচদিনের জন্যে বাইরে গেছেন। ..মামা একদিনও সময় নষ্ট না করে আজই। গেছে।
রাগে দুঃখে চোখে জল আসার উপক্রম মালার। দাঁতের চাপে নীচের ঠোঁটটা কেটে বসার উপক্রম। হতাশার প্রথম ধাক্কায় আগে মামার অপমানটাই বুকে বিঁধেছে। এভাবে চেষ্টা করার ফলে মামাকে প্যাচালো লোক ভেবেছে ওরা। কিন্তু মামার মতো লোক যে হয় না, সেটা তার থেকে আর কে বেশী জানে।
বে-সরকারী কলেজের অধ্যাপক বিমলেন্দুবাবু।…বিমলেন্দু বসু। বয়েস হয়েছে। দীর্ঘকাল যাবৎ লো-প্রেসারে ভুগছেন। খাটুনি বেশী বলেই হয়ত। কলেজের পুরনো মাস্টার, মাইনে মন্দ নয় একেবারে। কিন্তু এ-বাজারে কিছুই নয়। তার নিজের সংসারটিও ছোট নয় একেবারে। তার ওপর দুবছর হল চারটে ভাগ্নে-ভাগ্নী আশ্রিত। কলেজের খাটুনি, বাড়িতেও দুবেলা ছেলেরা আলাদা মাইনে দিয়ে পড়তে আসে। তার ওপর ফাঁক পেলেই নিজের পড়াশোনা। মালা এক-একসময় অবাক হয়ে ভাবে, মামার রক্তচাপ তো বাড়ার কথা, মাথায় সর্বক্ষণ রক্ত উঠে থাকার কথা!
মালার বাবা এক মফঃস্বল ইস্কুলের সহকারী হেডমাস্টার। কড়া নীতিবাগীশ, সাদাসিধে বেশবাস, মাথার চুল কদম-ছাট। তাঁর নীতির দাপটে ইস্কুলের ছেলেরা ভয়ে জড়সড়-বাড়িতে ছেলে-মেয়েরাও। দুই ছেলে দুই মেয়ে। মেয়ে দুটি বড়। মফঃস্বল ইস্কুলের সহকারী হেডমাস্টারের মাইনে সেই রকমই। মাসের শেষে সংসারের প্রায় অচলাবস্থা হত। সেই কারণেও মেজাজ সব সময় চড়া থাকত ভদ্রলোকের। তার স্ত্রী, অর্থাৎ মালার মা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিনই তাকে সংসার চালাতে না-জানার খোঁচা খেতে হয়েছে। বছর তিনেক হল ভদ্রমহিলা চোখ বুজেছেন।
আর বছর দেড়েক হল নীতিবাগীশ লোকটি সংসার চালনায় পটু নতুন ঘরনী এনেছেন। নতুন কী এসে অনটনের সংসারে ওই ছেলেমেয়েগুলোকে বাড়তি আপদ ভিন্ন আর কিছু ভাবেন নি। অমন বয়সের একজনের ঘরে আসার ফলে একটু বেশী সুখস্বাচ্ছন্দ্য আর আরাম তার পাওনা বলেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু চার-চারটে মুখ সামনে হাঁ করে আছে, সুখস্বাচ্ছন্দ্য জুটবে কোথা থেকে? অতএব তারও মেজাজের সমাচার খুব কুশল ছিল না।
ছেলেমেয়েগুলোর দুরবস্থার কথা তাদের মামা বিমলেন্দুবাবু প্রথম শুনেছিলেন। এক বন্ধুর মুখে। ভগ্নীপতির আবার বিয়ে করার খবরটাই মস্ত ধাক্কা তার। বোনটাকে ভালোবাসতেন তিনি–অনেক ছোট তার থেকে। তারপর যে-খবর শুনলেন, যদিও সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয় খুব, কিন্তু তার আংশিক সত্য হলেও স্থির থাকা কঠিন।
বিমলেন্দুবাবুর অস্থিরতা লক্ষ্য করে তার স্ত্রী-ই একদিন জোরজার করে তাকে দেখতে পাঠালেন। সৎমা এলেই পাঁচজনে পাঁচরকম সন্দেহের চোখে দেখে, তিলকে তাল করে।
বিমলেন্দুবাবু গেলেন, আর বেড়াবার নাম করে ভাগ্নে-ভাগ্নীদের একেবারে সঙ্গে করে ফিরলেন। তাঁর স্ত্রী আড়ালে যেটুকু শুনলেন তাতেই তার চোখে জল আসার উপক্রম। শুধু বললেন–নিয়ে এসে ভালো করেছ, এমন নির্লজ্জও মানুষ হয়!
দুবছর হল মালারা এসেছে এখানে। ষোল বছরে এসেছিল, এখন তার বয়েস আঠার। নিরাশ হবার মতো বয়েস নয় একটুও। গলির ওধারে ওই মস্ত দালানের ওই ঘরের লোকটা তাকে বাতিল করে দিলেও না। দুবছর ধরে এই কোণের জানালার। এখানটাই প্রধান আশ্রয় মালার। বারান্দার রেলিংয়ে গিয়ে দাঁড়ালেই বাঁয়ের দালানের পাজামা-পরনে ছেলেটার যেন রাস্তা দেখার দরকার হয়ে পড়ে। আর কোণঘেঁষা ডাইনের বাড়িটার ফেত্তা দিয়ে কাপড়-পরা সঙ্গীতজ্ঞ পুরুষটিও চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মালাকে শুনিয়ে শুনিয়ে গান ভাঁজতে থাকে। অন্ধকার রাত না হলে মালার বারান্দায় দাঁড়ানো হয় না। আর রাতেও দেখা যাক না যাক, সে দাঁড়িয়ে আছে অনুভব করলেই দুদিক থেকে দুজনের আবির্ভাব ঘটে।
অতএব ঘরের কোণের জানালাটাই ভরসা মালার। সেখানে বসেই পড়ে বা বোনে, বা যা হোক কিছু করে। কখনো কপাট খোলা থাকে জানালা দুটোর, কখনো বা নিজের সুবিধেমতো একটু আধটু। সবটা খোলা থাকে যখন গলির ওধারের ও-ঘরের বাসিন্দাটি অনুপস্থিত। জানালার এই কোণটি থেকে নীচের ওই ঘরটার ভিতরসুদ্ধ দেখা যায়। ওটা ঘর ঠিক নয়, বড় একটা হলঘরের মতো। ঘরের মধ্যে কাজের কত রকম সরঞ্জাম, কত রকমের ছবি। হলঘরের ভিতর দিয়ে যে ঘরটার আভাস, সেটা শোবার ঘর।
এই হলঘরটা রহস্যের মতো লাগে মালার। দুবছর ধরেই তাই লাগছে। সেখানে ঘরের মালিক যখন কর্মনিবিষ্ট, মালার এই কোণের জানালাটা তখন অল্প ফাঁক থাকে। ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে অবাক বিস্ময়ে দেখে মালা। অত নিবিষ্টচিত্তেও কাজ করতে পারে কেউ! সমস্ত দুনিয়াটা যেন অনুপস্থিত লোকটার কাছে। উপস্থিত শুধু ওই মস্ত ফ্রেমটা, আর তাতে আঁটা ক্যানভাসটা, আর পাশের রঙ-তুলি আর জলের বাটি। কখন নতুন ক্যানভাসে রঙ ছোঁয়ানো হল, আর কবে সেটা শেষ হল, মালা তার পুঙ্খানুপুঙ্খ জানে। কিন্তু কি শেষ হল, সেটা জানার উপায় নেই। জানার জন্যে ছটফটানিরও শেষ নেই। ইচ্ছে হয় ছুটে গিয়ে দেখে আসে। লোকটার মুখের তৃপ্তি দেখে বা বিরক্তি দেখে শুধু বুঝতে পারে, কোনটা মনের মতো হল, আর কোনটা হল না।
ইচ্ছে করলেই মালা ওই ঘরে ঢুকতে পারে, ইচ্ছে করলেই দেখতে পারে। নমিদি তো কতদিন তাকে যাবার কথা বলেছে। এই বয়সেই এত লজ্জা দেখে রাগ পর্যন্ত করেছে। কিন্তু রাজ্যের সংকোচ মালার। আর ওই ঘরে ঢোকা! বাবা রে বাবা! নমিদি। বলেছে, যখন তখন গৌতমদার ঘরে ঢুকলে তাকে সুষ্ঠু নাকি রাগ করে ঘর থেকে বার করে দেয়। আঁকা-টাকার গল্প উঠলে তার গৌতমদার প্রশংসায় নমিদি পঞ্চমুখ। তার মতে অমন শিল্পী আর আছে কিনা সন্দেহ! নমিদির থেকে মাত্র তিন বছরের। বড় খুড়তুতো দাদাটি। ওই বাড়িটার অর্ধেক মালিক। নমিদি এম. এ. পড়ে। তার এই দাদা বি. এস-সি. ডিস্টিংশনে পাস করে আঁকার কলেজে ঢুকেছিল। সেখানেও আগাগোড়া ফার্স্ট। এই বয়সেই এখন সেই আঁকার কলেজে মাস্টারি করে। অবসর সময় ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের কাজ করে।
মামীর সঙ্গে খুব ভাব নমিদির। প্রায়ই গল্প করতে আসে। মালা যায় না বলে মামীকে অনুযোগ করাতে মামী অনেক দিন ঠেলে পাঠাতে চেষ্টা করেছেন তাকে। সে-চেষ্টার পিছনে মামীর একটু আশাও ছিল। মালা শেষে নমিদিকে বলেছিল–পরীক্ষাটা হয়ে গেলে যাবে।…নমিদি হেসে ফেলেছিল–এখান থেকে লাফালে আমাদের ঘরে। গিয়ে পড়বে-পরীক্ষার জন্য যেতে পারছ না?
পরীক্ষা, অর্থাৎ স্কুল ফাইন্যাল পরীক্ষা। মামাই তোড়জোড় করে ওর পড়াশুনার ব্যবস্থা করেছিলেন আর অন্য ভাইবোনগুলোকে স্কুলে ভরতি করে দিয়েছিলেন। ওর পরীক্ষার পর নমিদিরাই দু-তিন মাসের জন্য কোথায় যেন গিয়েছিল। কিন্তু মালা তারপর যাবে কি, লজ্জায় মুখ লুকোতে পারলে বাঁচে–সে থার্ড ডিভিশনে পাস করেছে।
পাস করার পরেও তাকে কলেজে ভর্তি করানো যায় নি। তার লজ্জাই বেশী। মামা আবারও বাড়িতে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিন্তু পড়াশোনা মালার কমই হয়। সামনে বই খোলা থাকে, এই পর্যন্ত। চোখ থাকে আধ-পাটখোলা জানালার ভিতর দিয়ে গলির ওধারের ওই বড় ঘরটার দিকে। খুব ক্লান্ত লাগলে লোকটা তুলি-টুলি ফেলে হাত-পা ছড়িয়ে সিগারেট টানতে থাকে। আর সিগারেট একবার ধরল তো একেবারে দুটো তিনটে খাবে। মালা শুনেছিল বেশী সিগারেট খেলে গলায় ও বুকে অনেক সময় ব্যামো হয়। মালা ভুরু কোঁচকায়, কেন, কি দরকার অত সিগারেট খাবার!
জানালাটা যে সব সময় একেবারে মাপমতো বন্ধ থাকে তা নয়। এক-আধ সময় হয়ত খোলাই থেকে যায় অনেকটা। কাজে মন দিলে কোনোদিকে তো আর তাকাবে না লোকটা তাই সব সময় সতর্ক থাকার প্রয়োজন হয় না মালার। ফলে এক-একদিন দেখা হয়ে যায়, চোখখাচোখি হয়। তখনো খুব যে খেয়াল করে দেখে ওকে, মনে হয় না। মালা অবশ্য জানালাটা ঠেলেই দেয়। নমিদির মুখে নাম শুনেছে, গৌতম। গৌতমই বটে। মালার এক-একদিন ইচ্ছে হয়, স্কুল ফাইন্যালের ইতিহাস বইটা এনে গৌতমের ধ্যান অধ্যায়টা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ে। তারপর উদ্ভট ইচ্ছেটার কথা ভেবে নিজের মনেই হেসে বাঁচে না।
একদিন মালার দুই চক্ষু বিস্ফারিত। জানালা বন্ধ করতেও ভুল হয়ে গেল। একি কাণ্ড! ছোট ছেলের মতো একতাল কাদামাটি ছানাছানি করছে লোকটা। তাই দিয়ে কিছু একটা গড়তে চেষ্টা করছে, আবার তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে কাদার তালটাকে কিছু একটা আদলে আনার চেষ্টায় হাল ছেড়ে শেষে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। মালার তখনো খেয়াল নেই, সে হাঁ করে দাঁড়িয়েই আছে। লোকটার মুখে হাসির আভাস দেখে খেয়াল হয়েছে, হুড়মুড়িয়ে ছুটে পালিয়েছে সেখান থেকে।
মামী একদিন নমিদির কাছে ভাগ্নীর বিয়ের ভাবনাটা প্রকাশ করে ফেললেন। মালা কাছেই ছিল। নমিদির মন্তব্য কানে এল–ওর জন্যে আপনার ভাবনা কি, ওই চেহারার মেয়ে কটা হয়, যে দেখবে সেই লুফে নেবে।–এরপর আর একদিন মনের। বাসনাটা নমিদির কাছে প্রকাশই করে ফেললেন মামী। বললেন, দুরাশা তো বটেই, তবু ভাগ্নীর ওই চেহারাটুকুর জন্যেই ভরসা করে প্রস্তাবটা করা। গৌতম সোনার টুকরো ছেলে, এমন ভাগ্য তাদের হবার নয়, তবু নমি যদি তাদের মুখ চেয়ে একটু চেষ্টাচরিত্র করে, যদি তার বাবাকে একটু বলে কয়ে দেখে।
রূপের যতই প্রশংসা করুক, এই আশা তারা করতে পারে সেটা নমিদি ভাবে নি বোধহয়। দূর থেকে তার মুখ দেখে সেই রকমই মনে হয়েছিল মালার। তবে কথা দিয়েছিল, বলে দেখব।
বলেছিল। কিছুদিনের মধ্যেই ভাইপোর জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখে গেলেন। নমির মা-বাবা। মেয়ে যে তাদের পছন্দ হয়েছে সেটা সেখানেই তারা নির্দ্বিধায় বলে গৈলেন। মেয়ে মোটামুটি তারা নিজেদের ঘরে বসেই অনেকদিন ধরে দেখে আসছেন। সুখের ঘরে রূপের বাসা, কিন্তু এই ঘরে এই রূপ এল কেমন করে, তাই বোধ হয় মনে মনে অবাক হয়ে ভাবতেন তারা।
বিমলেন্দুবাবুকে কথাবার্তা বলার জন্য বাড়িতে আসতে বলা হল। মস্ত আশা নিয়ে তিনি গেলেন। কিন্তু তারপর মুখ অন্ধকার। আলোচনার ছলে মোটামুটি একটা ফর্দ পেশ করলেন নমির বাবা। সেই ফর্দ বিমলেন্দুবাবু তার নিজের দুটো মেয়ের বিয়েতেও মেটাতে পারতেন কিনা সন্দেহ। তার ওপর নগদ তিন হাজার এক টাকা পণ। দায়দায়িত্ব সবই জ্যাঠার যখন, ছেলেটা কোনোদিন না ভাবে জ্যাঠা তার পাওয়া থোয়ার ব্যাপারে উদাসীন ছিল।
বিমলেন্দুবাবুর মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। লো-প্রেসার কি হাই-প্রেসার বুঝছিলেন না। একটু সুস্থির হয়ে প্রথমে মেয়ের বাপের বাড়ির, পরে নিজের বাড়ির সংসারের চিত্রটা তার চোখের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেন–আপনাদের দয়ার ওপর নির্ভর
নমির বাবা নিরাসক্ত মুখে জবাব দিয়েছেন–তাহলে আর কি হবে।
তবু একটু অনুনয় করতে যাচ্ছিলেন বিমলেন্দুবাবু, কিন্তু ভদ্রলোক সেটা পছন্দ করেন নি। বলেছেন–এ নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি
না, কথা আর বাড়ে নি। তারপর মামীর তাড়নায় পড়ে এই শেষ চেষ্টাটা করেছিলেন বিমলেন্দু। ছেলেকে একবার এনে দেখানোর চেষ্টা। তারও এই ফল।
জানালা থেকে উঠে বাইরের বারান্দার রেলিংয়ে এসে দাঁড়াল মালা। এদিকে পাজামা-পরা লোকটা আর ওদিকের গায়ক গুটি-গুটি এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে টের পেল। দুদিকের দুজোড়া চোখ তাকে গিলছে, তাও উপলব্ধি করল। কিন্তু মালা ভাজ এই প্রথম দাঁড়িয়েই রইল। নির্লিপ্ত, উদাসীন। জগৎটাই যেন মৃত মূৰ্ছাতুর হয়ে পড়ে আছে তার সামনে।
এর মাস সাতেক বাদে এ-সংসারের সব থেকে অভিনব বিয়োগান্ত নাটকটা সুসম্পন্ন হয়ে গেল। মামা চোখ বুজলেন। লো-প্রেসারের স্ট্রোক। তিন দিন অজ্ঞান হয়ে ছিলেন। জ্ঞান আর হয়ই নি। মামী ডাক ছেড়ে কেঁদেছিলেন। মালা কাঁদতে পারে নি। কাঁদবে কেমন করে, কান্না শোনার কান কি ওই বিশাল বিস্তৃত মহাকাশে কোথাও আছে?
.
এ-কাহিনীর শেষ অধ্যায়ের সূচনা দশ বছর বাদে।
শহরের অভিজাত অঞ্চলে হয়ত সব থেকেই অভিজাত আদব-কায়দার হোটেল ওটা। এখানে পকেটের রসদের হিসেব কষে কেউ ঢোকে না। হিসেব জিনিসটাই অচল এখানে। এখানকার রাতের অঢেল যৌবন। এখানকার আলোর কণায় কণায় যৌবনের নেশা। বাঙালী মাদ্রাজী পার্শী শিখ নেটিভ-সাহেব খাস-সাহেব–সকল জাতের সকল বর্ণের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষদের অবসর-বিনোদনের বা শ্রান্তি-ক্লান্তি মোচনের জায়গা এটি। অর্থকৌলীন্যে যিনি যত বেশী মেজাজী কুলীন, তার তত সহজ আনাগেনা এখানে।
আইন? কানুন? সে-সবের কড়াকড়ি ছোট জায়গার জন্যে। বড় জায়গার স্পেশ্যাল পরোয়ানা। প্রয়োজন দেখাও, টাকা ঢালো–পরোয়ানা মিলবে। হোটেল কর্তৃপক্ষ রাতের মিয়াদ ভোরের দিকে টেনে নেবার জন্যে পরোয়ানা সংগ্রহে পিছ পা নয়, টাকা ঢালতে গররাজী নয়। কারণ তারা ঘরের টাকা ঢালছে না।
গৌতম দত্তর ছোট গাড়িটা হোটেলের সামনের ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়াল যখন, রাত তখন দশটার ওধারে। নিজেই ড্রাইভ করে। না, সে নিয়মিত আগন্তুক নয়। এখানকার। যা সে খুঁজছে, একজন বন্ধু তার হদিস দিয়েছিল। বলেছিল, দেখ গে, পছন্দ হবে হয়ত, যদি রাজী করাতে পার—
আজ নিয়ে পর পর এই তিন দিন আসছে সে। দুদিনই দেখা পেয়েছে, আজও পাবে হয়ত। পছন্দ হয়েছে। যতটা চেয়েছিল তার থেকেও বেশী পছন্দ। কিন্তু আলাপ করা হয়নি। প্রস্তাব করা হয়নি। চেয়ে চেয়ে দেখেছে শুধু।
এখানকার ক্ষণ-সহচরীদের একজন। বাঙালী মেয়ে। বাঙালী মেয়ে বোধহয় এই একজনই আসে এখানে। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান আছে, পার্শী আছে–সুন্দরীও বটে। সুন্দরী না হলে এখানে ঠাই মেলে না। শুধু রূপ থাকলে হবে না, বেশবাস, আচার-আচরণ, কথাবার্তায় সূক্ষ্ম মার্জিত রুচিবোধ থাকা চাই। তা-ই আছে সকলের। কিন্তু আর কারো দিকে চোখ পড়ে নি গৌতম দত্তর। ওই একটি মেয়ে ছাড়া। আশ্চর্য, এমন মেয়েও আসে এখানে!
গৌতম দত্ত নামজাদা শিল্পী। তার ছবি, তার মডেলিংয়ের আলাদা মর্যাদা। কিন্তু সম্প্রতি মডেলই খুঁজে বেড়াচ্ছে সে। মনের মতো মডেল। যে মডেল পেলে আন্তর্জাতিক সমঝদারদেরও টনক নড়বে। অনেকবার অনেক মডেল নিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু তেমন মন ওঠে না। শিল্পী নিজে মুগ্ধ না হলে, মুগ্ধ করবে কাকে? মন না ভরলে, গড়ার চেষ্টা বিড়ম্বনা। এজন্যে টাকা খরচ করতেও প্রস্তুত সে।
আগের দুদিন যেখানে বসেছিল আজও সেই কোণটাই বেছে নিয়ে বসল। বিয়ারের অর্ডার দিল। এখান থেকেই মেয়েটিকে দেখেছে দুদিন। আজও দেখছে। মুখখানা গত দুদিনের মতোই চেনা-চেনা লাগছে। একজন ফিটফাট শিখ তরুণের সঙ্গে হাসিমুখে কথা কইছে মেয়েটি। আর এক-আধবার ঘাড় ফিরিয়ে ওকেও দেখছে। আগের দিনও দেখেছিল।
গৌতম দত্ত অল্প অল্প বিয়ারে চুমুক দিচ্ছে, চোখ দুটো তার অদূরের নারীতনুতে আটকে আছে। গত দুদিনের মতোই বিশ্লেষণ করে দেখছেনাক, মুখ, চোখ, ঠোঁটের বক্রাভাস, চিবুক, গলা। তারপর বক্ষাভাস-মার্জিত চোখে যতটুকু সয় ততটুকুই স্পষ্ট, ততটুকুই সুন্দর। তারপর কটিদেশ। তারপর আরো নীচে, আরো নীচে–একেবারে পা পর্যন্ত।
আজই প্রস্তাব করবে গৌতম দত্ত।
শিখ তরুণটির পানাহারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে হাসিমুখে উঠল মেয়েটি। আগের দুদিনও প্রত্যেককে প্রত্যাখ্যান করতে দেখেছে। চাহিদা বজায় রাখার এটাই বোধহয় রীতি।
অনেক পুরুষেরই পরিচিতসুলভ ব্যবহার মেয়েটির সঙ্গে। কেউ হেসে অভ্যর্থনা জানায়, কেউ বা অভিবাদনে। মেয়েটি হেসে কারো সামনে দু-পাঁচ মিনিট বসে, কারো সামনে দাঁড়িয়ে দু-চারটে কথা বলে। আবার এগোয়। হোটেল কর্তৃপক্ষ যেন এখানকার মাননীয় অতিথিবর্গের সুখ-সুবিধের ভার তার ওপরেই অর্পণ করেছে। কারো হাসিমুখের আমন্ত্রণ দেখলেই হাসে, কাছে এসে খোঁজখবর করে।
দুটো টেবিলের ওধার দিয়ে যেতে যেতে আবারও দৃষ্টি বিনিময়। গৌতম দত্ত হাসল। যেমন করে ওরা হাসে। তার থেকেও ভালো করে। কাছে আসার অনুরোধের মতো হাসি।
মেয়েটি থমকে দাঁড়াল। হাসি মিলিয়ে আসছিল। সেটা খেয়াল হতেই হাসির জবাব দিল। সুন্দর সুচারু হাসি। তারপর টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল।
-বসুন না।
গৌতম দত্ত শশব্যস্তে দাঁড়িয়ে উঠে অভ্যর্থনা জানাল।
বসল। মুখোমুখি গৌতম দত্তও। আবারও মনে হল, মুখখানা চেনা-চেনা।
-আপনাকে কিছু দিতে বলি?
-না না, ধন্যবাদ, আপনি খান। আপনাকে নতুন দেখছি কদিন ধরে, নাকি আগে অন্য সময়ে আসতেন?
-না, এই তিনদিন এলাম।–গৌতম দত্ত থমকালো একটু, তারপর বলে ফেলল –তিনদিনই আপনার জন্যে আসছি।
-খুব ভাগ্য!–মেয়েটি হাসল। কিন্তু মনে হল এ-রকম কথা শুনে সে অভ্যস্ত।
গৌতম দত্ত দ্বিধা জানে না, কাজ বোঝে। হাতে এমন সময়ও নেই যে ভণিতা করে সময় কাটাতে পারে–অনেকের অনেক জোড়া চোখ এই টেবিলে। মেয়েটিও এর মধ্যে ঘড়ি দেখেছে একবার। এই এক হাতের মধ্যে তাকে দেখে গৌতম দত্ত কাজের ফয়সালাটা করে নেবার জন্য ভিতরে ভিতরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বলল, –আমার একটু বিশেষ আলোচনা ছিল আপনার সঙ্গে, একটা দরকারী প্রোপোজাল, কিন্তু এটা ঠিক সিরিয়াস আলোচনার আবহাওয়া নয়, আমার সঙ্গে গাড়ি আছে, আপনি যদি দয়া করে খানিকক্ষণের জন্যে আমার সঙ্গে আসেন।
এবারে মেয়েটির থমকাবার পালা। টানা টানা চোখ দুটি গৌতম দত্তর চোখের গভীরে। জবাব দিল না চট করে।
গৌতম দত্তর বলার মধ্যে এবারে প্রচ্ছন্ন অনুনয়ের সুর।–আপনি বিশ্বাস করুন, সত্যি খুব দরকারী আলোচনা, আপনার কোনো ভয় নেই, আমি আবার আপনাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে যাব।
–না, ভয় আর কি, চলুন।অল্প করে হাসল মেয়েটি।
গৌতম দত্তর মনে হল, এই হাসিটুকুও এঁকে রাখার মতো সুন্দর।
বিয়ারের গ্লাস থাকল পড়ে। গ্লাসে একটা নোট চাপা দিয়ে উৎফুল্ল চাপা আনন্দে সসঙ্গিনী নীচে নেমে এল। মোটরে উঠল। গাড়ি মাঠের ধার দিয়ে একটা নির্জন রাস্তা ধরে চলল। গৌতম দত্ত কি ভাবে কথাটা পাড়বে ভেবে নিচ্ছিল…সঙ্গিনী পাশের গদিতে গা ছেড়ে দিয়েছে।
এবারে একটু ভণিতা করা যেতে পারে। গৌতম দত্ত বলল–আচ্ছা আপনাকে যেন কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।
অস্ফুট হাসির শব্দ।–বিলিতী ক্যালেন্ডারে দেখে থাকবেন।
কিন্তু কোনো ক্যালেন্ডারে গৌতম দত্ত দেখেছে বলে মনে পড়ল না। দেখলে এ-মুখ মনে থাকার কথা।
মেয়েটি হালকা গাম্ভীর্যে বলল–আপনাকে তো এসব দিকে আনাড়ী মনে হয়, অচেনা কাউকে এভাবে গাড়িতে ডেকে তুলবেন না, বিপদ হতে পারে। কত রকম যে থাকে–
-না, ইয়ে–আমার অন্য কথা ছিল—
–সে তো শুনলাম। নমিদি কেমন আছে? কোথায় বিয়ে হল–ছেলেপুলে কী?
গৌতম দত্ত হতভম্ব।–আপনি নমিকে চেনেন?
-ওমা, চিনব না কেন? কতদিন পাশাপাশি কাটালাম, দিনরাত ঘরে বসে আপনার কত ছবি-আঁকা দেখতাম।
গৌতম দত্তর প্রায় মনে পড়ল বুঝি এবার, বিয়ের কথাও উঠেছিল পাশের বাড়ির কার সঙ্গে যেন–এই নাকি! কি কাণ্ড! হলে তো হয়েছিল আর কি! কিন্তু তার আশাও বাড়ল। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করল–তোমার–আই মিন্ আপনার নামটি কী?
–নাম মালা–অস্ফুট মিষ্টি হাসি তেমনি–নামে কি চিনবেন, দিনরাত চোখ-কান বন্ধ করে কাজ করতেন আপনি।
প্রশংসার কথাই। গৌতম দত্ত মনে মনে খুশী হল। স্তুতি অনেক জোটে, কিন্তু যার কাছে স্বার্থ তার স্তুতিটা বেশী কাম্য। স্টিয়ারিং হাতে থাকায় ঘাড় ফিরিয়ে ভালো করে দেখার সুবিধে হচ্ছিল না। বলল–তখন নিজের খেয়ালে আঁকতুম, শিল্পী হিসেবে এখন একটু-আধটু চেনে অনেকেই
মালা সায় দিল।–চিনবে জানতুম।–তা দরকারী আলোচনাটা কি আপনার, মডেল চাই?
গৌতম দত্ত অবাকই হচ্ছে মনে মনে। এই চেহারার এমন এক মেয়ে তার বাড়ির গায়ে থাকত, অথচ ভালো করে সে লক্ষ্যও করে নি কোনোদিন।…বছর দশেক হয়ে গেল বোধহয়, বয়েস তো তাহলে আটাশ-উনত্রিশের কম নয়–অথচ এত কাছ থেকেও সে বাইশ-তেইশের বেশি ভাবে নি। কারণ থাক আর না থাক, গৌতম দত্ত এই জন্যেও বোধহয় আরো খুশী মনে মনে। কিন্তু পেশাগত আলোচনার মুখে আগ্রহটা খুব বেশী দেখানো উচিত নয়।
মাথা নাড়ল। বলল–হ্যাঁ, একের পর এক দেখে যাচ্ছি, তুমি–মানে আপনি রাজী হলে
–তুমি আপনিতে বড় গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। একটা ঠিক করুন। তুমিও বলতে পারেন, আপত্তি করব না–
আপত্তি করবে না। সুতরাং তার আসা সার্থক, সেটা গৌতম দত্ত ধরেই নিয়েছে। বলল–তুমি রাজী হলে সেট করে ফেলি।
মালা ভাবনায় পড়ল যেন একটু।–আমার কি সময় হবে
লাগোয়া বাড়ির পড়শিনী ছিল একদিন, সেই কারণে গৌতম দত্তর যেন দাবিই আছে। জোর দিয়ে বলল–এ একটা মস্ত কাজ। আমার অনেক নতুন আইডিয়া আছে, অনেক প্ল্যানও আছে–আমার বিশ্বাস বিদেশেও কম কদর হবে না, আর মডেল হিসেবে তোমারও নাম ছড়াবে–এ রকম যোগাযোগ সব সময় ঠিক হয় না।
– অর্থাৎ যোগাযোগটা মালার দিক থেকেও সৌভাগ্যসূচক। মালাও সেটা বুঝল যেন, বলল–লোত হচ্ছে। আচ্ছা, এবারে গাড়ি ফেরান, যেতে যেতে, কথা বলি।
গৌতম দত্ত গাড়ি ফেরাল। অন্তর তুষ্টিতে ভরপুর। লোভের আরো একটু ইন্ধন যোগাল। বলল, এক আধ বছরের মধ্যে হয়ত-বাইরেও যাব আমরা
মালা চুপচাপ ভাবল একটু। বলল–আপনার মডেল মানে তো–ক্যালেন্ডার ট্যালেন্ডারে যে রকম সিটিং দিই, সে রকম নয় বোধহয়?
গৌতম দত্ত মাথা নাড়ল।-না সে রকম নয়। রিয়েল মডেল বলতে যা বোঝায়, মানে–
বলাটা সহজ হচ্ছিল না। মালা হেসে থামিয়ে দিল।–থাক, বুঝেছি। আচ্ছা, কি রকম কি ব্যবস্থা হবে বলুন
-তুমি বললেই ভালো হয়, কি রকম দরকার–
দরকার তো কম নয়।-হাসি-হাসি মুখখানা হিসেবে মগ্ন একটু।–তা দিনে কাজ, না রাত্রিতে?
দিনের বেলায়ও দরকার হতে পারে, তবে রাত্রিতেই কাজ করি
হিসেব ভুলে মালা সকৌতুকে ঘাড় ফেরাল তার দিকে।
–রিয়েল মডেল নিয়ে রাত্রিতে কাজ করলে আপনার স্ত্রী রাগ করেন না? বিয়ে করেছেন তো?
কাজের প্রসঙ্গে এই মেয়েলী কথা ভালো লাগল না গৌতম দত্তর। এককথায় দুটো জবাব সারল।–তিনি জানেন এটা পেশা আমার।
মালা মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, সেটা ঠিক কথা। জিজ্ঞাসা করল–কতদিনের কাজ আপনার?
–কাজ অনেকদিনের, এক বছরের না হয় তিন বছরেরই কন্ট্রাক্ট করে নিতে রাজী আছি আমি। তারপরেও কাজ শেষ হবে না, কন্ট্রাক্ট আবার রিনিউ হবে।
মালা খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল যেন। মনে মনে আবার একটু হিসেব করে নিয়ে বলল–দিনে কম হলেও দেড়শ টাকা–মাসে ধরুন সাড়ে চার হাজার টাকা রোজগার আমার, বেশীও হয়–
গৌতম দত্ত আঁতকে উঠল একেবারে। গাড়িটা সুষ্ঠু নড়েচড়ে গেল একটু। মনের মতো মডেল পেলে সে মোটা টাকা খরচ করতে প্রস্তুত-সেই মোটা টাকার অঙ্কটা খুব বেশী হলে হাজার টাকা মাসে। এই একটা অঙ্ক শুনে, রাজ্যের হতাশা যেন গ্রাস করতে এল তাকে। নিজেকে খানিকটা বঞ্চিত করে আর পৈতৃক সম্পত্তির জোরে টেনেটুনে বড় জোর দেড় হাজারে উঠতে পারে। সেও এই ঝোঁকে, এই মডেলের জন্যে।– শুকনো মুখে বলল–আমি অত পেরে উঠব,কেন, এতবড় কাজের দিকটা ভেবে আর শিল্পীর দিকটা ভেবেই তুমি যদি অনুগ্রহ করে রাজী হও।
চরম হতাশার মুহূর্তেও একটুখানি আশার আলো দেখছিল কি গৌতম দত্ত? সামনের দিকে নজর রাখা ভুলে পার্শ্ববর্তিনীর দিকেই চাইছে ফিরে ফিরে। আবেদনের ফলে একটু ভাবছেই মনে হল।
মালা বলল–মুশকিলে ফেললেন। আচ্ছা, মোটামুটি ওই চার হাজার পর্যন্ত পারি, তার নীচে আর পারি না।
গৌতম দত্তর সময় লাগল আত্মস্থ হতে। গাড়ি হোটেলের কাছাকাছি এসে গেছে। অস্ফুট স্বরে বলল–না, সেও আমার সাধ্যের বাইরে।
মালা তক্ষুণি সান্ত্বনার সুরে বলল–তাতে কি, কমে কি আর পাওয়া যায় না? আমার সঙ্গেই তো কত সময় কত জনের দেখা হয়, আর তারা সব দেখতেও ভালোই। আপনার স্টুডিও এখনো বাড়িতেই তো? সুবিধেমতো কাউকে পেলে আপনার ঠিকানা দিয়ে দেবখন।
গৌতম দত্ত নিরুত্তর।
গাড়ি হোটেলের সামনে দাঁড়াল। মালা নেমে এসে স্মিতমুখে দুহাত জুড়ে নমস্কার জানাল–বেড়িয়ে বেশ লাগছে, অনেক ধন্যবাদ। চলি।
ফুটপাথ পেরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।
পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট বার করল গৌতম দত্ত। সিগারেট ধরাল। তারপর গাড়িতে স্টার্ট দিল।
হোটেলের সিঁড়ি পর্যন্ত টকটকিয়ে এসে মালা দাঁড়িয়ে পড়ল। দোতলার দিকে তাকাল একবার। আজ আর ইচ্ছে করছে না দোতলায় উঠতে।…চল্লিশ-পঞ্চাশটা টাকা লোকসান কম করে। হোকগে। মনটা ভালো লাগছে খুব। শিথিল চরণে আবার বাইরে এসে একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসল সে।
এই স্পীডে গৌতম দত্ত গাড়ি চালায় না কখনো। ঘণ্টায় বিশ মাইলও হবে কিনা সন্দেহ। তার জীবনেরই খানিকটা গতি কমে গেছে যেন।
অবসাদগ্রস্তের মতো গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছিল গৌতম দত্ত, মেয়েদের কি হৃদয় বলে কোনো বস্তু নেই?