রানীদিন

ক্যালেণ্ডারে আজকের তারিখটার দিকে তাকাতেই প্রায় উনিশ বছর আগের ঠিক এই তারিখটাই আমার চোখের সামনে এগিয়ে এলো। সাত সাগর বাতাসে টপকে ইংলণ্ডের রাণীর পদার্পণ ঘটেছে ভারতে, উনিশ বছর আগের এই তারিখে তিনি কলকাতায়।

সেই দিনটিকে কেন্দ্র করে একটি পরিবারের যে মানসিক ছবিটি তুলে ধরতে চলেছি, পাঠক জেনে রাখুন বিশেষ কারণে তাদের সঠিক নাম কটি এখানে বদলাতে হয়েছে।

সেদিন আকাশ নির্মেঘ ছিল। কলকাতার বাতাসে রোমাঞ্চ ঠাসা ছিল। আবালবৃদ্ধবনিতার বুকের তলায় রূপকথার শিহরণ লেগেছিল। যাই যাই করেও বিদায়ী শীত হঠাৎ আবার থমকে দাঁড়িয়ে নতুন উদ্দীপনায় তার শেষ পুঁজি উজাড় করে দিচ্ছিল। হয়ত পুঁজি ছিলই না, আগামী শীতের থেকে কিছুটা ধার করে খরচা করছিল।

আমি ভাবছিলাম দেশটা অতিথি-পরায়ণ বটে। এই দেশেরই পুরাণের পুণ্য পাখিরা সপরিবারে ক্ষুধার্ত অতিথির সেবায় আগুনে দেহ দান করেছিল। পুরাণ-মাহাত্ম্য কল্কির বহু ধ্বংসযজ্ঞেও লুপ্ত হয়ে যায়নি একেবারে। সেই অতিথি-পরায়ণতার ঐতিহ্যের শীর্ণতর আর সূক্ষ্মতর ধারা যুগের পর যুগ পেরিয়ে তলায় তলায় তরতরিয়ে বইছে। রাণী এসে গেছেন সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে। রূপকথার রাণী নয়, স্বপ্নের রাণী নয়–রক্ত মাংসের তরতাজা রাণী। এই রাণীর জঠরের ক্ষুধা ভাবাটাও বিদ্যাসাগরীয় গদ্য গোছের। এই রাণীর চোখের ক্ষুধা। অতিথিপরায়ণ দেশ তার চোখের সামনে গোটা মনটি বিছিয়ে দিয়েছে। শুধু মানুষ কেন, তাই আকাশও সেদিন অত তকতকে নীল ছিল, বাতাসও রোমাঞ্চভারে কেঁপে কেঁপে উঠছিল, আর বিদায়ী শীতও অতিথি সম্বর্ধনার দায়িত্বে চকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।

কদিন আগে থেকেই সাজ সাজ রব। বুড়ী কলকাতার কতক অঙ্গ রং পালিশ আলোর বন্যায় নতুন-যৌবনে ঝলমলিয়ে উঠেছে। রক্ষা, সকল অঙ্গে চোখ ফেরাবার মত সময়। নেই রাণীর। মন্ত্রীদের আর মন্ত্রণা দপ্তরের মাথাওয়ালাদের কদিন ধরেই আহার নিদ্রা। ঘুচে গেছে-ভাবনায় ভাবনায় মাথার ঘিলু তাদের টগবগিয়ে ফুটছে। তাদের বউয়েরা ছেলেমেয়েরা অসুখের কথা বলতে এসে বা বাজার-খরচের তাগিদ দিতে এসে ধমক খেয়ে মরেছে। স্বামীদের মনে হয়েছে, কাণ্ডজ্ঞানহীনতারও একটা সীমা থাকা দরকার।

পুলিস দপ্তরের সকল স্তরের সকল পর্যায়ের কর্মচারীর দিশেহারা ব্যস্ততায় নাড়ী-ছাড়া ভাব একেবারে। দমদম এরোড্রোম থেকে গভর্নরের বাড়ি পর্যন্ত আট মাইল পথের শান্তিরক্ষার মহড়া দিতে দিতে গলদঘর্ম তারা। লাঠির ঘায়ে কিছু একটা। লণ্ডভণ্ড কাণ্ড ঘটিয়ে শান্তি স্থাপন করা বরং সহজ, কিন্তু এক্ষেত্রে লাঠি হাতে থাকবে অথচ কারো পিঠ দুরমুশনো চলবে না–দেখলে রাণী কি ভাববেন! এদিকে শান্তির খুঁটি নড়চড় হলেই তো সোজা নিজের ঘাড়ে কোপ! ভাবনা কম? ভাবনায় ভাবনায় মস্তিষ্ক বিকল হবার উপক্রম। গল্প শুনছিলাম, কোন একজন মাঝারী অফিসারকে তার নাম জিজ্ঞাস করতে অন্যমনস্কতায় তিনি তার ঠাকুরদার নাম বলে দিয়েছিলেন।

খবরের কাগজের দপ্তরে আর এক এলাহী কাণ্ড। তুলো থেকে সূক্ষ্মতম সূতো। বার করার মতো রাণীর বংশপঞ্জী আর দিনপঞ্জী থেকে সেখানে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিস্ময়ের খোরাক আহরণ করে খবরের হরপে সাজানোর ধুম পড়ে গেছে। রাণীর রূপ, গুণ, ঐশ্বর্য, আয়, ব্যয়, বিলাস, ব্যসন, আহার, নিদ্রা, অনুচর সহচরী–সব খবর আর সকলের খবর ইস্কুলের তিনবার ফেল-করা ছেলেটাও গড়গড়িয়ে বলে দেবে। পরীক্ষার খাতায় রবীন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ আর দ্বারকানাথের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে যে ছেলে বাপ-ঠাকুরদা ওলটপালট করে ফেলেছে, তার মুখেও রাণীর ছেলেপুলে স্বামী আর বাপ-ঠাকুরদার নির্ভুল সমাচার শোনা গেছে।

.

–ভেবে দেখো, একশ হাজারে এক লক্ষ আর একশ লক্ষয় এক কোটি

– আলোচনায় আর উদ্দীপনায় ট্রাম-বাস সরগরম। অল্পবয়সী একজন বাঁয়ে ঘেঁষা নব্যপন্থী ঝাঝালো তর্কের সুরে রাণী সমাগমে দেশের খরচ বোঝাচ্ছিল তার সহযাত্রীকে। –গোটা দেশের এই উপোসের মুখে রাণী নিয়ে আসার আড়ম্বরে এক কোটি টাকা খরচ ভারতবর্ষের–ভাবতে পারো?—–

-এক কোটি কি মশাই! দু চোখ কপালে তুলে ঘাড় বেঁকিয়ে ফোঁস করে উঠলেন সামনের সীটের এক যাত্রী।–একুশ কোটি বলুন! এক কোটি তো মশাই গভর্নমেন্টের আড়মোড়া ভাঙতেই বেরিয়ে যায়!… রাণী আসা একুশ কোটির ধাক্কা, বুঝলেন?

ট্রামের সকলের চোখ বক্তার মুখের ওপর। আর, আচমকা বিড়ম্বনায় এক কোটিওয়ালা হাবুডুবু। ক্ষীণ প্রতিবাদ, খবরের কাগজে এক কোটি দেখেছিলাম যেন…

ছাপার ভুলে তাহলে এক-এর বাঁয়ে দুইটা পড়ে গেছে। একুশ কোটিওয়ালার। নিঃসংশয় মন্তব্য।

-আপনারও কিন্তু একটু ভুল হল মশাই। পাশের আসন থেকে গুরুগম্ভীর প্রতিবাদ ছাড়লেন মাঝবয়েসী আর একজন ভদ্রলোক। রাণী আসার ব্যাপারে গোটা ভারতবর্ষ থেকে আসলে খরচা হচ্ছে ছাব্বিশ কোটি; একুশ কোটি নয়–নেট এক্সপেনডিচার টুয়েন্টিসিক্স ক্রোরস–প্রমাণ চান, চলুন যে-কোনো কাগজের অফিসে।

এক কোটি, একুশ কোটি আর ছাব্বিশ কোটির বিতণ্ডার মধ্যে কণ্ডাক্টার এগারো নয়া পয়সার টিকিট কাটার প্রত্যাশায় হাত বাড়িয়ে সেই থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে।

বুড়োরা অর্ধশতাব্দীগত স্মৃতি রোমন্থন করে একবারের রাজা আসার গল্প ফেঁদে বসেছেন। প্রৌঢ়ারা ট্রাঙ্ক থেকে তিন যুগ আগের বেনারসী বার করে সঙ্গোপনে রোদে দিয়ে ঝেড়ে মুছে রাখছেন। এই হিড়িকে ছেলেপুলের জন্যে নতুন এক প্রস্থ প্যান্ট জামা জুতো করিয়ে নেবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন মধ্যবিত্ত ঘরণীরা। পুরনো গয়না ভেঙে নতুন করে গড়িয়েছেন অনেকে। গিন্নিরা রাণী দেখতে যাবেন শুনে অনেক প্রৌঢ় চোখ কপালে তুলেছেন, আর অনেক তরুণ ঠাট্টা-ঠিসারা করেছেন। অফিস থেকে সোজা বেরিয়ে ও-কাজটি একেবারে সেরে বাড়ি ফেরার বাসনা তাদের, এর মধ্যে ছেলেপুলে গিন্নিরা বেরিয়ে পড়লে খানিকটা দুর্ভাবনার কথাই।

সেই দিন। রাণী দিন। দিনটার এর থেকে ভালো নাম আর সঠিক নাম কিছু হতে পারে না। সকাল থেকে গোটা শহর উত্তর কলকাতার পথে ভেঙে পড়েছে। শুধু কলকাতা শহর কেন, মফঃস্বল শহরেরও আধা-আধি। কি করে কোন কোন পথ দিয়ে। তারা গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে সঠিক করে কেউ বলতে পারবে না। আমি অন্তত পারব না।

আমিও গিয়েছিলাম। প্রথমে নিস্পৃহভাবে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, জনতা দেখতে যাচ্ছি, ভিড় দেখতে যাচ্ছি, লোকের হুজুগ দেখতে যাচ্ছি। লেখার কাজে লাগবে। কিন্তু সেটা সত্যের অপলাপ। আসলে আমিও রাণী দেখতেই যাচ্ছি। রাণী তরুণী, রাণী রূপসী, রাণীর কুবেরের ঐশ্বর্য, সব থেকে বড় কথা–এ রাণী রাণীই, রাজার স্ত্রী হিসেবে রাণী নয়–একেবারে সর্বপ্রধানা, স্বয়ংসম্পূর্ণা রাণী। রাজা হলে যেতাম কিনা সন্দেহ, রাণী বলে যাচ্ছি। মনের তলায় রূপকথার রাজ্যে যে-রাণীর অবস্থান সেই রাণী, সেই রকম রাণী।

বাস থেকে নামতে হয়েছে গন্তব্য স্থানের বেশ খানিকটা দূরে। যেখানে দু-দশটা চাপা দিয়েও আর বাস চলার পথ ছিল না–সেইখানে। তারপর পায়ে পায়ে কখন একসময় জনতার সমুদ্রে মিশে গেছি খেয়াল নেই।

না, মানুষ দেখে এমন বিস্ময় জীবনে আর কখনো অনুভব করিনি। রাণী আসতে তখনো অনেক দেরি, এই ভিড়ের মধ্যেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একে ঠেলে ওকে ফেলে কখনো-বা ভিড়ের চাপে শুন্যে উঠে প্রায় আধ মাইল পথ আমি বিচরণ করেছি আর সেই বিস্ময় উপলব্ধি করেছি। সময় লেগেছিল ঘড়ি ধরে তিন ঘণ্টা।

কি দেখেছি? মারামারি, হুড়োহুড়ি, কথা-কাটাকাটি, পুলিসের তর্জন গর্জন? না, এর একটাও না। লক্ষ লক্ষ মেয়ে-পুরুষের এক তারে বাঁধা একটি মাত্র প্রতীক্ষার রূপ দেখেছি, রূপ উপলব্ধি করেছি। একটা মারামারি হাতাহাতিও আমার চোখে পড়েনি। পুলিসকে নিজের পেটের কাছে লাঠি শুইয়ে জনতা ঠেকানো ছাড়া একবারও লাঠি ঊচোতে দেখিনি। ট্রামে বাসে মেয়েদের গায়ে গা লাগলে যেখানে সোরগোল পড়ে যায়–সেখানে ভিড়ের চাপে চিড়ে চ্যাপটা হয়েও অশোভন আচরণের একটিও বামাহুঙ্কার অথবা পুরুষগর্জন কানে আসেনি! কে যে কাকে ঠেলছে সেই দিকেই চোখ নেই কারো। আর, পকেটমাররা কি এই ভিড়েও বাণিজ্যের লোভে আসেনি বলতে চান? এসেছিল নিশ্চয়, কিন্তু পকেটমার বলে তাদের কি হৃদয় নেই, না সেই হৃদয়ে রাণীর আসন নেই? পরদিন তন্ন তন্ন করে আমি খবরের কাগজ খুঁজেছি, কিন্তু রাণীদিনের সেই জন-সমুদ্রে একটি পকেটমারের রিপোর্টও আমার চোখে পড়েনি। রাণী দেখার আগ্রহে তারাও পেশা ভুলেছিল মনে হয়।

যাক, রাস্তার দুপাশে লক্ষ লক্ষ লোকের একতাল মানুষ, আর দু-পাশের বাড়ির একতলা দোতলা তিনতলার রেলিং-এ আর ছাতের আলসেতে চোখ-ধাঁধানো বসন-ভূষণে মোড়া চাপ চাপ মেয়েছেলে। কারো কারো ধারণা, মাথাপিছু দুটাকা করে আদায় করে ওই দুধারের বাড়ির অনেক মালিক অনেক টাকা কামিয়েছে সেদিন।

আমি দেখছিলাম, আর আত্মাটাকে একদিকের ফুটপাতের জনতার ঢেউয়ে ছেড়ে দিয়ে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ছিলাম।

হঠাৎই বিষম একটা ধাক্কা। না, ভিড়ের ধাক্কা নয়। আত্মগত ধাক্কা।

আমার সামনের দুহাতের মধ্যে যে-লোকটি সকলের মাথার উপর দিয়ে আধ হাত গলা বাড়িয়ে সামনের ফাঁকা রাস্তাটাই একবার দেখে নেওয়ার জন্যে কসরৎ করছে, তাকে আমি চিনি। আর, কলকাতা ছেড়ে গোটা বাংলাদেশের লোক এখানে ভেঙে পড়লেও ওই একজনের এখানে আসার কথা নয়।

আমার বহুদিনের পরিচিত চাটুজ্জে বাড়ির বড়দা-মণিদা।

পরস্পরের দেখা হয়ে গেলে কে অপ্রস্তুত হবে না ভেবেই আমি তৎক্ষণাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে উল্টোদিকের ভিড়ে ভেসে পড়লাম। আধ ঘণ্টার চেষ্টায় বেশ খানিকটা তফাতে আসা গেল। তার পরেই একটা বন্ধ দোকানের উঁচু ধাপের দিকে চোখ যেতেই আবার ধাক্কা! চোখের দোষ নেই, বেশ একটি সুশ্রী মেয়ে ভিড় বাঁচিয়ে দোকানের বন্ধ দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

কিন্তু আমি চমকে উঠেছি, কারণ, ওই মেয়েও চাটুজ্জে বাড়ির একজন। বড়দা অন্যথায় মণিদার ছোট বোন জয়ন্তী। আমার সঙ্গে ওই বাড়ির আত্মীয়তার সূতোটায় পাঁচঘোঁচ অনেক। মাসতুতো বোনের শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কটাকে কোনোভাবেই কাছের সম্পর্ক বলা চলে না। কিন্তু সর্বদা যাওয়া-আসার ফলে সম্পর্কটা কাছেরই হয়ে গেছে।

এবারে আর নিঃশব্দে আড়াল হওয়া গেল না। চেষ্টা-চরিত্র করে, আর, অনেকের ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম।

দেখার সঙ্গে সঙ্গে জয়ন্তী একদফা থতমত খেয়ে উঠল। ভিড় ঠেলে উঁচু ধাপটা থেকে নেমে আসতে আসতে সামলে নিল একটু। কাছে এসে হাসতে চেষ্টা করে কৈফিয়তের সুরে বলল, কাণ্ড দেখুন লোকের, এমন আটকে গেছি যে নড়াচড়ার উপায় নেই।

জয়ন্তী ইস্কুলে মেয়ে পড়ায়, উক্তিটা যে ছেলেমানুষের মতো হয়ে গেল নিজেই বুঝেছে। ওদের বাড়ি যেতে হলে এতটা আসতে হয় না, আটকে যাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, যাচ্ছিলেন কোথায়?

বললাম, কোথাও না, এখানেই এসেছি।

জয়ন্তী আবারও ঢোঁক গিলল। ভিড়ের মধ্যে কয়েক পা এগিয়ে বলল, চলুন, বাড়ির দিকে যাই… কিন্তু বেরুবেন কি করে?

একটা জায়গা দেখে দাঁড়াই চলো, এসেছি যখন দেখেই যাই।

জয়ন্তী থমকে গিয়ে মুখের দিকে তাকালো। অপ্রতিভ হাসির আভাস, একটু অসহিষ্ণুও।বাড়ি গিয়ে আবার হড়বড়িয়ে বলে দেবেন না তো?

-না।…. তাছাড়া ওদিকে মণিদাও সকলের মাথার ওপর দিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে দেখার চেষ্টায় গলদঘর্ম হচ্ছে দেখলাম।

শুনে জয়ন্তী ঘুরে দাঁড়ালো একেবারে।–বড়দা? কই?

এখান থেকে দেখবে কি করে! আছে…। চলো, ওদিকে চলো—

বিস্ময় কাটিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে আবার সামনের দিকে এগলো সে। একটা অপরাধপ্রবণতার অনুভূতি জোর করেই বিলুপ্ত করার চেষ্টা। বলে উঠল, আসবে না। কেন, এর সঙ্গে অন্য কিছুর সম্পর্ক কি?

আমার নীরবতাটুকুই সায়ের মতো। দু চোখ আপাতত দুজনের মতো একটু জায়গা আবিষ্কারের চেষ্টায় মগ্ন।

এবারে একটু পূর্ব কথা বলে নেওয়া দরকার। জয়ন্তীর ওপরে তিনটি দাদা ও-ই সকলের ছোট। ওদের বাবা বিপ্লবী হরিশ চ্যাটার্জীর আপন বড় ভাই। ইংরেজ শাসনে যে হরিশ চ্যাটার্জীর প্রায় তিরিশ বছর আগে ফাঁসি হয়ে গেছে। জয়ন্ত ছেড়ে জয়ন্তীর ছোড়দাও জন্মায় নি তখনো। তাহলেও সেই কাকার আত্মাহুতির এক নিবিড় স্পর্শের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছে ওই বাড়ির সবকটি ছেলে মেয়ে। কাকীমা আছেন, তার বয়েস পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। ওই বাড়ির তিনিই শুচিশুভ্র আদর্শ। ভাই বোন সকলেরই ওই কাকীমা-অন্ত-প্রাণ, তারই প্রভাবে মানুষ ওরা। কাকীমা পূজা-আহ্নিক করেন, সেই ঘরে দেবতার পাশেই বিপ্লবী স্বামীর ফোটো। রোজই মালা দেওয়া হয় ফোটোতে। জয়ন্তীরা ঠাকুরঘরে গিয়ে ঠাকুর প্রণাম যত না করে, কাকার ফোটোতে প্রণাম করে। তার থেকে বেশী। কাকীমাও বলতে গেলে দিবারাত্রি ওই ঠাকুরঘরেই থাকেন, ঠাকুরঘরের মেঝেতে শোন।

হরিশ চ্যাটার্জীর ফাঁসির পর ও-বাড়িতে কোনো বিলিতি সামগ্রী ঢোকা দূরের কথা, বিলিতি বাতাসটুকু পর্যন্ত ঢুকতে পায়নি। আজও না। সেবারে কাকীমার অত বড় অসুখটাতেও এক ফোঁটা বিদেশী ওষুধ চলেনি। কাকীমা বলেছেন, মরবই তো একদিন তাতে কি, কিন্তু তোরা মারিস না।

মনের জোরে কাকীমা কবিরাজী চিকিৎসাতেই সেরে উঠেছিলেন।

রাণীর আসার ব্যাপারে আমি ওই এক বাড়িতেই শুধু আলোচনা শুনিনি। সকলকেই নিস্পৃহ, নিরাসক্ত দেখেছি। ঠিক তাও নয়, উল্টে যেন সকলের মনের তলায় এক ধরনের গাম্ভীর্য থিতনো দেখেছি।

.

রাণী এলেন। রাণী চলে গেলেন। জনতার অভ্যর্থনার উল্লাস আকাশে গিয়ে ঠেকল। শৃঙ্খলাবদ্ধ জনতা বাঁধভাঙা বন্যার মতোই তারপর আলোড়িত হয়ে উঠল। তার ভিতর দিয়ে পথ করার চেষ্টাও বিপজ্জনক।

রাণীদর্শনতৃপ্ত একটু-আধটু আলোচনা কানে আসছে। রাণীর রূপের ব্যাখ্যা, পঁয়ত্রিশ বছর বয়েস, তিনটি ছেলেমেয়ের মা–অথচ দেখে মনে হয় বাইশ বছরেরটি–না। জানলে বিবাহিত কিনা বোঝা শক্ত-রাণীর পরনে কি ছিল, কোন দিকে তাকিয়েছিলেন রাণী, কার চোখে চোখ পড়েছে, এই ভিড় আর এই অভ্যর্থনা দেখে রাণীর কতটা খুশি হওয়া সম্ভব, রাণীর স্বামী ওই ফিলিপ ভদ্রলোক বেচারী না ভাগ্যবান, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আরো ঘণ্টাখানেক পরে পাশাপাশি জয়ন্তীদের বাড়ির দিকে চলেছি। একটু সহজ হবার জন্যেই বোধহয় জয়ন্তী জিজ্ঞাসা করল, কেমন দেখলেন?

বললাম, তোমার থেকে সুন্দর নয় ভাবতে চেষ্টা করছি।

আ-হা, একটু খুশি হয়ে ও মন্তব্য করল, আমি ওর তুলনায় পেত্নী।

কিন্তু আমাদের হালকা হবার চেষ্টা ব্যর্থ। বাড়ির কাছাকাছি যে দুজন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তারা জয়ন্তীর মেজদা আর ছোড়দা। এক নজর তাকিয়েই বোঝা গেল, তারাও যেখান থেকে আসছে, আমরাও সেখান থেকেই। কিন্তু কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করল না। জয়ন্তীর ছোড়দা শুধু চোখের ইশারায় পিছনের দিকটা দেখিয়ে দিল। আমরা ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে মণিদাও। ওদের বড়দা।

তার শুকনো মুখে অপ্রতিভ হাসির আভাস। কাছে এসে দাঁড়াল। কিন্তু সেও রাণী প্রসঙ্গ তুলল না, বা কিছু জিজ্ঞাসা করল না। শুধু দৃষ্টি বিনিময়েই চার ভাইবোনের মধ্যে একটা নীরব প্যাক্ট হয়ে গেল যেন। তারপর ভাইদের আমার দিকে চোখ পড়তেই জয়ন্তী তেমনি নিঃশব্দ ইশারায় আশ্বস্ত করল, এ-দিক ঠিক আছে।

দোতলায় উঠেই সিঁড়ির পাশে কাকীমার পুজোর ঘর। সন্ধ্যার মুখ তখন। মুখ হাত ধুয়ে কাকীমা এ-সময়টা আধঘণ্টা খানেকের জন্য বৈকালিক জপে বসেন। আজও বসেছেন। ৬৫০

কাকীমা সকলকে একে একে তার ঘরটা অতিক্রম করতে দেখলেন। আমার দিকে চোখ পড়তে প্রসন্ন আহ্বান জানালেন, এসো, খবর ভালো তো?

আমি ঘাড় নাড়লাম। নিজের অগোচরে কাকীমার স্বামীর ফোটোখানার দিকে চোখ গেল। ফোটোর গলায় প্রতিদিনের মতই টাটকা মালা। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, জয়ন্তী আর তার দাদারাও অদূরে দাঁড়িয়ে গেছে। সশঙ্ক, অপরাধী দৃষ্টি।

খুব সাদাসিধেভাবেই কাকীমা জিজ্ঞাসা করলেন, রাণী দেখে এলে বুঝি?

এমন বিড়ম্বনায় জীবনে পড়িনি বোধহয়। আমি যে রাণী দেখে এলাম সে কি আমার মুখে লেখা ছিল? কিন্তু এই ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়ালে সত্যি জবাব যা সেটা আপনিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। নিজের অগোচরেই বলে ফেললাম, হ্যাঁ। তারপর শুকনো হাসি, আমার তো লেখা-টেখার ব্যাপারে দেখতেই হবে।

তেমনি সহজ সরল কৌতূহলে কাকীমা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন দেখলে?

হঠাৎ কি যে হল কে জানে। অকারণ জোর আর অকারণ উৎসাহভরে বলে ফেললাম, চমৎকার, এত সুন্দর আগে ভাবিনি।

তাই নাকি! কাকীমার প্রসন্ন বিস্ময়। তারপর ভাশুরঝি আর ভাশুরপোদের নির্বাক মুখের দিকে চোখ পড়ল।–ওরা কিছু বলছে না যে, ওদের ভালো লাগেনি বুঝি?

বোন আর ভাইয়েরা বিমূঢ় কয়েক মুহূর্ত। ধরা পড়ে হঠাৎ কাকীমার ওপরেই যেন সব রাগ গিয়ে পড়ল জয়ন্তীর। এক পা এগিয়ে এসে তরল উদ্দীপনায় বলে উঠল, খুব ভালো লেগেছে কাকীমা, কত সুন্দর ভাবতেও পারবে না, দেখলে চোখ। ফেরানো যায় না, একসঙ্গে যেন লক্ষ্মী সরস্বতী।

সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে তার ছোড়দা তেমনি ছদ্ম আগ্রহে যোগ দিল, খবরের কাগজের ছবিতে যেমন দেখো তার থেকে অনেক সুন্দর-কাগজে কিছুই ওঠে না।

আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কাকীমার মুখের ওপর। কিন্তু সেই মুখে কৃত্রিমতার আভাসও চোখে পড়ল না। সহজ সরল কৌতূহল। দেখে সকলে খুশি হয়েছে তাইতেই খুশি যেন। প্রসন্ন মন্তব্য, হবারই কথা, সুন্দরের গুষ্টি ওরা শুনেছি–আ-হা, বেঁচে থাক–

জয়ন্তীকে বললেন, মুখ হাত ধুয়ে ওদের খেতে দে, নিজেও খেয়ে নেখিদেয় মুখ চোখ বসে গেছে সব।

জপে মন ফেরানোর জন্যে ঘুরে বসলেন।

আমরা নির্বাক। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। ইংরেজ রাজদুহিতার উদ্দেশে কাকীমার ওই সাদাসিধে আশীর্বাদটুকু আমাদের কানের ভিতর দিয়ে বুকের কোথায় গিয়ে পৌঁছুল হঠাৎ ঠাওর করে উঠতে পারছি না।

নিজের অগোচরে আরো একবার তাকালাম।… অমন মাতৃত্বমণ্ডিত মুখ আর যেন দেখিনি আমি।

আজও থেকে থেকে মনে হয়, ভারতবর্ষ দেখতে এসে রাণী ভারতবর্ষের জনতা দেখে গেলেন শুধু, আর ভারতবর্ষের ভূগোল-পথে বিচরণ করে গেলেন। ভারতবর্ষ দেখতে পেলেন না।


© 2024 পুরনো বই