আশা আর বাসা

ছিল পোস্টমাস্টারের মেয়ে। নিজে কিছুকাল করল স্কুল-মাস্টারি। তারপর হয়ে পড়ল কলেজের মাস্টারের বউ।

জীবনের এই কোনো ক্ষেত্রই পছন্দ নয়। পোস্টমাস্টার বা স্কুল-মাস্টার অথবা কলেজের মাস্টার যে তার চক্ষুশূল এমন নয়, বরং পোস্টমাস্টার বাবাটিকে সে ভালই বাসত, তার সদা খুঁতখুঁতে মনোভাব দেখে বেশ মজা পেত। ড্রয়ারে একটা কাগজ রাখলেও তিনবার করে খুলে দেখতেন ঠিক রেখেছেন কিনা। কারো হাতে একটা দশ টাকার নোট দিলে দুতিনবার অন্তত সেটা টেনে নিয়ে আঙ্গুলে ঘষে দেখতেন একটার জায়গায় দুটো বেরিয়ে গেল কিনা।

নিজে যতদিন স্কুল-মাস্টারি করেছে ততদিন খুব যে নিরানন্দে ছিল তাও নয়। বরং সমবয়সী সতীর্থদের সঙ্গে হেসে-খেলে দিন কাটিয়েছে। তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছে।

আর কলেজের মাস্টারের বড় হবার জন্যেও কেউ তাকে বাধ্য করে নি। নিজের ইচ্ছেতেই হয়েছে। ঘরে প্রায় সর্বদাই পাঠ আর পঠনরত অল্পবয়সী একটি সিরিয়স মুখ দেখে এক-এক সময় সে বেশ কৌতুকই অনুভব করত। কোন সময় বা টেনে টেনে ছড়া কাটত, রাম গরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা। ফলে ইতিহাসের তরুণ মাস্টারের অনেক সময়ই পাঠ-পঠনের মনোযোগ রসাতলে যেত। তার হাসিতে প্রমাণ মিলত হাসির রসদ পেলে তার হাসতে তেমন মানা নেই, আর রাতের নিভৃতে এই টিপ্পনীর দরুণ দস্তুরমত হামলা করে চড়ামাশুলও আদায় করতে চেষ্টা করত। তখন সমর্পণের হাল ছাড়তে খুব মন্দও লাগত না।

তবু এই তিনের একটা ক্ষেত্রও যে পছন্দ নয় তার কারণ ওর নিজের চরিত্রগত উচ্ছলতা। ওই তিনের কোন ক্ষেত্র থেকেই সেটা পরিপূর্ণ রসের জোগান পেত না। উচ্ছল সত্তা বিকশিত বা বিস্তৃত হবার মতো সেগুলির একটাও তেমন প্রশস্ত নয়, উর্বর নয়-মানিয়ে নিতে পারলে দিন এক রকম করে কাটে, এই পর্যন্ত। কিন্তু বর্ণশূন্য দিনযাপনের সহিষ্ণুতা তার কম। বরং বর্ণের অনুশীলনে সেটা কত ভাবে কত রকমে উজ্জ্বল হতে পারে সেই কল্পনার সঙ্গে তার মানসিক যোগ।

এরও কারণ আছে।

নাম রাখি। আগে গাঙ্গুলি ছিল। কলেজের মাস্টারের ঘরে এসে চক্রবর্তী হয়েছে। রাখি চক্রবর্তী। বর্ণবিলাসী কল্পনার সঙ্গে তার মানসিক যোগের কারণ বিশ্লেষণ এই নাম থেকেই শুরু করা যেতে পারে।

ওর বাবারা পাঁচ ভাই। জলপাইগুড়িতে একান্নবর্তী পরিবার। তাদের কেউ স্কুল মাস্টার, কেউ উকিল, কেউ কেরানী। বাবা পোস্টমাস্টার আর ছোট কাকার স্টেশনারি দোকান। রাখির বাবা সেজ। রাখির চারটি নিজস্ব দাদা। বড় জ্যাঠা আর মেজ জ্যাঠার চারটি করে ছেলে। বড় কাকার ছয় ছেলে। ছোট কাকার পাঁচ ছেলে। সব মিলিয়ে বাড়িতে ছেলের সংখ্যা তেইশ। আর একটি মাত্র মেয়ে–সে রাখি। মেজ জ্যাঠার নাকি একটা মেয়ে হয়েছিল। সে দেড় বছরের বেশি টেকেনি। বাড়িতে মেয়ের দুর্ভিক্ষ। সাধারণত লোকে ছেলে হলে খুশি হয়, কিন্তু এ বাড়িতে ছেলের মুখ দেখতে দেখতে এমন অবস্থা যে ছেলে হলে মন-মেজাজ খারাপ হয়। ছোট কাকিমার কাছে রাখি শুনেছে, ওর ছোড়দা যখন হল, মায়ের সে কি কান্না! কে নাকি হাত দেখে মাকে বলেছিল এবারে ছেলে হবে!

এহেন পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ আগন্তুক কন্যা। স্বভাবতই তার আদর, তার কদর, তার প্রশ্রয় অন্যরকম। ও এসেছে তাই আনন্দ ধরে না, শেষ পর্যন্ত টেকে কি টেকে না ভিতরে ভিতরে সেই শঙ্কা। সেই কারণেই নাম–রাখি। তা ছেলেবেলা থেকে সকলে মাথায় করেই রেখেছে তাকে। বৃহৎ পারিবারে অনটনের ছায়া পড়েই ছিল। কিন্তু সেটা একমাত্র ওকেই স্পর্শ করে নি কোনদিন। যখন যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। বাবা না দিলে কাকা-জ্যাঠারা দিয়েছে। বছর পনের বয়েস পর্যন্ত অন্তত চাইলে পাবে না এমন কিছু আছে বলেই সে ভাবতে পারত না। তার চোখে তখন পর্যন্ত সমস্ত দুনিয়াটাই বর্ণে গন্ধে আনন্দে ভরা।

স্কুল ফাইন্যাল থেকে বি.এ. পাস করার চারটে বছরের মধ্যে পর পর কটা বিপর্যয়ে সেই রংদার দুনিয়ার সব বর্ণ সব গন্ধ আর সব আনন্দ যেন কর্পূরের মতো মিলিয়ে গেল চোখের সমুখ থেকে। আর যে বাস্তব মুখব্যাদান করে তার সামনে এগিয়ে এলো সেটা যেমন নীরস, তেমনি অকরুণ। পনের বছর পর্যন্ত যে মেয়েটা সব পেয়েছে, এ বাস্তবের সঙ্গে তার আপোস করে চলাটা সহজ নয়।

ওই চার বছরের গোড়ায় বড় কাকা চোখ বুজলেন। তারপর বড় জ্যাঠা। শেষে বি. এ. পাস করার ছমাস আগে তার বাবা মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের তাপ্লি মারা নৌকোটা হঠাৎ যেন খান-খান হয়ে গেল।

বি. এ. পাশ করার আগেই রাখি গাঙ্গুলি যেন অকূল পাথারে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগল। নিজের এবং খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো তেইশটি দাদার মধ্যে মতের মিল থেকে অমিলই বেশি। অনেকেই বিয়ে-থা করেছে, অনেকেই বাইরে চাকরি-বাকরি করছে–কিন্তু পৈতৃক বাড়ির বিধি-ব্যবস্থা সম্পর্কে যে যার ভিন্ন-মতে মাথা ঘামাতেও কসুর করছে না। একান্নবর্তী পরিবারের জমিজমা কিছু ছিল।! চার বছরের মধ্যে সেসব শূন্যে মিলিয়ে গেল। পৈতৃক বাড়িতে যারা থাকে তাদের প্রতি যারা থাকে না তাদের যেন একধরণের অনুকম্পামিশ্রিত উদারতা। ইচ্ছে করলে ওই বাড়িও বেচে দেওয়ার দাবি তোলা যেতে পারে, ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে গেলে তো কারো ভাগেই কয়েকখানা করে ইট-কাঠের বেশি কিছু পড়বে না। অতএব বেচে দেবার দাবি না তোলাটা প্রকাশ্য উদারতা ছাড়া আর কি!

বাবা মারা যাবার কিছুদিনের মধ্যে জানা গেল ভদ্রলোক মেয়ের বিয়েবাবদ আলাদা। করে কিছু টাকা রেখে গেছেন। প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা মা আর ছেলেরা পাবে। এ টাকাটা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত। আলাদা। বড়জোর হাজার পাঁচেক হবে–তাই নিয়েই আড়ালে-আবডালে কথা। যে জ্যাঠা আর কাকা মারা গেছেন, তাদের ছেলেদের সংশয়, এত খরচের মধ্যে বাবা মেয়ের জন্যে ওই টাকা জমালেন কী করে? শেষের কয়েকটা বছর এই একান্নবর্তী সংসার পরিচালনার ভার রাখির বাবার ওপরেই ছিল।

অপরের কথা দূরে থাক, একমাত্র ছোট বোনের প্রতি বাবার পক্ষপাতিত্ব দেখে। দাদারাও কেউ কেউ গম্ভীর। তার কারণ, তারা দেখেছে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকার একটা বড় অংশই বাবা ধারে কমিয়ে রেখে গেছেন। সেই কারণেই ছোট বোনের নামে পাঁচ হাজারের অঙ্কটা তাদের চোখে খুব কম ঠেকেনি।

বি. এ. পরীক্ষার মাত্র মাসতিনেক আগে বড়দার কথা শুনে তো রাখির চোখে জলই এসে গেছল। গম্ভীর মুখে বড়দা মাকে বলছিল, পরীক্ষার জন্যে আবার কতগুলো টাকা খরচ করে কী হবে, পড়াশুনায় যা মন আর যা মাথা, নির্ঘাৎ ফেল করবে আর টাকাগুলোও যাবে। তার থেকে চেষ্টা-চরিত্র করে বিয়েই দিয়ে দাও, ঝামেলা মিটে যাবে।

মা অবশ্য দাদার কথায় কান দেয়নি। আর পরীক্ষার ফীও ছোট কাকা নিজে থেকে ডেকে দিয়েছে ওকে। কিন্তু বড়দার কথা শুনে ও যত না দুঃখ পেয়েছিল তার থেকে তাজ্জব হয়েছিল ঢের বেশি। বাড়ির একটামাত্র এত আদরের মেয়ে সে। কিনা এরই মধ্যে ঝামেলার সামিল! যেমন-তেমন করে তাকে বিদায় করতে পারলে ঝামেলা মেটে!

সেই প্রথম নিজের ওপর ভয়ানক রাগ হয়েছিল রাখি গাঙ্গুলির। পড়াশুনায় তার কোনদিন খুব একটা মন ছিল না সত্যি কথা। প্রতিবার যখন পরীক্ষাসংকট একেবারে নাকের ডগায় এগিয়ে আসে তখনি প্রতিজ্ঞা করে, ঠাকুরের দয়ায় সেবারের মতো। কোনরকমে উতরে গেলে জীবনে আর পড়াশুনায় গাফিলতি করবে না। কিন্তু উতরে যাবার পর প্রতিজ্ঞার কথা আর মনে থাকে না। কিন্তু তা বলে পড়শুনা করলে পাস না করার মতো মাথাও নেই তার? বরং স্কুলে পড়তে টিচাররা উল্টো কথাই বলত। বলত, মেয়েটার মাথা ছিল, পড়াশুনা মন দিয়ে করলে ওই সোমা মিত্রর থেকেও ভালো করত। সোমা প্রতি বছর একগাদা প্রাইজ নিয়ে বাড়ি ফিরত। বি. এ.-তেও সে অনার্স পড়ছে আর আশা করছে ভালো রেজাল্ট করবে। নিজের ওপর রাখির রাগ এই জন্য, কেন এতগুলো বছর সে হেলায় হারালো, কেন সকলের জিব নাড়া বন্ধ করার মতো রেজাল্ট করল না আগাগোড়া!

যাই হোক, সাংসারিক বিপর্যয়ের পর বিশেষ করে বাবা মারা যাবার পর রাখি গাঙ্গুলি বেশ টের পাচ্ছিল সে কোন মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। খানিকটা নিজের ওপর আর সক্কলের ওপর রাগ করে, খানিকটা ঝোঁকের মাথায়, আর খানিকটা বা বেগতিক দেখে পরীক্ষার কটা মাস এমন পড়াই পড়ল যে শুধু পাশ নয়, ডিস্টিংশনে পাস।

পাস করার পর বাবার মৃত্যটা যেন আরো বেশি অনুভব করল সে। বাবা বেঁচে থাকলে যেমন করে যোক কলকাতায় থেকে এম. এ. পড়ার ব্যবস্থা করা যেত। উৎসাহের আতিশয্যে মনে মনে একটা হিসেব করে ফেলল সে। যে পাঁচ হাজার ঢাকা বাবা ওর নামে রেখে গেছেন তার থেকে দুবছরে হাজার আড়াই খরচা করে কলকাতার কোনো হস্টেলে থেকে এম.এ-টা পড়ে ফেললে কেমন হয়? কিন্তু মাকে এ প্রস্তাবে রাজি করানো গেল না। তার পড়াশুনার ব্যাপারে বাড়ির মধ্যে আগ্রহ ছিল। একমাত্র যে মানুষটির তিনি ছোট কাকা। তিনিও এ প্রস্তাবে সায় দিলেন না।

ফলে প্রায় একটা বছর বেকার দশা। মাঝে দুমাস একমাসের জন্য যে স্কুলে পড়ত সেই স্কুলে কাজ করেছে। কোনো টিচার ছুটিছাটায় গেলে তবে সেরকম কাজ মেলে।

ইতিমধ্যে ওর সহপাঠিনী এবং স্কুল-কলেজের ভালো মেয়ে সোমার মস্ত ঘরে বিয়ে হয়ে গেল। সোমা এমন কিছু রূপসী নয় তার থেকে। বরং স্কুল-কলেজে পড়তে করলা নদীর ধারে অথবা তিস্তার চরে ওরা দল বেঁধে হুটোপুটি করত যখন, সেদিককার ছোঁড়াগুলোও দল বেঁধে আসতই। ওর সঙ্গেই গায়ে পড়ে বেশি আলাপ করতে চেষ্টা করতে, আর পাত্তা না দেবার ফলে ওকেই বেশি জ্বালাতন করত।

কিন্তু বিয়েটা ওদের মধ্যে সোমারই সব থেকে ভালো হল। বান্ধবীদের বিয়ে আরো কারো কারো হয়েছে, কিন্তু সোমার মতো কারো নয়। সোমার বাবার টাকার জোর ছিল, অঢেল খরচ করেছেন তিনি। ছেলে আই. এ. এস অফিসার। আর সেই বিয়ের রাতে সোমাকে যেন রাজকন্যার মতো লাগছিল রাখির। সোমার পরে আরো দুই-একটি অন্তরঙ্গ বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে। তাতেও ঘটা মন্দ হয়নি। এ-সবের মধ্যে পাঁচ হাজার টাকায় নিজের বিয়ের চিত্রটা এত অনুজ্জ্বল ঠেকেছে চোখে যে মনে হয়েছে। তার থেকে বিয়ে না হওয়াই ভালো। বান্ধবীদের কাছে যে মাথাটা তার একেবারেই নীচু হয়ে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

মোট কথা পনের বছর বয়েস পর্যন্ত বহু আদর আর প্রশ্রয়ের মধ্যে চরিত্রের যে ভিত গড়ে উঠেছে রাখি গাঙ্গুলির, বিশ বছর বয়সের প্রতিকূল ধারার মধ্যে পড়ে সেটা বিপর্যস্ত হয়েছে শুধু–একটুও বদলায়নি।

এক বছর বাদে স্কুলেই চাকরি পেল। সরকারী স্কুলের চাকরি। অনেক ডিস্ট্রিক্ট স্কুলেই টিচার নেওয়া হচ্ছিল, এবারে তার ডিস্টিংশনের ছাপটাই কাজে লেগে গেল। এম. এ. বা অনার্স হলে আরো ভালো হত, মাইনে আরো কিছু বেশি পেত। যাই হোক, চেষ্টা-চরিত্র করলে কাছাকাছি থেকেই চাকরিটা করতে পারত। কিন্তু মনের আনন্দে সে দার্জিলিংয়ে চাকরি নিয়ে বসল। দার্জিলিং-এ থেকে চাকরি করবে এতে যেন নিজের কাছেই তার মর্যদা খানিকটা বেড়ে গেল। মনের আনন্দেই চাকরি করতে এলো।

কিন্তু এ আনন্দ খুব বেশিদিন থাকল না। গোড়ায় গোড়ায় হাতে যা পেত, ভাবত অনেক টাকা। কিন্তু কয়েকটা মাস না যেতে মাইনের অঙ্কটা কেমন জ্যোতিশূন্য ঠেকতে লাগল চোখে। তার প্রধান কারণ, সে হিসেব করে খরচ করতে জানে না। চোখে বা মনে কিছু ধরলে সেটার অধিকার না মেলা পর্যন্ত স্বস্তি নেই। দার্জিলিংয়ের মতো জায়গায় শীতের ভব্যসব্য বেশবাসের ব্যবস্থাতেই অনেক খরচ। এ ব্যাপারে স্কুল। মিসট্রেস বলে সে মান খাটো করতে রাজি নয়। তার ওপর খাওয়া-দাওয়া আর প্রসাধনসামগ্রীর খরচ। মাস কাবার হবার আগে প্রতিবারই দস্তুরমতো ফাঁপরে পড়ে যায় রাখি গাঙ্গুলি।

এই কারণেই স্কুলের চাকরির ওপর বিরূপ সে। মাইনেটা আরো শদেড়েক টাকা বেশি হলেও মনের আনন্দে কাটাতে পারত। টিচাররা আর মেয়েরাও সৌখিনভাবে থাকে। আড়ালে তাকে নিয়ে কথাও হয়, এটুকু বাড়তি মর্যদার মতো। এর থেকে নেমে আসতে মন সরে না। সেই ছেলেবেলা থেকেই দৃষ্টি উঁচুর দিকে, তার কী দোষ! দোষ ভাবে না, কিন্তু মাসের শেষে মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

.

এই শৈলশিখরেই সুবীরকান্তর সঙ্গে আলাপ এবং পরিণয় বিধিলিপি।

সুবীরকান্ত চক্রবর্তী:এখানকার কলেজের নতুন মাস্টার। নতুন বলতে দার্জিলিং এ নতুন। হুগলি না কোথাকার কোন কলেজ থেকে বদলি হয়ে এসেছে।

এ-সব পরের বৃত্তান্ত।

বিকেলে ম্যাল বা বাজারের দিকে সেজেগুজে বেড়াতে বেরিয়ে রাখি গাঙ্গুলির দিনকয়েক মনে হল দুর থেকে এক অল্পবয়সী ভদ্রলোক তাকে নীরবে লক্ষ্য করে। তা লক্ষ্য অমন অনেক সময় অনেকেই করে। এখানে মৌসুমের সময় বেড়াতে যারা আসে, পাহাড় দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাদের যেন মেয়ে দেখে বেড়ানোর বাই চাপে। এ তো তবু তার দিকে চেয়ে থাকে, রাখি এও দেখেছে, নীচের থেকে বেড়াতে এসে এখানে খেটে আর মেহনতী করে খায় যে মেয়েগুলো, হ্যাংলার মতো লোকগুলো ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে।…কিন্তু এ লোকটার তাকানোটা সে-রকম মনে হয়নি রাখির। বেশ পরিষ্কার চাউনি, আর বেশ একটু উৎসুক ভাব।

একদিন লেবংয়ের পথে দেখা হল। রাখি নামছিল আর লোকটা উঠছিল। ওকে দেখে দাঁড়িয়ে গেছল। রাখিও থামলে এগিয়ে এসে কথাই বলত হয়ত, কিন্তু রাখি দাঁড়ায়নি বা থামেনি। স্কুল-টিচারের এ-ধরণের গায়ে-পড়া আলাপ বরদাস্ত করা ঠিক নয়, এটুকু জ্ঞান তার আছে।

আর একদিন জলাপাহাড়ে দেখা। এই দিন আর আলাপ ঠেকানো গেল না। মাঝে মাঝে এসে বসে এখানে। সহকর্মিণীরাও সঙ্গে থাকে প্রায়ই। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আসেনি, রাখি একাই বসে গুনগুন করে গান গাইছিল। এক সময়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে অদূরে লোকটা দাঁড়িয়ে। উৎসুক দৃষ্টি, ঠোঁটের ডগায় সামান্য। হাসির আভাস। চোখাচোখি হতে দুহাত জুড়ে নমস্কার জানিয়ে লোকটা এগিয়ে এলো।

–কিছু মনে করবেন না, আপনার নাম রাখি গাঙ্গুলি?

সরাসরি একেবারে নামের ওপর চড়াও না হলে এই আলাপের ইচ্ছেটা রাখি বাতিলই করে দিত। কারণ এক্ষুনি সুলতাদি বা মুখরা রমলাদি ওদের কেউ এসে গেলে জেরার চোটে রাখিকে অস্থির করে মারবে। কিন্তু অচেনা লোকের মুখে নিজের নাম শুনে বিরক্তির বদলে অবাক হল। মাথা নাড়তে আবার প্রশ্ন হল, আপনি। জলপাইগুড়ির মেয়ে আর ওমুকের ভাইঝি তো?

ছোট কাকার নামই করল। কিন্তু এবারের প্রশ্নটা কেন যেন খুব মার্জিত ঠেকল রাখির কানে।

এবারেও মাথা নেড়ে মৃদু প্রশ্ন করল, আপনি?

লোকটা জবাব দেবার আগে আরো একটু কাছে এগিয়ে এলো। পাশে বসেই পড়ে কিনা সেই ভয় রাখির। হাসিমুখে জবাব দিল, আমি জলপাইগুড়িতে আমার কাকার বাড়িতে অনেকবার কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছি। আমার কাকা আপনার কাকার খুব বন্ধু। তখন আপনাকে তিস্তার ধারে অনেকবার দেখেছি।

কাকার যে নাম করল, সেটা বিলক্ষণ চেনাই বটে। রাখির ছোট কাকার অন্তরঙ্গ বন্ধু শুধু নয়, সে বাড়িতে রাখি বা রাখির মায়ের যাতায়াতও আছে। ওদের বাড়ির মেয়েরাও তাদের বাড়িতে আসে। কিন্তু কাকার বন্ধুর ভাইপোর সঙ্গে আর আলাপ বাড়ানোর ইচ্ছে খুব নেই রাখির। সুলতাদি-রমলাদিরা আসার আগে সরে গেলেই ভালো হয়। তাই নিস্পৃহ একটা উক্তি বেরুলো গলা দিয়েও…।

কিন্তু লোকটার কেটে পড়ার ইচ্ছে নেই বোঝা গেল। হাসিমুখে বলল, আমার নাম সুবীরকান্ত চক্রবর্তী-এবার এখানে আসার আগেও জলপাইগুড়িতে কাকার বাড়ি হয়ে এসেছি। কাকা আপনার কথা বলছিলেন, আপনি এখানকার স্কুলে কাজ করছেন। …দেখা করে আলাপ করতে বলেছিলেন, আপনার কাকাও বলেছিলেন। হাসল। কিন্তু কদিন আপনাকে দেখেও ঠিক ভরসা পেয়ে উঠিনি। আর আপনার সঙ্গে প্রায়ই অন্য মেয়েরাও থাকেন…তাই একদিন আপনাদের বোর্ডিংয়েই যাব ভাবছিলাম।

আলাপে এগোতে ভরসা পেয়ে ওঠেনি পর্যন্তই শুনতে খারাপ লাগেনি। নিতান্ত সৌজন্যের খাতিরেই রাখি গাঙ্গুলি জিজ্ঞাসা করল, এখানে বেড়াতে এসেছেন?

এই সামান্য প্রশ্নটাই যেন একটা পাথর ছেড়ে পরের পাথরটায় বসে পড়ার পাসপোর্ট। কিন্তু জবাব যা পেল তা শোনার জন্যে খুব প্রস্তুত ছিল না রাখি গাঙ্গুলি। বলল, বেড়াতে এলে তো কবেই পালিয়ে বাঁচতাম। এসেছি এখানকার কলেজে মাস্টারি। করতে। কী কুক্ষণেই যে বদলি হতে রাজি হলাম!

কলেজের মাস্টার শুনে রাখি এবার এবং এই প্রথম কাছে থেকে ভালো করে দেখল মানুষটাকে। ছোট করে ছাঁটা চুল, চাকচিক্যশূন্য সাদামাটা মুখ–কেবল চাউনি ভারি পরিষ্কার আর উজ্জ্বল। চোখ দুটো লক্ষ্য না করলে মানুষটাকে নিরীহ বোকা। গোছের মনে হবে।

–এখানকার গভর্নমেন্ট কলেজে?

–হ্যাঁ, তাছাড়া আর বদলি হয়ে আসব কী করে? …এসে এই দুমাসের মধ্যেই। হাঁপ ধরে গেছে, এখন থেকেই কবে পালাতে পারব ভাবছি।

কলেজের মাস্টার শোনার পর আগের মতো আর অবজ্ঞার চোখে দেখা গেল না লোকটাকে। রাখি জিজ্ঞাসা করল, কেন?

-প্রথম কারণ, এখানকার অভদ্র রকমের শীত। একেবার জ্বালিয়ে মারলে। দ্বিতীয় কারণ, রাস্তাঘাট। হয় নাক উঁচিয়ে উঠতে হবে, নয়তো চোখ পায়ে ঠেকিয়ে নামতে হবে–আর তৃতীয় কারণটাই আসল, এখানে এ মাইনেয় পোযায় না, এখানে চাকরি করতে হলে মাইনে ডবল হওয়া উচিত।

জবাবটা বেশ স্বচ্ছ ঠেকল কানে। অথচ এই বয়সের লোকের শীতে কাবু হওয়া বা উঁচু-নীচু পথের দরুণ বিতৃষ্ণ হওয়া তেমন বীরোচিত সমস্যা বলে ঘোষণা করা উচিত নয়। আর শেষের উক্তির সঙ্গে রাখিও একমত। কিন্তু এই সামান্য আলাপের মধ্যে খরচায় না পোষানোর কথাটা রাখি গাঙ্গুলি অন্তত বলে ফেলতে পারত না। কিন্তু একজন কলেজের মাস্টার আর একজন স্কুল মাস্টারকে এ-কথা বলছে বলেই হয়ত ঝরঝরে স্পষ্টোক্তির মতো লাগল কথাগুলো।

পিছনে রমলাদির গলা শুনে রাখি সচকিত হয়ে ঘাড় ফেরাল। সুলতাদি আর রমলাদি দুজনেই এদিকে আসছে। রমলাদি বোধহয় পাথরে হোঁচট-টোচট খেয়েছে, তার গলা দিয়ে অস্ফুট একটা কাতর শব্দই বেরিয়ে এসেছে। সুবীরকান্তও ফিরে তাকিয়েছে। সুলতাদি হাসি চাপতে চেষ্টা করছে।

কাছে এসে দুজনেই গম্ভীর। রমলাদি আরো বেশি। সুবীরকান্ত তাদের উদ্দেশ্যে দুহাত কপালে তুলল। জবাবে তারা একবার মাথা নেড়ে সপ্রশ্ন গম্ভীর দৃষ্টিতে রাখির। দিকে তাকালো।

রাখি তাড়াতাড়ি পরিচয় করিয়ে দিল, ইনি এখানকার গভর্নমেন্ট কলেজের প্রোফেসার, সুবীরকান্ত চক্রবর্তী, দার্জিলিংএ নতুন এসেছেন–

সুবীরকান্ত সবিনয়ে বলল, প্রোফেসার হবার আশা শিগগীরই আছে বটে, তবে এখনো লেকচারার।

রমলাদি গম্ভীরমুখে সুলতাদিকে বলল, বোসো সুলতা। নিজেও একটা ছোট পাথরে বসে সদ্যপরিচিতের দিকে তাকালো।–আমরা স্কুলমাস্টার, তাই কলেজের ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাকটরকেও প্রোফেসার বলে সম্মান দেখাই, আপনি হবু প্রোফেসার যখন, আমাদের চোখে প্রায় ভাইস প্রিন্সিপাল।

মাত্রা-ছাড়ানো রসিকতার কথা শুনে সুবীরকান্ত হাসতে চেষ্টা করল একটু। সুলতাদি ফস করে জিজ্ঞাসা করে বসল, রাখির সঙ্গে আগে আলাপ ছিল না, এখানে নতুন এসে আলাপ হল?

এদের এই বেশি-বেশি কথা বিচ্ছিরি লাগছিল রাখির। সুবীরকান্ত জবাব দিল, আলাপ আজই…তবে জলপাইগুড়িতে আগেও দেখেছি ওঁকে, আমার কাকা আর ওঁর কাকা বিশেষ বন্ধু।

–ও। রমলাদি গম্ভীরমুখেই মাথা নাড়ল।–সেই জন্যেই, নইলে কলেজের মাস্টাররা স্কুলের মাস্টারদের দিকে ফিরেও তাকায় না।

সুবীরকান্ত জবাব দিল, তা কেন, অবস্থা তো দুজনেরই সমান।

সুলতাদি যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল, ফোড়ন কাটল, দার্জিলিংয়ের উঁচু জায়গায় এসে আপনার দৃষ্টির আধোগতি হয়েছে দেখছি-কলেজে কী পড়ান, ফিলসফি নিশ্চয়ই?

-আজ্ঞে না, ইতিহাস।

ছদ্ম-বিস্ময়ে সুলতাদি তার সহচরীর দিকে ফিরল।-তুমিও তো ইতিহাস পড়াও রমলাদি, এ-রকম সাম্যবাদের কথা আছে নাকি কোথাও?

ঠোঁট উল্টে রমলাদি জবাব দিল, ঢের। সুলতান মামুদ নাদির, তৈমুর লং মন্দির দেখলেই ধ্বংস করেছে, ছোট বড় তফাত করেনি, আর খুন করার সময়ও মেয়ে-পুরুষে তফাত রাখেনি। তারপর ইংরেজ… হিন্দু মুসলমান ফরাসী শিখ–কাউকে ছোট করে দেখেনি, সক্কলের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে।

দুই মহিলার দ্বারা এ-ভাবে আক্রান্ত হয়ে আঁর শেষে সাম্যবাদের এই বেপেরোয়া বিশ্লেষণ শুনে সুবীরকান্ত গোবেচারার মতো হাসতে লাগল। রাখি ভাবছে, লোকটা বুদ্ধিমান হলে এবার তার উঠে পালানো উচিত।

সুলতাদি বলল, রমলাদি একটু বেশি কথা বলেন, আপনি কিছু মনে করবেন না যেন।

হাসিমুখে মাথা নেড়ে সুবীরকান্ত এবারে উঠেই দাঁড়াল।–না, এখানে এসে পর্যন্ত একঘেয়ে লাগছিল, আলাপ হয়ে আজ সময়টা বরং ভালই কাটল। আচ্ছা, আবার দেখা হবে নিশ্চয়

সুলতাদি সায় দিল, নিশ্চয়, আমরা তো প্রায়ই আসি এখানে।

সকলের উদ্দেশে নমস্কার জানিয়ে সুবীরকান্ত প্রস্থান করল। সেদিকে খানিক চেয়ে থেকে রমলাদি ডাকল, রাখি–

এবারে তাকে নিয়ে পড়বে ওরা, রাখি ভালই জানে। সদ্যপরিচিত একটা লোকের সামনে এই গোছের বাঁচালতা তার ভালো লাগছিল না। ডাক শুনে তাকালো শুধু।

-একটা গান কর তো!

রাখি কোনদিন গান করেও নি, গান জানেও না। কিন্তু এই ফর্মাসের তাৎপর্য বুঝেছে। এই দুজনের মধ্যে রমলাদির মুখখানাকেই সকলে বেশি সমঝে চলে। বয়েস ছত্তিরিশ, দেখতে ভালো নয়, বিয়ে-থা হবার আশা নিজেও আর রাখে না। কিন্তু এতটুকু রসের হদিস পেলে আর রক্ষা নেই।

–তোমার প্রাণে বাতাস লেগে থাকে তো তুমি করো!

টেনে টেনে রমলাদি বলল, লেগেছে, ছত্তিরিশের প্রাণে বাহাতুরে বাতাস, গান। কর না একটা, আজ বোধহয় চেষ্টা করলে পারবি!

রাখি হেসে ফেলল।

অমনি সোজা হয়ে বসে চোখ পাকালো রমলাদি।–আবার হাসি! বলি, এক কাকার ভাইপোর সঙ্গে আর-এক কাকার ভাইঝির কিছু একটা হয়ে-টয়ে যাবার সম্ভবনা আছে?

রাখি প্রায় রাগ করেই বলল, তুমি একটি অসভ্য!

–ও! আর নিজেরা যে নিরিবিলিতে ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে বসেছিলি? স্কুলের কোনো মেয়ে দেখে ফেললে?

রাখি প্রতিবাদ করল, ঘেঁষাঘেঁষি, মানে! ভদ্রলোক তো ওই পাথরে বসেছিল।

সুলতাদি ইন্ধন যোগালো, পাহাড় কিনা, নীচে থেকে ঘেঁষাঘেঁষি মনে হয়।

–হোক। পাহাড়টা কী আমার, ভদ্রলোক এসে বসলে কী করব?

রমলাদি তক্ষুনি জবাব দিল, দুটো কাজ করতে পারতিস। আসামাত্র বলে উঠতে পারতিস, এসো নাথ, আমি উমা, শিবের তপস্যায় এই শৈলশিখরে বসে মাথা খুঁড়ছি! নয়তো এসে বসামাত্র পাথর তুলে তাড়া করতে পারতিস! কিছুই যখন করলি না, বুঝতে হবে তোর মনে অনিশ্চয়তার পাপ ঢুকেছে।

নিরুপায় রাখি আবারও হেসেই ফেলল।

এখানেই যে প্রজাপতির নির্বন্ধ সেটা রাখি দিনকতকের মধ্যেই জেনেছে। আর সেটা এমন আচমকা জানা যে সে হকচকিয়ে গেছল।

তার আগে কটা দিন সুবীরকান্তর সঙ্গে প্রায় রোজই দেখা হয়েছে। কোনদিন রমলাদি-সুলতাদির সামনে, কোনোদিন বা একা। এই দেখা হয়ে যাওয়াটা যে লোকটার সক্রিয় চেষ্টার ফল সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি। রমলাদি-সুলতাদির ঠাট্টা-তামাসায় নাজেহাল হয়ে লোকটার প্রতি রাখি বলতে গেলে একটু বিরক্তই তখন।…কলেজের মাস্টার, এমনিতে হাবভাব গম্ভীর, কিন্তু তার মধ্যেই তার প্রতি উৎসুক-উৎসুক ভাবটা রাখি টের পায়। রমলাদি সুলতাদি আরো বেশি টের পায়। তাকে একলা দেখলে যেন আরো বেশি খুশি হয়। গায়ে পড়ে নিজের কাকার কথা বলে, ওর কাকার কথা, বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করে, স্কুলে কী পড়ায়, উঁচু ক্লাসে পড়ায় কিনা খোঁজ নেয়–আর কিছু কথা না পেলে রমলাদি-সুলতাদির প্রশংসা করে।

রাখিও মনে মনে বলে–সুবীরকান্ত না হ্যাংলাকান্ত!

কিন্তু আচমকা সেদিন এক অভাবিত মানসিক বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে গেল রাখি গাঙ্গুলি।…রমলাদি আর সুলতাদির সঙ্গেই জলাপাহাড়ের দিকে যাচ্ছিল, কিছুদূরে ওই মূর্তি। গম্ভীর মুখে যেন তারই প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। রমলাদি গলা দিয়ে একটা চাপা শব্দ বার করে রাখিকে বলল, একটু ভাওতাবাজী করব?

–যা খুশি করগে। ভ্রুকুটি করে রাখি জবাব দিল।

–আচ্ছা তুই বোসগে যা। বলেই সুলতাদির হাত ধরে টেনে রমলাদি ভাঁওতাবাজী করতে চলল। রাখি একাই তাদের বসার জায়গায় উঠে গেল।

কিন্তু মিনিট সাতেক না যেতেই অবাক সে। তক্ষুনি বুঝে নিল রমলাদি ভাওতাবাজীটা আসলে কার সঙ্গে করেছে। তার দিকেই একলা উঠে আসছে সুবীরকান্ত, ওরা দুজন নিপাত্তা।

কাছে এসে সামনের পাথরটায় বসে পড়ল। তাড়াতাড়ি ওঠার দরুণ অল্প অল্প হাঁপাচ্ছে। বলল, এ-রকম শরীর খারাপ নিয়েও পাহাড়ে ওঠা-নামা করেন কী করে, আশ্চর্য! তার ওপর আজ সমস্ত দিন কিছু খাননি শুনলাম!

রাখির রাগই হচ্ছে, সেই সঙ্গে বিব্রতও কম নয়। জবাব না দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওঁরা কোথায়?

–ওঁরা বাজারের দিকে গেলেন। বললেন, শরীর খারাপ তাই আপনার জন্যে ফল কিনতে যাচ্ছেন, আর আমাকে বললেন, গল্প করার ইচ্ছে থাকলে ওপরে চলে। যান। হাসল। রমলা দেবী আবার ঠাট্টা করলেন, আমার বরাতেও কিছু ফল-টল জুটতে পারে।…আমি বেশ পেটুক আছি জানেন, এবারে আসার আগে আপনার মা আমাকে একদিন খুব যত্ন করে খাইয়েছিলেন…কী চমৎকার রান্না তার!

কী থেকে কী কথা! রাখি অবাক, আমার মা?

-হ্যাঁ, কাকা নিয়ে গেছলেন। খুব ভালো লেগেছিল তাকে।

রাখি ভেবেই পেল না তার মা হঠাৎ এই লোককে আদর-যত্ন করে খাওয়াতে গেল কেন? সুবীরকান্ত অন্তরঙ্গ সুরে জিজ্ঞাসা করল, যাক, আপনার কী হয়েছে বলুন তো?

-কিছু না।

সমস্ত দিন কিছু খান নি শুনলাম যে?

–খেয়েছি। ঈষৎ বসুরে জবাব দিল, তাছাড়া দার্জিলিংয়ের বাতাস খেলেও কিছু কাজ দেয়।

-বলেন কি! আমার তো উল্টে ঘণ্টায় ঘণ্টায় খিদে পায়! হাসছে।…ওঁরা তাহলে ঠাট্টা করেছেন, আমি কিন্তু আজ সত্যি আপনাকে খুঁজছিলাম–দেখা না হলে হয়ত আপনার বোর্ডিংয়েই চলে যেতাম।

রমলাদি আর সুলতাদির জন্যেই মেজাজ প্রসন্ন নয় রাখির। অন্তরঙ্গ উক্তিটা তাই স্পর্ধার মতো ঠেকল কানে। জিজ্ঞাসু দুচোখ তার মুখের ওপর থমকালো।

সুবীরকান্ত বলল, সামনে চার দিন ছুটি আছে, আপনাদেরও ছুটি নিশ্চয়, ভাবছি একবার জলপাইগুড়ি ঘুরে এলে হয়।…যাবেন?

–না।

এ-রকম সাদাসাপ্টা জবাব আশা করেনি সুবীরকান্ত। মুখের দিকে একটু চেয়ে থেকে আবার বলল, ছুটির মধ্যে এখানে বসে থেকে কী করবেন, চলুন না একসঙ্গে ঘুরে আসি।

রাখির রাগ চড়ছে। মাসের শেষে হাত খালি, ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া হত না। কিন্তু অসহিষ্ণুতার আসল কারণ, লোকটার হ্যাংলামি দেখে। মাত্র কটা দিনের আলাপে এ-রকম অনুরোধ করার মতো অন্তরঙ্গতা কিছু হয়নি। কিন্তু কলেজের মাস্টারের সঙ্গে কত আর অভদ্র ব্যবহার করতে পারে। আবারও সংযত জবাবই দিল, না, আমার যাওয়া সম্ভব নয়।

একটু চুপ করে থেকে লোকটা দ্বিধান্বিত মুখে হাসল একটু। তারপর বলল, আপনি বোধহয় বিরক্ত হচ্ছেন, কিন্তু এদিকে আমি একটু মুশকিলে পড়ে গেছি…যাবেন না যখন, বোঝাপড়াটা এখানেই সেরে নিই…আপনার সত্যই শরীর খারাপ নয় তো?

এবারে রাখি অবাক। গোড়া থেকেই আজ কথাবার্তার সুর অন্যরকম ঠেকছিল কানে। জবাব না দিয়ে মুখের দিকে তাকালো শুধু।

সুবীরকান্ত পকেট থেকে খাম বার করল একটা। তারপর সেটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, দার্জিলিংয়ে আসার পর আমার কাকার এই তিন নম্বর চিঠি। পড়ুন

বিস্ময়ের ওপর বিড়ম্বনা।–আমি কেন!

-আপনার আর আপনার মায়ের ব্যাপার নিয়ে লেখা। পড়ুন।

–রাখি খামটা নিল। খুলল। কিন্তু পড়তে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে দেহের রক্তকণাগুলো বুঝি মুখের দিকে ছোটাছুটি আরম্ভ করে দিল। একটু অনুযোগের সুরেই ভাইপোকে কাকা লিখেছেন, এর আগে দুদুটো চিঠি লিখেও আসল প্রসঙ্গের জবাব পাননি। দার্জিলিংয়ে আসার সময় সে কথা দিয়ে গেছল রাখি গাঙ্গুলির সঙ্গে দেখা করে এবং আলাপ করে তার মতামত জানাবে। এদিকে ভদ্রমহিলা (রাখির মা) আশায় দিন গুনছেন আর প্রায় রোজই খোঁজ নিচ্ছেন ভাইপোর মতামত কিছু জানা গেল কিনা। ভরসা পেলেই মেয়েকে তিনি চিঠি লিখতেন। কোনো খবর না পেয়ে মহিলা ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছেন। কাকা লিখেছেন, পছন্দ যদি না-ই হয়ে থাকে তো এভাবে ঝুলিয়ে না রেখে সেটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে অসুবিধে কি? শেষের মন্তব্য, তাঁর মতে মেয়েটি ভালো এবং অপছন্দের নয়, ভাইপো এখানে বিয়ে করলে ব্যক্তিগতভাবে তিনি খুশিই হতেন।

চিঠি শেষ করতে গিয়ে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে বসেও রাখি ঘেমে ওঠার দাখিল। চিঠি খামের মধ্যে পুরে রাখতে গিয়েও হাত কাঁপছে যেন। ও যতক্ষণ চিঠি পড়ছিল, সুবীরকান্ত ওর মুখের ওপর থেকে চোখ ফেরাতে পারেনি। বিড়ম্বিত রমণী-মুখের এমন মিষ্টি কারুকার্য আর বুঝি দেখেনি! হাত বাড়িয়ে খামটা নিল।

রাখি আর এদিকে ফিরে তাকাতেও পারছে না।

একটু অপেক্ষা করে সুবীরকান্ত বলল, এখন আমার মত আমি জানাতে পারি, কিন্তু একতরফা মতের উপর তো কিছু নির্ভর করছে না, কী জবাব দেব বলুন?

নিজেকে রাখি বচনপটু বলে জানত। কিন্তু এখন আর গলা দিয়ে শব্দ বেরুতে চায় না। এমন আচমকা বিড়ম্বনার মধ্যে জীবনে পড়েনি। সামনের দিকে চোখ রেখেই বলল, এ সম্পর্কে আমি কিছু ভাবিনি।

–ঠিক কথা।…আপনার মা আপনাকেও লিখলে পারতেন, তাহলে এ-রকম বিব্রত বোধ করতেন না। তার বোধহয় ধারণা, আমার মত পেলেই আটকাবে না। সে যাক, আপনার ভাবার সুবিধের জন্যে নিজের সম্পর্কে দুই-একটা কথা বলে রাখি। জলপাইগুড়ির ওই এক কাকা ছাড়া আমার তিনকুলে আর কেউ নেই। ম্যাট্রিক থেকে এম.এ. পর্যন্ত স্কলারশিপের টাকায় পড়েছি। বি.এ. আর এম. এ. দুটোতেই ফার্স্টক্লাস পেয়েছি। একেবারে প্রোফেসারি পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পিছনে সুপারিশের জোর না থাকায় লেকচারারের পোস্ট অ্যাকসেপ্ট করতে হয়েছে, আর এক-আধ বছরের মধ্যে প্রোফেসার হব আশা করাটা খুব বেশি হবে না বোধহয়।

এতগুলো কথা শোনার ফাঁকে রাখি কখন এদিকে মুখ ফিরিয়েছিল জানে না। কথা শেষ হতে খেয়াল হল দুজনে দুজনার দিকে চেয়ে আছে। তাড়াতাড়ি মুখ ফেরাল আবার।

সুবীরকান্ত উঠে দাঁড়াল।–আচ্ছা আর বিরক্ত করব না, ভেবে আমাকে জানাবেন।

চলে যাচ্ছে। রাখি সেদিকে চেয়ে আছে। যতক্ষণ দেখা গেল চেয়েই রইল। তারপর খেয়াল হল, রমলাদি সুলতাদি এক্ষুনি ফিরে এসে তাকে নিয়ে পড়বে।

উঠে হনহন করে সেও বোর্ডিংয়ের উদ্দেশে নেমে চলল। গিয়ে কোন রকমে ঘরের দরজা বন্ধ করতে পারলে হয়। ভিতরটা কেমন যেন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তার। আবার সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে, পাহাড়ী শহরটার রঙ যেন এক মুহূর্তে বদলে গেছে।…প্রথম দিন এসে আলাপ করা থেকে এ-পর্যন্ত লোকটার কোনো আচরণই এখন আর বিসদৃশ লাগছে না।

.

কটা দিনের মধ্যে রাখি আর বোর্ডিং ছেড়ে বেরুতেই পারল না। কী একটা সঙ্কোচ যেন পায়ে জড়িয়ে আছে তার।

নিজের বিয়ের সম্পর্কে ওর নিজেরই কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না। বিয়ের কল্পনা করেনি এমন নয়–করেছে যখন বেশ ঘটা করেই করেছে। কল্পনায় ঘটা করতে দোষ। কী? সেই সম্ভাব্য জীবনের মানুষকে একসময় সর্ব-যোগ্যতার চূড়ায় তুলেও বসিয়েছে। তার সঙ্গে আর যাই হোক, কলেজের মাস্টার সুবীরকান্ত চক্রবর্তীর মিল। নেই। কিন্তু নিজের এই সংগোপন কল্পনাটাকে রাখি গাঙ্গুলি বাস্তবের মর্যাদা কখনো দেয়নি। বরং আচমকা যে মানুষটা এগিয়ে এসেছে তাকেই এখন অন্যরকম লাগছে।…চেহারা সাদামাটা হলেও চোখদুটো ভারী উজ্জ্বল। কথাবার্তাগুলোও স্পষ্ট আর স্বচ্ছ। ম্যাট্রিক থেকে এম.এ. পর্যন্ত স্কলার, এও খুব কম কথা নয়। তার ওপর স্কুল-মাস্টার তো নয়, প্রোফেসার। প্রোফেসার আর লেকচারারে এখনো খুব তফাত দেখে না সে।

….সেদিনের নিজের ব্যবহারে রাখি নিজেই লজ্জা পাচ্ছে। কী করে জানাবে ভিতরে ভিতরে এই ব্যাপার চলেছে। রমলাদি আর সুলতাদির ঠাট্টাতামাসা–কলেজ-মাস্টারের হ্যাংলামি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেনি। চারদিনের ছুটি শুয়ে বসে কেটে যাচ্ছে, একসঙ্গে জলপাইগুড়ি গেলেও মন্দ হত না। অন্তত ওরকম ঠাসঠাস জবাব না দিলেও

আবার বিয়েটা এখানে যে হয়েই যাবে, চিন্তার এই নিশ্চিত প্রশ্রয়েও গা ভাসাতে পারছে না।…বিয়ের বাজারে এই সব ছেলের দামও কম নয়। কতটা আশা করে বসে আছে, ঠিক কি? যদিও খুব বেশি আশা করছে বলে তার মনে হয় না। তবু তাকে এখানে এই বড়লোকী চালে থাকতে দেখে কী ভেবে বসে আছে ঠিক কী? তাদের বাড়ি-ঘরের ভেতরের অবস্থা ঠিকঠিক জানে কী না তাই বা কে জানে!..মায়ের তো ওই পাঁচ হাজার টাকা সম্বল!

চিন্তা যে ভাবেই করুক, বাইরে বেরুবার জন্যে ভেতরটা কদিন ধরে ছটফট করছিলই। সেদিন সকালে মায়ের একটা চিঠি পেল। অন্যান্য পাঁচকথার পর মা লিখেছে, ওমুকের ভাইপো সুবীরকান্ত নামে একটি ছেলের সঙ্গে তার ইতিমধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা জানাতে। ছেলেটি এখানকার কলেজের প্রোফেসার। তাকে দেখে আর তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে খুবই ভালো লেগেছিল। আশা ছিল, নির্বন্ধ থাকলে এখানেই রাখির বিয়েটা দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারবে। তার কাকাও আশা দিয়েছিল। এতদিনেও কোনো খবর না পেয়ে মনে হচ্ছে–হবে না। ছেলেটির হয়ত আরও বড় ঘরে বিয়ে করার ইচ্ছে। তবু এ-রকম কোনো ছেলের সঙ্গে কখনো দেখা হয়েছে কিনা মেয়েকে জানাতে লিখেছেন।

সেই বিকেলেই রাখি চুপচাপ একা না বেরিয়ে পারল না। রাস্তায় নেমেই বুকের ভেতরটা কেমন ঢিপঢিপ করতে লাগল।

জলাপাহাড়েই উঠল।

কেউ কোথাও নেই।…নিজে থেকে এসে আন্দাজে কোথায় খুঁজবে? একবার ভাবল ম্যালের দিকটা ঘুরে এদিকে এলে পারত। আবার ভাবছে সেটা যেন বেশি বেশি হবে। পরিচিত জায়গাটা ছেড়ে আরো খানিকটা পিছনদিকে পাহাড়ের আড়ালে গিয়ে বসল। এরও মনস্তত্ত্বগত কারণ আছে। রমলাদি সুলতাদি এসে পড়লে দূর থেকে দেখে ভাববে কেউ নেই। কিন্তু যে কারণে এই সাবধানতা, তারই দেখা মিলবে কিনা কে জানে!

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। দেখা মিলল। কাছে এসে দাঁড়াল। আগের দিনের মতো সামনে বসে পড়ল না। বলল, সেদিন ও-কথা বলে আপনাকে এতটা বিব্রত বা বিরক্ত করা হবে বুঝতে পারিনি। কটা দিন আপনার বেরুনোই বন্ধ হয়ে গেল! যাক, আপনার দিক থেকে কোনো সঙ্কোচের কারণ নেই, ও ব্যাপারে স্বাধীন মতামত তো সকলেরই থাকা স্বাভাবিক। কিছু মনে করবেন না, দ্বিতীয়বার আর বিরক্ত করব না।

রাখি ফাঁপরে পড়ল। ও যে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে–এই রকমই ভাবা স্বাভাবিক। …এবারে চলেই যাবে বোধহয়। অতএব তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, আপনি জলপাইগুড়ি যান নি?

সুবীরকান্ত হাসল একটু। প্রশ্নটা যেন আশাপ্রদ ঠেকল কানে। বলল, যে জন্যে যাবার চিন্তাটা মাথায় এসেছিল তার আলোচনা তো এখানেই হয়ে গেল। এরপর কিছু না জেনে সেখানে একলা ছুটে লাভ কী?

রাখি নীরব আবার। কী ভাবে যে প্রাসঙ্গিক আলাপটা শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না।

–আপনি কী ভেবেছিলেন আমি জলপাইগুড়ি চলে গেছি?

এবারে রাখি একটু বুদ্ধিমতীর মতো কাজ করল। হাঁ-না কিছুই জবাব না দিয়ে। অল্প একটু হেসে বলল, বসুন।

কদিনের মধ্যে দেখা না মেলার একটাই অর্থ ধরে নিয়েছিল সুবীরকান্ত। তাকে এড়াবার চেষ্টা। কিন্তু এই সামান্য অভ্যর্থনার ফলেই সংশয় দেখা দিল। সামনের পাথরে বসে ঈষৎ আগ্রহ নিয়েই তাকালো তার দিকে।

অন্য দিকে চোখ রেখে মৃদু গলায় রাখি বলল, আজ সকালে আমিও মায়ের চিঠি পেয়েছি।

আরো কিছু শোনার আশায় সুবীরকান্ত অপেক্ষা করল একটু। তারপর জিজ্ঞাসা। করল, আমি কী ধরে নেব, আমার সেদিনের প্রস্তাবটা বাতিল হয়ে যায় নি?

চোখ তুলে রাখি একবার তার দিকে না তাকিয়ে পারল না। আর তার পরেই সঙ্কোচ কেমন কমে আসতে লাগল। আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করল, আমাদের বাড়ির সব খবর আপনার জানা আছে?

সুবীরকান্ত অবাক একটু।–কী খবর?

আরো মৃদু সুরে রাখি জবাব দিল, আমাদের বাড়ির অবস্থা-টবস্থা…

বলার পর নিজেরই বিচ্ছিরি লাগল রাখির। অনুরাগ-পর্বের যেটুকু জানা আছে। তাতে কোনো মেয়ে নিজে মুখ ফুটে এ-কথা বলেছে বলে শোনেনি। ওদিকে বক্তব্যটা বোধগম্য হতে সুবীরকান্ত তার দিকে চেয়ে হাসছে মিটি মিটি। বলল, কাকা কিছু কিছু বলেছেন, কিন্তু ও নিয়ে আমি মাথা ঘামানো দরকার মনে করিনি।…আমি গরিবের ছেলে, রাজত্ব বা রাজকন্যার আশা রাখি না, শুধু মনের মতো একটি কন্যা পেলেই খুশি।

কথাগুলো কান পেতে শোনার মতো। রাখির সমস্ত মুখে লালের আভা ছড়াচ্ছে। হাসছে অল্প অল্প। হাওয়া অনুকূল সেটা সুবীরকান্ত বুঝে নিয়েছে। তাই আরো কিছু বলার লোভ সংবরণ করতে পারল না। সামনের দিকে আর-একটু ঝুঁকল। হাসছে।–বললে বিশ্বাস হবে কিনা জানি না, বছর আটেক আগে একবার কাকার কাছে এসে তিস্তার চরে কতগুলো মেয়েকে হুটোপুটি করতে দেখতাম। তার মধ্যে একটি মেয়েকেই ভারী জীবন্ত মনে হত আমার। তারপর আরো অনেকবার এসেছি, অনেকবার দেখেছি, কিন্তু দার্জিলিংয়ে এসে কাকা যে সেই মেয়েকেই দেখতে বলে দিয়েছিলেন এতবার করে, কী করে জানব!

লজ্জা সত্ত্বেও রাখি আবার তার চোখ না তুলে পারল না। এই মুহূর্তে যেন একটা অদ্ভুত ভালো লাগার স্বাদ তার অস্তিত্ব ভরাট করে তুলছে।

সুবীরকান্ত সরাসরি কাজের কথায় চলে এলো এবার।–এখন তাহলে আমি আমার কাকাকে চিঠি লিখতে পারি?…হাঁ কী না বলো?

মুখে বলা গেল না। রাখি হাসিমুখে মাথা নেড়ে সায় দিল। পুরুষগুলো এত চট করে আপনি থেকে তুমিতে চলে আসে কী করে ভেবে পায় না!

ভাবতে না পারার আরও একটু বাকি ছিল। মাথার ওপর একটা চলতি মেঘ যে আরো একটু আচমকা কৌতুক বর্ষণের জন্যে এগিয়ে এসেছিল দুজনের কেউ লক্ষ্য করেনি। হঠাৎ একপশলা বৃষ্টিতে সচকিত দুজনেই। রাস্তায় বেরুলে এখানে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতোই ছাতা একটা থাকে সঙ্গে। সুবীরকান্তর সঙ্গে ছাতা আছে, কিন্তু বেরুবার তাড়ায় রাখি ছাতা আনতে ভুলে গেছে। চট করে নিজের ছাতাটা খুলে এগিয়ে এলো, তারপর রাখির গা ঘেঁষে ওই পাথরটাতেই বসে পড়ল।

দুজনে অনায়াসে বসার মত বড় নয় পাথরটা। রাখি আড়ষ্ট একটু। গায়ে গা ঠেকছে, কাঁধে কাধ লাগছে। তাছাড়া অন্তরঙ্গ না হলে পাঁচমিনিটের বৃষ্টির ঝাঁপটায় সর্বাঙ্গ ভিজবে। কিন্তু পাশের লোকের তাকে ভিজতে দেবার ইচ্ছে নেই। বৃষ্টির ধারা আরো জোরে নামতে একেবারে গায়ের সঙ্গে লেগেই বসল। ওদিকে আচমকা বৃষ্টির প্রথম ঝাঁপটাতেই রাখির মুখ আর মাথার খানিকটা ভিজে গেছে।

সুবীরকান্ত হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল, আজ ছাতা আনোনি যে?

–ভুলে গেছি।

সুবীরকান্ত বলল, ভুলের জন্যে কৃতজ্ঞ।

রাখিও হেসেই ফেলল।

পাঁচমিনিটের বৃষ্টি। মেঘটা চলে যেতেই ঝলমলে আলো। যেন রসিকতা করার জন্যই আসা। ছাতা বন্ধ করে সুবীরকান্ত পকেট থেকে রুমাল বার করে হাতমুখ মুছতে গিয়ে দেখে রাখি তার ব্যাগ খুলে রুমাল খুঁজছে। ব্যাগে রুমাল নেই, অর্থাৎ তাও ভুলেছে।

হাসিমুখে সুবীরকান্ত নিজের রুমাল এগিয়ে দিল। দ্বিধা দেখে রুমালটা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, বিপাকে পড়লে লজ্জা করতে নেই!

অগত্যা তার রুমালেই মুখ মুছল রাখি। শরীরে কী এক অজানা অনুভূতি শিরশির করছে। রুমালটা তার হাতে ফেরত দিয়ে হাসিমুখে বলেই ফেলল, এটা বিপাক! ২৬০

রুমালটা দিয়ে বেশ চেপে চেপে নিজের মুখ মুছল সুবীরকান্ত। একটা লোভনীয় স্পর্শ যেন ওতে লেগে আছে। জবাব দিল, দুজনের দুরকমের বিপাক। তোমার বিপাক জলটা এল বলে, আর আমার বিপাক ওটা এত চট করে থেমে গেল বলে।… এবারে বোধহয় ভদ্রলোকের মতো আমার ওই পাথরটাতে উঠে যাওয়া উচিত।

হাসছে রাখিও। চোখের কোণে দুষ্টুমি। অল্প মাথা নাড়ল। অর্থাৎ তাই উচিত।

সুবীরকান্ত তক্ষুনি আবার বলল, কলেজের মাস্টার তো, উচিত কাজ করে করে ওটার ওপর একেবারে অরুচি ধরে গেছে। যেতেই পারে–তুমি কী বলে?

মুখের দিকে চেয়ে রাখি এবারে বেশিই হেসে ফেলল। জবাব দিল, আমিও স্কুলের মাস্টার।

সুবীরকান্ত মহা উৎফুল্ল। ওইটুকু পাথরের মধ্যেই মুখোমুখি ঘুরে বসার চেষ্টা।–তার মানে তোমারও অরুচি ধরেছে? ওয়ারফুল!

রাখির ভালো লাগছে বটে, আবার ভাবগতিক দেখে ভয়ও করছে। রুচি বদলাবার আশায় আরো কী করে বসে ঠিক কী! কলেজের ছেলে বা স্কুলের মেয়ে এসে হাজির হতে পারে, আর সুলতাদি রমলাদি কেউ এ অবস্থায় দেখলে ওকে আস্ত রাখবে কিনা সন্দেহ।

সুবীরকান্ত হাসতে হাসতে বলল, আজ এই বরাত আমার কল্পনাও করিনি, ভেবেছিলাম তোমাকে সেদিন বিব্রত করার জন্যে দুটো পোশাকী কথা বলেই চলে যেতে হবে। পরের মুহূর্তে কী মনে পড়তে আঁতকে উঠল যেন।–কী সর্বনাশ!

কেউ এসেই গেছে ভেবে সচকিত হয়ে রাখি এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। কাউকে না দেখে বিমূঢ় দৃষ্টি গা-ঘেঁষা-লোকটার দিকে ফেরালো।

সুবীরকান্ত বলে উঠল, এটা তো শ্রাবণ মাস এসে গেল!

দুশ্চিন্তার কারণটা সঠিক বোধগম্য হল না। রাখি চেয়েই রইল।

–ভাদ্রয় বিয়ে নেই, আশ্বিনে বিয়ে নেই, কার্তিকে বিয়ে নেই! তোমাকে কাল পরশুর মধ্যেই ছুটি নিতে হচ্ছে, তারপর চলো দুজনে জলপাইগুড়ি পালিয়ে গিয়ে কাজটা সেরে আসি আমার অত দেরি সহ্য হবে না।

তার চোখে চোখ রেখে রাখি হাসতেই লাগল।

.

বিয়ে হয়ে গেল। সেটা এত সহজে হল যে রাখির ভাবতেই অবাক লাগে। এই বিস্ময়ের সঙ্গে একটা রোমাঞ্চকর বিহ্বলতার মধ্যে দুটো মাস কেটে গেল।

তারপর শ্রীমতী রাখি চক্রবর্তী ধীরেসুস্থে তার শ্রীচক্রবর্তাটিকে নতুন করে আবিষ্কার করতে লাগল। তার প্রথম চোখ গেল লোকটার পড়ার নেশার দিকে। বই পড়ে লোক এত আনন্দ কী করে পায়, রাখি ভেবে পায় না। ফি-মাসে পার্শেলে কলকাতা থেকে বই আসে। তার বই যে কলেজের পাঠ্যবই-এর অন্তর্গত তা নয়, আবার ওই সব পড়ার ব্যাপার নিয়ে আলোচনার উৎসাহও কম নয়। ফলে রাখির ধৈর্য ফুরোতে সময় লাগে না। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শোনার ভান করেই কাছে এগোয়। লেকচার শুনতে শুনতে এক সময় চুপি চুপি বইটা সরিয়ে ফেলে। তারপর আলস্যভরে বুকের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে হাই তুলে বলে, তারপর?

ফলে তারপর যা সেটা কোনো আলোচনার বিষয় নয়।

আবার কোনো সময় বা লেকচার শুনতে শুনতে টান মেরেই হাতের বই ফেলে দিয়ে নিজের দুই ঠোঁট দিয়ে খানিকক্ষণ পর্যন্ত ওই মুখ বন্ধ করে রাখে। শেষে নিরীহ মুখে জিজ্ঞেস করে, তারপর?

রাখি লক্ষ্য করেছে, এই একটি মাত্র উপায় ভিন্ন লোকটাকে পড়াশুনার জগৎ থেকে অন্য দিকে টেনে আনা খুব সহজ নয়।

তার দ্বিতীয় আবিষ্কার, লোকটা স্নেহ আর দরদের কাঙাল। খুব অল্পবয়সে বাপ মা হারিয়েছে, আর আপনার বলতে তেমন কেউ নেই বলেই বোধহয়। ওর কাকা বা রাখির মা চিঠিতে আদর করে দুকথা লিখলেই ভারী খুশি। দুজনের সংসারে কমবাই-হ্যাণ্ড গোছের একটা লোক রাখা হয়েছে। প্রেসার-কুকারে রান্না সে-ই করে নটা না বাজতে রাখি স্কুলে ছোটে, আসতে তো বিকেল। এরই মধ্যে ছুটির দিনে ও যদি মানুষটার জন্যে বাড়তি একটু খাবার-দাবার করে, তাতেই আনন্দে আটখানা। মাঝে একদিন সর্দিজ্বর হয়েছিল। স্কুল থেকে ফিরে রাখি সেদিন আর বেরোয়নি, শিয়রের কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। সেটা যে বিশেষ কিছু করা, রাখির মনেও হয়নি। কিন্তু একটু বাদেই অবাক সে। দুচোখ যেন ছলছল করছে।

রাখি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল কষ্ট হচ্ছে খুব?

মুখের দিকে চেয়ে থেকেই আস্তে আস্তে মাথা নেড়েছে, কষ্ট হচ্ছে না। বলেছে, কত সময় অসুখে পড়ে থাকতাম, ওঠার শক্তি নেই, হামা দিয়ে গিয়ে এক গেলাস জল গড়িয়ে খেতে হয়েছে।…আর আজ?

রাখিরও বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠেছিল, মনে আছে নিজের গালটা তার কপালের ওপর ছিল।

তৃতীয় ব্যাপার লক্ষ্য করেছে, মানুষটার গোঁ-ভরা অভিমান। প্রত্যাশা বেশি বলেই অভিমান বেশি। রাখি আগে স্কুলে চলে যায়। কিন্তু একটা দিন তার জামা-কাপড় ঠিক-ঠাক করে না রেখে গেলে ময়লা জামা-কাপড় পরেই কলেজে চলে যাবে। ভুল করে নয়, ইচ্ছে করে। তারপর ফিরে এসে অভিমান–অর্থাৎ বাক্যালাপ কম, চুপ।

রাখি হয়ত বলল, তোমার কি নিজের চোখ নেই? আমার মনে ছিল না বলে এই জামা-কাপড়ে কলেজ করে এলে?

জবাব, এলাম–এরপর যাতে তোমার মনে থাকে সেই জন্যে!

আর একদিনও এই ভুল হয়েছিল। সেদিনও একই ব্যাপার। মিষ্টিকথায় দুই-এক কথায় নিজের ভুলের কথা বলার পরেও গম্ভীর দেখে রাখিরও রাগ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলেই বলেছিল, আচ্ছা আমার কী আগে আরো দুপাঁচবার বিয়ে হয়েছে যে এত অভিজ্ঞতা–কোনো কিছুর ভুল হতে পারবে না?

তখন ঠাণ্ডা।

মনঃপূত নয় এমন কিছু করলেই অভিমান। নিজের খেয়ালখুশিতেই রাখি এমন অনেক কিছুই করে বসে। বেঁকের মাথায় স্কুল থেকে হয়ত দলের সঙ্গে সিনেমায় চলে গেল, নয়ত একেবারে সন্ধ্যার পর বেরিয়ে ফিরল কোথাও থেকে। ব্যস, মুখ ভার। ফলে আগের থেকে মানুষটাকে ঠাণ্ডা রাখার কৌশলও রপ্ত করেছে রাখি।…সেদিন সুলতাদি রমলাদি ধরল–কাল রবিবার, তাদের টাইগার হিলএ নিয়ে যেতে হবে। খরচ সব রাখির। এড়ানো গেল না। ঠিক হল খুব সকালে বেরুবে, বেলা দেড়টা দুটো নাগাদ ফিরে আসবে।

কথা দিয়ে আসার পর রাখির ভাবনা। মানুষটা সঙ্গে যাবে না জানা কথাই৷ রবিবারে প্রথমে ছাত্র পড়তে আসবে গুটিকয়েক, তারপর মাস্টাররা আসবে কেউ কেউ। তাদের চা-টা একদিন অবশ্য ছোকরা চাকরটাই দিতে পারবে, কিন্তু তাহলেও ছুটির দিনে সকাল থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত বাইরে কাটানো বাবুর সহজে বরদাস্ত হবে না। তার ওপর একটু অন্যরকম রান্নাবান্না করা হবে না বলে বেলা দুটো আড়াইটে পর্যন্ত হয়ত না খেয়েই বসে থাকবে।

অতএব উল্টো প্যাঁচ কষল রাখি। বাড়ি ফিরে মুখহাত ধুয়ে বিকেলেই মুখরোচক কিছু খাবার তৈরী করল। তারপর গুনগুন করে গান করতে করতে খাবারের ডিস সামনে এনে ধরল। সুবীরকান্ত বই-মুখে চিৎপাত হয়ে বিছানায় শয়ান। রাখি তার মুখে কিছুটা খাবার গুঁজে দিতে সে হাসিমুখেই উঠে বসল।

জলযোগ শেষ হতে টুকিটাকি কিছু কাজ করার জন্য বেরিয়ে এলো। ও লোকটা আবার বই নিয়ে শুয়ে পড়বে জানা কথাই। খানিক বাদে রাখি লঘুপায়ে ঘরে ফিরল আবার। পর্দটা টেনে দিয়ে সোজা শয্যায় তার পাশে বসে পড়ে বইটা হাত থেকে টেনে ফেলে দিল। তারপর আধ-বসা হয়েই তার বুকের ওপর বুক রেখে দুহাতে মাথাটা ধরে ঝাঁকালো একবার। তারপর একেবারে মুখের ওপর ঝুঁকে বলল, মাস্টারমশায়, আমার একটা আর্জি আছে।

এই গোছের বিস্মৃতি পেলে তখনকার মতো পড়াশুনার আশায় জলাঞ্জলি দিতে সুবীরকান্তর একটুও আপত্তি নেই। দুহাতে তাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে আর্জি যেন মঞ্জুরই করে ফেলল।–এই দিনের বেলাতেই?

–ধ্যেৎ, অসভ্য কোথাকার! হাত ছাড়াবার চেষ্টা।

–আচ্ছা বলো বলো।

–না, আগে তুমি কথা দাও!

–কথা দিলে শেষে যদি তুমি ফ্যাসাদে ফেলো আমাকে?

–ও, এই টান আর এই বিশ্বাস তোমার আমার ওপর?

–ছাড়ো

ছদ্ম রাগে আবারও হাত ছাড়ানোর চেষ্টা।

–আচ্ছা, কথাই দিলাম। বলো।

কাল সকালে তুমি ছেলে পড়াবে না, আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবে?

–কোথায়? আঁতকে উঠল যেন।

টাইগার হিলএ। খুব সক্কালে উঠে যাব, বেলা একটা দুটোর মধ্যে ফিরে আসব। সুলতাদি রমলাদি এমন ধরেছে, আমি কিছুতে এড়াতে পারলুম না। ওরা ঠাট্টা করে, মুখে মুখ লাগিয়ে আর কতকাল কাটাবি, চার সাল তো হয়ে গেল!

এর পর রমলাদি-সুলতাদির সঙ্গে ওকে ছাড়াই টাইগার হিল ঘুরে আসার জন্যে পাল্টা অনুরোধ শোনার পালা। ছেলেগুলো সমস্ত সপ্তাহ এই একটা দিনের আশায়। বসে থাকে, কী করে যায় সুবীরকান্ত-আগে জানলেও না হয় কথা ছিল!

বেগতিক দেখলে রাখি এই গোছের কৌশলে ঘরের লোকের অভিমান ঠেকিয়ে রাখে।

কিন্তু ও যেমন স্বামীর মান-অভিমান সবলতা-দুর্বলতার সন্ধান পেয়েছে, স্বামীটিও যে ঠিক তেমনি করেই তার স্ত্রীর চরিত্রটি নানা খুঁটিনাটির ভিতর দিয়ে সকৌতুকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে–সে খবর রাখির জানা নেই।

না, এযাবৎ নিজের স্ত্রীর প্রতি সুবীরকান্ত বিরূপ কখনো হয়নি। বরং অনেক ব্যাপারে তার ছেলেমানুষি দুর্বলতা দেখে বেশ মজাই লেগেছে।…ব্যাপারে আধুনিক চটকের ওপর স্ত্রীটির অনুরাগ। প্রথমেই তার নাক ধরে টান দিয়েছিল, বলেছিল, আচ্ছা নামের সঙ্গে তুমি আবার একটা কান্ত জুড়েছ কেন? সুবীর চক্রবর্তী তো বেশ নাম।

ও হেসে জবাব দিয়েছে, কান্ত নাই বলে বোধহয় বাপ-মা নামের ওপর দিয়ে অভাবটুকু উশুল করতে চেয়েছে।

–এখন ছেটে দাও।

–ছাঁটতে রাজি নই, বরং নাম বদলে রাখিকান্ত হতে পারি।

বিয়ের পরেই বাপেরবাড়িতে দিনকয়েক রাখি ওকে সুবীর বলেই ডেকেছে। কিন্তু একদিন ওর মায়ের কানে যেতে সুবীরের সামনেই কষে ধমক।-ও কী বিচ্ছিরি! খবরদার নাম নিয়ে ডাকবি না!

-বা-রে! ও যে নাম ধরে ডাকে?

–ও ডাকুক, তুই ডাকবি না।

আপত্তি সত্ত্বেও মায়ের কথা ফেলতে পারেনি। এখন আর ডাকে না।

দার্জিলিংয়ে আসার দিনকয়েক বাদে হঠাৎ একদিন বলেছিল, আচ্ছা এত বড় স্কলার হয়েও তুমি আই, এ. এস. পরীক্ষা দিলে না কেন?

–দিলে কী হত?

–দিলে আই. এ. এস, হতে পারতে না? আমার বন্ধু সোমার আই. এ. এস. বর, কী বিরাট চাকরি করে এখন জানো?

ঠিক এই গোছের ছেলেমানুষি ধরনের কথা না হলে সুবীরকান্তর হয়ত খারাপই লাগত। হেসেই ফিরে জিজ্ঞাসা করেছে, কেন, কলেজের মাস্টার পছন্দ নয়?

-মাস্টার পছন্দ নয়, তোমাকে পছন্দ।…চেষ্টা করলে তুমি আই. এ. এস. হতে পারতে।

-তা হয়ত হতে পারতুম, কিন্তু এই রাখিকে পেতাম না।

-কেন?

–তখন আর দার্জিলিংয়ে আসতুম না, তোমার সঙ্গে দেখাও হত না। তাছাড়া আই. এ. এস. হলে হয়ত লোভ আরো বেড় যেত, রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব খুঁজতাম।

যুক্তিটা অস্বীকার করেনি রাখি, মাথা নেড়ে বলেছে, তা সত্যি, কী খরচটাই করেছিল তোমার কাকা, আমাদের ঘর-বাড়ি বেচলেও অত হত না।

স্ত্রীর উঁচু দৃষ্টির আঘাত পরের এই ছেলেমানুষি উক্তির দরুণই একটুও লেগে থাকে না। রং মজাই লাগে শুনতে। গম্ভীর মুখে ও-কথার পর বলেছিল, ধরো। আই. এ. এস, অফিসার হয়ে, আর তোমার বদলে তোমার বন্ধু সোমার বরটি হয়ে, আমি দার্জিলিংয়ে বেড়াচ্ছি-তোমার দেখতে কেমন লাগত?

ভালো যে একটুও লাগত না সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গেছে। আর জবাবটা আরও ভালো লেগেছে।-ইস! এখানেই যখন বিয়ে লেখা, যেভাবে হোক ঠিক তোমার সঙ্গেই জুটে যেতাম আমি।

স্ত্রীর আর একটা স্বভাব লক্ষ্য করে মুখ ফুটে কিছু না বললেও মনে মনে এক-আধ সময় উতলা হয়েছে সুবীরকান্ত। সর্বদাই রাখির দৃষ্টি যেমন উঁচু দিকে, খরচের হাতও সেই রকমই খোলা। বিলেতি ধাঁচের নামী স্কুল, মাইনে ভালই। দ্বীরকান্ত সে টাকা হাতেও নেয়নি কখনো, বলেছে তোমার কাছেই থাক। কিন্তু থাকছে যা এই কমাস সে ভালো করেই দেখছে। সব মাসের শেষেই তার চিন্তা দেখেছে-হাতের টাকা-টুকি ফুরিয়ে গেল, কী-যে করি!

জিনিস দেখলেই তার কিনতে ইচ্ছে করে। মনের মত ঘর সাজায়, সুবীরকান্তর জন্যেও এটা-সেটা কেনে। আর নিজের জামা-কাপড় কেনা তো সব মাসেই লেগে আছে। মাইনের অর্ধেক টাকা দিয়ে হয়ত একখানা শাড়ি কিনে বসল। পরে-পরে তক্ষুনি আবার তাকে দেখানো চাই।-কেমন হয়েছে?

চোখ তুষ্ট হলেও টাকার অংকটা ভিতরে ভিতরে খচখচ করতেই থাকে সুবীরকার। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না। ফলে রসিকতা করতে হয়, গরিব মাস্টার–এই রাখিকে আমি রাখি কোথায়?

রাখি তাইতেই খুশি, কোনো প্যাঁচ-পোঁচের ধার ধারে না সে।

যাই হোক, আনন্দের মধ্যেই দিন কাটছিল সুবীরকান্তরও। মাসপাঁচেক বাদে তার মনের দরজায় আর এক বৈচিত্র্য এসে হানা দিল। শুকনো-মুখ-রাখি সেদিন ঘরে ঢুকেই বলল, হয়েছে কাজ, এবারে ঠিক গণ্ডগোল বেঁধেছে!

মুখ থেকে বই সরিয়ে সুবীরকান্ত জিজ্ঞাস করল, কিসের গণ্ডগোল?

-আবার কিসের, যা হয় তাই, আরো খুব আনন্দ করো–কতদিন বলেছি একটু সামলে-সুমলে চলো!

তবু বুঝতে সময় লেগেছে একটু। তারপর বোঝা গেছে যখন বই ফেলে আনন্দে একেবারে উঠে বসেছে।-সত্যি? তারপর মুখের দিকে চেয়ে হাসতে সুরু করেছে।

রাখি রাগ দেখাতে গিয়েও হেসে ফেলল।-তুমি তো মজা দেখবেই এখন, আমি ওদিকে চিন্তায় মরি!

-কিসের চিন্তা?

স্কুলে তো আর একবছর ধরে ছুটি দেবে না, কিছুদিন গেলেই মেয়েরা ঠিক টের পাবে। কী লজ্জার কথা হল বলো তো?

ছদ্ম গাম্ভীর্যে মাথা নেড়ে সায় দিল।–তহালে এক কাজ করো, স্কুলের চাকরি। ছেড়ে দাও।

-বলো কী, চাকরি ছেড়ে এখন থেকে আমি ঘরে বসে থাকব?

–তাহালে চোখ-কান বুজে স্কুল করতে থাকো।…তোমাদের স্কুলের টিচারদের বুঝি কারো ছেলেপুলে নেই!

-থাকবে না কেন, মেম-টিচারগুলোর তো এক-একজনের তিনটে-চারটে করে ছেলেপুলে, ওদের অত লজ্জাসরমের বালাই নেই!

সুবীরকান্ত আরো গম্ভার।–প্রথমবার বলেই তোমার লজ্জা, পরের বার থেকে আর তোমারও থাকবে না।

এবারে গাম্ভীর্যের আড়ালে কৌতুক লক্ষ্য করল রাখি। রাগতে গিয়ে আবার ও হেসে ফেলল।–ভালো হবে না বলছি, সখ দেখে আর বাঁচি না!

এই সমাচারের দিন-কয়েকের মধ্যে সুধারকান্তর এই বহু প্রত্যাশিত পদোন্নতির সংবাদ এলো। এই কলেজেই লেকচারার থেকে প্রফেসার হয়ে গেল সে। সেদিন। কলেজ থেকে ফিরেই আনন্দে আটখানা হয়ে রাখিকে খবরটা দিল সে। আর রাতে চুপি চুপি বলল, যে আসছে সে বিশেষ ভাগ্য নিয়েই আসছে, বুঝলে…নইলে উন্নতির আশা তো কবে থেকেই করছিলাম, এতদিনেই বা হল কেন?

শুনে রাখিও খুশি বটে, কিন্তু তার মনে তখন নানা চিন্তা।

এর পরের কতগুলো মাসে যথার্থই আনন্দের মধ্য কাটল সুবীরকান্তর। নিজের মনেই জীবনের একটা নতুন স্বাদ অনুভব করে সে। আলো-বাতাসও অন্যরকম মনে হয়। রাখিকেও কেমন নতুন মনে হয় তার। ওর সর্বশরীরে যেন নতুন ছদ, নতুন সুষমার ছোঁয়া লেগেছে। চেয়ে থাকে, চুরি করে দেখে। আবার ধরাও পড়ে। রাখি লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলে।–কী দেখছ?

সুবীরকান্ত হাসে শুধু।

সময় এগিয়ে আসতে স্কুল থেকে রাখি. তিন মাসের ছুটি পেল। ভিতরে ভিতরে তার নানারকম ভয়-ভাবনা। তাই ও প্রস্তাব করল, এ সময়টা মায়ের কাছে গিয়ে থাকলে কেমন হয়! আপত্তি করা উচিত নয়। কিন্তু এবারে সুবীরকান্তই দুর্ভাবনার মধ্যে পড়ে গেল।–তিন মাসের জন্য? ও বাবা, আমি থাকব কী করে?

অসহায় মুখখানা দেখে তার হাসিই পেল।…মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। বটে, কিন্তু সেই সময় এই লোক কাছে থাকবে না ভেবে আবার ভয়-ভয়ও করছিল। অতএব এখানেই থাকা মনস্থ করল সে। তাছাড়া এখানে ভালো ডাক্তার আর সুব্যবস্থার আশ্বাসও বেশি। তার ওপর সুবীরকান্ত যখন বলল, মাকেই বরং মাসখানেকের জন্য এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবে–তখন অনেকখানি নিশ্চিন্ত।

.

মেয়ে হল।

আর তাতেই যেন সুবীরকান্ত বেশি খুশি। মাস-দেড়েক না যেতে কঁপা হাতে শাশুড়ীর হাত থেকে মেয়ে কোলে নিয়ে বসতে চেষ্টা করেছে। নড়তে-চড়তে ভয়, পাছে মেয়ের লাগে। বাপকে রাগাবার জন্যেই মেয়েটাকে কুচ্ছিত বলে রাখি। তার কারণ মেয়ের রং একটু চাপা হবে বলেই মনে হয়, কিন্তু মুখশ্রী সুন্দর। শাশুড়ীর সামনেই এই নিয়ে ঝগড়া। মেয়ের নাম নিয়েও। সুবীর প্রস্তাব করে রাখির মেয়ের নাম পাখি হোক। রাখি তক্ষুনি স-ঝঙ্কারে আপত্তি করে, হ্যাঁ বয়েসকালে শেষে উড়ে পালাক আর কী! এ সুবীর হাসে।–বয়েসকালে তো উড়ে পালাবেই। শাশুড়ীর অনুপস্থিতিতে সেদিন বলেছিল, উড়ে পালাবার সময় হলে ওকে পরামর্শ দেব দার্জিলিংয়ে জলাপাহাড়ে উঠে বসে থাকতে।

কিন্তু আরো মাসখানেক না যেতেই রাখি সত্যিকারের দুর্ভাবনার মধ্যে পড়ল। মা তখন জলপাইগুড়ি ফিরে গেছে। রাখি আবার স্কুলে যেতে শুরু করবে। ভাবছে। তিন মাসের পরে আরো দেড় মাসের আধা-মাইনের ছুটিও ফুরিয়ে এসেছে। মেয়ের জন্য সবে ভালো একটা আয়া রাখা হয়েছে। সব সুব্যবস্থার মধ্যে আচমকা। এই খবর।

সুবীরকান্ত কলকাতায় বদলির হুকুম-পত্র পেয়েছে। শুনে রাখি বিমূঢ় একেবারে।

–কি হবে তাহলে?

–কি আবার হবে, যাব!

–আর আমি?

–তুমিও যাবে!

এই নির্লিপ্ততা দেখে রাখি আরো অবাক যেন।–চাকরি ছেড়ে দেব?

সুবীরকান্ত হাসতে লাগল, তুমি কী ভেবেছ চিরকাল আমি এই দার্জিলিংয়েই থেকে যাব?

না, রাখি কিছুই ভাবেনি। সমূহ সমস্যাটাই তার কাছে বড়। সে জোর দিয়ে। বলল, এখন চাকরি ছাড়া কোনো কাজের কথা নয়, তুমি বদলি ক্যানসেল করার ব্যবস্থা করো।

-পাগল নাকি!

এই এক কথাতেই রাখি বুঝে নিয়েছে সেটা সম্ভব নয়, অথবা সম্ভব হলেও এই লোক সে-রকম তদবিরের ধার-কাছ দিয়েও যাবে না। গোড়াতে রাগই হয়ে গেছে। তার। আসলে সে চাকরি করে এটাই বোধহয় তার পছন্দ নয়–ঘরের মধ্যে মেয়ে। আগলে বসে থাকুক তাই চায়। এই অনুযোগের পরেও মানুষটার তাপ-উত্তাপ নেই, কেবল হাসে।

রাখি বলতে ছাড়ে না, এই তো মাইনে, চলবে কী করে?

সুবীরকান্ত যেন আরো মজা পায়।-এক-বেলা খাব, কী আর করা যাবে…এত বড় চাকরিটা তোমার! শেষে হেসেই বলে, তোমার এত ভাবনা কেন, কত লোকে বুড়ো বয়েসে প্রফেসার হয়েও চার-পাঁচটা ছেলেপুলে নিয়ে চালায়, আর একটা মেয়ে। নিয়ে আমাদের চলবে না? তাছাড়া কলকাতায় মেয়ে-স্কুল নেই? চাকরি করতে চাইলে তোমার এত বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা চাকরি পাবে না সেখানে?

এই প্রথম একটু আশার কথা শুনল যেন। আর তারপর সুবীরকান্ত যে প্রস্তাব দিল, ভাবতে গেলে সেটা রোমাঞ্চকরই বটে। সুবীরকান্ত পরামর্শ দিল, একটা কাজ যদি করো তো দেখবে এই বদলিটা আমাদের কাছে আশীর্বাদই হয়েছে। কলকাতায় গিয়ে ঘরে বসে দুটো বছর পড়াশুনা করে এম. এ.-টা পাশ করে নাও। স্কুল ছেড়ে তখন কোন কলেজেই চাকরি পেয়ে যাবে…আর মেয়েটাও ততদিনে একটু বড় হবে।

বরাবর উঁচু দিকে দৃষ্টি রাখির, তাই শোনামাত্র উৎফুল্ল। কিন্তু পরক্ষণে নিজের ওপর অনাস্থা।-হ্যাঁ, এতকাল বাদে আবার আমি করব এম. এ. পাশ, তাহলেই হয়েছে!

মুখে বললেও এ সম্ভাবনাটা একটা বড়গোছের আশার মতই মনের কোণে লেগে থাকল। তবু যাবার আগে তার মন-খারাপ। খুঁতখুঁত করে বলল, এই মেয়েটাই অপয়া, আসতে না আসতে আমার চাকরিটা গেল!

.

কলকাতায় এসে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু। আড়াইখানা ছোট ঘরের ফ্ল্যাট নিয়েছে একটা। তারই ভাড়া এককাড়ি। গোড়ায় গোড়ায় রাখি আবার চিন্তা করেছে –চলবে কী করে?

–ঠিক চলবে, কিছু ভেবো না। সুবীরকান্তর সেই এক কথা।

চলে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু রাখির মনে মনে বাসনা, আর একটু ভালো চললে ভালো হত। ভিতরে ভিতরে সেই ভালো দিনে পদার্পণের সঙ্কল্প নিয়েই এম, এ, পড়ার জন্য প্রস্তুত হল সে।

আলাপ-আলোচনা করে ইকনমিক্স-এ এম. এ. পড়া সাব্যস্ত হল। বি. এ.-তে এই বিষয়টা ভালই লাগত তার। এ ব্যাপারে সুবীরকান্তরও উৎসাহ কম নয়। বই-পত্র সংগ্রহ করে দিল। তার কলেজের ইকনমিক্স-এর এক তরুণ লেকচারারকে বাড়িতে এনে হাজির করল। সুদর্শনা ছাত্রী-বউদিকে সে যথাসাধ্য সাহায্য করবে সানন্দে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেল।

সুবীরকান্ত বলল, খুব বিদ্বান ছেলে, যতখানি পারো আদায় করে নাও।

রাখি ধরেই নিয়েছে তার এম. এ. পাশের রাস্তা সুগম। মনের আনন্দে তাই ঠাট্টা করেছে, বেশি আদায় করতে গেলে সেও যাদি কিছু আদায় করতে চায়?

অরসিক স্ত্রীর কাছে সুবীরকান্তও নয়। পাল্টা ঠাট্টা করেছে, গুরু যখন, চাইলে কী আর করা যাবে…কিন্তু খুব গোপনে, আমি যেন জানতে না পারি।

রাখির ভালো পাশ করার ইচ্ছে, যত, ধৈর্য তত নয়! বেশি পড়াশুনার নামে তার হাঁপ ধরে যায়। বিশাল সমুদ্র সে পার হবে কী করে, বই-পত্র খুলে এক-একসময় গালে হাত দিয়ে তাই ভাবে। ভাবতে ভাবতে অসময়ে ঘুম পেয়ে যায়। তারই ঘরের লোক বিনা উদ্দেশ্যেও অত পড়ে কী করে সেটা তার কাছে এখন এক বিস্ময়। বইগুলো বোঝার মত ঠেকে। মন হালকা করার জন্যে বিকেলের শোযে দুজনের সিনেমার। টিকিট কেটে বসে। সুবীরকান্ত কখনো বিরক্ত হয়, কখনো হাসে।এভাবে চললেই পাশ করা হয়েছে আর কী!

রাখি রেগে যায়, না হয় না হবে, আর পারিনে বাপু, কেবল মাস্টারি! কখনো বলে, আমার দ্বারা কিছু হবে-টবে না, আমার জন্যে তুমি একটা স্কুল-মাস্টারিই দেখো।

সুবীরকান্ত সে-কথা কানে তোলে না। পড়ার তাগিদ দেয়। ফাঁক পেলেই রাখি মেয়ের ঘাড়ে দোষ চাপায়, ওর জন্যে পড়াশুনা হচ্ছে না। মেয়ের জন্যে ওদিকে সর্বক্ষণের ঝি আছে একটা। আর বাপের আদুরে মেয়ে, বাপকে দেখলেই তার কোলে চেপে বসে থাকে। তাই ওর জন্যে পড়া কেন হয় না সুবীরকান্ত ভেবে পায় না। তা ছাড়া ঠিকে-চাকর আছে একটা, দুবেলার রান্না আর বাড়ির কাজ সে-ই করে দিয়ে যায়। এসব ব্যবস্থার ফলে প্রতি মাসেই খরচের টানাটানি। কিন্তু পারতপক্ষে সুবীরকান্ত তা জানতে দেয় না।

দ্বিতীয় বছরের কয়েকটা মাস কেটে যেতে রাখি একদিন হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসল। পড়া কিছুই এগোয়নি, কী করে পরীক্ষা দেবে!

আর তখুনি ঘরের লোকের আরেক রূপ দেখল সে। প্রথমে বিরক্ত হয়ে হুকুম করল, সব কটা পেপারে শূন্য পেলেও গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসতে হবে। তারপর বলল, আচ্ছা তোমার পাশ-ফেলের দায় আমার। যা বলি তুমি শুধু তাই করে যাও, আর কিছু ভাবতে হবে না।

এরপর থেকে দেখা গেল, ইতিহাস বই ছেড়ে তার ইকনমিক্স বই নিয়ে পড়াশুনায় মগ্ন হয়েছে লোকটা। আর দুবেলা নিজেই তাকে পড়াতে বসে যায়। প্রথমে বাংলায় জলের মত করে বোঝায়, তারপর ইংরেজিতে। এক-একটা দুরূহ পরিচ্ছেদ যে এত সহজে শেষ হতে পারে তার যেন বিশ্বাস হয় না। পড়ানো হলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, ঠিক হলে উত্তর লিখে রাখতে বলে। আগের কয়েক বছরের প্রশ্নপত্র এনে সেগুলির খুঁটিনাটি জবাব শেখায়–লেখায়। খবরের কাগজ থেকে অর্থনৈতিক প্রসঙ্গের কাটিং রেখে তাকে পাঁচবার করে পড়তে বলে, লিখতে বলে। সব লেখাই আবার ধৈর্য ধরে সংশোধন করে দেয়। এই তন্ময় গম্ভীর মানুষটাকে তখন যেন খুব কাছের কেউ বলে মনে হয় না তার।

নিজের অগোচরেই একটু একটু করে আস্থা ফিরছে রাখির। তাই শঙ্কার ভাবটা কমছে। সব থেকে বড় কথা, একটু দুশ্চিন্তা দেখলেই মানুষটা ধমকায় তাকে।–তোমাকে তো বলেছি, শূন্য পেলেও তোমার কোন দোষ হবে না–সব দায় আমার।

এ-কথা শুনলে মনের জোর কার না বাড়ে! তাই রাত্রে দুজনে মুখোমুখি আধশোয়া হয়ে পড়াশুনা চলে যখন, রাখির মাথায় এক-এক সময় দুষ্টুমি চেপে বসে। একেবারে বুকের কাছে এগিয়ে গেলেও এত তন্ময় যে খেয়াল করে না। রাখি তখন আচমকা দুহাতে জাপটে ধরে তাকে, গালে গাল চেপে বলে, তারপর?

ধ্যানভঙ্গ হয় তখন। সেদিন এমনি ব্যাপারের পর সুবীরকান্ত তাকে টেনে ধরে রেখে জবাব দিল, তারপর পরীক্ষা হয়ে গেলেই আর একবার নির্ঘাত তোমার নার্সিং। হোমে যাবার ব্যবস্থা!

ছিটকে সরে আসতে চেষ্টা করেছে রাখি।-খবরদার, কখখনো না।

আর ছেলেপুলে হবার ব্যাপারে রাখির বেজায় আপত্তি। বলে, একটাই বেঁচে থাক, পাখিকে ভালো করে মানুষ করো, আর বেশিতে কাজ নেই।

মেয়ের ডাক-নাম পাখিই আছে। সুবীরকান্ত হাসে। বলে দেখা যাবে।

পরদিন সকালেই আবার সেই পঠন আর পাঠনের তন্ময়তা।

বেশ নির্বিঘ্নে এম. এ পাশ করার পরেও রাখি ভোলেনি আসল কৃতিত্বটা কার। ভালই পাশ করেছে। মাঝামাঝির থেকেও একটু উঁচুর দিকের সেকেণ্ড ক্লাস। সেটুকুও আশার অতিরিক্ত। ফল যেদিন বেরুল রাখি সেদিন গম্ভীর মুখে সুবীরকান্তকে জিজ্ঞেস করেছিল, জীবনে বোধহয় এই পরীক্ষাটাই সব থেকে খারাপ হল, কেমন?

যেন সুবীরকান্তই পরীক্ষা দিয়েছে এবং পাশ করেছে। সে হেসে জবাব দিয়েছে, হ্যাঁ।

জীবনযাত্রার পট পরিবর্তন আসন্ন বলেই বোধহয় এমন দিনে একজনের সঙ্গে দেখা রাখির। সেদিন কী একটা ইংরেজী সিনেমা দেখতে গেছল তারা, তাদের সামনেই ঝকঝকে গাড়ি থেকে নামল একজোড়া মেয়ে-পুরুষ। মেয়েটি গোলগাল মোটাসোটা, পরনে দামী শাড়ি, গলায় আর হাতে দামী গয়না। পুরুষটি ফিটফাট বাঙালী সাহেব। গাড়ি থেকে দম্পতিটিকে নামতে দেখেই সিনেমা দেখার আকর্ষণ ভুলে রাখি হাঁ করে তাদের দিকে চেয়ে রইল। পাশ কাটিয়ে যাবার মুখে মহিলাটিও তাকে দেখে থমকে দাঁড়াল।

অস্ফুট বিস্ময়ে রাখি বলে উঠল, সোমা না?

–রাখি, তুই!

হলের সামনে দুটি রমণীর পুলকিত জড়াজড়ির দৃশ্য দেখল অনেকে। তাদের স্বামী দুটি পরস্পরকে দেখে নিল একবার।

রাখির সহপাঠিনী সেই সোমা আর তার আই. এ. এস. স্বামী রমেন্দ্র সরকার। বান্ধবীর হাত ঝাঁকিয়ে রাখি বলে উঠল, কী গোল হয়ে গেছিস রে তুই, আমি তো প্রথমে হকচকিয়ে গেছি! পরক্ষণে আই. এ. এস-এর দিকে তাকিয়ে দুহাত জুড়ে নমস্কার জানালো, চিনতে পারেন?

বিব্রত জিজ্ঞাসু নেত্রে স্ত্রীর দিকে তাকালো ভদ্রলোক।–সোমা সরকার বলল, চিনবে কী করে, বিয়ের সময় সেই তো একবার দেখেছে! পরিচয় করিয়ে দিল, আমার বন্ধু রাখি গাঙ্গুলি–ওমা, গাঙ্গুলি বলছি কেন! সুবীরান্তর দিকে চোখ আটকালো তার, পরক্ষণে রাখির দিকে ফিরল।–বল না, ইনি নিশ্চয়?

হাসিমুখেই মাথা নাড়ল রাখি।–প্রফেসর সুবীর চক্রবর্তী।

আর এক-দফা সৌজন্য বিনিময়। ওদিকে সিনেমায় দ্বিতীয় বেল বেজে গেছে। খুশির ব্যস্ততায় সোমা জিজ্ঞাসা করল, সিনেমা দেখবি তো? কোথায় সীট তোদের?

কোথায় সীট রাখি জানে না, তবু বিব্রত অভিব্যক্তি একটু। সুবীরকান্ত জবাব দিল, নীচে।

সোমাদের ওপরের সব থেকে সেরা সীট সন্দেহ নেই রাখির। কিন্তু সোমা কিছু খেয়াল না করেই বলল, শো শেষ হলে পালাবি না বলছি, এইখানে দাঁড়াবি–কতকাল বাদে দেখা!

এত দিন বাদে দেখা হওয়ার ফলে রাখিও খুশি কম নয়। কিন্তু সোমার সঙ্গে তার অবস্থার তারতম্যটা এভাবে স্পষ্ট না হয়ে উঠলে যেন আরো খুশি হত। এতদিন বাদে আজ আবার মনে হল, তার ভদ্রলোকও যদি আই এ. এস-টাই হতে পারত–ইতিহাসের মাস্টার হয়েও যে আনায়াসে এম. এ. ক্লাসের ইকনমিকস পড়াতে পারে–ইচ্ছে করলে সে অনেক কিছু হতে পারত!

সীটে বসে বিস্ময় প্রকাশ করল, সোমাটা কী বিষম মোটা হয়েছে, দিব্বি ছিপছিপে চেহারা ছিল!

একটা কথা ভেবে সুবীরকান্ত মনে মনে কৌতুক বোধ করছিল, পরিচয় দেবার সময় রাখি সুবীরকান্ত বলেনি, শুধু সুবীর চক্রবর্তী বলেছে। ওর কথা শুনে মৃদু জবাব দিল, তোমার মত তো আর মাস্টারের বউ নয়, আই. এ. এস-এর বউ-সুখে আছেন। …কিন্তু শো ভাঙলে মহিলা আবার তো চড়াও করবেন মনে হচ্ছে!

চাপা হেসে রাখি জবাব দিল, তোমার তাতে ভয়টা কী, সঙ্গে আমি আছি, ওর। বরও আছে।

শো ভাঙতে শুধু চড়াও করা নয়, কোনো ওজর-আপত্তিতে কান না দিয়ে সোমা সরকার একেবারে গাড়িতে টেনে তুলল তাদের। আই. এ. এস. সামনে ড্রাইভারের পাশে বসল, তারা তিনজন পিছনে।

হাসিমুখে সোমা সরকার সুবীরকান্তর উদ্দেশে বলল, আপনার স্ত্রী-টি মশাই কি যে দুষ্টু ছিল আপনার কোনো ধারণা নেই, আমাদের একেবারে নাজেহাল করে ছাড়ত!

সুবীরকান্ত মন্তব্য করল, স্বভাব এখনো খুব বদলায়নি।

সোমা সরকার হালকা সুরে চ্যালেঞ্জ করল, আপনাকে তো বেশ ভালো মানুষ মনে হচ্ছে, না বদলালে সামলান কী করে?

সামলাবার চেষ্টাও করি না, হাল ছেড়ে দিয়েছি।

সকলেই হেসে উঠল। এমন কী সামনে থেকে রমেন্দ্র সরকারও হাসিমুখে এদিকে তাকালো।

সোমা সরকার বলল, না সামলালেও আপনার স্ত্রী আগের থেকে ঢের বেশি সুন্দর হয়েছে এখন, বুঝলেন?

সুবীরকান্ত জবাব দিল, আমি সামান্য মাস্টার, এতেও আমার কিছুমাত্র হাতযশ নেই।

আবার একপ্রস্থ হাসি। রাখির কানের কাছে মুখ এনে সোমা সোচ্ছ্বাসে বলল, বেশ লোকটি তো রে তোর! তারপর তেমনি চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, চেহারাখানা। তো দিব্বি কচি রেখেছিস–ছেলেপুলে কী?

-একটা মেয়ে।

সোমা জোরেই বলে উঠল, মাত্র!

রাখি তার হাঁটুতে একটা চিমটি কেটে মুখ বন্ধ করতে চাইল। তারপর গলা। আরো খাটো করে জিজ্ঞাসা করল, তোর?

সোমা সরকার ছদ্ম-কোপে তার আই. এ. এস, স্বামীর দিকে তাকালো একবার। তারপর জবাব দিল, আমার এক গণ্ডা।

বলা বাহুল্য, যত নীচু স্বরেই তারা বাক্যালাপ করুক, সুবীরকান্তর কানে এসেছে সবই।

সোমার বাড়ি-ঘর দেখে দুচোখ জুড়িয়ে গেল রাখির। ছবির মত বাড়ি, চমৎকার আসবাব-পত্র, আর তেমনি পরিপাটি ব্যবস্থা সব-কিছুর। ওর ছেলেমেয়েগুলোও তেমনি ফুটফুটে সুন্দর। সুখের ঘরে রূপের বাসা। রাখির যেমন স্বভাব, নিজের অবস্থার তুলনামূলক চিত্রটা মনে আসছেই।

বাড়ি ফিরে রাত্রিতে বিছানায় গা এলিয়েও ওদের কথাই ভাবছিল। বলল, কী চমৎকার আছে সোমারা, তাই না?

কাছে এগিয়ে এসে সুবীরকান্ত সায় দিয়ে বলল, চমৎকার, কিন্তু ওদের তুলনায় আমি আর এত পিছিয়ে থাকতে রাজি নই!

রাখি উৎসুক নেত্রে তাকালো তার দিকে। ভাবল অবস্থা ফেরানোর কোনো মতলবের কথাই শুনবে।

–ওদের চারটে ছেলেপুলে, আমার মাত্র একটা থাকবে কেন?

–যাও! রাখি ঠেলে সরাতে চেষ্টা করেছে তাকে।–তোমার কেবল ওই চোখে পড়েছে! কার সঙ্গে কার তুলনা!

সত্যি কথাই বলেছে। কিন্তু সব সত্যি কথা সর্বদা ভালো লাগে না। শেষের। এই তুলনার উক্তিটুকু সুবীরকান্তর কানে খুব মিষ্টি লাগল না।

এরপর সোমা সরকার একদিন তাদের ফ্ল্যাটে এলো। রাখি তাকে কোথায় বসাবে, কতভাবে আপ্যায়ন করবে ভেবে পায় না। তার গাড়ি পাঠিয়ে ওকেও দুতিনদিন তার। বাড়িতে নিয়ে গেল।

সেদিন তাদের বাড়ি থেকে রাখি রীতিমত একটা উত্তেজনা নিয়ে ফিরল। একটা অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্য যেন সেধে তার দোরগোড়ায় এসে হাজির হবার উপক্রম করেছে। এখন শেষ পর্যন্ত এলে হয়।

সুবীরকান্ত ব্যাপারটা শুনল। আই. এ. এস. রমেন্দ্র সরকার এখন ডিরেক্টর অফ সোস্যাল ওয়েলফেয়ার, অর্থাৎ এই বিভাগটির সর্বময়কর্তা। এম. এ. পাশ করে রাখি কলেজে চাকরির চেষ্টা করছে শুনে সে একটা আশাতীত প্রস্তাব দিয়েছে। তার বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট ওয়েলফেয়ার অফিসার নেওয়া হবে একজন–স্যোসিওলজির এম. এ. চাই, ইকনমিক্সও চলতে পারে, কারণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ.-তে এই সাবজেক্ট নেই। অবশ্য এ চাকরি হওয়া খুব সহজ নয়, পরীক্ষা হবে, ইন্টারভিউ হবে, তারপর চাকরির প্রশ্ন। তবে রমেন্দ্র সরকার সহায় বলেই আশা। সে নিজেই বলেছে, যতটা সম্ভব চেষ্টা করবে। আর সোমা তাকে বলেছে, ওরা ওরকম হাতে রেখে বলে, শেষ পর্যন্ত চাকরি তোরই হবে জেনে রাখ।

আশ্চর্য, এমন একটা খবর শোনার পরেও লোকটা প্রায় নির্বিকার! খানিক চুপ করে থেকে মন্তব্য যা করল শুনে রাখির রাগ হবারই কথা। বলল, মেয়েদের পক্ষে এ বড় ঝামেলার চাকরি, তার থেকে কলেজই ভালো।

-বলো কী? গোড়াতেই গেজেটেড র‍্যাঙ্ক, কলেজে যেখানে শেষ এখানে প্রায় সেই মাইনের শুরু। এর ওপর কত প্রমোশন আছে–ওয়েলফেয়ার অফিসার তো হওয়া যাবেই, অ্যাসিস্টান্ট ডাইরেক্টার, ডেপুটি ডাইরেক্টার পর্যন্ত হওয়ার আশা আছে। তাছাড়া কলেজের চাকরি যে পাবই তারই বা ঠিক কী?

না পেলে স্কুলে তো পাবেই।

ঠাট্টা করছে কিনা রাখির প্রথমে সেই সন্দেহ হল। পরে রেগেই গেল।–তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে?

সুবীরকান্ত জবাব দিল না, চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে রইল শুধু।

এরপর দিনকতকের জন্যে আহার-নিদ্রা ঘুচে গেল রাখির।

দরখাস্ত করা হল। রোজই একবার করে সোমার ওখানে ছুটতে লাগল। লিখিত পরীক্ষার জন্য কীভাবে তৈরি হবে, ইন্টারভিউতেই বা কী ধরনের প্রশ্ন করা হয়ে থাকে, এ-সব ব্যাপারে তার কিছুই ধারণা নেই। সোমাকে বলে, পরীক্ষায় চিত্তির করে এলে আর এ বাড়িতে মুখ দেখাতে আসতে পারব না বলে দিলাম।

আর ওখানে যজ্ঞেশ্বর কাপুর নামে একজনের সঙ্গে সরকার আলাপ করিয়ে দিল। জয়েন্ট ডাইরেক্টার, রমেন্দ্র সরকারের ঠিক নীচের লোক। সোমা বলেছে, আপিসের সর্বকর্মে সেই নাকি বৃহস্পতি। বয়েস রমেন্দ্র সরকারের থেকে কিছু বেশি হবে। হাসি-খুশি দিলদরিয়া মানুষ। এখানে অনেককাল আছে, মোটামুটি ভালই বাংলা বলতে পারে। তুমি বলে। তুমিটা অন্তরঙ্গসূচক জানার পর থেকে একটু খাতির হলেই সে আর কাউকে আপনি করে বলে না।

রমেন্দ্র সরকারের সামনেই সোমার আব্দার, মিস্টার কাপুর, আমার বন্ধুকে কিন্তু নিতে হবে, নইলে আপনার সঙ্গে কথা বন্ধ।

কাপুর হেসেই ভয়ের কারুকার্য ফুটিয়েছে মুখে।–কী সর্বনাশ, তাহলে তো নিতেই হবে।

পরীক্ষায় কী ধরনের প্রশ্ন আশা সম্ভব সেটা কাপুরই লিখে দিয়েছে তাকে। সে-সব নিয়ে রাখি আবার ঘরের লোকের শরণাপন্ন হয়ছে। এত বড় একটা ব্যাপারে তার নির্লিপ্ততা দেখে সে মনে মনে বিরক্ত। কিন্তু এখন প্রয়োজনে তোয়াজ না করে। উপায় কী?

বড় চাকরি করার ঝোঁক এত প্রবল যে সুবীরকান্তও আর মুখ ফুটে বাধা দেয়নি। নিজে খেটে-খুটে আর বইপত্র ঘেঁটে সম্ভাব্য প্রশ্নগুলোর উত্তর লিখে দিয়েছে। আর গলদঘর্ম হয়ে রাখি সে-সব কণ্ঠস্থ করেছে।

পরীক্ষা হয়ে গেল। রাখি অবাক, আসতে পারে বলে কাপুর যা লিখে দিয়েছিল, হুবহু সেই সবই এসেছে। তার বাইরে একটিও নয়। এর দিনকয়েক বাদে কাপুর লাফাতে লাফাতে এক বিকেলে আপিস-ফেরত বড়কর্তা অর্থাৎ সোমার বাড়ি এসে হাজির। রমেন্দ্র সরকার তখন টুরে। পরীক্ষার ফলাফল জানার আশায় রাখি প্রায়ই সোমার ওখানে যায়। সেদিনও গেছল। তাকে দেখামাত্র কাপুর হৈ-হৈ করে উঠল। –কনগ্রাচুলেশনস ম্যাডাম, কনগ্রাচুলেশনস্! তুমি তো একটি সাংঘাতিক মেয়ে দেখি, পরীক্ষার খাতায় কী কাণ্ড করেছ! সোমার দিকে ফিরল।-বুঝলে ম্যাডাম, তোমার বন্ধু একটি জিনিস, পরীক্ষার খাতায় যা-সব লিখেছে আমার বাবার সাধ্যি নেই সেরকম লেখে! অফিসাররা সব কাড়াকাড়ি করে ওর খাতা পড়েছে!

চাকরি? কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে এর পরেও চাকরি হবে না!

হাওয়ায় ভেসে বাড়ি ফিরেছে রাখি। এতবড় কৃতিত্বটা কার প্রাপ্য সেটা সে ভালই জানে। সুখবরটা তক্ষুনি ভাঙল না। খাওয়া-দাওয়ার পর লোকটা আবার বই নিয়ে শুয়ে পড়েছে। ইদানীং পড়াশুনা একটু বেড়েছে লক্ষ্য করেছে। বইখানা হাত থেকে টেনে নিয়ে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে রাখল, তারপর দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে যেন একটা সবল অধিকার ঘোষণা করল।

-কী ব্যাপার?

রাখি বলল, ব্যাপার গুরুতর। তোমার এবারের চাকরির পরীক্ষাটা খুব ভালো হয়েছে–একেবারে ফাস্ট!

সুবীরকান্ত কিছুটা নির্লিপ্ত সুরে জবাব দিল, তোমাকে ফার্স্ট করার দায়ে যারা প্রায় প্রশ্নপত্র চালান করেছে, তাদের মুখ রক্ষা হয়েছে বলো!

মনে মনে একটু লজ্জা পেলেও উৎফুল্ল মুখে রাখি বেশ জোর দিয়েই বলল, বেশ যাও, সকলেই তো আর তোমার মত আদর্শ নিয়ে বসে নেই–কি যে হচ্ছে সর্বত্র তুমি খবরও রাখো না।

-বুঝলাম। তোমার চাকরি হচ্ছে তাহলে!

–হচ্ছেই তো। ছদ্ম-কোপে রাখি চোখ পাকালো।-কেন, না হলে তুমি খুশি হও?

সুবারকান্ত হেসেই জবাব দিল, ঠিক বুঝছি না!

রাখি বলল, তুমি একটা স্বার্থপর, একটা ভালো চাকরি করবো তাও তোমার হ্য হয় না। মেয়েদের পোস্ট, আমি না পেলে আর কোনো মেয়েই পেতো এটা–তাহলে আমি কী দোষ করলাম!

সুবীরকান্ত অন্তরঙ্গ আকর্ষণে তাকে আগলে রেখে হেসেই জবাব দিল, দোষ কিছু নয়, বিয়ের পর থেকে তোমার বড় হবার ঝোঁক দেখে আমার ভয়।

-বারে, চাকরিই যখন করব, ছোট চাকরি করব কেন?

সুবীরকান্ত তক্ষুনি ফিরে প্রশ্ন করল, আমার চাকরিটা ছোট চাকরি, না?

এবারে রাখি লজ্জা পেল একটু।-তুমি তো তবু প্রোফেসার, তোমার মতো তো। হলার নই আমি, প্রোফেসার হতে হতে বুড়িয়ে যাব।

-তাহলে তোমার স্কুলের চাকরিটা ছোট চাকরি ছিল বলো?

–অত সব জানি না, বিচ্ছিরি চাকরি।

এই প্রসঙ্গ বাতিল করে দিয়ে মনের আনন্দে আরো নিবিড়ভাবে বক্ষলগ্ন হল। নে। কিন্তু মানুষটাকে কেমন যেন অন্যমনস্ক মনে হল তার।

.

জীবনের একটা ছোট বৃত্ত থেকে অনেক দিনের আকাঙ্ক্ষিত একটা বড় বৃত্তে দার্পণ করল যেন রাখি। এই বৃত্তের রূপ আলাদা, রঙ আলাদা।

গোড়ায় গোড়ায় তার কাণ্ড দেখে সুবীরকান্ত হাসত। দুঘরের ফ্ল্যাটে আর চলছে, তিনঘরের ফ্ল্যাট একটা সংগ্রহ করতেই হল। ঘর হলেই হল না, তার যোগ্য সাজসজ্জা চাই। সোফা সেট এলো, তার সঙ্গে রং মিলিয়ে জানলা দরজার পর্দা এলো। টেলিফোন তো অফিস থেকেই মিলেছে। ছমাস না যেতে মাসিক কিস্তির ব্যবস্থায় ছোটখাটো একটা ফ্রীজও কিনে ফেলল সে।

মুখের হাসি আস্তে আস্তে কমে ব্যঙ্গোক্তি করেছিল, এবারে একটা গাড়ি চাই না?

–রোসো, আস্তে আস্তে সব চাই। তোমার কি, ভোলানাথ, কিছুই চাই না।

এ-সবের সঙ্গে তাল রেখে চাকরির মর্যাদা অনুযায়ী নিজের বেশবাসের ব্যবস্থা।

ছমাসের মধ্যে কম করে চারমাসের শেষের দিকেই বিব্রত মুখে রাখি এসে বললে, কিছু টাকা দিতে পারো, আমার হাতে যা ছিল ফুরিয়ে গেছে!

সুবীরকান্ত টাকা দেয়, কিন্তু টিপ্পনীও কাটে।–তুমি বড় চাকরি পাওয়াতে আমার কত সুবিধেই না হচ্ছে!

-বেশ যাও। সব যেন আমি নিজের জন্যে খরচ করছি। আর টাকাগুলোও ছাই কিভাবে যে খরচ হয়ে যায়–তা গোড়ায় গোড়ায় তো এরকম হবেই, একবার সব গোছানো হয়ে গেল তখন দেখো।

কিন্তু গোছানোর শেষ কোনো কালে হবে এমন ভরসা সুবীরকান্ত রাখে না।

বছর ঘুরতে পাখিকে নিয়ে তাদের মধ্যে ছোটখাট ঝগড়াই হয়ে গেল একটা। পাখি চার-এ পড়েছে, অতএব এখন ওকে কিন্ডারগার্টেনে না দিলেই নয়। নামজাদা এক মিশনারী স্কুলে ব্যবস্থা করল রাখি।

কিন্তু এ ব্যাপারে ওর বাপের বেয়াড়া গো দেখে মনে মনে রীতিমত বিরক্ত। তার সাফ কথা, ওর জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না–যখন সময় হবে, আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মত ও সাধারণ স্কুলেই পড়বে।

রাখি দেখে আসছে তার অনেক ব্যাপারে মানুষটা ইচ্ছে করেই আপত্তি করে। রেগে গিয়ে বলল, তাহলে বড় স্কুলগুলো আছে কী করতে?

-বড় স্কুলের কটা বাপ নিজে তার মেয়ের ভার নেয় আমি খবর রাখি না, আমার মেয়ের ভার আমি নিজে যখন নিয়েছি, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। কিন্তু তার পরেই হেসে যে কথা বলেছে, রাগ হবারই কথা। বলেছে, তেমার অসুবিধেটা কোথায় আমি বুঝি, মেয়ে তোমার কোনো নাম-করা বিলিতি স্কুলে পড়ছে না, লোকের কাছে সেটা বলতে তোমার মানহানি হবারই কথা।

ঠিক এমনি করেই একটা ঠাণ্ডা বিচ্ছিন্নতা দুজনের মধ্যে এগিয়ে আসছে ক্রমশ। রাখির মনে হয় বাড়িতে পা দিলেই সে যেন একটা সঙ্কীর্ণ পরিবেশের মধ্যে এসে পড়ে। বাইরেটা এর থেকে অনেক উদার, অনেক প্রশস্ত।

এদিকে তার অফিসের খাটুনিরও অন্ত নেই। কিন্তু তাতে বেশ একটা আনন্দ আছে, বৈচিত্র্য আছে। এক বছরের মধ্যেই চাকরিতে রীতিমত সুনাম রাখি চক্রবর্তীর। তার জন্যে পড়শুনা এবং পরিশ্রমও কম করেনি। চাইলড় ওয়েলফেয়ার, মেটারনিটি ওয়েলফেয়ার, নিম্নশ্রেণীর মেয়েদের উন্নতি এবং শিক্ষার ব্যবস্থা, তাদের কারিগরী শিক্ষার মহড়া, স্বাস্থ্য, সমস্যা, সাংস্কৃতিক উন্নতি, স্পোর্টস, কমিউনিটি সেন্টার স্থাপন–ইত্যাদির ব্যাপারে যে কত কত বই আর কত রিপোট পড়তে হয়েছে তাকে ঠিক নেই। এবারে আর সে কারো সাহায্যভিক্ষা করেনি, খেটে খেটে আর চোখ-কান খোলা রেখে নিজের ভিত নিজেই তৈরি করেছে।

ঘরের লোকের মেজাজ-পত্র তখনো অবশ্য অতটা অপ্রসন্ন দেখা যায়নি। বরং। বলেছে, কাজ যখন নিয়েছ, সৰ্বরকমে সে কাজের উপযুক্ত হওয়া ভালো।

কিন্তু অদৃশ্য বিচ্ছিন্নতাটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল তারপরে। কাজের আঁটঘাট যখন বোঝা হয়ে গেছে, আর যখন সে নিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে–আপিস থেকে সন্ধ্যে গড়িয়ে যায় প্রায়ই। সব-দিন যে কাজ থাকে এমন নয়। আপিসের শেষে মাঝে-মাঝেই উঁচুমহলের বৈঠক বসে, পরামর্শ হয়, আলাপ-আলোচনা হয়, কোনদিন বা নিছক আড়াই হয়। এগুলোও চাকরির অঙ্গ। তাছাড়া উঁচু মহলের এখানে সেখানে আনন্দ-সমাবেশ বা সাংস্কৃতিক ডাকও আছেই।

কিন্তু বাড়ি ফেরামাত্র একখানা গুরুগম্ভীর মুখ দেখতেই হবে। যেন কত অপরাধ করে বাড়ি ফিরল সে। তিনটে কথা জিজ্ঞাসা করলে একটার জবাব দেবে। গোড়ায়। গোড়ায় দেরিতে ফেরার কারণ বলত। এখন আর কিছু বলে না। হয় বই, নয় মেয়ে। নিয়ে আছে। আর ওর সঙ্গে আড়াআড়ি করেই যেন মেয়েটার স্বভাব অন্যরকম করে তুলছে। শুধু ওর জন্যেই এখন আয়া আছে একটা, কিন্তু বাপ বাড়ি থাকলে এক ঘণ্টাও এখন আর তার কাছে থাকতে চায় না মেয়েটা। নিজে হাতে তাকে খাওয়াবে, জামা পরাবে, অতবড় মেয়েকে সর্বক্ষণ কোলে বসিয়ে আদর দেবে, ঘুম পাড়াবে। মেয়েও তেমনি হয়ে উঠছে, পানের থেকে চুন খসলে বাবা বলে চিৎকার। মনের মতো কথা না বললে বা কখনো ধমক-ধামক করলে তাকে পর্যন্ত শাসায়, বাবাকে বলে দেব!

রাখির রাগ হয়ে যায় এক-একদিন, বলে, বল গে যা, তোর বাবা এসে মাথা কাটবে আমার! আদর দিয়ে দিয়ে মাথাখানা খাচ্ছে একেবারে।

ঝাঁঝটা সুবীরকান্তর কানে যায়। কিন্তু সে বলে না কিছু। মেয়েটা একটু-আধটু অসুখে ভোগে প্রায়ই, তাতেও ওর বাপের বাড়াবাড়ি রকমের ব্যস্ততা। সেদিন কাজের চাপই বেশি ছিল একটু, সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে দেখে মেয়েকে কোলে বসিয়ে তার বাবা দুধের গেলাস নিয়ে সাধ্য-সাধনা করছে–কিন্তু মেয়ে কিছুতে খাবে না। রাখি শাড়ি বদলে মুখহাত ধুয়ে এলো, চা খেল–দুধের গেলাস হাতে তখনো সেই সাধাসাধি চলেছে।

এই দেখে মেয়ের বাবাকেই ঝাঁঝিয়ে উঠল রাখি।–আদর দিয়ে দিয়ে কী করে তুলছ এখন দেখো! তার পরেই মেয়েকে শাসালো, এই মেয়ে, ভেবেছিল কী তুই? খাবি তো খা, নইলে বেরো এখান থেকে!

মায়ের দিকে চেয়ে মেয়ে পাল্টা চোখ পাকালো।-তুমি একটা পাজী!

সঙ্গে সঙ্গে বাপের কোল থেকে মেয়েকে টেনে তুলে একটু জোরেই হয়ত ঝাঁকুনি দিল রাখি।–কী বললি?

মেয়ে ভ্যা করে কেঁদে উঠল। তাই শুনে আয়া ঘরে ঢুকতে রাখি তাকেও ধমকে উঠল, মেয়েকে দুধ-টুধ খাইয়ে দেখেশুনে রাখো না কেন? সব সময় বাবুকে কষ্ট করতে হয় কেন? ২৭৬

জবাবদিহি না করে আয় কাঁদুনে মেয়েকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে প্রস্থান করল। দুধের গেলাস হাতে সুবীরকান্ত যে-ভাবে চেয়ে আছে তাতে রাগ হচ্ছে রাখির।–কী, মাকে পাজী বলতে শিখেছে, শাসন করে খুব অন্যায় করেছি?

-না। তবে এই কথাটা সে তোমার কাছ থেকেই শিখেছে। দিনের মধ্যে দুই একবার তুমিই ওকে পাজী বলো, আর কেউ বলে না!

উঠে জানালা দিয়ে গেলাসের সবটুকু দুধ বাইরে ফেলে দিয়ে শূন্য গেলাসটা টেবিলের ওপর রাখল।–মেয়েটা কাল থেকে সর্দিতে ভুগছে, আজ একটু জ্বর-জ্বরও হয়েছে–রোজ যা খায় সকাল থেকে এ পর্যন্ত তার অর্ধেকও খায়নি, এ-খবর তুমি রাখো?

গেলাসের দুধ ফেলে দিতে দেখে অপমানে রাখির মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছিল। শেষের কথা শুনে বিপরীত প্রতিক্রিয়া।–আমাকে তো বলোনি!

-আমি বলব, কেমন? তুমি মস্ত চাকরি করো, তাই মেয়ের অসুখের খবর তোমাকে আমার কাছ থেকে পেতে হবে? কোনা খবর যখন রাখার সময় নেই, তখন শাসন করারই বা দরকার কী? সবে খেতে শুরু করেছিল মেয়েটা–মধ্যে এসে তোমাকে এই মুর্তি দেখাতে কে বলেছিল?

ঘর ছেড়ে চলে গেল। রাখি অপ্রস্তুত হয়েছে বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে চাকরির খোটাটা বিধছে। পায়ে পায়ে মেয়ের কাছে এলো। পিঠে হাত দিয়ে দেখল, একটু ছাক-ছাক করছে বটে। আর ঢপটপে সর্দিটাও মিথ্যে নয়। মুখের দিকে একটু চেয়ে থেকে বলল, খাবি?

মায়ের গম্ভীর অথচ নমনীয় মুখ দেখে মেয়ে কৌতুক বোধ করল। আয়ার কোল থেকে মাথা নাড়ল, খাবে। রাখি দুধ ঢেলে নিতে এলো আবার। বই ফেলে তক্ষনি সুবীরকান্ত উঠে এলো–দুধ কী হবে?

–ও খাবে বলছে।

–খেতে হবে না, রেখে দাও–যখন খাওয়াবার দরকার হবে আমি খাওয়াব।

রাখির সমস্ত মুখ লাল হয়ে উঠেছে আবার। দুধের সসপ্যান হাতে রাখি তার দিকে ফিরে চেয়ে আছে।

দেখছ কী, তোমার কোনো ব্যবহারে ওইটুকু মেয়েকে আমি অবাক করতে চাই না। রেখে দাও, নয়তো ওই প্যানসুদ্ধ দুধ আমি রাস্তায় ঢেলে দেব!

ফিরে গিয়ে আবার বই নিয়ে বসল। রাখি স্তব্ধ খানিকক্ষণ। লোকটার গোঁ জানে, কিন্তু মেজাজ তার নিজেরও কম নয়। জীবনের যে ক্ষেত্রে এখন বিচরণ তার, তুচ্ছ। কারণে এ-রকম ঝগড়াবিবাদ রুচিতে ঘা লাগার মতো। দুধের সসপ্যান রেখে সোজা ওই ঘরেই এসে দাঁড়াল সে-ও।

–আমার সঙ্গে আজকাল তুমি এ-রকম ব্যবহার করছ কেন?

সুবীরকান্ত বই পড়ছে–পড়ছে। জবাব দিল না।

অনুচ্চ কিন্তু আরো কঠিন সুরে রাখি বলে উঠল, তোমার এ-রকম ব্যবহারের অর্থ কী আমি জানতে চাই।

–তাতে অশান্তি বাড়বে।

–অশান্তি আমি করছি কেমন, তুমি নিজে কিছু করছ না!

সুবীরকান্ত বই পড়ছে।

.

বিচ্ছিন্নতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠল আরো বছরখানেক বাদে।

সহকারী ওয়েলফেয়ার অফিসার থেকে রাখি চক্রবর্তী ওয়েলফেয়ার অফিসার হয়ে বসল। কিন্তু প্রত্যাশিত উন্নতিটা একটু অপ্রত্যাশিত ভাবেই এগিয়ে এলো তার সামনে। কথা ছিল, এক বুড়ো অ্যাসিসট্যান্ট ডাইরেক্টর বছর দেড়েক বাদে রিটায়ার করলে ওয়েলফেয়ার অফিসার মণিমালা ঘোষ অ্যাসিট্যান্ট ডাইরেক্টার হবে আর মণিমালা ঘোষের জায়গাটি তখন রাখি চক্রবর্তী দখল করবে। কিন্তু রাতারাতি অবাক ব্যাপার। হল একটা, বলা নেই কওয়া নেই মণিমালা ঘোষ হঠাৎ নিজের ইচ্ছেয় একেবারে অন্য বিভাগে অন্য চাকরি নিয়ে চলে গেল।

এই নিয়ে অবশ্য কানাঘুষো হল একটু। উড়ো গুজব কানে এলো রাখি চক্রবর্তীর, মণিমালা নাকি জয়েন্ট ডাইরেক্টার যজ্ঞেশ্বর কাপুরের ওপরেই রাগ করে চলে গেল। রাখি অবশ্য এ গুজবে কান দেয়নি। কারণ দিলখোলা যজ্ঞেশ্বর কাপুরের ওপর রাগ কারো হতে পারে না। তার ওপর এ আপিসে এসে অবধি মণিমালার সঙ্গে একটু খাতিরই বরং বেশি দেখেছে। একেবারে নিম্নপর্যায়ের মানুষদের কিছু চটুল রটনাও কানে এসেছে তার, কিন্তু এ-সব উক্তিতে রাখি কখনো কান পাতে নি। কারণ কাপুরের সঙ্গে খাতির সকলেরই–সে যখন ম্যাডাম বলে সরাসরি কাঁধে হাত রাখত অথবা হাত ধরে ঝাঁকাতো–রাখির নিজের মুখও গোড়ায় গোড়ায় লাল হত, এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর বলতে গেলে কাপুরের খাতির এখন সব থেকে বেশি তার সঙ্গেই। রাখি জানে, এই নিয়েও আড়ালে চোখ-টেপাটেপি করে কেউ কেউ আজকাল। কিন্তু এ-সব নিম্নস্তরের ব্যাপার কখনো গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি সে।

মণিমালা ঘোষ আই. এ. এস. ডাইরেক্টটার রমেন্দ্র সরকারের নিজের খুড়তুতো বোন। নিঃসন্তান, বিধবা। বছর সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ হবে বয়েস, রমেন্দ্র সরকারের থেকে বছর দেড়-দুইয়ের ছোট। কিন্তু রাখি বা সোমার থেকে অনেকটাই বড়। ওরা মণিদি বলে ডাকত তাকে। আর রাখির বেশ ভালো লাগত তাকে। বুদ্ধিমতী, মোটামুটি সুশ্রী মিষ্টি চেহারা।

সে এভাবে হুট করে চলে যেতে রাখি অবাক হয়েছিল সন্দেহ নেই। সোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কী ব্যাপার, মণিদি চলে গেল কেন?

সোমা ঠোঁট উল্টে জবাব দিল, কে জানে, মেজাজী মেয়ে, ভালো লাগল না চলে গেল। আমাকে শুনিয়ে গেল, দাদার আণ্ডারে আর চাকরি করার ইচ্ছে নেই। তারপরেই মুচকি হেসে সোমা বলল, ও বদলি হয়ে তোর তো কপাল খুলে গেল রে!

মিথ্যে নয়, কপাল খুলেছে বটে। এখন তো ওয়েলফেয়ার অফিসার, দেড় বছর বাদে ওই আধ-বুড়ো অ্যাসিট্যান্ট ডাইরেক্টর রিটায়ার করলে সেই পোস্টও অবধারিত সে-ই পাবে। কাপুর এ আশ্বাসও তাকে দিয়েই রেখেছে। সে জয়েন্ট ডাইরেক্টর বটে, কিন্তু এসব ব্যাপারে সমস্ত বিভাগটির সময়কর্তা বলতে গেলে সে-ই। মিনিস্টর থেকে শুরু করে সকলের সঙ্গেই তার দহরম-মহরম। সেদিক থেকে প্রতাপ তার ডাইরেক্টারের থেকেও বেশি। কিন্তু মানুষ হিসেবে এমনি মজার যে প্রতাপের দিকটা কখনো কোনা কারণে উগ্র হয়ে ওঠে না।

ভাগ্যের এ-হেন পরিবর্তনেও নির্বিকার শুধু ঘরের একজন। এই কারণে রাখির ভেতরটা এখন বিরক্তিতে ভরপুর। তার মনে মনে ধারণা, তার বড় চাকরির দরুণ। লোকটা তাকে ঈর্ষাই করে। আসলে তার নিজেরই পুরুষকারের অভাব। নইলে এত বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে কলেজের মাস্টারিতেই খুশি থাকে কী করে? একটু খাটলে ডক্টরেট অনায়াসে পেতে পারে! রাখি একবার সেকথা বলেও ছিল। জবাবে যে কথা তাকে শুনতে হয়েছিল তাও চাপা গাত্রদাহ ছাড়া আর কিছু নয়। সে বলেছিল, বড় চাকর করার পর আজকাল আমাকে নিয়েও বোধহয় একটু লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তোমর!

রাখির রাগই হয়েছে। জবাব না দিয়ে চলে গেছে। ঘরের লোক মস্ত লেক, সেটা যে সব স্ত্রীরই গর্বের কারণ, এটুকু বোঝার মত উদারতা পর্যন্ত যদি না থাকে, তার সঙ্গে তর্ক করে কী হবে?

এমনি করেই হালকা ব্যাপারগুলোও ঘোরালো হয়ে উঠছে। যেমন সেদিন–সর পর এক বড় হোটেলে কাপুর সেদিন ওদের ডিনারে ডেকেছিল। ওদের বলতে রমেন্দ্র সরকার, সোমা সরকার আর রাখি। মনে মনে খুশি হল, কারণ ডিনারটা তাই প্রমোশনের খাতিরে। কিন্তু কাপুরের সেটা মাথায় না এলে রাখিই বা বলে কী করে?

ডিনারে হাসিখুশির ব্যাপারটা একটু বেশিই গড়ালো। এ-ধরনের নিরিবিলি সমাবেশে রমেন্দ্র সরকার আর কাপুরকে ড্রিঙ্ক করতে রাখি আগেও দেখেছে। সেদিন কাএ প্রস্তাব করল, তাদের সম্মানে মহিলাদেরও একটু ড্রিঙ্ক করতে হবে। সোমা সানন্দে রাজি। ও একেবারে অনভ্যস্ত নয়, সেটা খানিক বাদেই বোঝা গেল। কিন্তু তরল খুশির ব্যাপারটা জমে উঠল রাখিকে নিয়ে। সে কিছুতে খাবে না, কাপুর খাওয়াবে তাকে। গেলাসের রঙিন পদার্থ সে খুব হালকা করে মিশিয়ে তারপর সেই থেকে অনুরোধ করে চলেছে। শেষে সোমা বলেছে, অত করে বলছে, খা না বাপু, এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না–এই তো আমি দুবার মেরে দিলাম!

শেষ পর্যন্ত নাচার হয়েই গেলাসের জলীয় বস্তু চোখ-কান বুজে এক নিঃশ্বাসে জঠরে চালান করে দিল রাখি। বিচ্ছিরি লাগল। তেতো-তেতো স্বাদ। গায়ে একটা ঝঙ্কার দিয়ে উঠতে সকলে হেসে উঠল।

ডিনারের পর রমেন্দ্র সরকার কাপুরের গাড়িতে তার সঙ্গে কোথায় তাদের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে চলে গেল। সোমা তার গাড়িতে রাখিকে পৌঁছে দিতে এলো। রাখির ভেতরটা তখন আনন্দে ভরাট, ভারী হালকা লাগছে। কোনো দুর্যোগের ছায়া তার কল্পনাতেও নেই। অন্যথায় বাড়ির দরজায় নেমে সোমাকে হয়ত গাড়ি থেকেই বিদায় দিতে চেষ্টা করত।

দোতলার বসার ঘরে ঢুকতেই সুবীরকান্তর সঙ্গে দেখা। সোমা হেসে বলে উঠল, আজ কিন্তু আপনার স্ত্রীর চরিত্র খারাপ করে দিয়েছি আমরা…কাপুর ওকে ড্রিঙ্ক করিয়ে ছেড়েছে!

শোনা-মাত্র মুখখানা যা হয়ে গেল, ভিতরে ভিতরে রাখি যেন কেঁপে উঠল। সোমাও বলে উঠল, ভয় পেয়ে গেলেন নাকি! কিছু ঘাবড়াবেন না মশাই, ইট ওয়জ জস্ট স্পোর্ট, আমি ওর ডবল খেয়েছি!

নিষ্প্রাণ ঠাণ্ডা গলায় সুবীরকান্ত জবাব দিল, আপনার যা সহ্য হবে ওর তা সহ্য। হবে কি?

সোমা চোখ পাকালো, কেন, আপনার স্ত্রীটিকে আপনি কারো থেকে কম ভাবেন। নাকি?

-না, তবে নিজের থেকেও খুব বেশি ভাবার মতো মুশকিলে না পড়ে যাই!

তরল বস্তুর প্রতিক্রিয়ায় সোমার ভেতরটাও খুব হালকা। অন্যথায় এই গম্ভীর আচরণ মর্যাদায় লাগার কথা। হেসেই রাখির দিকে ফিরল, তোর ভদ্রলোক দেখি বেজায় পিউরিটান, মেজাজপত্র খুব ভালো দেখছি না। আজ পালাই, আর একদিন এসে তর্ক করব।

লজ্জায় রাখির মাথা কাটা যাচ্ছিল। তাকে বিদায় দিয়ে ঘরে এসেই ফেটে পড়ল। বলে উঠলো, আমার বন্ধু হলেও ও আমার ডাইরেক্টরের স্ত্রী, এটা তোমার মনে রাখা উচিত ছিল–তুমি ওর সঙ্গে এ ব্যবহার করলে কী বলে!

হাতের বই রেখে সুবীরকান্ত আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল।–কী রকম ব্যবহার করতে হবে, তোমরা স্পোর্ট করে মদ খেয়ে এসেছ সেই আনন্দে আটখানা হয়ে উঠব?

-কী বললে? স্পোর্ট কাকে বলে তুমি জানবে কী করে? নিজের কাছে এক মস্ত লেক হয়ে বসে আছ তুমি, বাইরের দুনিয়ায় কেউ তোমার আদর্শের কানাকড়িও দাম দেয় না, সেখানকার সভ্যতা ভব্যতা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই–বুঝলে?

–ধারণা কার আছে, ওই কাপুরের? তাহলে তার কাছেই যাও!

–কী? কী বললে? দুপা এগিয়ে এলো সে।

–সামনে এসো না, ওইখানে দাঁড়াও। অনুচ্চ কিন্তু কঠিন এই স্বর শুনে রাখি থমকে আঁড়াল। তেমনি স্পষ্ট পুনরুক্তি সুবীরকান্তর। বললাম আমার দুনিয়ার আদর্শ আলাদা, সেটা যদি তোমার না পোষায়, তুমি অন্য ব্যবস্থা দেখতে পারো।

ভিতরের ঘরে ঢুকে গেল। সেখান থেকে মেয়ের ঘরে। মেয়ে রাতে আয়ার কাছে। ঘুমোয়–বাবা-মায়ের সঙ্গে একঘরে থাকা উচিত নয় বলে মাসছয়েক ধরে রাখিই এই ব্যবস্তা করেছিল। একটু বাদে মেয়ের ঘর থেকে আয়াকে বেরিয়ে আসতে দেখল। তারপরেই ওই লোককে শোবার ঘর থেকে নিজের বালিস নিয়ে যেতেও দেখল।

রাখির মাথায় আগুনই জ্বলছে। প্রতিদিনের এই সঙ্কীর্ণতার অত্যাচার যেন মুহূর্তের মধ্যে সহ্যের সীমা ছাড়াল। দুঘরের মাঝের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সে। দেখল। একট।..বাহুতে চোখ ঢেকে মেয়ের পাশে শুয়ে আছে। অপমানে রক্তবর্ণ হয়ে গেল রাখির মখ। ঠাস করে মাঝের দরজা টেনে বন্ধ করে দিল সে। এত জোরে যে ঘুমন্ত মেয়েটা চমকে উঠল।

থাকুক। দেখা যাক কদিন পরে থাকতে। আদর্শবান পুরুষের আর এক দিকও খুব ভালই জানা আছে তার। এ অপমানের জবাব সেও দিতে জানে।

দিন কাটতে লাগল। যে চিড়টা খেল সেটা আর জোড়া লাগল না। কিন্তু কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগল। বাক্যালাপটা প্রয়োজনের বাক্যালাপে এসে ঠেকল। রাখির। কাজের সুনাম যেমন বাড়ছে, ব্যস্ততাও বাড়ছে। দুদিন একদিনের জন্যে মাসে কয়েক দফা ট্যুরে বেরুতে হয়। বেশ আনন্দের মধ্যেই কাটে তখন। কখনো খোদ ডাইরেক্টর রমেন্দ্র সরকার সঙ্গে থাকে, কখনো বা জয়েন্ট ডাইরেক্টার যজ্ঞেশ্বর কাপুর।

কিন্তু ফিরে এলেই সেই নীরস গুরুগম্ভীর পরিবেশ। রাখির হাঁপ ধরে যায় এক এক সময়। কোনো সময় যদি মেয়ে বা মেয়ের বাপের শরীর খারাপ হয়, সে খবরও ঝি-চাকরের মুখে শুনতে হয়। কেউ বলে না তাকে। তাকে অপ্রস্তুত করার জন্যই যে বলে না, রাখি সেটা ভালই বুঝতে পারে। তবু যতটুকু সম্ভব নিজের কর্তব্য করে যেতে চেষ্টা করে। মেয়ের আব্দারে তার বাপের এখনো তার কাছেই শোয়া বহাল আছে।

একে একে প্রায় দুবছর ঘুরে গেল আরো। রাখির অক্লেশে প্রত্যাশিত উন্নতি হয়েছে আবার। সে এ্যাসিসট্যান্ট ডাইরেক্টার হয়েছে। কাপুর ট্যুরে। এই উপলক্ষে সোমা আর তার বর সেদিন ওদের ফ্ল্যাটে এসেছিল। রাখি আদর অভ্যর্থনা করেছে। তাদের। ইদানীংকালের মধ্যে রমেন্দ্র সরকার সস্ত্রীক আরো দিন-দুই তাদের ফ্ল্যাটে এসেছে। বলা বাহুল্য ডাইরেক্টর হিসাবে নয়, স্ত্রীর বন্ধুর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ধরেই। সুবীরকান্ত সে দুদিনের একদিনও বাড়ি ছিল না। এই দিনে ছিল, কারণ রাখি আগে। থেকেই তাকে বলে রেখেছিল। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও করেছিল।

সুবীরকান্ত হাসিমুখেই কথাবার্তা বলেছে তাদের সঙ্গে। তবু শুরুতেই রাখির মেজাজ বিগড়লো। তার মেয়েকে দেখে সোমা জিজ্ঞেস করেছিল, কোন স্কুলে পড়ো?

মেয়ে যে স্কুলের নাম করল সেটা যেন নতুন করে কানের পরদায় বিধল রাখির। তার ওপর সোমা বলল, একটা মাত্র মেয়ে তোর, একটা ভালো স্কুলে দিলি না কেন?

রাগ চেপে রাখি জবাব দিল, ওর বাবার আপত্তি।

সোমা হাসিমুখে সুবীরকান্তর দিকে তাকালো।-বাবা, আপনি এমন পিউরিটান যে মেয়েকে একটা ভালো স্কুলে দিতেও আপত্তি?

মেয়ের সামনে তার স্কুল সম্পর্কে এই উক্তি যে পছন্দ হবে না সেটা একমাত্র রাখিই জানে। সুবীরকান্ত ক্ষুদ্র জবাব দিল, এটাও খারাপ স্কুল নয়। মেয়েকে বলল, তুমি খেলা করো গে যাও।

সোমা হাসিমুখেই আবার বলল, কিন্তু আশা আর বাসা ছোট করতে নেই, আপনার স্ত্রীকে দিয়েই দেখলেন তো? বরাবর উঁচু আশা ছিল ওর–আপনার পাল্লায় পড়ে হতে যাচ্ছিল স্কুল-মাস্টার হয়ে বসল এ্যাসিট্যান্ট ডাইরেক্টর…কটা বছর গেলে ডেপুটি ডাইরেক্টরও হবেই।

রমেন্দ্র সরকার মাথা নেড়ে সায় দিল, ইয়েস, সী ইজ ভেরি ডিজারভিং!

ভিতরে ভিতরে রাখি উৎফুল্ল। ঘরের লোকের মুখখানাই দেখছে সে। রমেন্দ্র সরকারের কথা শুনে কান জুড়িয়েছে, আর সোমার কথাগুলো চমৎকার লেগেছে।

-আশা আর বাসা ছোট করতে নেই!

সুবীরকান্ত মৃদু হেসে সোমার দিকে তাকালো।–ডেপুটি ডাইরেক্টর হলেই আশা। আর বাসার শেষ?

সোমা জবাব দিয়েছে, আর কত চান মশাই?

-আমি চাইনে।…আশা আর বাসার মধ্যে খানিকটা সামঞ্জস্য না ঘটালে বিপদও হয়, সেই কথা বলছিলাম।

-কী রকম? সোমা উৎসুক।

–আশার থেকে বাসাটা বেশি বড় হয়ে গেলে খরচ বাড়ে, ঋণগ্রস্ত হতে হয়। আর, আর বাসার থেকে আশাটা খুব বেশি ছাড়িয়ে উঠলে অবজ্ঞায় যে বাসা আছে তাও ভাঙে।

লজিক! রমেন্দ্র সরকার তারিফ করে উঠল।

–ছাই লজিক! সোমা সরকার ছদ্ম কোপ দেখালো।–আমি লজিক পড়া মেয়ে, সব উপমাই অমন ভাঙাচোরা করা যায়।

.

রাখি চক্রবর্তী আর এক ধাপ ওপরে উঠেছে বলেই হয়ত সহিষ্ণুতা কমেছে আরো একটু। বাইরে তার মর্যাদা প্রতিপত্তি যত বাড়ছে, অন্দরের সহজ আলো-বাতাস যেন ততো বেশি সঙ্কীর্ণ ঠেকছে। চাকরির ব্যাপারে মিনিস্টারের সঙ্গে পর্যন্ত সহজ যোগাযোগ এখন (অবশ্য কাপুর আর রমেন্দ্র সরকারের কল্যাণেই সেটা আরো সহজ হয়েছে), ঘরের লোকের সেজন্য গর্ব বোধ করা দূরে থাক, তার রূঢ় অসহযোগ দিনকে দিন যেন আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

কিন্তু রাখি আর অত কেয়ার করে না। কেউ যদি ইচ্ছে করে তফাতে সরে থাকে, সে কী করতে পারে? মাসের মধ্যে বার-দুই অন্তত এক এক দফায় চার পাঁচ দিন করে ট্যুর-প্রোগ্রাম আজকাল। কিন্তু ফিরে এসেও সেই গোমড়ামুখ দেখে মেজাজ চড়ে যায় তারও। আরো দু-তিন দফা ট্যুর-প্রোগ্রাম ফেলতে ইচ্ছে করে।

অনেক দিনের পুঞ্জীভূত মেঘ ফেটে ভেঙে চৌচির হয়ে পড়ল বুঝি সেদিন। কটা দিন রাখি বিশেষ ব্যস্ত ছিল। দুরের এক মফঃস্বল সহরে কম করে দশ-বারো দিনের ট্যুর-প্রোগ্রাম। বড় ব্যাপার। ছোট ছেলেমেয়েদের ফ্রী প্রাইমারি স্কুলের উদ্বোধন, তাদের শিক্ষার মহড়া, প্রসূতিসদনের উদ্বোধনী, জন্ম-নিয়ন্ত্রণ শিক্ষা সপ্তাহ পালন, ওয়েলফেয়ার একজিবিশন ইত্যাদি অনেক ব্যাপার। কটা দিন হিমসিম অবস্থা রাখির। বাড়িতে ফাইল-পত্র এনে রাত জেগে কাজ করতে হয়েছে, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়ার ফুরসতও মেলেনি। তাছাড়া মেয়ের খপ্পরে না পড়লে সারাক্ষণ তো বই মুখে করেই আছে। রাখি চাকরকে বলে দিয়েছে, বাবুকে যেন সময়মতো খেতে দেওয়া হয়, তার সময়মত সে খেয়ে নেবে।

সেদিন ফাঁক পেয়ে একটু সকাল সকাল বাড়ি ফিরল। এসে দেখল কলেজের সেই অল্পবয়সী ইকনমিক্স-এর প্রোফেসারটি মেয়ের সঙ্গে গল্প করছে। এম. এ. পরীক্ষার সময় যে ভদ্রলোকটি তাকে খানিকটা সাহায্য করেছিল। তাকে দেখে বলল, দাদার জন্য বসে আছি, বাড়ি নেই শুনলাম। দুদিন কলেজ যাননি দেখে খবর নিতে এলাম, কী হল?

রাখি অবাক! দুদিন কলেজে যায়নি–ও জানেও না। তাছাড়া কলেজ পারতপক্ষে কখনো কামাই করে না। রাখি চাকরকে ডেকে তাড়াতাড়ি চা দিতে বলে বিস্ময় গোপন করতে চেষ্টা করল। ভদ্রলোকের নাম প্রতুল সোম। এ-কথা সে-কথার পর সে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা বউদি, দাদা বদলির জন্য এরকম উঠে-পড়ে লেগেছেন কেন? আমরা জিজ্ঞেস করলে বলেন, এখানে শরীর টিকছে না।…কিন্তু যে-সব জায়গায় তিনি যেতে রাজি সে-সব কলকাতার থেকে কি এমন ভাল জায়গা?…আবার সরকারী চাকরি ছেড়ে বাইরের কোন কোন যুনিভার্সিটিতেও যেতে চেষ্টা করছেন শুনলাম, অবশ্য ওঁর মতো প্রোফেসার পেলে অনেকেই লুফে নেবে…কিন্তু ওঁর হঠাৎ এ-রকম ইচ্ছে। হল কেন?

রাখি নির্বাক বিমূঢ় খানিকক্ষণ। এমন একটা সংবাদ সে কল্পনাও করতে পারে না। তার মুখ দেখে প্রতুল সোমও প্রথমে অবাক, পরে অপ্রস্তুত। সে বলেই ফেলল, আপনি এ-সব জানেন না নাকি?

সহজ হবার চেষ্টায় প্রাণান্তকর ধকল। সমস্ত শক্তি দিয়ে হাসতে চেষ্টা করল রাখি। বলল, ঠিক এতটা জানি না…।

বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছে বুঝে প্রতুল নোম আর অপেক্ষা না করে উঠে পালাল।

মাথায় আগুন জ্বলছে রাখির, সে অপেক্ষা করছে।

সন্ধ্যার একটু পরেই মানুষটা এলো টের পেল। সোজা তার শোয়ার ঘরে চলে। গেল। ওর ঘরে আসা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে।

খানিকটা সময় নিয়ে মাঝের দরজা দিয়ে রাখিই ও-ঘরে এসে দাঁড়াল। মেয়ে তখন বাপের বুকের ওপর উপুড় হয়ে কে এসেছিল সেই সমাচার জানাচ্ছে। তার বাবার গায়ে চাদর জড়ানো, শুকনো মুখ। কিন্তু আর লক্ষ্য করার ধৈর্য নেই রাখির। মেয়েকে বলল, ওদিকে আয়ার কাছে যাও।

মেয়ে আজকাল একটু ভয়ই করে তার মাকে। এই মুখের হুকুম শুনে তক্ষুনি চলে গেল। রাখি আরো একটু এগিয়ে এলো।-তুমি অন্য জায়গায় বদলির চেষ্টা করছ শুনলাম?

বদলির চেষ্টা নয়, আসলে সরকারী চাকরি ছেড়ে চলে যাবে কিনা, সম্প্রতি সেই চিন্তাই করছিল সে। জয়পুরের এক কলেজ থেকে তার আমন্ত্রণ যে এসেই গেছে, সেটা এ পর্যন্ত কারো কাছে বলেনি। এখনো বলল না। গায়ে চাদরটা আর একটু ভালো করে জড়িয়ে উঁচু বালিসে মাথা রাখল।

-হ্যাঁ।

-তা এ সামান্য খবরটা আমাকে বলোনি কেন, বাইরের লোকের কাছে বেশ ভালো-মতো অপমান করার জন্যে?

সুবীরকান্ত জবাব দিল না। ..

তীক্ষ্ণ কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রাখি।-আমাকে চাকরি ছাড়তে হবে?

–না।

–মেয়ে নিয়ে তুমি একা যাবে?

–হ্যাঁ।

চেয়ে আছে রাখি। মর্মান্তিক দেখাই দেখে নিচ্ছে যেন।–আশা বড় করেছি সেই মস্ত অপরাধে বাসা তাহলে ভাঙাই ঠিক করেছ তুমি?

সুবীরকান্ত নিরুত্তর।

দুচোখ ধক-ধক করে জ্বলছে রাখির। গলার স্বরেও এবার বুঝি আগুন ঝরল। –এত হিংসে তোমার ভেতরে ভেতরে! এত জ্বালা!

ধার কিন্তু পাণ্ডুর মুখে সুবীরকান্ত আস্তে আস্তে বসল। কঠিন স্বরে বলল, রাখি। আমার শরীর সুস্থ নয়, তুমি ও-ঘরে যাবে?

শরীর-মন কিছুই তোমার সুস্থ নয় সে তো অনেক দিন ধরেই দেখছি, ভিতরে এত বিকৃতি যার সে সুস্থ থাকবে কেমন করে? ও-ভাবে দেখছ কী, আজও তুমি মুখ বন্ধ করবে ভেবেছ? তুমি নীচ! তুমি অতি নীচ, অতি ছোট, অতি হীন, বুঝলে-বুঝলে?

তার মুখখানা ঝলসে দিয়েই এক ঝটকায় সে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

হাঁপাচ্ছে। বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে তখনো।

কবরের স্তব্ধতার মধ্যে কেটে গেল কয়েক ঘণ্টা। ও-ঘরের আলো অনেকক্ষণ। নিভে গেছে। মাঝের পর্দাটা ঝুলছে। রাখি নিজের ঘর থেকে বেরুলো একসময়। খাবার ঘরে আলো জ্বলছে। চাকরটা বসে আছে। তাকে দেখে উঠে এলো।-বাবু রাতে কী খাবেন বললেন না তো?

তার দিকে চেয়ে রাখি থমকালো একটু।–কী খাবেন মানে?

চাকর জানালো, আজ দুদিন বাবুর শরীর খারাপ, দুবেলাই দুধ-সাগু খাচ্ছেন –আজ কী খাবেন কিছুই বলেন নি।

কয়েক মুহূর্ত রাখি নির্বাক। তারপর চাকরকে বলল, আর অপেক্ষা না করে খেয়ে নিতে। তারও খিদে নেই বলে এলো।

.

পরদিন।

মেয়ে স্কুলে চলে গেছে। অফিসে বেরুবার আগে এক-রকম জোর করেই রাখি ঘরে ঢুকল।…চোখ বুজে শুয়ে আছে। টেবিলে ওষুধের শিশি একটা। তেমনি পড়ে আছে–এক দাগও খাওয়া হয়নি। কাল বিকেলে ডাক্তারের কাছে গেছল বোঝা গেল। সকালে টোস্ট পাঠিয়েছিল, তা তেমনি পড়ে আছে, শুধু চা খেয়েছে।

ফিরে তাকাতে দেখল তার দিকেই চেয়ে আছে। রাখির মানসিক যাতনা একটুও কমেনি। সমস্ত রাত বরং আরো বেশি জ্বলেছে। তবু এই মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ দার্জিলিংয়ের একবারের সামান্য অসুখের কথা মনে পড়ল। রাখি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে কয়েকটা কথা বলেছিল।…এ মুখের সঙ্গে সেই মুখের মিল নেই একটুও।

জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী অসুখ?

জবাব পেল না।

–আজ কলেজ যাবে?

নিরুত্তর।

–দুপুরে কী খাবে সে-কথা বলবে?

নির্বাক।

রাখি বেরিয়ে এলো। কাল বাদে পরশু অত বড় ট্যুর-প্রোগ্রাম, অফিসে অনেক কাজ। কিন্তু কাজ না থাকলেই বা কী করত? ও বাড়ি থাকলেই বরং না খেয়ে না দেয়ে ওই ভাবে বসে থেকে তাকে আক্কেল দেবে। ক্ষোভ আর একটা অসহ্য যাতনা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

এমনি স্তব্ধতার মধ্যেই সেই দিনটা গেল। পরের দিনও। সন্ধ্যা। প্রাণান্তকর বিমুখতা সত্ত্বেও পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল।…বসে আছে। পাশে মেয়ে।

-কেমন আছ?

জবাব পেল। মেয়ে সামনে আছে বলেই।-ভালো।

ট্যুরে বেরোনোর খবর আগেই জানত। পাঁচ-ছদিন আগে রাখি বলে রেখেছিল। ভিতরে ভিতরে মানুষটা কোন ছুরি শানাচ্ছে তখনো জানা ছিল না। জিজ্ঞাসা করল, কাল আমার ট্যুর-প্রোগ্রাম, কী করব?

যাবে।

–ফিরতে আট-দশদিন দেরি হবে।

হবে।

বাইরে এসে কাজের চাপে সাময়িকভাবে যাতনাটা ভুলতে চেষ্টা করল রাখি। শুধু যাতনা নয়, সেই সঙ্গে বিদ্বেষ, ক্ষোভ-আবার কী একটা অজ্ঞাত ভয়ও…মানুষটার অভিসন্ধি জানার পর এতবড় একটা ব্যাপার ঘটে গেছে যখন, ভয়ের কিছু আছে। ভাবছে না। তবুও ভয়।

.

সমস্ত দিনে ফুরসত নেই বললেই চলে। বড় ব্যাপার। সোমাকে নিয়ে ডাইরেক্টর রমেন্দ্র সরকার এসেছে, জয়েন্ট ডাইরেক্টর কাপুর এসেছে, রাখি এসেছে, ওয়েলফেয়ার অফিসার এসেছে, আর আরো নীচের কর্মচারীরা যে কত এসেছে ঠিক নেই।

ওপরের দিকের ওরা মস্ত সরকারী বাংলোয় আছে-সস্ত্রীক রমেন্দ্র সরকার, কাপুর, রাখি আর ওয়েলফেয়ার অফিসার। রাতে কাপুরের ফুর্তির আড্ডা বসে। বোতলের রসদ সে কলকাতা থেকেই নিয়ে এসেছে। তাদের চারজনের আনন্দের আসর বসে। আনন্দ যে নেই সেটা বুঝতে না দেবার তাগিদেই রাখি যোগ দেয়। না এলে সোমা বা কাপুর গিয়ে ঘর থেকে ধরে নিয়ে আসে।

তাদের অনুরোধে গেলাসও হাতে তুলে নেয়। সমস্ত দিনের এত পরিশ্রমের পরেও রাতে ঘুম হতে চায় না। এই তরল জিনিস জঠরে গেলে চিন্তা-ভাবনাও কিছুটা ফিকে হয়ে যায়, ঘুমও একটু হয়। রাখি ভিতরের সমস্ত ক্ষোভ চিন্তা-ভাবনা যাতনা মুছে ফেলতেই চায়।

দশটা দিন কেটে গেল। রমেন্দ্র সরকার সোমা আর কাপুর কাল চলে যাবে। রাখির আরও দিন-দুই থাকা দরকার। মন না চাইলেও থেকেই যাবে।

রাতের আসর আজ একটু বেশিই জমেছে। রাখি গেলাস তেমন মুখে তুলছে না দেখে রমেন্দ্র সরকার নিজে পর্যন্ত দুই-একবার সাহায্য করতে এগিয়েছে। সোমার হাব-ভাবও অন্য দিন থেকে একটু বেশি খুশি-খুশি। বেশি খেয়েছে বলেই বোধহয়।

রাত মন্দ হল না। বরের শরীর খারাপ হবার ভয়ে সোমা একরকম জোর করেই রমেন্দ্র সরকারকে টেনে তুলে নিয়ে চলে গেল।

রাখিও উঠল।

কাপুর বাধা দিল, ম্যাডাম দাঁড়াও, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

উঠে সোজা এগিয়ে গিয়ে ঘরের পুরু নীল পর্দার ওধারের দরজা দুটো টেনে দিয়ে সোজা তার কাছে ফিরে এলো। খুব কাছে। সঙ্গে সঙ্গে হাত দুটো তার দুই কাঁধে উঠে এলো।

-এ-ভাবে আর কত দিন চলবে? হোয়াই ওয়েস্ট টাইম?

-তার মানে? রাখি হতভম্ব। তার বোধশক্তি কয়েক নিমেষের জন্যে যেন বিলুপ্ত একেবারে।

-ও, ইউ নো ওয়েল! একটা জোরালো আকর্ষণ, পরমুহূর্তে পুরু দুই অধরের নিষ্পেষণে ঠোঁটদুটো যেন জ্বলেপুড়ে গেল রাখির। সর্বাঙ্গ অবশ, পায়ের নীচে মাটি দুলছে।

কয়েকটা মুহূর্ত। প্রাণপণে লোকটাকে ঠেলে সরালো সে। চকিতে বসন সংবরণ করে নিয়ে একটা চাপা আর্তনাদ করে উঠল প্রায়।–এ আপনি কী করছেন?

কাপুর থমকাল একটু। তারপর হেসেই আবার বলল, রাখি, লেটস কাম আউট –আমার ফ্লার্টিং ওয়াইফের সঙ্গে আমার বনছে না, তোমারও ওই রাফ হাজব্যাণ্ডের সঙ্গে বনছে না–সো লেট আস মেক অ্যারেজমেন্ট অ্যাণ্ড লেট দে গো টু হেল!

–এসব; এসব আপনাকে কে বলেছে? আমার কথা আপনাকে কে বলেছে? ক্রোধে আর সেই সঙ্গে এক অব্যক্ত যাতনায় রাখি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

আর তাই দেখেই কাপুর হকচকিয়ে গেল কেমন।-বোসো ম্যাডাম, আই অ্যাম স্থাউন্ড্রেল বাট নট মীন! আমাকে বুঝতে দাও। তুমি তোমার হাজব্যাণ্ডকে ভালবাসো?

রাখি অসহিষ্ণু জোরের সঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ।

–সে তোমাকে ভালবাসে?

–বাসে।

কাপুর ধুপ করে সোফায় বসে পড়ল।–দেন আই অ্যাম এ ফুল অ্যাণ্ড হ্যাভ প্লেড ইন হার হ্যাঁণ্ডস এগেইন! শোনো ম্যাডাম, আমি একেবারে ভুল ধারণা থেকে এগিয়েছি–দ্যাট লেডী, সোমা সরকার, সী ইজ অ্যান ইনট্রিগিং গার্ল! নাও আই আণ্ডারস্ট্যাণ্ড এভরিথিং! –ওয়েলফেয়ার অফিসার মণিমালা ঘোষকে মনে আছে? ওদের আত্মীয়। সি লাইকড মি..পরিবারের দুর্নাম হবে সেই ভয়ে আমাদের মাঝখানে ওরা তোমাকে নিয়ে এলো। সোমা সরকার কত যে প্রশংসা করেছিল তোমার ঠিক নেই। আর আমারও সত্যি তোমাকে ভালো লাগতে শুরু করেছিল, সেটা বুঝেই মণিমালা সরে গেছে।

রাখি স্তব্ধ। কাপুর উঠে লম্বা ঘরটায় একবার পায়চারি করে তার হাত-কয়েক দূরে এসে দাঁড়াল।-ইদানীং সোমা সরকার তোমার স্বামীর সম্পর্কে আমার কাছে অজস্র নিন্দা করত, তাকে রোগ বলত, বলত বিয়ের পর থেকে কোনোদিন তুমি শান্তি পাওনি বলে তার ধারণা।-কেন বলত জানো? বিকজ হার হ্যাঁজব্যাণ্ড হ্যাঁজ স্টার্টেড লাইকিং ইউ, ইয়েস সী ক্যান স্মেল দ্যাট!–তাই সে এখন আমাকে দিয়ে তোমাকে ভালোমত আড়াল করার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। আজ বিকেলেও আমাকে বার বার বলেছে, না এগোলে হবে কি করে, এতবড় সুযোগ পেয়েও এগোচ্ছ না কেন?

অদ্ভুত একটা হাসি দেখা গেল কাপুরের মুখে। সব ঝেড়ে ফেলেই যেন বলল, যাক, লেট এভরিওয়ান অফ আস একসেপটিং ইউ গো টু হেল! ক্যান ইউ ফরগিভ মি?

রাখি চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে। জবাব দিতে পারেনি।

পরদিন সন্ধ্যাতেই বাড়ি ফিরল রাখি। একটা দিনও আর দেরি করতে পারেনি। তার কেবলই মনে হচ্ছিল, কী একটা ব্যাপারে যেন বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে। থেকে থেকে একটা দুর্যোগের ছায়া পড়ছে।

তাই ছুটে আসার তাড়া।

মেয়ে দৌড়ে এলো কাছে।-মা তুমি এসে গেছ! আমার কী খারাপ যে লাগছিল, ভাবছিলাম তোমার সঙ্গে যাবার আগে বুঝি দেখাই হল না!

বিষম চমকে উঠল রাখি। সত্রাসে তাকালো মেয়ের দিকে।–কোথায় যাবি?

-বারে, কাল যে আমরা জয়পুর চলে যাচ্ছি! বাবু বলেছে, কাল এই সময় ট্রেন।

রাখি বাকশক্তিরহিত। কোনরকমে দুপা এগিয়ে পাশের ঘরের পরদা সরালো। ঘরে কেউ নেই।

মেয়ে বলল, বাবা আরো কী সব কিনতে গেছে।

…নিজের ঘরের শয্যায় এসে বসল পাখি। নিস্পন্দ, কাঠ। রাখি পাশে দাঁড়িয়ে সাগ্রহে কী যেন বলছে..বলছে বাবাকে আর সেই সঙ্গে ওকেও কলেজে নিয়ে গিয়ে কত খাতির করেছে, বাবাকে মোটা মোটা মালা পরিয়েছে, কত ভাল ভাল কথা বলেছে, তারপর কত কী খাইয়েছে তাদের!

নিষ্প্রাণ মূর্তির মত রাখি বসেই আছে।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ।…ওদিকের দরজা দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। কিন্তু রাখির নড়ার শক্তি নেই। মেয়ের গলা কানে আসছে। মায়ের ফেরার খবর দিচ্ছে বাবাকে।

খানিক বাদে সুবীরকান্ত এ-ঘরে এলো। শরীর এখনো ভালো করে সারেনি বোধহয়। শুকনো মুখ। নির্লিপ্ত মুখে সামনের বিবর্ণ মূর্তির দিকে চেয়ে রইল একটু। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলল, ভাবনার কিছু নেই, তোমার অনেক ক্ষমতা, দুদিনেই ঠিক হয়ে যাবে। কাল যাচ্ছি আমরা, তুমি আজই আসবে ধরে নিয়েছিলাম, না এলে প্রতুলের কাছে চাবিটাবিগুলো রেখে যেতে হত…যাক, এই তোমার চাবি-পত্র–আর সব যেমন ছিল তেমনি আছে।

প্রাণপণ শক্তিতে নিজেকে সংবরণ করতে চেষ্টা করছে রাখি। অস্ফুট স্বর নির্গত হল গলা দিয়ে–যাচ্ছ কেন?

স্থির নেত্রে সুবীরকান্ত চেয়ে রইল একটু। জবাব দিল, যাচ্ছি, তোমার জীবনে এই নীচ ছোট হীন লোকের আর দরকার নেই বলে।

দরকার আছে।

দুচোখ ধারালো-হয়ে উঠছে সুবীরকান্তর।–আছে? বড় দুর্ভাগ্য আমার। তাহলেও যাচ্ছি, আমার জীবনেও তোমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলে।

অসহিষ্ণু হাতে পর্দা ঠেলে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।

পর্দাটা দুলে দুলে স্থির হল আবার।

রাতটা কীভাবে কাটল রাখি জানে না। ঘুমোয়নি, আবার জেগেও ছিল না। মাথার মধ্যে কী সব অজস্র হিজিবিজি ব্যাপার চলেছিল। সকাল হতে আর কিছু মনে নেই।

এক রাতের মধ্যে শরীরটা যেন পঙ্গু হয়ে গেছে। সমস্ত অস্তিত্বটাই যেন অনড় হয়ে গেছে। নড়তে-চড়তে কষ্ট। সকাল থেকে বসে আছে নিষ্প্রাণ মূর্তির মতো।

সাড়ে নটা বাজতে ধড়মড় করে উঠল।

অফিসে যাবে।

না খেয়েই বেরিয়ে গেল। অফিসে এলো। নিজের ঘরে বসে রইল চুপচাপ। একটা ফাইলও ওলটালো না। মাথার মধ্যে কী যেন সব তালগোল পাকাচ্ছে সেই থেকে। বেলা দুটো না বাজতে ভিতরে ভিতরে ওঠার তাড়া। ঘন ঘন ঘড়ি দেখল। কিন্তু জোর করে পাঁচটা পর্যন্ত বসেই থাকল। বাড়ি ফিরে কী করবে? কী করতে পারে রাখি? …চোখের সামনে মেয়ের হাত ধরে চলে যাচ্ছে, তাই দেখবে চেয়ে চেয়ে?

অন্যদিন অফিসের গাড়িতে বাড়ি ফেরে। আজ ট্রামে উঠল। তাতেও বেশ কিছুটা সময় চলে গেল। জায়গায় নামল। ট্রাম-স্টপের উল্টোদিকের রাস্তা ধরে আধ মিনিট হাঁটলে বাঁ-দিকে বাড়ি। ট্রাম-স্টপ থেকে বাড়িটা দেখা যায়।

রাখি রাস্তা পার আর হল না। ট্রাম-স্টপেই দাঁড়িয়ে রইল। বাড়িটার দিকে নিস্পলক চেয়ে রইল।

বিকেলের ছায়া ঘন হয়ে আসছে।

…বাড়ির দোরে একটা ট্যাক্সি দাঁড়াল। ও-মুখ করে। ওই ফাঁকা রাস্তা ধরে স্টেশনে যেতে সুবিধা। রাখির বুকের ওপর হাতুড়ির ঘা পড়ল। চাকরটা নেমে ভেতরে চলে গেল।

একটু বাদে মাল-পত্র তুলতে লাগল। বেশি কিছু নয়। মেয়ের হাত ধরে তার বাবা ট্যাক্সির সামনে এসে দাঁড়াল।

সমস্ত শক্তি একত্র করে রাখি দেখছে। নিঃশ্বাস রুদ্ধ।

তারা উঠল। ট্যাক্সি চলে গেল। ওই চাকাগুলো বুঝি রাখির বুকের ওপর দিয়েই। চলে গেল।

সামনে রাজ্যের অন্ধকার ধেয়ে আসছে। রাখি এবার তার আগেই বাড়ি পৌঁছুতে চায়। নইলে আর পারবে না। পায়ের নিচে মাটি দুলছে। পৃথিবী ঘুরছে।

…বাড়ি। সিঁড়ি ধরে দোতলা। দোতলায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে সামনের দুটো শূন্য ঘর যেন হাঁ করে গিলতে এলো তাকে। মিনিটখানেক শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে রাখি আত্মরক্ষা করল।

তারপর পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকল।

মাথার মধ্যে আবার কী সব হিজিবিজি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। রাখি তারও জট ছাড়াতে চেষ্টা করছে।…কী এমন হয়েছে? কিছু হয়নি। পৃথিবী রসাতলে যায়নি। সবই ঠিক আছে। জয়পুর আর কতদূর?…দার্জিলিংয়ে কবে যেন একটা লোক অসুখে পড়ে আনন্দ ছলছল চোখে বলেছিল–এত দিন তার কেউ ছিল না, এখন সব আছে। … আর ও নিজের হাতে খাবার তৈরি করলে সেই লোকটা ছোট ছেলের মত খুশি হত। অনেকদিন কিছু করা হয়নি। কিন্তু তাতে কী, দিন কী ফুরিয়ে গেল নাকি…জয়পুর কত আর দূর?

..কাপুর জিজ্ঞেস করেছিল, হাজব্যাণ্ড ওকে ভালবাসে কিনা, আর জিজ্ঞেস করেছিল, ও হাজব্যাণ্ডকে ভালবাসে কিনা। যেন এরকম সম্ভাবনার মতো ছেলেমানুষি। সম্পর্ক এটা। ঠোঁট দুটো বিষম জ্বালা করে উঠল হঠাৎ, সুরাযুক্ত দুটো অধরের স্পর্শ। তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে বেশ করে মুখটা ধুয়ে এলো।…সোমাটা হতচ্ছাড়ি একটা, দিল একটা ভালমানুষকে ক্ষেপিয়ে! কী না, ওর বর রাখিকে পছন্দ করতে শুরু করেছে! করলেই হল, অত সস্তা আর কী! জয়পুর যেন ভয়ানক দূর!

আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বিছানায় বসল।–কী যেন ভাবছিল। কী যেন ভাবা দরকার। কিন্তু আজ আর কিছু পারছে না। ভয়ানক ক্লান্ত। ঘুম পাচ্ছে। কাল ভাববে। পরশু ভাববে। ইচ্ছেমতো যে-কোন দিন ভাববে। আজ ঘুম পাচ্ছে–মোটা কথা, জয়পুর এমন কিছু দূর নয়!

ক্লান্ত অবসন্ন দেহটা রাখি শয্যায় এলিয়ে দিয়ে নির্জীবের মত চোখ বুজল। আজ আর কিছু ভাবতে পারছেই না। কাল ভাববে। পরশু ভাববে। ইচ্ছেমতো যে কোনদিন ভাববে। আজ রাখি ঘুমুবে।


© 2024 পুরনো বই