পরিতাপ

আমার ধারণা, বিচারে লোকটার ফাসী হবে, নয়ত দ্বীপান্তর হবে।

দুটোর একটা যাতে হয় পুলিস সে চেষ্টায় সুতৎপর। এই তৎপরতার দরুনই মঙ্গলের সঙ্গে দেড় বছর বাদে আমার আবার যোগাযোগ।

পুলিসের তদন্তসাপেক্ষে ওকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত অফিসারটির সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের আলাপ। কাগজের অফিসের চাকরির দরুন হোক বা ভদ্রলোক নাট্যরসিক এবং আমি লেখক বলে হোক, আলাপটা মোটামুটি অন্তরঙ্গমুখী। এঁর কাছে গেলে অনেক সময় লেখার মত অনেক বিচিত্র রসদ মেলে। তাঁর দখলের আবাসটিও আমার বাড়ি থেকে দূরে নয়।

সেদিন সকালে ভদ্রলোক আমার বাড়িতে হাজির। অবকাশ পেলে সাধারণত আমিই তার ওখানে গিয়ে থাকি। এসেই সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ মশাই, মঙ্গল দাস নামে একটা লোককে আপনি চিনতেন?

চট করে ওই নাম বা নামের কোন মুখ স্মরণে এলো না। ভেবে বললাম, মনে। পড়ছে না তো!

সে তো আপনার নাম খুব ফলাও করে বলল, আপনি নাকি তার অনেক উপকার করেছেন…তার বদলে সে আপনার কিছু উপকার করেছে–আপনার দামী ঘড়ি, দামী পেন, জামার সোনার বোতাম আর পকেটের কিছু টাকা নিয়ে সরে পড়েছিল।

মঙলা! সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল প্রতি মাসের গোড়ায় পদ্মমণিকে টাকা পাঠাত যখন, প্রেরকের নাম মঙ্গল দাসই লেখা হত বটে। মণি-অর্ডার আমিই লিখে দিতাম। কিন্তু ওই নামে বোর্ডিংয়ের কেউ তাকে চিনত না। সকলেই হাঁক দিত মঙলা বলে। নতুন বোর্ডার এসে নাম জিজ্ঞাসা করলে ও নিজেও এই নামই বলত। আর দুদিন না যেতেই নতুন বোর্ডার টের পেত, মঙলা সেখানকার একটি বিশেষ চরিত্র–আর পাঁচটা চাকর-বাকরের মত হেলাফেলা বা অবজ্ঞার পাত্র নয়।

আমাদের বোর্ডিংয়ে বেকার বা আধা-বেকারের বাস ছিল না। সবাই মোটামুটি ভালো উপার্জনশীল। একবার এক আত্মাভিমানী প্রায়-নতুন বোর্ডারের মুখের ওপর ও কী একটা জবাব দিয়ে বসেছিল, ফলে ঠাস করে গালের ওপর এক চড়। জবাবে স্তব্ধ চোখে মঙলা তার দিকে চেয়ে ছিল শুধু। এই ঔদ্ধত্যের জন্যেও নবীন ভদ্রলোক। দ্বিতীয় দফা তেড়ে এসেছিল। তার আগেই অন্য বোর্ডাররা হাঁ-হাঁ করে ছুটে এসে তাকে ধরে ফেলেছিল। তেমনি নিষ্পলক তার দিকে চেয়ে থেকে মঙলা শুধু বলেছিল, এখন থেকে নিজের জন্য আপনি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন।

এই কথা শুনে আর অন্য বোর্ডারদের বিচলিত হাবভাব দেখে চাকরি-গর্বা আধা নতুন বোর্ডারটি মনে মনে ঘাবড়েছে। পরে সতীর্থদের মুখে মঙলা-সমাচার শুনে মুখ আমসি। সকলের এক কথা, করলেন কী মশায়, এখন সামলাবেন কী করে! ওর দলের কানে তো পৌঁছুল বলে!

ওর দল বলতে এই এলাকায় ওদের শ্রেণীর ছন্নছাড়াদের গোষ্ঠী। ওদের মধ্যে অনেকে বাড়ি আর হোটেলে বোর্ডিংয়ে চাকরি করে, অনেকে আবার কিছুই করে না, উপার্জনের আশায় নানা রকমের বাঁকা রাস্তায় ঘোরাফেরা করে। এ-রকম একটা দলের। ও মাতব্বর হয়ে বসল কী করে সঠিক খবর রাখি না। রোজ দুপুরে সামনের পার্কের একটা চাতালে ওদের জুয়ার আড্ডা বসে। আমার ধারণা, এই থেকেই মঙলা ওদের পাণ্ডা। গোড়ায় ওকে দুই-একবার সাবধান করেছি, তোমাকে পুলিশে ধরল বলে!

ও তাচ্ছিল্যভরে জবাব দিয়েছে, পুলিশ নিজের ক্ষেতি করবে কেন, তার ট্যাকেও দুপয়সা আসছে।

তবে ওই মঙলাই আমাকে আশ্বস্ত করেছিল, এখন আর সে জুয়া-টুয়া খেলে। না, আড্ডায় গিয়ে বসে এইমাত্র, নইলে ছোঁড়াগুলো নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি খাওয়া খাওয়ি করে। একদিন সে ওদের থেকেও অনেক বড় বদমাস ছিল, এখন ভালো হতে চায় বলেই চাকরি করছে আর জুয়াখেলাও বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছে।

ওর এই সুমতির কিছু কিছু কারণ আমার জানা আছে। সেটা পরের প্রসঙ্গ। যাক, ওর সমাচার শোনার পরেও সেই আত্মাভিমানী নব্য বোর্ডারটি ভয় গোপন করে। ঝাঁঝিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছিল, এ-রকম একটা রাফিয়ানকে বোর্ডিংয়ে রাখা হয়েছে। কেন–পত্রপাঠ তাড়িয়ে দেওয়া উচিত আর পুলিসেও একটা খবর দিয়ে রাখা উচিত।

একজন বলে উঠেছিল, উচিত কাজ নিয়ে মাথা ঘামানোর আগে নিজের মাথাখানা। বাঁচাবার কথা ভাবুন মশাই! বলা নেই কওয়া নেই, আপনি গায়ে হাত তুলতেই বা গেলেন কেন? এখনো সেই রামরাজত্বে আছেন ভাবেন?

সন্ধ্যেনাগাদ সতীর্থরাই তাকে আমার কাছে আসার পরামর্শ দিয়ে পাঠিয়েছে বোঝা। গেল। তাদের ধারণা, এরপর আমিই বলে-কয়ে মঙলার মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারি, অন্যথায় বিপদ অনিবার্য। ভয়ে ত্রাসে ভদ্রলোক মুষড়ে পড়েছে। অগত্যা মঙ্গলাকে ঘরে ডেকে বললাম, বাবু একটা অন্যায় কাজই করে ফেলেছেন, তুমি কিছু মনে রেখো না।

ড্যাবড্যাব করে খানিক মুখের দিকে চেয়ে থেকে ও জিজ্ঞেস করল, আপনি ওনার মঙ্গল চান?

না চাইলে তোমাকে ডাকলাম কেন?

চাহিবেন বৈকি বাবু, আপনিও ভদ্র লোক, আর একজন ভদ্রলোক একটা ছোটলোকের গায়ে হাত তুলেছে এ আর এমন কী কথা!

ফাঁকে পেলে ও আমাকে অনেক রকমের নীতিকথা শোনায়! কিন্তু এ কথার ধার অন্যরকম। মুখে বিরক্তির ভাব এনে বললাম, তাহলে কী করতে হবে এখন?

আড়চোখে একবার ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে ও জবাব দিল, ওঁর ভালো চাইলে কাল সকালের মধ্যে ওঁকে এখেন থেকে চলে যেতে বলুন।

রাগ হচ্ছিল বটে, কিন্তু মঙলাকে যে চেনে সে নির্বোধের মতো রাগ করবে না। পাংশুমূর্তি ভদ্রলোকের দিকে ফিরে আমি বললাম, ঠিক আছে, কাল সকালে আমি আপনি দুজনেই চলে যাব এখান থেকে!

এবারে মঙলা থমকালো একটু। থমথমে মুখে একবার আমার দিকে আর একবার ভদ্রলোকের দিকে তাকালো। তারপর হনহন করে দরজার ওধারে চলে গিয়েও অসহিষ্ণু ক্ষোভে ফিরে এলো আবার। শরণাপন্ন বোর্ডারটির দিকে চেয়ে গরগর করে উঠল, দিনকাল খারাপ, হাত নিশপিশ করলেও হাত দুটোকে বশে রাখতে শেখেন! আমার দিকে ফিরে অভিমানহত ঝঝে বলে গেল, গরিবের আপনজন কেউ নেই, সবাইকেই জানা আছে আমার-কাউকেই যেতে হবে না এখান থেকে।

এই মঙলা!

.

বিস্ময় চেপে পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, চুরির চার্জ নাকি?

মাথা নেড়ে পুলিশ অফিসার জবাব দিলেন, একেবারে প্রাণ চুরি-মার্ডার চার্জ!

চমকে উঠলাম। নিজের অগোচরে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, কী সর্বনাশ, গৌরী দাসীকে?

ভদ্রলোক নড়ে-চড়ে সোজা হয়ে বসলেন।–আপনি জানলেন কী করে?

আমি বিমূঢ়। কী ফ্যাসাদ ঘটালাম কে জানে।

পুলিশ অফিসারটির দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মুহূর্তের জন্য। তারপর মুখে হাসি ঝরল। বললেন, যা জানেন, বন্ধু হিসেবে খোলাখুলি বলুন–তাতে বরং লোকটার কিছু উপকার হতে পারে… এভিডেন্স যা, তাতে ওর অব্যাহতির আশা কম। অথচ লোকটার। হাবভাব কেমন পিকিউলিয়ার…নট লাইক এ সীজৰ্ড ক্রিমিন্যাল। কিন্তু মার্ডার শুনেই আপনার গৌরী দাসীর নাম মনে এলো কেন?

সত্যি জবাবই দিলাম–বোর্ডিং-এ থাকতে ও শাসাতে ওই একটা মেয়েছেলেকে ঠিক একদিন খুন করে বসবে! বলত, ভগবান যেন তার হাত থেকে ওকে রক্ষা করেন!

পুলিশ অফিসার বললেন, রক্ষা করেনি, ওই-গৌরী দাসীই তার নিজের বস্তিঘরে খুন হয়েছে। ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ালেন। জরুরী কাজ পড়েছে, যেতে হবে…বিকেলের দিকে আমার অফিসে আসুন একবার, এ নিয়ে একটু আলাপ-আলোচনা করা যাবে। বোর্ডিংয়ের চাকরির আমলে কে ভালো চিনত জিজ্ঞেস করতে মঙ্গল দাস প্রথমেই আপনার নাম করল, আর আপনার কী কী চুরি করেছিল তাও কবুল করল। আপনি নাকি ইচ্ছে করলেই তাকে ধরাতে পারতেন, কিন্তু ধরান নি। ভয়ানক শ্রদ্ধা আপনার ওপর। আপনার সঙ্গে আমার খাতির আছে শুনেই একবার দেখা করিয়ে দেবার জন্য দুহাত জুড়ে আকৃতি। নিয়ম নেই, বাট আই মে ট্রাই, আসুন তো একবার বিকেলে

চোখের সামনে একদিনের ছবি ভেসে উঠল। বোর্ডিংয়ের বাজার সেদিন আমার হাতে। বাজার করে ফিরছিলাম–মঙলার দুহাতে দুটো বড় বোঝা, পিছনে মুটে! মঙলা হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল।

অদূরে একটা ভিখিরি গোছের লোক তার সাত-আট বছরের একটা ছেলেকে বেদম মারছে। মার খেয়ে ছেলেটা ফুটপাতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, কিন্তু তবু বাপের রাগ কমছে না।

মঙলা হঠাৎ হনহন করে এগিয়ে গেল। তারপর হাতের বোঝা মাটিতে রেখে হাড়-জিরজিরে লোকটার ঝাকড়া চুলের মুঠি ধরে ঠাস ঠাস করে দুই গালে দুটো পেল্লায় চড়। কাছাকাছি যারা ছিল সকলে হতভম্ব, এমন কি যে লোকটা মার খেল সেও। দাঁতে দাঁত ঘষে মঙলা বলে উঠল, এ-সব ছেলে জন্মায় কেন,জন্মায় কেন পাজী শূওর কোথাকার!

লোকটার হাতে চারআনা পয়সা গুঁজে দিয়ে আমি মঙলাকে একরকম ঠেলে নিয়ে বোর্ডিংয়ে ফিরি।

বোর্ডিংয়ের মাসিক ফিস্টএর দিন সেটা। অতএব আনন্দের দিন। কিন্তু রাত পর্যন্ত মঙলার থমথমে মুখ। একসময় ওকে ঘরে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম, সকালে ওভাবে লোকটাকে কেন মারল?

ও গুম হয়ে বসে রইল খানিক। তারপর হঠাৎ কপালে হাত দিয়ে বলল, এটা দেখেছেন?

কপালে মস্ত একটা পুরানো ক্ষতচিহ্ন। মুখের দিকে তাকালে ওটাই আগে চোখে পড়ে। বলে গেল, এই দশা ওর মা করেছে, তখন ওর বয়েস আট কি নয়। ফুটপাতে থাকত। ওর পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা যায়। তার পরের কবছরের মধ্যে আরো দুটো ভাই-বোন এসেছিল। তাদের বাবা কে মঙলা জানে না। মা ওকে যখন-তখন। ধরে বেদম ঠেঙাত। একদিন ও রাগ করে খাবার ফেলে দিয়েছিল বলে চুলের মুঠি ধরে মা ওকে মাটিতে ফেলে থেতলাতে লাগল। কপাল ফেটে চৌচির-রক্তে ভেসে গেল। মা ওকে সেদিন মেরেই ফেলত বোধহয়, অন্য লোকের জন্য পারেনি। মায়ের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ও ছুটে পালিয়েছিল। কপালের ক্ষতের মধ্যে অনেক ময়লা ঢুকে যেতে শরীর বিষিয়ে গেছল। কদিন অজ্ঞান হয়ে ছিল জানে না, জ্ঞান হতে দেখে একটা হাসপাতালে পড়ে আছে। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে আর ও মায়ের খোঁজ করেনি।

আজ ভিখারিটা তার ছেলেকে ওভাবে মারছিল যখন, ওর মনে হচ্ছিল সেই মার যেন ওর গায়ে পড়ছে।

এর পর দিনে দিনে মঙলার জীবনের আরো অনেক খবর আমি জেনেছিলাম। …দশ বছর বয়সে ও একজনের কাছে আশ্রয় পেয়েছিল। পেয়েছিল কারণ ও একটু একটু গান গাইতে পারত। ভিক্ষে পেতে সুবিধে হয় বলে মায়ের কাছে মার খেতে খেতে গান শিখতে হত। আশ্রয় যে দিয়েছিল তার নাম চিন্তমণি। তার কাছে ছ। বছরের একটা মেয়ে ছিল–নাম গৌরী। মোটাসোটা মেয়েটা দেখতে একেবারে মন্দ নয়। কার মেয়ে কোথাকার মেয়ে কেউ জানে না। মঙলা এসে জোটার পর চিন্তামণি ওদের হর-গৌরী সাজিয়ে পয়সা রোজগারের রাস্তা ধরল। রোজ রং মেখে সং সেজে ওদের পথে রেরুতে হত–হর-গৌরীর নাচ নাচতে হত, গাইতে হত সেই সঙ্গে, চিন্তামণি ভাঙা হারমোনিয়াম বাজাতো। রাস্তায় ছেলেমেয়েদের ভিড় জমে যেত, বাড়ির একতলর দোতলায় দাঁড়িয়ে মেয়েরা মজা দেখত, নাচগান শেষ হলে পয়সা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিত।

এক-একদিন চিন্তামণির বেশ ভালো রোজগার হত। পরিশ্রম খুব হত, পায়ের। সুতো ছেঁড়ার দাখিল হত। কাহিল হয়ে পড়লে চিন্তামণি কষে ঠ্যাঙানি লাগত। তবু এই নেচেগেয়ে বেড়ানোটা ভারী পছন্দের জিনিস ছিল মঙলার। দশ থেকে আঠেরো এই আট বছর এমনি কেটেছে। তার পরেই গণ্ডগোলের সুত্রপাত। গৌরীর তখন চোদ্দ বছর বয়েস, কিন্তু দেখাতো সতের-আঠেরোর মতো। তার আশেপাশে বাজে লোক জুটতে লাগল। মঙলাও তখন কুসঙ্গে মেশা শুরু করেছে, তাই সবই সে বুঝতে পারে। আরো একটা বছর টেনেটুনে কাটানো গেল। তারপর আর গেল না–গেল না মঙর জন্যেই। পনের বছরের গৌরীর নাচ সকলে হাঁ করে গেলে, চোখে-মুখে। কুৎসিত ইঙ্গিত করে। অথচ তার মত ধাড়ী ছেলের নাচ যেন সকলের চক্ষুশূল, হেসে হেসে টিটকিরি দেয়। হর-গৌরী পালার মধ্যে দুজনে কাছাকাছি হলে সকলে হৈ-হৈ করে ওঠে।

ঘরে ফিরে মঙলা রাগ করে, আর গৌরী হি-হি করে হাসে। কখনো ফিরে আঁঝ। দেখিয়ে বলে, লোক অমন করবে না তো কি–গায়ে হাত দেবার সময় তুই আজকাল সাপটে ধ্বতে চাস আমাকে! কার চোখে ধুলো দিবি?

বেগতিক দেখলেই মঙলা ওকে ধরে মার লাগাতো। আর মার খেলেই গৌরী ফুঁসে উঠত। ফলে আরো বেশি মার খেত। মেয়ে সেয়ানা হয়ে উঠেছে। বেশ। ফাঁক পেলে বাজে ছেলের সঙ্গে ফিসফিস গুজগুজ করে। ওদিকে নাচ প্রায় হু, খাওয়া জোটে না। মঙলা এখানে-সেখানে বা কারখানায় কাজের। ধান্ধায় বেড়ায়।

একদিন ঘরে ফিরে দেখে ঘর খালি। গৌরীও নেই, চিন্তামণিও নেই। এরপর ছবছর কেটেছে। এই ছবছর ধরেই মঙলা ওদের খুঁজেছে। ও তখন পঁচিশ বছরের জোয়ান। ওদের পেলে দুজনকেই খুন করত। না পাওয়ার আক্রোশে আরো বেশি। উচ্ছজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বয়েসকালের মেয়ে দেখলেই ওর শিরায় শিরায় আগুন জ্বলত। কারখানায় চাকরি করত–মদ খেত, জুয়া খেলত আর দুরন্ত আক্রোশে ব্যাভিচারের পাতাল চষে বেড়াতো।

কারখানায় কাজ করার সময় হারানের বউ পদ্মর সঙ্গে যোগাযোগ। হারান কলে কাটা পড়ে মরেছে। তার বউটা রোজগারের আশায় আসে। বেশ সুশ্রী মেয়ে। অনেকেরই চোখ গেছে তার দিকে। কিন্তু মঙলার চোখও আটকেছে যখন, কারো ঘাড়ে দুটো মাথা নেই যে পদ্মর দিকে এগোবে।

কিছুদিনের ঘনিষ্ঠতার পর পদ্ম ওর জুলুমে পড়ে সেই রাতে ওকে ওর ঘরে আসতে বলল। অল্পস্বল্প নেশা করে মঙলা ওর ঘরে গেল। বেশি নেশা করলে আনন্দ মাটি। মাথায় আর এক ক্ষুধার আগুন জ্বলছে বলে সময়ের একটু আগেই গিয়ে পৌঁছুল।

ঘরে পা দিয়েই হতভম্ব সে। পদ্ম ভূঁয়ে লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে। সে কি কান্না! তার বুকের কাছে হারানের একটা পুরনো ফোটো। অদূরে একটা কচি ছেলে আর একটা কচি মেয়ে বসে বোবা-বিস্ময়ে মায়ের বুকফাটা কান্না দেখছে।

মুহূর্তের মধ্যে মঙলা কেমন যেন হয়ে গেল। পদ্মকে জেরা করে শুনল, হারান একদিন তাকে পথের থেকে ঘরে এনে তুলেছিল। মঙলা পাথর! মনে পড়ল, মায়ের সঙ্গে রাস্তায় রাত কাটতো যখন, তারও বোন ছিল একটা। এ সে-ই কিনা কে জানে! ঠিক সে না হোক, সেই রকমই একজন।

সেই থেকে মঙলা অন্য মানুষ। একে একে অনেক ছেড়েছে তারপর থেকে। কারখানার চাকরিও ছেড়েছে। না ছাড়লে পাতাল তাকে টানত। সেই বোর্ডিংয়ে চাকরি নিয়েছিল। পদ্মকে আর ছেলেমেয়ে দুটোকে হারানের দেশের ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। মাসের শেষে আমাকে দিয়ে যে মণি-অর্ডার ফর্ম লিখিয়ে টাকা পাঠাতো, সে ওই পদ্মর কাছে।

ওর দুর্ভাগ্য, তাই ওই সময় গৌরীর সঙ্গে আবার দেখা। পথে দেখা প্রথমে হঠাৎ একদিন চিন্তামণির সঙ্গে। ওই বয়সেই চিন্তামণি বুড়িয়ে গেছে। হাঁপ-রোগে ভুগছে। মাথার চুল সাদা। মঙলাকে সে-ই তার বস্তিঘরে টেনে নিয়ে গেছে।

হা, মঙলা যা ভাবতে পারেনি তাই হয়েছে। মঙলা ভেবেছিল পুঁজি হাতছাড়া হবার ভয়ে চিন্তামণি গৌরীকে সরিয়েছিল। গৌরী ওর পুঁজি। কিন্তু তা নয়, গৌরীকে ও-ই জোর করে বিয়ে করেছে। গৌরীর থেকে চিন্তামণির বয়েস কম কারে এক-কুড়ি বেশি। কিন্তু ষোল বছরের মেয়েটাকে ও নিজেই খেয়েছে। তারপর সাত বছর কাটতে এই হাল।

গৌরীর দিকে প্রথম প্রথম মঙলা চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। যৌবনেরই আগুন যেন ওর সঙ্গে বাসা বেঁধেছে। নড়লে-চড়লে ঝলসে ওঠে। হাসলে পরে উছলে পড়ে।

ঘরে একটা তিন বছরের রোগাটে ছেলে। গৌরীর ছেলে। বোবা-মূর্তি মঙলা। তাকেই একটু আদর করছিল, চিন্তামণি তখন বাইরে চা বানাচ্ছিল–সেই ফাঁকে গৌরী বেশ কাছে এসে কোমরে দুহাত দিয়ে ছদ্ম ভ্রুকুটি করে সকৌতুকে তাকে দেখছিল। ছেলেকে আদর করতে দেখে হেসে গুনগুন করে গেয়ে উঠেছিল, হায় গো হায়, রাই না পাই, দুধের সাধ ঘোলে মেটাই।

সেই থেকে মঙলার মাথায় আবার আগুন জ্বলতে শুরু করেছিল। প্রায়ই ইচ্ছে হত চিন্তামণিকে খতম করে দিয়ে সবদিক পরিষ্কার করে ফেলে।

কিন্তু দেখা হলেই হেঁপো রোগী চিন্তামণি ওর কাছে দুঃখ করত। বলত, গৌরী তাকে দেখতে পারে না, এমন কি ওর ওপর রাগে রোগা ছেলেটাকে পর্যন্ত দেখতে পারে না। চিন্তামণির ধারণা, একটা পালাগানের দল ওকে না করে দিতে পারলে আর বেশিদিন ওকে ধরে রাখা যাবে না। ছেলেবেলার সেই ঝোঁক গৌরীর এখনও কাটেনি। এক বাড়িতে গৌরী এখন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনটে ছেলেমেয়ে রাখার কাজ করে। সেই বাবুটির বউ নেই। বাবুর মতলব ভাল নয় বুঝেও গৌরী তাকে আসকারা দেয়। কিছু বললে উল্টে শাসায়, শিগগীরই পালাগানের দল না করে দিলে ও যার সঙ্গে খুশি তার সঙ্গে চলে যাবে।

কিন্তু পালাগানের দল খোলার মত টাকা চিন্তামণি পাবে কোথায়?

রঙ্গ করে গৌরী একদিন চিন্তামণির সামনেই মঙলাকে বলেছিল, তুমি যোগাড় করে দাও না টাকা, তুমি তো আমার প্রথম পক্ষের শিবঠাকুর গো, ভাগে-সাগে না হয় দুজনেরই ঘর করা যাবে। এমন কী দোষের, দ্রৌপদী তো পাঁচজনের ঘর করত। বলেই খিলখিল হাসি। এত হেসেছিল বলেই কথাটায় তেমন দোষ ধরেনি চিন্তামণি। কিন্তু মঙলার মাথার আর বুকের জ্বলুনি বেড়েই গেছল।

.

একদিন সকাল থেকে মঙলার দেখা নেই। বোর্ডিংয়ে ফিরল সন্ধ্যার পর। উসকো খুসকো মূর্তি। দেখলেই বোঝা যায় বিশেষ কিছু ঘটেছে। রাত্রিতে ওকে ঘরে ডেকে এনে ব্যাপার শুনলাম। গৌরী তার বাবুর বাক্স থেকে তিনশ টাকা চুরি করে চিন্তামণির হাতে দিয়েছে। প্ল্যান ছিল ভোররাতে ওরা পালাবে, তারপর দূরে কোথাও গিয়ে ওই টাকা দিয়ে পালাগানের দল গড়বে। কিন্তু মঙলার মতে চিন্তামণি বুদ্ধিমান লোক, সে জানে পালাগানের দল হোক বা না হোক, গৌরী একদিন তাকে ছেড়ে চলে যাবেই। তাই কড়কড়ে তিনশ টাকা হাতে পেয়ে মাঝরাতে উঠে সে একাই পালিয়েছে। ওদিকে বাবু পুলিশে খবর দিতে তারা এসে গৌরীকে টানাহেঁচড়া করছে। গৌরী অবশ্য স্বীকার করেনি, কিন্তু স্বীকার না করে যাবে কোথায়? বাবুর বাড়ি গিয়ে তার হাতেপায়ে ধরেছিল, বাবু শেষ পর্যন্ত বলেছে টাকা পেলে ফয়সলা করে নেবে।

তারপর?

তারপর মঙলা গৌরীর ঘরে গেছে। এলোপাথারি কিল-চড় মেরেছে তাকে। মেরে এখানে চলে এসেছে। বলল, ও আমার হাতে একদিন ঠিক খুন হবে। একথা আগেও বলেছে।

পরদিন আমার ঘড়ি, পেন আর সোনার বোতাম চুরি এবং মঙলা নিখাঁজ।

পুলিশ অফিসারকে মঙলা ঠিকই বলেছে, একটু তৎপর হয়ে গৌরী দাসীর বস্তি ঘরের আশেপাশে পুলিশ মোতায়েন করলেই আমি ওকে ধরতে পারতুম।

.

বিকেলে পুলিশ অফিসারের ঘরে গেলাম। তিনি বললেন, আপনার মঙ্গল দাস লোকটার মশাই মেজাজ এখনও তিরিক্ষি। কবুল করবার ফিকিরে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা হচ্ছে কিনা। ও তার জবাবে খানিক চুপ করে থেকে আমাকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, মানুষ মরলে ফিরে আবার জন্মায় কিনা। বুঝুন ঠেলা–অর্থাৎ আবার জন্মালে আবার ও গৌরী দাসীকে খুন করবে!

একটু বাদে মঙলাকে আমার সামনে এনে হাজির করা হল। তার হাতে শেকল, পায়ে বেড়ি, কোমরে দড়ি। আমি আঁতকে উঠলাম-প্রেত-মূর্তি যেন!

অফিসার আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী, চিনতে পারো?

জবাবে যতটা সম্ভব ঝুঁকে শেকল-বাঁধা-হাত কপালে ঠেকিয়ে আমাকে প্রণাম করল! আমাকে অবাক করে দিয়ে পুলিশ অফিসার উঠে দাঁড়িয়ে ওকে বললেন, বাবুর সঙ্গে কথা বল, আমি একটু কাজ সেরে আসি–কিছু ভয় নেই।

ঘর ফাঁকা। বাইরে অবশ্য প্রহরী মোতায়েন বলে ধারণা আমার। তাছাড়া এ রকম অবস্থায় ওই একটা সামনের দরজা দিয়ে কারো পালাবার প্রশ্ন ওঠে না। তবু কেমন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।

বাবু ভালো আছেন?

আমি সচকিত।-হ্যাঁ।…কিন্তু এ কী হলো!

জবাবে ও ওপরের দিকে ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল একবার। তারপর বিড়বিড় করে বলল, সবই অদেষ্ট। একটু বাদেই ওর গর্তের চোখ দুটোতে আগ্রহের ছোঁয়া লাগল। –আচ্ছা বাবু, মানুষ মরলে আবার জন্মায়?

পুলিশ অফিসার এ প্রশ্নের যাই তাৎপর্য বুঝুন, আমি বুঝতে পারলাম না। জানি না …কেন বল তো?

জবাব দিল না। চুপ করে খানিক ভাবল কি। তারপর অনুনয়ের সুরে বলল, বাবু, আপনার কাছেও আমি অপরাধ করেছি, তবু দয়া করে আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন। আর একটুখানি দয়া চাইব বাবু…?

আমি জিজ্ঞাসু।

মঙলা বলল, গৌরীর রোগা ছেলেটাকে ওরা অনাথ আশ্রমে রেখেছে। শুনলাম…আমার কিছু টাকা আছে, হক্কের টাকা, সেটা যাতে ওই ছেলেটার ভালোর জন্যে খরচ হয় আপনি সে ব্যবস্থা করে দেবেন–দেবেন?

বললাম, আচ্ছা সে হবেখন, আগে তো কেটেস হোক।

এরপর দুচার কথায় ব্যাপারটা শোনা গেল।…চুরির দায় থেকে খালাস পেয়ে গৌরী যেন কেনা দাসী হয়ে গেল মঙলার। নিজেকে ওর কাছে বিলিয়ে দিয়ে ওর নেশা ধরিয়ে দিল। মঙলা দূরের এক কলে কাজ নিয়েছিল, প্রতিজ্ঞা করেছিল, আমি ওকে পুলিশে ধরিয়ে দিলাম না বলেই ও রোজগার করে চুরির দেনা শোধ করবে। হপ্তার ছুটির দিনে গৌরীর বস্তিতে আসত, একদিন থেকে আবার চলে যেত।

কিন্তু গৌরী আসলে ওকে ভালবাসত না, ভয় করত। ভিতরে ভিতরে যে অন্য লোক জুটিয়েছে সেটা বোঝা গেল বছর না ঘুরতে। দুই-একবার ধরা পড়ে ওর হাতে বেদম মার খেল গৌরী। মার খেয়ে কিছুদিন ঠাণ্ডা হয়ে থাকে, তারপর আবার বেচাল শুরু হয়। একবার খাওয়ার দোষে ওর রোগা ছেলেটা মরমর, ভাবনা-চিন্তায় মঙলা রাতে ফ্যাক্টরী থেকে পালিয়ে বস্তিতে এসে দেখে সেই বিপদের দিনেও রাতের আঁধারে বেড়ার গায়ে দাঁড়িয়ে বাবুগোছের একটা লোকের সঙ্গে গৌরী ফিসফিস করছে। ওর সাড়া পেয়েই লোকটা পালিয়ে গেল।

সেই রাতে হাড়ভাঙা মার খেয়েও মঙলা দেখেছে, গৌরীর দুচোখ বাঘিনীর মতো জ্বলছে। এর কমাসের মধ্যে মঙলা যে করেই হোক স্থির বুঝেছিল, গৌরী ওকে ছেড়ে পালাবে। বুঝেছিল, কারো সঙ্গে পালাবার ষড়যন্ত্র পাকা করে এনেছে। এই পর্যন্ত বলে। মঙলা থামল।

আমি বলে উঠলাম, ও-রকম একটা মেয়ের জন্য নিজের এতবড় বিপদ ডেকে আনলে?

আবার একটু চুপ করে থেকে মঙলা বিড়বিড় করে জবাব দিল, কোন মেয়ের জন্য নয় বাবু, গৌরীকে খুন না করলে ওর হাতে একটা শিশু খুন হত। নিজের ছেলেটাই সব থেকে বড় কাটা, ওকে একেবারে সরিয়ে দিয়ে পালাবার মতলব ভেজেছিল ওরা।…আগেরবারে খাবারের সঙ্গে বিষও গৌরীর ওই লোকই দিয়েছিল।..বুকে ছোরা বসাবার পর চোখের জলে ভেসে গৌরী সব স্বীকার করে গেছে।

.

ঘরে পুলিশ অফিসারের সামনে বোকার মতো আমি বসে। উনি বললেন, এ ঘরের আপনাদের সব কথা ওদিক থেকে শোনার ব্যবস্থা আমি আগেই করে রেখেছিলাম। ..ভেরি স্যাড ইনডিড়!

অন্যমনস্কের মতো বাড়ি ফিরছি। পর পর কতগুলো দৃশ্য আমার চোখের সামনে। ভাসছে।…একটা ভিখিরি তার ছেলেকে মারছে দেখে হাতের মোট নামিয়ে ক্ষিপ্ত আক্রোশে মঙলা তাকে মেরে বসল।…আদিম রিপুর তাড়নায় পদ্মর ঘরে গিয়ে সেই কান্না দেখে, আর তার থেকেও বেশি–সেখানে দুটো অসহায় নির্বাক শিশুমূর্তি দেখে ওই উচ্চুঙ্খল মঙলার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল।…আর তারপর, ওই মঙলা আর একটা অসহায় শিশুর আসন্ন মৃত্যুভয়ে গৌরী দাসীকে খুনই করে বসল।… কেন, পথের ছেলে মঙ্গলা কি ওদের মধ্যে নিজেকেই দেখত?

চমকে উঠলাম। কানে যেন বিড়বিড় স্বরের একটা উৎসুক প্রশ্ন আঘাত করল।–আচ্ছা বাবু, মানুষ মরলে আবার জন্মায়?

…মঙলা আজীবন তার জম্মটাকে ঘৃণা করেছে। আবার একটা জন্মের অভিশাপ ও বহন করতে চায় না।


© 2024 পুরনো বই