স্বপ্নের গাছে বাস্তবের ফল সত্যিই ধরে?
বিজন ঘোষ চৌরঙ্গী এলাকায় এসেছিল একটা ওষুধের খোঁজে। কদিন আসবে আসবে করে সময় করে উঠতে পারেনি। তার কর্মক্ষেত্র সুদূর দক্ষিণে। থাকেও সেদিকেই। কিন্তু ওষুধটা আর না কিনেলই নয়। সমস্ত দক্ষিণ কলকাতা চষে পায় নি! আপিস থেকে একটু আগে বেরিয়ে এসেছে মধ্যস্থলে।
ওষুধটা পাওয়া গেল। ফেরার বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল।
তখনি যোগাযোগ।
একটা কাগজের প্যাকেট বুকে করে ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তা পার হবার তোড়জোড় করছিল প্রমীতা গুপ্ত। পরিচিত ফ্যালফেলে চাউনির চেনা-মুখ দেখে দাঁড়িয়ে গেল। বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিড়ম্বনার চকিত কারুকার্য একটু। পলকের দ্বিধা। তারপর মিষ্টি আর ভারী অবাক মুখ করেই প্রমীতা কাছে এগিয়ে এলো।–তুমি! কী আশ্চর্য!
বিজন ঘোষের মুখে লাজুক হাসি। কাছে এসে দাঁড়ানোর পর অবাধ্য চোখ দুটো প্রমীতার মুখের ওপর থেকে নড়তে চাইছে না। পলকের দেখার মধ্যে চৌদ্দ বছরের অদেখার একটা দুস্তর সমুদ্র পাড়ি দেবার বাসনা।
–দেখছ কী এমন করে, চিনতে পারছ তো?
বিজন ঘোষের হাসি-হাসি মুখ, কিন্তু চোখের তারা দুটো বড় বেশি স্থির তার মুখের পর। মাথা নাড়ল, অর্থাৎ চিনতে অনায়াসেই পেরেছে। বলল, তুমি রাস্তা পার হতে চেষ্টা করছিলে দেখছিলাম।
-বলো কি, দেখেও ডাকোনি?..নাকি ডাকতে চাওনি?
–মনে মনে ডাকছিলাম, ভরসা করে গলার আশ্রয় নিতে পারিনি।
প্রমীতা হঠাৎ হেসে উঠল। ফর্সা মুখখানা খুশি-খুশি দেখালো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একনজর দেখল তাকে। পরনের ধুতিটা পরিষ্কার, গায়ের মূগা-রঙা পাঞ্জাবিটা আধময়লা–কিন্তু একটু মোটা হয়েছে, আর মুখখানাও আগের থেকে ঢলঢলে হয়েছে। বলল, তুমি একেবারে আগের মতই আছ দেখছি, কত বছর পরে দেখা বলো তো!
–চৌদ্দ বছর। রামচন্দ্রের বনবাসের কাল।
-এত হিসেবও রেখেছ! উৎফুল্ল মুখে প্রমীতা জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু তুমি কলকাতায় কবে থেকে? আমি তো শুনেছিলাম পাকাপাকি পশ্চিমবাসী হয়ে গেছ?
বছরখানেক হল কলকাতাবাসী হয়েছি, বিহারী আপিসের কলকাতায়। শাখা-বিস্তার হয়েছে। দড়ি।
প্রমীতা সকৌতুকে তাকালো তার দিকে।–এক বছরের মধ্যে মনে পড়ল না, আমাদের বাড়ির রাস্তাটা ভুলে গেছ বুঝি?
বিজন হাসতে লাগল। হাসিটা মিষ্টি লাগছে প্রমীতার, কিন্তু মুখের ওপর ওই চাউনিটা অস্বস্তিকর। জবাব দিল, ভুলিনি…রাবরই সাহসের অভাব তো! তাছাড়া ভেবেছিলাম তুমিও ঘর বদলেছ।…কিন্তু কী ব্যাপার, সীমন্তে দাগ দেখছি না যে?
নিমেষে মুখের রঙবদল হল যেন একট, তারপর হাসি-মাখা দুচোখ তার চোখের ওপর তুলল প্রমীতা। লোকটার কথাবার্তার ধরনও যেন আগের থেকে তাজা হয়েছে মনে হল। বলল, দাগ ফেলার মত লোক আর এলোই না, তার কী করা যাবে? মুখ আবারও রাঙালো একটু, তাড়াতাড়ি বলল, চলো কোনো ভালো জায়গায় বসে একটু চা বা কফি খাওয়া যাক, তোমার তা নেই তো কিছু?
খুশিমুখে বিজন পকেটে হাত ঢোকালে, দাঁড়াও, পকেটে রসদ কী আছে। দেখি
দেখতে হবে না, এসো।
স্মিতমুখ দুজনেরই। পাশাপাশি কোনো রেস্তরাঁর উদ্দেশে এগোলো তারা।
.
আপিসের হিসেব রাখার কাজ করে বিজন ঘোষ। জীবনের হিসেবও ভোলেনি। আর দেখা না হলেও প্রমীতা গুপ্তর খবর রাখে না এমন নয়। কোন এক বে-সরকারী কলেজে প্রোফেসারি করে এই খবর রাখে, সমন্তে এখনো দাগ পড়েনি এবং পড়ার সম্ভাবনাও বিশেষ নেই–এ-খবরও রাখে। আর চৌরঙ্গিপাড়া থেকে বিলিতি বই কিনে আর পড়ে অবসর সময় কাটায়, হাতের প্যাকেট দেখে অনুমানে সে-খবরটা আজ পেল।
…বিজনের উনচল্লিশ চলছে, প্রমতার বয়েস তাহলে এখন ছত্তিরিশ হবে। দেখায়ও তার থেকে কম নয়, ফর্সা মুখ আগের থেকে আরো ফ্যাকাশে হয়েছে।
.
আঠারো বছর বয়সে পনের বছরের মেয়ে প্রমীতার প্রেমে পড়েছিল বিজন ঘোষ। ভীরু প্রেম। বাইরের প্রকাশ আরো উক্ত। কিন্তু ভিতরে প্রেমানলের স্রোত।
তার মামাতো বোন শেফালীর সহপাঠিনী ছিল। মামারবাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করত বিজন ঘোষ। সেই সূত্রেই বাড়িতে যাতায়াত আর পরিচয়। শেফালী খানিকটা করুণার চোখে দেখত ভালোমানুষ পিসতুতো দলটিকে। প্রমীতার চোখও তার থেকে ওপরে ওঠেনি। গরীব ঘরের মেয়ে শেফালীর সতেরোয় বিয়ে হয়ে গেছে। গল্পের বই যোগান দিয়ে, সিনেমার টিকেট কেটে দিয়ে, আরো অনেক-রকম সরল কৌশলে প্রমীতার সঙ্গে যোগাযোগটা অন্তরঙ্গ করে তুলেছিল বিজন ঘোষ। অন্তরঙ্গতা শুধু তার। দিক থেকেই, প্রমীতার দিক থেকে সেটা প্রীতি-দাক্ষিণ্যের বেশি নয়।
ফেল করার মত ছাত্র ছিল না বিজন ঘোষ। কিন্তু রয়েসয়ে এক বছর পর এক বছর ফেল করে করে এম-এ ক্লাসে উঠে প্রমীতার সহপাঠী হবার সৌভাগা অর্জন করেছিল সে। আর খুশিমুখে কৌশলে এই ফেল করার উদ্দেশ্যটা প্রমীতাকে জানিয়েছিল।
বিস্ময় ছাপিয়ে প্রমীতার ভ্রকুটি বেশি ঘন হয়ে উঠেছিল। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! কেন?
এই কেনর জবাব প্রমীতা যদি নিজের থেকে বুঝে না নেয়, বিজন ঘোষ কী বলতে পারে!
সিক্সথ ইয়ারে উঠে প্রমীতার বিরক্তিটা প্রায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সর্বদা যদি একটা লোক ছায়ার মত লেগে থাকে, কাহাতক ভালো লাগে! বন্ধুরা মুখ টিপে হাসে, সীতা দেবীর ভক্ত হনুমান বলে ওকে নিয়ে আড়ালে ঠাট্টা-তামাশাও করে– প্রমীতা তাকে বলেছেও সে-কথা। কিন্তু বলার উদ্দেশ্য সফল হত বোঝারও চেষ্টা যদি থাকত।
ওই সময়েই কোথা থেকে ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল তার, বিজন। খবরটা জানতে পারার পর এই দীর্ঘ ব্যাপারটার ছেদ।
আমতা-আমতা করে শুকনো মুখে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল সে। তখনি নয়। অবশ্য, এম-এ পাশ করার পর, আর ভালো চাকরি জুটিয়ে যোগ্যতা অর্জনের পর। সে শুধু ভবিষ্যতের আশ্বাসটুকু চায়।
মুখের দিকে চেয়ে কটু কথা বলা দূরে থাক, আশ্বাসটুকু ধূলিসাৎ করতেও কষ্ট হয়েছিল প্রমীতার। আবার এরকম সম্ভাবনার কথা ভাবতেও রাগ হচ্ছিল। খানিক চুপ করে থেকে জবাব দিয়েছিল, মাকে গিয়ে বলো, এ-সব আমি কিছু জানি না।
প্রমীতা সেদিনই মাকে একটু আভাস দিয়ে রেখেছিল, ভদ্রভাবে বেশ স্পষ্ট করেই। যেন প্রস্তাবটা নাকচ করা হয়।
প্রমীতার মা ওই সাদামাটা নিষ্প্রভ ছেলের দুঃসাহসিক অভিলাষের কথা শুনে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। প্রস্তাবটা আর তার কাছে ভালো করে উত্থাপনও করতে পারেনি বিজন ঘোষ। তার আগেই বেশ স্পষ্ট অনুশাসনের সুরে আর এ-বড়ি আসতে বা প্রমীতার ছায়া মাড়াতেও নিষেধ করে দিয়েছিলেন তিনি।
কৃতী স্বামী আর চার-চারটে কৃতী ছেলের পর ওই একটিমাত্র মেয়ে তাঁর। রাগ হবারই কথা।
এর পরদিন থেকে প্রমীতা আর তাকে দেখেনি। য়ুনিভার্সিটিতেও আসে নি বিজন ঘোষ, অর্থাৎ এম-এ পড়া সেখানেই খতম হয়েছে। পরে কার কাছে শুনেছে, এ দেশ ছেড়েই চলে গেছে সে, বিহারে না কোথায় চাকরি নিয়েছে।
লোকটা দুঃখ পেয়ে গেল বলে প্রমীতার অবশ্য কষ্টই হয়েছিল, কিন্তু কী আর করতে পারে সে!
প্রমীতার জীবনেও অনেক জল ঘোলা হয়েছে এর পর। জামাই বাছতে বাছতে হঠাৎ একদিন চোখ বুজেছেন তার মা। তারপর প্রমীতা নিজেও অনেক সম্ভাব্য পাত্র বাতিল করেছে, আবার কেউ কেউ তাকেও বাতিল করেছে। এমনি এক বাতিলের ব্যাপার নিয়ে রীতিমত অপমানকর ব্যাপার ঘটে যায় একটা। বাবাকে আর তার বিয়ে নিয়ে মাথা ঘামাতে নিষেধ করে প্রমীতা কলেজে চাকরি নিয়েছে। বয়েস এখন। ছত্তিরিশ…চাকরিই করে যাচ্ছে। ক্লান্তিকর অবকাশ কাটানোর জন্যে মাঝে মাঝে এ পাড়ায় এসে বিলিতি বই কেনে।
জীবনের এই সীমান্তে এসে বিজন ঘোষের সঙ্গে দেখা।
.
একটা ক্যাবিনে মুখোমুখি বসেছে দুজনে। বয় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রমীতা জিজ্ঞাসা করল, চা না কফি?
-কফি হোক। অনেকদিন ও বস্তু জিভে ঠেকাইনি।
এই সরলতা কানে বেশ ভালো লাগল প্রমীতার। হেসে বলল, আর কি?
-আর কিছু না।
বয় কফির অর্ডার নিয়ে গেল আর দিয়ে গেল। কফি তৈরি করে পেয়ালা এগিয়ে। দিল প্রমীতা, নিজেরটাও টেনে নিল। সহজ অন্তরঙ্গতার সুরেই জিজ্ঞাসা করল, তারপর, এখানে আছ কোথায়?
–সেই দক্ষিণে।
–দক্ষিণে কোথায়?
–কেন, যাবে?
আবারও মুখের উপর চোখ দুটো বড় বেশি স্থির মনে হল প্রমীতার। হেসেই জিজ্ঞাসা করল, কেন, গেলে কারো আপত্তির কারণ হবে?
বিজন হাসছে মৃদু মৃদু–তা হবে না অবশ্য। বাড়ি পনেরোর দুই, ভবেন হালদার লেন, চারু মার্কেটের কাছে।
–ঠিক যাব একদিন দেখো, ছুটির দিনে থাকো তো?
বিজন মাথা নাড়ল, থাকে। ওষুধের বোতলটার দিকে চোখ পড়তে প্রমীতা জিজ্ঞাসা করল, ওষুধ মনে হচ্ছে, কার?
–মেজ মেয়ের। ও-পাড়ায় পেলাম না।
ঠিক সেই মুহূর্তে প্রমীতার মুখখানা নিষ্প্রভ দেখালো একটু, গলার স্বরও বদলালো যেন। কিন্তু মুহূর্তের ব্যতিক্রম মাত্র, তারপরে হেসেই বলল, সংসারচিত্রের প্রথমেই মেয়ের অসুখের খবর দিলে! কী হয়েছে?
-পেটে চিনচিনে ব্যথা, প্রায়ই ভুগছে, আজও ওষুধটা না নিলে খণ্ড-প্রলয়ের সম্ভাবনা ছিল।
পরিতুষ্ট মন্তব্যের মত শোনালো প্রমীতার কানে। হেসেই জিজ্ঞাসা করল, ছেলেপুলে কী তোমার?
–দুই মেয়ে, এক ছেলে।
কার কত বয়েস? সত্যিই এই লোকটার সম্পর্কে জানার কৌতূহল প্রমীতার।
–বড় মেয়ে এগারো, মেজোটা সাড়ে আট, ছেলে সারে ছয়।
–বেশ। এবার বউ কেমন শুনি?
–বিয়ের পর একবছর পর্যন্ত বউ ছিল, এখন তিনি কর্তা–আমার পোজিশন ছেলে-মেয়েদের থেকে খুব বেশি ওপরে নয়। নিজেও কিছু উপার্জন করে বলে আমাকেও প্রায় অকর্মণ্য পোষ্য ভাবে।
–চাকরিও করে তাহলে! লেখা-পড়া জানা বলো..কী চাকরি?
-মাস্টারী। তবে তোমার মত বড়দরের নয়, ছোটদরের। দিনের বেলায় স্কুলের। মেয়েদের ওপর, রাত্রিতে আমাদের ওপর।
প্রমীতা লক্ষ্য করছে, মুখখানা আগের থেকে সত্যিই অনেক ঢলঢলে হয়েছে, আর প্রকারান্তরে যতই বউয়ের নিন্দার আভাস ফোঁটাতে চেষ্টা করুক, কথাবার্তায় আসলে বেশ একটা সহজ পরিতৃপ্তির আমেজ রয়েছে।
হেসে ছদ্ম ভ্রূকুটি করল প্রমীতা, বিচ্ছিরি কথাবার্তা হয়েছে তো তোমার! দাঁড়াও, বাড়ি গিয়ে যা-যা বলেছ, বউকে বলে দেব সব!
-বোলো। বিশ্বাস করলে আমাকে ধোলাই করতে নিশ্চয় ছাড়বে না, কিন্তু তোমার। মত এমন পরিচিত একজনও আছে আমার, চাক্ষুষ সে-প্রমাণ পেলে মনে মনে একটু সম্মানও অন্তত নিশ্চয় করবে–আমার কপালে এ বস্তুটি দিনকে দিন দুর্লভ হয়ে উঠছে।
চারুমার্কেট ছড়িয়ে, ট্রামডিপো ছাড়িয়ে, আরো আধমাইল পথ পায়ে হেঁটে অন্ধকার গলির ভিতর দিয়ে ঠাওর করে এগিয়ে এসে জীর্ণ বদ্ধ দরজার তালা খুলল বিজন ঘোষ। নিঃশব্দ হাসিটা সমস্ত মুখে ছড়িয়ে আছে।
বগলের ওষুধটা নিজেরই, পেটের চিনচিনে ব্যথাটাও নিজেরই। কিন্তু ওষুধটা না কিনলেও হত, ব্যথাটা বোধ হয় সেরেই গেল। প্রমীতা কোন দিনও আর তার ঘরে আসবে না। এলেও চারুমার্কেটের সামনে পনেরোর দুই ভবেন হালদার লেনের অস্তিত্ব কোথাও আছে কিনা বিজন ঘোষ জানে না।
অন্ধকারশূন্য ঘরে তার নিঃশব্দ হাসিটা গাল বেয়ে প্রায় কানের দিকে ছড়াচ্ছে। এখন। কলকাতায় এসে এই দেড় বছর ধরে এই গোছেরই একটা স্বপ্ন দেখেছিল যেন। স্বপ্নের গাছে বাস্তবের ফল সত্যিই ধরে?
বিজন ঘোষও হরিপদ কেরানীদেরই একজন। এই শূন্যঘরে যে মানসীর আনাগোনা, তারও প্রনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর…।
বিজন ঘোষ কোনদিন তার অস্তিত্ব টের না পেলেও প্রমীতা গুপ্ত পাচ্ছে।