০১. গল্পের নায়িকা রাজনন্দিনী

 সাবরমতী – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

০১.

লিখতে বসে এক সে বিদেশী বিদেশী মনে পড়ে গেল। সেই গল্পের নায়িকা কোনো রাজনন্দিনী। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত, সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকে রাতে ফিরে আবার ঘুমনো পর্যন্ত, তার প্রতিটি দিন প্রতিটি মুহূর্ত নিয়মের সাড়ম্বর শৃঙ্খলায় বাঁধা।

কিন্তু রাজকুমারীর মাঝে মাঝে মনে হয়, শিকলে বাঁধা।

সোনার শিকল। জলুস আছে, ছটা আছে। তবু শক্তপোক্ত শিকলই বটে। ভাঙে না, ছেঁড়ে না। এ শিকল দেখে লোকের চোখ ঠিকরয়, বেদনার দিকটা কারো চোখে পড়ে না। রাজনন্দিনীর চলা-ফেরা ওঠা-বসা, তার বেশ-বাস সাজ-সজ্জা আহার-বিহার আরাম-বিরাম তার হাসি-আনন্দ শোক-তাপ–এক কথায় তার গোটা অস্তিত্ব এক সুমহান রাজকীয় ঐতিহ্যের ধারায় সুনির্দিষ্ট। কোনো ফাঁক নেই, কোনো ব্যতিক্রম নেই। ফাঁক কেউ খোঁজে না, ব্যতিক্রম কেউ চায় না। এমন কি অনেক-অনেকদিন পর্যন্ত রাজকুমারীও খোঁজেনি, চায়নি। চেতনার শুরু থেকে সে-যেন একটানা ঘুমিয়ে ছিল। সেই ঘুমের ফাঁকে তার চেতনা কখনো সুদূরপ্রসারী হতে চায়নি। কোনো নিভৃতের রহস্যতলে মাথা খোড়েনি। সেই নিয়মের ঘোরে কোনো বেদনা গুমরে উঠতে চায়নি।

কিন্তু রাজকুমারীর ঘুম হঠাৎ একদিন ভেঙে গেল। তলায় তলায় এই ঘুম ভাঙার প্রস্তুতি চলেছিল কবে থেকে তা জানে না।

সেটা রাজকুমারীর যৌবনকাল।…আশ্চর্য, নিয়মের ছকে বাঁধা সেই শান্ত যৌবনে সমুদ্রের অশান্ত ঢেউ লাগে কেমন করে। শান্ত যৌবন দুলে ওঠে ফুলে ওঠে কেঁপে ওঠে গর্জে ওঠে। হঠাৎ এ কি হল রাজকুমারীর! এ কি দারুণ যাতনা আর দারুন আনন্দ। ঐতিহ্যের বাঁধগুলো সব ভেঙে গুঁড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। সেই যৌবন মুক্ত হতে চায়, বন্য হতে চায়, সমুদ্র হতে চায়।

কিন্তু শুধু চায়। পারে না। পাল ছেঁড়ে না। হাল ঘোরে না।

শত শতাব্দীর নিয়মের বনিয়াদে ফাটল ধরে না। সত্তার আর এক দিক অটুট আভিজাত্যের নিশ্চিত বন্দরে বাঁধা। নিয়মের বন্দরে। অভ্যস্ততার বন্দরে। দিশেহারা দিকহারা হবার ঘোর কাটে একসময়। তাড়না সরে যায়। বহুদিনের বন্দী পাখি খাঁচা খোল পেলে যেমন তার ডানা উসখুস করে ওঠে, বাইরে বেরিয়ে আসে–অথচ খাঁচার অলক্ষ্য বন্ধন আবার তাকে ভিতরে টেনে নিয়ে যায়। ঠিক তেমনি করে নতুন অনুভূতির উত্তেজনা কাটিয়ে বিনা প্রতিবাদে আবার সে নিশ্চিন্ত শান্তির নৌকায় উঠে বসে। এ নৌকোর নোঙর ছেঁড়ে না।

রাজকুমারীর ভোগের উত্তেজনা আর ভোগের ক্লান্তি সম্বল।

কিন্তু একদিন….

রাজকীয় আভিজাত্যের সুতোয় গাঁথা মালা থেকে খসে-পড়া একটি দিন। সমস্ত হিসেবের বাইরের মুক্ত দিন একটা।

মাত্র একদিনের জন্য মুক্তি পেয়েছিল রাজকুমারী। রাজনীতির ছক-কাটা গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। অফুরন্ত মুক্তির বাতাসে ভাসতে পেরেছিল, হৃৎপিণ্ড ভরে নিতে পেরেছিল। সেই একদিনের জন্য রাজকুমারী ঐতিহ্যের শৃঙ্খলমুক্ত, রাজটিকার ছাপমুক্ত, পরিচয়শূন্য সাধারণ রমণী একটি। বৈশাখের মেঘের মত মাত্র একদিনের জন্য সেই রমণী নিরুদ্দিষ্ট হতে পেরেছিল। সহস্র সাধারণের জীবনের স্রোতের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে পেরেছিল, সেই এক মুক্ত দিনের প্রতিটি পল প্রতিটি মুহূর্ত যেন আস্বাদনের বস্তু। শুধু তাই নয়, ওই একটি দিনের মুক্তির মধ্যেই সেই তৃষাতুর রমণীর যৌবন নামশূন্য রাজটিকাশূন্য আর এক অতি-সাধারণ পুরুষ-যৌবনের সন্ধান পেয়েছিল, স্পর্শ পেয়েছিল। তাদের হৃদয়ের বিনিময় ঘটেছিল–যে বিনিময়ের জন্য নারী আর পুরুষের শাশ্বত প্রতীক্ষা।

দুটি হৃদয় দুটি হৃদয়ের দরজা খুলে দিয়েছিল।

কিন্তু একটা দিনের পরমায়ু কতটুকু আর?

দিন ফুরিয়েছে। রাজকুমারীর মুক্তির মিয়াদও। পরদিনই আবার তাকে রাজসম্মানের সেই পুরনো জগতে ফিরে আসতে হয়েছে। আগের দিনটা যেন স্বপ্ন। স্বপ্ন, কিন্তু সত্যি। যে পুরুষ-হৃদয়ের সঙ্গে তার অন্তরতম বিনিময় ঘটেছিল, এই সাড়ম্বর রাজকীয় বেষ্টনীর মধ্যে সে অনেক দূরের মানুষ। দূরেই থেকেছে। দূরে সরে গেছে। হৃদয় আকাশের দুটি ভাসমান মেঘ কাছাকাছি এসেছিল কেমন করে। মিলনমুখি হয়েছিল। কিন্তু মেলেনি। মিলতে পারলে ফলপ্রসূ হত, মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারত। কিন্তু তার আগেই তারা থমকেছে। পরস্পরকে দেখেছে। চিনেছে। তারপর আবার যে যার দুদিকে ভেসে গেছে।

আর দেখা হয়নি। হবেও না।

রাজকুমারীর জীবনে আবার সেই প্রাণশূন্য পারম্পর্যশূন্য রাজ-আভিজাত্যে মোড়া একটানা দিনের মালা গাঁথা হতে থাকে। কিন্তু সেই মালার মাঝখানে দুলছে একটি মাত্র কক্ষচ্যুত দিনের স্মৃতি। হৃদয়ের সমস্ত অর্ঘ্য নিটোল শুচিশুভ্র একফোঁটা অশ্রু হয়ে মধ্যমণির মত দুলছে সেখানে।

.

কাহিনীটা মনে পড়তে লেখনী দ্বিধান্বিত হয়েছিল কয়েক মুহূর্ত। আমার চোখের সামনে দুটি নারী-পুরুষের জীবন যে ছাঁদে যে ছন্দে ভিড় করে আসছে, দেশ-কাল-পাত্র হিসেবে ওপরের ওই কাহিনীর রমণীর সঙ্গে তাদের সহস্র যোজন তফাত। তবু কোথায় যেন মিল।

সাবরমতীর ধারে বসে সেই মিলের হিসেব মেলাতে গিয়ে বিস্ময়ের অন্ত নেই আমার। সেই বিস্ময়ের ঢেউয়ে দ্বিধা সরে গেছে। মানুষের নিভৃততম হৃদয়ের খবরে খুব বেশি রকমফের হয় না বোধহয়। হৃদয়ের তন্ত্রীতে আর এক হৃদয়ের স্পর্শ মুখর হয়ে উঠলে একই সুর বাজে বুঝি, একই ঝঙ্কার ওঠে। বিশ্ববেদনার একই সুর, বিশ্ব-হৃদয়ের একই রূপ। এই সত্যের নতুন পুরনো বলে কিছু নেই। যে সূর্য রোজ উঠছে, তার প্রথম আবির্ভাবের রূপটা চির-পুরাতন, কিন্তু চির নতুন। রাতের রজনীগন্ধা যে বারতা পাঠায় সেটা প্রত্যহের বারতা হলেও পুরনো বলে কে কবে তার প্রতি উদাসীন হতে পেরেছে?

হৃদয়ের কথা এমনি কোনো সত্যেরই প্রতীক হয়তো।

কিন্তু হৃদয়ের ঠিক এই কথার জাল বিস্তারের আগ্রহ নিয়ে আমি এই সাবরমতীর দেশে আসিনি। বস্তুত, এখানে আসার পিছনে উদ্দেশ্য বলতে কিছু ছিল না। উপলক্ষ ছিল। সেও নিতান্ত গতানুগতিক। উপলক্ষ সাহিত্য-সম্মেলন। উদ্যোক্তারা বাংলার বাইরে এ-ধরনের সম্মেলনের আসর সাজানোর ফলে বহু সাহিত্যরসিক কাব্যরসিক নাট্যরসিকের সমাবেশ ঘটে। এই সমাবেশের পিছনেও সাহিত্যরসাহরণ প্রধান আকর্ষণ কিনা সঠিক বলতে পারব না। আমার দিক থেকে অন্তত আরো গোটাকতক জোরালো আকর্ষণ আছে। কোথাও থেকে আমন্ত্রণ এলেই সিঙ্গল ফেয়ার ডাবল জার্নির হাতছানিটা প্রথম চোখে ভাসে। দ্বিতীয়, সম্মেলনের চার-পাঁচটা দিন কোথাও রাজ-অভ্যর্থনা, কোথাও রাজসিক। বলা বাহুল্য, এটা নি-খরচায়। তৃতীয়, নতুন জায়গা দেখার সুযোগ।

তবু গুজরাটের এ-হেন জায়গায় বাংলা সাহিত্য অধিবেশনের ব্যবস্থার কথা শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম। শুনেছিলাম, এই রাজ্যের ছেলেমেয়েরা প্রথম জ্ঞান-উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা বুঝতে শেখে। এই দেশ লক্ষ্মীর চলা-ফেরার একেবারে সদর রাস্তা। ভারতের সব রাজ্যে বিত্তবানের সংখ্যা কিছু আছেই–কিন্তু এখানকার মতো আর কোথাও নেই নাকি। ছেলেবেলায় ভুগোল বইয়ে পড়েছিলাম বস্ত্র-শিল্পে গোটা ভারতের মুখ উজ্জ্বল করে রেখেছে এই একটি জায়গা। এই দেশ বলতে আমার চোখে শুধু ভাসত তুলোর চাষ, তুলোর গাছ, সুতোর কল, আর কাপড়ের কল।

অবশ্য এই ধারণার সবটাই অজ্ঞতা-প্রসূত। জানার তাগিদ থাকলে অনেক জানা যেত। একেবারে যে কিছুই জানতুম না তাও নয়। কিন্তু সেটা ভাসা-ভাসা জানা। শরতের হালকা মেঘের মতো একটা অগভীর ধারণা শুধু মনের আনাচে-কানাচে ভাসছিল। এখানে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তার অনেকটাই সরে গেছে। শহরের বুকের ওপরেই সুতোর কল আর কাপড়ের কল অনেক আছে বটে। কিন্তু তুলোর চাষ, তুলোর গাছ নেই। তুলো আসে অনেক দূর থেকে। আসে পশ্চিমঘাট উপত্যকার সমতল ভূমি সহ্যাদ্রির কালো মাটির অঞ্চল থেকে, আর বহু দূরের সাতপুরা হিলস থেকে।

এখানে এসে প্রথম যে জিনিসটি ভাল লেগেছিল, তা এখানকার মানুষদের অন্তরঙ্গ আতিথেয়তা, অমায়িক অথচ সহজ সৌজন্যবোধ। এযাবৎ বিত্তবানের দু’রকমের আতিথ্য লাভের সুযোগ ঘটেছে। এক, খানদানী আতিথ্য। সেখানে গৃহস্বামী আর অতিথি যত কাছে আসে ততো ব্যবধান বাড়ে। তাদের আতিথ্যের চটকের সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে হাঁপ ধরে আর ভিতরের এক ধরনের দৈন্য নিভৃতের নানা জটিলতার বিবরে আত্মগোপন করতে চায়। দ্বিতীয় পর্যায়ের আতিথেয়তা নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ তুষ্টির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেবার মতো। উদ্বেগ নেই, মান খোয়া যাবার শঙ্কা নেই, হিসেব করে পা ফেলে চলার অদৃশ্য তাগিদ নেই। ঐশ্বর্য সেখানে চোখের ওপর সরাসরি সূর্যের আলো ফেলে দৃষ্টি অন্ধ করে না। উদয়ের প্রথম অথবা অস্তের শেষ আভার মত স্নিগ্ধ স্পর্শ ছড়ায়। স্মৃতিপটে সেটুকু লেগে থাকে। বিত্তবান ব্যক্তিবিশেষের এ-রকম আতিথ্য বেশি না জুটলেও জুটেছে। কিন্তু সমবেত বিপুল অভ্যাগতসমষ্টির প্রতি এখানকার সামগ্রিক আতিথ্যের রূপটাই এই দ্বিতীয় পর্যায়ের। এই জায়গাটার সম্পর্কে আগের ধারণা বা অজ্ঞতার জন্য মনে মনে নিজেই লজ্জা পেয়েছি। বিত্ত যেখানে প্রসন্ন দৃষ্টি ফেলে তার রূপ আলাদা।

শুকনো বাদামী বালির দেশ। কিছুটা টানের জায়গা। অঙ্কের হিসেবে মরুভূমির দূরত্ব এখান থেকে খুব দুস্তর নয়। কিন্তু মরুভূমি এখানকার কোনো কিছুতে টান ধরাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। একটা ভৌগোলিক অস্তিত্ব নিয়ে কোনো এক পাশে পড়ে আছে যেন। এখানকার মানসিকতা থেকে মরুভূমি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।

তার কারণ বোধহয় এখানকার হৃৎপিণ্ডের ওপর দিয়ে বইছে সাবরমতী। শহরের প্রায় মাঝখান দিয়ে গেছে। তার দু’কুলে শহর। একই শহর। স্বভাবতই মাঝে মাঝে সেতুবন্ধ চোখে পড়বে। মনে হয়, এই নদীর সঙ্গেই এখানকার মানুষদের নাড়ীর যোগ। জন্মের পর চোখ খুলেই যারা নদী দেখে তাদের সত্তাও সেইভাবেই পুষ্ট হয় বলে বিশ্বাস। এখানকার মানুষদের আমোদ প্রমোদ ধর্মাচরণ অনেকটাই এই নদীর সঙ্গে যুক্ত ছিল। ছিল বলি কেন, আজও নেই এ-কথা জোর করে বলতে পারিনে। দিন বদলেছে বলে হয়তো ধারা বদলেছে কিছুটা। পুরনোর উপর নতুনের আলো সর্বত্র যেমন পড়ে তেমনি পড়েছে। কিন্তু সেটা বহিরঙ্গের ব্যাপার।

দেশের সতেরোটি পবিত্র স্থানের মধ্যে বেশির ভাগেরই অস্তিত্ব এই সাবরমতীর তীরে। চোখে দেখিনি, গল্প শুনেছি–তিন বছর অন্তর মলমাসের উৎসবানুষ্ঠানে আজও হাজার হাজার রমণী খালি পায়ে এই সব পবিত্র স্থানে উপসনান্তে নগর-প্রদক্ষিণ করে। অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত সংস্কারান্ধ গরিব ঘরের মেয়ে নয় সকলেই। গরিবের সংখ্যা এমনিতেই কম এখানে, শিক্ষারও দ্রুত বিস্তার ঘটছে। রমণীদের বিশ্বাস তারা নগর প্রদক্ষিণ করলে নগরের কল্যাণ হবে। কেন হবে তা তারা জানে না বা জানতে চেষ্টাও করে না। শিক্ষার গর্ব বা বিত্তের ছটা প্রাচীন বিশ্বাসের শিকড় কেটে দেয়নি। কল্যাণ হোক না হোক কল্যাণ তারা চায় এটাই বড় কথা। নগর প্রদক্ষিণের এ-দৃশ্য স্বচক্ষে না দেখলেও নদীর ধারের আর এক উৎসব প্রত্যক্ষ করেছি। কার্তিকের শুক্লা-একাদশীর মেলা। শুধু মেলা দেখলে হয়তো এমন কিছু বৈচিত্র্য চোখে পড়বে না। বহু দর্শনার্থী বহু জন-সমাগম বহু পণ্যের চিরাচরিত দৃশ্য। কিন্তু মেলার অদৃশ্য মানসিকতাটুকু মনোগ্রাহী। দেবোত্থান একাদশীর মেলা–দেব-উঠি-আগিয়ারস্।

শীতারম্ভের এই সময়টায় সাহিত্য-সম্মেলন ব্যবস্থার দরুন উদ্যোক্তাদের মনে মনে ধন্যবাদ জানিয়েছি। নইলে দেখা হত না এই দেব-উঠি-আগিয়ারস্। আমি একালের মানুষ। স্বভাবতই একালের মন, একালের দৃষ্টি, একালের হৃদয় নিয়ে বসে আছি। শুধু আমি কেন, সকলেই। তবু এমনি সমাবেশে এলে মনে হয়, আমাদের এই দৃষ্টি মন হৃদয়ের একটা দিক বুঝি কবেকার কোন সাধক ভারতের চতুষ্পথে বসে আছে। সেই ভারত বা সেই অতীতের সম্বন্ধে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। তবু সুদূর অতীতের কোনো অনাবিল পুষ্টির সঙ্গে সত্তার একটা অবিচ্ছেদ্য যোগ থেকেই গেছে। নইলে দেবতা উঠবেন শোনামাত্র একালের এই অশান্ত মন-সমুদ্রের তলায় তলায় নিঃশব্দ একটা ঢেউ ওঠে কেন? বহুকালের হারানো অথচ প্রায়-চেনা পথের স্মৃতি বার বার পিছনপানে টানে কেন?

আর ক’টা দিন থেকে যান। শুক্লা-একাদশীর উৎসব দেখে যান। রমণীর সদয় মিষ্টি আতিথ্য বড় লোভনীয়ভাবে প্রসারিত হয়েছিল। এখানকার যে রমণীটি সকলের মধ্যমণি, তার প্রস্তাব।

–সেটা কি ব্যাপার? আমি উৎসুক হয়েছিলাম।

–দেব-উঠি-আগিয়ারস–দেবোত্থান একাদশী।

—কি হয়?

মহিলা হেসে বলেছিল, হয় না কিছু। নদীর ধারে সকাল থেকে মেলা বসে।

বাংলাদেশের ছেলে, মেলা শুনে অভিভূত হবার কারণ নেই। তবু নতুন জায়গায় সব আকর্ষণ ছেড়ে মেলা দেখে যাবার প্রস্তাব শুনে বলেছি, দেশে মেলা দেখে দেখে এখন মেলার কথা শুনলে ভয় করে। এটা কি-রকম মেলা?

মেলার আলোচনা উপলক্ষ। লক্ষ্য, অবকাশ যাপন। সেটা মনের মতো হলে সবই ভালো লাগে। সামান্য আলোচনাও বৈচিত্র্য মনে হয় না। মহিলা তেমনি হেসেই বলেছিল, কি-রকম আর, সব মেলা একই রকম। সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষ মেলে, আবার মন চাইলে দু’একজন মানুষেরও সন্ধান মেলে।

মহিলার হাসিমাখা মিষ্টি মুখে বাড়তি একটু লালিমা চোখে পড়েছিল কিনা ঠিক বলতে পারব না। কিন্তু কথা ক’টা আমার কানে লেগেছিল। আজও লেগে আছে।

আজ যদি শুনি, কোনো কুবেরাধিপ সার অমুকের মেয়ে অথবা সার তমুকের বউ স্বল্প-পরিচয়ের অতিথিকে দেশের কোনো মেলা দেখে যাবার জন্য আপ্যায়ন জানাচ্ছে, কানের পর্দায় একটা নাড়াচাড়া পড়ে যাবে বোধ করি। যে মহিলার কথা বলছি এখানে তার মর্যাদা আরো বেশি ছাড়া কম নয়। কোনো পুরুষের গৌরবে গরবিনী নয়, নিজেই সে ভাগ্যের তুঙ্গশিখরাসীনা। তার লক্ষ্মীর প্রসাদ-ভাণ্ডারের দিকে তাকালে অনেক ভাগ্যবানের দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়বে। শুনেছি এই লক্ষ্মীর প্রসাদ-ভাণ্ডারের দিকে তাকালে তা তো বটেই। ঐশ্বর্য-ভাণ্ডারের সঠিক হিসেব সে নিজেও রাখে না। বড় বড় কাপড়ের কলের সংখ্যা এখানে পঁচাত্তরের উপরে। তার দু’একটার মালিক হওয়া খুব বড় কথা নয় এখানে। এই দেশে লক্ষ্মীর সমুচ্ছল পদক্ষেপ বস্ত্রশিল্পের পথ ধরেই। কিন্তু বড় মিলগুলোর মধ্যেও যদি শুধুমাত্র একটিকে সবগুলোর চুড়ো হিসেবে বেছে নেওয়া যায়, দেখা যাবে সেই মিলের অধিশ্বরী এক মহিলা। যে রমণী এখানকার কটন চেম্বারের অধিনায়িকা–এ বছরের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট।

সেই রমণী। সেই মহিলা। আমাকে সাবরমতীর দেবোত্থান একাদশীর মেলা দেখে যাবার জন্য সাদর আমন্তণ জানিয়েছে।

…. যশোমতী পাঠক।

এই নাম এখানকার সর্বস্তরের মেয়ে-পুরুষের সুপরিচিত।

হ্যাঁ, এখানকার সব থেকে বড় কটন মিলের মালিক, কটন্ চেম্বারের প্রেসিডেন্ট যশোমতী পাঠক সেই এক সন্ধ্যায় বলেছিল এই কথা। বলেছিল, কি-রকম আর, সব মেলা একই। সেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষ মেলে, আবার মন চাইলে দুই-একজন মানুষেরও সন্ধান মেলে।

আমি হাঁ করে তার মুখের দিকে চেয়ে ছিলাম। তাতে অভব্যতা ছিল না, বিস্ময় ছিল। কারণ, মনে মনে আমি তার দিন কতক আগে থেকেই দুটি নারী-পুরুষের জীবন-চিত্রের একেবারে অন্তঃপুরে বিচরণের চেষ্টায় ছিলাম। সেটা এই মহিলা জানে। শুধু জানে না, এই একটি কারণে আমার কিছু লাভ হয়েছিল। সে রকমটা আর কোনো অভ্যাগতর কপালে অন্তত জোটেনি। মহিলার পরোক্ষ প্রশ্রয়ের ফলে এই সাবরমতীর দেশে আসাটা আমার সার্থক মনে হয়েছিল।

শোনামাত্র সেই মুখের দিকে চেয়ে আমি কিছু দেখতে চেষ্টা করেছিলাম। মনে হয়েছিল, সাবরমতীর ওই মেলার সঙ্গে তার কোনো একটা নিরবচ্ছিন্ন মেলার ধারা মিশে আছে। যশোমতীর মন কাউকে চেয়েছিল, খুঁজেছিল। কারো সন্ধান মিলেছিল।

হতে পারে, দেবতা উঠেছিলেন।

কিন্তু এ-প্রসঙ্গ পরের বিস্তার সাপেক্ষ। সাহিত্য-অধিবেশন উপলক্ষে সদ্য-আসা এই দুই চোখ তখন শুধু এই জায়গাটা আর তার মানুষগুলোকে দেখে বেড়াচ্ছিল। যশোমতী সম্পূর্ণ অপরিচিত তখনো। নামটাই শুধু শোনা ছিল। সম্ভাব্য কোনো কাহিনীর গতি যে এই পথে গড়াবে, সেটা কল্পনার বাইরে। আমি তখন শুধু  সাবরমতী চিনতে চেষ্টা করছিলাম।

নদীর কথায় যশোমতীর কথা এসে গেছে।

নদীর জল নীলাভ। নীল আভার সঙ্গে মানুষের ধমনীর রক্তের অদৃশ্য কি যোগ কে জানে। চারদিনের সাহিত্য-সম্মেলন উপলক্ষে এই প্রায়-অপরিচিত মানুষদের উদ্যম দেখেছি, উৎসাহ দেখেছি, উদ্দীপনা লক্ষ্য করেছি। আমরা, বিশেষ করে খাস বাংলার সাহিত্যিকরা যেন ভারি প্রিয়জন তাদের। প্রিয়জনের প্রতি অন্তরঙ্গতার আতিশয্য যেটুকু, সেটুকুও অন্তরের। তাদের ঐশ্বর্যের ছটা থেকেও ছোট বড় নির্বিশেষে অন্তরের এই সামগ্রিক খুশির ছটাটুকুই বেশি টেনেছিল আমাকে।

কাপড়-কলের দেশে সাহিত্য-সম্মেলনের আড়ম্বর হবে শুনে মনে মনে যারা মুচকি হেসেছিল তারাও ভিতরে ভিতরে আমার মতই অপ্রস্তুত হয়েছে হয়তো। টাকা আছে অথচ সাহিত্য-প্রীতি নেই, এই দিনে সেটা মানহানিকর ব্যাপার প্রায়। সাহিত্য-সম্মেলনও সেই গোছছরই হবে ধরে নিয়েছিল সকলে। কিন্তু ঐশ্বর্যের সঙ্গে মার্জিত রুচি তার সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগের দিকটা যে কত সহজভাবে মিশে আছে, এখানে এসে গোড়াতেই সেটা উপলব্ধি করতে হবে। লক্ষ্মী সরস্বতীর চিরন্তন বিবাদের কথা মনে হবে না।

বিশেষ বিত্তবানদের প্রতি বিপরীত অবস্থার মানুষের এক ধরনের মানসিক বিরাগ আছেই। এই বিরাগের প্রধান হেতু বোধ করি বিত্তবানের হৃদয়শূন্যতা, পারিপার্শ্বিক মানুষের প্রতি তাদের নির্লিপ্ত উদাসীনতা। বিত্ত তার চারদিকে একটা বৃত্ত টেনে দেবেই। কিন্তু সেই বৃত্তটা ছোট বা সংকীর্ণ হলে যতটা চোখে লাগে, বড় হলে ততটা লাগে না বোধহয়। আমাদের চোখ ছোট বৃত্ত দেখে অভ্যস্ত। সেখানে স্বার্থ আর আত্মচেতনা আর মর্যাদাবোধ যেন সর্বদাই একটা ধারালো ছুরি হাতে পাহারায় বসে আছে। সেখানে হৃদয়ের কারবার নেই।

হৃদয়ের কারবারের খবর এখানেও খুব রাখিনে। কিন্তু এখনকার বৃত্তটা যে বড় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই বড় বৃত্তের সঙ্গে পুরুষকার মিশলে তার চেহারা অন্যরকম। আর তার মধ্যে মানসিক সলতা প্রতিফলিত হলে তা চেহারা আরো অন্য রকম। এই সামগ্রিক বিত্তের দেশে পথে-ঘাটে যে একটিও ভিখিরি চোখে পড়ল না সেটা নিশ্চয় চোখ বা মনের দিক থেকে অবাঞ্ছিত নয়। এ-হেন জায়গায় হঠাৎ বড়লোক হবার নেশায় পাগল হয়ে ছুটবে এমন একটিও রেসকোর্স যে নেই, এও নিশ্চয় এক সামগ্রিক মানসিক পুষ্টির লক্ষণ। এই পুষ্টির চেহারাটা সর্বত্র চোখে পড়ে না। না পড়লে আমাদের অভ্যস্ত চোখে তেমন ধাক্কা বা খোঁচাও লাগে না। কিন্তু পড়লে ব্যতিক্রম মনে হয়। এখানকার শিক্ষার ব্যবস্থাও সাবরমতীর মতো বহু ধারায় একে-বেঁকে গেছে। প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এখানেই। এর অধীনে শুনলাম বাহাত্তরটি কলেজ, আর তার মধ্যে একুশটি নাকি আছে এই শহরেই। কত রকমের কলেজ তার ফিরিস্তি দেওয়া নিয়োজন। শুধু অর্থ আর কচি এখানে বিপরীত বাস্তায় চলছে না কেন, সেই প্রসঙ্গে এই উক্তি।

বিদেশে এসে সেখানকার একজন লোককেও দেশের ভাষায় কথা বলতে শুনলে আপনার ভালো লাগবে। কিন্তু এসে যদি শোনেন এবং দেখেন আপনার দেশের ব্যাপক সাহিত্যচিন্তার এক বৃহৎ সমজদারগোষ্ঠ আছে সেখানে–তাহলে সেই ভালো লাগাটা বুকের একেবারে কাছাকাছি কোথাও পৌঁছতে বাধ্য। শরৎবাবু যে এখানে সমষ্টিগতভাবে এমন এক হৃদয়ের আসনে প্রতিষ্ঠিত কখনো কল্পনাও করিনি। ঘরে ঘরে তাঁর ছবি, ঘরে ঘরে তার অনুবাদ-সাহিত্য। ভাষা-শিক্ষার ব্যাপারে এখানকার ছাত্রছাত্রীদের সব থেকে বেশি ভিড় বাংলা ক্লাসে। এর পিছনে একটাই কারণ। আমাদের কবি আর আমাদের লেখককে তাদের জানার আগ্রহ। এই আগ্রহ কল্পনার বস্তু নয়, বাস্তব সত্য। এতে তাদের জাতীয় বৈভবের কোনো খাদ মেশেনি। অল্পবয়সী এত ছেলেমেয়ে ছোটাছুটি করে এসে বাংলায় কথা বলবে, বাংলায় অভ্যর্থনা জানাবে-বাংলা সাহিত্য-সম্মেলনে এসেও এ আর কে আশা করেছিল?

বিলাস-ব্যসনের অনুষ্ঠান বলতে নাটক নাচ আর গান। এখানকার আবালবৃদ্ধ-বনিতা এই তিন কলার ভক্ত। প্রচুর খরচও হয় এতে। সম্মেলনে তিনের ব্যবস্থাই ছিল। নাটক একদিন, নাচ আর গান প্রতিদিন।

কমলা-তনয়া যশোমতী পাঠকের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ এক সন্ধ্যার গানের আসরে। কিন্তু এ কাহিনী বিস্তারের মত অনুকূল নয় সেটা আদৌ।

সাহিত্যের আসরে আগেও ক’দিন দেখেছি মহিলাকে। শুনেছি, আমাদের আপ্যায়ন এবং অভ্যর্থনার ব্যাপারে তারই উদার হাত সব থেকে বেশি প্রসারিত। অবশ্য সেটা প্রকাশ্যে নয়। সে-ও খুব অভাবনীয় মনে হয়নি, কারণ অপ্রকাশ্য উদারতা শেষ পর্যন্ত প্রকাশ হয়েই পড়ে আর তাতে ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনের চটক বাড়ে। মহিলা অধিবেশনে আসা মাত্র স্থানীয় ব্যবস্থাপকদের একটু বেশি মাত্রায় সচেতন হতে দেখেছি। এক পাশের একটা নির্দিষ্ট আসনে বসে ঈষৎ কৌতুকমেশা গাম্ভীর্যে তাকে অধিবেশনের আলোচনায় মনোনিবেশ করতেও দেখেছি।

দেখেছি, তার কারণ মহিলার সম্বন্ধে এখানকার বাঙালী বাসিন্দাদের মুখে নিজের পেশাগত কিছু রসদের সন্ধান পেয়েছি। অবশ্য তখনো সম্পূর্ণই আগোচরের রসদ সেসব। অর্থাৎ মহিলাকে দেখার আগের রসদ। সেটা সব থেকে বেশি যুগিয়েছে ত্রিপুরারি ঘোষ। বস্তুত, আমার এখানে আসাটা সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের আগ্রহের দরুন যতটা না, তার থেকে অনেক বেশি ত্রিপুরারিয় তাগিদে। না এলে জীবনে আর মুখ দেখবে না, চিঠিতে এমন হুমকিও দিয়েছিল সে। লিখেছিল, তার প্রাণের দায় না এলেই নয়।

যশোমতী প্রসঙ্গে এই ত্রিপুরারির মুখখানা উদ্ভাসিত হতে দেখেছি কতবার ঠিক নেই। অথচ স্বভাবের দিক থেকে বরাবর ওকে নীরস গদ্যকারের মানুষ বলে জানি। ছোট একটা কবিতা মুখস্থ করতে গলদঘর্ম হয়ে উঠত, কিন্তু লাভ-লোকসানের দুরূহ অঙ্কের ফল মেলাতে ওর জুড়ি ছিল না। ছেলেবেলা থেকে হিসেব করে চলত, উচ্ছ্বাসের মুখেও হিসেবের রাশ টেনে ধরত, পাছে কাউকে পাওনার অধিক দিয়ে বসে। সে টাকা-পয়সাই হোক বা নিন্দা-প্রশংসাই হোক। হস্টেলের ও ছিল ম্যানেজার। বাজার সরকারের মোটা চুরি ধরা পড়েছিল একবার। কিন্তু সরকার এমন নিখুঁত হিসেব দিয়েছিল যে তাকে বরখাস্ত করার বদলে দু’টাকা মাইনে বাড়ানোর সুপারিশ করেছিল ত্রিপুরারি।

কলেজে ঢুকেও এই হিসেবের রাস্তাই ধরেছিল সে। কমার্স পড়েছে। পাঠগত ঐক্যে সেই প্রথম বিচ্ছেদ। তারপর কর্মের অধ্যায়ে সঙ্গবিচ্ছেদ। নিষ্ঠা সহকারে ত্রিপুরারি সেই হিসেবের রাস্তা ধরেই এগিয়েছে। এম. এ. কমার্স পাস করেছে, অ্যাকাউন্টস-এর আরো দুই একটা কি বাড়তি পরীক্ষাও দিয়েছে শুনেছিলাম। তাতেও ভালো করেছে। কিন্তু উপরওয়ালা অনেকদিন পর্যন্ত তার চাকরির ব্যাপারে হিসেবের গরমিল করেছেন। কোনটাই মনের মত হয় না। কর্মজীবনে নানা ঘাটের জল খেয়ে একসময় ওই কাপড়ের কলের দেশে গিয়ে স্থিতি হয়েছে সে। দু’তিন বছর অন্তর দেখাশুনা হয় ও কলকাতায় এলে। কোন্ এক কটন মিলের চিফ অ্যাকাউন্টেন্টের পোস্টে প্রমোশন পেয়েছে–ওর সম্পর্কে আমার শেষ খবর এইটুকু।

এই ত্রিপুরারির অপ্রত্যাশিত পত্রাঘাতে একটু অবাকই হয়েছিলাম। পত্র একটি নয়, পর পর কয়েকটি। সব ক’টারই সার মর্ম এক। আসা চাই। আসা চাই-ই চাই। না এলে ওর প্রেস্টিজের হানি। ফাস্ট ক্লাসের যাতায়াতের ভাড়া পাঠাতেও সে প্রস্তুত।

সেই কাঠখোট্টা চিঠির কোনো কোনো অংশ হাসি উদ্রেক করার মতো। লিখেছিল, আমাদের সাহিত্য-ফাহিত্যের কানাকড়ি দামও সে কোনো দিন দেয়নি। আজও এর মর্ম নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু এখন বুঝছে ঘামালে ভালো করত। অন্তত কখন কি লিখছি আমি, তার একটু-আধটু খবর রাখলেও মন্দ হত না। কারণ, জীবনের এই নতুন অভিজ্ঞায় সে দেখছে অকাজের কাজও কখন যে কত বড় হয়ে ওঠে তার ঠিক নেই। লিখেছে, আমার বোধহয় জানা নেই, যে বিশাল কটন মিলের সে চিফ, অ্যাকাউন্টেন্ট এখন, তার একেশ্বরী অধিশ্বরী এক রমণী। রমণীর সাহিত্যপ্রীতি সম্পর্কে বিশদ কোনো ধারণা ছিল না ত্রিপুরারির। এর থেকে যে এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তাও কখনো কল্পনা করেনি। সংস্কৃতির সর্ব ব্যাপারে মহিলাটির মোটামুটি এক ধরনের প্রীতির যোগ দেখে অভ্যস্ত সকলে। এটা বাইরের বস্তু বলেই ধরে নিয়েছিল ত্রিপুরারি। কারণ এতবড় কোম্পানীর যাবতীয় হিসেব দেখতে এবং বুঝে নিতে চেষ্টা করে যে মহিলা, সাহিত্য-টাহিত্য নিয়ে তার সময় নষ্ট করার মতো সময় আছে বলেই সে ভাবতে পারত না।

ত্রিপুরারির যত ফ্যাসাদ এই ভাবতে না পারার দরুন।

আসন্ন সম্মেলনের আগে কত্রীর ঘরে তার ডাক পড়েছিল মোটা অঙ্কের কিছু নগদ টাকা যোগানোর জন্য। মোটা অঙ্ক বলতে দু’দশ লাখ টাকার চেকও অনায়াসে মহিলা নিজেই কাটতে পারে। কিন্তু সচরাচর তা করে না। করে না তার কারণ সে বুদ্ধিমতী। গণ্যমান্য সমাবেশের খরচাটা যদি কোম্পানীর কোনোরকম প্রচারের খাতে চালিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে মোটা অঙ্কের আয়কর বাঁচে। ব্যাঙ্কের ব্যক্তিগত তহবিলও নড়চড় হয় না। এসব ব্যাপারে মহিলার পাকা মাথা অনেক সময় বিড়ম্বনার কারণ, অনেক সময় বিস্ময়ের।

কথা-প্রসঙ্গে এখানেই ছেলেবেলার পরিচিত বন্ধু হিসেবে আমার নামটাও সাত-পাঁচ না ভেবেই ছুঁড়ে দিয়েছিল ত্রিপুরারি। কত্রীর ঘরে বসে আরো কারা দু-চারজন চেনা-জানা সাহিত্যিকের নাম করছিল। কে আসতে পারে না পারে। মুখ খুলে এমন ফ্যাসাদে পড়বে ত্রিপুরারি ভাবতেও পারেনি। শোনামাত্র মহিলার আগ্রহ দেখে সে অবাক যেমন, বিব্রতও তেমনি। এক কথায়, আমাকে সম্মেলনে আনার দায়িত্ব ওর ঘাড়েই পড়েছে। এখন আনতে না পারলে ওর ঘাড় বাঁচে না। এর পরে দেখা হলেই কত্ৰী জিজ্ঞাস! করে, আপনার বন্ধু আসছেন তো?….অতএব, সম্মেলনের কর্মকর্তাদের আমন্ত্রণের অপেক্ষায় আমি যেন বসে না থাকি। এ যাত্রায় ওর মুখরক্ষার ব্যবস্থাটা আমাকে করতেই হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখানে আসার পর অবশ্য এই বিশেষ আমন্ত্রণের আনন্দটুকু কিছুটা নিষ্প্রভ হয়েছিল। কারণ, শুনলাম মহিলার এ-ধরনের আগ্রহের নায়ক আমি একা নই। বাংলাদেশের যে সাহিত্যিক বা কবির নামই এই স্থানে একটু-আধটু, রচিত–তাকেই সম্মেলনে আনার জন্য কোনো না কোনো বিশেষ চেষ্টা করা হয়েছে। আসল উদ্দেশ্য, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি জমজমাট করে তোলা। বিশেষ আমন্ত্রণ ব্যবস্থায় লেখকরা অনেকেই আমার মতে পরিতুষ্ট দেখলাম। অতএব নিজেকে বিশেষ ম্মানিত ব্যক্তি মনে করার খুব কারণ নেই।

স্টেশনে নিতে এসেই ত্রিপুরারি ঠাস ঠাস কথা শুনিয়েছে। সে কথা থেকে ওর বক্তব্য উদ্ধার করা সহজ নয়। দুটো প্রেমের গল্প বাতাসে ছেড়ে দিয়ে কি মজাই লুটছ বাবা তোমরা, এমন জানলে কোন্ শালা অ্যাকাউন্ট নিয়ে মাথা খুড়ত! মাঝবয়সে এখন সাহিত্যের পিছনে ছোটাছুটি–

-ছোটাছুটি কি রকম? আমি ঘাবড়েই গেলাম, তুমি সাহিত্য চর্চা শুরু করেছ নাকি?

অবাঙালী ড্রাইভারকে ওর বাড়ির দিকে চালাতে নির্দেশ দিয়ে ভুরু কুঁচকে ঘুরে বসল।–শুরু করেছি মানে? একের পর এক শেষ করছি। প্রথম তিন পাতা, মাঝের তিন পাতা, আর শেষের তিন পাতা। একদিনে একখানা বই তিনবারে ফিনিস। গেল এক মাসে কম করে তোমার দশখানা বই লাইব্রেরি থেকে ইস্যু করতে হয়েছে, জানো?

হেসে বাঁচি না।—সে কি হে! তোমাকে এ-রকম শাস্তির মধ্যে কে ফেললে?

–হাসো, খুব হেসে নাও, বে-কায়দায় পড়লে সকলেই হাসে–বউও হেসেছে। আমার হাতে নভেল দেখে তো প্রথমে ভয়ই পেয়েছিল, ভেবেছিল মাথাটাই বুঝি গেছে খারাপ হয়ে। চোখ-কান বুজে তোমার সব থেকে গাবদা রাবিশ বইটাকে পর্যন্ত খতম করেছি, জানো?

-সত্যি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে প্রাণ বেঁচেছে ওই শর্ট-কাট বার করে। প্রথম, মাঝের আর শেষের–তিন তিরিক্কে ওই ন’পাতা। তাও কি হয়। এক একটা অ্যাকাউন্টস্ মেলাতে গিয়ে কতবার পর পর তিন রাত চার রাত চোখ থেকে ঘুম ছুটে গেছে–সেই ঘুম পোড়া চোখের সামনে যেই তোমাদের ওই ছাইভস্ম গল্পের বই খোল, অমনি কে যেন সাড়াশি দিয়ে ধরে চোখের পাতা টেনে নামিয়ে দেয়। শেষে ওই শর্ট-কাট বার করে বাঁচোয়া। দিনে তিন পাতা করে তিন দিনে ন’পাতা-একখানা বই শেষ। চরিত্রের নাম জানা গেল, কে কোন্ হাওয়ায় ভাসছে একটু-আধটু বোঝা গেল, আর শেষ ওলটালে বিচ্ছেদ কি মিলন সে তত দয়া করে তোমরা জানাবেই। ব্যস, আলোচনায় একটু-আধটু মুখ নাড়ার পক্ষে ওটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু তাও কি ফ্যাসাদ কম! তিনটে বই শেষ করতে না করতে সব মিলে-মিশে জগাখিচুড়ি, –এই বইয়ের নায়ক ওই বইয়ের নায়কের ঘাড়ে চাপল, এর ঘটনা ওর কাঁধে। এক নায়িকার মিলন আর এক নায়িকার বিরহের সঙ্গে ঘুলিয়ে গেল–রাবিশ! গোড়া থেকে একটা চার্ট করে পড়লে হয়তো কিছুটা মনে রাখা সম্ভব।….কি বিপাকে না পড়েছিলাম সেদিন। তোমার কোন্ উপন্যাসের কি এক চরিত্র মনে ধরেছে আমাদের লেডির, প্রশংসা কচ্ছিল–চোখ কান বুজে আমিও দু’দশ কথা জুড়ে দিলাম, যেন আমার পরামর্শ নিয়েই তুমি লিখেছ। তারপর দেখি ভদ্রমহিলা হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে আছে। তক্ষুনি বুঝলাম মিসফায়ার হয়ে গেছে। মুখ টিপে হেসে লেডি বলল, আপনার সব ঘুলিয়ে গেছে, কার সঙ্গে কি জুড়ছেন ঠিক নেই।

আমার শ্রোতার ভূমিকা। শুনতে ভালো লাগছিল। কিন্তু ত্রিপুরারি আবার বাড়িয়ে বলছে কিনা সেই খটকা লাগল। জিজ্ঞাসা করলাম, এ-সব বই তো অনুবাদ হয়নি, উনি বাংলা পড়তে পারেন নাকি?

-বাংলা এখানে অনেকেই লিখতে পড়তে পারে–আমাদের লেডি বাংলায় ভাবতে পর্যন্ত পারে। তার লাইব্রেরি বাংলা বইয়ের সমুদ্র একখানা। দেখলে তোমার তাক লেগে যাবে। কলকাতা থেকে বই আসে না এমন মাস যায় না।

অবাক হবারই কথা। কাপড়ের কলের সঙ্গে সাহিত্য বস্তুটার কতটা মেশা সম্ভব–সেই সংশয়। বললাম, ওঁর তো মস্ত কটন্ মিল শুনেছি।

-হ্যাঁ। বিগেস্ট।

–উনিই চালান?

–সব তার নখদর্পণে।

লেডির লর্ড কি করেন?

মুচকি হেসে জবাব দিল, আইনত লর্ড নেই।

তেমন প্রাঞ্জল ঠেকল না কানে। জিজ্ঞাসা করলাম, ছেলে পুলে কি?

তুমি একটি গণ্ডমূর্খ। ছেলে-পুলে থাকতে হলে একটি স্বামীর দরকার হয়।

আমি অপ্রস্তুত।–কেন, বিধবা নন?

-না। অধবা।

শোনামাত্র যে অনুভূতিটা প্রবল হল, তার নাম কৌতূহল। এই কাহিনীর সূত্রপাত তখনি ঘটে গেল কিনা জানি না। ত্রিপুরারির গাম্ভীর্যটুকু খুব অচপল মনে হল না।

-বয়েস কত?

–গোটা চল্লিশ হতে পারে।

সম্ভাব্য কাহিনীটা একটু নিষ্প্রভ হবার দাখিল। তবু বললাম, একেবারে হতাশ হবার মতো নয়, চেহারা স্বাস্থ্য-টাস্থ্য কেমন?

ত্রিপুরারি ঘুরে বসল।–কি মতলব?

–কিছু না। কেমন?

ত্রিপুরারি কাব্য করতে জানে না। তবু যা বলল, খুজলে একটু কাব্যের ছোঁয়া মিলতে পারে। সামনে এসে দাঁড়ালে হিসেব-পত্র ভুল হবার মতো। দেখলে চল্লিশ বছর বয়সের থেকে গোটা পনেরো বছর অন্তত ঝেটিয়ে বাদ দিতে ইচ্ছে করবে। তোমাদের তো করবেই, চল্লিশ নিয়ে কবে আর কারবার করে তোমর-ও বয়েসটা কেবল মাসি পিসির ঘাড়ে চাপিয়ে বেড়াও।

অ্যাকাউন্টেন্ট যেন আমিই, বললাম, চল্লিশের হিসেব নিয়ে এগনোর ব্যাপারেও অনভ্যস্ত নই খুব। মোট কথা তুমি তাহলে লেডিকে চল্লিশ মাইনাস পনের ইজ, ইকোয়াল টু পঁচিশের চোখে দেখো?

–আমি? আমি তাকে দেখলে চোখে শুধু সর্ষেফুল দেখি।

–তোমার সঙ্গে ভাব-সাব কেমন?

জবাব দিল, ভাব-সাব বলতে সুনজর খুব। এতবড় ব্যবসার চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট একজন বাঙালী হবে এটা কেউ চায়নি। সতেজনে সতের রকম পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু আগের বুড়ো চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট রিটায়ার করার সঙ্গে সঙ্গে কাউকে একটি কথাও জিজ্ঞাসা না করে লেডি যা করা উচিত তাই করলে, চোখ-কান বুজে সরাসরি আমাকে তার জায়গায় বসিয়ে দিলে।

গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করলাম, একেবারে বসিয়ে দিলে, না কিছু বাকি আছে?

খটকা লাগল, কিন্তু ঠিক বুঝে উঠল না। বোকার মতো জিজ্ঞাসা করল, কি বললে?

বললাম, তোমার আশা কি? বক্তব্য আরো প্রাঞ্জল না করলে ওর হিসেবী মাথায় ঢুকবে না।–ঘরে তো সেই কবে একটিকে এনে বসে আছ–তার মারফত আরো কটি এসেছে খবর রাখিনে–ছেলে পুলে কি তোমার, তিনটে না চারটে?

হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক, তারপর আস্তে আস্তে বোধগম্য হল যেন। ড্রাইভার বাংলা বোঝে না, তাও সচকিত। মুখখানা দেখার মতই হল তারপর। কোনো দেবী অথবা দেবী সদৃশাকে ভুল রসিকতার মধ্যে টেনে আনতে দেখলে ভক্ত যেমন বিচলিত হয়, ত্রিপুরারির মুখের সেই অবস্থা। চুপচাপ খানিক চেয়ে থেকে মন্তব্য করল, তুমি একটা রাসকেল! হেসে ফেলল।একটু আগে বল’ছাম, আইনত লেডির কোন লর্ড নেই, সেটা কানে গেছে?

-গেছে।

-কিন্তু আইনের বাইরে একজন আছে। সে-খবর রাখে না ছেলে বুড়ো মেয়ে-পুরুষের মধ্যে এমন একজনও পাবে না। জেনেও সকলে শ্রদ্ধাই করে তাদের। চাপা রসিকতায় বলার ধরন তরল হয়ে আসছে ত্রিপুরারির।

–লর্ডটি কে?

–শঙ্কর সারাভাই–সে-ও মস্ত কটন মিলের মালিক, ব্যবসায়ে আমাদের লেডির সঙ্গে কী কপিটিশন। সেই রেষারেষি দেখলে তুমি ভাবও একজন আর একজনকে ডোবাবার ফিকিরে আছে কেবল। এই দুদিন আগেও লেডি তার মিলের একজন ভালো মেসিনম্যান ভাঙিয়ে আনতে পেরে মহা খুশি। পরে জানা গেল সেই ভাটিয়া ভদ্রলোক দিনের বেলাতেও হোম-মেড, নেশা করত বলে শঙ্কর সারাভাই তিনবার ওয়ানিং দিয়ে তাকে বরখাস্ত করেছে।

-হোম-মেড নেশা কি রকম?

—এখানে নেশার বস্তু দুর্লভ।

–আগ্রহ বোধ করার মতো কিছু রসদের ঘ্রাণ পাচ্ছি মনে হল। জিজ্ঞাসা করলাম, শঙ্কর সারাভাইয়ের বয়েস কত?

ভুরু কুঁচকে ত্রিপুরারি ভাল একটু। হিসেবে ভুল করা তার বীতি নয়। জবাব দিল, লেডির সঙ্গে আরো বছর পাঁচেক যোগ দাও।

—বিবাহিত?

চাপা কৌতুকে টসটস করে উঠল ত্রিপুরারির মুখ। সেই মুখ দিয়ে আধা কাব্য নিঃসৃত হল।-না, ওই এক রমণীবল্লভ।

এই প্রেমের সঠিক হদিস মিলল না। জিজ্ঞাসা করলাম তাদের মিলন-পর্বটি সমাধা হবে কবে-শ্মশান-যাত্রার আগে?

প্রসঙ্গ অন্য দিকে ঘুরে যেতে ত্রিপুরারির উৎসাহ বাড়ল। বলল, তাও হবে না, আবার হয়েও গেছে বলতে পারো। তোমরা সাহিত্যিক রাসকেলরা মিলন-পর্ব যাকে বলো, সে সম্বন্ধে সঠিক খবর দিতে পারব না। যা লেখো, পড়লে একা ঘরেও কান গরম হয়। মোট কথা, এ-ক্ষেত্রে আত্মার মিল, জাতের অমিল। সারাভাই বামুন নয়, যশোমতী পাঠক নিখাদ ব্রাহ্মণ-কন্যা….আজকালকার দিনে এখানে এরকম বাধা ঘোচেনি এমন নয়, কিন্তু ওদের ব্যাপারটা ঠিক সে রকম নয়।

ত্রিপুরারির প্রাথমিক রিপোর্ট অভিনব কিছু নয়, তবে মোটামুটি কৌতূহলোদ্দীপক। জিজ্ঞাসা করলাম, তা ব্যবসায় রেষারিষি খুব?

-খুব। আবার মিলও খুব। কোনো ব্যাপারে পরামর্শ দরকার হলে লেডি একমাত্র তার ওই লর্ডের শরণাপন্ন হয়। তা এতবড় কারবার চালাতে পরামর্শের তো হামেশাই দরকার। লর্ডটি সে ব্যাপারে উদার এবং মুক্ত-মস্তিষ্ক।


© 2024 পুরনো বই