ঘোষ সাহেবের বাড়ির এই পুজো দেখে সকলেই অভিভূত, মুগ্ধ। বলা বাহুল্য, এটুকু, শুধু নাম গান আর পরিবেশ গুণে। পুজো কারো মন কাড়েনি, ওই পটের প্রতিমাও না। মন কেড়েছে রাধা, যাকে মায়ের মেয়েই ভাবছে সকলে।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সেরে ঘরে ফিরতে রাত এগারোটা। ঘোষ সাহেব চুপি চুপি এক ফাঁকে বলে রাখলেন, আপনার কাল দুপুরেও নেমন্তন্ন, অবশ্য আসবেন.. ফাইন্যাল রাউণ্ড এখনো বাকি ভুলে যাবেন না।
এক ঘুমে রাত কেটে গেল। সকাল থেকেই মন টানছিল। তবু সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে গিয়ে হাজির হলাম। সকলেই ওই পুজোর ঘরে জমায়েত তখন। সকলে হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানালো। রাধা বেদীর কাছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। কালীর পট এরই মধ্যে আবার দেয়ালে উঠে গেছে। বেদীর ওপর। একটা মঙ্গল ঘট, তাতে বিল্বপত্র। খাট সরানো হয়েছিল, সেটাও আবার যথাস্থানে।
ঘোষ সাহেব জিগ্যেস করলেন, রাধার পুজো কেমন লাগল আগে বলুন।
সঙ্গে সঙ্গে মুখে একটু বিরক্তি ভাব এনে, রাধা বলল, বড়বাবু তুমি বড় দিক্ করো–
ঘোষ সাহেবের পাশে বসে বললাম, আমি তো-পাপী-তাপী মানুষ, তবে ভালোই লাগলো…
রাধার ঠাণ্ডা দু’চোখ সঙ্গে সঙ্গে সোজা আমার মুখের ওপর। মনে হল কিছু দেখে নেবার ছিল দেখে নিল। তারপর মন্তব্যের সুরে বলল, মনে অহংকারের ঠাঁই রেখোনি বাপু।
সকলেরই সজাগ দৃষ্টি। একটু অপ্রস্তুত মুখে ঘোষ সাহেব জিগ্যেস করলেন, এর অহঙ্কারের কি দেখলি?
জবাব, উনি পাপের কি জানেন তাপেরই বা কি জানেন? জগাই মাধাই পাপী ছেল? না তাপী ছেল? জাহির করাটাই অহংকার।
কে কি বুঝল জানি না, আমি অন্তত বুঝলাম না। তার মানে জগাই মাধাই হলেও উদ্ধার পেয়ে যাব বলছেন?
হাঁ হয়ে চেয়ে রইলো একটু।-ও বড়বাবু তোমার বন্ধু যে আমাকে আপুনি আজ্ঞে করে কথা বলছেন গো! আমার দিকে ফিরল। বলি, রাধা কত মানী, না ঘুঁটে-কুড়নি রানী! আপনি-টাপনি করে কাজ বাড়ায়ো না বাবু।
হেসে বললাম, তাই না হয় হল, কিন্তু আমার কথার জবাবটা কি?
-কি আর, পাপ করার খ্যামোতা নেই যাদের তারাই পাপী পাপী বলে ডাই করে।
পিছনে লাগার সুরে ঘোষ সাহেব বললেন, সে ক্ষমতা ছিল বরং আমার–কি বলিস?
ঘরের সকলেই মজা পাচ্ছে, হাসছে। শমী বলল, বাবা তুমি কেন রাধা মাসিকে রাগাচ্ছ
কালো মুখের এটুকু বড় সুন্দর, তার থেকেও সুন্দর টানা চোখের সরল চাওনি। কাল এই দু’চোখই ভাবে একেবারে অন্যরকম দেখেছি। এখন কৌতুকের ছোঁয়া দেখছি। শমীর দিকে ফিরল, রাগব কেন, মিথ্যে তো নয়, তোর বাপের ছেল ক্ষ্যামতা বিসর্জন দেবার লড়াই, সে-লড়াইয়ে জিতেছে, ক্ষ্যামতা নাশের ক্ষ্যামতা কম কথা নাকি।
ঘোষ সাহেবের তৎক্ষণাৎ রণে ভঙ্গ দেবার মুখ। দোর গোড়ায় হীরুও সেই থেকে দাঁড়িয়ে। তাকেই তড়পে উঠলেন, গদগদ হয়ে কেবল তোর মা-কেই দেখবি না আমাদের খেতে-টেতে দের কথা ভাববি? সে ছুট লাগাতেই কিছু যেন মনে পড়ল, আমার দিকে ফিরলেন, ভালো কথা আপনি বোম্বাই উড়ছেন কবে?
দিন বললাম। মাঝে চার দিন বাকি।
–টিকিট করা হয়ে গেছে?
হয়ে গেছে তিনিও জানেন। বললাম, আজ বিকেলের মধ্যে করে নেব-পেয়ে যাব।
ঘোষ সাহেব ছেলেমেয়ে জামাইদের দিকে ফিরলেন। বললেন, উনি যাচ্ছেন বলেই বোধ হয়…আজ সকালেই মনে হচ্ছিল বছরে পর বছর একই জায়গায় পড়ে আছি, এই মওকায় ওঁর সঙ্গে একটু ঘুরে এলে কি হয়?
সকলেই ভেবাচাকা খেল, এমন প্রস্তাবের জন্য কেউ প্রস্তুত নয়। কি বলবে ভেবে না পেয়ে শমী তার রাধা মাসির দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে ঘোষ সাহেব রাধাকেই জিগ্যেস করলেন, তুই কি বলিস…ইচ্ছে যখন হচ্ছে একবার ঘুরেই আসি? তারও জবাব পাবার আগে আমার দিকে ফিরলেন, আপনার অসুবিধে হবে না তো মশাই?
ঘাবড়ে যাওয়া মুখ করে বললাম, ইচ্ছেটা আপনার নিজের খরচে ত?… আমার যাতায়াতের ব্যাপারটা অন্যের ঘাড়ে…
ঘোষ সাহেব হাসিমুখে দাবড়ানি দিয়ে উঠলেন, আপনার ঘাড়ে যেতে আমার বয়ে গেছে–রাধা কিছু বলছিস না যে, মত নেই নাকি?
রাধার শান্ত মুখ। তাঁকেই জিগ্যেস করলেন, বাবুটি কি কাজে যাচ্ছেন?
আমি নিষ্কৃতি পেলাম, শমীই সোৎসাহে তাকে বম্বে যাবার হেতু বোঝালো। শোনার পরেও নির্লিপ্ত। ঠাণ্ডা দু’চোখ এবারে আমার দিকে।–কত দিনের জন্য যাওয়া?
বললাম, কাজ এক দু’দিনেই হয়ে যেতে পারে, যাচ্ছি যখন পাঁচ সাত দিন কাটিয়ে আসার ইচ্ছে…তবে এর জন্য দুশ্চিন্তা করে যদি আগেও ফিরতে পারি
আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল। একটুও দুশ্চিন্তা নেই, এখেনে একঘেয়ে লাগারই কথা, যাচ্ছ যখন ভালো করে দেখিয়ে শুনিয়ে নিয়ে এসো, ফেরার তাড়া কোরো না
আমি মনে মনে হাঁপ ফেলে বাচলাম। এরপর মেয়ে-জামাই ছেলে-বউ সকলেই খুশি। তাদের প্রিয়জন অনেক কাল বাদে একটু বাইরে ঘুরে আসতে যাচ্ছেন। খেতে বসে শমী তত তার বাবার অভ্যেস টভ্যেস সম্বন্ধে অনেক কথাই আমাকে সমঝে দিতে চেষ্টা করল।
ঘোষ সাহেব গম্ভীর।–নাবালক নিয়ে যাচ্ছেন, ভালো করে শুনে রাখুন চোর ডাকাতের সঙ্গে বন্দুক আর রিভলবার নিয়ে মোকাবিলা করত সে হল অংশুমান ঘোষ…কারো বাবা তো নয়।
মেয়ে হেসে ফেলল।–বেশ। তুমি আর সেই লোক আছ?
.
সকালের প্লেনে যাচ্ছি। বেলা সাড়ে বারোটার মধ্যে পৌঁছনোর কথা। কলকাতার স্পেশালিস্ট ডাক্তার যে ভদ্রলোকের কাছে চিঠি দিয়েছেন পারলে তার সঙ্গে আজই যোগাযোগ করতে বলেছেন।
প্লেন আকাশে ওড়ার আধঘণ্টা খানেক বাদে ঘোষ সাহেব হাসি মুখে আমার দিকে ঘুরলেন।আপনি সেই থেকে কি ভাবছেন বলে দেব?
-কি ভাবছি?
-যে টেস্ট করাতে যাচ্ছি তার রিডিংএ কি বেরুবে–একশ চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ ইউনিট না একশ ষাট, বিনাইন না ম্যালিগন্যান্ট।
একটু চুপ করে থেকে জিগ্যেস করলাম, আপনি কি ভাবছেন?
-আমিও এই ভাবছি, তবে একটু অন্যভাবে।
–কি রকম?
হাসছেন।– কালীপুজোর পরে রাধা বরাবরই আমার পায়ে ওই রকম মাথা রেখে প্রণাম করে…ভাবছি, কোনবার কাঁদে না, এবারে ও এত কাঁদল কেন?
ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। বললাম, ভক্তি আবেগের ব্যাপার, বেশি-কম তো হতেই পারে।
–তা পারে। হাসছেন। আবার টেস্ট-এর রেজাল্ট একশ ষাট বা তার বেশিও হতে পারে…আমি বিজ্ঞান-টিজ্ঞান ভুলে গেছি মশাই।
বেশ নাড়াচাড়া খেলাম। তারপর রাগত সুরেই বললাম, আমি খুব আশা নিয়েই যাচ্ছি, এক বছরের ওপর হয়ে গেল আপনি একই রকম আছেন, আগে থাকতে আমার মেজাজ খারাপ করে দেবেন না।
–ঠিক আছে ঠিক আছে। মুচকি হেসে তিনি জানলার দিকে মুখ ফেরালেন।
মুখে যা-ই বলি আমার মনটা দুশ্চিন্তায় ছেয়েই থাকল।
বম্বে পৌঁছে পরিচিত এক মাঝারি হোটেলে উঠলাম। পরিচ্ছন্ন, ব্যবস্থাপত্র ভালো। পছন্দমতো ডবল-বেডের ঘর পেলাম।
খাওয়া দাওয়া বিশ্রামের পর বিকেলের মধ্যে চিঠি আর রিপোর্ট গুলো নিয়ে দু’জনে বেরুলাম। ট্যাক্সিঅলাকে ঠিকানা বলতে সে সহজেই পৌঁছে দিল।
ভদ্রলোক চিঠিটা ভালো করে পড়লেন। রিপোর্ট দেখলেন না। জানালেন তিনি ডাক্তার নন, ম্যানেজমেন্টের একজন। অ্যাডভাইস আর রিপোর্টগুলো নিয়ে পরদিন সকালে যশলোক হাসপাতালের ওমুক ডিপার্টমেন্টে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন।
পরদিন ঠিক সময়ে আমরা উপস্থিত। সেই ভদ্রলোক আমাদের যেখানে নিয়ে গেলেন সেখানে দু’জন ডাক্তার বসে। দুজনেই অবাঙালী। অ্যাডভাইস দেখলেন কলকাতার যাবতীয় রিপোর্ট খুটিয়ে পড়লেন। খানিকক্ষণ ধরে গলাও পরীক্ষা করলেন। তারপর চার্ট দেখে দু’দিন পরের ডেট দিলেন, সকালে ওমুক সময় টেস্ট হবে।
এই দুটো দিন রোগ নিয়ে আমরা একটি কথাও বললাম না। এমন কি রাধা প্রসঙ্গেও কোনো কথা নয়। বম্বে শহর ঘোষ সাহেবের কাছে বলতে গেলে নতুন, চাকরি জীবনের শেষের দিকে একবার এসেছিলেন, যে ক’দিন ছিলেন কাজের চাপে নাওয়া খাওয়ার সময় মেলেনি। ঘুরে ঘুরে তাঁকে শহর আর শহরতলী দেখালাম।
যথা সময়ে টেস্ট হয়ে গেল। ঘোষ সাহেবের মুখ দেখে কিছু বোঝা যায় নি, রিপোর্ট হাতে না আসা পর্যন্ত আমারই সংকটের মধ্যে কেটেছে। রিপোর্ট আসার পর অনিশ্চয়তার অবসান ঘটে, কিন্তু এতটুকু সুন্তি বোধ করার কোনো হেতু নেই। ইলেক্ট্রোগ্রাফিক রিডিং একশ পঞ্চান্ন ইউনিট। আর মাত্র পাঁচ বাড়লে ক্যানসার ধরেই নিতে হবে।
ডাক্তার দুটির সঙ্গে আলোচনা করে বোঝা গেল গ্রোথের পোজিশন ‘হাইলি ট্র্যানজিটারি’, তবে একশ পঞ্চান্নতে এসে দীর্ঘকাল থেমে আছে কিনা সেটা আগে আর এ টেস্ট করা হয়নি বলে বোঝ যাচ্ছে না। তাদের মতে যথাযথ চিকিৎসা করে মাস তিন চার বাদে আবার এই টেস্ট করা উচিত, তবে এর মধ্যে যদি গলার ট্রাবল বাড়ে তাহলে আমরা আগেই আবার এ টেস্ট করা উচিত।
আমার প্রশ্ন, একশ পঞ্চান্নয় কত দিন থেমে থাকতে পারে?
তাঁদের জবাব, পাঁচ সাত দশ বছরও একই ভাবে থাকতে পারে আবার পাঁচ সাত মাসও না থাকতে পারে। এ কাউন্ট কমতেও পারে না এমন নয়, তবে যাতে না বাড়ে সে চেষ্টাটাই একমাত্র চিকিৎসা এখন। কি করা উচিত কলকাতার ডাক্তার এই রিপোর্ট দেখে তিনিই স্থির করবেন।
আমার ইচ্ছে করছিল সেই বিকেলের ফ্লাইটেই কলকাতা ফিরে আসি। মন সত্যি বিগড়ে গেছে। কিন্তু ঘোষ সাহেবের অন্য মেজাজ। তিনি আরো দিন তিনেক থেকে যাওয়ার জন্য জোর করলেন। রাতে রসিকতার সুরে বললেন, এখন ফিরে গেলে আপনার মুখ দেখলেই লোকে কিছু একটা বিপদ আঁচ করবে। তারপর একটা বালিশ কোলের ওপর টেনে নিয়ে হাসি হাসি মুখে বলেছেন, আমার মনের কথা শুনলে আপনার বিশ্বাস হবে?
চেয়ে আছি।
কালীপুজোর রাতে রাধার সেই পায়ে মাথা রেখে কামা দেখে আমি ধরেই নিয়েছিলাম এখানকার রিপোর্ট অবধারিত একশ ষাট দেখব। ভেবেছিলাম সে সমূহ কোনো বিপদ দেখছে।
চুপ করে আছি। সমূহ বিপদ নেই সেটা এখনো তো ভাবার মতো কোনো আশ্বাসই নেই। আমার মুখের দিকে চেয়ে ঘোষ সাহেব এটুকু বুঝে নিলেন বোধহয়। আস্তে আস্তে বললেন, সেই রাতে আমার মনের দিক থেকে আরো কিছু ব্যাপার ঘটেছে যার কোনো কারণ নেই যুক্তি নেই ব্যাখ্যা নেই–এমন কি হেসে ওঠার ভয়ে কাউকে সেটা বলার কথাও নয়…মনের এই হঠাৎ ব্যাপারটা যে ঘটছে, ঘটেছে, সেটা অস্বীকার করি কি করে?
আমি আগ্রহ নিয়েই চেয়ে আছি। নিজে বিশ্বাস করি বা না করি, আমার জানার বাইরে, জ্ঞান বুদ্ধির বাইরে, বিশ্বাসের বাইরে পৃথিবীতে কত কি যে ঘটে যাচ্ছে সে-তে অস্বীকার করার নয়।
দুই শয্যায় দু’জনে মুখোমুখি বসে আছি। প্রসঙ্গ বদলে ঘোষ সাহেব জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা সেই কালীপুজোর রাতের পর থেকে আমাকে দেখে আপনার কেমন মনে হচ্ছে?
বললাম, আনন্দেই আছেন মনে হচ্ছে।
–আর সেটা মেকি বলেও মনে হচ্ছে তো?
অস্বীকার করতে পারলাম না। তাঁর এ ক’দিনের খোশ মেজাজ সত্যিই অকৃত্রিম ভাবিনি।
ঘোষ সাহেব রয়েসয়ে এরপর যা বলে গেলেন সেটা বিজ্ঞান-যুগের যুক্তিগ্রাহ্য কোনো ব্যাপার তো নয়ই, বিশ্লেষণ করতে বসলে নিছক ভাবাবেগ ছাড়া আর কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না।
…অংশুমান ঘোষের ধারণা, নিজেটের না পেলেও তার এই গলার নোগটা দু’বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে। এ-ধারণাটা হয়েছে যেদিন হুট করে রাধা এক দুপুরে নিজে থেকে বাড়িতে এসে নতুন ডাক্তার দেখানোর তাগিদ দিয়ে গেল।…মোটামুটি দু’বছরই হল (ঘোষ সাহেব। তখন তার কোয়াটার্সএ থাকেন) রাধা থেকে থেকে তার কাছে হাত জোড় করে অদ্ভুত একটা ভিক্ষে চায়। বলে, বড়বাবু, তোমার সব চিন্তা ভাবনা, সব বালাই আমাকে ভিক্ষে দাও। ভাবের কথা ধরে নিয়ে উনি তক্ষুনি হাসি মুখে মাথা নাড়েন, বলেন দিলাম।…একবার রাধা বেশ রাগ করেই বলল, কেবল মুখেই বলো, দাও কোথায়? দিলে তোমাকে নিয়ে আমার মনে ভাবনা জমছে কেন? এ-কথার কোনো অর্থ হয়, অর্থ নিয়ে ঘোষ সাহেব মাথা ঘামাননি।…কিন্তু নতুন ডাক্তার দেখাবার কথা যেদিন বলতে এসেছিল রাধা সেদিন শুধু ওই কথাই বলেনি, দস্তুরমতো রাগ আর অভিমানও করেছিল। বলেছিল, চোখ বোজার আগে দিদি (ঘোষ সাহেবের স্ত্রী) বলে গেল রাধা সব রইলো দেখিস–কিন্তু কাকে দেখব কে আমার কথা শোনে, কতবার হাত জাড কবে ভিক্ষে চেয়েছি, তোমার সব বালাই সব ভাবনা-চিন্ত। আমাকে ভিক্ষে দাও বড়বাবু–কিন্তু কে দেয়, রোগ-শোকের আমিটাও কে ছাড়তে চায়?
সেদিন থেকেই বিজ্ঞান-পড়া মানুষটার মনে ডাক দিয়েছে গলার রাগটা সহজ ব্যাপার নয়।…সহজ যে নয় কলকাতার ডাক্তাররাই তা বলে দিয়েছেন। তাবপব কালীপুজোর রাতে উনি দেখলেন অন্যান্য বারের তুলনায় বাধা অনেক বেশি ভাবের ঘোরে আছে, পুজোয় বসার আগে পর্যন্ত ছেলেমেয়ে জামাই বউ নাতি-নাতনির সঙ্গে কত-রকম ঠাট্টা মস্করা করে, এবারে একেবারে অন্যরকম। শেষে ঘোষ সাহেব সব থেকে বেশি ঝাঁকুনি খেলেন পুজোর পর তার পায়ে মাথা রেখে বাধাকে ও ভাবে কাঁদতে দেখে।…মঙ্গল-প্রদীপের শিখা তাঁর কপালে মাথায় বুকে পিঠে বুলোচ্ছিল যখন তখনো অনুভব করছিলেন ওর ভিতরে কেউ কাঁদছে আর সব আপদ মুছে তুলে নেবার জন্য আকুল হয়ে উঠছে। কিন্তু তারপর পায়ে মাথা রেখে ও-ভাবে কদল যখন, আর কোনো সন্দেহই থাকল না এখানকার টেস্টের ফলাফল কি পাবেন। একশ ষাটের বদলে একশ পঞ্চান্ন দেখেই তিনি বরং অবাক হয়েছেন।
…কিন্তু সেই কালীপুজোর রাতে যুক্তি বুদ্ধি ব্যাখ্যার বাইরে ঘোষ সাহেবের মনে যে ব্যাপারটা ঘটে গেছে সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। রোগের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই।
…রোগের লক্ষণ যে আদৌ ভালো নয় সে তত কলকাতার সার্জন আর ডাক্তারের কথা থেকেই বোঝা গেছে।
রাধার কান্নর আসল অর্থটাই তখন তিনি বুঝতে পারেন নি। কিন্তু ওই রাতেই পেরেছেন।
সেই রাতে ঘোষ সাহেবের সামনের ঘরে শোর ব্যবস্থা। কারণ বরাবরই রাধা পুজোর ঘরেই থাকে কি করে, ঘুমোয় কি ঘুমোয় না সে-ই জানে। ঘোষ সাহেবের শুতে শুতে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা। বিছানায় গা দেবার দেড় দু’মিনিটের মধ্যে ঘুম।
…হঠাৎ দেখেন, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, রাধা তার পায়ে মাথা রেখে ঠিক তেমনি করেই কাঁদছে। চোখের জলে দু’পা ভেসে যাচ্ছে। ঘোষ সাহেব বার বার বলছেন, ওঠ, ওঠ, রাধা ওঠ, যে ভিক্ষে চেয়ে আসছিস তা এবার আমি তোকে সত্যি দিলাম, আমার সব ভাবনা সব চিন্তা সব দায সব বালাই সব-সব তোকে দিলাম, তুই আমাকে সেই শক্তি দে, নিজের বলে আর যেন কিছু না রাখি।
না, স্বপ্ন-টপ্ন বড় একটা দেখেন না ঘোষ সাহেব সেই বাতে এই এক স্বপ্ন দেখলেন। তখন ভোব-ভোর, একটা হাত আপন থেকেই চোখে উঠল। চোখে জল।
ঘোষ সাহেব বলে উঠলেন, বিশ্বাস করবেন না মশাই, কি যে হয় গেল তার পর থেকে, আমার সমস্ত চিন্তা-ভাবনা হিসেব-নিকেশ যেন এই দেহটার অস্তিত্ব ছেড়ে গেল। এখানকাব রিপোর্ট ভালো পাব না ধরে নিয়েও বিশ্বাস করুন, তাবপ থেকে আমার এতটুকু উদ্বেগ নেই, বিনাইন হলেও ন’ ম্যালিগন্যান্ট হলেও না, বাঁচাব চিন্তাও নেই মরার চিন্তাও নেই, আগে মেযেটাব কথা ভেবে মন খারাপ হত দুশ্চিন্তা হত, তাও গেল।
এই অনুভূতি আমার বোধের অতীত, কিন্তু আমি একটুও অবিশ্বাস করছি না।
জানান দিয়ে হোটেলের বয় আমাদের ডিনার দিয়ে গেল। একটু বেশি সাভিস চার্জ দিয়ে দু’বেই আমরা ঘরে বসে খাই। খেতে খেতে আর একটি কথাও হল না। দু’জনার মুখ পোবার ফাঁকে বেয়ারা ডিশ-টিশ সরিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে চলে গেল। জিগ্যেস করলাম, মন হালকা বলছেন, এবারে বেশ আরাম কবে ঘুমোন বোধ হয়?
নিজের শয্যায় বসে পাশ বালিশটা কোলে টেনে নিয়ে অল্প অল্প হাসতে লাগলেন। বললেন, বোধহয় না, আপনার মনে যে সব প্রশ্ন জমে আছে তার জবাব সেরে না নিলে আপনার ঘুম হবে না।
শোনামাত্র আমি ভিতরে ভিতরে কত উদগ্রীব বুঝতে না দেবার চেষ্টা। হেসে বললাম, প্রশ্নতত এক দু’দিনের নয়, অনেক দিন ধরে অনেক প্রশ্ন জমা হচ্ছে…কিন্তু বলতে আপনারই আপত্তি ছিল, বলেছিলেন, কবর খুড়েও আবার তত্ত্ব-তল্লাসী হতে পারে।
ঘোড়ার ডিম পারে, আরে মশাই যখন বলেছিলাম তখন কি এই দিনের মত আপনি এত কাছের কেউ ছিলেন? লেখার আগে আপনি কি হলপ করে নেবেন, যা লিখছি সত্যি লিখছি, সত্যি বই মিথ্যে লিখছি না–না কি আমি গলা বাড়িয়ে দিয়ে বলব, দেখে প্রভুরা, লেখক বানিয়ে কিছু লেখেনি, তোমরা আমাকে বিচারের কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করাতে পারে। আমার একটা চুলের ডগাও কেউ ছুতে পারবে না, আর এখানকার মনের অবস্থায় তো আমি যম ব্যাটাকেও কেয়ার করি না।
স্পষ্টই মনে হল আমার শোনার আগ্রহ থেকে তাঁর বলার আগ্রহও কম নয়। আরব সাগরের কূলে হোটেলের দোতলার ঘরে মুখোমুখি বসে শোনার এমন সুযোগ বা পরিবেশ কলকাতায় পাব না।
ভূমিকা হিসেবে আমার প্রথম প্রশ্ন, আচ্ছা জয়নগরের যেখানে আপনি থানার ও সি ছিলেন সেখান থেকে মাতন…মানে যে জংলা গায়ে রাখা থাকে বলেছিলেন, সেটা কত দূর?
–মাইল আড়াই তিন হবে।
…সেখানকার থানার ও সি মানে তো প্রবল দাপট আর প্রতি পত্তির মানুষ, আড়াই তিন মাইল দূরের একটা গ্রাম্য মেয়ে আপনার নাগাল পেল কি করে?
ঘোষ সাহেব হেসে মন্তব্য করলেন, বেশ ধরে বেঁধেই শুরুটা করলেন। তারপর হেসে বললেন, ওর সঙ্গে আমার সত্যি আশ্চর্য ভাবে যোগাযোগ আজ থেকে তেইশ বছর আগে, ওর বয়েস তখন উনিশ…আর সেই বছরেই সবে আমি জয়নগর থানার চার্জ নিয়েছি।
…চৌষট্টি সালের মাঝামাঝি হবে সেটা। আমার তখন বছর চল্লিশ হবে বয়েস, কি কড়া মেজাজের মানুষ ছিলাম তখন আপনি ভাবতে পারবেন না, কিন্তু ওই মেজাজের মাথায় মেয়েটা প্রথম দিনেই একটা থাপ্পড় মেরে বসল।
শুনলাম। মনে দাগ ফেলার মতোই ছোট একট। প্রহসন বটে।
…থানার ও সি অংশুমান ঘোষের এগারো বছরের ছেলে দেবুর হঠাৎ ধুম জ্বর। একশ সাড়ে পাঁচ। রাত তখন প্রায় এগারোটা, গ্রাম দেশের মাঝ রাত। পাইক আর ডিউটির সাব ইনসপেক্টর ক’জন সাইকেল আর জিপ নিয়ে বরফ আর ডাক্তারের খোঁজে ছোটাছুটি করছে। ডাক্তারকে পাওয়া যাচ্ছে না, তিনি নাকি সাইকেলে চেপে পাশের গায়ের এক রোগী দেখতে গেছেন। রাতে ফেরার কথা তখনো ফেরেননি। ডাক্তারের পরিবার কি উপলক্ষে ছেলেপুলে নিয়ে তখন বাপের বাড়ি। রাতে ডাক্তারের ফেরার কথা শুনে দু’জন পাইক সেখানে অপেক্ষা করছিল, সাব ইনসপেক্টর জিপ নিয়ে চলে গেছে সেখানে।
পাইক দুজন ফিরল, তাদের সঙ্গে মাঝবয়সী দু’টো লোক আর এই একটা মেয়ে। অংশুমান তখন ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে ডাক্তারের আশায় থানার নিচের দাওয়ায় পায়চারি করছিলেন, আর এক-একবার ছুটে ওপরে গিয়ে ছেলেকে দেখে আসছিলেন।
এত রাতে দুই পাইকের সঙ্গে এই তিনজনকে দেখেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল। এত রাতে কি ব্যাপার?
মাঝবয়সী লোক দুটো হাত জোড় করে যা নিবেদন করল তার সার, তারা অমুক গায়ের লোক, হেঁটে বাড়ি ফিরছিল, কোথা থেকে এই মেয়েটা আলুথালু মূর্তিতে ছুটে এসে বলল, আমাকে বাঁচাও। শুনল তিনটে ডাকাত মুখ বেঁধে আর পিছমোড়া করে হাত বেঁধে ওকে কোন এক দূরে মাঠের ধারে চালা ঘরে নিয়ে গেছল, মা রক্ষা করবে বলেই ওকে ওমনি বেঁধে ফেলে রেখে ডাকাতরা ওকে ঘরের শিকল তুলে দিয়ে মদ কিনতে ছেল। মা-কালী তখন এক বুড়ী সেজে পিদিম হাতে এসে শিকল খুলে ওকে বার কবে দিয়ে বলেছে, শিগগীর পালা। এসে দেখতে না পেলে ও’ আবার তোর পেছনে ছুটবে, বাঁচতে চাস তো মরণ ছোটা ছোট।
লোক দুটো এ শুনেই ভয় পেয়ে গেছে, ওকে নিয়ে যে পথে আসছিল সে-পথেই পা চালিয়ে দিল। তখন মেয়েটা বলল, এ-পথেই আধকোশ (ক্রোশ) এগোলে ডাক্তারবাবুর বাড়ি, খুব চেনা লোক, সেখেনে ছাড়ি দিয়ে চলে যাও। তার কথা মতো সেই বাড়ি এসে শোনে ডাক্তারবাবু ভিন গেরামে, তার পরিবারের সব বাপের বাড়ি– আর সেখানে এই দু’জন পাইক বসে সব শুনে তারা বলল তারা থানার লোক, বড়বাবুব ছেলের অসুখ তাই ডাক্তারের জন্য বসি আছে, এতক্ষণে ডাক্তারকে লিসপেক্টর বাবু জিপে তুলে নে চলে গেছে, ডাকাতের কেস বলছ এতে রতে থানার জিম্মায় রেখে আসাই ভালো –তাই নে এসেছে।
অংশুমান এবার মেয়েটাকে ভালো করে দেখলেন। আঠেরো উনিশ বছরে সোমত্ত মেয়ে, কালো। এপর মিষ্টি মুখ, ডাকাতে ধরে নিয়ে গেছল বলছে, হাত মুখ বেঁধে ফেলে রেখে গেছল-কিন্তু তার চোখে মুখে এখন অন্তত ভয় বা উদবেগের কোনো চিহ্ন নেই।
ভুরু কুচকে জিগ্যেস করলেন, তোর নাম কি?
–রাধা।
–কোথায় থাকিস?
–মাতন গাঁয়ে।
অংশুমান নতুন এসেছে, জিজ্ঞেস করলেন সেটা কোথায়?
–বিষ্টুপুরের পথে।
মেয়েটার কথাবার্তা পরিস্কার আর মুখ দেখে এতবড় বিপদ ঘটেছে বোঝাই যায় না। সন্দিগ্ধ হয়ে উঠলেন, তোর বাড়িতে কে আছে?
-কেউ নাই।
–ডাকাতরা তোকে কখন ধরে নিয়ে গেছল?
–তা এখন দেড় দু’ঘণ্টা হবে।
আশুমান ঘড়ি দেখলেন, তখন রাত এগারোটা। জিগ্যেস করলেন, ডাকাতরা তোকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গেল কেউ টের পেল না?
তা কেন গো, আমি তো বিবি মায়ের স্থান থেকে জাঙল পথে ঘরে ফিরতিছিলাম, সিখেনে ওই তিন ডাকাত ওঁত পাতি ছেল, পলকে মুখ বেন্ধে তুলি নিয়ে চলি গেল, অনেক পথ হাঁটি একটা খেতির ধারের ক’টা খোল ঘরের একটাতে আনি তুলল, তারপর আমাকে পিছমোড়া করি বান্ধি রেখে ঘর বন্ধ করে ফুত্তি করার জন্যি চোলাই আনতি চলি গেল, তখন
পরের কথা অংশুমান আগেই শুনেছেন, আর শোনার ধৈর্য থাকল না। জোরেই ধমকে উঠলেন, ডাকাতে তুলে নিয়ে যাবে বলেই রাত ন’টার পরে একলা মেয়েছেলে তুই জঙ্গল পথে ঘরে ফিরছিলি কেমন? পাইক দুটোর দিকে ফিরে বললেন, একে বাতের মতো কোনো ঘরে ফেলে রাখ–ও কি-রকম ভাঁওতাবাজ মেয়ে কাল বুঝব।
মেয়েটা চকিতে একবার পাইক দুটোকে দেখল। অংশুমান তখন আবার ছেলেকে দেখে আসার জন্য ভিতরের দিকে পা বাড়িয়েছেন। পিছন থেকে মেয়েটা বলে উঠল, ও বড়বাবু, তিনটে নেকড়ের হাত থেকে বাঁচি এলাম, আর ইভেনে এনে আমাকে তুমিই দুটো হাঙরের জেম্মায় রেখে যাচ্ছ। রেতে যে ওরাই আমাকে ছিঁড়ে খাবে!
অংশুমান ঘুরে দাঁড়ালেন। আশ্চর্য, এখানে এসেই থানার ঠিক এই দুটো লোকের সম্পর্কেই গোপন রিপোর্ট পেয়েছেন, চাকরির সুযোগ নিয়ে ওরা গায়ের কয়েকটা মেয়ের সর্বনাশ করেছে ওই দু’জনের চরিত্র অতি মন্দ।
বড়বাবু ঘুরে না দাঁড়ালে রাগের চোটে ওরা হয়তো মেয়েটাকে মেরেই বসত। চোখ লাল করে ওর দিকে চেয়ে রইলো। মেয়েটা আবার বলল, ছেলের জন্য তোমার কোনো চিন্তা নাই গো বড়বাবু, তোমার মুখে শোকের চেহ্নও নাই, তোমার বউ ছেলেমেয়ে আছে, রেতের মতো একটু ঠাঁই দাও পড়ে থাকি, ডাক্তারবাবুটি আলেই বুঝতে পারবে উনি কত ভালবাসেন আমাকে–উনি আসেন বলে–ওনার পরিবার থাকলে আর থানাতক আসতাম না, তার কাছেই থাকি যেতাম।
ডাক্তারবাবুর কথা শুনে দাপটের বড়বাবুটির আরো একটু থমকাতে হল। কি ভেবে বললেন, আচ্ছা আয়
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ছোট্ট চত্বরটুকু দেখিয়ে বললেন, এখানে বসে থাক্।
তিনি ভেতরে চলে গেলেন। ছেলে তখনো রাগজরে বেহুশ, কপালে জলপট্টি, আইস ব্যাগের বরফ ফুরিয়ে এসেছে, এত রাতে আরো বরফের খোঁজে যারা গেছে তারা এখনো ফেরেনি। এদিকে এখনো ডাক্তারের দেখা নেই। অংশুমানের স্ত্রী ভয়ে আতঙ্কে অস্থির। হঠাৎ মহিলাকে অবাক মুখে পাশের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে অংশুমান ঘুরে দেখেন তার আধ-হাত পিছনে সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে। রেগে উঠতে গিয়েও থমকালেন, কারণ মেয়েটা খুব খুটিয়ে অপলক চোখে তার ছেলেকেই দেখছে।
পনেরো বিশ সেকেণ্ড পরেই খুব নিশ্চিন্ত করার সুরে বলল, কোনো ভয় নাইগো তোমার বড়বাবু, এখার তড়াসে জ্বর, ঠাণ্ডা জল আনি ছেলের সর্ব অঙ্গে বেশ করে ছিটিয়ে দাও জ্বর নামি যাবে।
শোনামাত্র অংশুমানের মাথায় রক্ত উঠল। একশ সাড়ে পাঁচ ছয় জ্বর ছেলের। বলে কিনা ঠাণ্ডা জলে গা ধুয়ে দাও! চাপা হুংকার দিয়ে উঠলেন, তোকে কে এখানে আসতে বলেছে?
ফ্যালফ্যাল করে কয়েক পলক চেয়ে থেকে বেরিয়ে গেল। সিঁড়ির ও-পাশের অন্ধকার দিকটাতে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলো।
এর তিন চার মিনিটের মধ্যে ডাক্তার এলেন। অংশুমান হন্তদন্ত হয়ে সর্ধেক সিঁড়ি নেমে তাকে নিয়ে এলেন। ও-দিকের অবস্থা অন্ধকারে কে বসে কেউ খেয়াল করলেন না, অংশুমান তখন ছেলের রোগের কথা বলতে ব্যস্ত। ডাক্তারটির নাম বিজন চৌধুরী, বয়সে অংশুমানের থেকে কিছু ছোট।
ডাক্তার চৌধুরী সমাচার শোনার পর বেশ করে রোগী দেখলেন তারপর বললেন, বড় বালতির এক বালতি ঠাণ্ডা জল আর দুটো বড় তোয়ালে অনিতে বলুন। বড় একটা অয়েল ক্লথও দরকার।
দু’মিনিটের মধ্যে এসে গেল। অংশুমান আর তাঁর স্ত্রী বলেন, অত রাগজ্বর বলে বেশ করে মাথা ধুইয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি যা বললেন আর করলেন, তারা স্বামী-স্ত্রীতে হাঁ।
ছেলেকে চাপাচুপি দিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছিল, ডাক্তার সে-সব নিজেই টেনে সরালেন, তারপর বললেন, গা থেকে জামা গেঞ্জি সব খুলে নিন, পরনের প্যান্টও।
খোলা হল। ছেলে তখনো বেহুশ, সম্পূর্ণ নগ্ন। এ-কাত ও-কাত করে তাকে অয়েল ক্লথের ওপর শুইয়ে দেওয়া হল। ডাক্তার শার্টের হাত গুটিয়ে একটা তোয়ালে বালতির জলে ডুবিয়ে বললেন, আর এক বালতি ঠাণ্ডা জল রেডি রাখুন তার স্ত্রীকে বললেন, আমি বললেই ওই শুকনো তোয়ালে দিয়ে আপনি মুছিয়ে মুছিয়ে দিয়ে যাবেন।
বালতির ঠাণ্ডা জলে ভোয়ালেটা সপনপে করে ভিজিয়ে অনেক বার মাথা কপাল মুখে বেশ করে চাপড়ে দিলেন, শেষ বারে তোয়ালের জল নিঙড়ে মাথায় মুখে দিলেন। এর নাম স্পঞ্জ নয়, যাকে বলে ভেজা ভোয়ালে দিয়ে ঠাণ্ডা জলে স্নান করানো।
ডাক্তার নিজেই ছেলেকে এ-পাশে টেনে কাত করে বললেন, অয়েল ক্লথটা বেশ করে মুছে ফেলুন তারপর ছেলেকে এর উপুড় করে শুইয়ে দ্বিতীয় বালতির ঠাণ্ডা জলে বার বার তোয়ালে ভিজিয়ে ঘাড় থেকে পিঠ কোমর আর দু’পা পর্যন্ত একই ব্যাপারের মোহড়া চলল। সব হয়ে যেতে শেষ বার শুকনো তোয়ালে দিয়ে আবার সর্বাঙ্গ বেশ করে মুছে দেবার পর অয়েল ক্লথ সরিয়ে দেওয়া হল। গলা পর্যন্ত একটা পাতলা চাদরে ঢাকা হল। ডাক্তার মাথার ওপর পাখাটা কেবল একটু কমিয়ে দিতে বললেন। ছেলে তখন চোখ মেলে চারদিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে। ব্যাগ থেকে দুটো বড়ি বার করে তাকে খাওয়ালেন। কাগজ নিয়ে একটা প্রেসকৃপশন লিখে বললেন, কালকের মধ্যে রেমিশন হয়ে যাবে আশা করছি, তবু এ ওষুধটা খাইয়ে যাবেন।
আরো মিনিট পনেরো বসে থেকে টেম্পারেচার নিলেন। জ্বর একশ দুই। চেয়ার ছেড়ে উঠে আশ্বাস দিলেন, কোনো ভয় নেই, হীট স্ট্রোকে এখানে এ-কম সাংঘাতিক জ্বর হয়…কালও ঠিক এ ভাবে নয়, ঠাণ্ডা জলে একবার স্পঞ্জ করিয়ে দেবেন আর বাই চান্স জ্বর বাড়লে আমাকে খবর দেবেন।
সাড়ে পাঁচ ছয় জ্বরের রোগীকে ওভাবে সপসপে করে চান করানো আর মোছার সময়েও অংশুমান থেকে থেকে স্ত্রীর দিকে তাকাচ্ছিলেন, স্ত্রী-ও তার দিকে। এখনো দু’জনে দু’জনের দিকে তাকাচ্ছেন। দু’জনেরই বার বার অজানা অচেনা মেয়েটার কথা মনে পড়ছিল।
তারা ডাক্তারকে নিয়ে সিড়ির দিকে এগোলেন। অংশুমান সামনের দিকে চেয়ে ডাকলেন, এই–কি-যেন নাম তোর…রাধা এদিকে আয়।
সিড়ির ও-পারের অন্ধকার আলসে থেকে রাধা পায়ে পায়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখেই ডাক্তার হতবাক! এ কি কাণ্ড! রাধা, এত রাতে তুই এখানে…থানায়!
জবাব না দিয়ে রাধা হাটু মুড়ে বসে আগে তাকে প্রণাম করল তারপর উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে জিগ্যেস করল, আগে বলো ওই খরা জ্বরের রোগীকে তুমি বেশ করে ঠাণ্ডা জলে চান করালে কিনা?
ডাক্তার অবাক। করালাম তো, তাতে কি?
–কিছু না, এটা বড় মেজাজের জায়গা, আমাকে তোমার সঙ্গে নে চলো
হতবুদ্ধির মতো ডাক্তার ঘোষ দম্পতির দিকে তাকালেন। অংশুমান জিগ্যেস করলেন, আপনি তাহলে একে ভালোই চেনেন?
-আমি তো চিনিই, আমার স্ত্রী মানে ওর ‘ডাক্তার দিদি’ নিজের ছোট বনের মতো দেখে কিন্তু ও এত রাতে এখানে কেন?
অংশুমান তখনো সন্দিগ্ধ গলায় বললেন, ও বলছে রাত ন’টায় জঙ্গলের পথে কোন্ থান থেকে একা ফিরছিল, তিনটে ডাকাত তখন ওর মুখ বেঁধে কোথায় নিয়ে গিয়ে তুলেছিল, কোন্ ফাঁকে মা-কালী এক বুড়ী সেজে ওকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে
ডাক্তার চৌধুরী থমকালেন একটু, তারপর বললেন, একটু দাঁড়া তুই। সোজা বাবার অংশুমানের ভিতরের ঘরে চলে এলেন। ওঁরা স্বামী-স্ত্রী পিছনে আসবেন জানা কথাই। গলা খাটো করে ডাক্তার জিগ্যেস করলেন, আপনি কি ওকে এখানে এনে বকা-ঝকা করেছেন নাকি?
অংশুমান অপ্রস্তুত একটু। তার স্ত্রী সুচার দেবী চাপা ঝাঝালো গলায় বলে উঠলেন, পুলিশের মেজাজ, বকা-ঝকা করবে না। দোষের মধ্যে আপনি আসার আগে ছেলেকে অত জ্বরে ছটফট করতে দেখে মেয়েটা বলেছিল, ও কিছু না, বেশ করে ঠাণ্ডা জলে চান করিয়ে দাও, তাইতেই উনি ক্ষেপে গিয়ে বললেন, ঘাড় ধরে তোকে রাস্তায় বের করে দেব–আর আপনি কিনা এসেই ও যা বলল তা-ই করলেন। আমার বড় অদ্ভুত লাগছে মেয়েটাকে..কে বলুন তো?
এবারে ডাক্তার চৌধুরী হাসতে লাগলেন। বললেন, অদ্ভুত মেয়েই বটে, আমার অত বিশ্বাসও নেই বুঝিও না, আমার স্ত্রী বরং আপনাকে ওর সম্পর্কে অনেক কথা বলতে পারবেন…তবে ডাকাতে ধরে নিয়ে গেছল যদি বলে থাকে তবে সেটা ঠিক ধরে নিতে পারেন, ও মিথ্যে কখনো বলবে না।
রাগজ্বরের ছেলেকে সত্যি অত ঠাণ্ডা জলে স্নান করানোর ফলে সুস্থ হতে দেখে অংশুমান একটু অপ্রস্তুত হয়েছিলেন। এখানে এরকম হয় জানা থাকলে ওই দাওয়াই বাতলে দেওয়া এখন খুব একটা কৃতিত্বের ব্যাপার ভাবছেন না। স্ত্রীর ভাব-গতিক দেখে গম্ভীর শ্লেষে বললেন, ডাকাতরা ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে খালি ঘরে বেধে ফেলে রেখে ফুর্তি করার জন্য দল বেধে চলে গেল আর সেই ফাঁকে মা-কালী বুড়ী সেজে ওকে মুক্ত করল আর রক্ষা করল-এও তাহলে সত্যি ধরে নেব।
ডাক্তার হেসেই জবাব দিলেন, কাকতলীয় কি ঘটেছে তা বলতে পারব না …কিন্তু ওকে নিয়ে কি করা যায়, আমার স্ত্রী তো ছেলে পুলে নিয়ে তার বাপের বাড়ি, একটা রাত আপনাদের কাছে রাখতে খুব অসুবিধে হবে?
ব্যস্ত হয়ে সুচারু দেবী আগ বাড়িয়ে বললেন, আর কিছু অসুবিধে হবে না, আমি খুব যত্ন করেই ওকে রাখব
ডাক্তার আবার বেরিয়ে এলেন, ওঁরাও। সুচারু দেবী রাখার হাত ধরে বললেন, আমরা এখানে নতুন এসেছি বোন, তোমার কথা ডাক্তার বাবুর মুখে এই প্রথম শুনলাম, তোমার সঙ্গে তখন ও-ভাবে কথা বলা খুব অন্যায় হয়েছে, ডাক্তারবাবুর স্ত্রী ঘরে নেই, একটা রাত আমার কাছে থেকে যেতে তোমার কোনো অসুবিধে হবে না
মেয়েটা অংশুমান-গৃহিণীর আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নিল, তার পর ফিক করে হেসে বলল, মেজাজের ঘরে তুমি যে দেখি আনন্দময়ী গোতারপরেই সংশয়, কিন্তু তোর ওই বড়বাবু ফের জেরা করতে বসে আবার আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বার করতে চাইবে না তো?
সুচারু দেবী জোরেই মাথা নাড়লেন, না না, আমি তো বলছি!
গম্ভীর মুখে অংশুমান বললেন, কোনো চিন্তা নেই, মা-কালী বুড়ী সেজে তোকে রক্ষা করলেন আজ রাতের মতো না-হয় তাও বিশ্বাস করব।
শ্লেষটুকু স্ত্রীর উদ্দেশে।
ডাক্তার তাড়াতাড়ি বললেন, তোর কোনো ভাবনা নেই, ওঁরা খুব ভালো লোক।-বুঝলি?
কিন্তু বড়বার আগের কথা শুনেই রাধা অসন্তুষ্ট। ডাক্তারকেই ঝাঁঝিয়ে উঠল, তুমি ডাক্তারি করে শরীলের রোগ ধোভালোমল চেনার কত ক্ষ্যামোতা তোমার! তারপরেই দু’চোখ বড়বাবুর মুখের ওপর, যেন ভালো কি মন্দ যাচাই করার ক্ষমতা তার আছে। এবারে হাসিহাসি মুখ, সুচাৰু দেবীর দিকে ফিরল, খারাপ নয় গো দিদি তবে কড়া পুলিশ, বড়বাবুর অবিশ্বাসের রোগ ছাড়াতে তোমার প্রায় জেবন কেটে যাবে।
ডাক্তার চলে যাবার পরে ছেলের জ্বর আরো নেমে এসেছে সুচারু দেবী তার বিচিত্র অতিথি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু মেয়েটা সবরকম তোয়াজের চেষ্টা দু’কথায় নাকচ করে দিল। বলল আমি মেঝেতেই পড়ে থাকি, চাইছ যখন একটা চ্যাটাই দাও, তার বেশি সহ্যি হয় না। না না, খাবার ভাবনা কোরো না, তিন হাবাতে দেহটা ছানাছানি করে বয়ে নিয়ে গেছে-সকালে চানের আগে গলা দিয়ে কিছু নামবে না।
সুচারু দেবী চানের যোগাড় করে দিতে চাইলেন, একটু দুধ খাবার জন্য ঝোলাঝুলি করলেন। রাধা বিরক্ত ‘কেন দিক্ করছ বলো তো?’
অংশুমান স্ত্রীকে ডেকে বললেন, যেমন আছে থাকতে দাও, বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না।
সবে সকাল। বেশ মিষ্টি গানের গলা কানে আসতে অংশুমানের ঘুম ভেঙে গেল, বিছানায় উঠে বসলেন, দেখলেন স্ত্রী আগেই উঠে দোর গোড়ায় দাডিযে শুনছেন। অংশুমান ছেলের গায়ে হাত রাখলেন, গা ঠাণ্ডা। দু’কান আবার নিজের অগোচরে সজাগ। গ্রাম, সুবের বড় অদ্ভুত মিষ্টি গান। গলা ছেড়ে গাইছে না, আবার একেবারে আস্তে না।
ও মা, দেহ-জ্বর আসে যায়
ভব-জ্বর তো ছাড়ে না,
মন জ্বলে আর পরাণ জ্বলে
ও মা, তার বদ্যি তো মেলে না
দেহ-জ্বর আসে যায়
ওষুধ গুণে সেরে যায়
মা-গো, ভব-জ্বরে যে জর-জর
সে ওষুধ কোথায় পায়?
রাধা কয়, যা রে মন নিজ ধাম
তার ওষুধ মায়ের নাম।
স্ত্রী দু’হাত জোড় করে কপালে ঠেকালেন। কার উদ্দেশে এ প্রণাম অংশুমান বুঝলেন না। কোনরকম উচ্চাঙ্গের আহামরি গান কিছু নয়। কিন্তু আবেদনে এমনই মূর্ত যে সবল স্নায়ুর মানুষটাও কান পেতে না শুনে পারেননি।
সুচারু দেবী উঠে পায়ে পায়ে রাধার সামনে এসে দাঁড়ালেন। গান থেমেছে, কিন্তু চাউনি এখনো ভাবে তন্ময়। টেনে টেনে জিগ্যেস করল, ছেলে ভালো তো?
–ভালো। এমন গান তুমি কোথা থেকে শিখলে গো?
খুশি। –তোমার ভালো লেগেছে? …তোমার মনখানা ভালো তাই ভালো লেগেছে। কোত্থেকে আর শিখব, আমি কি আর মাস্টার রেখে গান শিখি? বাবা গাইত, কপালী বাবা গায়, শুনে শুনে যে টুকু শেখা যায়, আর মনে যা আসে গেয়ে যাই, আবার ভুলেও যাই–যা গাইছিলাম আবার বললে গাইতে পারব নি।
ঘরে দাঁড়িয়ে অংশুমান শুনছিলেন। হ্যাঁ, ভোরে এই গান শুনে ঘুম ভেঙেছে, ভালো লেগেছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এ ধরনের বোল-চালে বিশ্বাস করার লোক নন তিনি, এমন সুরেলা গলায় টেনে টেনে পদ আর ছন্দ মিলিয়ে গাইছিল, অথচ বলছে ফের গাইতে বললে পারবে না। এটা ভাবের বাহাদুরি ছাড়া আর কিছু ভাবলেন না অংশুমান।
–বড়বাবুকে বলে দিও আমি যাচ্ছি, এরপর রোদ চড়ে যাবে।
সুচারু দেবী ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, সে কি! কাল জলটুকুও মুখে দাওনি, আজ এক্ষুনি যাবে কি, আমাদের অকল্যাণ হবে না!
সরল হাসি আর জবাব কানে এলো অংশুমানের।–আমার জন্যি কোনো গেরস্তের কখনো অকল্যাণ হয় না গো দিদি-কিছু ভেবনি।
-না না তা হবে না, আমাকে দিদি বলেছ, কিন্তু আমি তোমার মায়ের মতো দিদি, আমার কথা না রাখলে আমি সমস্ত দিন না খেয়ে থাকব বলে দিলাম
-বড় ঝামেলা করো বাপু, চান করে আবার এই বাসি জামা কাপড় পরব?
–আমি ধোয়া জামা-কাপড় এনে দিচ্ছি।
তা হলে খুব ছেঁড়া-খোঁড়া কিছু দাও, তিন মাইল পথ ঠেঙিয়ে আমি আর ফেরত দিতে আসতে পারবনি।
ছেলে এখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছে। অংশুমান সেই খাটেই বসে। স্ত্রীকে ঘরে ঢুকে আলমারি খুলতে দেখলেন। তার এই ভাবাবেগের তিনি খুব দাম দ্যান না, কিন্তু এ নিয়ে খোঁচাখুচিও করেন না। আলমারি খুলে যা-যা নেবার নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চোখাচোখি। হাসি দেখেই ভ্রুকুটি।
–সব-কিছু অত তুচ্ছ কোরো না-বুঝলে?
কি নিয়েছেন সেটা এক-রকম আড়াল করেই দ্রুত চলে গেলেন। কিন্তু পরের কথাও অংশুমানের কানে এলেই।
ও-ঘরে রাধার গলায় রাজ্যের বিস্ময়।–শাড়ি সায়া ব্লাউজ সব যে একেবারে নতুন দেখছি–এত ভালো আমি কখনো দেখেছি না পরেছি-বললাম না ছেঁড়া-খোঁড়া কিছু দাও।
স্ত্রীর জবাব, দিদি কি তোকে এক প্রস্থ জামা-কাপড় দিতে পারে না? এত লজ্জা কিসের
লজ্জা! আমি ভিক্ষে করে খাই, আমার আবার লজ্জা! কি ভাগ্যি গো দিদি আজ আমার-কাল রেতে কালামুখোগুলো ও ভাবে বেন্ধে নে গেল বলে মনে খুব দুঃখ হয়েছিল–আর আজ মা কি দেল দেখো।
এঘরে বসে অংশুমান একটু ভুরু কোচকালেন।
স্ত্রীর অতিথিপরায়ণতা এরপর একটু বাড়াবাড়িই মনে হয়েছে অংশুমানের। চান করে আসার পর নিজে ওর চুল বাঁধতে বসে গেছেন। ওদিকে রাধুনিকে হুকুম করেছেন লুচি বেগুনভাজা আর তরকারি করতে। চাকরকে পাঠিয়েছে মিষ্টি আনতে। দু’জনের কথা বার্তাও কানে আসছে।
কালো হলেও কি সুন্দর চেহারাখানা তোর। কী মিষ্টি চোখ মুখ–এভাবে থাকিস কেন?
হাসি।–মা-কালী কালো করেছে বেশ করেছে, এর ওপর হদ কুচ্ছিৎ করলে আরো ভালো হত, নিশ্চিন্তে থাকতাম
-কেন? স্ত্রীর প্রশ্ন।
–বোঝো না? পাঁচ বাড়ি থেকে ডাক আসে, গান গেয়ে ভিক্ষে করে খাইলোকে সন্দ করতে ছাড়ে না পিছনে লাগতে ছাড়ে?
-কেন, তোর কেউ কোথাও নেই? স্ত্রীর গলায় স্নেহ ঝরা উৎকণ্ঠা।
নির্লিপ্ত গোছের সাদা-মাটা জবাব কানে এলো অংশুমানের।– বাবা মা, অনেক বড় দিদি আর একটা ছোট ভাই ছিল। মা ওর ন’বছর বয়সে সগগে চলে গেল, ভাইটা তখন পাঁচ বছরের। ওর থেকে আট বছরের বড় দিদির সবে তখন বিয়ে হয়েছে। বাবা হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে গান গেয়ে যা রোজগার করত তাতেই বেশ চলে যেত। ছ’সাত বছর বয়েস হতে ভাইও বাপের সঙ্গে যেত, দোহার করত, করতাল বাজাতে। কেবল গ্রামে নয়, টেরেনে চেপে তারা হরদম কলকাতায়ও চলে যেত। দু’বছর আগে বাবা আবার বিষম দাগা পেল। পঁচিশ বছরের জোয়ান দিদিটাকে সাপে কাটল, নামী-নামী ওঝা এসেও কিচ্ছুটি করতে পারল না। তা দিদির মনেও সুখ ছিল না, দু’ দুটো সন্তান হয়েছিল, একটা এক বছর বেঁচেছিল আর একটা দেড বছর। শেষে নিজে মরে হাড় জুড়ালো।…পরের বছরই বাপ কলকাতার রাস্তায় গান গাইতে গাইতেই ধুপ করে পড়ল আর মরে গেল। কেবল থাকল ছোট ভাইটা। পনেরো বছর বয়েস হলে কি হবে, বাপ বেঁচে থাকতেই বখাটে হয়ে গেছল, তিন চার মাস না যেতে একদিন সেই যে পালালো আজও ফেরেনি। কপালী বাবা বলেছে ও বদ সঙ্গে পড়ে অনেক দূরে চলে গেছে, ওর আশা আর রাখিসনি। শেষটুকুতে তপতপে রাগের গলা, মা-কালীর রঙ্গ দ্যাখো গো দিদি, এক-এক সময় ইচ্ছে করে ওই সকলকে জিভ টেনে ছিড়ে আনতে।
অংশুমান উঠে ধরা-চুড়া পরে এবার নিচে নামার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। এত বছরের চাকরিতে এর থেকে ঢের বেশি দুঃখ আর অত্যাচারে জর্জর শতশত জীবন দেখেছেন।
কিন্তু ও-ঘরে স্ত্রীটি আ- আ-হা করে অস্থির।–তাহলে তোর দেখাশুনা এখন করে?
–মা-কালী করে, বিবি-মা করে, বড় মাজারের পীরবাবা করে কপালী বাবা করে–ও-জঞ্চি আমি ভাবি না গো দিদি। তারপরেই ফিক করে একটু হাসি। দেখা শোনা করার লোভ তো তিন গায়ের আরো কত জনার, কিন্তু ভগ্নিপতির দাপটে পেরে ওঠে না–তার নিজের জিভেই যে অষ্টপ্রহর টসটস করে জল গড়াচ্ছে! মা-কালীর যেমন ইচ্ছে তেমন হবে।
…মেয়েটার কথা-বার্তা যেমন সহজ সরল, ওর ভিতরটাও সত্যি সে-রকম কিনা অংশুমান ভেবে পান না।
সুচারু সামনে বসে রাধাকে খাওয়াচ্ছেন। সবে খান দুই লুচি মুখে দিয়েছে, সিঁড়িতে ব্যস্তসমস্ত পায়ের শব্দ শোনা গেল। তারপরেই বড়বাবুর সঙ্গে কার কথা কানে এলো।
কুলপির দিকে এক চাষের জমির কাছে একটা বুড়ী মরে পড়েছিল। দেখে মনে হয় রাতে তাকে গলা টিপে মারা হয়েছে। তাকে তুলে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। ওই জমির ধারে চাষের সময় মালিকের লোক থাকার তিনটি ‘কুজি’ ঘর আছে, আশপাশের কেউ কেউ বলছে, যখন কেউ থাকে না বুড়ীটা তখন ওই ঘরগুলোর কোনটাতে পড়ে থাকত।
সুচারু দেবী বাধা দেবার সময় পেলেন না, রাধা খাওয়া ফেলে ছিটকে উঠে দাঁড়ালো। সুচারু দেবী হাঁ-হাঁ করে ওঠার আগেই সে বাইরে।
তুই খাবার সব ফেলে রেখে উঠে এলি কেন, আয় শিগগীর, থানায় এ-রকম খবর হামেশা আসে
রাধার কানেও ঢুকল না, বড়বাবুর সামনে যে ইনসপেক্টর দাঁড়িয়ে তাকে গলা চড়িয়ে জিগ্যেস করল, কী বললে গো বাবু তুমি, রেতে চাষের জমির সামনে বুড়ীকে গলা টিপে মারা হয়েছে। সেখানে কুজিঘর আছে তিনটে-কুলপির দিকে। অস্বাভাবিক চাউনি বড়বাবুর দিকে ফিরল।–আমি আঁধারে ছুটতে ছুটতে যে লোক দুটোকে পেলাম তারা তো কুলপির দিক থেকেই আসছিল, সেপথেই ডাক্তারবাবুর বাড়ি–তাহলে যে বুড়ী কাল আমাকে ডাকাতদের হাত থেকে বাঁচালে, বুঝতে পেরে তারাই ওকে মেরে ফেলেনি তো?
এদিকে সুচারু দেবী হাত ধরে ওকে ধরে নিয়ে যাবার আর টানছেন। ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উত্তেজিত মুখে বড়বাবুকে বলে উঠল, হাঁ করে আমার দিকে চেয়ে আছ কি, আমাকে নে চলে আমি দেখব কোন বুড়ীকে নে আসা হল, সে হলে আমি ঠিক চিনতে পারব।
অংশুমান ঠাণ্ডা গলায় বললেন, কাল রাতে তো তুই বললি, মা কালী বুড়ী সেজে এসে তোকে উদ্ধার করল?
-আঃ, কী-যে বিবেচনা তোমাদের বুঝি না-মা-কালী ওর ওপর ভর করে আমাকে বাঁচাতে পারে না?
অংশুমান গম্ভীর মুখে একবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, এই মেয়ে নিচে নেমে আয়
-খাওয়ার নিকুচি করেছে। ছুটে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল। ইনসপেক্টরটি বিমুঢ়। বড়বাবুর রাগ হচ্ছে কিন্তু অবাকও কম হচ্ছেন না।
অংশুমান নিচে নেমে এলেন। বুড়ীর মৃতদেহ সামনের বারান্দায় শোয়ানো। তার পাশে ধুলো মাটির মেঝের ওপর নিশ্চল পাথর মূর্তির মত রাধা বসে। গত রাতে যে ওকে ডাকাতের হাত থেকে উদ্ধার করেছিল এ সেই বুড়ী কিনা, এ আর জিগ্যেস করাও নিরর্থক। কিন্তু অংশুমান পুলিশী ধাতেই কর্তব্য শুরু করলেন।–এ সেই বুড়ী তাহলে?
জবাবও দিল না, তার দিকে তাকালোও না।
এবারে আর একটু ঝাঝালো গলায় প্রশ্ন, এই বুড়ী তোকে চিনত বা আগে দেখেছে কখনো?
এবার নির্বাক, মুখও ফেরালো না।
হাতের বেটনটা দিয়ে শপাং করে দেয়ালে থামের ওপর বসালেন।-কথা কানে যাচ্ছে? এদিকে তাকা!
আস্তে আস্তে ফিরল। তেমন পাথর মূর্তি।
-আমি যদি বলি ডাকাত-টাকাত সব মিথ্যে কথা, তুই ওদের সঙ্গে ফুর্তি করার জন্য ওদিকে গেছলি-বুড়ীকে দেখে ধরা পড়ার ভয়ে ওকে মারা হয়েছে–তারপর ছুটে এসে যা বলেছিস সব বানানো কথা?
পাথর মূর্তিতে সাড় ফিরে আসতে লাগল। অপলক চেয়ে রইলো। আশ্চর্য, এত দিনের পোড় খাওয়া ও সি অংশুমান ঘোষ কিরকম অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। তারপর জবাব এনে আরো স্তব্ধ। একটি একটি করে বলল, তোমার ঘরে ছেলেমেয়ে আছে, তোমার বউ ভালো মানুষ, আর এমন কথা বোলো না–মা-কালী তোমার জিভ টেনে ছিঁড়ে নেবে।
ঘোষ সাহেব আমার দিকে চেয়ে হাসছেন অল্প অল্প। ঘড়িতে রাত তখন এগারোটার কাছাকাছি। বললেন, থানার প্রবল দাপট তার প্রতিপত্তির ও সি’র নাগাল আড়াই তিনমাইল দূরের একটা গ্রাম্য মেয়ে কিভাবে পেল-এটাই তো আপনার প্রশ্ন ছিল?…পার আমি বলেছিলাম, এই কড়া মানুষের মেজাজের মাথায় যোগাযোগের প্রথম দিনেই মেয়েটা একটা থাপ্পড় মেরে বসল-মিলেছে?
হেসেই জবাব দিলাম, অনেকটা…তবে আমার প্রশ্নটা এর থেকেও অনেক বড় কিছুর ওপর থেকে যবনিকা তোলার ভনিতার মধ্যে ছিল।
মুখের মৃদু হাসিটুকু সুন্দর লাগছে। কোনরকম উদ্বেগের হিটে কেঁটাও দেখছি না। জানালা দিয়ে সমুজের দিকে চেয়ে আছেন। রাতের অপেক্ষাকৃত নির্জনতায় সমুদ্রের একটা শাঁ শাঁ শব্দ আসছে। বোম্বাই তটের এদিকের আরব সাগর বেশ শান্ত।
যবনিকা তোলার ব্যাপারেও ঘোষ সাহেব ছোট একটু ভূমিকা করে নিলেন। মেয়েটার উনিশ বছর বয়সে তাঁর আর তার স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ। কিন্তু মেয়েটার সাতাশ বছর বয়েস পর্যন্ত তিনি অন্তত এই মোগাযোগটুকু খুব একটা ভাবাবেগের দিকে গড়াতে দেননি। আরো পাঁচজন ভদ্রলোকের গৃহিণীর মতোই তাঁর স্ত্রীরও মেয়েটার প্রতি স্নেহ আর আকর্ষণ বাড়ছিল। কিন্তু এই ক’বছরের মধ্যে স্বামীর কুটির ভয়ে তাকে বাড়িতে অর্থাৎ থানার দোতলার কোয়াটার্স-এ ডেকে এনে কখনো নাম-গানের আসর বসাননি। কাছে বা তিন মাইলের মধ্যেও কোথাও রাধার গান হবে জানতে পারলে তিনি যাওয়া আসার জন্য আগে ভাগে জিপের বায়না করে রাখতেন। তার, ছেলেমেয়ের জন্মদিনে হোক বা যে-কোনো অছিলায় হোক রাধাকে নেমন্তন্ন করে জিপ পাঠিয়ে আনাতেন এবং পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করতেন। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা উপসী থেকে মেয়েটা খেতে বসেও না খেয়ে চলে গেছে এই খেদ ভুলতে মহিলার অনেক সময় লেগেছিল। কিন্তু তখনো বড়বাবুটি ওই মেয়ের তেমন কাছের মানুষ মোটেই নন। স্ত্রীকে নাকি বলত, তোমার বাড়িতে যাব কি, বড়বাবুটিকে দেখলেই আমার বুকের তলায় কাঁপুনি ধরে।
কিন্তু স্ত্রীর ঘরে এসে হেসে হেসেই মন্তব্য করতেন, মুখে বলে বটে, কিন্তু ভয় ও এই দুনিয়ায় বোধহয় কাউকেই করে না, বরং ওর কখন কি মেজাজ থাকে এই নিয়েই ভাবনা সকলের।
অংশুমান এটুকু খুব অবিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ, সেই প্রথম দিনের যোগাযোগে তাঁর নিচের কর্মচারীদের সামনে এক বুড়ীর মৃতদেহের পাশে বসে তার শাসানির জবাবে যে-রকম পাথুরে যা করে আর পাথুরে চোখ তুলে যা বলেছিল তা ভোলা নয়।
…বলেছিল, তোমার ঘরে ছেলেমেয়ে আছে, তোমার বউ ভালো মানুষ, তার এমন কথা বোলো না-মা-কালী তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে নেবে।
…ভয়-ডরের লেশ মাত্র থাকলে থানার দাপটের বড়বাবুকে এমন বলার বুকের পাটা আর দেখেননি।
…তারপর আট বছর পরের সেই এক ঘটনা। যে-ঘটনার পরে মেয়েটার যত না হোক, অংশুমান ঘোষের জীবনের পরিবর্তন ঘটে গেছে ঢের বেশি। তারপরে মাস আড়াই মাত্র সেখানকার চাকরিতে বহাল ছিলেন তিনি। ওই আড়াই মাসের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীতে ওই মেয়ের সঙ্গে যেন জন্ম-জন্মান্তরের শুদ্ধ বোগ অনুভব করেছেন। মাত্র আড়াই মাসে অনন্তকালের ব্যবধান উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন। প্রমোশন পেয়ে দূরে চলে আসার পরেও সেই যোগ আর ছেড়েনি বরং দৃঢ়তর হয়েছে।…ওই আড়াই মাসে সপ্তাহে দু’তিন রাতও রাধাকে তাঁর কোয়াটার্স-এ ধরে রাখতে পেরেছেন। সে এক অনির্বচনীয় আনন্দের দিন গেছে। রাধার ছেলেবেলার দিনগুলির কথাও রাতে পাশাপাশি শুয়ে সুচারু দেবী তার মুখ থেকেই শুনেছেন, আর পরে স্বামীকে বলেছেন, সেখান থেকেই শুরু করে ঘোষ সাহেব আট বছর পরের সেই একটি দিনের ঘটনা বিস্তার করে পরের উপসংহারে এসে থেমেছেন।
বিছানায় শুয়েই ঘড়ি দেখলাম। রাত সাড়ে চারটে। সাড়ে তিনটেয় আমরা শুয়েছি। এরই মধ্যে পাশের শয্যায় ঘোষ সাহেবের নাসিকা-গর্জন বেড়েই চলেছে। বড় তৃপ্তির ঘুম ঘুমোচ্ছেন।
আমার চোখে ঘুম নেই। কিন্তু তার জন্য কোনো ক্লান্তিও নেই। নিঃশব্দে উঠে পড়লাম। চোখে মুখে জল দিয়ে চেয়ারটা জানালার থারে তুলে এনে বসলাম। সামনে চেয়ে বসে আছি বটে, কিন্তু আবছা অন্ধকারে কিছু দেখছি না বা দেখতে চেষ্টাও করছি না।
ভোরের আলো স্পষ্ট হচ্ছে। আরব সাগরের কালো জলে লাল সূর্যের গলানো সোনার রঙের ছোঁয়া লাগল।
আমার চোখের সামনে সমুদ্র-জোড়া একখানা সুশ্রী কালো মুখ। সেই কালো মুখের ওপর ওমনি সোনার রং ঝিকমিক করছে।