সাত আট মাসের মাথায় ভদ্রলোককে নিয়ে আমার বড় রকমের দুর্ভাবনার কারণ ঘটল। তার গলা নিয়ে অশান্তি বাড়ছেই। গলার স্বর সত্যিই কেমন ফ্যাঁসফেঁসে হয়ে যায়। তখন চাপ ধরে, স্বস্তিতে খেতেও পারেন না। অবশ্য ব্যথা বেদনা নেই। আমার আর তার নিজেরও ধারণা ঠাণ্ডা খাওয়ার থেকেই এরকমটা হয়। একটু ভালো থাকলেই ফ্রিজের জল ছাড়া মুখে রোচে না, দুধের গেলাস আগের দিন রাত থেকে ফ্রিজে ঠাণ্ডা হতে থাকে, পরদিন সকালে খান। ফলটলও ঠাণ্ডা খেতে ভালবাসেন। অস্বস্তি শুরু হলে এগুলো বন্ধ করেন, আর আনুষঙ্গিক চিকিৎসায় একটু ভালো থাকেন। কিন্তু ইদানীং ট্রাবলটা একটু ঘনঘন হচ্ছে। তবু এজন্য তাঁর নিজের খুব একটা দুশ্চিন্তা হয়নি বলে আমি মাথা ঘামাইনি।
কিন্তু সেদিন একটু ধাক্কা খেলাম। লেকে বেড়াতে বেড়াতে খুব নিস্পৃহ মুখে বললেন, আপনার কোনো থ্রোট স্পেশালিস্ট আর ভালো জেনারেল সার্জন জানাশোনা আছে?
মুখের দিকে চেয়ে দুশ্চিন্তার ছিটেফোঁটাও দেখলাম না। বললাম থ্রোট স্পেশালিস তো দেখাচ্ছেন, সার্জন দিয়ে কি হবে?
–সেকেণ্ড ওপিনিয়নের জন্য আর একজন থ্রোট স্পেশালিস্টের কথা ভাবছি–তারপর দরকার হলে একজন সার্জনও দেখাব।
হাঁটা থামিয়ে আমি থমকে তাকালাম। সামনে একটা খালি বেঞ্চ দেখে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বসলাম, নিজেও বসলাম।–কি ব্যাপার বলুন তো, ট্রাবলটা খুব বেড়েছে?
তিনি হেসে উঠলেন।–এই জন্যেই মুখ খুলতে চাই না মশাই, ছেলে মেয়ে জামাইরা শুনলে ঘাবড়াবে বলে আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম–ট্রাবল তো বাড়েইনি, এখন বরং কম–
–তাহলে অন্য থ্রোট স্পেশালিস্ট আর সার্জন দেখানোর কথা কেন?
অল্প অল্প হাসতে লাগলেন। তারপর আমার দিকে একটু ঘুরে বসে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, কারো কারো মনে আগে থাকতে ভালো-মন্দ বা আপদ-বিপদের ছায়া পড়ে এ আপনি বিশ্বাস করেন।
বললাম, এমন কথা শুনেছি কিন্তু এমন কাউকে চোখে দেখিনি।
–আমি দেখেছি–যত দেখেছি ততো অবাক হয়েছি–বিজ্ঞান মানি, কিন্তু এ মানা শক্ত, না মানা আরো শক্ত।
হঠাৎই একটি মুখ মনে পড়ল। অতি সাধারণ বেশবাসের এক রমণীর মুখ। এই সুযোগ। দুশ্চিন্তার প্রসঙ্গ ভুলে জিগ্যেস করলাম, সেই একজন পুরুষ না মেয়েছেলে?
হাসতে লাগলেন। বললেন, কথাটা তুলে ভালো করলাম না, লেখকের নাক-কান সজাগ দেখছি। মেয়েছেলে মশাই মেয়েছেলে আমার বাড়িতে তাকে আসতে-যেতে দেখেন না তা-ও মনে হয় না।
ইদানীং একটু বেশিই আসতে-যেতে দেখছি। স্নায়ুর উত্তেজনা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা আমার। স্বাভাবিক সুরে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি কোনো বিপদের ছায়া দেখছেন?
–দেখলেও তা কি বলবে! দেখতে ইচ্ছে করলে আমি তাকে গাড়ি পাঠিয়ে আনাই, কিছুদিন আগে এক দুপুরে হঠাৎ নিজে থেকে হাজির। বলল, দেখতে ইচ্ছা করল, খর-খর চলি এলাম। তা গলা লয়ে অত ভুগতেছ, এবারে এট্টু ভালো করে চিকিচ্ছেয় মন দাও দেখি। শুনে আমি একটু ধাক্কাই খেলাম, অমন ঠাণ্ডা মেয়েকে খুব সুস্থির মনে হল না, কিছু একটা উদবেগ নিয়ে ছুটে এসেছে বুঝতে পারছি। বললাম, ভালোই তো আছি, হঠাৎ এ কথা কেন, কিছু খারাপ-টারাপ চোখে পড়ছে নাকি?
উদগ্রীব হয়ে শুনছি।–তারপর?
জবাব দিলেন, কাউকে কিছু বললে মেয়েটা কেন কি জন্য এসব প্রশ্ন পছন্দ করে না। ঝাঁজি মেরে বললে, অত কথায় কাজ কি তোমার বড়বাবু, যা বললাম করো দিকিনি, করে আমাকে নিচিন্দি করো, আমি দৈবী জানি না গণা জানি যে আগে থাকতি ভালো-খারাপ বাখাই দিব? মনে ডাক দেছে যখন দুটো একটা ভালো ডাক্তার দেখাও, তোমার তো অভাব কিছু নাই।
আরো কিছু শোনার আশায় ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে আছি। এর মতো রাশভারী লোককে এক গ্রাম্য মেয়ে ঝাঁজি মেরে তুমি তুমি করে কথা বলে, বড়বাবু বলে ডাকে। কিন্তু যা বলে উনি সেটা অবহেলা করতে পারেন না তা তাঁর পরের কথায় স্পষ্ট। বললেন, আপনার হয়তো হাসি পাচ্ছে, কিন্তু ওর মনে ডাক দেওয়াটা আমরা যারা জানি, তুচ্ছ করতে পারি না, বরং শোনার পর থেকে একটু দুশ্চিন্তাই হচ্ছে।
দুশ্চিন্তা আমারও হচ্ছে এটা প্রকাশ করলাম না। বললাম, দেখুন আমরা শিক্ষাদীক্ষার গর্ব করি, কিন্তু কত সময় একটা শিশুও বড় রকমের এক-একটা সহজ ভুল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যিনি বলেছেন আপনাকে তাঁর দৃষ্টি অন্তত স্বচ্ছ এটা মানতেই হবে–আপনার এখানে আসা থেকেই শুনছি গলার ট্রাবল-এ ভুগছেন, থ্রোট স্পেশালিস্টের চিকিৎসায় সারছে না, কখনো কমছে, কখনো বাড়ছে, আমাদেরই সেকেণ্ড ওপিনিয়ন নেবার কথা বা সার্জন দেখানোর কথা ভাবা উচিত ছিল–অথচ এই রুটিন ব্যাপারটা আমার আপনার কারোই মনে আসেনি। যাক, আপনি উতলা হবেন না, যাকে দেখাচ্ছেন তিনি থ্রোট স্পেশালিস্টই, তার রিপোর্ট নিয়ে আপনাকে আমি আমার বিশেষ পরিচিত এ-লাইনেরই খুব নামকরা এক সার্জনের কাছে নিয়ে যেতে চাই।
একটু চেয়ে থেকে হালকা সুরে জিগ্যেস করলেন, এ-লাইনের মানে সেই লাইনের?
অগত্যা জোর দিয়েই বললাম, হ্যাঁ সেই লাইনের, আপনার মনে কি ডাক দিচ্ছে সেটা নিজেদের মধ্যে গোপন করে লাভ কি, সোজা হাইকোর্টে গিয়ে হাজির হওয়া ভালো।
–ঠিকই বলেছেন।…আপনার এই ক্যানসার স্পেশালিস্ট সার্জনের চেম্বার কোথায়?
বললাম। কোন্ বড় হাসপাতাল আর কোন্ কোন্ নামী নার্সিং হোমের সঙ্গে অ্যাটাচড তাও বললাম। জানালাম, আজকের মধ্যেই আমি ফোনে কনট্যাক্ট করতে চেষ্টা করব।
করুন…তবে কাটা-ছেঁড়া মানে বায়োপসি করতে চাইলে ছেলেমেয়ে দুটো ভয়েই আধমরা হয়ে যাবে।
করতে চাইলেই আপনি গলা পেতে দেবেন তার কি মানে, তখন হাইকোর্টের ওপরে সুপ্রিম কোর্ট আছে–আবার হয়তো এখানে গিয়েই দেখবেন কেস ডিসমিসড, আপনার কিছুই হয়নি। তবে এটা ঠিক, আপনার ছেলে-মেয়েকে আপাতত কিছুই না জানানো ভালো।
–তা তো ভালো, কিন্তু হীরু ব্যাটাই বলে দেবে, কোথায় কোন্ ডাক্তারের কাছে গেছি–নিজে ড্রাইভ করলেও ও সঙ্গে থাকেই, নইলে মেয়েটা খুব রেগে যায়।
-ব্যস, ও-ভাবনাও শিকেয় তুলে রাখুন, এ ব্যাপারে আপনার গাড়ি বেরুবেই না, আপনি আমার সঙ্গে আমার গাড়িতে যাবেন, আর সেটা যে-কোনো অজুহাতে হতে পারে।
খুব খুশি।
ফেরার সময় জিগ্যেস করলাম, ওই যে-মেয়েটির কথা বললেন তার বয়েস তো বেশি না–কোনো সাধিকা নাকি?
সকৌতুকে তাকালেন, বয়েস কত মনে হয় আপনার?
গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকতে আর বাড়ি থেকে গাড়িতে উঠতে যেটুকু দেখা। তবু যা মনে হয়েছে তাই বললাম।-আঠাশ তিরিশের মধ্যে?
-ওর বয়েস এখন বিয়াল্লিশ, কিন্তু সাধিকা আপনি কাকে বলেন? সাধনা যোগ বিভূতি-টিভূতি আছে এমন তো? তার ধারে কাছেও না, দুতিন ক্লাস পড়া অজ গাঁয়ের মেয়ে, গ্রাম্য কথাবার্তা, জাতে জলচলও নয়–আর চরিত্র নিয়ে ওর গায়ে কাদা ছোঁড়াছুড়িও বড় কম হয়নি। ঘোষ সাহেব হাসলেন একটু।–কালোর ওপর মুখখানা কেমন মিষ্টি আর এ বয়সেও কেমন সেক্সি ফিগার লক্ষ্য করেছেন তো? বয়স কালে অনেক হারামজাদার মুণ্ডু ঘুরেছে–
সন্তর্পণে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। গাঁয়ের লোক আর কত পিছিয়ে, শহরের শিক্ষিত প্রতিবেশীরাও যে এই মেয়েকে নিয়ে এ বয়সের পুলিশ সাহেবের মুণ্ডটি ঘুরে আছে ভাবছেন আর রসের কাদা ছোঁড়াছুড়ি করছেন এ-তো আর বলার কথা নয়।
কয়েক পা এগিয়ে ঘোষ সাহেব নিজে থেকেই বললেন, তবে একটা কথা আপনি ঠিক বলেছেন, মেয়েটার যেমন স্বচ্ছ দৃষ্টি তেমনি সহজ বুদ্ধি, ক্লেয়ারভয়েন্স বলে একটা কথা আছে না–দূরের জিনিস দেখতে পায়, দূরের কথা শুনতে পায়–সেই গোছের–হঠাৎ হঠাৎ জোরের সঙ্গে কিছু বলে বসে যখন মনে হবে কি হতে যাচ্ছে চোখে দেখতে পাচ্ছে বা কানে শুনতে পাচ্ছে–জিগ্যেস করলে বলে, ও কিছু না। কপালী বাবার জংলী কালী আর বিষ্টুপুর শ্মশান কালীর কাছে, বড় পীরের মাজারে বিবি মায়ের থানে, আর জয়চণ্ডীর মন্দিরে হাজার হাজার মানুষের কাতর প্রার্থনা মানত শুনতে শুনতে আর দুঃখ ব্যথা শোকের মুখগুলো দেখতে দেখতে এখন অনেকটা বুঝতে পারে কার ভিতরে কি যন্ত্রণা। যে মা ছেলেকে যম-দোর থেকে ফেরাবার প্রার্থনা বা মানত নিয়ে আসে আর যে লোক মামলা জেতার আরজি নিয়ে আসে–তাদের মুখের ভাব কি এক রকম হয়? আর ওর বিশ্বাস, মা-কালী বা বড়পীর বা বিবি-মা অথবা জয়চণ্ডী মা অনেক সময় ওকে চোখে আঙুল দিয়ে অনেক কিছু দেখিয়ে দেয় বা বলে দেয়–অবশ্য যখন ও খুব মন দিয়ে তাদের ডাকে। ওর বুদ্ধি পরামর্শগুলোও জল ভাতের মতো সহজ সরল, তাইতেই উপকার পেয়ে অনেকের তাক লেগে যায়। ও বলে, অবাক হবার কি আছে, বুনো ওল খেয়ে গলা ফুললে তাকে তেঁতুল গুলে খেতে বলব না তো কি রসগোল্লা খেতে বলব?
মেয়েটির কথা বলতে বলতে ঘোষ সাহেব মুডে এসেছেন বুঝতে পারছি। আমার আগ্রহ বুঝলে পাছে নিজেকে গুটিয়ে নেন তাই একটু হেসে নির্লিপ্ত সুরে বললাম, আপনি এত বড় একজন পুলিশ অফিসার আর মেয়েটি আপনাকে বড়বাবু বলে ডাকেন?
–আর বলেন কেন, হেসেই জবাব দিলেন, আমি তখন জয়নগর থানার ও. সি–ও. সি-কে বড়বাবুই বলে সকলে, ওর ধারণা বড়বাবুর থেকে বড় আর কে? অ্যাসিস্টান্ট কমিশনার ডেপুটি কমিশনারের থেকে এখনো ওর কাছে বড়বাবুই বড়। আরো মজা, ওর মুখে বড়বাবু ডাকটাই আমার মিষ্টি লাগে। কোয়াটার্স-এ থাকতে আমার মেয়ে দুই একবার ওকে শুধরে দিতে চেষ্টা করে বলেছে, তুমি সেই বড়বাবু ধরে আছ কেন মাসি-আমার বাবা যে এখন বড়বাবুর থেকেও ঢের বড়। না বুঝে ও বোকার মতো আমার দিকে তাকাতো, আমার চোখ টেপা বা ইশারা থেকে ও বুঝে নিয়েছে মেয়ে ঠাট্টা করছে।
মেয়েও ওই একজনের পরিচিত এবং মাসি বলে ডাকে শুনে একটু স্বস্তি বোধ করতে চেষ্টা করলাম। শুনলে যদিও আমার উল্টোমুখো বাড়ির অমর গাঙ্গুলী আরো বেশি মুখ মচকাবেন, বলবেন, মেয়ের মাসি অর্থাৎ ভদ্রলোকের পাতানো শালী সম্পর্কটা আরো রসঘন হতে বাধা কোথায়?
বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি। আর কোনোরকম ঔৎসুক্য প্রকাশ না করে বললাম, সার্জনের সঙ্গে কনট্যাক্ট করতে পারলে জানাব। যে-মেয়ের তাগিদে সার্জন দেখাবার সংকল্প তার সম্পর্কে এখনো কিছুই জানি না। অথচ একটু উতলা যে হয়েছি নিজেই টের পাচ্ছি। এটা কোনো অন্ধবিশ্বাসের কারণে নয়।…অংশুমান ঘোষ বিজ্ঞানের ছাত্র, তার ওপর পুলিশের নার্ভ। তাঁর চাকরি জীবনের যে দুটো ঘটনা আমি গল্পে টেনে এনেছি তা অপরাধী জীবনের বুকের তলার ভিন্ন ছবি, কিন্তু ওই দুর্ধর্ষ চতুর অপরাধীদের নাগাল পাওয়া সম্ভব হয়েছিল কেবল তেমনি ইস্পাতকঠিন স্নায়ু আর প্রত্যুৎপন্ন বুদ্ধির জোরে। সেটা নিজে তিনি জাহির করেননি, কিন্তু আমার অনুভব করতে অসুবিধে হয়নি। এই মানুষই একটি অশিক্ষিত গ্রাম্য মেয়ের অঙ্গুলি নির্দেশ পেয়ে বিচলিত একটু হয়েছেন সন্দেহ নেই। নিজের ছেলেমেয়ে বা জামাই ও-কথা বললে তিনি কানেও নিতেন না হয়তো।
অংশুমান ঘোষের শোবার ঘরে বসে প্রথম দিনের আলাপের কিছু কথা আমার কানে লেগে আছে। বলেছিলেন, মাঝ বয়েস পর্যন্ত মনেপ্রাণে উনি পুলিশই ছিলেন, অনেক নিষ্ঠুর কাজ অনায়াসে করে গেছেন, কর্তাদের অবিবেচনায় মন মেজাজ যখন খুব খারাপ সেই সময় একটা ঘটনা আর বিশ্বাসের এক আশ্চর্য নজির দেখে তার ভিতরে কি রকম নাড়াচাড়া পড়ে গেল আর সেই থেকেই মনে জিজ্ঞাসার উৎপাত শুরু হল। সেই ঘটনা আর বিশ্বাসের ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করতে তৎক্ষণাৎ ধামাচাপা দিয়েছিলেন আর রসিকতার সুরে বলেছিলেন পুলিশ অফিসার চাকরি থেকে রিটায়ার করলেও তার এক্সহিউমড হবার ভয় থাকে। এখন আমার বদ্ধ ধারণা সেই ঘটনা আর বিশ্বাসের আশ্চর্য নজিরের সঙ্গে এই গ্রাম্য মেয়েই যুক্ত, এই কারণে অংশুমান ঘোষের মতো দাপটের পুলিশ অফিসারের এই পরিবর্তন, তাঁর মনে অনন্ত জিজ্ঞাসার তৃষ্ণা।
বাড়ি ফিরে কতগুলো শব্দ আমার মাথায় ঘুর পাক খেতে লাগল। কপালী বাবার জংলী কালী…শ্মশান কালী..বড় পীরের মাজার… বিবি মায়ের থান…জয়চণ্ডীর মন্দির। এগুলো সব কোথায়? জয়নগর বা তার কাছাকাছি কোথাও হতে পারে। কারণ ঘোষ সাহেব যখন জয়নগর থানার ও. সি. সকলে তাকে বড়বাবু ডাকত, আর সেটাই সব থেকে মর্যাদার ডাক জেনে এই মেয়েও তাই বলে।…সেই তল্লাটের মেয়ে হলে মোটরে কলকাতায় যাতায়াতে কম করে আড়াই ঘণ্টার পথ। হীরু ওকে সেখান থেকে নিয়ে আসে দিয়ে আসে।
সার্জনের সঙ্গে সেই সন্ধ্যাতেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম। গোপন রাখার তাগিদে নিজের ড্রাইভারও নিলাম না। কারণ দু’বাড়ির দুই ড্রাইভারের সঙ্গে ইতিমধ্যে ভাব-সাব হয়ে গেছে। আমি চালাচ্ছি, ঘোষ সাহেব পাশে। সার্জন সম্পর্কেই আবার একটু খোঁজ নিলেন তিনি, কত বয়েস কত দিনের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। জবাব দিয়ে তাকে আরো একটু নিশ্চিন্ত করার জন্য জানালাম, ফরেনের ডিগ্রিটিগ্রির জন্য বলছি না, এর থেকে বেশি আস্থা আর আমার কারো ওপর নেই, আমার একটি নিকট আত্মীয়ের কাঁধ আর ঘাড়ের ক্যানসার ইনি অপারেশন করে ভালো করেছেন।
হেসে উঠলেন।–নিশ্চিন্ত হলাম, গলা কেটে বাদ দিলেও ক্যানসারটা অন্তত সারবে।
না বলাই ভালো ছিল মনে হল।
সার্জন খুব যত্ন করেই পরীক্ষা করলেন। গত এক বছরের রিপোর্ট নিলেন। থ্রোট স্পেশালিস্টের প্রেসকৃপশনগুলো দেখলেন। তারপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার এক মস্ত ফর্দ দাখিল করলেন। এক বড় প্রতিষ্ঠানের নাম করে নির্দেশ দিলেন, এগুলো সব করিয়ে আনুন, সবগুলো টেস্ট হতে আট-দশ দিন লাগতে পারে, তারপর আসুন।
সোজাসুজি জিগ্যেস করলাম, আপনার কি মনে হয় বলুন?
জবাব দিলেন, ঘাবড়াবার মতো কিছু না-ও হতে পারে, আবার এ-ও বলা উচিত নেগলেক্ট করা কোনো মতেই উচিত হবে না–আগে এই টেস্টগুলো সব করিয়ে আনুন।
ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে কাউকে জানতে না দিয়ে এ-পর্বও নির্বিঘ্নে সারা হল। ঘোষ সাহেব বার বারই বলেছেন, আপনার সময় নষ্ট পেট্রল নষ্ট, বড় বেশি জুলুম করা হয়ে যাচ্ছে।
শেষে বাধ্য হয়ে বলেছি, আপনি আর একবার একথা বললে আপনার ছেলেময়েকে জানাবো, তারাই দায়িত্ব নেবে।
একটু থমকে গিয়ে হেসে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, আমার মতো পুলিশ অফিসারকেও বেশ কড়া কথা শোনাতে পারেন দেখছি!
সমস্ত রিপোর্ট নিয়ে আবার সার্জনের কাছে হাজির হবার পর আমাদের দুশ্চিন্তা আরো বাড়ল বই কমল না। রিপোর্টগুলো থেকে তিনি একজনের নাম করলেন যিনি সার্জন নন, কিন্তু এ-লাইনের নাম করা স্পেশালিস্ট ডাক্তার। একটা চিঠি লিখে রিপোর্টগুলো নিয়ে তাঁর কাছে যেতে বললেন। অর্থাৎ যা করার দু’জনে কনসালট করে করবেন।
ফেরার সময় ঘোষ সাহেব হেসেই বললেন, সেধে কি-রকম জড়িয়ে পড়েছেন বুঝতে পারছেন? ব্যাপারখানা বায়োপসির দিকে গড়াচ্ছে–
মনটা সত্যি দমে গেছে। তবু জোর দিয়েই বললাম, এটা করতেই হবে মনে হলে সার্জন আপনাকে সে-কথাই বলতেন, অন্য স্পেশালিস্টের কাছে ওপিনিয়নের জন্য পাঠাতেন না।
গাড়ি চালাচ্ছি। সামনের দিকে চোখ। তবু মনে হল ভদ্রলোক নিজের মনে হাসছেন। হঠাৎ বললেন, দেখুন মশাই, ওপিনিয়ন আমি মোটামুটি পেয়েই গেছি, গাড়ি না পাঠাতে রাধা যেদিন নিজে থেকে চলে এলো আর বলল, দেখতে ইচ্ছা করল তাই খরখর (পা চালিয়ে) চলি এলাম, আর তার পরেই গলার জন্য অন্য ভালো ডাক্তার দেখাবার হুকুম করে গেল, সেদিনই বুঝেছি ব্যাপার সুবিধের নয়। তখন অবশ্য একটু ধাক্কা খেয়েছিলাম, কিন্তু আপনি বললে বিশ্বাস করবেন না, এখন আর খুব একটা উদবেগ নেই–যা হবার হবে।
একটু চুপ করে থেকে বললাম, তার ওপর যখন আপনার এত বিশ্বাস, সময়ে চিকিৎসা করলে আপনি সুস্থ হবেন বলেই তিনি যেচে এসে এই ফতোয়া দিয়ে গেছেন।
–তা হবে।
জিগ্যেস করলাম, মেয়েটির নাম বুঝি রাধা?
হুঁ।
সামনের দিকে চোখ রেখে আবার বললাম, তাঁর মাথায় কাপড় দেখেছি, কিন্তু সিঁদুর-টিঁদুর চোখে পড়েনি। সধবা না বিধবা?
রসিকতার সুরে জবাব দিলেন, একবার নয়, দু’ দুবারের বিধবা, প্রথম বারে তেইশ বছর বয়সে দ্বিতীয়বার সাতাশ বছর বয়সে, অরুচি ধরে না গেলে আরো এক আধবার হতে পারত, শুনেছি যাদের সাধ ছিল তারা কপালী বাবার খাঁড়ার ভয়ে পিছু হটেছে, ওকে আর বেশি উত্যক্ত করেনি।
আমার কান-মন সজাগ। কপালী বাবা নামটা আগেও শুনেছি। বিয়াল্লিশের রাধা যদি এই হয়, সাতাশের চেহারাখানা কল্পনায় আনতে চেষ্টা করলাম। বললাম, আপনার মুখে শুনেছিলাম আপনার জয়নগর থানার বড়বাবু ডাকটাই উনি এখনো ধরে আছেন, তার মানে জয়নগরের মেয়ে আর সেখানেই থাকেন?
–ও যেখানে থাকে সে জায়গাটার নাম ছিল মাতন, জয়নগর আর বিষ্টুপুরের মাঝামাঝি একটা জংলা জায়গা, এখন একটু এদিকে হলে জয়নগর, ও-দিকে হলে বিষ্টুপুর–আশপাশের ওই সব জায়গাই জয়নগর থানার জুরিসডিকশনে। তারপর গম্ভীর গলার রসিকতা, এখন আমার চিকিৎসার জন্য দ্বিতীয় স্পেশালিস্টের কাছে যাবেন কি মাতনের রাধার কাছে, বেশ করে ভেবে নিন।
.
দ্বিতীয় স্পেশালিস্ট ভদ্রলোক আরো প্রবীণ। সব শুনলেন, নিজে পরীক্ষা করলেন, রিপোর্টগুলো খুঁটিয়ে পড়লেন। তারপর সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করলেন। যথা, গ্রোথ যা পাওয়া যাচ্ছে তা বিনাইন কি ম্যালিগন্যান্ট না ট্রানজিটারি সেটা এখন পর্যন্ত ধরা যাচ্ছে না। বিনাইন হলে ভয়ের কিছুই নেই, ম্যালিগন্যান্ট বলেও তিনি ধরে নিচ্ছেন না, কারণ এক বছরের ওপর হয়ে গেল উপসর্গগুলো মোটামুটি একই রকম আছে, চিকিৎসায় বা শুশ্রূষায় কমছে বাড়ছে, কিন্তু এজন্যই আবার ট্রানজিটারি অবস্থার আশঙ্কাটা বাতিল করা যাচ্ছে না
সাদা কথায় এই অবস্থার পরিনামও মারাত্মক হতে পারে। তাঁর মত আপাতত কিছুদিন চিকিৎসা করে দেখবেন, তারপর এই টেস্টগুলোই আবার করানো হবে–ফলাফলের কোনো তারতম্য হয় কিনা দেখার পর তিনি যা বলার বলবেন।
চিকিৎসা বলতে ইনজেকশন আর ওষুধ। তাই চলতে লাগল। ছেলেমেয়ে জানল তাদের রাধা মাসির পরামর্শে বাবাকে অন্য ডাক্তার দেখছে এবং সাধারণ চিকিৎসাই চলছে।
এরই মধ্যে পুজো এসে গেল। পনেরো বিশ দিনের জন্য সপরিবারে আমার বাইরে বেরুনোর প্রোগ্রাম ছিল। ভিড় এড়ানোর জন্য পুজোর দিন সাতেক আগে টিকিট বুক করা ছিল। ডাক্তারের এই ট্রিটমেন্টের কোর্স শেষ হতেও আরোও তিন সপ্তাহ বাকি। তার মধ্যে ফিরে আসা যাবে। মনে বেশ একটু অশান্তি নিয়েই বেরুলাম। সেটা টের পেয়ে ঘোষ সাহেব ঠাট্টা করেছিলেন, বলেন তো রোজ আপনাকে একটা করে টেলিগ্রাম করতে পারি।
এই এক অসুখের ব্যাপার শুনে মনের দিক থেকে দুজনেই কত কাছাকাছি এসে গেছি সেটা অনুভবের বস্তু। দিল্লি হয়ে আমার হরিদ্বারে যাবার কথা। বিজয়ার পর হরিদ্বারে বসে ঘোষ সাহেবের ছোট্ট একখানা চিঠি পেলাম। শুভেচ্ছা জানিয়ে লিখেছেন, নিজের অদৃষ্টকে ধন্যবাদ, মানুষ কত সহজে আপনার জন হয়ে উঠতে পারে এটুকুও আমার জানতে বাকি ছিল। আমি বহাল তবিয়তে আছি, কিচ্ছু ভাববেন না।
লক্ষ্মী পুজোর দিন পাঁচেক পরে ফিরেছি। গাড়ি থেকে নেমে দেখি ঘোষ সাহেব সহাস্য বদনে তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে। চোখাচোখি হতেই সানন্দে দু’হাত মাথার ওপর তুললেন। অর্থাৎ কেবল শুভেচ্ছা জ্ঞাপন নয়, আমাকে নিশ্চিন্তও করতে চাইলেন।
গাড়ি থেকে মালপত্র নামানোর ফাঁকটুকুর মধ্যে লোক-চরিত্রের একটু ছোট প্রহসনের মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খেয়ে উঠলাম। গাড়ি থেকে আমি আমার বাড়ির ফুটপাথে নেমেছি। উল্টো দিকের দুই বাড়ির ওঁরাও যে লক্ষ্য করছেন জানি না। প্রথমে দোতলার অমর গাঙ্গুলী একরকম ছুটেই রাস্তা পার হয়ে এসে আমাকে বুকে জাপটে ধরলেন। কোলাকুলির ঘটা শেষ না হতে হাসি মুখে ও-পাশের দোতলার ভটচায মশাই আর এক তলার রায় মশাইও হাজির। আরো দু’দফা কোলাকুলির ঘটা। যেন আমার ফেরার অপেক্ষায় ওঁরা দিন গুনছিলেন। সাড়ম্বর কুশল বিনিময় সেরে ওঁরা বিদায় নিতে আমি আর একবার আমার পাশের দোতলার দিকে তাকালাম।
ঘোষ সাহেব তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসছেন।
এমন প্রহসনের একটাই অর্থ। নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে তিনি যাকে মর্যাদা দিলেন, সেই আমি ওঁর এই অবহেলিত তিন প্রতিবেশীর কত অন্তরঙ্গ আপনার জন সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হল।
সন্ধ্যার পরে জানান না দিয়ে তাঁর বাড়ির দোতলায় উঠে এলাম। বারান্দায় বসে টিভি দেখছিলেন। আনন্দে উঠে দাঁড়ালেন।–আসুন, প্রায় দু’দিন ট্রেনের ধকল গেছে ভেবে হীরুকে পাঠাইনি, তবু মনে মনে খুব আশা করেছিলাম–আপনি ছিলেন না পাড়া একেবারে অন্ধকার, মানে সকালে রাস্তায় কোলাকুলির ঘটা দেখে তাই মনে হল।
আমিও হাসছি।
দু’পা এগিয়ে এলেন।–আপনি বয়োজ্যষ্ঠ একটা প্রণাম করি?
বাধা দিয়ে কোলাকুলি সেরে নিলাম।
–ওরে হীরু, টিভি বন্ধ কর, পুজোর পরে এলেন, তোর স্পেশাল কিছু আছে নাকি বার কর।
হীরুকেই বললাম, আর একদিন হবে, আজ শরীরের যুত নেই, এক পেয়ালা চা কেবল দিতে পারো।
শোবার ঘরে এসে বসলাম। আমি খাটে ঘোষ সাহেব ইজিচেয়ারে। কালীর ফোটোতে একশ আট জবার মালা। ধূপ-ধুনোর সেই পরিচিত গন্ধ। বাতাসে শুচি স্পর্শ।
–কেমন বেড়ালেন আগে বলুন।
অনেক বারের দেখা জায়গায় বেড়ানো। দু’চার কথায় ও-প্রসঙ্গ সেরে তার খবর জিগ্যেস করলাম।
উনি জানালেন নতুন করে কিছু বুঝছেন না, একই রকম আছেন। গত কাল ট্রিটমেন্টের কোর্স শেষ হয়েছে, স্পেশালিস্ট ডাক্তারকেও কালই ফোন করেছিলেন। তিনি একবার দেখতে চেয়েছেন, কি কি টেস্ট করতে হবে তা-ও লিখে দেবেন।
-কালই চলুন তাহলে?
–অত তাড়ার কি আছে, দুই একদিন বিশ্রাম করে নিন …
–বিশ্রাম নেবার মতো কোনো পরিশ্রম আমার হয়নি, কালই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান কিনা ফোন করে দেখুন।
-আচ্ছা করব। হাসছেন।–আমার চিঠি পেয়েছিলেন?
মাথা নাড়ালাম, পেয়েছি।…উনি লিখেছিলেন, নিজের অদৃষ্টকে ধন্যবাদ, মানুষ কত সহজে আপনার জন হয়ে উঠতে পারে এটুকুও জানতে বাকি ছিল। হেসে এ-প্রশ্নটা করে সেই অনুভূতিটুকুই আবার ব্যক্ত করলেন। জিগ্যেস করলাম, সেই মেয়েটি মানে রাধা এর মধ্যে এসেছিলেন?
গাড়ি পাঠিয়ে দু’দিন আনিয়েছিলাম, সপ্তমীর দিন আর বিজয়ার দিন। ওই দু’রাত এখানেই ছিল, ভিড়ে বিকেলে আর গাড়িই বার করা যায়নি।…তবে অসুখ নিয়ে কথা বলার ফুরসৎ মেলেনি, ওই দু’রাত মেয়ে বউমা আর নাতি নাতনিরাও এখানেই ছিল, বাড়ি জমজমাট, কেবল যাবার আগে যা দু’চার কথা হ’ল–
জমজমাট বাড়িতে সেই মেয়ে এসে দু’রাত ছিল শুনে আমিই যেন সামনের তিন প্রতিবেশীর আর এক দফা কাদা ছোঁড়ার হাত থেকে বাঁচলাম। ফি দু’চার কথা হল শোনার আগ্রহ। ঘোষ সাহেব হাসি মুখেই সেটুকু শোনালেন।…বউমা ঊর্মিলা আর মেয়ে শমী ছেলেমেয়ে নিয়ে তার খানিক আগেই চলে গেছে। যাবার জন্য তৈরি হয়ে রাধা তার কাছে এসে মাথা থেকে পা পর্যন্ত এক প্রস্থ দেখে নিয়ে জিগ্যেস করল, এই চিকিচ্ছেয় একটু ভালো বোধ করছ? ঘোষ সাহেব বিশ্বাসযোগ্যভাবেই মাথা নেড়েছেন, ভালো বোধ করছেন। রাধা আরো এগিয়ে এসে নিজের হাত দু’খানা তাঁর গলার চার দিকে বোলালো, তারপর সেই দু’হাত মায়ের ছবির ওই পায়ে রেখে স্থির হয়ে খানিক দাঁড়িয়ে রইলো। ব্যাপারখানা কি হল বুঝতে পেরেছেন?
–কি?
-আমার সব বালাই মায়ের পায়ে জমা করে দিল। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, বেশি ভেব-টেবনি বড়বাবু–
ভাবলাম এটুকুতেই শেষ। কিন্তু ঘোষ সাহেব আমার দিকে চেয়ে যে-ভাবে টিপটিপ হাসছেন, মনে হল আরো কিছু শুনতে বাকি।
তাই। নিজে থেকেই বললেন, ওর মনে কি আছে বোঝবার জন্য হঠাৎ আপনাকেই টেনে আনলাম। বললাম, আমি খুব ভাবছি টাবছি না, কিন্তু বাইরে বেড়াতে বেরিয়েও আর এক ভদ্রলোক আমার জন্য ভেবে সারা হচ্ছেন।…তখন আপনার কথা এসেই গেল।
আমি উৎসুক।
–শুনেই মশাই বিরক্ত কেবল নয়, রাগ রাগ ভাব। বলল, চিকিচ্ছে করাতে বলেছিলাম করাচ্ছ–ফুরিয়ে গেল, পাঁচ কান করার কি দরকার ছল তোমার?
চেয়ে আছি।
ঘোষ সাহেব তেমনি হাসছেন। তখন চিঠিতে আপনাকে যা লিখেছিলাম ওকেও তাই বলতে একেবারে ঠাণ্ডা। বলল, ভালো বন্ধু মেলা তো ভাগ্যের কথাই, কিন্তু মেলে কই।
ডাক্তারকে ফোন করার কথা আবার মনে করিয়ে দিয়ে নেমে এলাম। ভিতরের অস্বস্তি প্রকাশ করার নয়। মনে ডাক দিয়েছিল বলেই রাধা অন্য ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করানোর তাগিদ দিয়ে ছিল। আমরা কতদূর কি করেছি সে জানেও না। কেবল জানে অন্য ডাক্তার দেখানো হয়েছে, চিকিৎসাও হচ্ছে। কিন্তু সেটা পাঁচ কান হবার ব্যাপারে আপত্তির একটাই কারণ। কেউ কিছু না বললেও রোগ সম্পর্কে এখনো তার মনে কিছু জটিলতার আশংকা থিতিয়ে আছে।
.
একরকমই আছেন স্পেশালিস্ট ডাক্তারকে ঘোষ সাহেব ফোনে আগেই জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয় দফা পরীক্ষা করে তিনি ভরসা বা ভয়ের কোনো কথাই বললেন না। দুই একটা বাদ দিয়ে আগের টেস্টগুলোই আবার করিয়ে নেবার নির্দেশ লিখে দিলেন। তফাৎ কিছু হল কিনা এই রিপোর্ট পেলে বোঝা যাবে।
আট-দশ দিন বাদে সব রিপোর্ট নিয়ে আবার আমরা এক সন্ধ্যায় তাঁর কাছে উপস্থিত। আগের আর পরের রিপোর্ট মিলিয়ে ছোট মন্তব্য করলেন, না, একইরকম আছে দেখছি।
আমি আশান্বিত, তার মানে বিনাইন?
মাথা নাড়লেন।–মনে হয় না, এ দু’মাসের চিকিৎসায় রিপোর্ট গুলোর পিকচার ঠিক এক রকম হবার কথা নয়, আর উনিও আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো বোধ করতেন।
ঠাণ্ডা মুখে ঘোষ সাহেব জিগ্যেস করলেন, এখন তাহলে বায়োপসি ছাড়া আর কিছু করার নেই?
আবার মাথা নাড়লেন।–দেখুন আপনার কিছু টাকার জোর থাকলে আমি এখনই কাটা-ছেঁড়ার বা ঘাঁটাঘাটির মধ্যে যেতে রাজি নই ..বম্বের টাটা জশলোক হসপিটাল থেকে বিনা বায়োপসিতে গ্রোথ টেস্ট করে আনতে পারেন, ওখানে ছাড়া এ-দেশে আর কোথাও ওই টেস্ট করার ব্যবস্থা নেই।
দু’জনেই উৎসুক আমরা। জিগ্যেস করলাম, কি টেস্ট ওটা?
–নাম বললে বুঝতে পারবেন না, বিরাট ল্যাটিন নাম–ধরুন অনেকটা ই. সি. জি’র মতো, হাইলি কমপিউটারাইজড, ইলেক্ট্রোগ্রাফিক মেথডে এটা করা হয়, এর রিডিং থেকে বোঝা যায় গ্রোথ বিনাইন কি ম্যালিগন্যান্ট অথবা মাঝামাঝি কিছু।…আপনাদের বলেই দিই, রিডিং যদি একশ চল্লিশ ইউনিটের মধ্যে পাওয়া যায় তাহলে ওটা বিনাইন–ভাবনার কিছু নেই, একশ পঁয়তাল্লিশ পর্যন্তও ইগনোর করা চলে, আবার একশ ষাট হলে ধরে নিতে হবে ডেফিনিটলি ম্যালিগন্যান্ট আর একশ পঁয়তাল্লিশ থেকে একশ উনষাট হল ট্র্যান জিটারি স্টেজ–যত বাড়বে ততো ম্যালিগন্যানসির সম্ভাবনার দিকে যাচ্ছে ধরে নিয়ে চিকিৎসা করতে হবে।
ঘোষ সাহেব ঠাণ্ডা মুখেই জিগ্যেস করলেন, এটা সিওর টেস্ট?
–বায়োপসির থেকে বেশি ছাড়া কম সিওর নয়।
–বম্বে গিয়ে এই টেস্টের রেজাল্ট পেতে কিরকম সময় লাগবে?
হসপিটালের দিক থেকে কোনো অসুবিধে না থাকলে আপনি দু’দিনের মধ্যেই রেজাল্ট নিয়ে চলে আসতে পারেন।…এখান থেকে অ্যাডভাইস আর টেস্ট রিপোর্টগুলো নিয়ে যেতে হবে, সেই সঙ্গে ওখানকার একজনকে একটা পারসোনাল চিঠিও দিতে পারি।
ঘোষ সাহেবকে একটু চিন্তায় মনে হল। জিগ্যেস করলেন, ধরুন আমি যদি দিন দশেক পরে যাই…তাহলে কি ক্ষতি হবার সম্ভাবনা।
–কিছু না কিছু না, এক বছরের ওপর এভাবে আছেন, দশ পনেরো দিনে আর কি ক্ষতি হবে।…তবে এ-সব ব্যাপারে খুব একটা দেরি না করাই ভালো।
ঘোষ সাহেব জানালেন তিনি ঠিক দশ দিন পরেই যাবেন, সেই অনুযায়ী উনি যেন অ্যাডভাইস আর চিঠিটা লিখে রাখেন।
চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছি। আমার ভিতরটা উদ্বেগে আচ্ছন্ন। একটু বাদে ঘোষ সাহেব বেশ হালকা গলায় বললেন, গোপনতার পাট শেষ তাহলে… কিন্তু আমি দমে যাচ্ছি কেবল মেয়েটার কথা ভেবে, একেবারে বাচ্চা বয়েস থেকে ও আমার মা হয়ে বসে আছে, ভয়ে দুশ্চিন্তায় আধ মরা হয়ে যাবে।
প্রায় আধা-আধি পথ পেরিয়ে এসে আমি মুখ খুললাম। বললাম, যদি চার আনা মিথ্যে আর বারো-চৌদ্দ আনা মিথ্যের মধ্যে কোনো তফাৎ না ধরেন আমার মনে হয় এখনো ওদের কিছু না বলাই ভালো, কাউকে কিছু না জানিয়ে আপনাকে বম্বে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমি নিতে পারি–
উৎসুক মুখে আধা-আধি ঘুরে বসলেন প্রায়।–কি করে?
কি করে বলতে উনি নির্বাক খানিক। কাউকে জানতে বুঝতে না দেবার এমন সহজ রাস্তাও থাকতে পারে সেটা তাঁর অবশ্য কল্পনা করার কথাও নয়। হাত তুলে আমার কাঁধে দু’বার মৃদু চাপ দিলেন। কৃতজ্ঞতা জানাবার আর কোনো ভাষা নেই। বললাম, কোন সময়ে ছেলেমেয়ের সামনে আপনি কথাটা তুলবেন সেটা পরে ঠিক করা যাবে, এখন বলুন তো আপনি মাঝখানে দশ-দশটা দিন সময় নিলেন কেন?
–আপনাকে বলা হয়নি, কাল পরশুর মধ্যেই বলতাম, আর ঠিক ছ’দিন বাদে কালীপুজো, আট বছর ধরে এই পুজোটি আমার বাড়িতে হয়ে আসছে..আমি করছি বললে ঠিক হবে না, আমাকে দিয়ে করানো হচ্ছে।
আমি বেশ অবাক।–রাধা করাচ্ছেন?
–আর কে… তবে আলাদা কোনো মূর্তি এনে পুজো নয়, আমার ঘরে কালীর যে বড় ফোটোখানা দেখেন, তাকেই বেদিতে সিয়ে পুজো–এও ওই মেয়েরই বিধান, বলে সবই এক, আলাদা মূর্তি গড়িয়ে কি হবে? আর ওমুক সময় তমুক সময় বা মাঝ রাত্তিরে পুজো–এ সবও নেই, আমাদের পুজো রাত এগারোটার মধ্যেই শেষ–ও অবশ্য সমস্ত রাত ধরেই পুজো করে।
…আট বছর ধরে পুজো চলছে মানে অংশুমান ঘোষ তখন ও. সি’র থেকে বড় পোস্টে। এই মানুষকে কালীপুজোয় নামিয়েছে। মেয়েটার ক্ষমতা আছে বলতে হবে। আর এ-পুজো এখন ভদ্রলোকের কাছে এমনই ব্যাপার যে গলার রোগের সঙ্কটও তার পরের ভাবনা। আমার স্নায়ু জুড়ে সেই পুরনো কৌতূহল, এই মেয়ের কি ঘটনা আর বিশ্বাসের নজির দেখে ভদ্রলোকের এ-রকম পরিবর্তন।
জিগ্যেস করলাম, বেশ ঘটা করে পুজো নাকি?
–আগে তাই হত, রাধার আবার এ পুজোয় ঘটা পছন্দ কিন্তু মুশকিল কি জানেন মশাই, লোকে ভাবে ব্যাটা পুলিশের চাকরিতে কত পাপ করেছে ঠিক নেই, যার ফলে এখন পুজো করে দোষ কাটানোর চেষ্টা–তবু লোকজন হয় কিছু, রাধার সঙ্গে দু’চারজন আসে, মেয়ে আর ছেলের শ্বশুর বাড়ির সব আসেন, ভক্তিশ্রদ্ধা আছে এমন আরো দু’পাঁচজনকে বলি, এবারে আপনি আছেন, আপনার বাড়ির সক্কলকেও আনতেই হবে–আমি নিজে গিয়ে বলে আসব। আমার মনে হয় আপনার ভালো লাগবে।
তাঁর অগোচরে গাড়ির গতি অনেকটাই কমিয়ে দিলাম। বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছি, মনে যা আসছে ভদ্রলোকের মানসিক অশান্তির মধ্যে সেটা বলব কি বলব না সেই দ্বিধা। আড়চোখে এক বার দেখে নিলাম। মনে হল কালীপুজোর নামে আপাতত রোগের চিন্তা ভুলে গেছেন।
–ইয়ে, পাড়ার আর কাউকে বলবেন না?
ভদ্রলোক কত চতুর সেটা তাঁর পরের কথা থেকেই বোঝা গেল। আমার প্রশ্ন শুনে ঘুরে একটু দেখে নিলেন। তারপর হেসে বললেন, আপনার কাছে আমার ঋণের পাহাড় জমছে, আমাকে আর একটা ভুলের হাত থেকে বাঁচালেন। এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসার পর থেকে আপনার ওপর আমি যেভাবে দখল নিয়ে চলেছি তাতে প্রতিবেশীদের কাছে আপনাকে অপ্রস্তুত হতে হয় কিনা এ-চিন্তা আমার মাথায় আসা উচিত ছিল। নিশ্চয় করব। ভদ্রলোকদের নিজে গিয়ে কর্তাদের বলে আসব, আর বাড়ির সকলকেও নেমন্তন্ন করতে মেয়ে বা বউমাকে পাঠাবো–
তাড়াতাড়ি বাধা দিলাম, অত দরকার নেই, শুধু ভদ্রলোক ক’জনকে বললেই হবে–
–থামুন তো মশাই, হেসেই দাবড়ানির সুরে বললেন, আপনার প্রেস্টিজ এখন আমার নিজের প্রেস্টিজের থেকেও ঢের বড়, আপনি একটুও ইতস্তত করবেন না।
এভাবে বলা সত্ত্বেও বিব্রত বোধ করছি। যে-যে কারণে এ ব্যাপারে আমার নাক গলানো তা ব্যক্ত করার নয়। বললাম, প্রেস্টিজের কোনো ব্যাপার নয়, এরা আপনাকে একটু দাম্ভিক ভাবেন সেটা আমার পছন্দ নয়।
–আপনার পছন্দ না হলে কি হবে, ঠিকই তো ভাবেন। এত মাস হয়ে গেল রিটার্ন ভিজিট দেবার ভদ্রতাটুকুও স্বীকার করিনি, আমাকে দাম্ভিক ভাববেন না তো কি বিনয়ী বোষ্টম ভাববেন?
হেসে ফেললাম।–তাহলে এমন জ্ঞানপাপীই বা হতে গেলেন কেন?
অসুখ-টসুখের চিন্তা আপাতত উবেই গেছে মনে হয়। হাসছেন।—তাহলে সত্যি কথাটাই আপনাকে বলি, পুলিশের লোক তো, এখানে আসার এক মাসের মধ্যে কে কি লোক আর কোন্ ভাবের লোক ঘরে বসেই সেটা আমার জানা হয়ে গেছে–আর স্বভাবখানাও তেমনি হয়েছে এখন, মন না টানলে লোক-দেখানো গলাগলি আর করতে পারিনে।
কথাগুলো ভালো লাগছে, তাই আমার নাক গলানোটা আরো খারাপ লাগছে। বললাম, তাহলে এখনো বাদ দিন–
–ফের এই কথা! রাগত মুখ।–আমার ভুলটা শুধরেছেন বলে আমি কত খুশি বুঝতে পারছেন না?
.
পরদিন সকালে হাঁক-ডাক করে সাড়া দিয়ে অংশুমান ঘোষ হাজির। আমার স্ত্রীকে ডাকিয়ে বাড়ির সক্কলকে এমন কি কাজের লোকদেরও নেমন্তন্ন করলেন। বললেন, আমি বলে গেলাম, এরপর মেয়ে এলে তাকেও পাঠাব–
জোরালো গাম্ভীর্যে বলে উঠলাম, তাহলে নেমন্তন্ন নট অ্যাকসেপ্টেবল হয়ে যাবে, আপনি আপনার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডেকে নেমন্তন্ন করলেও আমরা দল বেঁধে যাব।
-থ্যাংক ইউ। বউঠান এবার আমাদের চা পাঠান।
স্ত্রী চলে যেতে উনি পকেট থেকে এক গোছা একশ টাকার নোট বার করে বললেন, আমার দ্বারা তো হবে না, আপনি প্লেনের দু’খানা টিকিট কেটে ফেলুন–ডেট ওপেন রেখে রিটার্ন টিকিট করে নেওয়াই ভালো।
বিব্রত মুখে বললাম, বেড়ানো ছাড়া হয়তো সত্যি কিছু কাজও করে আসতে পারব–আপনার টিকিটের টাকাটাই শুধু দিন।
পুলিশের গরম চোখ দেখার সুযোগ কমই হয়েছে। ঠায় চেয়ে রইলেন খানিক। তারপর বেশ ধীর মোটা গলায় বললেন, এসময় আপনাকে খোয়ানো মানে আমার দিক থেকে কতটা খোয়ানো সেটা জেনেও আপনি আমাকে সেই দিকে ঠেলবেন নাকি?…আপনি যাবেন কি যাবেন না সেটাই আগে ভেবে ঠিক করুন তাহলে।
তাড়াতাড়ি হাত বাড়ালাম।–ঠিক আছে দিন, কিন্তু অত খরচ করে প্লেনে যাবার কি দরকার? তাড়া তো কিছু নেই, ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাসে গেলেই তো হয়?
–না মশাই, এখন পুজোর মেজাজে আছি, তারপর আর সইবে না, তাছাড়া আপনার প্ল্যানেও ফাঁক থেকে যাবে..আপনার ফিল্ম প্রোডিউসাররা আপনার জন্য প্লেনের ভাড়া গোনে না ট্রেনের? হাসতে লাগলেন, আর একটা ব্যাপার কি জানেন, আমার লেট ফাদার তাঁর একমাত্র ছেলের জন্য এতই জমিয়ে রেখে গেছেন যে পরের দু’পুরুষ কিছু না করেও পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়ে দিতে পারত…কিন্তু ভদ্রলোক যত বড় চাকরিই করুন সাদা রাস্তায় অত টাকা হয় না, আমরা দু’দশ বার প্লেনে সমস্ত ভারতবর্ষ ঘুরলেও সেই বিত্ত খুব বেশি হালকা হবে না…তবু যতটুকু হয় ততটুকুই হালকা বোধ করব।
দ্বিরুক্তি না করে টাকাগুলো নিলাম। হেসে বললাম, বাপ না পারুক ছেলে তো এ ব্যাপারে পুলিশের মুখ কিছুটা উজ্জ্বল করেছেন–
চা আসতে পর-পর কয়েকটা চুমুক দিলেন, কৌতুকে টুপুটুপু দুই চোখ আমার মুখের ওপর। যেন ভারি একটা মজার কথা শুনলেন। পেয়ালা রেখে জিগ্যেস করলেন, লেখকদের মতে অপ্রাপ্য প্রশংসা হজম করে গেলে কতটা অপরাধ হয়?
আমি অপ্রস্তুত একটু।
বাকি চাটুকু শেষ করে হৃষ্ট মুখেই বললেন, আমি যতটুকু সাধু এখন তার সবটাই গুঁতোর চোটে।…বাবার থেকে টাকার খাঁই আমার একটুও কম ছিল না, সুযোগ পেলে দু’হাতে টাকা খেয়েছি। তারপর কি যে হয়ে গেল, এই বিজ্ঞানের যুগে আপনি সেটা বিশ্বাস করবেন কি করে? টাকা চাইতে গেলে বা নিতে গেলে কোথা থেকে যে বাতাসে স্পষ্ট নিষেধ ভেসে আসত আপনি ভাবতে পারবেন না। বড়বাবু এটি কোরো না। বড়বাবু এটি ভালো হচ্ছে না। বড়বাবু লোভের আস্কারা দিও না, বিদেয় করো বিদেয় করো। এ এক আশ্চর্য নিষেধ মশাই! তা সত্ত্বেও দুই একবার নিইনি এমন নয়, আর তারপরেই যেন দম-বন্ধ করা এক বিষাদের খুপরির মধ্যে ঢুকে গেছি, কাঁধ থেকে আঙুলের হাড় পর্যন্ত যন্ত্রণা–সবই সাইকোলজিকাল ব্যাপার এ আমিও জানি, কিন্তু আমার তো এমন হবার কথা নয়। শেষে আমার স্ত্রীর কাছে প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছে এমন টাকা আর ছোঁব না।…সেই মহিলা এই মেয়েটাকে কি চোখে যে দেখত, বদলি হয়ে অন্যত্র চলে আসার পরেও ছুটে ছুটে ওর কাছে চলে যেত, একবার ধরে আনতে পারলে সহজে ছাড়তে চাইতেন না। মৃত্যুর আগে আমাকে নয়, ওই হাত ধরে বলে গেছল, সব রইলো, দেখিস–
এই মানুষ আমার চোখে আর জাঁদরেল পুলিশ অফিসার নন। ভাবের আবেগে মনের গ্লানি ধুয়ে ফেলতে পেরেছেন এমন একজন স্বচ্ছ পরিচ্ছন্ন মানুষ।
পরের দু’দিন কেবল হীরু দাসের ছোটাছুটি আর ব্যস্ততা লক্ষ্য কলাম। বাঁশ এলো, ত্রিপল এলো, ছাদে রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা। কেটারার নয়, ঠাকুর এসে রান্না করবে। বাজার করার দায়িত্ব দেবব্রত অর্থাৎ জামাইয়ের ওপর, সঙ্গে হীরু থাকবে। পাড়ার ইলেকট্রিসিয়ানের সঙ্গে আমিই যোগাযোগ করে দিলাম। দীপাবলীর রাত, দোতলার ছাদ পর্যন্ত আলো দিয়ে সাজানো হবে। বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘোষ সাহেবের মেয়ে শমী আর ঊর্মিলাকে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি ঢুকতে আর বেরুতে দেখেছে। তার আগে ভদ্রলোকদের নেমন্তন ঘোষ সাহেব সেরে এসেছেন নিশ্চয়। তাঁরা কতটা অবাক হয়েছেন বা কি ভাবছেন তা
[৫৩ পৃষ্ঠার শেষাংশ এবং ৫৪ নং পৃষ্ঠা মিসিং]
কোন্ গল্প? ওরা তো আপনার ক’টা ভালো ভালো গল্পের সর্বনাশ করেছে, ট্র্যাজেডিকে কমেডিতে ঘুরিয়ে দিয়েছে–
ঢোঁক গিলে জবাব দিলাম, ওদের একটা আইডিয়া নিয়ে আলোচনা, পছন্দ হলে লিখে দেব।
বউমা ঊর্মিলার মন্তব্য, সে-ও ভালো, অমন সুন্দর গল্পগুলোকে উল্টেপাল্টে দিলে এতে খারাপ লাগে–
–আপনার প্লেনে আসা যাওয়া হোটলে থাকা খাওয়া সব খরচ এঁদের? শমীর জানার আগ্রহ।
বললাম, এ-সব খরচ ওঁদের কাছে কিছুই না।
–অন্য যে-সব ছবি হয়েছে, আপনাকে যেতে হয়েছে?
–একবার ছেড়ে দু’তিন বারও যেতে হয়েছে।
–বেশ মজা তো…কিন্তু ওদের আইডিয়া মানে তো মারামারি রক্তারক্তি কাণ্ড, আপনি কি সেই গল্প লিখবেন নাকি?
এ প্রসঙ্গ থামলে বাঁচি। বললাম, আমি কোন্ ধাঁচের লেখক ওরা জানে, সে-রকম আইডিয়া হলে আমাকে ডাকত না। কিছু মনে পড়তেই যেন ঘড়ি দেখলাম আর সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লাম, এক ভদ্রলোকের আসার কথা আছে, চলি–
সঙ্গ দেবার আছিলায় ঘোষ সাহেবও উঠলেন। নিচে নেমে ঠাট্টার সুরে বললেন, আপনি যে ফাস্ট রাউণ্ডেই ঘেমে গেলেন দেখছি, ফাইন্যাল রাউণ্ডে কি করবেন?
হেসে জবাব দিলাম, আপনি যে জার্সিটা গায়ে চড়ানোরও সুযোগ দিলেন না…তা ছাড়া এমন সত্যি কথাগুলো একেবারে পুজোর ঘরের প্রতিমার সামনে বসে!
হাসতে লাগলেন।–আমি কে বলুন, সকলি তোমার ইচ্ছে, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি…আঃ, জাস্ট দি রাইট প্লেস ফর এ ভেরি ভেরি অনেস্ট লাই।
জয় হর, মনোরমা জয় শিবরানী
জয় দুর্গা জয় কালী মা ভবানী।
জয় মহাকালী তারা জয় মা ষোড়শী
জয় মা ভুবনেশ্বরী ত্রিতাপ নাশিনী।
ভৈরবী ছিন্নমস্তা ধূমাবতী বগলা
মাতঙ্গী কমলা দুর্গতিনাশিনী
জয় হর মনোরমা জয় শিবরানী।
.
দেয়াল ঘেঁষা বেদীর ওপর কালীর ফোটোখানা বসানো হয়েছে। তারপর এতবড় ঘরে তিন ভাগের এক ভাগ জুড়ে পূজার উপকরণ। ধূপ-ধুনো আর ফুলের গন্ধে বাতাস ভরপুর। পুজারীর আসনে রক্তাম্বর বসনে যে মানুষটি বসে তিনিই কপালী বাবা। নোগা লম্বা, বুক-পিঠ সমান কাঁচা পাকা চুল দাড়ি। বয়েস ষাট হতে পারে আশিও হতে পারে। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, দুই বাহুতে রুদ্রাক্ষের বলয়, কপালে সিঁদুর লেপা। পুজোর আসনে পাথর মূর্তির মতো বসে আছেন। তাঁর বাঁ দিকের আসনে বসে রাধা, স্নান-সারা ভিজে চুল পিঠে ছড়ানো। পরনে গরদের থান, গায়ে শেমিজ। আসনে বসার আগে ঘণ্টাখানেক ধরে তাকে লক্ষ্য করছি। এত কাছ থেকে বয়েস অব সাতাস আঠাশ মনে হয় না, বিয়াল্লিশও মনে হয় না তা’বলে। তেত্রিশ চৌত্রিশ ভাবা যেতে পারে। কাছ থেকে দেখে সব থেকে ভালো লেগেছে তার চোখ দুটো। প্রথম যখন দেখি, স্বচ্ছ টলমলে। ঘোষ সাহেব আলাপ করিয়ে দিতে সোজা যখন মুখের দিকে তাকালো, মনে হল আমারও অজানা অন্তঃপুরে ঘুরে এলো। অথচ বড় স্নিগ্ধ আর ঠাণ্ডা সেই দৃষ্টি। তারপর যত দেখছি মনে হয়েছে সে যেন সকলের মধ্যে থেকেও নেই, ভাবের ঘোরে সকলের কাছ থেকেই দূরে সরে যাচ্ছে।
তার পাশে একটি মেয়ে হারমনিয়াম নিয়ে বসে, ও-পাশে আর একটি মেয়ের হাতে দুটো কাঠের খঞ্জনি। হঠাৎ সকলকে চমকে কপালী বাবা তিন বার রব তুললেন, কালী! কালী! কালী!
হলঘর সামনের ঘর আর বারান্দা মেয়ে পুরুষে ঠাসা। কপালী বাবার ডান পাশের দুটি মেয়ের হাতে শখ আর ঘণ্টা বেজে উঠল। তারা থামতেই দেখা গেল আসনে বসে রাধা অল্প অল্প ডাইনে বাঁয়ে দুলছে। পাশের মেয়ে হারমোনিয়ামের বিড চেপে একটা টানা সুর ধরে রাখল, খঞ্জনির মৃদু ধ্বনি উঠল।
তারপর রাধার ওই গান, জয় হর-মনোরমা জয় শিবানী, জয় দুর্গা জয় কালী জয় মা ভবানী..
গানও নয়, টানা সুরের স্তবও নয়, কিন্তু এমন কিছু যা দেহের কণায় কণায় রোমাঞ্চ তুলে মনের গভীরে এসে স্থির হয়। নিটোল মিষ্টি গলা, সুরের কুশলী বিন্যাস নেই, আছে কেবল আবেগ-বিহ্বল বিশ্বাসের জয়ধ্বনি তুলে ঘরে বাইরে বারান্দায় যে-যেখানে আছে তাদের মনগুলোকে জড়ো করে এই ষড়ৈশ্বর্যের বেদীমূলে আকর্ষণ করার সহজ মহিমা।
এবারে রাধা নিশ্চল। কপালী বাবার দেবী-পূজা শুরু। তাঁর পূজায় কণ্ঠস্বর নেই, বাণী নেই, মন্ত্র নেই। থাকলেও সেটা দর্শকের কানে অশ্রুত। এক একরকমের হাতের মুদ্রা আঙুলের মুদ্রা, পটের পায়ে ফুল-চন্দন ছোঁড়া, কখনো ক্রুদ্ধ, কখনো সমর্পণে আনত। তারপর আবার স্থির নিশ্চল।
হারমোনিয়ামে সুর উঠল। খঞ্জনির মৃদুধ্বনি। রাধা অল্প অল্প দুলছে। সকলে আগ্রহে উন্মুখ আবার। এবারের গানে আর এক সুর, আর এক ভাব আর এক রস।
শ্মশান তো ভালবাসিস মাগো,
তবে কেন ছেড়ে গেলি?
এত বড় বিকট শ্মশান আর তুই কোথা
পেলি?
দেখ সে হেথা কি হয়েছে,
কোটি কোটি শব পড়ে আছে
কত ভূত বেতাল নাচে, রঙ্গে ভঙ্গ করে
কেলি।
ভূত পিশাচ তাল বেতাল,
নাচে আর বাজায় গাল,
সঙ্গে ধায় ফেরুপাল, এটা ধরি ওটা ফেলি।
আয়না হেথা নাচবি শ্যামা
শব হবে শিব পা ছুঁয়ে মা,
জগৎ জুড়ে বাজাবে দামা।
দেখবে জগৎ নয়ন মেলি।
(এমন শ্মশান কেন মা ছেড়ে গেলি।)
অনুযোগের সঙ্গে করুণ বিদ্রুপের মিশেল, কিন্তু প্রাণের আকৃতি আবেগে ভরপুর। আমার এপাশ ও-পাশে অমর গাঙ্গুলী, ভটচায মশাই রায় মশাই আর কন্টাকটর দত্ত সাহেব বসে। লক্ষ্য করছি তাঁরাও নির্বাক, অপলক।
কপালী বাবার আবার সেই নিঃশব্দ মন্ত্রহীন হাত আর কর-মুদ্রার পূজা। ত্রিশূল হাতে হঠাৎ একবার আসনে উঠে দাঁড়ালেন, প্রতিমা পটকেই বিদ্ধ করবেন এমন ভাব আর মূর্তি। তার পরেই ত্রিশূল ফেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আত্মসমর্পণ। উঠে বসতে সময় লাগল।
হারমোনিয়ামে সুর উঠল। খঞ্জনির মৃদু ঝুম ঝুনা রাধা দুলছে।
চিন্তামনি তারা তুমি, আমার চিন্তা করেছ কি?
নামে জগৎ-চিন্তাময়ী, ব্যাভারে কই তেমন দেখি।
প্রভাতে দাও বিষয় চিন্তে, মধ্যাহ্নে দাও জঠর চিন্তে
ও মা শয়নে দাও সর্ব চিন্তে, বল মা তোরে কখন ডাকি।
পুজো সাঙ্গ কিনা বুঝলাম না, কারণ কপালী বাবা তার আসনে স্থির বসে। রাধা থামছে, ভাবের ঘোরে দুলছে, আবার গান ধরছে। কোনোটা দু’লাইন কোনোটা চার লাইন, ভাবের আবেগেই আত্মবিস্মৃত হয়ে থেমে যাচ্ছে মনে হয়, ঘোর ভাঙতে নতুন গান ধরছে।
জানোরে মন, পরম কারণ, শ্যামা তো শুধু মেয়ে নয়
মেঘের বরণ করিয়ে ধারণ, কখনো কখনো পুরুষ হয়।
কভু বাঁধে ধরা কভু বাধে চূড়া ময়ুরপুচ্ছ শোভিত তায়
কখনো পার্বতী কখনো শ্ৰীমতী, কখনো রামের জানকী হয়।
হয়ে এলোকেশী করে লয়ে অসি দনুজদলে করে সভয়।
জগৎ জুড়ে জাল ফেলেছিস, শ্যামা কি তুই জেলের মেয়ে
তোর মায়ার জালে, মহামায়’, বিশ্বভুবন আছে ছেয়ে।
‘দয়াময়ী মা যদি হইতে তুমি;
শিব কেন নিলেন শ্মশান ভূমি।
কত যন্ত্রণা জ্বালা দাও তুমি মা
শ্মশানবাসিনী মা দিন তারিণী।
‘মাতিয়ে দে মা আনন্দময়ী, একেবারে মেতে যাই,
তেমন করে মাতিয়ে দে মা, যেমন মেতেছিল রাই।
দেশে দেশে গ্রামে গ্রামে, তব নাম সুধা পানে,
ও মা মাতৃক যত নরনারী দেখে শুনে প্রাণ জুড়াই।
‘যে ভালো করেছ কালী, আর ভালতে কাজ নাই,
ভালয় ভালয় বিদায় দে মা আলোয় আলোয় চলে যাই।
শেষ হল না, আর্ত রব তুলে পটের সামনে লুটিয়ে পড়ল। পড়েই থাকল। মেয়েরা কেউ কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমার মনে হল বড় শান্তি আর বড় আনন্দের কান্না। লক্ষ্য করলাম ভটচায মশাই আর রায় মশাইরও চোখ ঝাপসা।
কপালী বাবা রাধার মাথায় পিঠে কমণ্ডলুর জল ছিটোতে লাগলেন। খানিক বাদে রাধা আস্তে আস্তে আবার উঠে বসল। আর দুলছে না। স্থির নিশ্চল। .
কপালী বাবা প্রদীপ আর চামর দুলিয়ে সংক্ষেপে আরতি পারলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শান্তি জল ছিটালেন। হল-এর পাশের ঘরে আর বারান্দায় যারা তারাও তাঁকে ডেকে ডেকে শান্তি জল মাথায় নিল। উনি আবার আসনে ফিরে আসতে রাধা আস্তে আস্তে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো। তারপর সকলকে সচকিত করে ডাকল, বড়বাবু এখানে এসো।
ঘোষ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর পরনে গরদের ধুতি, গায়ে হাফ-হাতা পশমী গেঞ্জি। গরদের ধুতির কোঁচা চাদরের মতো গায়ে জড়ানো। পটের সামনে গিয়ে জামু আসনে বসলেন। কপালী বাবা তাঁর কপালে লম্বা করে সিঁদুর টেনে দিলেন। কালীর পটের পা থেকে ফুল তুলে নিয়ে মাথায় রেখে কিছু মন্ত্র পড়লেন হয়তো। তারপর ওই ফুল গেঞ্জির গলার দিক টেনে বুকে রাখলেন। রাধা এবারে মঙ্গল প্রদীপ তুলে নিল। অন্য হাতের তালু প্রদীপের শিখার ওপর রেখে সেই তপ্ত হাত তার মাথায় বোলালো। এ-রকম করে আগুনের তাপ নিয়ে নিয়ে তিন বার মাথায় কপালে, তিন বার বুকে আর তিন বার পিঠে বোলালো।
ঘোষ সাহেব উঠ আস্তে আস্তে ফিরে এলেন। ঘরের সকলের সেই মঙ্গল শিখার স্পর্শ মাথায় নেবার হিড়িক পড়ে গেল। রাধা প্রতিবার শিখার ওপর হাতের তালু রাখছে আর একজনের মাথায় সেই হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দেখলাম, নিঃশব্দে অমর গাঙ্গুলীও মাথা পেতে দিলেন। ঘরের সকলের শেষ হতে বারান্দায় ডাক পড়ল। সেখানে আশিস-তাপ নেওয়া শেষ হতে সামনের ঘরে। শেষে সামনের ঘর থেকে হলঘরে। সক্কলের মাথায় প্রদীপ শিখার তাপ বোলানো হতে হাসি-ছোঁয়া গম্ভীর মুখে অংশুমান ঘোষ তার সামনে এসে দাঁড়াল।-আগে তোর হাতখানা দেখা, কতটা পুড়ল দেখে নি।
রাধা হাত দেখালো না, মুখের দিকে একটু চেয়ে থেকে পুজোর ঘরের দিকে এগোতে গেল।
দাঁড়ারে মা, আগে, আমারটুকু সেরে নিই।
ঘোষ সাহেবের মুখে এই মা-ডাক আর ‘তুই বলে কথা আমিও এই প্রথম শুনলাম। রাধা দাঁড়িয়ে গিয়ে আবার তার দিকে তাকালো। স্থির হয়ে দাঁড়ালো। হাত দুই তফাতে এসে ঘোষ সাহেব আবার মাটিতে জামু আসনে বসলেন, তারপর উপুড় হয়ে মাটিতে মাথা রেখে প্রণাম করলেন পনেরো বিশ সেকেণ্ড ধরে।
রাধা হাতের প্রদীপ পাশের একজনের হাতে দিল। ঘোষ সাহেব উঠে দাঁড়াতে শাড়ির আঁচল গলায় জড়িয়ে নিল। ঘোষ। সাহেব মাটিতে মাথা রেখেছিলেন, কিন্তু রাধা এগিয়ে এসে হাঁটু মুড়ে বসে তার দু’পায়ের ওপর মাথা রাখল, দু’হাতে পা দুটি জড়িয়ে ধরে থাকল। ঘোষ সাহেব বিড়বিড় করে বললেন, ওঠরে মা ওঠ,
উঠতে দেখলাম তার দু’পাই চোখের জলে ভেজা।
আমি ভক্ত নই, বিশ্বাসের গর্বও নেই, কিন্তু অভিভূত হবার ব্যাপারে কোনো ইচ্ছে বা যুক্তির ব্যাপার নেই এটুকু অনুভব করতে হল। এরপর প্রণামের ঘটা। কোথা থেকে প্রথমেই হীরু এসে রাধার পায়ে পড়ল। তার পিছনে ঘোষ সাহেবের ছেলেমেয়ে ছেলের বউ নাতিনাতনিরা আর প্রতিবেশিনীদেরও অনেকে দাঁড়িয়ে।রাধা নিচু জাতের মেয়ে শুনেছিলাম। এখানে জাতের বিচার কেউ করছে না।
পায়ে পায়ে সামনের বারান্দায় চলে এলাম। কোণ ঘেঁষে চুপচাপ অমর গাঙ্গুলী ঘুরে দাঁড়িয়ে। আমার হাত দুটো চেপে ধরলেন। ধরা গলায় ফিসফিস করে বলে উঠলেন, আমার কি হবে মুখুজ্জে মশাই –ওদের দুজনকে নিয়ে আমরা কি না বলেছি।
আমি হেসে বললাম, আপনারই সবার আগে গ্লানি ধুয়ে গেল, মুক্তি হয়ে গেল।
-আপনি ঠাট্টা করছেন…? কাঁদ কাঁদ মুখ।
আমি ঠাট্টা করছি না।
খানিক বাদে কপালী বাবাকে আর দেখলাম না। তার পুজোর কিছু বুঝিওনি মুগ্ধ হইনি। তবু একটু আলাপ করার ইচ্ছে ছিল। শুনলাম, তার ফেরার জন্য ট্যাক্সি মজুত ছিল, চলে গেছেন। আগে নিজের ঘরের জংলী কালীর পুজো সারবেন, তারপর সমস্ত রাত শ্মশান কালীর পুজো।