সোনার হরিণ নেই – ১৮

 

আঠারো

জিপ থেকে নেমে বাপী বাংলোটার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল খানিক। বানারজুলি জঙ্গলের বড় সাহেবের বাংলো। বারো বছরের এক ছেলের চোখে যেটা রূপকথার দেশের কোনো নিষেধের বাড়ির মতো।—রূপকথার সব নিষেধই শুধু ভাঙার জন্য। সেই ছেলেও ভেঙেছিল। তারপর দু’বছর ধরে ভেঙেই চলেছিল। তারপর পিঠের চামড়া ফালা ফালা। জিভে রক্তের স্বাদ।

এখন নিষেধ নেই। কোনো বড়সাহেব বা মহারানীর রক্তচক্ষু নেই। তাদের কাপুরুষ ছেলের দামাল শাসন নেই। সবার মধ্যমণি যে, এই পুরীতে সেই মেয়েও নেই।…আষ্টে-পৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরা স্মৃতির তবু লয়-ক্ষয় নেই।

একজন বেয়ারা ছুটে এলো। সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। দেবেই। ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। তার ওপর জিপে এসেছে। পরনে দামী গরম প্যান্ট কোট শার্ট, গলায় ঝকঝকে টাই, পায়ে চকচকে শু। ওদের বড় সাহেবের কাছে ছোট কেউ আসেনি।

বেয়ারার হাতে কার্ড দিয়ে বাপী ড্রাইভারকে বলল, ফাইল আর সঙ্গের প্যাকেটটা পৌঁছে দিয়ে আসতে। ফাইলে কিছু প্ল্যান, জঙ্গলের নকসা, আর একটা দরখাস্ত। প্যাকেটে দুটো দামী হুইস্কির বোতল। আবুর কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল তার বড় সাহেবও রসিক মানুষ।

বড় সাহেব মধ্যপ্রদেশের মানুষ। মাঝবয়সী। কার্ড হাতে বেরিয়ে এলো। জিপ, রিজিয়ন্যাল ম্যানেজারের বেশবাস আর চেহারাপত্র দেখে হেলাফেলার লোক ভাবা গেল না। তার ওপর গায়ত্রী রাইয়ের নাম ভালোই জানে, আর রসের দোসর হিসেবে রণজিৎ চালিহাকেও খুব চেনে। উপহারের প্যাকেট দেখে মুখে বিড়ম্বনা। এ-সবের কি দরকার ছিল ইত্যাদি। দশ মিনিটের মধ্যে বাপীর কথা শেষ। সদয় বিবেচনার প্রতিশ্রুতি লাভও। রাই অ্যান্ড রাইয়ের আর্জি সামান্য। এত বড় জঙ্গলের কত জায়গা অকেজো পড়ে আছে। সেখানে কোন্ কোন্ হার্বের চাষ হতে পারে আর কত রকমের প্রয়োজনে সে-সব দরকার ইত্যাদি। ব্যবসা হলেও জনসেবারই কাজ। সুবিধে দরে লীজ পেলে আপাতত কোথায় কতটা পড়ো জংলা জমি নিজেরা সাফ করিয়ে নিয়ে টেস্ট-কেস হিসেবে কাজে নামা যেতে পারে তার ফিরিস্তি। এতে জঙ্গলও কিছুটা পরিচ্ছন্ন হবে।

দরখাস্ত রেখে বড় সাহেব আশ্বাস দিল, যথাসাধ্য চেষ্টা করবে, ডি-এফ-ও.-র এতে আপত্তি হবে বলে মনে হয় না।

এই লোক তুষ্ট যখন, আপত্তি হবে না জানা কথাই। হুকুম আসার আগেই বাপীর প্ল্যানমতো আবু লোক যোগাড় করে কোমর বেঁধে কাজে লেগে গেল। তার উৎসাহ এখন দেখার মতো। জঙ্গলের বহু মেহনতী মানুষ তার হাতে মজুত। বড় সাহেবের সায় আছে যখন, বাড়তি কিছু পেলে উপরি কাজ তারা সানন্দে করবে।

জঙ্গলের চার-পাঁচ জায়গায় এমন তড়িঘড়ি কাজ শুরু হয়ে যেতে দেখে গাম্ভীর্যের তলায় গায়ত্রী রাইয়ের পরিতুষ্ট মুখ। কিন্তু সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ফ্রেন্ড-এর এমন কাজ নিয়ে ডুবে থাকা তার মেয়ের পছন্দ নয়। ফাঁক পেলেই তাড়া দেয়, মা তোমাকে ড্রাইভিং শিখে নিতে বলেছে, সেটা কবে হবে? না কি ভয় ধরেছে?

জিপ এখন বাপীর জিম্মায়। কিন্তু ড্রাইভার নিয়ে ঊর্মিলার মিরিকে যাবার সাহস নেই। মা সক্কলের থেকে কথা বার করে নিতে ওস্তাদ। বিশ্বাস কেবল ফ্রেন্ডকে।

জিপ হাতে আসার পরদিন থেকেই খুব ভোরে বাদশাকে নিয়ে ড্রাইভিং শেখা শুরু হয়ে গেছে, ঊর্মিলার তা জানার কথা নয়। কারণ ওর দিন শুরু তারও তিন ঘণ্টা বাদে। সকালের আলো পরিষ্কার হবার সঙ্গে সঙ্গে বাদশা জিপ নিয়ে আসে। ঘণ্টা দুই মহড়ার পরে চলে যায়। ফাঁকা রাস্তা, এরই মধ্যে হাত বেশ পাকা হয়েছে বাপীর। শুধু জিপ নয়, এক দিন ভ্যান নিয়েও বেরোয়। বাদশা বলেছে এই ভ্যানের গীয়ার আর মোটর গাড়ির গীয়ারে কোনো তফাৎ নেই। তাই ভ্যানে হাত পাকা হলে মোটরও চালাতে পারবে।

ঊর্মিলার ড্রাইভিং শেখার তাগিদে একটা আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছিল বাপী।— দেখাশোনার ব্যাপার তো দিব্বি চলছে, ড্রাইভিং শেখার পর দলে টেনে মাঝখান থেকে আমাকে ফাঁসাতে চাও কেন?

জলের মাছ খপ করে ডাঙায় তোলা হয়েছে।—তুমি জানলে কি করে?

বাপী স্বীকার করেছে, জানত না, এইবার জানল।

চালাকির ফাঁদে পড়ে ঊর্মিলা শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছে, ডিসেম্বরের এই ছাব্বিশ-সাতাশ দিনের মধ্যে দু’দিন মাত্র দেখা হয়েছে। ওর চিঠি পেয়ে বিজয় এসেছিল। সামনের সপ্তাহে আবার আসার কথা আছে।

রেশমা তার ঘর ছেড়ে দেয়?

—ধেৎ! চিঠিতে আমিই এক-একদিন এক-এক জায়গায় ওকে আসতে বলে দিই।

সামনের মাসের শেষে কত দূরে চলে যাচ্ছে, দু’জনেরই ওদের নাকি ভয়ঙ্কর মন খারাপ।

—তোমার সঙ্গে এখন তাহলে ঝগড়া করছে না?

—না। আর ঝগড়া করে কি করবে।

—ছেলেটা বোকা দেখছি। বাপীর গম্ভীর মন্তব্য।

—কেন?

—ঝগড়া করলে তো ওর বেশি লাভ হয়।

ইঙ্গিত বুঝে মুখ লাল করে ঊর্মিলা তেড়ে এসেছে।

জানুয়ারির গোড়ায় শিলিগুড়িতে ড্রাইভিং টেস্ট দিয়ে লাইসেন্স পকেটে করে বাপী নিজেই জিপ ড্রাইভ করে গায়ত্রী রাইয়ের বাংলোয় এসে ঢুকেছে। মা মেয়ে অবাক যেমন, খুশিও তেমনি। বাপী ঊর্মিলাকে প্রস্তাব দিল, চলো তোমাকে ঘুরিয়ে আনি একটু। স্বচক্ষে লাইসেন্স দেখেও ঊর্মিলার ভয়। —নিয়ে গিয়ে শেষে মারবে না তো!

খানিক বাদে ডবল আনন্দ।—দিব্বি পাকা হাত হয়ে গেছে দেখি যে—অ্যাঁ?

এরপর রোজই প্রায় মিরিকে নিয়ে যাবার বায়না ওর। এই বিপাকে পড়তে হবে বাপী জানত। কাজের অজুহাতে আজ নয় কাল নয় করে ক’টা দিন কাটিয়ে দিয়েছে। ঊর্মিলা শেষে রেগেই গেল। দু’দিন বাদে কোথায় কত দূরে চলে যাচ্ছে ছেলেটা অথচ ফ্রেন্ডের এতটুকু গা নেই।

শেষে নিয়ে গেল একদিন। মেয়ে তার সঙ্গে বেরুলে গায়ত্রী রাই কিছু বলে না, কোথায় যাচ্ছে তাও খোঁজ করে না। তাইতেই তলায় তলায় বাপীর আরো অস্বস্তি। মহিলার হাবভাব স্পষ্ট, দায় তোমার, তুমি বোঝো। ওদিকে ঊর্মিলার কথাতেই বিজয় মেহেরারও ওর ওপর অগাধ বিশ্বাস, সেও তাকে সত্যিকারের ফ্রেন্ড ভাবে। তার সামনেই ওদের বোঝাপড়া শুনল। মাঝে একদিন বিজয় বানারজুলি আসবে। আর তার কলকাতায় রওনা হবার আগের দিন ঊর্মিলা আবার মিরিকে আসবে বাপীকে নিয়ে। কলকাতা থেকে লন্ডন রওনা হবার আগে এ-যাত্রায় সেটাই শেষ দেখা। বাপীর সায় না দিয়ে উপায় নেই। কথা দিল নিয়ে আসবে।

কথার খেলাপ করল না। বাপীর আপিসের সময়—ঊর্মিলাও খেয়েদেয়ে প্রস্তুত। মাকে জানিয়েছে বাপীর সঙ্গে এক জায়গায় যাচ্ছে, ফিরতে দেরি হতে পারে। গায়ত্রী রাই এবারও কিছু জিগ্যেস করেনি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একসঙ্গে দু’জনে রওনা হতে দেখেছে।

বাপী ওকে মিরিকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসেছে। আবার কথামতো বিকেলে গিয়ে নিয়ে এসেছে। মেয়ের মুখ শুকনো। চোখ লাল। কান্নাকাটিও করেছে বোধ হয়। বিজয় মেহেরার বিষণ্ণ মুখ। বাপীকেই জিজ্ঞাসা করল, বিলেত থেকে চিঠি পাঠালে কোন্ ঠিকানায় পাঠাবে। বাপীর ভেতরটা সত্যি সদয়। ভেবে-চিন্তে বলেছে, লন্ডনের ঠিকানা দিয়ে প্রথম চিঠি আমার নামে পাঠাও। পিছনে তোমার নাম দেখলে ওকে দিয়ে দেব। তারপর কোন ঠিকানায় লিখবে ঠিক করে ডলিই তোমাকে জানাবে।

সেই সন্ধ্যাতেই গায়ত্রী রাই ওর বাংলোয় এলো। যেমন গম্ভীর তেমনি ঠাণ্ডা।—মিরিকে গেছলে?

সাদা মুখ করে বাপী জবাব দিল, হ্যাঁ।

এতক্ষণ পর্যন্ত তুমি ওদের সঙ্গে ছিলে?

এবারেও বাপী সত্যি জবাব দিল।—না, ডলিকে ছেড়ে এসে আবার বিকেলে গিয়ে নিয়ে এসেছি।

গলার স্বর ঈষৎ কঠিন। —কাজটা ভালো করলে?

—তা না হলে অশান্তি হত। তিন বছর ধরেই আক্রোশ পুষত।

যুক্তি অগ্রাহ্য করতে পারল না। আবার ঠাণ্ডা।—সেই ছেলে কবে রওনা হচ্ছে?

—কাল ভোরে।

ঠিক আছে। এবার থেকে তোমার চেষ্টা তুমি করো।

চলে গেল। একরাশ অস্বস্তি যেন সঙ্গে সঙ্গে হেঁকে ধরল বাপীকে। যা বলল তার সাদা অর্থ, মেয়ের মন থেকে এবারে আস্তে আস্তে ওই ছেলেকে হটাতে চেষ্টা করো। অস্বস্তি। ভিতরে অনাগত কোনো আশঙ্কার ছায়া।

কিন্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসৎ বাপীর সত্যি নেই। সমস্ত ফেব্রুয়ারি মাসটা জলপাইগুড়ি পশ্চিম দিনাজপুর মালদহ কুচবিহার আর দ্বারভাঙার বড় ঘাঁটিগুলিতে ঘুরেছে। আগে রণজিৎ চালিহা আসাম সফরে বেরুলে গায়ত্রী রাই দু’পাঁচ দিনের জন্য বেরিয়ে কিছুটা ঠেকা কাজ চালিয়ে দিত। কিন্তু নগদ বিনিময়ে কালো মাল অর্থাৎ বাড়তি মাল লেন-দেনের ব্যাপারে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যেত না। চালিহার অনুপস্থিতিতে মাল ঠিক-ঠিকই যেত, লেন-দেনের ফয়সলা সে ফিরে এলে হত। কাজে নামার পর বাপী এই দায়িত্ব হাতছাড়া হবার দরুন রণজিৎ চালিহার খেদের কারণ বুঝেছে। কেউ যদি মাথা খাটিয়ে এই লাভের ওপর বড়সড় থাবা বসাতে চায় এমন মওকা আর হয় না। গায়ত্রী রাইয়ের বিশেষ নির্দেশে সর্বত্র সব থেকে বড় হোটেলে থেকেছে, শাঁসালো মক্কেলদের ডিনার—লাঞ্চে ডেকেছে, মাটিতে পা ফেলেনি, ট্যাক্সি বা মক্কেলের গাড়িতে ঘুরেছে। ফার্মের সুনাম তো বটেই, কিছুটা নিরাপত্তার কারণেও এই চালে থাকার রীতি। যদিও দেশভাগের এই দু’ বছরের মধ্যে কড়াকড়ির রক্তচক্ষু কোথাও তেমন দেখা যেত না।

একটা মাস নানা ঘাঁটিতে ঘুরে দফায় দফায় সর্বসাকুল্যে তেরো হাজার হিসেবের আর চৌত্রিশ হাজার হিসেবের বাইরের টাকা গায়ত্রী রাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে। মহিলা মুখে কিছু বলেনি, কিন্তু বাপী অনায়াসে আঁচ করতে পেরেছে, সুড়ঙ্গপথের টাকার অঙ্কটা এবারে বেশি। এদিকের সফর শেষে সেই চৌত্রিশ হাজার টাকা থেকে গায়ত্রী রাই হিসেব করে পাঁচ হাজার একশ টাকাটা বাপীর হাতে তুলে দিল। এ নাকি তার প্রাপ্য। এ-টাকার পনের পারসেন্ট চালিহা পেত। বাপীও তাই পাচ্ছে। ঠাণ্ডা মুখে সতর্কও করে দিল, বোকার মতো এর সব টাকা আবার এখানকার ব্যাঙ্কে রাখতে যেও না।

ভাগ-বাঁটোয়ারার এদিকটা বাপীর জানা ছিল না। মাথায় হিসেব ঢুকলে তার নিষ্পত্তির দিকে ঝুঁকবেই। সব খরচ-খরচা বাদ দিলে ওই চৌত্রিশ হাজারের অর্ধেক অন্তত ছাঁকা লাভ। সতের হাজার টাকার মধ্যে পাঁচ হাজার একশ এলো বাপীর ভাগে। মহিলার ছাঁকা লাভের ভাগ তাহলে এগারো হাজার ন’শ টাকা? শুধু এই নয়, ব্যবসার আরো কত দিক আছে। এতদিন ধরে মোটামুটি এই হারে টাকা পেয়ে এসে থাকলে তার কত টাকা? ওকে সতর্ক করা হল, কিন্তু নিজে এত টাকা রাখছে কোথায়? দেশের বাইরে অর্থাৎ নেপাল ভুটান বা সিকিমে অবশ্যই তার পক্ষে মোটা টাকা সরিয়ে রাখা সম্ভব। আর এদিকেও হয়তো নানা জায়গার ব্যাঙ্কে টাকা ছড়ানো আছে। তবু আনুমানিক হিসেবের মধ্যে ঢোকার ফলে বাপীর ধারণা, ব্যাঙ্কে ঠাঁই হয়নি এমন বহু টাকাও মহিলার কাছে মজুত আছে।

পরের মাসের সফর ভুটান সিকিম নেপাল। ফাঁক পেলে এসব জায়গায় গায়ত্রী রাই, নিজেই গিয়ে থাকে। কাজকর্মের ব্যাপারে এসব এলাকায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের প্রতিপত্তি বেশি। কাজের সুবিধের জন্য এর প্রতিটি জায়গায় একজন দু’জন করে মেয়ে এজেন্টও আছে। তাছাড়া এসব এলাকায় তেমন বড় ঘাঁটি বলতে কিছু নেই, খুচরো কারবারের টান প্রচুর। ছেলেদের থেকে এ-ব্যাপারে মেয়েরাই বেশি নির্ভরযোগ্য। গায়ত্রী রাই এবারে এলো না। শরীরটা খুব ভালো নেই বলল। বানারজুলির চা-বাগানের ডাক্তারের আনাগোনাও দেখেছে এক—আধবার। ঊর্মিলার মুখে শুনেছে মায়ের মাঝে মাঝে কেমন শ্বাসকষ্ট হয়। তবে ডাক্তার বলেছে বিশেষ কিছু না।

কিন্তু মহিলার প্ল্যান সাফ। যে কারণ দেখিয়ে রণজিৎ চালিহা রেশমাকে আসামে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, সেই কারণেই ওকে এবারে বাপীর সঙ্গে পাঠিয়ে দিল। আবার সাপ ধরার সময় এসেছে। অনেক লোক আছে এজন্যে, দু’চার মাস ও না থাকলে সত্যি এমন আর কি অসুবিধে। রোজগার যখন ডবলের বেশি, রেশমাও নতুন কাজে ভিড়তে এক পায়ে তৈরি। বাপী আর রেশমার সঙ্গে সেখানকার এজেন্টদের যোগাযোগের ব্যবস্থা ঝগড়ু করে দেবে। পাহাড়ের বাংলো থেকে তাদের কাছে খুচরো মাল চালান রেশমার মারফৎ ভালো হবে। আর ওসব জায়গা থেকে বাছাই মদ রেশমাই বাংলোয় এনে তুলবে। ঝগডু তাকে শিখিয়ে—পড়িয়ে নেবে। জিপে হোক ভ্যানে হোক দরকার মতো রেশমাই সে-সব বানারজুলিতে নিয়ে আসবে। আবু রব্বানীর মারফৎ সেসব চা-বাগানের ক্লাবে বা অন্যত্র চালান দেওয়া হবে। বাপীর শুধু তদারকের ভার।

রেশমা সঙ্গে চলল দেখে ঊর্মিলার জিভ সুড়সুড় করে উঠেছে। কপট উদ্বেগে মুখ মচকে ছুবলোতে ছাড়েনি।—ওই পাজী মেয়ের তো তোমার ওপর এত ভক্তি এখন যে সুযোগ পেলে জিভে করে পা চাটে—মা যে কি ফ্যাসাদের দিকে ঠেলে দিল তোমাকে কে জানে। ওদিকে দুলারির মতো গম্ভীর মেয়ে পর্যন্ত মুখ টিপে হেসেছে। বলেছে, যাবার আনন্দে রেশমা হাত-পা তুলে নাচছে—আমি অবশ্য সাবধান করে দিয়েছি বেশি নাচানাচি করলে বাপীভাই ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে।

ঠাট্টা ঠাট্টাই। বাপী তবু অস্বস্তিই বোধ করেছে। নিজেকেই সব থেকে কম বিশ্বাস করে, তাই অস্বস্তি। তাছাড়া ঊর্মিলা বাড়িয়ে বলেনি খুব। সমস্ত দুর্যোগ কাটিয়ে উঠে ভাগ্যের এই মুখ দেখার ফলে ওই সাপ-ধরা মেয়ের চোখে বাপীভাই সত্যিকারের দিলের মানুষ আর অবাক মানুষ এখন। কিন্তু তা বলে জঙ্গলের বেপরোয়া মেয়ের স্বভাবসুলভ উচ্ছলতা যাবে কোথায়? আর, চালিহার মতো ভদ্রসমাজের দাপটের পুরুষেরও দুর্বলতার খবর রাখে যে মেয়ে, তার বুকের পাটাই বা কম হবে কেন? ভক্তিশ্রদ্ধা করতে পারে কিন্তু শাসনের পরোয়া করা ওর ধাতে নেই।

পাহাড়ে পৌঁছুনোর আগেই শাসন নাকচ শুরু। বাপী জিপ চালাচ্ছে। রেশমা পিছনে। হঠাৎ ডেকে বলল, বাপীভাই, গাড়িটা থামাও তো একটু—

ব্রেক কষে বাপী ঘুরে তাকালো।—কেন?

না বুঝে বাপী জীপ থামাতে চোখে পলকে নেমে সামনের দরজা খুলে পাশে বসল।—চলো। তুমি দিব্বি সব দেখতে দেখতে যাবে আর আমি খুপরির মধ্যে বসে থাকব!

বাপী সত্যি বিরক্ত।—এটা ভালো দেখাবে না, নেমে যাও।

রেশমার অবাক মুখ।—তুমি তো ওই উঁচু পাহাড়ের মতো মাথা-উঁচু মুরুব্বী আমাদেরকে কি ভাববে? তারপরেই চোখের কোণে হাসির ছুরি।—আচ্ছা পাহাড়ের কাছে এসে নেমে যাব’খন, চলো।

পাহাড়ের নিচে পৌঁছে বাপী আবার জীপ থামিয়েছে। মুখে কিছু না বলে তাকিয়েছে শুধু। গোমড়া মুখ করে রেশমা নেমে পিছনে গিয়ে বসেছে। তারপর কথা শুনিয়েছে, আবু সাহেব একবার হিসেব করেছিল বয়সে আমি তোমার থেকে প্রায় দু’ বছরের বড়, বুঝলে? কেউ কিছু ভাববে না হাতি, আসলে এত বড় মুরুব্বী হয়ে তোমার মান বেড়েছে।

নতুন কাজে উৎসাহের অন্ত নেই রেশমার। এ-বেলায় কোনরকম চপলতা ছিটেফোঁটাও নেই। মুখ বুজে উপদেশ শুনেছে, নির্দেশ মেনেছে। কোন্ মাল কোথায় কিভাবে দিয়ে আসতে হবে,আর কোন্ জিনিস ঘরে এনে তুলতে হবে— ঝগড়ু আর মেয়ে এজেন্টদের কাছ থেকে তাও বুঝে নিতে সময় লাগেনি। পনের দিনের মধ্যে ঝগড়ু বা বাপীকে আর সঙ্গেও যেতে হয়নি। এজেন্টদের কাছ থেকে বাপী টাকার হিসেব আর মালের চাহিদা বুঝে নিয়েই খালাস। ভালো মদের বোতলও রেশমা সংগ্রহ করতে শিখছে।

খুশির পরব ঝড়ুর। দিলদার বাপী-ভাইয়ের কল্যাণে সাহেবসুবোদের ভোগের সেরা মাল পেটে পড়ছে। তাছাড়া ওর চোখে রেশমার মতো মেয়ে হয় না। একদিন একঘণ্টা সাপের বিষ বার করতে দেখেই, খপ করে একটা বিষাক্ত সাপের চুঁটি টিপে ধরে এনে নির্ভয়ে ওর মতো করেই গলগল করে বিষ বার করে এনেছে। সাহস দেখে ঝগড়ু যেমন তাজ্জব, তেমনি খুশি। বার বার বলেছে, তোর কথা আবুর মুখে শুনেছি, কিন্তু এমন ডাকাত মেয়ে তুই ভাবিনি। চাকর-বাকরদের আউট-হাউসে ওকে থাকতে দেয়নি, বাংলোর ভিতরেই একটা স্টোর-রুম খালি করে দিয়েছে। পাশাপাশি ওইরকম আর একটা ঘরে নিজে থাকে। বয়েস সত্তর ছাড়িয়েছে, সঙ্কোচের বালাই নেই। বেশি বয়সে পাওয়া নিজের আদরের ছোট মেয়ের সঙ্গে খুশি-উপচনো সম্পর্কের মতো

বাংলোয় অনেক রকমের লোক আসে। কাজ করে। আউটহাউসে থাকেও কেউ কেউ। এই মেয়ের দিকে চোখ পড়বে জানা কথাই। কিন্তু বাপী নিশ্চিন্ত ঝগড়ুর ভয়ে কেউ কখনো ধারে কাছে ঘেঁষবে না।

কিন্তু অস্বস্তি নিজেকে নিয়েই। অবসর সময় পাহাড়ে জঙ্গলে ঘোরাটা নেশার মতো। রেশমাও তখন সঙ্গ নেবেই। হাসবে, হৈ-চৈ করবে। জঙ্গল ওরও কম প্রিয় নয়। এদিকে বসন্তকাল। বনের সর্বত্র রূপের ঢেউ। অশোক পলাশে রঙের বাহার। শিমুল কৃষ্ণচূড়ার মাথা লালে লাল। বাপী বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। পালিয়ে আসে। নিজেকেই ভয়। মেয়েটা তাও বুঝতে পারে কি না কে জানে। রাতে ঝগড়ুর হাত ধরে বাগানে বেড়ায়। ফুলের গন্ধ আর বাতাসের ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। পাহাড়ের কোন্ গাছে কোকিলের গলা চড়ে। স্বর নকল করে থেকে থেকে রেশমাও ভেঙচে ওঠে। হাসে খিলখিল করে। বাপী নিঃশব্দে বারান্দা থেকেও সরে আসে।

তিন সপ্তাহ বাদে বাপী একলা ফিরতে পেরে হাঁফ ফেলে বেঁচেছে। ভ্যান পাঠিয়ে মালপত্রসহ রেশমাকে আনানো হয়েছে আরো পনের দিন পরে। প্রথম বারেই কর্ত্রীর চোখে কাজের মেয়ে হয়ে উঠতে পেরেছে এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি আছেই। এখানে থাকলে সাপ ধরার কাজ, আর পাহাড়ে গেলে চারগুণ পয়সার কাজ। ভাগ্যের এমন টইটম্বুর দশায় কে না খোশমেজাজে থাকে। কিন্তু আবুর ডেরায় বাপীভাইকে দেখে ত্রাসের মুখ তার। আবুকে ছেড়ে দুলারির দিকে চেয়ে বলেছে, কর্তা-মানুষ সঙ্গে থাকলে কত মুশকিল জানো না ভাবী—ভয়ে সৰ্ব্বোক্ষণ বুক ঢিপ-টিপ। পাহাড়গুলোকেও ঢের নরম মনে হয়েছে সে-সময়।

আবু মুখ টিপে হেসেছে। আর পলকা ধমকের সুরে দুলারি বলেছে, তুই যেমন পাজী, তোকে ঢিট করতে বাপীভাইই ঠিক লোক।

রেশমা ভালো মুখ করে চোখের কোণে তাকিয়েছে। এই পরিবেশেও অতটা সহজ হওয়া গেল না বলে মনে মনে বাপী নিজের ওপরেই বিরক্ত।

.

রণজিৎ চালিহা ফিরল চার মাস বাদে। দেরি হবে গায়ত্রী রাই বলেছিল। বাপীর অনুমান, এত দেরি হবার পিছনে মহিলার কারসাজি আছে। চিঠি তো হামেশাই লিখেছে। বাড়তি কাজে আটকে রাখা কঠিন কিছু নয়। সে ফেরার পরেও গায়ত্রী রাইয়ের সতর্ক পদক্ষেপ। বুঝতে অসুবিধে হয়নি বাপীর। শরীর ভালো যাচ্ছে না বলে চালিহার সামনেই ওকে নিজের বাংলোর আপিস ঘরটা ব্যবহার করতে হুকুম করেছে। কারণ, মিস্টার চালিহার ঘর তো এখন তাকে ছেড়ে দিতেই হবে।

চালিহা ফিরে এলে তার কাজ তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে কিনা বাপী ভেবে পাচ্ছিল না। কিন্তু সে আসার পর দেখা গেল দায়িত্বের কাজ ভালোভাবে চালিয়ে যাবার জন্য একলাফে দেড়শ টাকা মাইনে বেড়েছে বাপীর। মালিকের ইচ্ছেয় চিফ একজিকিউটিভকে এখন আরো বড় দায়িত্ব নিতে হবে। বিহার আর মধ্যপ্রদেশের বাজার দখলে আনতে হবে এবার। বাপী তরফদারের তদারকের আগের তৈরি ঘাঁটিগুলো থেকে যে টাকা আসবে তার থেকে পাঁচ পারসেন্ট কমিশন চালিহাকে দেওয়া হবে। আর মধ্যপ্রদেশ বা বিহারে যে-সব ঘাঁটি হবে তার থেকে পাবে কুড়ি পারসেন্ট। তার আসামের প্রাপ্যও পনের থেকে কুড়ি পারসেন্ট তুলে দিল গায়ত্রী রাই। এক কথায় আরো বড় দায়িত্ব, আরো বেশি স্বীকৃতি। কিন্তু লোকটা নির্বোধ নয় আদৌ। বাপী তরফদার সেভাবে সামনে এগিয়ে আসার আগেই সে সতর্ক হতে চেয়েছিল। বাপী নিঃসংশয়, এখন এই পরিস্থিতি দেখে সে আরো সন্দিগ্ধ, আরো সতর্ক। তার বাইরের আচরণ স্নেহভাজন সতীর্থের মতো। কিন্তু দেখতে জানলে মানুষের চোখের আয়নার ভেতর দেখা যায়। অমায়িক হাসির ফাঁকে ওই দুটো চোখে ক্রূর আক্রোশের ঝিলিক দেখেছে।

এরই মধ্যে দিন দশেকের জন্য আর এক দফা পাহাড়ের বাংলোয় পাঠানো হল রেশমাকে। আগের বারে বাপীর সঙ্গে গিয়ে ও কত ভালো কাজ করেছে, গায়ত্ৰী রাই চালিহার কাছে সেই গল্পও করেছে। খুশিমুখে চালিহা বলেছে, মেয়েটা যে চালাকচতুর খুব এ তো সে-ই সবার আগে বুঝেছিল। কিন্তু এই খুশীর বিপরীত কিছু আঁচ করতে বাপীর অসুবিধে হয়নি। গায়ত্রী রাইয়ের সামনেই তেমনি হাসিমুখে অন্তরঙ্গ ঠাট্টা করেছে। বাপীকে বলেছে, কিন্তু তুমি ইয়ংম্যান একটু সাবধান, সাপ-ধরা মেয়ের জালে পড়ো না যেন। নিজের রসিকতায় নিজেই বেশি হেসেছে।

গায়ত্রী রাই কিছু বলেনি বাপীকে কিন্তু রেশমা ফিরে আসার পর আবু চুপি চুপি তাকে জানিয়েছে, ম্যানেজার এর মধ্যে একদিন পাহাড়ের বাংলোয় গেছল, রাতে ছিলও। মেমসায়েবকে নাকি জানিয়েই গেছে। ভালো মদ চেনানো আর তার ঘাঁটির সন্ধান দেবার ব্যাপারে রণজিৎ চালিহা যে এক্সপার্ট একজন এ কেউ অস্বীকার করবে না। তা ছাড়া এ-সব জিনিস সরবরাহ করার মতো চেনা-জানা লোকও আছে। রেশমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। রাতে নিজে মদের বোতল খুলে বসে গল্প করার জন্য রেশমার খোঁজও করেছিল নাকি। তাকে ডাকতে গিয়ে ফিরে এসে ঝগড়ুই খবর দিয়েছে, সমস্ত দিনের পরিশ্রমে মেয়েটা এরই মধ্যে ঘুমিয়ে কাদা।

এই একজনের সঙ্গে চূড়ান্ত ফয়সলার দিন আসবেই। কিন্তু সেটা কোন্ ভবিষ্যতে হবে বা কেমন করে হবে, বাপী ভেবে পায় না। তার ধারণা, গায়ত্ৰী রাইও এখন পর্যন্ত অন্ধকারে পথ হাতড়ে বেড়াচ্ছে। পাচ্ছে না বলেই আপাতত যতটা সম্ভব তাকে দূরে রাখার চেষ্টা।

মহিলা হঠাৎ বেশ অসুস্থই হয়ে পড়ল। একই ব্যাপার। নিঃশ্বাস নিতে ফেলতে অসুবিধে। অসুবিধেটা বেড়ে গেল হঠাৎ। সাদা মুখ বেশি ফ্যাকাশে। কাউকে কিছু না বলে বাপী নিজেই ভ্যান হাঁকিয়ে শিলিগুড়ি চলে গেল। তিনগুণ ফি কবুল করে সেখানকার সব থেকে বড় ডাক্তার নিয়ে এলো। তার রায়, হার্টের একটা ভাল ড্যামেজ হয়েছে। তেমন সাংঘাতিক না হলেও ব্যাপারটা ভালো না। বিশ্রামের ওপর থাকতে হবে, কোনো ভারী জিনিস টানা চলবে না। নিঃসংশয় হবার জন্য এক্সরে আর ই. সি. জি. করানো হল। চা-বাগানের হাসপাতালে এসবের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বাপী বিছানা ছেড়ে গায়ত্রী রাইকে নড়তে দিল না। চারগুণ খরচ করে বাড়িতে এনে সেসব করানো হল।

এত ঘটা আর টাকার শ্রাদ্ধ দেখে গায়ত্রী রাই রেগেই গেল বাপীর ওপর।— সামান্য ব্যাপারে এত হৈ-চৈ করার দরকার কি? টাকা কি খোলামকুচি নাকি?

মুখের ওপর বাপীর সাদাসাপ্টা জবাব, আপনার কিছু হলে খোলামকুচি। একটু সুস্থ হতে কত খরচ হয়েছে জিগ্যেস করতে বাপী বলেছে, খরচ আবার কি—

—আঃ! বিরক্ত।—তোমার টাকায় আমার চিকিৎসা হবে?

—তাই যদি মনে করেন তাহলে আজ থেকে আমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও আমি নিজেই করে নেব, আমি কার জন্যে কি করেছি বললে ডলি এরপর তেলের ঠেস দেবে!

খুশি মুখে ঊর্মিলা বলল, কেমন সেয়ানা দেখো মা, আগে থাকতে আমার মুখ মেরে দিলে।

মহিলার মুখে আবার সেই কমনীয় শ্রী দেখল বাপী যা খুব বেশি দেখা যায় না। চেয়ে রইল খানিক। ওর দিকে। মেয়ের দিকেও। সঙ্গে সঙ্গে বাপীর বুকের তলায় সেই অজানা আশঙ্কার ছায়া।

ঊর্মিলা পড়াশুনা শুরু করেছে বটে, কিন্তু তেমন মন বসেনি। ওর বিলেতের চিঠি এখন চা-বাগানের ক্লাবের ঠিকানায় আসছে। ভেবে-চিন্তে বাপী এর থেকে ভালো ব্যবস্থা কিছু করতে পারেনি। আপিসে ওর ঠিকানায় এলে রণজিৎ চালিহার হাতে পড়তে পারেই। ডাটাবাবু বাপীর হাতের মুঠোর লোক এখন। খামের ওপর লেখা থাকে, ডলি। ডলি কে, ডাটাবাবুর জানার কথা নয়। চিঠির খবর কেউ জানবে না এও সে ডাটাবাবুকে বেশ স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছে। গোপন থাকবে বলেই বিশ্বাস। কারণ ডাটাবাবু সর্বদা খাস লোকের দাস। খাস লোক যে এখন কে আবু রব্বানী ডাটাবাবুকে সেটা ভালো করেই জানিয়ে দিয়েছে।

সেই দিনই সকালে বাপী ঊর্মিলার হাতে বিজয় মেহেরার চিঠি দিয়েছিল। সন্ধের দিকে আনন্দে ডগমগ মুখে সে হাজির হতে বাপী নির্লিপ্ত মুখে জিগ্যেস করল, খুব সুখবর।

—দারুণ! তুমি শোনোনি?

—কি শুনব? বাপী অবাক একটু।

—বনমায়া পালিয়েছে। রেশমার মুখে শুনেছি একটা বুনো হাতির ডাকে ও ফি বছর একবার করে পালায়—আবার নিজেই ফিরে আসে। তুমি তো সব জানো, বলো না!

বাপী হেসে জবাব দিল, এটা কোনো খবর নয় এখন। সবাই জানে ও পালাবে। ফিরেও আসবে।

ঊর্মিলার তবু বনমায়ার গল্প শোনার লোভ। এমন দুর্বার প্রেমিকা যেন ওর কাছের কেউ। কিন্তু বাপীর ততো আগ্রহ নেই।…একজনকে ঘটা করে বনমায়ার গল্প শোনাতো মনে আছে। আট বছর বাদেও সেই একজন ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বনমায়ার খবর কি?

এর দিন দশেক বাদে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাপী সকালে ভ্যান নিয়ে শিলিগুড়ি চলে এসেছিল। ভ্যান এখন ওর হেপাজতে। আসল কারণ, আগের দিনের কাগজে খবর দেখেছে বি.এ. পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। বানারজুলিতে গেজেট পাবে কোথায়? তাই শিলিগুড়িতে বি.এ.-র ইতিহাসের রেজাল্ট দেখে গেজেটটাকেই আছড়ে ফেলতে ইচ্ছে করল বাপীর। ফার্স্ট ক্লাস তিনজন পেয়েছে। তার মধ্যে মালবিকা নন্দীর নাম নেই। ও সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে। মিষ্টির ওপর আর সেই সঙ্গে আর একজনের ওপরে রাগ বাপীর। সাতাশি নম্বরের উল্টো দিকের বাড়ির সেই সোনার চশমা রাঙামুখো ছেলেটার ওপর। যার নাম অসিতদা। পরীক্ষার এই রেজাল্ট হবে না তো কি, আরো প্রেম করোগে যাও!

পরে অবশ্য অত খারাপ লাগেনি। মেয়ের গুমোর কিছু কমবে।…এরই মধ্যে প্রায় দেড়টা বছর কেটে গেল। ওর সঙ্গে দেখা হবার পরের প্রতিটি খুঁটিনাটি চোখে ভাসছে। যেন সেদিনের কথা।

ফেরার সময় অন্যমনস্ক ছিল। চা-বাগানের এলাকা পেরিয়ে লছমন মাহুতের ডেরার কাছে আসতে বিষম চমকে উঠল। যে গাছের গুঁড়িতে বনমায়া বাঁধা থাকত সেখানে অনেক মেয়েপুরুষের ভিড়। সব গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছে তারা!

বিপদের গন্ধ বাতাসে ছোটে। একটা অশুভ চিন্তা বুকে হাতুড়ির ঘা বসালো। ভ্যান থামিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এলো।

…এত লোক ঘিরে দাঁড়িয়ে বনমায়াকে দেখছে কেন?

বনমায়া মাটিতে শুয়ে আছে কাত হয়ে। অত বড় শরীরের দু’তিন জায়গায় দগদগে ঘা। দুর্গন্ধ নাকে আসছে। পাহাড়ের মতো শরীরটা নিথর। যত বড় করে সম্ভব চোখ চেয়ে আছে। জল গড়াচ্ছে। মৃত্যু ওর চোখের দিকে এগিয়ে আসছে।

বাপীর বুকের ভেতরটা পাথর হঠাৎ! আবু কাঁদছে। আরো বেশি কাঁদছে লছমন। রেশমারও চোখ ছলছল। ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে আছে, সক্কলের মুখ বিষাদে কালো।

কি ঘটেছে, সঠিক কেউ জানে না। কিন্তু অনুমান করা আদৌ কঠিন নয়। দলছুট বুনো পাগলা হাতি মারা নিষেধ নয়। কারণ একটা পাগলা মরদ হাতি একটা বিশাল এলাকার সর্বনাশের কারণ হতে পারে। কিন্তু অতি দামী দাঁতের লোভে পাগল না হলেও বুনো মরদ হাতি সময় সময় শয়তানের শিকার হয়ে বসে। দৈবাৎ দল-ছুট এরকম হাতি মারা হয়ে গেলে সেটাই ঢ্যাড়া অনুযায়ী পাগলা ছিল কিনা কে বলবে। তখন পাগল বললেই পাগল। এবারেও বনমায়ার সঙ্গী মরদ হাতিটাকে কেউ কেউ দেখেছে। তার অতিকায় দুটো দাঁত। লোভী শিকারীর ওটাই লক্ষ্য ছিল তাতে কারো সন্দেহ নেই। নিঃশব্দে এই শিকারের সব থেকে সহজ উপায় দলে তীর-ধনুক-অলা জংলি জুটিয়ে নেওয়া। তীরের ফলায় ‘নিং-দিউদ’ আর গন্-চং নামে গাছের শিকড়ের অমোঘ মারাত্মক বিষ মেশানো থাকে। বিষক্রিয়ার ফলে যত বিশাল দেহ হোক পচন ধরতে সময় লাগে না। তীর-ধনু—অলা লোককে বুনো হাতিরাও যমের মতো ভয় করে। বনমায়ার দেহে তিনটে বিষাক্ত তীরের ক্ষত

মানুষের কাছে ছিল। দেহটাকে টেনেহিঁচড়ে মানুষের কাছেই নিয়ে এসেছে।

আবুর বদ্ধ ধারণা, লোভী শিকারীর হাত থেকে দাঁতাল মরদের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বনমায়ার এই হাল। ও তাকে না আগলালে নিশানার এত বড় ভুল হতে পারে না। পারেই না। বনমায়ার গায়ে আঁচড় পড়ারও কথা নয়।

বাপী আস্তে আস্তে বনমায়ার মুখের সামনে এসে দাঁড়াল। ও চোখ টান করে দেখল। চিনল। জল গড়াচ্ছে। কাত হয়ে শোয়া অবস্থাতেই শুঁড়টা মাটি ঘষটে মাথার কাছে বেঁকিয়ে নিয়ে এলো। সেলাম করল।

বাপী পালিয়ে এলো।

সন্ধ্যার মধ্যে খবর পেল সব শেষ। বনমায়া ছিল। বানারজুলির বাতাসে প্রেম ছিল। বনমায়া নেই। প্রেম শরবিদ্ধ। নিহত। আবু কেঁদেছে। লছমন কেঁদেছে। রেশমা কেঁদেছে। বনমায়াকে যারা জানে তারাই কেঁদেছে। বাপী কাঁদতে পারে না। এও এক অভিশাপ। একটা শুকনো যন্ত্রণা শুধু ভিতরটাকে কুরে খাচ্ছে।

দু’দিন বাদে কলকাতায় একটা টেলিগ্রাম পাঠালো। ওটা পারে মালবিকা নন্দী। মিষ্টি নন্দী লিখেও কেটে মালবিকা নন্দী করেছে। ওতে এক শব্দে পাশে অভিনন্দন। আর, দু’শব্দর একটা খবর।— কনগ্র্যাচুলেশনস। বনমায়া কিল্ড।’

মাঝে একদিন বাদ দিয়ে টেলিগ্রামেই তিন শব্দের জবাব এসেছে। ‘থ্যাঙ্কস। সরি।—মিষ্টি।’

জবাব আশা করেনি। আরো অপ্রত্যাশিত আর কিছু। মালবিকা বাতিল। লিখেছে, মিষ্টি। বাপীর জগতে মালবিকা নামের কোনো অস্তিত্ব নেই জেনেও লিখেছে?

ওর থেকে বাপী কি ভাববে? কি বুঝবে? প্রেম শরবিদ্ধ নয়? নিহত নয়?


© 2024 পুরনো বই